বুধবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৪

সাঈদী ৭১ সালে কিছু করলে দুটি বইয়ে অবশ্যই তার নাম থাকত-শুনানিতে বললেন বিচারপতি

মেহেদী হাসান, 29/1/2014
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল আবেদন শুনানির সময় বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেছেন, সাঈদী ১৯৭১ সালে কিছু করে থাকলে দুটি বইয়ে অবশ্যই তার নাম থাকত। বই দুটি হল কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিক তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র এবং পিরোজপুর জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত পিরোজপুর জেলার ইতিহাস। এ বই দুটির কোথাও মাওলানা সাঈদীর নাম না থাকার বিষয়টিকে বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা খুবই সিগনিফিকেন্স (তাৎপর্যপূর্ণ) বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ও মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে তার আইনজীবীরা  ডকুমেন্ট আকারে  ট্রাইব্যুনালে  জমা দিয়েছিলেন উক্ত বই দুটি। আজ  সুপ্রীম কোর্টের আপিল বেঞ্চে মাওলানা সাঈদীর আপিল আবেদন শুনানীর সময় এভিডেন্স হিসেবে প্রদর্শিত ওই  বই দুটি  বিষয়ে যুক্তি পেশ করেন অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান। তিনি বলেন, বই দুটিতে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার ন্যায়  পিরোজপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা, ক্ষতিগ্রস্তদের নাম, স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম এবং তাদের কর্মকান্ডের অনেক বিবরন রয়েছে। কিন্তু বই দুটির কোথাও মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। মাওলানা সাঈদী যদি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকতেন তাহলে এ বই  দুটিতে অন্তত কোথাও না কোথাও মাওলানা সাঈদীর নাম থাকত।

তিনি বলেন, পিরোজপুর জেলা পরিষদ কর্তৃক পিরোজপুর জেলার ইতিহাস নামক বইতে পিরোজপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ননার পাশপাশি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি, স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, শান্তি কমিমিটির লোকজনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তুএস তালিকারও কোথাও মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। এমনকি এ বইয়ে পিরোজপুর জেলার কৃতি সন্তানদের নামের যে তালিকা রয়েছে সেখানে মাওলানা সাঈদীর ছবিসহ তার পরিচিতি রয়েছে যেখানে মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিন, বেগম মতিয়া চৌধুরীসহ পিরোজপুর জেলার আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের নাম রয়েছে। এ বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৭ সালে যখন কোন রাজনৈতিক সরকার ছিলনা দেশে। তাছাড়া বইটি যারা সম্পাদনা করেছেন তাদের মধ্যে পিরোজপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জামালুল হক মনুসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা জড়িত ছিলেন।

যুক্তি উপস্থাপনের এ পর্যায়ে বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, মাওলানা সাঈদী যদি ১৯৭১ সালে কিছু করত তাহলে এ দুটি বইয়ে অবশ্যই তার নাম থাকত। এটা খুবই সিগনিফিকেন্স (তাৎপর্যপূর্ণ) একটা বিষয়। এছাড়া পিরোজপুর জেলার ইতিহাস বইয়ে পিরোজপুরের কৃতি সন্তানদের তালিকায় অন্যান্যদের সাথে  তার নাম রয়েছে ছবিসহ। এটিও খুবই সিগনিফিকেন্স। বইটি সম্পাদনার সাথে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের নাম রয়েছে। তিনি জেলার সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। এটাও ইমপরটেন্ট একটা  বিষয়।

এসময় অপর বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, পিরোজপুর জেলার ইতিহাস বইয়ে জামায়াতের সম্পর্কেও আলোচনা রয়েছে। সেখানেও সাঈদীর নাম নেই। স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায়ও সাঈদীর নাম নেই। অথচ দানেশ মোল্লা সেকেন্দার শিকদার এদের নাম বারবার এসেছে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে।  কিন্তু সাঈদীর নাম একবারও আসেনি।
এসময় বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা পিরোজপুর জেলার ইতিহাস নামক বই থেকে কয়েকটি লাইন পড়ে শুনিয়ে বলেন, এখানে জামায়াত নেতা কাউখালির মাওলানা আব্দুর রহিমের নাম রয়েছে। কিন্তু মাওলানা সাঈদীর নাম নেই।

তখন অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র বইটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর এটি খুবই অথেনটিক একটি বই। মাওলানা সাঈদী সাহেব যদি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী কাজের সাথে জড়িত থাকতেন তাহলে এ বইটি এবং পিরোজপুর জেলার ইতিহাস নামক বই যেখানে পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিবরন রয়েছে এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের  কর্মকান্ড এবং তাদের নামের তালিকা রয়েছে সেখানে কোথাও না কোথাও তার নাম থাকত। তিনি বলেন পিরোজপুর জেলার ইতিহাস বইতে স্বাধীনতা বিরোধীদের  নামের তালিকায় দানেশ মোল্লা সেকেন্দার সিকদার, মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দার কমান্ডার, সরদার সুলতান মাহমুদ, আবুদুল আজিজ মল্লিক, আশরাফ আলী, আজিজুল হকম দেলোয়ার মল্লিক, জিন্নাত আলী, সৈয়দ সালেহ আহমেদ, মানিক খন্দকার এদের নাম রয়েছে। কিন্তু এদের সাথে মাওলানা সাঈদীর নাম নেই।

প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ আজ শুনানী গ্রহণ করেন। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ৬ নং অভিযোগ বিষয়ে যুক্তিপেশ শেষে ৭ নং অভিযোগ বিষয়ে যুক্তিপেশ শুরু হয়েছে। শুনানী আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।

মাওলানা সাঈদীর মামলার তদ্বিরকারক মাসুদ সাঈদী বিকালে এ প্রতিনিধিকে বলেন, পিরোজপুর জেলার ইতিহাস বইটি সম্পাদনার সাথে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জামালুল হক মনু ছাড়াও আরো একজন জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জড়িত ছিলেন। তিনি হলেন, গৌতম রায় চৌধুরী। এছাড়া বইটি সম্পাদনার সাথে অধিকাংশ প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পিরোজপুর প্রতিনিধিরা জড়িত ছিলেন। পিরোজপুর জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি মনিকামন্ডলসহ পাঁচজন হিন্দু জড়িত রয়েছেন। এছাড়া পিরোজপুরের নামকরা অনেক আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নেতৃবৃন্দ জড়িত ছিলেন বইটি প্রণয়নের সাথে। বইটিতে পিরোজপুর জেলার কৃতিসন্তানদের নামের যে তালিকা রয়েছে সেখানে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ যিনি ১৯৭৭ সালে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন, সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এমএনএ খিতিশ চন্দ্র মন্ডল ও এনায়েত হোসেনসহ অনেকের সাথে মাওলানা সাঈদীর নামও রয়েছে।
মাসুদ সাঈদী বলেন, হুমায়ূন আহমেদ এর ভগ্নিপতি অ্যাডভোকেট আলী হায়দার কর্তৃক বর্নিত হুমায়ূন আহমেদ এর পিত হত্যার ঘটনা, দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত ভাগিরথী হত্যার ঘটনা, মাছিমুপুর গণহত্যায় নিহত অনেক হিন্দু পরিবারের আত্মীয় স্বজন এর সাক্ষাৎকার  রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র বইটিতে। কিন্তু কেউই  পিরোজপুরের কোন ঘটনার সাথে মাওলানা সাঈদীর নাম উল্লেখ করেননি। 

আজ  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ৬ নং অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন শেষে ৭ নং অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়েছে। ৬ নং অভিযোগ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামী পক্ষের সাক্ষীদের জবানবন্দী এবং জেরা উপস্থাপন করে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান প্রমান করার  চেষ্টা করেন যে, পাড়েরহাট ৭ মে ঘটনার সাথে মাওলানা সাঈদী জড়িত ছিলেননা।
তিনি বলেন, ৬ নং অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৮ জন সাক্ষী হাজির করেছে কিন্তু তাদের কেউই পাড়েরহাট বাজারের নন। কোন ভুক্তভোগীকে সাক্ষী হিসেবে আনা হয়নি। যারা আসছেন তারা কেউ ভুক্তভোগী নন। তিনি বলেন সাক্ষীদের কারো বাড়ি টেংরাটিলা, কারো বাড়ি চিথলিয়া, কারো বাড়ি হোগলাবুনিয়া এবং কারো বাড়ি পাড়েরহাট বাজার থেকে দেড় দুই মাইল দুরে অন্য গ্রামে।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ৭ নং অভিযোগে বলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সেলিম খানের বাড়িতে মাওলানা সাঈদীর দেখানো মতে লুটপাট শেষে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট শাহাজাহান বলেন, সেলিম খানের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে কিন্তু তাকে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হিসেবে হাজির করেনি। সাক্ষী হিসেবে হাজির করেছে দূরের লোক। রাষ্ট্রপক্ষের আট নং সাক্ষী বলেছেন তিনি খালের ওপারে দাড়িয়ে সেলিম খানের বাড়িতে ধোয়া উড়তে দেখেছেন। কাজেই তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেননা এবং তিনি যে  বলেছেন সাঈদীর দেখানো মতে আগুন দেয়া হয়েছে তাও সত্য নয়।

শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান আসামী পক্ষে অ্যাডভোকেট গিয়াসউদ্দিন আহমেদ মিঠু, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, অ্যাডভোকেট তারিকুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন