সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৩

নিজামীর বিরুদ্ধে ১৭ তম সাক্ষীর জেরা শেষ : রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর অশালীন মন্তব্যে ট্রাইব্যুনালে উত্তেজনা


মেহেদী হাসান, ২৬/৮/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ১৭ তম সাক্ষী জামাল উদ্দিনের জেরা আজ  শেষ হয়েছে। গত রোববার জামাল উদ্দিনের জবানবন্দী গ্রহণ শেষে জেরা শুরু হয়।
মাওলানা নিজামীর পক্ষে আইনজীবী মিজানুল ইসলাম তাকে জেরা করেন।

জেরা : (সংক্ষিপ্ত )
জেরায় আইনজীবীর প্রশ্নে সাক্ষী যে উত্তর বলেন তা নিম্নরূপ:
২০০০ সালে ডিসেম্বর মাসে করমজা গ্রাম থেকে হাড়গোড় উদ্ধারের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। যে সমস্ত লোক ঐ ঘটনা সম্পর্কে আমাদেরকে জানায় তাদের মধ্যে চতুর আলী চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধা আবু সামা এবং আরো অনেকেই ছিলেন। এই চতুর আলী চেয়ারম্যান ঐ এলাকার পিস কমিটির চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খোদা বক্সের ভাই কিনা তা আমি বলতে পারব না। আমি ঐ সময় সাথিয়া উপজেলা পরিষদ বা সাথিয়া উন্নয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলাম না। আমি ২০০৩ সালে সাথিয়া উপজেলার শান্তি শৃংখলা কমিটির সদস্য ছিলাম কিনা তা আমার মনে নাই, তবে আমি ঐ সময় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলাম। করমজা গ্রাম আমার ইউনিয়নের অন্তর্গত নয়। আমাদের গ্রাম থেকে করমজা গ্রাম আনুমানিক ১৫ কিলোমিটার দূরে। ঐ স্থানে যাওয়ার জন্য তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাঈদ সাহেবই আমাকে খবর দিয়েছিল। ১৯৭১ সাল থেকে ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসের আগ পর্যন্ত আমাকে কেউ করমজা গ্রামের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করে নাই, তবে আমি আগে থেকেই ঘটনাটি জানতাম। যেহেতু করমজা আমার ইউনিয়নের নয় তাই আমি প্রশাসনকে ঐ ঘটনাটি জানাইনি। ১৯৯১ সালে অধ্যাপক আবু সাঈদকে পরাজিত করে নিজামী সাহেব এম.পি হয়েছিলেন। তবে ঐ সময় নিজামী সাহেব জামায়াতে ইসলামীর সাধারন সম্পাদক নাকি আমীর ছিলেন তা আমি বলতে পারব না। ১৯৯৬ সালে অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেব নিজামী সাহেবকে পরাজিত করে ঐ এলাকায় এম.পি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসের হাড়গোড় উদ্ধারের ঘটনার ২/১ দিন আগে নিজামী সাহেব জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হয়েছিলেন কিনা তা আমার জানা নাই। ঐ সময় নির্বাচন সমাগত থাকলে নির্বাচনি আমেজ থাকার কথা। ২০০১ সালের নির্বাচনে নিজামী সাহেব আবু সাঈদ সাহেবকে হারিয়ে আমাদের এলাকার এম.পি নির্বাচিত হয়েছিলেন কিনা তা আমার জানা নাই। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হওয়ায় এবং ঐ এলাকায় আবু সাঈদ সাহেবের বিপক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করবেন এই আশংকায় অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেবের সাথে আমি এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারা নিজামী সাহেবের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য হাড়গোড় উদ্ধারের কল্প কাহিনী তৈরী করেছিলাম, এটা সত্য নয়।  মেঘা ঠাকুরের মেয়ে পাবনায় বসবাস করে কিনা তা আমি জানি না। মেঘা ঠাকুরের কোন আত্মীয় স্বজন ঐ এলাকায় বসবাস করেন কিনা তাও আমি জানি না।
১৯৭১ সালের জহরুল হক মাস্টারের বাড়িতে নিজামী সাহেবের নেতৃত্বে রাজাকার আলবদর ও পাক বাহিনী জহুরুল হককে ধরতে যাওয়ার ঘটনা জহুরুল হক নিজেই এই ঘটনার ২/৩ দিন পর আমাকে বলেছিল। সাথিয়া থানা এলাকায়ই আমাকে ঐ ঘটনা সম্পর্কে বলেছিল, তবে কোন স্থানে বলেছিল তাহা আমার স্মরন নাই।
রূপসী এলাকা আমাদের এলাকা থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে। আমার গ্রাম থেকে পাবনা শহর বা ধূলাউড়ি বাজারে যেতে রূপসী গ্রাম পড়ে না। আমরা সাধারনত ধূলাউড়ি বাজারে হাট বাজার করতাম। আমি যে স্কুলে পড়তাম সে স্কুলে যাওয়ার পথে রূপসী গ্রাম পড়ে না। বাউশগাড়ী এবং ডেমরা রূপসী গ্রামের পাশাপাশি অবস্থিত। রূপসী, বাউশগাড়ী ও ডেমরা গ্রামের ঐ সময়ের অধিবাসী কে কোন দল করতো তা আমি বলতে পারবো না। আমাদের স্কুলে যেহেতু চারজন শিক্ষক ছিল সেহেতু অনুমান করে বলছি রূপসী স্কুলেও চারজন শিক্ষক থাকতে পারে। আইনুল হক ছাড়া রূপসী স্কুলের অন্য শিক্ষকদের নাম আমি বলতে পারব না। আইনুল হক রূপসী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন কিনা আমার জানা নাই, তবে তিনি সেই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আমি আমার মূল জবানবন্দীতে আইনুল হক সাহেবকে ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেছিলাম অনুমান করে। মুক্তিযোদ্ধা শামসুল রহমান ওরফে নান্নুকে আমি ১৯৭১ সালে বা আগে থেকেই চিনতাম, তার বাড়ি সাথিয়া থানায়। উনার সাথে ভারতে ট্রেনিং নেওয়ার সময় দেখা হয় নাই। উনার পাবনা শহরের বাসা আমি চিনতাম না। নান্নু সাহেবের সম্বন্ধি এ্যাডভোকেট এ.কে.এম শামসুল হুদাকে আমি চিনি না।
ভারতে ইয়থ ক্যাম্প ট্রেনিং নেওয়ার সময় আমাদের এলাকার আনছার, লাল মোহন, আনন্দ গোপাল সহ আরো অনেকে সেই ক্যাম্পে ছিল। সেখানে ট্রেনিং নেওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান সাহেবের (গলাকাটা) সাথে আমার দেখা হয়নি।  আমার সাথে মুখলেছুর রহমান ওরফে রঞ্জু, কুদ্দুস, সালাম, মাজেদ, মুকছেদ ও জলিল আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে ছিল না।
রূপসী, বাউশগাড়ি ও ডেমরা গ্রামে ১৯৭১ সালে যাদের বয়স ১৫ বৎসরের বেশি ছিল তাদের অনেকেই এখনো জীবিত থাকতে পারেন। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে আসার ২দিন আগেও আমি রূপসী, বাউশগাড়ী ও ডেমরা বাজারে গিয়েছি। রূপসী, বাউশগাড়ি, ডেমরা ও ধূলাউড়ি গ্রামে আমার থেকে বয়সে বড় লোক এখনও জীবিত আছেন। ধূলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয় রাত অনুমান ২.৩০/৩.০০ টার দিকে এবং ফজরের সময় পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। ফজরের আযানের পর পরই আমরা ধূলাউড়ি গ্রামে পৌছাই। ঐ সময় আমি এবং তাদের সহযোগিরা চলে গিয়েছিল।
মতিউর রহমান নিজামী সাহেব বাংলাদেশের একজন পরিচিত ব্যক্তি। ১৯৭১ সালে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব বাংলাদেশে থাকতেন জানি, তবে কখন কোথায় থাকতেন তা জানি না। ১৯৭১ সালে সাথিয়ায় কোন কলেজ ছিল না। শাহজাহান সাহেবের আহত হওয়ার ঘটনাটি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর পরই দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধা মুখলেছ ঐ যুদ্ধেই মারা গিয়েছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধা মাজেদ ঐ যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন কিনা আমার স্মরন নাই।
১৯৭১ সালে করমজা গ্রামের ঘটনা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের নেতৃত্বে ঘটে মর্মে আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলি নাই, এটা সত্য নয়।
মেঘা ঠাকুরের মেয়ে এবং তার ছেলের বউকে ধর্ষণ করা হয়, এ কথা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলি নাই, এটা সত্য নয়।
১৯৭১ সালের ১২ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হককে রাজাকার, আলবদর ও পাক বাহিনী নিজামী সাহেবের “নেতৃত্বে” ধরতে যায় একথা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, এটা সত্য নয়।
মামলার কার্যক্রম আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত পাঁচজন সাক্ষী তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করেছে। আগামীকাল এ বিষয়ে শুনানী অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে।
জেরায় মিজানুল ইসলামকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট মনজুর আজমেদ আনসারী, তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, আসাদ উদ্দিন প্রমুখ।


আইনজীবীর অশ্লীল মন্তব্যে উত্তেজনা :
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আলতাফ হোসেন কর্তৃক মিজানুল ইসলামের প্রতি অশ্লীল  মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনালে উত্তেজনা দেখা দেয়। ট্রাইব্যুনাল আলতাফ হোসেন এর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
