বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মীর কাসেম আলীর আপিল শুনানীতে যুক্তি উপস্থাপন শুরু

১০/২/২০১৬

 মেহেদী হাসান

জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর আপিল শুনানীতে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়েছে। আজ  সাক্ষীদের জবানবন্দী ও জেরা পড়ে শুনানো শেষে যুক্তি উপস্থান শুরু করেন মীর কাসেম আলীর  পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবী এসএম শাহজাহান। প্রথম দিন একটি অভিযোগের বিরুদ্ধে  যুক্তি উপস্থাপন শেষে হয়েছে । এরপর আরেকটি অভিযোগের বিরুদ্ধে  যুক্তি পেশ শুরু করেন তিনি। এরপর মামলার শুনানী আগামী সোমবার পর্যন্ত মুলতবী করেন আদালত।

সকালে মামলার কার্যক্রম শুরুতে সাক্ষীদের জবানবন্দী ও জেরা পড়ে শেষ করেন  মীর কাসেম আলীর পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবী হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী এবং  এসএম শাহজাহান।

২ নং অভিযোগের বিরুদ্ধে উপস্থাপিত যুক্তি : 
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (২) মোট ১৪টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ১০টি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেয়া হয়েছে। দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। গতকাল দুই নং অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থান শুরু করেণ এসএম শাহজাহান। দুই নং অভিযোগ ছিল লুৎফর রহমান ফারুক নামে এক ব্যক্তিকে অপহরণ এবং ডালিম হোটেলে  আটকে রেখে নির্যাতন। এ অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে ২০ বছর সাজা দেয়া হয়েছে। অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, এ অভিযোগ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের একমাত্র সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন ভুক্তভোগী লুৎফর রহমান ফরুক (২০ নং সাক্ষী)। তিনি সাক্ষ্য দেয়ার সময় ট্রাইব্যুনালে কেঁদে বলেছেন, নির্যাতনের ফলে তিনি  পুুরুষত্বহীন হয়ে পড়েছেন। তার সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ তিনি জেরায় স্বীকার করেছন ১৯৭৯ সালে দিলারা বেগম নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেছেন। আমাদের কাছে প্রমান আছে তার এক মেয়ে আছে। তার মেয়ের নাম তাসনীম রহমান মুক্তা । মুক্তার  বিয়ের কাবিননামা  এবং  এসএসসির মার্কশটি  আমারা সংগ্রহ করেছি। ২১/৪/২০১৪ তারিখ আমরা সে ডকুমেন্ট ট্রাইব্যুনালে  জমা দিয়েছি। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল  তা গ্রহণ করেনি।
এসময় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রশ্ন করেণ যখন এটা জমা দিয়েছেন তখন মামলা কোন পর্যায়ে ছিল। এসএম শাহজাহান বলেন, তখন আসামী পক্ষের প্রথম সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ চলছিল। প্রধান বিচারপতি জানতে চান তখন আপনাদের সাক্ষীর মাধ্যমে এ ডকুমেন্ট ট্রাইব্যুনালে কেন উপস্থাপন করলেননা। এসএম শাহজাহান বলেন, যেহেতু আগে আমাদের ডকুমেন্ট ট্রাইব্যুনাল প্রত্যখ্যান করেছে তাই পরে আর জমা দেইনি। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, মামলার কোন পর্যায়ে কোন ডকুমেন্ট জমা দেয়া যাবে  এবং কী গ্রহণ করা যাবে সে বিষয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলায় বিস্তারিত উল্লেখ করেছি।

এসএম শাহজাহান এরপর বলেন, দ্ইু নং অভিযোগ বিষয়ে সাক্ষী লুৎফর রহমান একজন রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট সাক্ষী। তিনি তার জবানবন্দীতে স্বীকার করেছেন ১৯৭৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত  তিনি চাকতাই বকশীরহাট ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ।
অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, সাক্ষী তার সাক্ষ্যে বলেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বিভিন্ন সভা সমাবেশে মীর কাসেম আলীকে দেখেছেন কিন্তু তিনি গত ৪২ বছরেও তার বিরুদ্ধে কোন মামলা মোকদ্মমা করেননি দালাল আইনের অধীনে।
তাছাড়া তাকে অপরনের স্থান বিষয়ে বিপরীতমুখী তথ্য রয়েছে।  সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে অপহনের যে স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন চার্জশীটে তা নেই বরং চার্জশীটে অন্য একটি স্থানের কথা উল্লেখ রয়েছে।

সাক্ষী নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেছেন কিন্তু পাচলাইশে ১৯৭১ সালে কোন আর্মি ক্যাম্প ছিল কি-না তা বলতে পারেননি। অথচ এটা তার জানার কথা ছিল।

এসএম শাহজাহান বলেন, দুই নং অভিযোগ বিষয়ে ২০ নং সাক্ষী লুৎফর রহমান ফারুকই হলেন একমাত্র সাক্ষী। তার বক্তব্যের সমর্থনে আর কোন সাক্ষী ছিলনা রাষ্ট্রপক্ষের। রাষ্ট্রপক্ষের অপর কোন সাক্ষী তাকে ডালিম হোটেলে বন্দী অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হতে দেখেনি এবং বলেওনি। ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়টি বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

সাক্ষী বলেছেন, ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর আটক হওয়ার আগেই তিনি মীর কাসেম আলীকে দেখেছন ছাত্র নেতা হিসেবে। অথচ তার এ বক্তব্য যে সঠিক নয় তা  ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সাক্ষীর বক্তব্য যে সঠিক নয় তার প্রমান হল মীর কাসেম আলী যে কলেজের ছাত্র ছিলেন সাক্ষী সে কলেজের ছাত্র ছিলেননা। অথচ তিনি তাকে ১৯৭১ সালের আগে দেখার কথা বললেও অন্য কোন কলেজের ছাত্রনেতার নাম তিনি বলতে পারেননি। যেমন ১৯৬৮, ১৯৬৯ এবং ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ, মহসিন কলেজের ভিপি, জিএস কারা ছিল তা বলতে পারেননি। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রশক্তির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কে ছিলেন তাও বলতে পারেননি।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র  কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহণ করেন। বেঞ্চের অপর চার সদস্য হলেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার এবং বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুর রহমান।  শুনানী আজ বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।

আপিল আবেদন শুনানীর সময় মীর কাসেম আলীর পক্ষে অন্যান্য আইনজীবীর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার মীর আহমাদ  বিন কাসেম, ব্যারিস্টার জাকের আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে অন্যান্যের মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম উপস্থিত ছিলেন।

বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর  বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এর আপত্তি : হাইকোর্টের সদ্য অবসরে যাওয়া বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী আজ  মীর কাসেম আলীর পক্ষে আইনজীবী হিসেবে অংশগ্রহণের শুরুতে আপত্তি উত্থাপন করেণ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী মাত্র এক মাস আগে এলপিআরে গেছেন। তিনি সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন। সরকারি বাসভবনে থাকেন এবং সকারি গাড়ি ব্যবহার করেন। এ অবস্থায় তিনি আইনজীবী হিসেবে মামলায় অংশ গ্রহণ করতে পারেণ কি-না।
তখন প্রধান বিচারপতি বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, আমি তাকে আইনজীবী হিসেবে আইনপেশায় ফেরার   অনুমতি দিয়েছি। অনুমতি দেয়ার পূর্বে আমি তার এলপিআর এবং অন্য্যান্য সকল সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সাক্ষর করে শেষ করেছি। এরপর আইনপেশায় ফেরার  অনুমতি দিয়েছি। তিনি তো অন্য মামলায়ও অংশগ্রহণ করছেন।  এরপর তিনি বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীকে বলেন, আপনি পড়েন (সাক্ষীর জবানবন্দী ও জেরা)।

১১টার সময় শুনানী বিরতি ঘোষণার আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, জাজেস রেসিডেন্ট কমপ্লেক্স এর মর্যাদা সবাই রক্ষা করবেন। যারা অবসরে গেছেন এবং যারা বর্তমানে বিচারপতি আছেন তাদের সবার প্রতি আমার এ অনুরোধ।

আপিল শুনানীর বিরতি এবং শুনানী শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, নৈতিকভাবে বিচারপতি নজরুল ইসলাম এটা করতে পারেণনা।
শুনানী শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের যখন এ বিষয়ে ব্রিফিং করেণ তখন এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেণ রাষ্ট্র পরিচালিত মামলার বিরুদ্ধে তিনি আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন বিধায় কি আপনি তার বিরোধীতা করছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল এর আপত্তি বিষয়ে সুপ্রীম কোর্ট বার ভবনে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর  কাছে জানতে চান সাংবাদিকরা। তিনি তাদের বলেন, সংবিধা এবং আইন আমাকে যে অধিকার দিয়েছে তা মেনেই আমি কাজ করছি। আমি আইনের বাইরে কিছু করছিনা।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মীর কাসেম আলীকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয় ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ।
২০১২ সালের   ১৭ জুন মীর কাসেম আলীকে  গ্রেফতার করা হয় ।