বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সাঈদীর আপিল আবেদন// ৬ নং অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন শেষ রাষ্ট্রপক্ষের

মেহেদী হাসান, ২৭/২/২০১৪
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম  ছয় নং অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেছেন।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ছয় নং অভিযোগ হল পাড়েরহাট বাজারে হিন্দুদের দোকানপাট ও বসতবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব প্রদান।
প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহণ করেন।
গতকাল বুধবারের  ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আজ মাহবুবে আলম যুক্তি পেশ শুরু করেন।
তিনি বলেন, আসামী পক্ষ অভিযোগ করেছে রাষ্ট্রপক্ষের নবম সাক্ষী ছয় নং অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু তারপরও ছয়  নং অভিযোগ প্রমানের ক্ষেত্রে তাকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। তাদের এ অভিযোগ ঠিক নয়। নবম  নং সাক্ষী ছয়  নং অভিযোগ বিষয়ে তার জবানবন্দীতে বলেছেন। আমি আপনাদের পড়ে শোনাচ্ছি তার জবানবন্দী থেকে।
নবম সাক্ষী আলতাফ হোসেন ছয় নং অভিযোগ বিষয়ে  বলেছেন, ‘মে মাসের  সাত তারিখ পাক আর্মি পারেরহাট বাজারে আসে। পাক আর্মি আসার  ছয়/সাত দিন আগে  সেকেন্দার শিকদার, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মোসলেম মাওলানা, দানেশ আলী মোল্লার নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠন হয়। তারপর রেজাকার বাহিনী গঠন হয় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নেতত্বে। শান্তি কমিটির লোকজনই রেজাকার বাহিনী গঠন করে।

এ বাহিনী গঠনের পর পারেরহাট বন্দরে ৩০/৩৫টি  দোকান ঘর  এবং ববাসা বাড়ি লুটপাট করে । পারেরহাট এবং তার আশপাশে যা কিছুই ঘটে যেমন অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষন সবই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।’
অ্যঅটর্নি জেনারেল জেরা থেকে পড়ে শুনিয়ে বলেন, এ সাক্ষী জেরায়ও ছয়  নং অভিযোগ বিষয়ে বলেছেন।

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাওলানা সাঈদীর পক্ষের কয়েকজন সাক্ষীদের বক্তব্য বিষয়ে যুক্তি পেশ করেন। তিনি বলেন, আসামী পক্ষের এক নং সাক্ষী শামসুল আলম তালুকদার জেরায় বলেছেন,  ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাওলানা ভাসানী যখন পার্টির প্রধান ছিলেন তখন মশিউর রহমান  যাদু মিয়া পার্টির সেক্রেটারি  ছিলেন। মশিউর রহমান যাদু মিয়া মুক্তিযুদ্ধের পরে কারাগারে আটক ছিলেন জানি তবে কি করনে তা জানা নেই। আমি ভাসানী ন্যাপের পরে  জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট হয়ে বিএনপিতে  যোগদান করি ১৯৭৯ সালে ।  বিএনপিতে  যোগ দেয়ার পর বাগেরহাট জেলা সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হই।’

জেরা থেকে এ পর্যন্ত পড়ে শুনিয়ে অ্যটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এ সাক্ষী বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জোটবদ্ধ রাজনীতি করছে।

জেরায় তাকে সাজেশন দিয়ে আমরা বলেছি ‘বিএনপি জামায়াতের জোট থাকায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকান্ড জানা থাকা সত্ত্বেও আপনি তা গোপন করেছেন ইচ্ছাকৃতভাবে।’ সাক্ষী বলেছেন সত্য নয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এরপর সাক্ষী শামসুল আলম তালুকদার জবানবন্দী থেকে পড়ে শোনান আদালতকে । শামসুল আলম তালুকদার তার জবানবন্দীতে বলেছেন, ‘এই অবস্থায় আমরা ৮ই ডিসেম্বর মেজর জিয়াউদ্দিনসহ পিরোজপুরের পাড়েরহাটে যাই। মেজর জিয়াউদ্দিন ১০/১৫ মিনিট ছিলেন। আমাকে উনি সমস্ত অবস্থা জেনে ২/৩ ঘন্টা পরে পিরোজপুরে আসতে বলেছিলেন। সেখানে আমাদের কমান্ডার খসরু, মোকাররম, লিয়াকত আলী বাদশা, বাতেন, মুনাম, সানু খোন্দকার সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও অনেক জনসাধারন তাদের অবস্থা বর্ণনা করে। আমি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শন করি। মোসলেম মওলানা, দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, রাজ্জাক, দুইজন চৌকিদারসহ আরও কয়েকজন কে কি অত্যাচার করেছে তার বর্ণনা করে। ঐ সময়ে দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সম্পর্কে আমাকে কেউ কিছু বলে নাই। ঐ দিন আমরা রাত্রে পিরোজপুরে অবস্থান করি। পরবর্তীতে আমরা সমস্ত অস্ত্র সারেন্ডার করি।
দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সাহেবের ছেলে মাসুদ সাঈদী আমাকে তার পিতার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়ার অনুরোধ করে বলেছেন যে,  যা সত্য আমি যেন তাই বলি ট্রাইব্যুনালে গিয়ে। তাই এখানে এসে সাক্ষ্য দিলাম।  আমি সাক্ষ্য দিতে এসে একটিও মিথ্যা কথা বলিনি। যদি সাঈদী সাহেব কোন অন্যায় কাজ করতেন তাহলে আমি কমান্ডার, লোকজন তখন আমার নিকট তা বলতো।’

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মেজর জিয়াউদ্দিনের লেখা বই থেকে  ৮ ডিসেম্বর তার পাড়েরহাট গমন সংক্রান্ত অংশ পড়ে শোনান।  অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মেজর জিয়াউদ্দিনের এ লেখার সাথে সাক্ষী শামসুল আলম তালূকদারের দাবির মিল নেই।
তিনি বলেন, মেজর জিয়াউদ্দিনের এ বইটি আসামী পক্ষই ডকুমেন্ট হিসেবে জমা দিয়েছে আদালতে। তারা দেখাতে চেয়েছে মেজর জিয়াউদ্দিনের লেখায় কোথাও সাঈদী সাহেবের নাম নেই।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আসামী পক্ষের সাক্ষী নরুল হক হাওলাদার জেরায় বলেছেন, তিনি কখনো পাড়েরহাট রাজাকার ক্যাম্প বা শন্তি কমিটির অফিসে যাননি। কাজেই কারা শান্তি কমিটি রাজাকার কমিটির সদস্য তা তার চেনার কথা নয়। সুতরাং মাওলানা সাঈদী রাজাকার বা শান্তি কমিটিতে ছিলনা মর্মে তার যে দাবি তাও সঠিক হতে পারেনা।

মাওলানা সাঈদীর ছেলে  মাসুদ সাঈদী তার পিতার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে বলেছেন,  তার পিতার পেশা লেখক। তিনি ৭২টি বই লিখেছেন। তিনি বলেছেন লেখালেখি ছাড়া তার পিতার আর কোন পেশা নেই এবং অতীতেও ছিলনা। কিন্তু আসামী পক্ষের ১৪ নং সাক্ষী এমরান হোসেন বলেছেন মাওলানা সাঈদী ১৯৬৯-৭০ সালে যশোরে থাকতেন এবং সেখানে তিনি ধর্মসভা করতেন।

এ সময় একজন বিচারপতি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ১৫ নং সাক্ষী ছয় নং অভিযোগ বিষয়ে বলেছেন। কিন্তু সেটা ট্রাইব্যুনাল বিবেবচনা করেনি। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল ১৫ নং সাক্ষীর জবানবন্দী থেকে ছয়  নং অভিযোগ বিষয়ে পড়ে শোনান যেখানে সাক্ষী বলেছেন, ৭ই মে তারিখে পাক সেনারা পাড়েরহাটে আসে। তাদের সহযোগিতায় পাড়েরহাটের কিছু সংখ্যক লোক দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, মোসলেম মাওলানা, গণি গাজি, আসমত আলী মুন্সি, মালেক শিকদার পাড়েরহাটের ৫/৬টি হিন্দুর দোকান লুট করে। লুটপাটের পরে পাক সেনারা আবার পিরোজপুরের দিকে রওনা করে যায়। যাদের দোকান লুট করে তারা হলেন মাখন সাহা, নারায়ন সাহা, মদন সাহা, বিজয় মাস্টার, গৌরাঙ্গ পাল প্রমুখ। লুটপাটের পরের দিন আবার পাক সেনারা পাড়েরহাটে আসে।’
অ্যটার্নি জেনারেল বলেন, হ্যা এ সাক্ষী ছয়  নং অভিযোগ বিষয়ে বলেছেন এবং অনেক দোকান মালিকের নামও বলেছেন। তার সাক্ষ্য বিবেবচনায় নেয়া উচিত ছিল ট্রাইব্যুনালের। কেন নিলনা বুঝতে পারলামনা।
তখন একজন বিচারপতি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরাও দানেশ মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দোর শিকদার এদের নাম বলেছেন এবং আসামী পক্ষের সাক্ষীও এদের নাম বলেছেন। পার্থক্য হল আসামী পক্ষের সাক্ষী শুধুমাত্র মাওলানা সাঈদীর  নাম বলেননি। আর সব ঠিক আছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হ্যা, তারাও ঘটনা স্বীকার করেছে। ঘটনা ঘটেছে এটা সত্য। তাদের দাবি সেখানে আসামী সাঈদী ছিলেননা।

এ পর্যন্ত শুনানী শেষে আগামী রোববার পর্যন্ত শুনানী মুলতবি করা হয়।







বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সাঈদীর আপিল// অ্যাটর্নি জেনারেল কর্তৃক আজকের পেশকৃত যুক্তি

মেহেদী হাসান, ২৬/২/২০১৪
রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আজো ৬ নং অভিযোগ পাড়েরহাটে হিন্দুদের দোকানপাট ও বসতবাড়িতে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন।
আজ প্রথমে তিনি  এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের ১ নং সাক্ষী মাহবুব আলম হাওলাদারের জবানবন্দী থেকে পড়ে শোনান।  ৬ নং অভিযোগ বিষয়ে মাহবুবে আলম বলেছেন, ৭ মে সকাল বেলা আমি নিজ বাড়িতেই ছিলাম। এবং লোকমুখে শুনতে পাই পাক হানাদার বাহিনী পাড়েরহাট আসিতেছে  এবং পারের হাটের শান্তি কমিটির লোকেরা পাড়েরহাট রিক্সা স্ট্যান্ডে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে। আমি পাড়েরহাটে যাইয়া  রিক্সা স্ট্যান্ডের আড়ালে থেকে  গোপনে লক্ষ্য করিতেছি পাড়েরহাটের শান্তি কমিটির লোকের দাড়িয়ে আছে। কিছু পরে একেকটি রিক্সা করে ২৬টি রিক্সায় ৫২
জন পাক হানাদার বাহিনী রিক্সা স্ট্যান্ডে নামে। শান্তি কমিটির লোকেরা তাদের অভ্যর্থনা জানায়। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী উর্দুভাষা ভাল জানতেন বিধায় ক্যাপ্টেন ইজাজের সাথে কথা বলেন।  পরে বাজারের দিকে পাক হানাদার বাহিনী যেতে থাকে। শান্তি কমিটির লোকেরা বাজারের ভেতরের দিকে যায়।  মুক্তিযোদ্ধার পক্ষের আওয়ামী লীগ ও হিন্দু  সম্প্রদায়ের লোকদের দোকানঘর, বসতঘর ক্যাপ্টেন ইজাজকে দেখিয়ে দেয়। ক্যাপ্টেন ইজাজ লুটের নির্দেশ দেয়। লুটপাট শুরু হয়ে যায়। আমি অকুস্থল থেকে কিছু দূরে সরে যাই। পরে জানতে পারি ৩০ থেকে ৩১টি দোকান ঘরের মামামাল, বসতবাড়ি লুটপাট করে  সাঈদী সাহেবের নেতৃত্বে ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়। পাড়েহাটের বড় ব্যবসায়ী মাখন সাহার দোকান ঘরের মাটির নিচে একটি লোহার সিন্ধুক থেকে ২২ কোজি সোনা রূপা লুট করে। ক্যাপ্টেন ইজাজ তা নিজেই নিয়ে নেয়। এক ঘরে  এত সোনা পাওয়ায় ক্যাপ্টেন ইজাজ পারের হাটের নাম রাখেন সোনার পারেরর হাট। পারের হাটের উত্তর দিকে পুলের নিকট মদন সাহার দোকান ঘর, বসত ঘর দেলাওয়ার হোসাইন বর্তমান সাঈদী নিজের নেতৃত্বে লুটপাট করে। দোকান ও বসত ঘর ভেঙ্গে খালের পূর্ব পাশে শ্বশুর  বাড়ি নিয়ে যায়। পারের হাটের লোকেররা লুটপাটের মালামাল, সোনাসহ ১৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি পাসতহবিল গঠন করে। নগরবাসী সাহা, তারকাচন্দ্র  সাহা, বেনীমাধব সাহা প্রানের ভয়ে ভারতে চলে গেলে তাদের ঘরের মালামাল লুটপাট করে। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নেতৃত্বে নগরবাসী সাহার ও পারের হাটের লুটের মালামাল নিয়ে গঠিত পাসতহবিলের মালালা নিজেই বেচাকেনা করে। এবং  আরো লুটের অর্থ এর সাথে যোগ করে বাড়াতে থাকে। এই টাকা দিয়ে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী খুলনা, ঢাকায় অট্টালিকা ও বহু সম্পদ গড়ে তোলে।

এরপর তিনি ২ নং সাক্ষী রুহুল আমিন নবিনের জবানবন্দী থেকে প্রসঙ্গক্রমে পড়ে শোনান। ২ নং সাক্ষী বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ কিনতে  জুন মাসে   বৃহষ্পতিবার হাটের দিন  পারের হাট বাজারে  যাই।  এসময় লুঙ্গি ও পাঞ্জাবী পরিহিত তৎকালীন দেলাওয়ার হোসাইন শিকদার (বর্তমানে দেলাওয়ার হোসাইন  সাঈদী) বা হাতের বগলের নিচে একখানা ঢেউটিন, মাথায় একটি ঝাকায় কাসা পিতলের বাটি, জগ ও একটি কলস নিয়ে পাসতহবিলের দোকানের দিকে যাচ্ছে। আমি বাজারের উত্তর দিকে গিয়ে শফিজউদ্দিন মৌলভীর দোকানের সামনে যাবার পর উপস্থিত লোকদের কাছে জানতে পারি মদন সাহার দোকান লুট হয়েছে। কিছুক্ষন পর মদন সাহার দোকান ঘরটি  ভেঙ্গে নৌকাযোগে তার (মাওলানা সাঈদী) শশুর  ইউনুসল আলী মুুিন্স সাহেবের বাড়িতে নিয়ে তোলে।
স্বাধীনতাকমী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার লক্ষ্যে কতিপর স্বাধীনতা বিরোধী লোকদের নিয়ে সেকেন্দার আলী শিকদার, দানেশ মোল্লা, মাওলানা মোসলেহউদ্দিন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নেতৃত্বে পারের হাট এলাকায়  রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। অন্যান্য এলাকার ন্যায় পিরোজপুর এলাকার  স্বাধীনতাকামীদের চিরতরে নিংশেষ করার জন্য ১৯৭১ সালের ৩ মে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী  আগমন করে।  ৭ মে  পারের হাটের শান্তি কমিটির  সেকেন্দার  আলী শিকদার, দানেস মোল্লা, মাওলানা মোসলেহউদ্দিন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব সহ আরো কয়েকন পারের হাটে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য রিক্সা স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতে থাকে। ২৬টি রিক্সাযোগে  প্রায় ৫২ জন পাক হানাদার বাহিনী পারের হাটে প্রবশে করে।  শান্তি কমিটির লোকজন পাক হানাদারদের নিয়ে পারেরহাট বাজারে  প্রবেশ করে  এবং  আওয়ামী লীগ ও হিন্দুদের বাড়িঘর দোকানপাট দেখিয়ে দেয়। ক্যাপ্টেন এজাজ অন্যান্যদের সাথে পরামর্শ করে উর্দুতে বলেন ‘লে লও”।  শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের দেখিয়ে দেওয়া ঘরগুলোতে   শুরু হয় লুটপাট।  পারের হাট বাজারের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মাখন  সাহার দোকানের মাটির নিচের লোহার সিন্দুক থেকে ২২ শের স্বর্ণ ও রূপা লুট করে। ৩০/৩৫টি দোকান ঘর লুটাপাট চালায়। পরের দিন ৮ মার্চ বাদুরা চিথলিয়া গ্রামে সাত আটটি ঘরে  লুটাপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।


৩ নং সাক্ষী মিজানুর রহমান তালকদার বলেছেন, দেলোয়ার হোসেন শিকদার কথিত সাঈদী পারের হাট বাজারে সেনাবাহিনী  এবং রাজাকার ক্যম্প স্থাপনের পর যেসব কুকর্ম সংঘটিত হয়েছে যেমন অগ্নি সংযোগ, হত্যা লুটপাট, নারী নির্যাতন, হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণ, রেপের উদ্দেশে গ্রামের সাধারণ মহিলাদের ধরে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর এসব কাজের সাথে প্রত্যক্ষ  এবং পরোক্ষভাবে দেলোয়ার হোসেন শিকদার জড়িত ।

চার নং সাক্ষী সুলতান আহমেদ হাওলাদার বলেছেন, ১৯৭১ সালে তিনি  পিরোজপুর সোহরাওয়াদী কলেজের   ছাত্র ছিলেন। পিরোজপুরে পাক বাহিনী আসার খবর পেয়ে তিনি গ্রামে চলে যান। গ্রামে গিয়ে  জানতে পারেন জামায়াত নেতা সেকেন্দার  আলী শিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন শিকদার বর্তমানে সাঈদী, মোসলেম মাওওলানা এদের নেতৃত্বে পিস কমিটি গঠিত হয়। দেলোয়ার হোসেন শিকদার বর্তমানে সাঈদীর নেতৃত্বে বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র এবং স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠনের  লোকদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। 
সুলতান আহমদ বলেন, বাজারে এবং আশপাশের এলাকায় ঘোরাঘুরি করে পাক বাহিনী, পিস কমিটি এবং রাজাকারদের কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করি।   পাক বাহিনী  পাড়েরহাটে আসার পর উপরে বর্নিত পিস কমিটির নেতৃবৃন্দ পাক পাহিনীকে স্বাগত জানায় এবং বাজারে নিয়ে   যায় লুটপাটের জন্য। দেলোয়ার হোসেন বর্তমান সাঈদী হাত উচু করে তাদেরকে হিন্দু  সম্প্রদায় এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির দোকান ও বসতঘর দেখিয়ে দেয়।  বাজারে লুটপাট এবং মানুষের ছোটাছুটি শুরু হলে আত্মীয়ের বাসায় চলে যাই।  পরে আবার বাজারে এসে জানতে পারি ৩০/৩৫টি ঘর লুট হয়েছে। দেলোয়ার হোসেন বর্তমান সাঈদীর নেতৃত্বে লুটের মাল খেয়াঘাটের সামনে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। আরো শুনতে পেলাম মাখন সাহার ঘর থেকে ২২ শের সোনা রূপা উদ্ধার করা হয়েছে যা  ক্যাপ্টেন  এজাজ নিয়ে যায়। পরে জানতে পারি এবং গিয়ে দেখি খেয়াঘাটে অবস্থিত নগরবাসী সাহার  ঘর দখল করে লুটের মালামাল  এর সাহায্যে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে যার পরিচালক  ছিলেন দেলোয়ার হোসেন  শিকদার বর্তমানে সাঈদী।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অষ্টম সাক্ষী মোস্তফা হাওলাদার তখন বাজারে ছোলা মুরি বিক্রি করত। সে খুবই ন্যাচারাল সাক্ষী । তিনি বলেছেন, আমি ১৯৭১ সালে পারেরহাট বাজারে বুটমুড়ি ফেরি করে বিক্রি করতাম।  মে মাসের সাত তারিখ  শান্তি কমিটির দেলোয়ার  শিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা এরা  বাজারের উত্তর মাথায় রিক্সা স্ট্যান্ডের কাছে যায়। কিছুক্ষন পর ২৬টি  রিক্সায় ৫২ জন পাক আর্মি আসে। পাক আর্মি নামার পর তারা দেলোয়ার শিকদার, মোসলেম মাওলানা,  দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার এদের জিজ্ঞসা করে বাজারের  অবস্থা কি । তারপর শান্তি কমিটির লোকজন পাক আর্মিদের হিন্দু এবং নৌকা মার্কার লোকজনের দোকান, ঘরবাড়ি দেখিয়ে দেয়।    এরপর তারা বাজারে ঢোকে। দেলোয়ার শিকাদর  পাক আর্মিদের  ঘরবাড়ি দেখিয়ে দেয়। আর লুটপাটের নির্দেশ দেয়। অর্মির অর্ডারে শুরু হয় লুটপাট। ৩০/৩৫ টি ঘরে তারা লুটপাট করে। দেলোয়ার শিকদার,  মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দার শিকদার, খলিল মৌলভীসহ শান্তি কমিটির অন্যান্যরা লুটপাট করে।  ঘন্টা দেড়েক লুটপাট করে চলে যায় পাক আর্মি। এরপর পুরাদমে লুটপাট করে শান্তি কমিটির লোকেরা।

নবম সাক্ষী আলতাফ বলেন, মে মাসের  সাত তারিখ পাক আর্মি পারেরহাট বাজারে আসে। পাক আর্মি আসার  ছয়/সাত দিন আগে  সেকেন্দার শিকদার, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মোসলেম মাওলানা, দানেশ আলী মোল্লার নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠন হয়। তারপর রেজাকার বাহিনী গঠন হয় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নেতত্বে। শান্তি কমিটির লোকজনই রেজাকার বাহিনী গঠন করে।

এ বাহিনী গঠনের পর পারেরহাট বন্দরে ৩০/৩৫টি  দোকান ঘর  এবং ববাসা বাড়ি লুটপাট করে । পারেরহাট এবং তার আশপাশে যা কিছুই ঘটে যেমন অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষন সবই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।

এভাবে অ্যাটর্নি জেনারেল ১২, ১৩ নং সাক্ষীর জবানবন্দী পড়ে শোনান। এরপর ১৯ (২) ধারায় গৃহীত ১৫ জন সাক্ষীর মধ্যে যে ৩ জন সাক্ষীর সাক্ষীর ওপর ৬ নং অভিযোগ বিষয়ে নির্ভর করা হয়েছে সে বিষয়ে উল্লেখ করেন। এসময় তিনি ট্রাইব্যুনালের আদেশ পড়ে শোনান ১৫ সাক্ষীর জবানবন্দী সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করন প্রসঙ্গে।

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল ৬ নং অভিযোগ বিষয়ে আসামী পক্ষের উপস্থাপিত যুক্তির জবাব দেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা ট্রাইব্যুনালে যে জবানবন্দী দিয়েছেন জেরায় তা আনশেকেন রয়ে গেছে। এসময় আদালত বলেন, আপনার এ দাবি ঠিক নয়। আসামী পক্ষ তাদের চ্যালেঞ্জ করেছে। আপনি তার জবাব দেন। আপনি দেখান যে, সাক্ষীদের জবানবন্দী আনশেকেন রয়ে গেছে। আসামী পক্ষ আরো বলেছেন আপনাদের সাক্ষীরা নির্দিষ্ট করে কোন দোকানদার এবং বাড়ির মালিকের নাম বলতে পারেনি।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সব হিন্দুদের নাম বলতে হবে বিষয়টি এমন নয়। রাষ্ট্রপক্ষের কয়েকজন সাক্ষী মাখন সাহা, মদন সাহার নাম বলেছেন। আসামী পক্ষের ৩ নং সাক্ষী  বলেছেন পাড়েটহাট বাজারে লুটপাট হয়েছে। তিনি মাখন সাহা, মদন সাহা, বিজয় মাস্টার এবং গৌরাঙ্গসাহার দোকান লুটোর কথা বলেছেন। এ থেকে এটা প্রমানিত যে ঘটনা সত্য। কাজেই সবার নাম বলতে হবে তার দরকার নেই। ঘটনা ঘটেছে কি-না সেটাই আসল।

রাষ্ট্রপক্ষের ১ নং সাক্ষী এবং মামলার বাদী মাহবুবুল আলমের বয়স চ্যালেঞ্জ করে  আসামী পক্ষ বলেছে সে তখন ১২/১৩ বছরের বালক ছিল।
এর জবাবে অ্যটর্নি জেনারেল বলেন, সনদে তার জন্ম তারিখ ১৯৬৯। লেখাপড়ার বেলায় এটি হতে পারে বলে সাক্ষী জানিয়েছে। কিন্তু সাক্ষী বলেছেন সে ১৯৭৩ সালে বিয়ে করেছেন। কাজেই ১৯৭৩ সালে বিয়ে করলে ১৯৭১ সালে বালক থাকার কথা নয়।
তখন একজন বিচারপতি বলেন, মহাত্মাগান্ধী কত বছর বয়সে বিয়ে করেছেন জানেন? ১৩ বছরে। তখন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন বলেন, সেই যুগে আর্লি বিয়ে হত।

২ নংসাক্ষী রুহুল আমিন নবিন বিষয়ে আসামী পক্ষ দাবি করেছে সে ঘটনার সময় এলাকায় ছিলনা। সে কোন ঘটনা দেখেনি।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সাক্ষী নিজেই বলেছেন ২১ জুন সে এলাকা ত্যাগ করে। সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। কাজেই সেতো পাড়েরহাট বাজারে ঘোরাফেরা করবেনা। এটাই স্বাভাবিক।
চার নং সাক্ষী সুলতান আহমেদ ট্রাইব্যুনালে এসে বলেছেন তিনি দেখেছেন মাওলানা সাঈদী  লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সময় হাত উচিয়ে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট দেখিয়ে দেয়। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তার কাছে একথা তিনি বলেননি।
এ বিষয়ে আদালত বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা কি তদন্ত করেছে? এত সুযোগসুবিধা নিয়ে তারা কি করেছে? তারা কি বনভোজন করেছে। সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে এসে বলছে সে দেখেছে সাঈদী হাত উচু করে ঘরবাড়ি দেখিয়ে দিয়েছে আর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এ কথাটি বলেনি?

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আরো দুই সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ

২৫/২/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের একাদশ ও দ্বাদশ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ একাদশ সাক্ষী নাজিম উদ্দিন ও দ্বাদশ সাক্ষী মো: হাসানের জবানবন্দী গ্রহণ করার পর আসামীপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম তাদের জেরা করেন। এরপর আগামী ৩ মার্চ পরবর্তী সাক্ষীর জবনবন্দী গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে।


সাক্ষ্যগ্রহণের সময় মীর কাসেম আলীকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় আনা হয়। তার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মিজানুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম ও অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও সুলতান মাহমুদ সিমন।

একাদশ সাক্ষী নাজিম উদ্দিনের জবানবন্দী (সংক্ষিপ্ত) : 
জবানবন্দীতে সাক্ষী নাজিম উদ্দিন বলেন, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর আল-বদররা আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে আমাকে নাজিরবাড়ি মসজিদের সামনে নিয়ে আসে। সেখানে আবু জাফর, আমার চাচাতো ভাই ছুটু মিয়া, জাকারিয়া, এস্কান্দারসহ আরো কয়েকজনকে দেখতে পাই। এরপর আল-বদররা আমাদের সবাইকে দুটি ট্রাকে উঠিয়ে ডালিম হোটেলের একটি কক্ষে নিয়ে যায়। আমাকে আটক রাখার আনুমানিক ২ ঘণ্টা পর আল-বদর সদস্যরা এসে পূর্বে থেকে আটক থাকা কয়েকজনকে বের করে নিয়ে যায়। আনুমানিক ২ ঘণ্টা পর আবার তাদের রুমে ফিরিয়ে আনে যাদের অনেকের শরীরে আমি অত্যাচারের চিহ্ন দেখতে পাই। আহত ব্যক্তিরা আমাকে বলল, ‘তোমাকেও এভাবে নির্যাতন করা হবে।’ একথা শুনে আমি ভয়ে কাঁদতে থাকি। নির্যাতিত ব্যক্তিরা আরো বলছিল এটা মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে একটি নির্যাতন কেন্দ্র। এর তিন বা চারদিন পর আমার বাবার তদবিরে আল-বদররা আমাকে ছেড়ে দিলে বাড়ি চলে আসি। 
জবানবন্দী শেষে আসামীপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সাক্ষীকে জেরা করেন।

জেরা:
প্রশ্ন : আপনাকে আটক করে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসা পর্যন্ত আবু জাফর, ছুটু মিয়া, জাকারিয়া ও এস্কান্দার ছাড়া আটককৃত আর কাউকে আপনি চিনতে পেরেছেন।
উত্তর : আর কাউকে চিনতে পারিনি।
প্রশ্ন : আপনার চাচা এস্কান্দার আটক হওয়ার পূর্বে কি করতেন।
উত্তর : পাকিস্তানে থাকতেন, সেখানে কি করতেন তা জানতাম না।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের পূর্বে মীর কাসেম আলীর সঙ্গে আপনার কোন পরিচয় ছিল?
উত্তর : পরিচয় ছিল না।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর ও আস শামস বাহিনী সম্পার্কে আপনার কোন ধারণা আছে।
উত্তর : আমার কোন ধারণা নেই।
প্রশ্ন : আপনাকে আটক করার পর থেকে ডালিম হোটেলে আনা পর্যন্ত সময়ে পাকিস্তান আর্মি দেখেছিলেন কি?
উত্তর : দেখিনি।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে আপনাকে আটক করা হয়নি।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি মীর কাসেম আলীকে জড়িয়ে অসত্য সাক্ষ্য দিলেন।
উত্তর : সত্য নয়।

দ্বাদশ সাক্ষীর জবানবন্দী ও জেরা: দ্বাদশ সাক্ষী মো: হাসান জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি চান্দগাঁও এনএমসি হাই স্কুলের কাস নাইনের ছাত্র ছিলাম এবং স্কুলের জিএস ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিজের জিবন রক্ষার্থে অন্যত্র আত্মগোপনে যাই এবং আগষ্ট মাসে চট্টগ্রামের সাবানঘাটার বাড়িতে ফিরে আসি। ১৯৭১ সালে ২৯ নভেম্বর রাত আনুমানিক ৩টার দিকে আল-বদর বাহিনীর লোক আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে এবং বাড়ি থেকে আমিসহ প্রফেসর মওলানা নূরুল ইসলাম, আমার বাবা মরহুম আবদুস ছাত্তার, চাচাতো ভাই নূরুল কুদ্দুস, নূরুল হাশেম, মো: ইব্রাহিম, আবদুল হাকিম, মো: ইদ্রিস, মো: শফিসহ ২০-২৫ জন লোককে বের করে এনএমসি স্কুলের সামনে নিয়ে আসে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে এবং আমাদের সেখানে আল-বদরদের পাহারায় রেখে মীর কাসেম আলী চলে যায়। এনএমসি হাই স্কুলের সামনে দুটি ট্রাক দাঁড়ানো অবস্থায় ছিল যাতে আটককৃত লোকদের তোলা হয়। আমার বয়স কম থাকায় আমাকে আল-বদররা এনএমসি স্কুলের সামনে থেকে ছেড়ে দেয়। এছাড়াও আমার বাবা মওলানা আবদুস ছাত্তার এবং মওলানা নূরুল ইসলাম সাহেবকে একই জায়গা থেকে আল-বদররা ছেড়ে দেয়। ট্রাকে করে যে সমস্ত ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল তারা স্বাধীনতার পরে মুক্তি পেয়ে আমাকে জানিয়েছিল যে, তাদেরকে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে ডালিম হোটেলে আটকে রাখা হয়েছিল।
টু কোর্ট- প্রশ্ন: জবানবন্দীতে বর্নিত আটককৃত কুদ্দস এবং হাশেমকে কোথা থেকে মুক্তি দেয়া হয়?
          উত্তর: চট্টগ্রাম জেল খানা থেকে। ডালিম হোটেল থেকে তাদেরকে আল-বদররা জেল খানায় পাঠিয়েছিল।
আমি মীর কাসেম আলীকে ১৯৭০ সাল থেকে চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যায়নরত অবস্থায় চিনতাম। উনি ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম কলেজ শাখার সভাপতি ছিলেন।
জেরা:
প্রশ্ন : যেসব আল-বদরদের ঘটনার সময় দেখেছেন তারা কি মুখোশ পরিহিত ছিল?
উত্তর : সবাই মুখোশ পরা ছিল না।
প্রশ্ন : আপনি এসএমসি হাই স্কুলে পড়ার আগে কোথায় পড়তেন?
উত্তর : জামিয়া আহমাদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায়।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে এনএমসি স্কুল কোন থানার অধীনে ছিল?
উত্তর : পাঁচলাইশ থানার অধীনে।
প্রশ্ন : চট্টগ্রাম কলেজ কোন থানার অধীনে ছিল?
উত্তর : কোতয়ালি থানার অধীনে।
প্রশ্ন : আপনার বাড়ি থেকে চট্টগ্রাম কলেজ কোন দিকে কত দূরে অবস্থিত?
উত্তর : পশ্চিম ও দক্ষিণে চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
প্রশ্ন : ১৯৭০-৭১ সালে চট্টগ্রাম কলেজের মেনন ও মতিয়া পন্থি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও সম্পাদক কে চিল?
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রসংসদের ভিপি কে ছিল?
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে আপনি চট্টগ্রামে পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্প দেখেছেন?
উত্তর : পাকিস্তান আর্মির কোন ক্যাম্প দেখিনি।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে আপনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর ও ফিরে আসার সময় একই রকম খারাপ অবস্থা ছিল।
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : বাদামতলীর মাওলানা আবুল কাশেমের নাম শুনেছেন?
উত্তর : শুনেছি। তিনি ’৭১ সালে নিহত হন।
প্রশ্ন : তিনি কি ৮০ বছর উর্ধ্ব বৃদ্ধ লোক ছিলেন?
উত্তর : বৃদ্ধ লোক ছিলেন। তবে ৮০ বছর উর্ধ্ব ছিলেন কি না বলতে পারব না। তিনি মাদ্রাসায় চাকরি করতেন।
প্রশ্ন : পিস কমিটি, রাজাকার, আস শামস সম্পার্কে আপনার কোন ধারণা নেই।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : চট্টগ্রাম শহরের রাজাকার প্রধান জালাল চৌধুরীর নাম শুনেছেন?
উত্তর : শুনিনি।
প্রশ্ন : চট্টগ্রাম শহরের পিস কমিটির চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারির নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : বলতে পারব না।
প্রশ্ন : আপনি বর্নিত ডালিম হোটেলে গিয়েছেন?
উত্তর : হ্যাঁ, গিয়েছি।
প্রশ্ন : ওই হোটেলের কোন মালিককে আপনি চেনেন?
উত্তর : চিনি না।
প্রশ্ন : আপনি মতিউর রহমান ওরফে মইত্যা রাজাকারের নাম শুনেছেন?
উত্তর : শুনিনি।
প্রশ্ন : আপনাদের এলাকায় কোন আল-বদর ক্যাম্প ছিল?
উত্তর : ছিল না।
প্রশ্ন : কুদ্দস এবং হাশেমকে কোথায় নিয়ে আটক রাখা হয়েছিল তা আপনি জানতেন না।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : সৈয়দ মো: এমরানকে জেল খানায় আটক রাখা হয়েছিল এবং তাকে ডালিম হোটেল আটক রাখা হয়নি।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে ২৯ নভেম্বর আপনাকে আটক করা হয়নি বা আপনি ওইদিন মীর কাসেম আলীকে দেখেনি বা ডালিম হোটেল সম্পার্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা তা অসত্য। 
উত্তর : সত্য নয়।

##

মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সাঈদীর আপিল আবেদন রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু

মেহেদী হাসান, ২৫/২/২০১৪
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আজ যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেছেন। তার আগে সকালে আসামী পক্ষে এসএম শাহজাহান যুক্তি পেশ শেষ করেন।
সকালে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে শিকদার নাম প্রসঙ্গ এবং তার যশোরে অবস্থান বা প্লি অব এলিবাই বিষয়ে যুক্তি পেশ করেন অ্যাডভোকেট শাহজাহান। প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহন করেন।

অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, যশোরে অবস্থান বিষয়ে আসামী পক্ষে পাঁচজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছে। তাছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের ১৫, ১৬ এবং ২৪ নং সাক্ষীও যাশোরে অবস্থান বিষয়ে সমর্থন করেছে। কিন্তু এর কোন কিছুই ট্রাইবুন্যনালের রায়ে বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ৫টি পুলিশ প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তার একটিতে উল্লেখ আছে স্বাধীনতার পর আসামী খুলনা থাকেন।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য হলে তার পালিয়ে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি দেশের ভেতরেই প্রকাশ্যে স্বাভাবিক জীবন যাপন করেছেন।

অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের যে সময়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে সে সময় তিনি যশোরে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই তিনি যশোরে বাড়িভাড়া করে থাকতেন এবং সেখানে ওয়াজ করতেন।

শিকদার প্রসঙ্গ :
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ দীর্ঘ সময় নিয়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে এবং অনেক কাগজপত্র জমা দিয়েছে তার বিষয়ে । কিন্তু মাওলানা সাঈদীর নাম পূর্বে শিকদার ছিল এ মর্মে একটি ডকুমেন্টও তারা দেখাতে পারেনি। বরং তাদের জমা দেয়া ডকুমেন্টেই উল্লেখ আছে মাওলানা সাঈদীর নাম সবসময়ই সাঈদী ছিল। রাষ্ট্রপক্ষ তার ১৯৫৭ সালের দাখিল সনদ জমা দিয়েছে। সেখানে তার নাম দেলোয়ার হোসেন সাঈদী লেখা রয়েছে। পিতার নামের শেষেও সাঈদী লেখা রয়েছে। তাছাড়া তারা মাওলানা সাঈদীর আলিম সনদ জমা দিয়েছে এবং সেখানেও তার নামের শেষে সাঈদী লেখা রয়েছে। তার পিতার নামের শেষেও সাঈদী রয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের ১ নং সাক্ষী মামলার বাদী মাহবুবুল আলম এবং ৬ নং সাক্ষী মানিক পসারী ২০০৯ সালে পিরোজপুরে যে মামলা করেছে তাতেও তারা উল্লেখ করেছে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। সেখানে তাদের কেউ লেখেনি যে, তার নাম পূর্বে শিকদার ছিল। তাছাড়া তদন্ত কর্মকর্তাও জেরায় স্বীকার করেছেন দেলোয়ার হোসেন শিকদার পিতা রসুল শিকদার নামে আলাদা একজন ব্যক্তি ছিল।

এরপর দুপুর ১২টায়  অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন। তিনি ৬ নং অভিযোগ পাড়েরহাটে লুটপাট বিষয়ে যুক্তি উপস্থান শুরু করেন। তখন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন বলেন, আপনিও প্রস্তুতি ছাড়াই এসেছেন? আপনি আমাদের সময় নষ্ট করছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি পূর্ণ প্রস্ততি নিয়ে এসেছি।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, দানেশ মোল্লা মোসলেম মাওলানা প্রমুখ এদের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয় পাড়েরহাট। পরে তারাই রাজাকার বাহিনী গঠন করে ওখানে। ৬ নং সাক্ষীও এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে।

তখন একজন বিচারপতি বলেন, আসামী পক্ষ দাবি করেছে মাওলানা সাঈদীর নাম পূর্বে শিকদার ছিল এ মর্মে আপনারা একটি ডকুমেন্টও দাখিল করতে পারেননি।
অ্যটর্নি জেনারেল বলেন, আমরা তার দাখিল ও আলিম সনদ জমা দিয়েছি। সেখানে তার নাম শুধু দেলোয়ার হোসেন ছিল। পরে সাঈদী নাম যোগ করেছে।
এসময় একজন বিচারপতি বলেন, সাঈদীর নাম শিকদার ছিল এটি আপনারা ডকুমেন্ট দিয়ে দেখাতে পারেননি।

৬ নং অভিযোগ প্রমানের জন্য ১৯ (২) ধারায় যেসব সাক্ষীদের  জবানবন্দী বিবেবচনা করা হয়েছে তাদের মধ্যে  আবদুল লতিফ হাওলাদার এর জবানবন্দী থেকে পড়ে শোনানোর সময়  একজন বিচারপতি প্রশ্ন করেন তাকে সাক্ষী হিসেবে কেন আনা হয়নি।

তখন তিনি ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৯.২ ধারা পড়ে শোনানা যেখানে লেখা রয়েছে সাক্ষী মারা গেলে বা তাকে আনতে সময় সাপেক্ষ ব্যয়বহুল এবং অসম্ভব হলে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত তার জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়।
তখন একজন বিচারপতি প্রশ্ন করেন পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসতে কতক্ষন লাগে। পিরোজপুর তো বিদেশ নয়। আরেক বিচারপতি প্রশ্ন করেন কেন তাকে হাজির করা অসম্ভব।
তখন ১৯(২) ধারায় ১৫ জনের জবানবন্দী গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনাল যে আদেশ দিয়েছিল তা পড়ে শুনিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সাক্ষীদের একটি মহল থেকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। তারা বাড়িছাড়া। তাদের বাড়ি পাওয়া যাচ্ছেনা। আইউব আলী হাওলাদারের ছেলে মেয়েরা তদন্ত কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেছে তার পিতাকে যেন সাক্ষ্য দিতে ঢাকায় না নেয়া হয়। বাড়িতে দুই জন লোক এসে হুমকি দিয়ে গেছে ।
এ পর্যায়ে যুক্তি উপস্থাপনে একটা বেজে যায় এবং তখন প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন আগামীকাল পইড়া দেইখা আইসেন।  না হলে আপনাকে বসিয়ে দেয়া হবে।


সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

নবম ও দশম সাক্ষীর সাক্ষ্য: সাক্ষী বললেন মীর কাসেম আলী ছাড়া অন্যকোন রাজাকার, আল-বদরকে চিনিনা

২৪/২/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের নবম ও দশম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। আজ  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ নবম সাক্ষী মো: সালাউদ্দিন ও দশম সাক্ষী মো: জাকারিয়ার জবানবন্দী গ্রহণ করার পর আসামীপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম তাদের জেরা করেন। জেরায় দশম সাক্ষী মো: জাকারিয়া বলেন, আমি মীর কাসেম আলী ছাড়া অন্যকোন রাজাকার ও আল-বদরকে চিনিনা। 
জেরা শেষে আগামীকাল মঙ্গলবার পরবর্তী সাক্ষীর জবনবন্দী গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে।


নবম সাক্ষী মো: সালাউদ্দিনের জবানবন্দী (সংক্ষিপ্ত) : 
জবানবন্দীতে সাক্ষী সালাউদ্দিন বলেন, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর আল-বদররা আমাকে এবং আমার চাচা মো: জাকারিয়া, জেঠাতো ভাই নাজেম, জাফর ও চাচা এস্কান্দারকে ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। ডালিম হোটেলের একটি কে আমাদের ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তারা মেরে চলে যায়। আটক করার দু’তিন দিন পর আল-বদররা দরজা খুলে আমাদের এলোপাতাড়ি পেটায়। এর চার বা পাঁচদিন পর কেউ একজন আমাদের কে প্রবেশ করে আমার নাম ধরে ডাকে। ডাক শুনে সামনে এলে লোকটি আমার চোখ বেধে ডালিম হোটেলের উপরে নিয়ে যায় এবং আমাকে বলে, আমাদের কমান্ডার মীর কাশেম আলী তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এরপর আমী মীর কাসেম আলীর সামনে গেলে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করে বল কোথায় অস্ত্র আছে এবং মুক্তিবাহিনীরা কোথায় আছে। না বললে তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে কর্নফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেব। আমি কোন তথ্য না দেয়ায় মীর কাশেম আলীর নির্দেশে আল-বদরা আমাকে নির্যাতন করতে থাকে। 
আটকের এক পর্যায়ে আমার বাবা জনৈক আজিম সওদাগরের সহযোগিতায় আমাকে ছাড়িয়ে আনতে ডালিম হোটেলে যান। আমাকে আবার নিচ তলা থেকে হোটেলের ওপর তলায় নিয়ে আসে। তখন মীর কাশেম আলী বাবাকে দেখিয়ে বলেন, উনি কি তোমার বাবা? আমি হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলে মীর কাশেম আলী বলেন, তোমার বাবার জন্য তুমি এবার বেঁচে গেলে। এরপর আমি বাবার সাথে বাড়িতে চলে আসি।
জবানবন্দী শেষে আসামীপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সাক্ষীকে জেরা করেন।
জেরা:
প্রশ্ন : আপনি স্বাধীনতার আগে ও পরে মীর কাসেম আলীকে দেখেননি।
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : ডকে (আসামীর কাঠগড়ায়) একজন ব্যক্তি আছে আপনি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে এসেছেন।  
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পর থেকে আটক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আপনি রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীর সদস্য রাকা ছিল বা তারা কোথায় থাকতো সে সম্পার্কে আপনার কোন ধারণা ছিল?
উত্তর : রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীর নাম শুনলেও তারা কোথায় থাকত সে সম্পার্কে আমার কোন ধারণা ছিল না।
প্রশ্ন : মতিউর রহমান ওরফে মইত্যা গুন্ডার নাম শুনেছেন?
উত্তর : শুনেছি।
প্রশ্ন : আপনি কখন থেকে ডালিম হোটেলের নাম শুনেছেন?
উত্তর : পাকিস্তান আমল থেকে।
প্রশ্ন : ডালিম হোটেলের তৎকালীন মালিক চন্দ্র মোহন নাথের নাম শুনেছেন?
উত্তর : শুনিনি।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে মইত্যা গুন্ডা ডালিম হোটেল দখল করে ছিল, এটা আপনি শুনেছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনার চাচা এস্কান্দারকে কি কারণে চাকরি থেকে চলে এসছিল?
উত্তর : জানি না।
প্রশ্ন : আপনাকে ডালিম হোটেলে আটক করা হয়নি বা নির্যাতন করা হয়নি।
উত্তর : সত্য নয়।

দশম সাক্ষীর জবানবন্দী ও জেরা:
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে দশম মো: জাকারিয়া জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালের রমজানের ঈদের ৫/৭ দিন পর আমি বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ ভোররাতে ঘরের দরোজায় কড়া নাড়ার শব্দ পাই। দরোজা খুলে দুজন সশস্ত্র আল-বদর সদস্য দেখতে পাই। তারা আমাকে ধরে আমার ভাতিজা জাফর, সালাউদ্দিন, নাজিম এবং জেঠাতো ভাই এস্কান্দারসহ আরো অনেককে প্রথমে এমএমসি স্কুল মাঠ, তারপর ট্রাকে করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়।
আটকের দু’তিনদিন পর আমাকে হোটেলের উপর তলায় নিয়ে যায়। দোতলায় নিয়ে আমাকে আল-বদররা মুক্তিবাহিনী এবং তাদের অস্ত্র-শস্ত্র কোথায় এই তথ্য দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। আমি অপারগতা প্রকাশ করলে তারা আমার উপর নির্যাতন করতে থাকে। এপর্যায়ে আরেকটি লোক এসে একই তথ্য জানতে চাইল। অপারগতা প্রকাশ করলে আমাকে আবারও পেটাতে বলে। তখন আল-বদররা আবার নির্যাতন শুরু করে। এরপর আমার নিজের নিয়ে যায়। যে আল-বদররা আমাকে এতক্ষোণ যাবৎ নির্যাতন করেছিল তারা বলাবলি করছিল যে লোকটি পরবর্তীতে এসে আবার পেটাও বলে উক্তি করেছিল তার নাম মীর কাসেম আলী। এর দু’এক দিন পর আমার বাবা ও চাচা মান্নান সওদাগর এসে আল-বদর ক্যাম্প থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়।
জবানবন্দী শেষে আসামীপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সাক্ষীকে জেরা করেন।

জেরা:
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে রাজাকার ও আল-বদররা আপনাদের এলাকায় না এলাকার বাইরে ছিল?
উত্তর : বলতে পারব না।
প্রশ্ন : যে আল-বদররা আপনাকে ধরে নিয়ে যায় তারা কি মুখোশ পরা ছিল?
উত্তর : হ্যাঁ, মুখোশ পরা ছিল।
প্রশ্ন : আপনি মীর কাসেম আলীকে যুদ্ধের আগে চিনতেন?
উত্তর : না, চিনতাম না।
প্রশ্ন : স্বাধীনতা যুদ্ধের পরেও দেখেননি।
উত্তর : দেখিনি।
টু কোর্ট: প্রশ্ন : আপনি মীর কাসেম আলীকে কবে কোথায় দেখেছেন?
          উত্তর : ডালিম হোটেলে আটক অবস্থায় দেখেছি। 
প্রশ্ন : আপনি মীর কাসেম আলী ছাড়া অন্য কোন রাজাকার বা আল-বদরকে চেনেন না।
উত্তর : সত্য, মীর কাসেম আলী ছাড়া অন্য কোন রাজাকার, আল-বদরকে চিনি না।
প্রশ্ন : আপনার বর্ণিত নাজির বাড়ির দিক থেকে আসা আল-বদররাও কি মুখোশ পরা ছিল? 
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : আপনাদের আটক করার সময় আল-বদরদের সাথে কি পাকিস্তান আর্মি ছিল?
উত্তর : হ্যাঁ, ছিল।
প্রশ্ন : এনএমসি স্কুলের সামনে আল-বদরদের সাথে কি পাকিস্তান আর্মি দেখেছেন?
উত্তর : হ্যাঁ, দেখেছি। তারা ডালিম হোটেল পর্যন্ত গিয়েছিল। 
প্রশ্ন : শান্তি কমিটি সম্পার্কে আপনার কোন ধারণা আছে?
উত্তর : শান্তি কমিটি সম্পার্কে আমার কোন ধারণা নেই।
প্রশ্ন : আপনাদের এলাকায় কোন রাজাকার ক্যাম্প দেখেছেন?
উত্তর : না, দেখিনি।
প্রশ্ন : যুদ্ধের সময় আপনি কি বাড়ি থেকে চকবাজারে নিয়মিত যাতায়াত করতে?
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : আপনি ডালিম হোটেল কখন থেকে চিনতেন?
উত্তর : যুদ্ধের আগে থেকে চিনতাম।
প্রশ্ন : আপনাকে ডালিম হোটেলের দোতলায় কি একবারই নেয়া হয়?
উত্তর : এক বারই নেয়া হয়।
প্রশ্ন : আপনার জবানবন্দীতে বর্ণিত আটক ও নির্যাতন সম্পার্কে এ পর্যন্ত কোন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেননি।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : ’৭১ সালে আপনাকে ডালিম হোটেলে আটক রাখা বা মীর কাসেম আলীর উপস্থিতিতে নির্যাতন করা বিষয়ে যা বলেছেন তা শেখানো মতে বলেছেন।
উত্তর : সত্য নয়।

মাওলানা সাঈদীর আপিল// সাক্ষী বিবেচনায় ট্রাইব্যুনালের ডাবল স্টাডার্ন্ড ভূমিকা -আইনজীবী

মেহেদী হাসান, ২৪/২/২০১৩
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আজ ১৯তম অভিযোগ তথা জোর করে হিন্দুদের ধর্মান্তরকরন বিষয়ে আসামী পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহণ করেন।

অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান ট্রাইব্যুনালের রায় থেকে ১৯ নং অভিযোগ পড়ে শুনিয়ে বলেন, মধুসূদন ঘরামী, কৃষ্ণ, অজিত কুমার শীল, বিপদ সাহা, গৌরাঙ্গ সাহা, ফকির দাস, হরিদাস, মহামায়া, অন্নরানী, কমলারানীসহ ১০০-১৫০ জন হিন্দুদের জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করানোর পর তাদেরকে তজবি টুপি জায়নামাজ দিয়ে মসজিদে  যেতে এবং নামাজ পড়তে বাধ্য করানোর অভিযোগে মাওলানা সাঈদীতে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
এসময় একজন বিচারপতি বলেন, আপনি যে ২০ জনের নাম আপনি পড়ে শোনালেন তাদের মধ্যে কয়জনকে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষী করা হয়েছে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, এদের মধ্যে মধুসূদন ঘরামী এবং গৌরাঙ্গ সাহাকে সাক্ষী হিসেবে আনা হয়েছে। অজিত কুমার শীল সাক্ষী ছিল কিন্তু সে আসেনি এবং তার জবানবন্দী ১৯ (২) ধারায় গ্রহণ করা হয়েছে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ধর্মান্তরকরনের সময়কাল হিসেবে চার্জে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে এদেরকে ধর্মান্তরকরন করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষেরই দাবি যে, পাড়েরহাটে আর্মি আসে ১৯৭১ সালের ৭ মে। এরপর সেখানে রাজাকার, শান্তিকমিটি এবং পাক আর্মির অপকর্ম শুরু হয়। আর ধর্মান্তরকরন ঠিক কোন সময়ে হয়েছে সে বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট মাস বা সময় উল্লেখ নাই। কাজেই আসামীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ টেকেনা।

তিনি বলেন, ধর্মান্তরকরন বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের ২, ৩, ৪, ১৩ এবং ২৩ নং সাক্ষীর ওপর নির্ভর করা হয়েছে।

২ নং সাক্ষী রুহুল আমিন নবিন বলেছেন, শান্তি কমিটির লোকেরা লুটপাট অগ্নিসংযোগ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং ননীসাহা, মাখন সাহা, ডা. গণেশ চন্দ্র রায়, ডা. সতিশ চন্দ্র রায়, সুধীর চন্দ্র রায় গৌরাঙ্গসহ স্থানীয় অনেক হিন্দুকে জোর করে মুসলমান বানায়।

এসময় একজন বিচারপতি প্রশ্ন করেন যাদের বিরুদ্ধে জোর করে মুসলমান বানানোর অভিযোগ রয়েছে তাদের মধ্যে এখন জীবিত আছে কারা। অ্যাডভোকে শাহজাহান বলেন, মোসলেম মাওলানা জীবিত আছে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ২ নং সাক্ষী রুহুল আমিন নবিন সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের ৯ নং সাক্ষী বলেছেন তিনি যুদ্ধের শুরুতে এলাকা ছেড়ে চলে যান এবং ১৮ ডিসেম্বর তিনি তাকে পাড়েরহাট প্রথম দেখেন। কাজেই যুদ্ধের সময় রুহুল আমিন নবিন এলাকায় ছিলনা এবং ধর্মান্তারকরনের বিষয়ে তার অভিযোগও টেকেনা।
রাষ্ট্রপক্ষের ৩ নং সাক্ষী মিজানুর রহমান তার জবানবন্দীতে বলেছেন কথিত সাঈদী ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের ধরে এনে জোরপূর্ব ধর্মান্তকরণ করেন।
জেরায় তাকে প্রশ্ন করা হয় মুসলমান হওয়ার বিষয়ে তিনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীতে বলেছিলেন কি-না। তিনি জবাব দেন স্মরন নেই । তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরায় প্রশ্ন করা হয় কথিত সাঈদী ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের ধরে এনে জোর করে ধর্মান্তরকরন করেন একথাটি আপনাকে সাক্ষী বলেছিল কি-না। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, তার নিকট সাক্ষী একথা বলেনি।
রাষ্ট্রপক্ষের ৪ নং সাক্ষী সুলতান আহমেদ হাওলাদার ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, ভানু সাহার বাপ ভাই সকলকে মুসলমান বানিয়ে তাদেরকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে বাধ্য করে।
জেরায় তাকে প্রশ্ন করা হয় ভানু সাহার বাপ-ভাই সকলকে মুসলমান বানানোর কথা তিনি তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছিলেন কি-না। জবাবে সে জানায় স্মরন নেই। তদন্ত কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে জেরায় প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সাক্ষী সুলতান আহমেদ তার নিকট একথা বলেননি।

অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ভানুসাহার বাপ এবং ভাইরা দেশে আছে। কিন্তু তাদের সাক্ষী করা হয়নি। ভানু সাহার তিন ভাইর মধ্যে দুইজন অসুস্থ। কিন্তু বড়ভাই রামসাহা সুস্থ  আছে। ভানুসাহার বাপ ভাইকে মুসলমান বানানোর অভিযোগ। কাজেই রামসাহাকে সাক্ষী করা হলেই তিনি এ বিষয়ে সবচেয়ে ভাল সাক্ষ্য দিতে পারতেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন রামসাহাকে এ বিষয়ে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তিনি তাকে  সাক্ষী করেননি।
ট্রাইব্যুনালের রুলে বলা আছে আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানের ভার রাষ্ট্রপক্ষের। এবং আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করতে হলে সন্দোহীতভাবে অভিযোগ প্রমান করতে হবে।

এসময় একজন বিচারপতি বলেন, দুয়েকজন সাক্ষী না আনলেই কি বলা যাবে সন্দোহাতীতভাবে প্রমানিত হয়নি। যারা এসেছে তাদের সাক্ষ্য থেকে যদি প্রমানিত হয় তাহলে কি দোষী সাব্যস্ত করা যাবেনা?
অ্যাডভোকেট শাহাজহান বলেন, যারা এসেছে তাদের সাক্ষ্য থেকে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়নি।
এসময় একজন বিচারপতি বলেন, ৪০ বছর পরের ঘটনা। সবাই আসবে এটা আশা করা যায়না। সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়েও সমস্যা আছে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, কিন্তু ভানু সাহার বাপ ভাই এ মামলায় ভাইটাল সাক্ষী হতে পারত।
তখন ওই বিচারপতি বলেন, এজন্যইতো ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে সাজা উল্লেখ করেনি।

অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের চুতর্থ সাক্ষী সুলতান আহমেদের কলাচুরি মামলায় জজকোর্টে সাজা হয়েছে এবং এ মামলাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া ট্রলার চুরির দায়ে আরো দুটি মামলা বরিশালে বিচারাধীন রয়েছে। এরকম সাক্ষীর ওপর নির্ভর করা হয়েছে অভিযোগ প্রমানের ক্ষেত্রে। এসময় একজন বিচারপতি বলেন, চুরির মামলায় সাজা হয়েছে কোথায় আছে দেখান। তখন অ্যাডভোকেট শাহাজান চুরির মামলায় সাজা হওয়া বিষয়ে  সাক্ষী সুলতান আহমেদের  জেরা থেকে এ বিষয়ে তারই স্বীকারোক্তি পড়ে শোনান আদালতে।
রাষ্ট্রপক্ষের ১৩ নং সাক্ষী গৌরাঙ্গ সাহা ট্রাইব্যুনালে বলেছেন পিরোজপুর থেকে তার তিন বোনকে বাসায় ফেরত পাঠানোর কিছুদিন পর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তার  মা বাবা ভাই বোন পরিবারের সবাইকে মুসলমান বানায়। মসজিদে নিয়া নামাজ পড়ায়। ‘এ লজ্জায় আমার মা বাবা ভাইবোন সবাই ভারতে চলে যায়। আমি একাই এদেশে    আসি। তারা আরো অনেক হিন্দুকে মুসলমান বানায়। একশ থেকে দেড়শ হবে। এর  মধ্যে কয়েকজন হল নারায়ন সাহা, নিখিল পাল, গৌরাঙ্গ পাল, সুনীল পাল। এদের  অনেকে ভারতে চলে গেছে। অনেকে মারা গেছে। আমাকে মুসলমান বানিয়ে নাম দেয় আব্দুল  গনি। হাতে তজবী টুপি দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর আমি আবার নিজ ধর্মে ফিরে  আসি।’


অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী ১৯৭১ সালে সাক্ষীর বয়স ছিল ৭/৮ বছর। আর সাক্ষী বলেছেন তার তিন বোন ময়ামায়া, অন্নরানী এবং কমলারানী  তার ছোট ছিল। কাজেই এত ছোট মেয়েদের  ধর্মান্তারকরনের অভিযোগ টেকেনা। 
জেরায় তাকে প্রশ্ন করা হয় ‘আমার বোনেরা বাসায় আসার পর সবাইকে মুসলমান বানানো হয়..... তারা আরো অনেক হিন্দুকে মুসলমান বানায়। একশ থেকে দেড়শ হবে।’ একথাগুলো আপনি তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রদত্ত জবানবন্দীতে বলেননি। সাক্ষী বলেন বলেছি। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার বোনেরা বাসায় আসার পর সবাইকে মুসলমান বানানো হয়..... তারা আরো অনেক হিন্দুকে মুসলমান বানায়’ একথাগুলো সাক্ষী তাকে বলেনি।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, সাক্ষী গৌরাঙ্গ সাহা তিন বছর আগে সরকারের তরফ থেকে আশ্রয়ন প্রকল্পে একটি বরাদ্দ পেয়েছেন।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ৯ নং অভিযোগ যথা আব্দুল হালিম বাবুলের বাড়িতে লুটপাট এবং আগুন দেয়ার অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। এ অভিযোগ বিষয়ে সাক্ষী ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের ১৪ নং সাক্ষী আবদুল হালিম বাবুল। অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন,  ট্রাইব্যুনাল রায়ে এ অভিযোগের পক্ষে আবদুল হালিমের সাক্ষ্য আমলে নেয়া হয়া হয়নি। তাকে অবিশ্বাস করা হয়েছে।  এ অভিযোগ থেকে খালাসের বিষয়ে রায়ে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে  তাতে আবদুল হালিম বাবুলের সাক্ষ্য নাকচ করা প্রসঙ্গে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আবদুল হালিম বাবুলের জন্ম তারিখ ৬/৬/১৯৬০। ১৯৭১ সালে সে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিল। কাজেই তখন তার পক্ষে সাঈদীকে চেনা সম্ভব ছিলনা।

আবদুল হালিমের বয়স কম হওয়ার কারনে  ৯ নং অভিযোগের ক্ষেত্রে তাকে অবিশ্বাস করল ট্রাইব্যুনাল। অপর দিকে আসামী পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপক্ষের ১৩ নং     সাক্ষী গৌরাঙ্গ সাহার বিষয়ে ডকুমেন্ট দিয়ে দেখানো হয়েছে যে জাতীয় পরিচয়পত্রে  তার জন্ম তারিখ লেখা রয়েছে ৮/৭/১৯৬৩। সে হিসেবে ১৯৭১ সালে তার বয়স  দাড়ায় ৭/৮ বছর। কিন্তু মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯ নং তথা ধর্মান্তরকরন অভিযোগ প্রমানের ক্ষেত্রে ৭/৮ বছর বয়স্ক গৌরাঙ্গ সাহার সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করা হয়েছে ।

তখন একজন বিচারপতি বলেন, এখানে তাহলে আপনার বক্তব্য হল ট্রাইব্যুনাল ডাবল স্টান্ডার্ড ভূমিকা পালন করেছে। একটি কোর্ট ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ভূমিকা পালন করতে পারেনা। আদালত বৈষম্য করতে পারেনা।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান উক্ত বিচারপতির মন্তব্য পুনরুক্তি করে বলেন, এটাই আমার বক্তব্য।

রাষ্ট্রপক্ষের ২৩ নং সাক্ষী মধুসূদন ঘরামী বলেছেন, ‘কৃষ্ণসাহা, গনেশ আর আমি একদিন বাজারের মসজিদে বসে মুসলমান হই। দুই তিন পর কৃষ্ণসাহা মারা যায়। মুসলমান হয়েও বাঁচতে পারলনা। মুসলমান বানানোর পর আমার নাম হয় আলী আশরাফ আর গনেশের নাম হয় আলী আকবর।’

মুধুসূদন ঘরামীকে জেরায় প্রশ্ন করা হয় ‘ কৃষ্ণসাহা, গনেশ আর আমি একদিন বাজারের মসজিদে বসে মুসলমান হই.... মুসলমান বানানোর পর আমার নাম হয় আলী আশরাফ আর গনেশের নাম হয় আলী আকবর’ একথাগুলো আপনি তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেননি। সাক্ষী জবাব দেন স্মরন নেই। আর তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরায় এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কৃষ্ণসাহা, গনেশ আর আমি একদিন বাজারের মসজিদে বসে মুসলমান হই.... মুসলমান বানানোর পর আমার নাম হয় আলী আশরাফ আর গনেশের নাম হয় আলী আকবর’ এ কথাগুলো সাক্ষী আমাকে বলেনি।

অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মুধসূদন ঘরামী বলেছেন, দেলোয়ার নামে একজন রাজাকার ছিল। সে পরে পরিচয় দিত দেলোয়ার শিকদার। এখন শুনছি সাঈদী আগে শুননিনি জবানবন্দী প্রদানের সময় দুই/তিনটি প্রশ্নের পর তিনি একথা বলেন। মধুসূদন ঘরামী বলেছেন রাজাকার দেলোয়ার শিকদারকে ১৯৭১ সালের পর মেরে ফেলা হয়েছে এবং তাকে পিরোজপুরে হত্যা করা হতে পারে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, মাওলানা সাঈদীর নাম কখনো শিকদার ছিলনা। শিকদার নামে যে ছিল তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাকে যদি মেরে ফেলা না হত এবং সে যদি এখনো জীবিত থাকত এবং রাষ্ট্রপক্ষ যে দাবি করছে শিকার এখন সাঈদী নামে পরিচিত তাহলে এ দাবির  একটা অর্থ থাকত। কিন্তু শিকদার মারা গেছে। কাজেই দেলোয়ার শিকদার এবং দেলাওয়ার সাঈদী সম্পূর্ণ আলাদা দুজন ব্যক্তি এবং তাদের পিতার নামও আলাদা। এসময় একজন বিচারপতি বলেন, একথাটা আপনি আগেও কয়েকবার বলেছেন। আমাদের মনে আছে। আর বলার দরকার নেই।
এরপর শুনানী আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
শুনানীতে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহানকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানীতে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।


রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অষ্টম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ

২৩.০২.১৪
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ সাক্ষী ইস্কন্দার আলম চৌধুরীর জবানবন্দী গ্রহণ করার পর আসামীপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম তাকে জেরা করেন। এরপর আগামীকাল সোমবার পরবর্তী সাক্ষীর জবনবন্দী গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে।

জবানবন্দী (সংক্ষিপ্ত): জবানবন্দীতে সাক্ষী বলেন, আমি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে মৌরিপুর এয়ারবেজে গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়র হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ’৭১ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে এক সুযোগে পালিয়ে ঢাকায় আসি। ওই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপন্ন থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আমি চট্টগ্রামের নিজ বাড়িতে আসি। এর পরের দিন আমার বড়ভাই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও তৎকালীন নগর আওয়ামী লীগের সদস্য মরহুম শামসুল আলম চৌধুরীর গোপন আস্তানায় থাকি।
১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর আল-বদর বাহিনী ও পাকিস্তান আর্মি আনুমানিক ভোর ৪টার দিকে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। ওই সময় আমাকে আটক করে অন্যান্য আটককৃতদের সাথে ট্রাকে করে আল-বদরের নির্যাতন ক্যাম্প ডালিম হোটেলে নিয়ে আসে। এরপর ট্রাক থেকে সকলকে নামিয়ে ডালিম হোটেলের নিচতলায় ছোট্ট একটি কক্ষে ঢোকানো হয়। ওই কক্ষে নিয়ে আসার দু’একদিন পর আমাকে চোখ ও হাত বেধে হোটেলের দ্বিতীয় তলায় একটি রুমে নিয়ে যায়। রুমে যাওয়ার পর কোন একজন লোক বলল, ‘খান কোথায়? উত্তরে কেউ একজন মীর কাসেম আলী সাহেব আমি আসছি।’ এরপর একজন আমার কক্ষে প্রবেশ করে উপর্যুপরি কিলঘুষি ও লাথি মেরে ফোরে ফেলে দেয় এবং ইলেট্রিক ওয়ার দিয়ে পেটাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে নির্যাতনকারীদের একজন আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয়। চোখ খুলে যাওয়ার পরে আমি মীর কাসেম আলীসহ আরেকজনকে দেখতে পাই। যিনি সম্ভবত পূর্বে উল্লেখিত খান হতে পারে। এরপর আমাকে ডালিম হোটেলের দ্বিতীয় তলা থেকে নীচতলায় আনা হয়। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ডালিম হোটেলে লোকজনের আনাগোনা কমে এসছে বলে বুঝতে পারি। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর সকালে স্থানী লোকজন ডালিম হোটেলে এসে যে কক্ষে আটক ছিলাম তার দরজা ভেঙ্গে আমাকে উদ্ধার করে।

জেরা:
জবানবন্দী শেষে আসামীপক্ষের আইনজীবী সাক্ষীকে জেরা করেন।
প্রশ্ন : আপনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পর্যন্ত মীর কাসেম আলীকে দেখেছেন?
উত্তর : না, দেখিনি।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আপনি স্বচোখে মীর কাসেম আলীকে দেখেছেন?
উত্তর : না, দেখিনি।
প্রশ্ন : আজ ডকে (আসামীর কাঠগড়ায়) একজন ব্যক্তি উপস্থিত আছে?
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আজ এই ট্রাইব্যুনালে এসেছেন?
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে মীর কাসেম আলী কোথায় থাকতেন সে সম্পার্কে আপনার ধারণা আছে?
উত্তর : কোথায় থাকতেন সে সম্পার্কে ধারণা নেই।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে আপনি কি পাকিস্তানের মৌরিপুর এয়ারবেজ থেকে পালিয়ে যান?
উত্তর : হ্যাঁ। 
প্রশ্ন : আপনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়ার কোন আবেদন করেছেন?
উত্তর : না, করিনি।
প্রশ্ন : পাকিস্তানের মৌরিপুর এয়ারবেজ থেকে করাচী এয়ারপোটের দূরত্ব কত?
উত্তর : আনুমানিক ১০-১২ কিলোমিটার।
প্রশ্ন : বিমানবাহিনী থেকে কেউ পালিয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করা হয়।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি পাকিস্তানের মৌরিপুর থেকে কিভাবে ঢাকায় আসেন?
উত্তর : বিমানযোগে এসেছি।
প্রশ্ন : কোন বিমানে এসেছেন?
উত্তর : সম্ভবত পিআইএ এর বিমানযোগে ঢাকায় এসেছি।
প্রশ্ন : আপনি কোন পথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গেছেন?
উত্তর : আমি সড়কপথ, নৌপথ ও রেলপথ ব্যবহার করেছিলাম।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় সড়কপথ ও রেলপথ বিদ্ধস্ত ছিল কি?  
উত্তর : হ্যাঁ। তবে নৌপথ বিদ্ধস্ত ছিল না। 
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি কিভাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যান?
উত্তর : ঢাকা থেকে প্রথমে সদরঘাট হয়ে নৌপথে চাঁদপুর পৌছাই।
প্রশ্ন : আপনার বাড়ি চট্টগ্রামের কোথায়?
উত্তর : চট্টগ্রাম পাচলাইশ থানার অধীনে ছিল।
প্রশ্ন : সৈয়দ মো: এমরানের ঘাটিটি পাচলাইশ থানার অধীনে ছিল।
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : আপনি কখন সৈয়দ মো: এমরানের ঘাটিতে গিয়ে ছিলেন?
উত্তর : কোন সময় গিয়েছিলাম তা মনে নেই। 
প্রশ্ন : সৈয়দ মো: এমরান পাকিস্তান আর্মিদের বিরুদ্ধে কোন সম্মুখ যদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন কি?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের কোথায় কোথায় আল-বদর ক্যাম্প ছিল?
উত্তর : ডালিম হোটেলে আল-বদর ক্যাম্প ছিল আমি নিশ্চিত। তবে চকবাজারে আল-বদর ক্যাম্প ছিল বলে শুনেছি।
প্রশ্ন : আপনি ১৯৭১ সালে করাচী থেকে ঢাকায় এসে চট্টগ্রামে নিজ বাড়িতে যাওয়ার পথে পাকিস্তান আমি ও আল-বদরদের টহল দিতে দেখেছেন?
উত্তর : হ্যাঁ, দেখেছি।
প্রশ্ন : আপনি আটক হওয়ার আগে আপনার দেখা আল-বদরদের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি ডালিম হোটেলে আটক অবস্থায় আল-বদরদের সাথে পাকিস্তান আর্মিদের দেখেছেন?
উত্তর : দু’একজন পাকিস্তন আর্মি দেখেছি।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে জালাল আহমেদ চৌধুরী নামে কোন রাজাকারের নাম শুনেছেন? 
উত্তর : শুনিনি।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে মতিউর রহমান নামের রাজাকারের নাম শুনেছেন?
উত্তর : শুনিনি, তবে কোরবানীগঞ্জের মইত্যা গুন্ডা নামে একজনের নাম শুনেছি।
প্রশ্ন : আপনি জানেন মইত্যা গুন্ডা ১৯৭১ সালে ডালিম হোটেল দখল করেছিল।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি কি জানেন ডালিম হোটেলের মালিক কে ছিল?
উত্তর : আমি জানার চেষ্টা করিনি।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে মইত্যা গুন্ডা ডালিম হোটেল দখল করেছিল।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে আপনি চাকরি থেকে পালায়ন করে আসার কারণে আপনাকে গ্রেফতার করে জেলে আটক রাখা হয়।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : সৈয়দ মো: এমরান ৮০ বছরের অধিক বয়স্ক আবুল কাসেমকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় বন্দি ছিলেন বা ১৬ ডিসেম্বর তারিখে তিনি আপনার সাথে জেল থাকা অবস্থা থেকে মুক্তি পান। 
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনাকে ডালিম হোটেলে আটক রেখে নির্যাতনের ঘটনা সম্পর্কিত জবানবন্দী আপনি যা যা বলেছেন তা এই ট্রাইব্যুনালে প্রথম বললেন।
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডালিম হোটেল দখল রাখার অভিযোগে রাখার অভিযোগে কোন মামলা হয়ে ছিল কি না?
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : আপনাকে আটক করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া, সেখানে মীর কাসেম আলীর উপস্থিতিতে নির্যাতন করার বিষয়ে আপনি অসত্য সাক্ষ্য দিয়েছেন।
উত্তর : সত্য নয়।

##

মাওলানা সাঈদীর আপিল আবেদন বিষয়ে আজকে উপস্থিত যুক্তি


মেহেদী হাসান
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাাইন সাঈদীর মামলায় আজ আবার আপিল বিভাগে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়েছে। প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহণ করেন।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান ১৪ নং অভিযোগ যথা শেফালী ঘরামীকে ধর্ষনের অভিযোগ বিষয়ে  আগের দিনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আজ যুক্তি পেশ শুরু করেন।
তিনি বলেন, ১৪ নং অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করার পক্ষে  ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের ১, ২, ৪ এবং ২৩ নং সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। কিন্তু ১, ৩ এবং ৪ নং সাক্ষী এ বিষয়ে একটি কথাও বলেনি।
উপরন্তু ১ নং সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার তদন্ত সংস্থায় পূর্বে যে রিপোর্ট দাখিল করেছেন তাতে তিনি দাবি করেছেন জিয়ানগরে কোন বীরাঙ্গনা নেই। এটি রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেছে।

তাহলে ১৪ নং অভিযোগ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের শুধুমাত্র একজন সাক্ষী থাকে এবং তিনি হলেন মধুসূদন ঘরামী। একমাত্র এ একজন সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এ অভিযোগে। কিন্তু মধুসূদন ঘরামী বলেছেন তিনি তার স্ত্রীকে ধর্ষনের ঘটনা দেখেননি। তার স্ত্রীর বরাত দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তোমাকে যে মুসলমান বানিয়েছে সে এসেছিল তুমি পালাও।’
কে তাকে মুসলমান বানিয়েছিল তা কি শেফালী ঘরামীর পক্ষে জানা সম্ভব?
সম্ভব যদি মধুসূদন ঘরামী তাকে বলে থাকে। কিন্তু তাকে কে মুসলমান বানিয়েছিল সে কথা তিনি তার স্ত্রীকে বলেছেন মর্মে এভিডেন্সে কিছু নেই। বরং মধুসূদন ঘরামী বলেছেন, তার স্ত্রীর পাড়েরহাট বাজারে যাতায়াত ছিলনা। তার স্ত্রী কোন রাজাকার এবং পিস কমিটির কোন সদস্য চেয়ারম্যান মেম্বারকে সে চিনতনা।
মধুসূদন ঘরামী মাওলানা সাঈদীকে ডকে আইডেনটিফাই করেননি বরং তিনি  বলেছেন দেলোয়ার শিকদার নামে এক রাজাকার ছিল এবং তাকে স্বাধীনতার পর মেরে ফেলা হয়েছে।

‘তোমাকে যে মুসলমান বানিয়েছে সে এসেছিল তুমি পালাও’ কথাগুলো মধুসূদন তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছিল কি-না জেরায় প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমার স্মরন নেই।
তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরায় এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন আমাকে মধূসূদন ঘরামী এ কথা বলেননি।

১৯৭১ সালে মধুসূদন ঘরামীর কোন ঘরই ছিলনা। তিনি জেরায় বলেছেন, যুদ্ধের ২ বছর আগে তিনি তার অংশের জমি বিক্রি করেন এবং পরে তিনি তার মৃতভাই নিকুঞ্জ ওরফে সাধু ঘরামীর ঘরে ওঠেন।

মধুঘরামীর শশুর বাড়ি বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে। শেফালী ঘরামীর অবস্থান জানার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা বাগেরহাট যাননি এবং তার শশুরবাড়ি কোন খোঁজ খবর নেননি শেফলাী ঘরামী বিষয়ে। ভারতে যেখানে শেফালী ঘরামী থাকে সেখানেও কোন চিঠিপত্র পাঠাননি।
শেফালী ঘরামীর পিতা শ্রীনাথ এবং ভাই কার্তিক জীবিত আছে কিন্তু তাদের কাউকে এ মামলায় সাক্ষী করা হয়নি। তাদের কোন জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি।
তাছাড়া সাধু ঘরামীর স্ত্রী তথা মধুসূদনের বৌদি তখন ওই ঘরে থাকত এবং তিনি এখনো জীবিত । কিন্তু তাকেও তদন্ত কর্মকর্তা এ ঘটনা বিষয়ে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করেননি এবং সাক্ষীও করেননি।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফোর্সড প্রেগনেন্সির কথা লেখা আছে। ধর্ষনের ফলেই শেফালী ঘরামীর একটি মেয়ে হয়েছে এ কথা রায়ে কি করে লিখল।  মধুসূদন ঘরামী বলেছেন ঘটনার চার/পাঁচ মাস পরে  অগ্রহায়ন মাসে তার স্ত্রীর একটি কন্যা সন্তান হয় এবং তার নাম রাখা হয় সন্ধ্যা। ১৯৭১ সালের অগ্রহায়ন মাস  ইংরেজি নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাস হয়। নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে সন্তান জন্ম হলে ১৯৭১ সালে ফ্রেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে গর্ভধারন করা লাগে। আর পাড়েরহাট আর্মি আসার ঘটনা ঘটে মে মাসে। কাজেই মধুসূদনের বাড়ি লুট এবং তার স্ত্রীর ধর্ষনের ঘটনার সাথে আসামী এবং অভিযোগের কোন সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু রায়ে মন্তব্য করা হল ধর্ষনের ফলেই তার স্ত্রীর সন্তান হয়।

তদন্ত কর্মকর্তা মধুসূদন ঘরামী ছাড়া আর কাউকে এ ঘটনায় সাক্ষী করেনি। জেরায় তিনি বলেছেন অন্য কারোর জবানবন্দীও রেকর্ড করেননি।

১২টার পর
তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, মামলার তদন্তকাজে  তিনি ভারতে গেছেন। কিন্তু অন্যান্য অভিযোগ বিষয়ে খোঁজ খবর নিলেও তিনি শেফালী ঘরামী বিষয়ে কোন খোঁজ নেননি। তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ধর্ষনের ঘটনার তারিখ ও মাস সম্পর্কে কোন তথ্য তাকে সাক্ষী দেয়নি। তবে যুদ্ধের শেষ দিকে ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের ১ নং সাক্ষী মাহবুবুল আলম পিরোজপুর এবং তদন্ত সংস্থায় যে অভিযোগ দায়ের করেছেন তাতে তিনি শেফালী ঘরামীর ধর্ষণ বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ করেননি।
তদন্ত কর্মকর্তা আরো বলেছেন, ৩/১১/২০১০ তারিখে মধুসূদন ঘরামীর জবানবন্দী রেকর্ডের পূর্বে কেউ তাকে শেফালী ঘরামীকে ধর্ষনের বিষয়ে কোন তথ্য দেয়নি।
মধুসূদন ঘরামী বলেছেন, ২০১০ সাল থেকে তিনি এবং তার বৌদী বয়স্কভাতা পান। তিনি আসলে রাষ্ট্রীয় সুবিধার বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন।  মধুসূদন ঘরামী তার বৌদীর সাথে একান্নে খান।
আমাদের একটি ছবি ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়েছে যেটা হল মধুসূদনের ভিটা। এ ভিটা ১৯৭১ সালেও এভাবেই পরিত্যাক্ত ছিল বলে তদন্ত কর্মকর্তা জেরায়  স্বীকার করেছেন।

এরপর অ্যাডভোকেট শাহজাহান ১৬ নং অভিযোগ তথা গৌরাঙ্গ সাহার  তিন বোনকে ধর্ষনের বিষয়ে যুক্তি পেশ করেন। তিনি বলেন, রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের ৩, ৪ ৫, ১৩ নং সাক্ষী এবং ১৯ (২) ধারায় গৃহীত অজিত কুমার শীলের জবানবন্দীর ওপর নির্ভর করা হয়েছে এ অভিযোগে আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করা বিষয়ে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের ৩, ৪ এবং ৫ নং সাক্ষী এ অভিযোগ বিষয়ে একটি কথাও উচ্চারন করেননি। বাকী থাকল ১৩ নং সাক্ষী গৌরাঙ্গ সাহা। গৌরাঙ্গ বলেছেন, ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ২৭ বছর। কিন্তু আমরা একটি ডকুমেন্ট দিয়ে দেখিয়েছি যে, গৌরাঙ্গর জন্ম তারিখ ৮/৭/১৯৬৩। তিনি জেরায় বলেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্মতারিখ ৮/৭/১৯৬৩ লেখা। কিন্তু পরিচয়পত্র করার সময় তিনি নিজে ভুল বলেছেন না তারা ভুল লিখেছে তা তিনি জানেননা। তিনি এ ভুল সংশোধনের জন্য কোন দরখাস্তও দেননি। তাহলে সনদ অনুযায়ী তার বয়স ১৯৭১ সালে দাড়ায় ৭/৮ বছর। আর গৌরাঙ্গ সাহা বলেছেন, তার তিন বোনই তার ছোট। এক বছর পরপর জন্ম হলেও তার বোনদের বয়স দাড়ায় ৭, ৬ এবং ৫ বছর করে।
গৌরাঙ্গ সাহা বলেছেন, মুসলমান হবার পর তার পিতামাতা এবং তিন বোন ভারতে চলে যায়। ভারতে তারা কে কোথায় কিভাবে আছে তার কিছুই তিনি জানেননা। তার পিতা পাতার মৃত্যুর সংবাদ ছাড়া আর কোন তথ্যই তিনি ভারত থেকে পাননি।
এসময় একজন বিচারপতি বলেন, ৪২ বছর তার বোনরা কোথায় কিভাবে আছে তা না জানা একজন ভাই হিসেবে অস্বাভাবিক।
অ্যাডভোটেক শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের জমা দেয়া সরকারি ডকুমেন্টে বলা আছে জিয়া নগরে কোন বীরাঙ্গনা নেই।
তখন একজন বিচারপতি বলেন, এ রিপোর্ট কখন তৈরি করা হয়েছে?
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ২০১১ সালে।
তখন বিচারপতি বলেন, ঠিকই আছেতো। ২০১১ তারা ভারতে । দেশে নাই। তাই নাই লেখা হয়েছে।
তখন অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, আপনার যুক্তি ঠিক। কিন্তু আপনার এ দাবি আসামীর পক্ষেও যায়। নাই মানে যদি দেশে না থাকা বোঝায় তাহলে এর আরো একটি মানে করা যায় আর তাহল ১৯৭১ সালে সেখানে কোন ধর্ষনের ঘটনা ঘটেনি এবং কোন বীরাঙ্গনা জিয়া নগরে ছিলনা। সে কারনেই নাই লেখা হয়েছে।
এরপর তিনি সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে ১৯ (২) ধারায় গৃহীত অজিত কুমার শীল কর্তৃক তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দী পড়ে শোনান। অজিত কুমার শীল গৌরাঙ্গের তিন বোনকে ধর্ষনের অভিযোগ করে বলেছেন, যুদ্ধের সময় তারা ভারতে চলে যায়। এরপর আজো তার ফেরত আসেনি।
জেরায় তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করা হয়-  অজিত কুমার যে একজন ক্ষতিগ্রস্ত তা আপনি কবে জানলেন। তিনি বলেন, ডায়েরিতে লেখা না থাকায় তিনি বলতে পারছেননা। পাড়েরহাট কোন স্থানে অজিতের জবানবন্দী রেকর্ড করা হয় তাও তিনি তার ডায়েরিতে লেখা না থাকায় বলতে পারছেননা। তিনি বলেছেন তদন্তকালে তিনি কখনো অজিতের বাড়ি যাননি।
সমন নিয়ে যাবার তারিখও তিনি বলতে পারেননি।

অ্যাডভোকেট শাহজাহান ১৯ (২) ধারা পড়ে বলেন, কোন সাক্ষী বিচারচলাকালে মারা গেলে এবং তাকে ট্রাইব্যুনালে আনা যদি সময়সাপেক্ষ ও অতিরিক্ত ব্যায়বহুল হয় তবে তার অনুপস্থিতিতে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে তার প্রদত্ত জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
কিন্তু এ সাক্ষী মারা যায়নি। তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, অজিতকে হাজিরের জন্য তিনি ২/৩ বার অজিতের বাড়ি গিয়েছেন সমন নিয়ে। কিন্তু প্রথমবার যাওয়াসহ কোন তারিখই তিনি বলতে পারেননি। বাড়িতে গিয়ে তিনি তাকে প্রথমবার পাননি। তার স্ত্রী তখন বাড়িতে ছিল। দ্বিতীয়বার যাবার সময় তার স্ত্রী এবং ছেলে বাড়িতে ছিল বলে দাবি করেছেন তিনি।
অজিতকে না পেয়ে থানায় কোন জিডি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি তিনি। পরিবার কোন জিডি করেছেন কিনা তাও তিনি জানেননা। তার স্ত্রী ও ছেলে তাকে জানিয়েছে তার পিতা কোথায় তা তারা জানেনা। তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, অজানা কারনে সে পালিয়ে থাকতে পারে। পরে বলেছেন, তার ছেলে তাকে জানিয়েছে তার বাবা  সাক্ষ্য দিতে গেলে  তাকে মেরে ফেলা হতে পারে ।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, একজন মানুষ সাধারনত নিঁখোজ হলেও থানায় ডায়েরি হয়। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী এবং তার নিঁখোজের পর তদন্ত কর্মকর্তা কোন জিডি করেননি।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, আমরা একটি ডকুমেন্ট জমা দিয়েছিলাম যেখানে উল্লেখ আছে অজিত কুমার শিলকে ঢাকায় সাক্ষ্য দিতে আনা হয়েছিল এবং তাকে তিনদিন সেফ হোমে রাখা হয়। কিন্তু তিনি শেখানো মতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজী না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ তাকে বাড়িতে ফেরত পাঠায়। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ‘ট্রাইব্যুনালকে প্রসিকিউশনের ধোকা শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে অন্যান্য আরো অনেক সাক্ষীর সাথে অজিত কুমার শিলকে ২০১২  সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় আনা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের এনে যেখানে রাখে সেই উইটনেস হোম বা সেফহোমে  ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাকে রাখার পর বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, এ ধরনের সাক্ষীর ভেগ জবানবন্দী ১৯.২ ধারায় গ্রহণ  করা হয়েছে এবং আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করার পক্ষে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

সাক্ষী অজিতের নামে তদন্ত কর্মকর্তা যে জবনাবন্দী জমা দিয়েছেন তাকে ট্রাইব্যুনালে আনা হলে সে আসলে এ কথা বলতনা। সে কারনেই তাকে হাজির না করে ১৯/২ ধারায় দরখাস্ত দেয়া হয় ট্রাইব্যুনালে।
এসময় একজন বিচারপতি বলেন, গৌরাঙ্গ সাহার বয়স বিষয়ে রায়ে কি কিছু বলা হয়েছে বা আপনারা যে ডকুমেন্ট জমা দিয়েছেন সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ আছে?
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, একটি কথাও উল্লেখ নেই।
এরপর শুনানী আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
শুনানীতে অ্যাডভোকেট শাহজাহানকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন। রাষ্ট্রপক্ষে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।


বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আরো দুই সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ

১৯/২/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান (এমসি) মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ ও সপ্তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ ষষ্ঠ সাক্ষী মৃদুল কুমার দে ও সপ্তম সাক্ষী প্রদীপ তালুকদারের জবানবন্দী গ্রহণ করার পর আসামীপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম তাদের জেরা করেন। এরপর আগামী রোববার পরবর্তী সাক্ষীর জবনবন্দী গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে।

সাক্ষ্যগ্রহণের সময় মীর কাসেম আলী ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় বসে তা দেখেন। তার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মিজানুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম, অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিক ও অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দিন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও সাইফুল ইসলাম।

ষষ্ঠ সাক্ষী মৃদুল কুমার দের জবানবন্দী: আমার নাম মৃদুল কুমার দে। আমার বর্তমান ঠিকানা, ৬৫ হাজারী লেন। কোতয়ালী থানা, চট্টগ্রাম। ১৯৭১ সালে বয়স ছিল ১৬ বছর। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আস-শামস চট্টগ্রামের হাজারী লেনে নানাবিধ অত্যাচার নির্যাতন চালায়। তখন হাজারী লেনে দুই থেকে তিন শত পরিবার বসবাস করত। ওই ধ্বংসযজ্ঞের কারণে অধিকাংশ লোকজন এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। ’৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে টুনটু সেন ও রনজিত দাশকে আল-বদররা ধরে নিয়ে যায়। তাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার একদিন পর জানতে পারি মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে আল-বদররা এসে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে বদর বাহিনীর ক্যাম্পে নির্যাতন করে।
’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল বেলা দেশমুক্ত হওয়ার অবস্থায় ডালিম হোটেলের আশপাশে লোক দেখতে পাই। সেখানে আমি রনজিত দাশের স্ত্রী প্রভা রানি দাশকে দেখতে পাই। তিনি কেঁদে কেঁদে আমাকে বলে তার স্বামী ও টুনটু সেনকে এখনও খুজে পায়নি। তখন আমি সেখানে দাঁড়ানো অবস্থায় যারা বন্দি ছিলেন তাদের কাছ থেকে শুনতে পাই সম্ভবত টুনটু সেন ও রনজিত দাশকে মীর কাসেম আলীর লোকেরা মেরে ফেলেছে। টুনটু সেন ও রনজিত দাশকে খ্্ুঁজে পাওয়া যায়নি।

জেরা:
প্রশ্ন : আপনি কতদিন থেকে হাজারী লেনে বাস করছেন?
উত্তর : জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ’৭১ সাল পর্যন্ত এবং এখনো সেখানে আছি।
প্রশ্ন : ’৭১ সালে হাজারী লেনে আপনার বয়সী ৪০ বা ৫০ জন বেঁচে আছে। 
উত্তর : সত্য নয়। আমার জানা মতে দুইজন বেঁচে আছে।
প্রশ্ন : আপনার এলাকায় ’৭১ সালে যে টিএন্ডটি ভবন ছিলে তা চিনতেন?
উত্তর : হ্যা, চিনতাম।
প্রশ্ন : সেখানে আর্মি ক্যাম্প ছিল।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কতদিন পর আর্মি ক্যাম্প হয়েছিল?
উত্তর : তা আমি বলতে পারব না।
প্রশ্ন : আপনাদের এলাকার শান্তি কমিটির কেউ ছিল কি?
উত্তর : ছিল না।
প্রশ্ন : আপনাদের এলাকায় ’৭১ সালে ১৪টি স্থায়ী হিন্দু পরিবার ছিল।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : ডালিম হোটেল কখন থেকে চেনেন?
উত্তর : ’৭১ সালের আগের বছর থেকে দেখেছি।
প্রশ্ন : ডালিম হোটেলের মালিক বা তার পরিবারের কাউকে চেনেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি ’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পূর্বে ডালিম হোটেলে গিয়েছেন?
উত্তর : যায়নি।
প্রশ্ন : ’৭১ সালে আপনাদের এলাকার অজিত বনিক নামে কেউ ছিলেন?
উত্তর : এই নামে কেউ ছিলেন কিনা স্মরণ নেই।
প্রশ্ন : ’৭১ সালে আপনাদের এলাকার রনজন নাথ, বাবুল কান্তি নাথ ও চন্দ্র মোহন নামে কাউকে চিনতেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : মীর কাসেম আলীর বাড়ি কোথায় বা কি করতেন তা আপনি জানেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : টুনটু সেন ও রনজিত দাশকে কখন, কে এবং কিভাবে ধরে নিয়ে য়ায় তা কেউ আপনাকে বলেছে?
উত্তর : কেউ বলেনি।
প্রশ্ন : আপনি ৬৫ হাজারী লেনে থাকেন না?
উত্তর : ৬৫ হাজারী লেনে থাকি না। আমার বর্নিত হাজারী লেন ১৫৮/১৬৭ তে রূপান্ত্রিত হয়েছে।
প্রশ্ন : ১৬ ডিসেম্বর সকালে আপনি ডালিম হোটেলে গিয়েছিলেন এই কথাটি আপনি প্রথম এই ট্রাইব্যুনালে বলছেন।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : মীর কাসেম আলীর নির্দেশে টুনটু সেন ও রনজিত দাশকে ধরে নিয়ে যায়নি।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি শেখানো মতে অসত্য জবানবন্দী দিয়েছেন।
উত্তর : সত্য নয়।

সপ্তম সাক্ষীর জবানবন্দী ও জেরা:
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ষষ্ঠ সাক্ষীর জেরা শেষে সপ্তম সাক্ষী প্রদীপ তালুকদারের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। জবানবন্দীতে প্রদীপ তালুকদার বলেন, ’৭১ সালে আমার আনুমানিক বয়স ছিল ৬ বা ৭ বছর। আমি লেখা পড়া জানি না। ’৭১ সালে আমার মামা টুনটু সেনের বাড়িতে থাকতাম। ’৭১ সালে একদিন মামা টুনটু সেনের সঙ্গে শিব মন্দির মোড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে ঘোরাফেরারত আল-বদররা আমার মামাকে ডালিম হোটেলে ধরে নিয়ে যায়। তখন আমার দিদা (নানী) রসবালা ডালিম হোটেলে যান এবং মামাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেন। আল-বদররা বলে কমান্ডার না আসা পর্যন্ত ছাড়া যাবে না। আমার দিদা কমান্ডারের নাম জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে তার নাম মীর কাসেম আলী। আমার মামার সঙ্গে রনজিত দাশ ও আরো একজন মুসলমানকে আল-বদররা ধরে নিয়ে যায়। আমার দিদা একদিন ডালিম হোটেলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মামা জানালা দিয়ে দেখে তাকে ডাকে এবং এক পর্যায়ে ডালিম হোটেলের তৃতীয় তলা থেকে লাফ দিয়ে পাশের টিনের চালের উপর পড়ে। আমার দিদা তখন তাকে একটি চাটাই দিয়ে জড়িয়ে লুকিয়ে রাখে। কাসেম আলী তখন বলে ওকে ধর। এক পর্যায়ে মামাকে ধরে আবার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় এবং অত্যাচার করে মেরে ফেলে। এই ঘটনাগুলো আমি দিদার কাছ থেকে শুনেছি।

জবানবন্দী শেষে আসামীপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সাক্ষীকে জেরা করেন।
প্রশ্ন : আপনার মামা টুনটু সেন ’৭১ সালে কি বিবাহিত ছিল?
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : আপনার মামীর নাম কি?
উত্তর : মনে নেই।
প্রশ্ন : আপকি কি ’৭১ সালে আপনার মামা ও মামীর সাথে এক বাড়িতে ছিলেন?
উত্তর : এক বাড়িতে ছিলাম না।
প্রশ্ন : আপনার মামা-মামী কি এক বাড়িতে থাকতেন?
উত্তর : হ্যাঁ, এক বাড়িতে থাকতেন।
প্রশ্ন : ’৭১ সালে আপনি আপনার পিতা মাতার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : ’৭১ সালে আপনার মা কোথায় থাকতেন?
উত্তর : পটিয়ায় গ্রামের বাড়িতে।
প্রশ্ন : আপনার নানার নাম কি?
উত্তর : ভীম বালি সেন।
প্রশ্ন : আপনার নানার বাড়ি কোথায় ছিল?
উত্তর :ডালিম হোটেলের পাশে একেবারে লাগোয়া।
প্রশ্ন : ডালিম হোটেলের বর্তমান মালিক কে?
উত্তর : বলতে পারব না।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে আপনার সাথে খেলা করত এমন কারো নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : এমন কারো নাম মনে নেই।
প্রশ্ন : আপনার মামাকে ধরে নেয়ার সময় ওই এলাকায় অনেক লোকজন ছিল।
উত্তর : উল্লেখযোগ্য লোক ছিল না।
প্রশ্ন : আপনার মামা টুনটু সেনকে আটকের আগেই ওই এলাকার অনেক দোকানপাট ও বাড়িঘর পাকিস্তান আর্মিরা পুড়িয়ে দিয়েছিল।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : আপনি যে আল-বদর রাজাকারদের দেখেছেন তাদের কারো নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : বলতে পারব না।
প্রশ্ন : ডালিম হোটেলে যে রাজাকার ও আল-বদররা থাকত তাদেরকে আপনি নিজ চোখে দেখেছেন?
উত্তর : আমি নিজ চোখে দেখিনি।
প্রশ্ন : যে আল-বদরা আপনার মামাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের আগে দেখেছেন বা নাম জানেন?
উত্তর : আগে দেখিনি এবং নামও জানি না।
প্রশ্ন : আপনি হাজারী লেন এলাকায় বাস করেন না এবং আপনি ওই এলাকার ভোটার না।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি শেখানো মতে অসত্য সাক্ষ্য দিয়েছেন।
উত্তর : সত্য নয়।

মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে চতুর্থ ও পঞ্চম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ

১৮/২/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান (এমসি) মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ ও পঞ্চম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। আজ  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ চতুর্থ সাক্ষী সুনীল কান্তি বর্ধনকে আসামীপক্ষের জেরা শেষে পঞ্চম সাক্ষীর শিবু দাশের সাক্ষ্যগ্রহণ করা করা হয়। দুই সাক্ষীকেই জেরা করেন মীর কাসেম আলীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। জেরা শেষে আগামীকাল বুধবার রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে।

আজ জেরার সময় মীর কাসেম আলীকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। তার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মিজানুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম এবং অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিক ও অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দিন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, সাইফুল ইসলাম ও নুরজাহান মুক্তা।

চতুর্থ সাক্ষী সুনীল কান্তি বর্ধনের জেরা গতকাল মঙ্গলবার শুরু হয় । আজ তার জেরা সম্পন্ন হয়।

আজকের  জেরা
প্র্রশ্ন: ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ডালিম হোটেলে যে কক্ষে আপনাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেখানে পূর্ব থেকে আটককৃত বন্দিদের আপনি চিনতেন?
উত্তর: না, চিনতাম না। তবে তাদের দেখলে চিনব।
প্রশ্ন: সৈয়দ মোহাম্মদ এমরান, ডিসি অফিসের কর্মচারী সানাউল্লাহ চৌধুরী, তার ভগ্নিপতি হাবিবুর রহমান ও এসকান্দার আলীকে চিনতেন?
উত্তর: চিনতাম না।
প্রশ্ন: আপনারা চট্টগ্রামের হাজারী লেনের গলিতে আসার আগে না পরে ডালিম হোটেল তৈরি হয়েছিল?
উত্তর: বলতে পারব না।
প্রশ্ন: ডালিম হোটেলের বর্তমান মালিক কে এবং সেখানে এখন কারা বসবাস করে বলতে পারবেন?
উত্তর: বলতে পারব না এবং এখন ওই হোটেলে কারা বসবাস করে তাও বলতে পারব না।
প্রশ্ন: আপনি মীর কাসেম আলীকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গতকাল প্রথম দেখলেন।
উত্তর: সত্য।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে রনজিত দাশের পেশা কি ছিল?
উত্তর: ভাঙ্গা বোতল কেনা বেচা করতেন এবং চায়ের দোকান ছিল।
প্রশ্ন: টুনটু সেন ও রনজিত দাশের পিতার নাম বলতে পারবেন?
উত্তর: বলতে পারব না। তবে রনজিত দাশের পিতার নাম ছিল রবীন্দ্র দাশ।
প্রশ্ন: আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা?
উত্তর: হ্যাঁ, আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম।
প্রশ্ন: আপনি কোথায় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন?
উত্তর: আমি মুক্তিযুদ্ধ করিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সহযোগীতা করেছি।
প্রশ্ন: আল-বদর পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত একটি গোপন সংগঠন ছিল।
উত্তর: জানা নেই।
প্রশ্ন: স্বাধীনতার পর আপনার উপর নির্যাতনের বিষয়টি আপনি পুলিশ, জেলা প্রশাসন বা মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে জানাননি।
উত্তর: সত্য।
প্রশ্ন: টুনটু সেন ও রনজিত দাশকে হত্যার তাদের স্ত্রীদের সাথে কথপোকথনের বিষয়টি গতকালই প্রথম ট্রাইব্যুনালে বলেছেন।
উত্তর: সত্য।
প্রশ্ন : দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিংয়ের মালিক কে ছিল?
উত্তর: বলতে পারব না।
প্রশ্ন : বর্তমান মালিক কে বলতে পারবেন?
উত্তর :  বর্তমান মালিককে তাও বলতে পারব না।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে আপনাকে চাকতাই খালের নিকট থেকে আটক করা হয়নি বা দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিংয়ে নিয়ে যাওয়া বা ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়নি।
উত্তর: সত্য নয়।
প্রশ্ন: আপনি শেখানো মতে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলেন।
উত্তর: সত্য নয়।
প্রশ্ন: টুনটু সেন ও রনজিত দাশ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আপনার জ্ঞান নেই।
উত্তর: জ্ঞান নেই, তবে শুনেছি।
প্রশ্ন: ’৭১ সালে মীর কাসেম আলী কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন না।
উত্তর: সত্য নয়।

পঞ্চম সাক্ষীর জবানবন্দী ও জেরা :
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষীর জেরা শেষে পঞ্চম সাক্ষী শিবু দাশের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। জবানবন্দীতে শিবু দাশ বলেন, আমার নাম শিবু দাশ। পিতা শহীদ রনজিত দাশ। মার নাম প্রভা রানী দাশ। বর্তমান বয়স ৪৬ বছর। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আনুমানিক বয়স ছিল তিন বছর। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে আমার বাবা শহীদ হন। আমরা তিন ভাই বোন। ভাই বোনদের মধ্যে আমি তৃতীয়। ছোট বেলায় বাবার স্মৃতি মনে নেই। বড় হয়ে মার কাছ থেকে শুনেছি- আল-বদর বাহিনী বাবাকে হত্যা করেছে। ’৭১ সালে বাবা শিশি বোতল বিক্রি করত ও তার একটি চায়ের দোকান ছিল। ’৭১ সালের নভেম্বর মাসে মীর কাসেমের নির্দেশে বাবাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে আটক রেখে হত্যা করা হয়। এছাড়া টুনটু সেনকেও ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। ডালিম হোটেলে ’৭১ সালে বদর বাহিনীর আড্ডাখানা ছিল। সেখান থেকে অনেক লোকদেরকে নিয়ে মেরে ফেলত।  

জবানবন্দী শেষে আসামীপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সাক্ষীকে জেরা করেন।

জেরা:
প্রশ্ন: আপনার বড় বোনের নাম ও বয়স কত?
উত্তর: কৃষ্ণা দাশ। বয়স আনুমানিক ৫৫ বছর।
প্রশ্ন: টুনটু সেন ’৭১ সালে কোথায় থাকত?
উত্তর: হাজারী লেনে আমাদের প্রতিবেশি (ভাড়াটে) ছিল। 
প্রশ্ন: আপনাদের হাজারী লেনের বাড়ি থেকে ডালিম হোটেলের দূরত্ব কত?
উত্তর: প্রায় ১০০ গজ।
প্রশ্ন: ডালিম হোটেলে এখন কে থাকে?
উত্তর: বলতে পারব না। আমি এখন হাজারী লেনে থাকি না।
প্রশ্ন: আপনার মা কি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান?
উত্তর: না।
প্রশ্ন: হাজারী লেন এলাকায় ’৭১ সালে যাদের বয়েস ১৫ বা ১৬ বছর ছিল বর্তমানে এমন ৩০ থেকে ৪০ জন এখনও বেঁচে আছেন?
উত্তর: আমার জানা নেই।
প্রশ্ন: টুনটু সেনের ছেলে মেয়ে আছে কি?
উত্তর: টুনটু সেনের কোন ছেলে মেয়ে নেই এবং স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে করেছেন।
প্রশ্ন: ’৭১ সাল থেকে আপনার হাজারী লেন এলাকা ত্যাগ করা পর্যন্ত ডালিম হোটেলে কারা বসবাস করত জানেন?
উত্তর: কারা বসবাস করত আমি তাদের চিনি না এবং কে বসবাস করত তাও জানিনা।
প্রশ্ন: হাজারী লেন এলাকার কোন আল-বদর সদস্যর নাম বলতে পারবেন?
উত্তর: না পারব না।
প্রশ্ন: আপনার বাবাকে ধরে নেয়ার সময় অনেক লোক দেখেছে?
উত্তর: অনেক লোক দেখেছে কি না বলতে পারব না।
প্রশ্ন: আপনার মাও অপনার বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখেনি?
উত্তর: সত্য নয়।
প্রশ্ন: হাজারী লেনের অজিত কুমার বনিক নামে কোন স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে চেনেন?
উত্তর: চিনি না।
প্রশ্ন: ’৭১ সালে হাজারী লেনে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় স্বাধীনতার পর কোন মামলা হয়েছিল কি না?
উত্তর: জানি না।
জেরার গ্রহণের এক পর্যায়ে সাক্ষী বলেন, মাথা ঠিক নেই। অতীতের কথা ভুলে যাই।
এরপর আইনজীবী প্রশ্ন করেন, আপনার মস্তিস্কের সমস্যার কারণে আপনার স্মরণশক্তি লোপ পেয়েছে। জবাবে সাক্ষী বলেন, সত্য নয়।
প্রশ্ন: আপনার পিতা ও টুনটু সেন হত্যার বিষয়ে আপনার মায়ের উদ্বৃতি তিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা অসত্য এবং আপনার মা এধরণের কোন কথা বলেননি।
উত্তর: সত্য নয়।
প্রশ্ন: আপনি শেখানো মতে টুনটু সেন ও আপনার পিতা হত্যার ঘটনায় মীর কাসেম আলীকে জড়িয়ে অসত্য সাক্ষ্য দিলেন।
উত্তর: সত্য নয়।

সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে চতুর্থ সাক্ষীর জবানবন্দী

১৭/২/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান (এমসি) মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে। আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ চতুর্থ সাক্ষী সুনীল কান্তি বর্ধন ওরফে দুলালের জবানবন্দী গ্রহনের পর তাকে জেরা শুরু করেন মীর কাসেম আলীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মূলতবি করা হয়েছে।

সাক্ষ্যগ্রহণের সময় মীর কাসেম আলী ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় বসে সাক্ষ্যগ্রহণ দেখেন। তার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম, অ্যাডভোকেট আসাদউদ্দিন ও অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও সুলতান মাহমুদ সিমন।

জবানবন্দী (সংক্ষিপ্ত): আমার নাম সুনীল কান্তি বর্ধন ওরফে দুলাল। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে চট্টগ্রাম শহরের অবস্থা আরো খারাপ হলে একদিন আমি আমার স্ত্রী বাচ্চা ও কাজের লোকসহ চাকতাই থেকে বাড়ী যাওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকাতে উঠছিলাম। তখন সশস্ত্র আল-বদররা আমাকে দেখে বলে এই যে মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া গেছে। এ সময় তারা আমাকে গালিগালাজ করে চোখ বেঁধে রিকসায় তুলে। আল-বদররা চামরা গুদাম এলাকায় দোস্ত পাঞ্জাবি বিল্ডিংয়ের আল-বদর ক্যাম্পে নিয়ে আমাকে প্রচুর মারধোর করে। এরপর আমাদেরকে যথারীতি আটক রাখা হয় এবং বিভিন্নভাবে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর আমি লক্ষ্য করলাম দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিংয়ের বাল্ড খুলে ফেলা হচ্ছিল। কামরুল নামে এক আল-বদর আমাকে মাঝে মধ্যে খাবার পানি ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করতো। কখনও সে চোখের বাঁধনও খুলে দিত। সে আমাকে ঐ দিন অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বর জানায় তোকে তো বাঁচাতে পারলাম না আজকে অথবা আগামী কাল তোদেরকে ডালিম হোটেেেল নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে মীর কাশেম আলী আছে সে তোদেরকে বাচতে দিবে না। দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিংয়ে রাত্রি যাপনের পর আনুমানিক ভোর ৫টার দিকে আমাদেরকে নিচে নামানো হয় এবং সেখানে বন্দীদেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি ট্রাকে ওঠানো হয এবং এই ট্রাকে করে আমাদেরকে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসা হয়। ডালিম হোটেলে আসার পর ট্রাক থেকে লাথি মেরে মেরে নামানো হয়। সেখানে আমাকে অন্য বন্দীদের সঙ্গে একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে মরী কাসেম আলী ছিলেন। তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করেন তোমরা কে কি জান বল। আমরা যখন কোন তথ্যই দিচ্ছিলাম না তখন মীর কাসেম  আলী বলেন তোদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। এমতাবস্থায় আমিসহ মোট ৬ জনকে ডালিম হোটেলের একটি কক্ষে বন্দী করা হয় সেখানে আগে থেকেই আরো কয়েকজন বন্দী ছিলেন। বাইরে থেকে কক্ষটি তালা মেরে আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে তারা তাদের যার যার কর্মস্থলে চলে যায়।

১৪ ডিসেম্বর রাত্রে আমরা আর কারো সাড়া শব্দ পাইনি। আমরা নিজেরা নিজেদের চোখের বাঁধন খুলে ফেলে ঘুমানোর চেষ্টা করি। ১৫ ডিসেম্বর সকাল থেকে আর কারো কোন সাড়া শব্দ পাইনি। বেলা ২ ঘটিকার সময় আমরা আমাদের কক্ষের একটি জানালা খুলি কিন্তু কারো কোন সাড়া না পেয়ে জানালা বন্ধ করে দিলাম। ১৬ ডিসেম্বর ভোরবেলা স্থানীয় লোকজন ও আমার প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধবরা আমাদের কক্ষের দরজা কুড়াল দিয়ে ভেঙ্গে আমাদের মুক্ত করে নিয়ে যায়। আমরা মুক্ত হয়ে আসার পর টুনটু সেন এবং রনজিত দাসের স্ত্রলা  আমাকে বলে যে, আপনারা তো মুক্ত হয়ে আসলেন তারা কোথায়? তখন আমি বলি আল-বদররা তাদেরকে মেরে ফেলেছে। তখন আমি তাদের কাছ থেকে আরো জানতে পারি মীর কাসেম আলীর নির্দেশে আল-বদররা চোখ বেঁধে টুনটু সেন ও রনজিত দাসকে  ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তারা আর ফিরে আসেনি।

জেরা:
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের হাজারী লেনের অজিত কুমার বনিক নামে কাউকে চিনতেন?
উত্তর: না, এখনও চিনিনা। তবে হাজারী লেনের অজিত দাসকে আমি চিনতাম।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের এক সপ্তাহের মধ্যে পাক সেনারা লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে।
উত্তর:  এক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তান আর্মির অত্যাচার শুরু হয়নি। তবে আমরা গ্রামে চলে যাওয়ার সপ্তাহ বা দশ দিন পর হয়েছে।
প্রশ্ন: পাকিস্তান আর্মির লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ শুরু করার পর ওই এলাকায় কোন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক থাকত না।
উত্তর: সত্য নয়।
প্রশ্ন: বাবুল কান্তি নাথ নামে হাজারী লেনের কাউকে চিনতেন?
উত্তর: না। হাজারী লেনে ১৯৭১ সালে ১৪ বা ১৫টি পরিবার বসবাস করত। আর ভাড়াটিয়া ছিল শ’ খানেকের বেশি। বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজার লোক বসবাস করে।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালের মার্চের পর আপনারা গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর আর কখনো হাজারী লেনের বাসায় এসেছেন?
উত্তর: দু’এক বার গিয়েছি।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে আপনাদের বাসা থেকে ডালিম হোটেল দেখা যেত, মাঝখানে কোন বাড়ীঘর ছিল না। 
উত্তর: সত্য।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে ডালিম হোটেলের মালিক কে ছিল?
উত্তর: একজন নাথ বাবু। তার পুরো নাম বলতে পারব না। ছেলে মেয়ে কয়জন তাও বলতে পারব না।
প্রশ্ন: আপনাকে যখন দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং থেকে ডালিম হোটেলে আনা হয় তখন আপনার সঙ্গে হাজারী লেনের কেউ ছিল কি ?
উত্তর: না।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালের কত আগে থেকে অপনারা হাজারী লেনের বাড়িতে বসবাস করেন?
উত্তর: ১৯৫২ সাল থেকে।
প্রশ্ন: যে দোকানী ১৯৭১ সালে বন্দী অবস্থায় আপনাদের বিড়ি সিগারেট ও মুড়ি দিয়েছিল সেই দোকানীর নাম বলতে পারবেন?
উত্তর: সেই দোকানীর নাম আমি বলতে পারব না।
প্রশ্ন: আপনি কি আপনার কর্মস্থলে ডালিম হোটেলের পাশ দিয়ে যেতেন?
উত্তর: না।
প্রশ্ন:১৯৭১ সালের ডালিম হোটেলের কোন কর্মচারীর নাম বলতে পারবেন?
উত্তর: না, বলতে পারব না।
প্রশ্ন: ডালিম হোটেলের পাশে টিএন্ডাট কোলোনি ছিল এবং সেখানে পাকিস্তান আর্মি অবস্থান করত। 
উত্তর: হ্যাঁ।
প্রশ্ন: হাজারী লেনের জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে চিনতেন?
উত্তর: চিনতাম, তিনি বর্তমানে মৃত।
প্রশ্ন: জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বাড়ী পাকিস্তান আর্মি বা অন্য কেউ কি পুড়িয়ে ছিল?
উত্তর: না, পাকিস্তান আর্মি বা অন্যকেউ পোড়ায়নি।
প্রশ্ন: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর স্ত্রী পারভিন চৌধুরীকে চেনেন?
উত্তর: চিনিনা। জাহাঙ্গীর চৌধুরী বিয়ে করেছেন এক বড়–য়া মেয়েকে।

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সুখরঞ্জন বালীর সাক্ষাতকার জমা আপিল বিভাগে/// আমার ভাই হত্যার সময় সাঈদী সাহেব ছিলেন তা কখনো শুনিনাই

মেহেদী হাসান, ১৪/২/২০১৪
মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় আলোচিত সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীর একটি সাক্ষাতকারের সিডি এবং স্ক্রিপ্ট আপিল বিভাগে জমা দেয়া হয়েছে আসামী পক্ষ থেকে। ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরনের আগে দিগন্ত টিভিতে তিনি এ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন  বলে আদালতে জানানো হয়েছে। সাক্ষাতকারে সুখরঞ্জন বালী বলেছেন, আমার ভাই বিশাবালীকে  হত্যার সময় সাঈদী সাহেব ছিলেন বলে কখনো শুনিনাই। মিলিটারি এবং  দেশীয় যেসব লোক আমাদের বাড়ি থেকে আমার ভাইকে ধরে নিয়ে যায় সেদিন সাঈদী সাহেব সেখানে ছিলেননা, তাকে দেখিনাই।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে বিশাবালী হত্যার অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপনের সময় গত ১১ ফেব্রুয়ারি অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান সুখরঞ্জন বালীর সাক্ষাতকারের সিডি জমা দেন আপিল বিভাগে। এসময় প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন সিডির স্ক্রিপ্ট জমা দেয়ার নির্দেশ দেন।

সুখরঞ্জন বালী নিহত বিশাবালীর ভাই। তিনি ছিলেন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিতে না এসে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে আসার পথে ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য অপহরন করে বলে দাবি করে আসামী পক্ষ। এ নিয়ে সারা বিশ্বে তখন তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বর্তমানে ভারতে অবস্থানকারী সুখরঞ্জন বালীও গোয়েন্দা পুলিশ কর্তৃক তাকে অপহরনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

১৯৭১ সালে  পিরোজপুরে উমেদপুরে বিশাবালী নামে এক ব্যক্তিকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে মাওলানা  সাঈদীর নির্দেশে এবং উপস্থিতিতে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ আনা হয়েছে  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে। মাওলানা সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল  বিশাবালী হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে।

বিশাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালী ঢাকায় সাক্ষ্য দিতে আসার পর অপহরনের আগের দিন দিগন্ত টিভি তার সাক্ষাৎকার ধারন করেন। সেখানে তিনি তার ভাই হত্যার বিবরন দেন এবং তিনি দাবি করেন তার ভাই হত্যার সাথে মাওলানা সাঈদী জড়িত নন।
দিগন্ত টিভি ধারনকৃত সুখরঞ্জন বালীর সাক্ষাতকারের যে সিডি আদালতে জমা দেয়া হয়েছে তা নিন্মে তুলে ধরা হল।

প্রশ্ন ঃ ১৯৭১ সালে আপনার বাড়িতে কি ঘটনা ঘটেছিল? আপনার ভাই কিভাবে মারা গেলেন এবং কারা কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত ছিল?
সুখরঞ্জন বালী ঃ যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে আমরা বাড়ি থাকি, জৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি। বাড়ি থাকি তখন আমার ভাই অসুস্থ ।  উনারে নিয়া থাকি ঘরে। থাকার পরে শুনি, চিৎকার টের পাই মিলিটারি আসছে মিলিটারি টের পাই, টের পাওয়ার পরে আমার মাকে নিয়া আমি বাগানে যাই আমার অসুস্থ ভাইকে ঘরে রাইখ্যা। যাওয়ার পর বাগানে আড়ালে বইস্যা দেখি যে, ১৫/১৬ জন মিলিটারি আসছে তার সাথে দেশিয় মানুষ আসছে আবার কয়েকজন। রাজ্জাক, সেকেন্দার শিকদার, দানেশ মোল্লা, গনি গাজি, মোসলেম মওলানা, মোহসিন ও মোমিন ও মুন্সি এইরা ছিল মিলিটারীদের  সাথে আর কেউ ছিলেন না। তাদের সাথে অন্য কেউ ছিলেন না।  যদি অন্য কেউ আসতো তাকে চিনতাম। সাঈদী সাহেব ছিলেন না, তারে আমরা ভালোভাবেই চিনি। তার শ্বশুরের দোকান ছিল, পাড়েরহাটে কাপড়ের দোকান।  সেখানে বসে তার সাথে আমাদের পরিচয় আছে। সে যদি আসতেন তারে আমরা ভালভাবে চিনতাম। সে ছিলেন না, তারে আমরা দেখি নাই। আমার ঘরে আমার বড় ভাইর ঘরে মিলিটারি বা দেশি মানুষ যারা ছিল তারা উইড্ডা, আমার বড় ভাই অসুস্থ মানুষ তারে ঘর থেকে নামাইয়া রাইফেলের কোন্দা দিয়া পিডায়।  পিডাইয়া তারে বাইন্দা ছাইন্দা নিয়া এরপর আমার ঘরে এবং আমার পাশ্ববর্তী যতো হিন্দু বাড়ি ছিল সব পুড়াইয়া ফেলায়। এ পুড়াইয়া ফেলার পরে আমার ভাইকে নিয়া হোগলাবুনিয়া যায়। যাওয়ার পরে কিছু সময় পরে দেখি যে ধোয়া ওড়ে, এগুলা আমরা বাড়ি বসে দেখি। বিকেল বেলা শুনতে পাই যে, আমার ভাই এবং হোগলাবুনিয়া থেকে ৫/৬ জন হিন্দু লোক ধরে নিয়া পিরোজপুর যায় মিলিটারীরা। যাগো কাছে শুনছি তারাও বলছে সেখানে সাঈদী সাহেব ছিলেন না, যদি থাকতেন তাহলে আমার কাছে বলতেন। যাওয়ার পরে পরদিন সকাল বেলা শুনি পিরোজপুর বলেশ্বর নদীর পাড়ে নিয়া আমার ভাই ও হোগলাবুনিয়ার যে ৫/৬ জন লোক ধরছে তাদেরকে একত্র করিয়া বলেশ্বর নদীর ঘাটে নিয়া গুল্লি কইরা হত্যা করছে। সেখানে সাঈদী সাহেব ছিলেন না সে যথেষ্ঠ ভালো লোক ছিলেন।
প্রশ্ন ঃ তাহলে আপনার ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলেশ্বর নদীর ঘাটে-
সুখরঞ্জন বালী ঃ বলেশ্বর নদীর ঘাটে বসিয়া হত্যা করছে আমার ভাইকে।
প্রশ্ন ঃ কারা হত্যা করেছে?
সুখরঞ্জন বালী ঃ পাক সেনারা আর আমার দেশীয় যে রাজ্জাক, সেকেন্দার শিকদার, দানেশ মোল্লা, গনি গাজী যারাই ছিলেন, তারাই আমার ভাইকে গুলি করিয়া মারছে। এদের সাথে সাঈদী সাহেব ছিলেন না, কখনও তার নাম শুনিও নাই, আর সে ছিলও না।
প্রশ্ন ঃ আপনি তো সরকার পক্ষের একজন সাক্ষী ছিলেন। সরকার পক্ষের মানিত একজন সাক্ষী ছিলেন, আপনি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দিতে আসলেন না কেন?
সুখরঞ্জন বালী ঃ আসি নাই কারন আমি সত্য সাক্ষী দিবো বিধায়। এজন্য হেদিকে আমি যাই নাই। এদিকে আমারে আনছে, তারা আমারে আনে নাই।
প্রশ্ন ঃ তারা আপনাকে কেন আনলো না?
সুখরঞ্জন বালী ঃ আনে নাই, কারন আমাকে দিয়া তারা মিথ্যা কথা বলানোর জন্য চেষ্টা করছে। আমি মিথ্যা কথা বলতে পারবনা, সেই জন্য তারা আমারে আনে নাই ।
প্রশ্ন ঃ কি বলতে বলছে আপনাকে?
সুখরঞ্জন বালী ঃ বলতে বলছে, সাঈদী সাহেব ছিল এই কথা বলবা। আমি বলছি, না আমি বলতে পারবো না আমি মিথ্যা কথা বলবো না। যারে আমি দেখি নাই আমার বাড়ি কিভাবে বলব আমি যে, যারে আমি না দেখছি আমার বাড়ি, আমি কোনদিন তার নামে কোন মিথ্যা কথা বলতে পারবো না।
প্রশ্ন ঃ ট্রাইব্যুনাল থেকে লোক গিয়েছিল তো আপনার বাসায়?
সুখরঞ্জন বালী ঃ গেছিলো। আমার বাড়িতে গেছে তখন মাহবুব আমার বাড়িতে যাইয়া বলে তুমি সাক্ষী দিতে যাবা একটু পাড়েরহাট
প্রশ্ন ঃ মাহবুব কে?
সুখরঞ্জন বালী ঃ মাহবুব, এখন বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাজছে। এই মাহবুব আমার কাছে বলছে যে, তুমি একটু সাক্ষী দিতে যাবা। আমি বলছি, ঠিক আছে আমি যা জানি সেই সত্য কথাই বলব। সে বলে, ঠিক আছে যাবা আমার সাথে এহন চলো। হেরপর, আমারে নিয়া পাড়েরহাট রাজলক্ষী স্কুলের দোতলায় বইসা আমাকে সাক্ষী নেয়া শুরু করছে। আমি যেডুক জানি আমার ভাই সম্মন্ধে  কে মারছে, এই কথা আমি বলা শুরু করছি ।  আমি বলি যে অমুক অমুক ছিল, তখন মাহবুব বলে যে, না ঐসব বাদ দিয়া তুমি সাঈদীর কথা বলবা। আমি বলছি আমি পারব না বলতে, সাঈদীর কথা বলতে। যারে আমার বাড়ি দেখি নাই আমি কখনও বলতে পারব না। তখন আমার পেট পাছাইয়া চিমটি মারে, আমার পিঠে আঙুল দিয়া ঘগতা মারে মানিক ও মাহবুব। দু’জনাই এইসব করতাছে তখন ট্রাইব্যুনাল গেছে ঢাকা দিয়া তখন তার সামনে বলছি, স্যার আমি যেটা জানি সেটা বলব না আপনারা যা শিখায় দিবেন হেইডা বলব। তখন এই কথা বলার পরে তবু আমাকে ঐভাবে আঙুল দিয়া পেট পাছাইয়া মোচড় দেয়, চামড়া ধইরা মোড়ায়, গুতা দেয় । 
প্রশ্ন ঃ নির্যাতন করছে আপনাকে?
সুখরঞ্জন বালী ঃ হ্যা। আমাকে খুব রকমই করছে। তখন আমি তার কাছে বলি সেই ট্রাইব্যুনালের কাছে, তখন ট্রাইব্যুনাল এর লোক বলে কি যে, মাহবুব সাহেব আপনি যে সাক্ষী আনছেন, এই সাক্ষী আপনার সর্বনাশ হইয়া যাইতেছে, আপনার সাক্ষী হয় না। তখন অন্য ট্রাইব্যুনালের (এখানে ট্রাইব্যুনাল বলতে সুখরঞ্জন বালী তদন্ত কর্মকর্তা বা তদন্ত সংস্থার লোক যারা পিরোজপুর গিয়েছিল তাদের বুঝিয়েছেন)  লোক বলে কি, হেয় যা জানে হেইয়া বলতে দেন। তখন এই কথা বলার পরে আমার ঐখান দিয়া মাহবুব আর ঐ মানিক আইস্সা আমারে উঠাইয়া দেয়, আমি চইল্লা আসি বাড়িতে
প্রশ্ন ঃ অভিযোগ আছে আপনাকে সাঈদী সাহেবের পক্ষের লোকজন, অস্ত্রধারী লোকজন, সাঈদী সাহেবের ক্যাডারেরা আপনাকে হুমকি ধামকি দিছে বলেই আপনি সাক্ষী দিতে আসেমন নাই, তাইতো?
সুখরঞ্জন বালী ঃ না, কোনদিন আমার সাথে হেদের কেউ দেখাও করে নাই, হুমকি ধামকিও দেয় নাই। বর্তমানে আওয়ামী লীগের যে মাহবুব আর মানিক হেইরা আমারে হুমকি ধামকি করতেছে। আমাকে আর একদিন বলতেছে কি, তোমারে একটি বাড়ি একটি খামার দেব আর দেড় লাখ টাকা দেব, তুমি সাঈদী সাহেবের নামের কথা বলবা। আমি বলছি না, আমার মরা ভাইকে আমি বেচতে আমি স্বিকার নাই। আমার এত কিছুর দরকার নাই। আমি মিথ্যা কথা কইতাম না। যারে না দেখছি আমি কেউর নামের কথা বলতে পারব না। আর তুমি এই যে এইয়া এইয়া নামের কথা কইতে কও, আমি মিথ্যা কথা বলতেও পারব না আর কিছুও না ।
প্রশ্ন ঃ সাঈদী সাহেবের লোকেরা হুমকি ধামকি দিছে এই মর্মে আপনার মেয়ে একটি জিডি করেছে থানায়, ঠিক কিনা?
সুখরঞ্জন বালী ঃ আমি যখন বাড়ি দিয়া চইল্লা যাই তাদের ঐ মাইর গুতা খাইয়া, হের পর যখন বাজারে যাই, তখন লোকজন দিয়া রগ কাটতে চায় আমার পায়ের ।
প্রশ্ন ঃ কারা?
সুখরঞ্জন বালী ঃ ঐ মাহবুব আর মানিক লোকজন নিয়া রগ কাটতে চায়। তখন আমি বাড়িতে গেলে ওরা বাড়িতে যাইয়া আমারে ব্যার (ঘেরাও) দেছে, গালাগালি করছে। হেরপর, একদিন হঠাৎ আমার সাথে দেখা, দেখার পরে বলে তুমি একটি বাড়ি একটি খামার তুমি নিবা নাইলে তুমি এই দেশে থাকতে পারবা না। তারপরে আমার উপর টর্চারিং করার পরে আমি বাড়ির থেইক্কা চইল্লা গেছি। চইল্লা যাওয়ার পরে আমার মেয়ে, মেয়েরে এসে হুমকি ধামকি দিছে, তোর বাবার নামে তুই গুম কেস করবি। আমার মেয়ে বলছে, আমার বাবার নামে গুম কেস করা লাগবে না। আমার স্ত্রীর কাছেও ওরা বলছে, আমার স্ত্রী বলছে, হেয় যেখানে থাকুক না কেন আমাগো সাথে কথা বার্তা চলে, আমরা কারো নামে গুম কেস করতে পারব না। শেষ মেষ বলে জোর করে আমার মেয়েকে ১০০০/- এক হাজার টাকা দিয়া একটা সাদা কাগজে সই নিছে। তারপর ঐ সই করা কাগজ দিয়া তারা কি করছে না করছে তা আমি বলতে পারব না।


বিশাবালী হত্যা বিষয়ে অভিযোগ : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যে ২০ টি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়েছে তার মধ্যে একটি হল তার নির্দেশে এবং উপস্থিতিতে বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগ বিষয়ে মামলার বাদী এবং প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম ২০১১ সালের  ৭ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী প্রদানের সময় বলেন,
২ জুন সকাল বেলা আমি নিজ বাড়িতে ছিলাম। লোকদের কাছ থেকে জানতে পারি অনুমান সকাল ১০টায় পারেড়হাটের শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী দানশ আলী মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মোমিন হাওলাদার, হাকিম  কাজী, হাবিবুর রহমান মুন্সী  পাক হানাদার বাহিনী সঙ্গে নিয় উমেদপুর গ্রামে  আমার বাড়ির  নিকটস্থ হিন্দু পাড়ায় আক্রমণ চালিয়েছে।  ২৫/৩০টি ঘর লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বিশাবালী অসুস্থ  থাকায় তাকে ধরে ফেলে এবং একটি নারিকেল গাছের সাথে বেঁেধ মারমিট করে। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নির্দেশক্রমে বলে যে, ওটাকে যখন পেয়েছি ওটাকে গুলি কর। জনৈক রাজাকার গুলি করে বিশাবালীকে হত্যা করে।


বালীর ভারতে অবস্থান বিষয়ে নিউএজ এর  প্রতিবেদন :

সুখরঞ্জন বালী ভারতের কারাগারে বন্দী রয়েছে মর্মে ২০১৩ সালের ১৬ মে  নিউএজ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।  চাঞ্চল্যকর এ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি করেছেন নিউএজ পত্রিকার সাংবাদিক (এডিটর স্পেশাল রিপোর্টস) ডেভিড বার্গম্যান। এখানে তার প্রতিবেদনটির অনুবাদ তুলে ধরা হল।

ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন সাক্ষী ছিলেন সুখরঞ্জন বালী। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করে বলে আসামী পক্ষ দাবি করে আসছে। কলকাতার একটি কারাগারে তার খোঁজ পাওয়া  গেছে।
দণিাঞ্চলীয়  জেলা পিরোজপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের  লোক সুখরঞ্জন বালী।  গত বছরের (২০১২)  ৫ নভেম্বর  সকালে তিনি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে যাচ্ছিলেন। এসময় সকালে ট্রাইব্যুনালের সামনে  থেকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে অপহরন করে নিয়ে য়াওয়ার বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করেছেন।

সুখরঞ্জন বালী কলকাতার দমদম সংশোধন কেন্দ্রে আটক রয়েছেন  এবং তাকে দেখতে তার  পরিবারের সদস্যরা সেখানে গিয়েছে  মর্মে চলতি  বছরের  ফেব্রয়িারি মাসে  জানতে পারে নিউএজ।  এরপর এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে এবং কিভাবে তিনি সেখানে গেলেন তা খুঁজে বের করার জন্য অনুসন্ধান চালায় পত্রিকাটি।
পত্রিকাটি তার সঙ্গে দেখা করতে এবং তার বক্তব্য জানার জন্য  ওই কারাগারে  প্রবেশে  সক্ষম  একজন ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিরাপত্তার কারণে তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছর কথা জানান ওই ব্যক্তি। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির অনেক নেতৃবৃন্দের বিচার চলছে। এর কোন একটি দলের সাথেও ওই ব্যক্তির কোন সম্পৃক্ততা নেই।

যাকে দিয়ে আমরা সুখরঞ্জন বালীর কাছ থেকে বক্তব্য সংগ্রহ করেছি তিনি নিউএজকে নিশ্চিত করেছেন যে,  যে ব্যক্তির বক্তব্য সংগ্রহ করা হয়েছে তার সাথে বালীর আসল ছবির সম্পূর্ণ মিল রয়েছে।

বালীর কাছ থেকে বক্তব্য সংগ্রহ করা ওই ব্যক্তি নিউএজকে জানান, বালী পুরো অপহরন ঘটনার অত্যন্ত স্পষ্ট বিবরন দিয়েছেন। । আমি মনে করি, ঘটনাটি সত্য না হলে এ রকম মুহূর্তে তার কাছ থেকে এমন বিবরণ আসা খুবই কঠিন।’ অবশ্য বালীকে তখন নার্ভাস দেখাচ্ছিল  বলেও ওই ব্যক্তি নিউ এইজ-কে জানান।

বালী জানান, অপহরনের পর  তাকে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি।  তবে তারা প্রশ্ন করেছে  ‘কেন আমি সাঈদী সাহেবের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছি।  তারা বলেছে- আমাকে হত্যা করা হবে এবং সাঈদী সাহেবকে ফাঁসিতে ঝোলানো  হবে।’
তার বক্তব্য অনুযায়ী  ২০১২ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী  বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার আগে ঢাকায় তাকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত আটক রাখা হয়। গত সাড়ে চার মাস তাকে  ভারতের বিভিন্ন কারাগারে আটক রাখা  হয়েছে।

বালীর এসব দাবির সত্যতা নিউএইজ স্বাধীনভাবে   নিশ্চিত করতে পারেনি। কারণ, এর আগে তার পরিবারের এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আসামী পক্ষ তার অপহরন বিষয়ে যেসব কথা বলেছিল তার সাথে বালীর সর্বশেষ বক্তব্যের কিছু  কিছু গরমিল রয়েছে। তবে  বালী আটক থাকা থাকার  সময়সীমার যে তথ্য দিয়েছে তার সাথে মিল রয়েছে ভারতীয় আদালতে তার আটক থাকা বিষয়ে  পুলিশের দাখিলকৃত তথ্যের সাথে।

ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে দেশটির ফরেইনার অ্যাক্ট-১৯৪৬ এর অধীনে কলকাতার একটি আদালত বালীকে ১০৫ দিনের কারাদণ্ড দেয় গত ৩ এপ্রিল । । যেহেতু বিচার চলাকালে এই মেয়াদটা  তিনি কারাভোগ করেছেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে  তাকে যেকোনো দিন বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া এবং পাবলিক রিলেশনস কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে (বালীর বিষয়ে) কোনো তথ্য নেই। আমি যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামের  সঙ্গে কথা বলেছি এবং তিনি বলেছেন- তিনি কিছুই জানেন না। এই মুহূর্তে বালী কোথায়  আছে তিনি তা জানেন না।’ মনিরুল ইসলাম ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় দুটি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দেলাওয়ার হোসাইন  সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে।  এরমধ্যে একটি হলো- সুখরঞ্জন বালীর ভাই বিশাবালীকে হত্যায় জড়িত  থাকার অভিযোগ।

আদালত রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে  বিশাবালীকে একটি নারিকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা  হয়  এবং ‘অভিযুক্ত দেলাওয়ার  হোসাইন সাঈদীর নির্দেশে  রাজাকাররা তাকে গুলি করে হত্যা করে।  আদালত আরো ছয়টি অপরাধের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও কোনো সাজা ঘোষণা করেনি। মামলাটি বর্তমানে সুপ্রিম  কোর্টের  আপিল বিভাগে রয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে বালীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করেছে এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে সরকার এবং ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ।
গত বছরের (২০১২)  ৫ নভেম্বর  সকালে আসামিপক্ষের  আইনজীবীরা বালীকে অপহরনের ঘটনাটি  ট্রাইব্যুনালকে  জানায়। এর কিছুক্ষন পর  চিফ  প্রসিকিউটর  আদালতকে বলেন, ‘আদালত চত্বরে সাক্ষী অপহরনের কোন ঘটনাই ঘটেনি। আদালত চত্বরে যেসব পুলিশ সদস্য রয়েছে তাদের সাথে আমি কথা বলেছি। তারা আমাকে জানিয়েছে এখানে আজ এ ধরনের কোন ঘটনাই ঘটেনি। তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেননা। চিফ প্রসিকিউটর যখন ট্রাইব্যুনালকে এ তথ্য জানান তখন তার পাশে তদন্ত সংস্থার প্রধানও উপস্থিত ছিলেন এবং তিনিও এ বক্তব্য সমর্থন করেন।

এরপর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয় সাক্ষী অপহরনের ঘটনাটি আসামী পক্ষের একটি অগ্রহনযোগ্য নাটক। নেতাদের বেআইনিভাবে মুক্ত করতে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম বনচাল করতে তাদের  (জামায়াাতে ইসলামীর) চেষ্টার অংশ এটি।

অপহরণের ঘটনার এক সপ্তাহ পর বালীর পক্ষে দায়ের করা হেবিয়াস করপাস  আবেদনের পরিপ্রেেিত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম হাই কোর্টকে বলেন, ‘এই গল্প একেবারেই উদ্ভট এবং ট্রাইব্যুনালের সুনাম নষ্ট, ট্রাইব্যুনালকে হেয় প্রতিপন্ন  করাই এর উদ্দেশ্য।

বালীর জেলখানায় থেকে দেয়া বিবৃতিতে জানান,  ছয় সপ্তাহ তাকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটকে রাখার পর ২৩ ডিসেম্বর তাকে চোক বেঁধে  পুলিশ তাকে সীমান্তে  নিয়ে যায়। এরপর ভারতীয়  সীমান্তরী বাহিনী-বিএসএফের হাতে তাকে তুলে দেয়া হয়।  নিজের সই করা বিবৃতিতে বালী বলেন, ‘তারা আমাকে খাবার দেয়ার  জন্য মাগুরার একটি হোটেলের সামনে গাড়ি থামায় ।  এসময় তারা আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয়  এবং আমি বুঝতে পারি আমাকে প্রাইভেটকারে এখানে আনা  হয়েছে।

‘আমার খাবার খাওয়া  শেষ হলে ফের আমার চোখ বেঁধে  রওয়ানা দেয়া হয় গাড়িতে করে।  সর্বশেষ বিকেল ৫টার দিকে বিএসএফের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে  তারা চলে যায।

বালী বলেন, বিএসএফ সদস্যরা তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করে। ‘তারা আমাকে নির্যাতন করে এবং জানতে চায় আমি সেখানে কী করছিলাম। বিএসএফের হাতে তুলে দেয়ার আগ পর্যন্ত আমি কী করেছি তা তুলে ধরার চেষ্টা করি। সম্ভবত তারা আমার কাছ থেকে সন্তোষজনক জবাব পায়নি এবং আমাকে আরো বেধড়ক মারধর করা হয়।’
এতে আহত হলে বিএসএফ তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে স্বরূপনগর থানায  নিয়ে যাওয়া  হয়। সেখান থেকে পরদিন তাকে বসিরহাট আদালতে তোলা হয়। । বসিরহাট কারাগারে ২০ দিন আটক থাকার পর তাকে দম দম   সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয় বলে জানান বালী।

বালী তার বক্তব্যে বলেন, ২০১২ সালের মে মাসের কিছুদিন পর সাঈদীর ছেলে ‘বুলবুল’ তার বাড়িতে যান  তার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু এসময় তিনি বাড়িতে ছিলেননা। পরে ফোনে তিনি তাকে প্রথমবারের মত তার পিতা  সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য  দিতে বলেন। বুলবুল তার বাবার জন্য সাক্ষী হতে আমাকে অনুরোধ করে। কিছুদিন পর বুলবুল মারা যান। বালী উল্লেখ করেন  ২০১২ সালের ১৩ জুন সাঈদীর বড ছেলে রফিক-বিন-সাঈদী মারা যান।

এই ছেলে হৃদরোগে মারা যাওয়ার পর সাঈদীর আরেক ছেলে তার  সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ রাখেন বলে জানান বালী এবং দুর্গাপূজার আগে (অক্টোবর ২০-২৪) তিনি ঢাকা আসেন। সাঈদীর বাসায়  ১৫ থেকে ১৬ দিন থাকেন।
তিনি বলেন, ৫ নভেম্বর তাকে সাঈদীর আইনজীবীদের অফিস পল্টনের একটি ভবনের ১০ম তলায় নেয়া হয়।  সেখানে সাঈদীর আইনজীবীদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। এরপর  তাকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যায়  তারা।

এর আগে সাঈদীর আইনজীবীরা এবং বালীর স্ত্রী দাবি করেন, বালী নভেম্বরের শুরুতে প্রথমে ঢাকা আসেন। ঢাকায় অবস্থানকালে বালী সাঈদীর পরিবারের কোনো সদস্যের বাড়িতে অবস্থান করেননি  বলেও দাবি করেন তারা আইনজীবীরা।
ভারতীয় পুলিশের ২০১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর দাখিল করা প্রথম প্রতিবেদনে  বলা হয়, পুলিশ কর্মকর্তা কুলদীপ সিং ভারতীয়  সীমান্তবর্তী স্বরূপনগরে ‘সন্দেহজনক গতিবিধি পর্যবেক্ষন’ করেন এবং বালীকে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি পালান। এফআইআর-এ বলা হয়, আটক করা হলে বালী তাদের জানায়, ‘তিনি বাংলাদেশ থেকে তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে ভারতে এসেছে।’

কলকাতায় ভারতীয়  হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) শরিফ উদ্দিন নিউ এইজ-কে বলেন, ‘বিভিন্ন সংশোধন কেন্দ্রে আটক বাংলাদেশিদের দেখতে এপ্রিলের শেষের দিকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের  একটি দল কলকাতায় আসেন।’
‘আমরা  দমদম  সংশোধন কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। আমি তাদের সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু  তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলটি বালী সঙ্গে দেখা করেছেন কিনা আমি বলতে পারবো না’ বলে জানান শরিফ উদ্দিন।

ওই  প্রতিনিধি দলের একজন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির লে. কর্নেল তৌহিদ বলেন, ‘বালীর সঙ্গে তারা দেখা করেছেন কিনা তা তিনি বলতে পারবেন না।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু কারাগারে  প্রায় ১৩০ জন ছিল, তাই আমি বিষয়টি স্মরণ করতে পারছি না। আপনাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে হবে।’

কে এই সুখরঞ্জন বালী?  
নিহত বিশাবালীর ছোট ভাই ভাই সুখরঞ্জন বালীকেই সাক্ষী মেনেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিতে আসেননি ট্রাইব্যুনালে। তিনি যে শুধু রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ছিলেন তাই নয়, যে ১৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দী তাদের অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন সেই ১৫ জনেরও একজন এই   সুখরঞ্জন বালী। ।

গত ২০ মার্চ  রাষ্ট্রপক্ষ থেকে  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে   ৪৬ জন সাক্ষীর বিষয়ে একটি দরখাস্ত দাখিল করা হয়  ট্রাইব্যুনালে । দরখাস্তে নিবেদন করা হয়  ৪৬ জন সাক্ষীকে  ট্রাইব্যুনালে হাজির করা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। তাই এসব সাক্ষী  তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছে তা তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হোক।
৪৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৪ জন সম্পর্কে দরখাস্তে রাষ্ট্রপক্ষ উল্লেখ করেছিল  আসামীর (মাওলানা সাঈদী) পক্ষ অবলম্বনকারী পিরোজপুরের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গ্রুপ কর্তৃক সাক্ষীদের বাড়িতে গিয়ে হুমকির  প্রেক্ষিতে ভয়ে ভীত হয়ে তারা আত্মপোগন করেছে। তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। তাই তাদের হাজির করা সম্ভব নয়।
সুখরঞ্জন বালী সম্পর্কে বলা হয়েছিল চার মাস আগে  নিজ বাড়ি থেকে বের হবার পর নিখোঁজ। 
রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের  প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল গত ২৯ মার্চ ১৫ জন সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী প্রদান করেন তা তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে আদেশ দেন।  সুখরঞ্জন বালীর  নাম সেই ১৫ জনের তালিকায়ও রয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষ যে সাক্ষীর বিষয়ে বলেছিল মাওলানা সাঈদীর  পক্ষাবলম্বনকারী অস্ত্রধারী  সন্ত্রাসীদের ভয়ে বাড়ি থেকে নিখোঁজ সেই সুখরঞ্জন বালী ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর এসেছিলেন মাওলানা সাঈদীর পক্ষে  সাক্ষ্য দিতে। ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে তাকে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যরা অপহরন করে নিয়ে যায়।  রাষ্ট্রপক্ষের  প্রধান আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপু বলেছেন সেদিন এ ধরনের কোন ঘটনাই ঘটেনি।






আহম্মেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

বৃহষ্পতিবার ৪ অক্টোবর ২০১২
আমার নাম আহম্মেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আমার বয়স ৫৭ বৎসর।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমার বয়স ছিল ১৫ বৎসরের একটু বেশি। আমি ¯œাতক পাশ। ১৯৭১ সালে আমি ঢাকার আজিমপুরস্থ ওয়েস্টটেন্ড হাইস্কুলে দশন শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। আমি একজন সুরকার, গীতিকার এবং সংগীত পরিচালক। ছোটকালে আমি দুরন্ত এবং নির্ভিক ছিলাম। আপনারা যারা ১৯৭১ সালের ২৫ শে এবং ২৬ শে মার্চ অবলোকন করেছেন এবং শিকার হয়েছেন তারাই শুধু অনুধাবন করতে পারবেন আমার বিষয়টি। আমার মানে পড়ে ২৭ শে মার্চ তারিখে কারফিউ শিথিল করা হয়েছিল কয়েক ঘন্টার জন্য। যখনি কারফিউ শিথিল করা হয়েছে তখন আমি আমার বাই সাইকেল নিয়ে প্রথম ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পরে পলাশী ফায়ার সার্ভিস স্টেশন তার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ এবং রোকেয়া হল এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের চতুর্দিক আমি ঘুরে দেখেছি এবং লাশের পর লাশ দেখেছি যা কিনা আপনারা ছবির মাধ্যমে দেখেছেন। তার পর আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেব। আমি ২৭ মার্চের বিকেল বেলা একজন বিহারীর বাসায় জোর পূর্বক ঢুকে তাদের বন্দুক ছিনতাই করি এবং একটি ক্ষুদ্র দল গঠন করি এবং তাদেরকে শেখাই আমাদের আরও অস্ত্রের প্রয়োজন। এর মধ্যে একজন বন্ধু যার নাম সজিব তাদের প্রধান করে আমরা বেশ কয়েকটি বিহারীর বাসা থেকে অস্ত্র ছিনতাই করি এবং জিঞ্জিরায় প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি প্রতিষ্ঠা করি। আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন জিঞ্জিরায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমন করেছিল সেটি আমাদেরই কারণে। আমরা সেই আক্রমনের মুখে টিকে থাকতে পারি নাই। আমরা সেই জায়গা পরিবর্তন করে জিঞ্জিরা অঞ্চলের কেট্টা নামক স্থানে চলে যাই। সেখান থেকে আমরা সমস্ত অস্ত্র বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিয়ে ঢাকায় চলে আসি। সেখান থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, আমাদের অনেক ভারি অস্ত্রের প্রয়োজন আছে। তা না হলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা যাবে না। এরপর আমরা পালিয়ে বেরিয়েছি বেশ বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকদিন। যখন বাসায় ফিরলাম তখন মায়ের নিকট জানতে পারলাম আমার ভাই ইফতেখার আহমেদ টুলটুল (বর্তমানে মৃত) মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে এবং সে ২৭ মার্চের রাতেই চলে গিয়েছিল। সেই থেকে আমার মনে একটা স্বপ্ন ছিল, আমার ভাই যখন ফিরে আসবে তার কাছে থেকে অস্ত্র শিক্ষা শিখে নেব এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করব। ভাইয়ের সাথে আমার মে মাসে দেখা হয়। তাকে আমি বিনীত অনুরোধ করলাম তার সঙ্গে আমাকে রাখার জন্য। আমার ভাই ক্রাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন। তাদের কমান্ডার হলেন মোফাজ্জেল হোসেন মায়া। আমার বড় ভাইয়ের সাথে আমি একটি অফিসে যোগ দিই। শুধু আমি ও আমার বড় ভাই। আমরা চেয়েছিলাম আজিমপুর গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকার অফিস উড়িয়ে দিব। সেই মোতাবেক আমি নিজেই ঐ অফিসে ডিনামাইট বসাই। কিন্তু সেই ডিনামাইট আমি চার্জ করতে পারি নাই, কারন কয়েকজন ছাত্রী এসে গিয়েছিল।পরবর্তীতে আমি ভাইয়ের কাছে অনুরোধ করি আমাকে কিছু গ্রেনেড দেওয়ার জন্য। আমার ভাই আমাকে মাহবুবকে এবং সরোয়ারকে একসাথে করে তিনটি গ্রেনেড দেয়। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সেই তিনটি গ্রেনেডের মধ্যে দুটি আমি এবং সরোয়ার (বর্তমান মৃত) নিউ মার্কেটের ১ নম্বর গেটের সামনে মাত্র বিশ ফিট দূরে থেকে পাকিস্তানের তিনটি লরির উপর আক্রমন চালাই। এই আক্রমনের হতাহতের খবর আমি জানি না। তারপর আমাদের পলাতক জীবন। আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি, মানিক মাহবুব এবং খোকা ভারতে চলে যাই এবং আগরগলা হয়ে মেলাঘরে ট্রেনিং নিয়ে আমরা ঢাকায় ফিরে আসি এবং সজিব বাহিনীতে যোগ দিই। লালবাগ এলাকায় কাজ করতে থাকি। আমাদের প্লাটুনকে ওয়াই (ইয়াং) প্লাটুন বলা হত। এরপর অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখে আবারো ভারতে যাবার সময় আমি, মানিক, মাহবুব এবং খোকা পাকিস্তান আর্মি এবং রাজাকারদের হাতে বন্দি হয়ে যাই কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মনবাড়িয়ার মাঝামাঝি তন্তর চেকপোষ্টে। তারা ঘন্টা খানেক জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে যখন আমরা বার বার বলেছিলাম যে, আমরা মুক্তিযোদ্ধা নই, তখন তারা আমাদের পাশবিক নির্যাতন শুরু করে এবং একটানা আড়াই থেকে তিন ঘন্টা নির্যাতনের পরে আমাদের চারজনকে উলঙ্গ করে ফেলে শুধুমাত্র আমাদের পরনে জাঙ্গিয়া ছিল। একজন সুবেদার মেজর আমাদেরকে গুলির হুকুম দেয়। সে মোতাবেক পাশের মসজিদ থেকে একজন ইমাম সাহেবকে নিয়ে আসা হয়। তারপর আমাদের গরম পানি দিয়ে গোসল করানো হয় এবং সুরা পড়ানো হয়। তারপর চোখে কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। তবে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আমাদের সামনে তিনজন মিলিটারি মেশিনগান ঐ জাতীয় কিছু তাক করেছিল। সেই মুহুর্তেও আমি বিচলিত হই নাই। আমি মৃত্যুর প্রহর গুনছিলাম। হটাৎ করে অনেক নিস্তবদ্ধতার ভিতর একটি ওয়ারলেসের শব্দ শুনতে পেলাম যাহা বেজে উঠেছিলাম।শুনতে পাই মুক্তিকো হেড কোয়ার্টার মে লে আও। তারপর আমাদেরকে গুলি না করে উলঙ্গ অবস্থায় প্রায় ৫ ঘন্টা বাসের ভিতরে নীচে বসিয়ে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসা হয় আমাকে সহ বাকি তিন জনকে। সেখানে নিয়ে আমাদেরকে ভিন্ন করে ফেলা হয়। আমাকে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সেখানে আমি একজন ক্যাপ্টেনকে চেয়ারে বসা দেখি। তার নাম ছিল ক্যাপ্টেন আলী রেজা। তার মাথায় চুল ছিল না এবং সামনে দাঁত ছিল না। প্রথমে সে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। আমাকে নাম জিজ্ঞাসা করায় আমি বললাম মাই নেম ইজ আহম্মেদ ইমতিয়াজ। আমি লিখা পড়া করি কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে আমি স্বীকার করি। তখন তিনি আমায় জিজ্ঞেস করেন শিক্ষিত ছেলে হয়ে তুমি কিভাবে ভাবলে যে, এতবড়  পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তোমরা জিততে পারবে। জবাবে আমি বলি স্যার আপনারা এখন কোন র‌্যাংকিয়ে নাই, আমরা আপনাদের যে র‌্যাংকিং দিব তাই হবে আপনার র‌্যাংকিং। তখন তিনি একটি গালি দেয়। সে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে কাল দেখে নেবে বলে হুমকি দেয়।
চারজনকে একত্র করে বাহ্মনবাড়িয়া জেলখানায় পাঠানো হয়। জেলখানায় ঢুকে আমি আমাদের মত ছাত্র ধরনের অসংখ্য বন্দি দেখতে পাই। ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে পরিচিত হই। তাদের মধ্যে যাদের সঙ্গে বেশি পরিচিত হই তারা হলেন নজরুল (শহীদ), আমার বয়সী এক ছেলে কামাল (শহীদ), তার বাবা সিরু মিয়া (শহীদ) এবং কুমিল্লার বাতেন ভাই, সফিউদ্দিন এবং আরও অনেকে। প্রদর্শনী- ৪৯৬ সিরিজে সিরু মিয়া, কামাল  এবং নজরুলের ছবি সহ অন্যদের ছবি আছে। সেই জেলখানায় তখন সম্ভবত আমরা ৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধা বন্দি ছিলাম। নজরুল, সিরু মিয়া এবং কামাল তন্তর চেকপোষ্টে আমাদের থেকে দুদিন আগে ধরা পড়েছিল মর্মে শুনেছিলাম। পরের দিন আমাকে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার পিস কমিটির অফিসে যাহা দানা মিয়ার বাড়ি নামে পরিচিত হাজির করা হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। সেখানে গিয়ে আমি যাকে প্রথম দেখি তিনি হলেন কুখ্যাত পেয়ারা মিয়া। তার অশ্রাব্য এবং নির্যাতনের কথা আমি সারা জীবন মনে রাখবো। ঐ পিস কমিটি অফিসে তিনি আমাকে অনকেক্ষন নির্যাতন করার পরেও যখন আমি কিছু বলি নাই তখন তিনি একঘন্টা পরে আবার আমাকে পাঠান আর্মিসেল অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। সেখানে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে লেঃ ইফতেখার। সেখানে আমার প্রতি একই ধরনের অত্যচার করা হয়। এভাবে আমাদের একজনকে দুবার, প্রথমবার পিস কমিটির পেয়ারা মিয়া কর্তৃক দানা মিয়ার বাড়িতে এবং দ্বিতীয়বারআর্মি সেল অফিসে মিলিটারি কর্তৃক নির্যাতন করা হতো, আমাদের শরীরে রক্ত শুকাতে পারতো না। আমাকে আরেকটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, সেটা হলো আর্মিদের সামনে দোভাষী হিসেবে কাজ করার জন্য এবং সেটাও আমাকে করতে হয়েছে। শহীদ নজরুল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। তাকে আমি একদিন বলেছিলাম এখান থেকে পালিয়ে যাও। সে আমাকে মার ধর করেছিল এবং বলেছিল মুক্তিযোদ্ধারা পালাতে শেখেনি। ফুলের মালা গলায় দিয়ে একদিন এখন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের মুক্ত করে নিয়ে যাবে। নজরুলের পিছনে আমরা নামাজ পড়তাম। তিনি ইফতারি বণ্টন করে দিতেন। তিনিই ছিলেন আমাদের নেতা। রোজার ঈদের দিন সন্ধ্যায় একটু পরে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার জেলের দরজা খুব শব্দ করে খুলে যায়। এবং আমরা সকলে চমকে উঠি। জেলের ভিতরে পাক হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে এবং উচ্চ স্বরে চিৎকার করে বলে লাইন আপ, লাইন আপ। এই শব্দটির সংঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম। ঐ কথা শুনেই আমরা জেলের গারদ থেকে বের হই। আমরা কংক্রিটের মেঝেতে লাইন দিয়ে বসে পড়ি। সেখানে ক্যাপ্টেন আলী রেজা এবং লে: ইফতেখারকে দেখতে পাই। এর একটু পরে দেখতে পাই ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহকে। এরপর অনেক রাজাকার সহ পেয়ারা মিয়াকেও দেখতে পাই। ক্যাপ্টেন আলী রেজা আঙুল তুলে এক একজনকে দাড় করাতে থাকে। এভাবে প্রায় ৪৩ জনকে আলাদা করা হয় আমাকে একা রেখে তখন আমি মনে করেছিলাম আমাকে বুঝি হত্যা করা হবে। আমি সাহস করে ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহকে প্রশ্ন করলাম, আপনারা কি আমাকে মারবেন নাকি ওদেরকে মারবেন? তখন ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ আমার হাতটা তার হাতে নিয়ে বলল আজকের দিনটা কত পবিত্র তা তুমি জান। আমি বললাম আমি তা জানি। তিনি বললেন ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই, আজ এই দিনে যদি কোন মানুষকে হত্যা করা হয় সে সরাসরি আল্লাহ পাকের কাছে চলে যায়। তখন আমি জিজ্ঞেস করি তবে কি এই ৪৩ জনকে আপনারা হত্যা করবেন? উনি হাসিমুখে বললেন সেটাই করব। তখন আমি আরেকটা প্রশ্ন করলাম, আমার সংগে তো মানিক, মাহবুব ও খোকন ছিল তবে তাদেরকে আমার সংগে রাখেন আপনারা তো আমাকে হত্যা করবেন। তখন উনি বললেন হ্যা তোমাকেও হত্যা করবো তবে দুই দিন পরে কারণ দুই দিন পরে তুমি ধরা পড়েছো। তখন আমি বলি তারাও তো দুইদিন পর আমার সাথে ধরা পড়েছে। তখন ঐ তিনজনকে ভিন্ন করে আমার সংগে রাখা হয়। এরপর আমি নজরুল ভাইয়ের সংগে কথা বলি এবং জিজ্ঞেস করি ভাই আপনিতো আমাকে পালিয়ে যেতে দিলেন না, তখন নজরুল ভাই আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে আমার কিছু বলার নাই রে, আমার এই লুঙ্গিটা আমার মায়ের কাছে পৌছে দিস, আর ছোট্ট সিগারেটের টুকরোটি দেখিয়ে সেটাও দিতে বললো কামালের বাবা সিরু মিয়া অঝোরে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন তোর মার তো আর কেউ থাকলো নারে। তখন কামাল তার বাবাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বলে বুলবুল তুই যদি কোন দিন রাস্তার কোন পাগলি দেখিস তাহলে  মনে করবি এটাই আমার মা। নজরুল বলেছিল যখন কোন পাক আর্মি দেখবি একটি করে মাথায় গুলি করবি। কুমিল্লার বাতেন ভাই তার গায়ের চাদরটি আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। সেই চাদর দিয়ে আমি তৎক্ষণাৎ প্রত্যেকের চোখের পানি মুছে দিয়েছিলাম। এরপর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আমাদের কে গারদে আটক করা হয়। তার পরদিন আমি জানতে পারি ষ্টেশনের পশ্চিমে পৌরতলা নামক স্থানে তাদেরকে এক নাগারে হত্যা করা হয়েছে। আমার জানা মতে তাদের একজনকে জেল গেট থেকে ছেড়ে দিয়েছিল। এর দুই দিন পর আমাদের চারজনকে পুনরায় দানা মিয়ার টর্চার সেলে অর্থাৎ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের টর্চার করা হয় এবং সেই রাত্রে আমরা সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হই। পালিয়ে আমরা আমার বন্ধু মাহবুবের বোনের বাড়িতে উঠি। সেখানে আমাদেরকে দুধ দিয়ে গোসল করানো হয়। তার পরদিন আমরা লুঙ্গি গেঞ্জি পরে নৌকা যোগে ঢাকায় রওনা হই এবং আমি আজিমপুর এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করি। মায়ের সংগে দেখা করে ঐ বাড়িতে থাকি এবং মাঝ রাত্রে আর্মিরা এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায় এবং তেজগাঁও এম,পি হোষ্টেলে নিয়ে যায়। সেখানে সাতদিন রেখে টর্চার করা হয়। ফলে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। হুশ হওয়ার পর দেখি আমি রমনা থানায়। টর্চারের ফলে আমার পিটে, পায়ের পেছনে কোন চামড়া ছিলনা। রমনা থানায় ৮৪ জন বন্দীকে দেখতে পাই। তাদের মধ্যে পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন পোল ভল্টার মিরাজউদ্দিনকে দেখতে পাই। মিরাজ ভাই আমাকে অর্ধেক সুস্থ করে তোলেন। মিরাজ ভাইকে দিয়ে পাকিস্তান বাহিনী একটি ইন্টারভিউ করেছিলেন। সেই ইন্টারভিউতে মিরাজ ভাই বলেছিলেন ভারত বাহিনী কর্তৃক জোর পূর্বক মুক্তি বাহিনী গঠন করা হয়েছে। আসলে মুক্তিবাহিনী বলতে কিছুই নাই। এই বক্তব্যটি প্রচারিত হয়েছিল। পাক বাহিনী মিরাজ ভাইকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, তাকে মুক্ত করে দিবে। হত্যা করিবে না। পরবর্তীতে রায়ের বাজারে নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করে চিরতরে মুক্তি দিয়েছে। রমনা থানায় যে ৮৪ জন ছিল এর মধ্যে প্রতিদিন ৭ জন করে নিয়ে হত্যা করা হতো। ওদের একটা গাড়ি এসে ৭ জন করে নিয়ে যেত । ৮৪ জন থেকে আমরা যখন ১৪ জনে আসলাম তখন যৌথ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। সেই আক্রমনের পর থেকে সেই গাড়ি আর আসে নাই। এই দেশে স্বাধীনতা উদযাপন করে ১৬ ই ডিসেম্বর আর আমি মুক্ত হয়েছি ১৭ ডিসেম্বর। পরবর্তীকালে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের অনেক আত্মীয় স্বজনরা আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। ২০০৮ সালে যখন আমি এই ঘটনা সমূহ টেলিভিশনে এক প্রোগ্রামে বলি তখন ঐ প্রোগ্রাম দেখে সিরু মিয়া এবং কামালের মা আমার সংগে যোগাযোগ করেন। তার নাম আমি জেনেছি। তার নাম আনোয়ারা বেগম। বিশদ আলোচনা না হলেও আমি এই ঘটনার কথা কিছু তাকে বলেছি। যেভাবে একজন মায়ের কাছে তার শহীদ ছেলের কথা এবং স্ত্রীর কাছে শহীদ স্বামীর কথা বলা যায়। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সংগে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমার জবানবন্দী নিয়েছেন।

জেরা
০৪-১০-২০১২ ইং ২.০০ মি. পুনরায় জেরা ঃ
ঢাকায় মিত্র বাহিনীর বিমান হামলা ৪ ঠা ডিসেম্বর হয়েছিল কিনা তা আমি নিশ্চিত নই। আমি মুক্ত হওয়ার পাঁচ/ছয় দিন পূর্বে বিমান হামলা হয়েছিল। আমি ব্রাহ্মনবাড়িয়া থেকে পালিয়ে নভেম্বরের ২৫/২৬ তারিখে ঢাকায় এসেছিলাম কিনা তা স্মরণ করতে পারছি না। আমি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কোন ইউনিটের সদস্য নই। তবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আমার নাম আছে।
২০০৮ সালে যখন আমি এই ঘটনা সমূহ টেলিভিশনে এক প্রোগ্রামে বলি তখন ঐ প্রোগ্রাম দেখে সিরু মিয়া এবং কামালের মা আমার সংগে যোগাযোগ করেন। তার নাম আমি জেনেছি। তার নাম আনোয়ারা বেগম। বিশদ আলোচনা না হলেও আমি এই ঘটনার কথা কিছু তাকে বলেছি। যেভাবে একজন মায়ের কাছে তার শহীদ ছেলের কথা এবং স্ত্রীর কাছে শহীদ স্বামীর কথা বলা যায়। এই কথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য। আমি অসত্য জবানবন্দী প্রদান করলাম, ইহা সত্য নহে। (সমাপ্ত)