আলতাফ হোসেন মাওলানা নিজামীর পক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে কিছু অশালীন মন্তব্য (লেখার অনুপযুক্ত) করেন তার পাশের আরেক আইনজীবীর কাছে। সেকথা মিজানুল ইসলাম এবং মাওলানা নিজামীর পক্ষে অপর আইনজীবী তাজুল ইসলামের কানে যায় । মিজানুল ইসলাম তখন ক্ষোভের সাথে বলেন, আপনারা যে অভদ্র, অশভ্য ভাষা ব্যবহার করলেন তার জবাব দেয়ার ক্ষমতা এবং যোগ্যতা আমাদের আছে। কিন্তু আমরা এখানে ঝগড়া বা বাহাস করতে আসিনি। এসময়  রাষ্ট্রপক্ষের আরেক আইনজীবী  আবার কিছু একটা বলায় অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম দাড়িয়ে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে বলেন, আপনারা সবাই শুনেছেন তারা কি অশালীন ভাষা ব্যবহার করেছে। প্রয়োজনে আবার  রেকর্ড শুনতে পারেন আপনারা । তখন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমরা কেউ কিছূই শুনিনি। তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা সবাই শুনেছি। তখন বিচারপতি জাহঙ্গীর হোসেন তাজুল ইসলামের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা আগেও লক্ষ্য করেছি আপনি  ট্রাইব্যুনালকে আঘাত করে কথা বলেন। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমরা  রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর কথা শুনেও বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি?  এসময় অপর বিচারপতি আনোয়ারুল হক বলেন, আমরা আসলেই কিছু শুনিনি তাজুল সাহেব। আমরা তিনজন লোক কি মিথ্যা বলব? এসময় অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম তাজুল ইসলামকে থামানোর চেষ্টা করেন বারবার। তখন  তাজুল ইসলাম বেঞ্চে বসেন। তখন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন তাজুল ইসলাম এর  প্রতি উদ্দেশ্য করে বলেন,  আপনি যেভাবে বলেছেন বিষয়টা তা ঠিক নয়। আপনরা ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে নিজেরা ট্রাইব্যুনালকে আক্রমন শুরু করে দিয়েছেন। আমরা তিনজন এখানে অনেক সময় অনেক কথা বলি। তা কি আপনরা শুনতে পান? আপনাদেরও সব কথা আমরা শুনতে পাইনা। এসময় বিচারপতি আনোয়ারুল হক বলেন, আমাদের নজর থাকে সাক্ষীর প্রতি। বেঞ্চে বসে কোন কোন আইনজীবী কার সাথে কি বলে  তার প্রতি আমাদের লক্ষ্য থাকেনা সব সময়।
এরপর  তাজুল ইসলাম  দাড়িয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর একটি অশালানী মন্তব্য সম্পর্কে ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করে বলেন,  রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইজীবী মিজানুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, তিনি প্রস্রাব করলে মিজানুল ইসলাম তাতে ভেসে যাবেন। তাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের  আইনজীবী  মিজানুল ইসলামকে লক্ষ্য করে আরো একটি বাক্য বলেছেন তা উচ্চারনের যোগ্য নয়।
তখন  ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আলতাফ হোসেনের প্রতি  লক্ষ্য করে ক্ষোভের সাথে বলেন, আপনি এ ধরনের কথা বলেছেন? তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আলী দাড়িয়ে বলেন, তারা  পারসোনাল কথাবার্তা বলছিল। সাইড টকিং করছিল। মোহাম্মদ আলী আলতাফ হোসেনের পক্ষ থেকে আদালতের প্রতি ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
এসময় বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির বলেন, এ ধরনের ভাষা এখানে গ্রহণ করা হবেনা। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, মিস্টার মোহাম্মদ আলী, আপনারা যদি কোর্টকে সহায়তা করতে পারেন তাহলে আসবেন। আর তা না হলে এখানে আসবেননা। বিচারপতি আনোয়ারুল হক  আলতাফ হোসেনকে লক্ষ্য করে বলেন, আপনারা যে ভাষা ব্যবহার করলেন তা তো কোন আইনজীবীর ভাষা হতে পারেনা। এমনকি কোন ভদ্রলোকেরও ভাষা হতে পারেনা এটি।
এরপর তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালের সাথে তার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, এ ধরনের কথা কানে আসার পর স্বাভাবিকভাবে আমাদের উত্তেজিত করে। আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিল আমার মূল লক্ষ্য । আমার প্রকাশ ভঙ্গিটা হয়ত একটু অন্যরকম হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন