রবিবার, ৩০ জুন, ২০১৩

১৯৬৯ সালে শেখ কামাল, তোফায়েল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সিরাজুল আলম খানসহ অনেকে আমার বাসায় যেতেন-ট্রাইব্যুনালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী


মেহেদী হাসান, ৩০/৬/২০১৩
বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন, ১৯৬৯ এর আন্দোলনে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। সেই সুবাধে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রইউনিয়নের অনেকের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালে তার ধানমন্ডির বাসায়  শেখ কামাল, তোফায়েল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ অনেকে যেতেন।  এছাড়া তার বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিরাজুল আলম খান, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, ছাত্রলীগ সভাপতি আব্দুর রউফ, ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদসহ অনেকে যোগ দিতেন।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, তিনি ১৯৭১ সালের   রেসকোর্স ময়দানে  ঐতিহাসিক সাত মার্চের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তোফায়েল আহমেদ, সালমান এফ রহমানসহ অনেকে তার সাক্ষী আছেন। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষনকে যদি স্বাধীনতার ঘোষনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় তাহলে  সে সমাবেশে অংশগ্রহনের কারনে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী  নিজেকে  স্বাধীনতার স্বপক্ষে একজন সক্রিয় সমর্থক  হিসেবে দাবি করেন  আইনগতভাবে। তার এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচার চলছে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আসামী পক্ষের এক নং সাক্ষী হিসেবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজেই নিজের পক্ষে সাক্ষী প্রদান করছেন। আজ  তিনি সাক্ষ্যপ্রদানকালে উপরোক্ত তথ্য তুলে ধরেন।

ইংরেজিতে প্রদান করা জবানবন্দীতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, গুডস হিল আমাদের পারিবারিক বাসা কিন্তু সীমিত কিছু  সময় ছাড়া  আমার সেখানে কখনোই স্থায়ীভাবে বসবাস করা হয়নি। ১৯৬০ সালে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তান ক্যাােডট  কলেজ বর্তমানে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমার স্বাধীন জীবন যাপন   শুরু হয়। একইভাবে  ভাওয়ালপুর সাদিক পাবলিক  বোর্ডি স্কুল, নটরডেম কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনাকালে আমি স্বাধীনভাবে  জীবন যাপন করেছি । ১৯৬৫ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে  এসএসসি পরীক্ষার সময় চারমাস ছাড়া চট্টগ্রামের গুডস হিলে আমার কখনোই বাস করা হয়নি।  আমার  প্রায় সব বন্ধুবান্ধব এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের সাথে আমার সম্পর্ক তৈরি হয় ১৯৭৪ সালের পর। চট্টগ্রামে  আমার যারা পরিচিত তারা সবাই ১৯৬০ সালের পূর্বের এবং     ১৯৭৪ সালের পরবর্তী সময়ে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সালে আমি ঢাকার ধানমন্ডিতে একা এক বাসায় থাকতাম এবং আমার তখন একটি  গাড়ি ছিল ব্যবহারের জন্য।  আমার পিতা মাসে এক দুইবার আমাকে দেখতে আসতেন তখন ঢাকায়।  ধানমন্ডি বাসায় বসবাসকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার যেসব বন্ধু ধানমন্ডি এবং ধানমন্ডির বাইরে  বাস করত এবং ধানমন্ডি এলাকার   আমার অনেক বন্ধু, আমার বাসায় নিয়মিত আসত। বিশেষ করে ১৯৬৯  এর আন্দোলনের সময়। আমিও সে আন্দোলনে অংশ নিয়েছি । সেসমময় আমার বাসায় আমার যেসব পরিচিত বন্ধুবান্ধব আসতেন তাদের মধ্যে  মধ্যে রয়েছেন  শেখ কামাল, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তৌহিদ সামাদ, আহমেদ সালমান এফ রহমান, নিজাম আহমেদ, খায়রুল বাসার, ইরফান খান, ইমরান আহমেদ, কাজী আনোয়ার, আব্দুস সামাদ, কাইউম রেজা চৌধুরী। চলমান আন্দোলনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমার বাসায় তখন ছাত্রনেতাদের অনেক বৈঠক হত। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর আহবানে ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ, ছাত্রলীগ সভাপতি আব্দুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, সিরাজুল আলম খান, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজসহ অনেকে আমার বাসায়  বৈঠক করেছেন চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে। এসব নেতাদের অনেকে আমার পিতার সাথে বেশ কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ করেছেন। বড়ভাইদের এসব মিটিংয়ে আমার বাড়ি ব্যবহার ছাড়াও তাদের  আসা যাওয়ার জন্য আমার গাড়ি  দিয়ে সেবা করার সুযোগ হয়েছিল।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ১৯৬৫র শেষে বা ১৯৬৬ সালের শুরুতে আমার পিতাকে  মুসলিম লীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। ফলে আমার পিতা একজন স্বাধীন পার্লামেন্ট মেম্বার হিসেবে আইউব বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এসময়  পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের অনেকের সাথে আমারও বন্ধুত্ব হয়। আমি কখনো কোন ছাত্রসংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিলামনা কিন্তু তারপরও ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আমি অংশগ্রহণ করে।  ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে আসাদ নিহত হওয়ার সময়  আমি তার থেকে মাত্র দুশফুট দূরে অবস্থান করছিলাম। 
সালাহবউদ্দিন কাদের চৌধুরী উপরে যাদেরকে তার বাসায় যাবার কথা উল্লেখ করেছেন তারা মূলত এসময়ে তার  যেতেন বলে বলেছেন।
সালাহউািদ্দন কাদের চৌধুরী বলেন, ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুদের সাথে আমি রেসকোর্স ময়দানে  ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলাম। শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তোফায়েল  আহমেদ, মনিরুল হক চৌধুরী, নুরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, সালমান এফ রহমান, খায়রুল বাশার, কইউম রেজা চৌধুরী, ড. বেলাল বাকী, তৌহিদ সামাদসহ অনেকে তার সাক্ষী আছেন। সাত মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনকে অনেকে স্বাধীনতার ঘোষনা হিসেবে আখ্যায়িত করে। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষন যদি সর্বসম্মতভাবে স্বাধীনতার ঘোষনা হিসেবে  গ্রহণ করা হয় তাহলে সেই সমাবেশে আমার সক্রিয় অংশগ্রহনের কারনে আমি স্বভাবতই স্বাধীনতার পক্ষে একজন সক্রিয় সমর্থক হিসেবে দাবি করতে পারি।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন,  সাত মার্চ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার আমার পিতা বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠক করেছেন। তাছাড়া ১৯৭২ সালে আমার পিতার বিরুদ্ধে দালাল আইনের মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আসামী পক্ষের সাক্ষীর তালিকায় রাখা হয়। এর মাধ্যমে যেটি প্রমানিত তা হল আমার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবু রহমানকে পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা হিসেবে  এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেকে তার হাতে  ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে ছিলেন।

ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির এবং সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক আজ বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আগামীকাল সোমবারের মধ্যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে তার জবানবন্দী শেষ করার জন্য  বলেছেন ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে ট্রাইব্যুনাল-১ এ আজ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত  সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ফরমাল চর্জ জমা দেয়ার জন্য আগামী ১৫ জুলাই নির্ধারন করা হয়েছে।
   

অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ : কাদের মোল্লা মামলার আপিল শুনানী নতুন মোড় নিয়েছে



মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সাত বিশিষ্ট আইনবিদকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেয়ার মধ্য দিয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা মামলার আপিল শুনানী নতুন  পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।  ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ক্ষেত্রে পূর্বের বিধান ছিল- আসামী পক্ষ সাজার  বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আসামীকে সাজা দেয়া হলে রাষ্ট্রপক্ষ আর  আপিল করতে পারবেনা। ট্রাইব্যুনালের রায়ে যদি আসামীকে  খালাস দেয়া হয় শুধুমাত্র সেক্ষেত্রে সরকার পক্ষ বা অভিযোগকারী আপিল করার সুযোগ পাবে; অন্যথায় নয়। কিন্তু আব্দুল কাদের মোল্লাকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের পর তার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে  ওঠে।  সে প্রেক্ষিতে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইবুনাল আইনের আপিল সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করা হয় সংসদে।  সংশোধিত আইনে বলা হয়- আসামী পক্ষের মত সরকার পক্ষও আপিলের সমান সুযোগ পাবে। অর্থাৎ শুধু খালাসের ক্ষেত্রে নয়, ট্রাইব্যুনালের যেকোন রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষও আপিল করতে  পারবে । আপিল সংক্রান্ত বিধান সংশোধনী বিষয়ে বলা হয়েছে-এ সংশোধনী ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে কার্যকর ছিল বলে ধরে নিতে হবে।
এই যে ২০১৩ সালে আইন করে বলা হল ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর ছিল বলে ধরে নিতে হবে একেই বলে রিট্রোসপেক্টিবভ ইফেক্ট বা ভূতাপেক্ষতা।

আইনের আপিল সংক্রন্তা ধারা সংশোধনের পর সরকার পক্ষ আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করে। এছাড়া  কাদের মোল্লাকে যে একটি অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনাল খালাস দিয়েছে সেটিতেও সাজা দাবি করা হয়েছে সরকার পক্ষের আবেদনে।

আপিল শুনানীতে  রাষ্ট্রপক্ষ আদালতের কাছ থেকে অনেক আইনগত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে ।  এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হল- গত ১৮ ফেব্রুয়ারি যে আইন সংশোধন করা হয়েছে  তা আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় প্রযোজ্য কি-না।  এছাড়া অপর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপিত হয়েছে তাহল- আদালত  এটর্নি জেনারেল এর কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন- উপমহাদেশ বা ইংল্যান্ডের এমন কোন নিজর আছে কি-না যেখানে  রায় হবার পর এভাবে  আইন সংশোধন করে রিট্রোসপেকটিভ ইফেক্ট কার্যকর করা হয়েছে।

১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধনী করে সরকার পক্ষকে আপিলের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু এ সংশোধনী আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য কি-না এ প্রশ্নের জবাব   পাবার জন্য আদালত আইনটি পাশের সময় সংসদ প্রসিডিংস   হাজির করতে বলেন রাষ্ট্রপক্ষকে। কিন্তু সংসদীয় প্রসিডিংস পর্যালোচনা করে দেখা যায় সংশোধনী আইনটি আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য   না-কি চলমান অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সে বিষয়ে আইনে যেমন কোন কিছু নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি তেমনি সংসদ প্রসিডিংসেও কিছু  উল্লেখ নেই।

মজার বিষয় হল আব্দুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল আইনের আপিলের ধারা সংশোধন করা হয়েছে  কিন্তু আইনের সংশোধনিটি আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে  কি-না সে বিষয়ে কোথাও কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। আপিলের ধারা সংশোধনীতে বিরাট একটা ফাঁক বা দুর্বলতা রয়ে গেছে। এ বিষয়টি বেরিয়ে আসে আপিল শুনানীর সময়।

আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায়  আপিল  আবেদন শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি পেশ করছেন। শুনানীর সময়  আদালত তাকে প্রশ্ন করেন- আপনারা যে আইনের বলে আপিল আবেদন করেছেন তা আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি-না? কোন বিধান বলে আপনারা এই মামলার ক্ষেত্রে এ দরখাস্ত করেছেন।

তখন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জবাব দেন-এই যে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইনের আপিলের ধারা সংশোধন করা হয়েছে এবং সরকার পক্ষকে আপিলের সুযোগ দিয়েছে। এ সংশোধনী বলে আমরা আপিল করেছি। আর সংশোধনী আইনে বলা  আছে আছে- ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে এ সংশোধনী কার্যকর বলে ধরে নেয়া হবে।

এসময় আদালত জানতে চান  ১৮ ফেব্রুয়ারি সংশোধনী আইন পাশ  যে আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা  কোথায়  উল্লেখ আছে দেখান। এসময় আদালত আইনটি সংশোধনের  উদ্দেশ্য পড়ে শোনাতে বলেন এটর্নি জেনারেলকে। আইন পাশের উদ্দেশ্য পড়ে শোনানো হলে তাতে দেখা যায় আইনে যেমন এ বিষয়ে কোন কিছু বলা হয়নি তেমনি সংশোধনী আইন পাশের বিষয়েও আব্দুল কাদের মোল্লার মামলা বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ নেই। তখন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন বলেন, সংশোধনী পাশের সময় এর উদ্দেশ্য নিয়ে  সংসদে কি আলোচনা হয়েছিল তা আছে আপনার কাছে? সংসদে এর উদ্দেশ্য নিয়ে কোন আলোচনা হয়েছিল না শুধু হাত তুলে হ্যা জয়যুক্ত হয়েছে বলে পাশ হয়েছিল? এটর্নি জেনারেল এসময় সংশোধনী আইন পাশের সময়কার সংসদীয় প্রসিডিংস উপস্থাপন করেন আদালতে।
কিন্তু তা পর্যালোচনা করে দেখা যায় তাতেও সংশোধনীটি পাশের ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন কিছু উল্লেখ নেই। আব্দুল কাদের মোল্লার রায় বের হবার পর সেক্ষেত্রে  সংশোধনী প্রযোজ্য হবে কি-না সে বিষয়ে কেউ কোন আলোচনাও পেশ করেননি সংসদে। তখন এমপিদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন।

এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিলটি পাশের ক্ষেত্রে সংসদের যে প্রসিডিংস উত্থাপন করেন আদালতে। তাতে  দেখা যায় মো : ফজলে রাব্বি মিয়া সংশোধনী প্রস্তাব বিল আকারে সংসদে উত্থোপন করেন। হুইপ আব্দুল ওয়াহাব  এর ওপর আলোচনা করেন। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সংশোধনী গ্রহনের জন্য স্পিকারের মাধ্যমে অনুরোধ জানান। এরপর কণ্ঠভোটে হ্যা জয়যুক্ত হয়েছে মর্মে বিলটি পাশ হয়। এছাড়া রাশেদ খান মেনন সংশোধনীতে ‘অর্গানাইজেশন’ শব্দটি যোগ করার জন্য প্রস্তাব করেন এবং এ বিষয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন। তা এটর্নি জেনারেল পড়ে শোনান আদালতে। তাতে দেখা যায় রাশেদ খান মেনন জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন। তিনি বলেন,  ১৯৭১ সালে  জামায়াতে ইসলামী সিদ্ধান্ত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে।  আল বদর, আল শাসস, রাজাকার গঠন করে। আজো তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে চলেছে। তাই সংগঠন হিসেবে তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তিনি সংশোধনীতে ‘অর্গানাইজেশন’ শব্দ যোগ করার প্রস্তাব করেন। তার বক্তব্য পাঠ শেষ হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, এসবতো বেখাপ্পা কথাবার্তা। অস্পষ্ট। এর মধ্যেতো সংশোধনী পাশের উদ্দেশ্য বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ নেই। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়াও  একই ধরননের মন্তব্য করেন এসময়।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধ আইনটি পাশের ক্ষেত্রে সংসদে আইনের উদ্দেশ্য নিয়ে কত সুন্দর  আলোচনা এবং বিতর্ক হয়। অনেক এমপি আইনের ক্ষেত্রে তাদের মতামত তুলে ধরেছিলেন। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরসহ অন্যরা  আইনটি বিষয়ে সংসদে কথা বলেছিলেন।
এসময় অপর বিচারপতি সুরেন্ত্র কুমার সিনহা  আফসোস করে বলেন, সেই সংসদ আর আজকের সংসদ; কোথায় এসে দাড়িয়েছে।
আদালতের নির্দেশে আইনটি পাশের  উদ্দেশ্য সম্পর্কে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ  এর বক্তব্য পড়ে শোনান এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সেখানে উল্লেখ আছে যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যানশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যক্ট প্রণয়ন করা হয়। .....উক্ত অ্যাক্টের অধীনে ট্রাইব্যুনাল গঠনক্রমে যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধেল সাথে জড়িতদের বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্য পড়ে শোনানোর পর বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া বলেন, এখানে ‘বিচার কার্যক্রম চলামান রয়েছে’ বলে একটি কথা আছে। এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মারাত্মক। তিনি বলেন, মিস্টার এটর্নি জেনারেল, এ থেকে যেটি স্পষ্ট তাহল ১৮ ফেব্রুয়ারির সংশোধনী ট্রাইব্যুনালের যেসব বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।  এ মামলার ক্ষেত্রে নয়।

১৮ ফেব্রুয়ারি সংশোধনী আব্দুল কাদের মোল্লা  মালার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি-না সে বিষয়ে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শেষমেষ তার  জবাবে বলেন- সংশোধনীটি আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।   ট্রাইব্যুনাল রায় প্রদানের পর  এ বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের সমান সুযোগ দিয়ে আইনের আপিল সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে এ সংশোধনী কার্যকর হবে। আপনাদের ধরে নিতে হবে এই সংশোধনী ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর আছে। কাদের মোল্লার রায় হবার আগে থেকেই অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে  রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সমান সুযোগ ছিল বলে ধরে নিতে হবে। সেখানে কবে রায় হল এবং কবে  আইন সংশোধন হল এটা অপ্রাসঙ্গিক  বিষয়। কারণ সংশোধনীতে বলা হয়েছে এ সংশোধনী ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর।

কিন্তু আদালত এটর্নি জেনারেল এর উদ্দেশে  বলেন, আপনার আবেদন গ্রহণ করা হলে আমাদেরকে আইন রিরাইট করতে হবে। আইন রিসেটেল এবং রিস্টাবলিশ করতে হবে।
আদালত আরো বলেন, মনে রাখবেন আমরা আজ  এ মামলায় এখান থেকে যে ব্যাখ্যা দেব তা আইন হয়ে যাবে।  ভবিষ্যতে এর অনেক প্রভাব আছে। সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তাই যা বলার সাবধানে বলবেন। আপনি রাষ্ট্রের এটর্নি জেনারেল। একই সাথে আপনি রাষ্ট্রের একজন নাগরিক। এ বিষয় মাথায় রেখে সাবমিশন রাখবেন।

আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এর আগে তার সাবমিশনের বলেছিলেন,  ট্রাইব্যুনালের সাজার বিরুদ্ধে পূর্বে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ ছিলনা। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধনের পর  রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সুযোগ পেয়েছে এবং তারা মৃত্যুদন্ডের দাবি করে আবেদন করেছে। ১৮ ফ্রেবুয়ারি যদি আইনটি সংশোধন না হত তাহলে কাদের মোল্লার ফাঁসির কোন সুযোগ ছিলনা। আপিল বিভাগকে হয় ট্রাইব্যুনালের সাজা যাবজ্জীবন বহাল রাখতে হত না হয় কমাতে হত। কিন্তু যাবজ্জীবন বাড়িয়ে ফাঁসি দিতে পারতনা। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধনের ফলে আসামীর অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায়কে কেন্দ্র করে আপিলের ধারা সংশোধন এবং এ নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্নের সুরাহাসহ অন্যান্য আইনগত বিষয়ে মতামত গ্রহনের জন্য অবশেষে গত ২০ জুন আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় সাতজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে  অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিলেন সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ। 
সরকার পক্ষ আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় আপিল আবেদন করে আরো একটি বিব্রতকর অবস্থার  মুখোমুখি হয়েছে।  বিশেষ করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল সে অভিযোগে শাস্তি দাবি করে আপিলের ক্ষেত্রে। আসামী পক্ষ যুক্তি পেশ করে বলেছে-খালাস দেয়া অভিযোগে শাস্তির দাবি চাইলে রাষ্ট্রপক্ষকে প্রমান করতে হবে ট্রাইব্যুনালের রায় সঠিক ছিলনা। ট্রাইব্যুনালের রায় ন্যায় এবং নীতিভ্রষ্ট । এখন এর জবাবে রাষ্ট্রপক্ষ কি বলবে? তারা কি বলবে ট্রাইব্যুনাল এ ক্ষেত্রে সঠিক রায় দেয়নি? তাহলে তো আর কিছুই রইলনা। কিন্তু তারা এর কোন জবাব দিতে পারছেনা। হ্যা বা না কিছুই বলার কোন উপায় নেই তাদের।

আরো বিষয় আছে। সেটা হল ট্রাইব্যুনালের আইনে বলা হয়েছে- আসামীকে সাজা দিলে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবেনা। খালাস দিলে করতে পারবে।  এখন খালাস মানে কি সব অভিযোগ থেকে  বেকসুর খালাস না দুয়েকটি অভিযোগ থেকে খালাস এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় রায়ের পরে।  একপক্ষের আইনজ্ঞদের মতে আসামীকে সব অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দিলেই কেবল রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবে। কিন্তু কোন একটি অভিযোগেও যদি ন্যুনতম কোন সাজা দেয় ট্রাইব্যুনাল তাহলে আর  রাষ্ট্রপক্ষ কোন আপিল করতে পারবেনা। কারণ কোন না কোন অভিযোগে আসামীকে সাজা দেয়া হয়েছে। আরেক পক্ষের আইনজ্ঞদের মতে একটি অভিযোগে যদি দণ্ড দেয় এবং একটি অভিযোগে যদি খালাস দেয় তাহলে খালাস দেয়া অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবে। ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে ৫টি অভিযোগে দণ্ড দেয় এবং একটি অভিযোগে খালাস দেয়। একপক্ষের আইনজ্ঞরা মত দেন সরকার এ খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেনা এবং আরেক পক্ষের আইনজ্ঞরা বলেন সরকার এ খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। খালাস দেয়া অভিযোগের ক্ষেত্রে সরকার আপিল করতে পারবে কি পারবেনা এ নিয়ে রায়ের পরপর প্রশ্ন দেখা দিলে দুই পক্ষের আইনজ্ঞদের কাছ থেকে  দুধরনের মতামত আসে। যহোক শেষ পর্যন্ত  সরকার খালাস দেয়া অভিযোগেও শাস্তি দাবি করে আপিল করেছে। আপিল বিভাগের শুনানীতে এ বিষয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে কোর্টের পক্ষ থেকে। এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে ভারতের কয়েকটি রেফারেন্স পেশ করেছেন। এ বিষয়ে শুনানীর সময় বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া বলেছেন, সাজার কোন সিঙ্গুলার পুলুরাল হয়না। সাজা মানে সাজা।
গত ২০ জন আদালতের কার্যক্রম শেষে ১৫ দিনের ছুটিতে চলে যায় হাইকোর্ট। আগামী ৭ জুলাই কোর্ট খোলার পর আবার আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায় আপিল শুনানী শুরু হবে। ৮ জুলাই থেকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীদের শুনানী পেশ করার কথা রয়েছে। আব্দুল কাদের মোল্লার মামলা আপিল শুনানী শেষ পর্যায়ে ছিল। ২০ জুন কোর্ট ছুটিতে যাবার আগেই আশা করা হয়েছিল উভয় পক্ষের শুনানী শেষ হয়ে যাবে এবং চূড়ান্ত রায়ের তারিখ নির্ধারন করা   হতে পারে। কিন্তু ছুটির আগে শেষ কর্মদিবসে সাত অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগের মাধ্যমে মামলাটির শুনানী নতুন পর্যায় লাভ করেছে।

ট্রাইব্যুনালের আইনের ধারা সংশোধন করে ২ মাসের মধ্যে আপিল আবেদন নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়।  ৪ মার্চ আসামী পক্ষ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায় রায়ের বিরুদ্ধে আসামী পক্ষ আপিল করে।  দুই মাস সময় পার হয়ে গেছে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে।  সম্প্রতি আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন দুই মাসের সময়সীমা মেনে চলতে আপিল বিভাগ বাধ্য নয়। সব মিলিয়ে বলা যায়  যুদ্ধাপরাধ মামলার আপিল শুনানী নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।
অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ : কাদের মোল্লা মামলার আপিল শুনানী নতুন মোড় নিয়েছে

মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সাত বিশিষ্ট আইনবিদকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেয়ার মধ্য দিয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা মামলার আপিল শুনানী নতুন  পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।  ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ক্ষেত্রে পূর্বের বিধান ছিল- আসামী পক্ষ সাজার  বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আসামীকে সাজা দেয়া হলে রাষ্ট্রপক্ষ আর  আপিল করতে পারবেনা। ট্রাইব্যুনালের রায়ে যদি আসামীকে  খালাস দেয়া হয় শুধুমাত্র সেক্ষেত্রে সরকার পক্ষ বা অভিযোগকারী আপিল করার সুযোগ পাবে; অন্যথায় নয়। কিন্তু আব্দুল কাদের মোল্লাকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের পর তার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে  ওঠে।  সে প্রেক্ষিতে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইবুনাল আইনের আপিল সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করা হয় সংসদে।  সংশোধিত আইনে বলা হয়- আসামী পক্ষের মত সরকার পক্ষও আপিলের সমান সুযোগ পাবে। অর্থাৎ শুধু খালাসের ক্ষেত্রে নয়, ট্রাইব্যুনালের যেকোন রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষও আপিল করতে  পারবে । আপিল সংক্রান্ত বিধান সংশোধনী বিষয়ে বলা হয়েছে-এ সংশোধনী ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে কার্যকর ছিল বলে ধরে নিতে হবে।
এই যে ২০১৩ সালে আইন করে বলা হল ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর ছিল বলে ধরে নিতে হবে একেই বলে রিট্রোসপেক্টিবভ ইফেক্ট বা ভূতাপেক্ষতা।

আইনের আপিল সংক্রন্তা ধারা সংশোধনের পর সরকার পক্ষ আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করে। এছাড়া  কাদের মোল্লাকে যে একটি অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনাল খালাস দিয়েছে সেটিতেও সাজা দাবি করা হয়েছে সরকার পক্ষের আবেদনে।

আপিল শুনানীতে  রাষ্ট্রপক্ষ আদালতের কাছ থেকে অনেক আইনগত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে ।  এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হল- গত ১৮ ফেব্রুয়ারি যে আইন সংশোধন করা হয়েছে  তা আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় প্রযোজ্য কি-না।  এছাড়া অপর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপিত হয়েছে তাহল- আদালত  এটর্নি জেনারেল এর কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন- উপমহাদেশ বা ইংল্যান্ডের এমন কোন নিজর আছে কি-না যেখানে  রায় হবার পর এভাবে  আইন সংশোধন করে রিট্রোসপেকটিভ ইফেক্ট কার্যকর করা হয়েছে।

১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধনী করে সরকার পক্ষকে আপিলের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু এ সংশোধনী আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য কি-না এ প্রশ্নের জবাব   পাবার জন্য আদালত আইনটি পাশের সময় সংসদ প্রসিডিংস   হাজির করতে বলেন রাষ্ট্রপক্ষকে। কিন্তু সংসদীয় প্রসিডিংস পর্যালোচনা করে দেখা যায় সংশোধনী আইনটি আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য   না-কি চলমান অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সে বিষয়ে আইনে যেমন কোন কিছু নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি তেমনি সংসদ প্রসিডিংসেও কিছু  উল্লেখ নেই।

মজার বিষয় হল আব্দুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল আইনের আপিলের ধারা সংশোধন করা হয়েছে  কিন্তু আইনের সংশোধনিটি আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে  কি-না সে বিষয়ে কোথাও কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। আপিলের ধারা সংশোধনীতে বিরাট একটা ফাঁক বা দুর্বলতা রয়ে গেছে। এ বিষয়টি বেরিয়ে আসে আপিল শুনানীর সময়।

আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায়  আপিল  আবেদন শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি পেশ করছেন। শুনানীর সময়  আদালত তাকে প্রশ্ন করেন- আপনারা যে আইনের বলে আপিল আবেদন করেছেন তা আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি-না? কোন বিধান বলে আপনারা এই মামলার ক্ষেত্রে এ দরখাস্ত করেছেন।

তখন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জবাব দেন-এই যে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইনের আপিলের ধারা সংশোধন করা হয়েছে এবং সরকার পক্ষকে আপিলের সুযোগ দিয়েছে। এ সংশোধনী বলে আমরা আপিল করেছি। আর সংশোধনী আইনে বলা  আছে আছে- ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে এ সংশোধনী কার্যকর বলে ধরে নেয়া হবে।

এসময় আদালত জানতে চান  ১৮ ফেব্রুয়ারি সংশোধনী আইন পাশ  যে আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা  কোথায়  উল্লেখ আছে দেখান। এসময় আদালত আইনটি সংশোধনের  উদ্দেশ্য পড়ে শোনাতে বলেন এটর্নি জেনারেলকে। আইন পাশের উদ্দেশ্য পড়ে শোনানো হলে তাতে দেখা যায় আইনে যেমন এ বিষয়ে কোন কিছু বলা হয়নি তেমনি সংশোধনী আইন পাশের বিষয়েও আব্দুল কাদের মোল্লার মামলা বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ নেই। তখন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন বলেন, সংশোধনী পাশের সময় এর উদ্দেশ্য নিয়ে  সংসদে কি আলোচনা হয়েছিল তা আছে আপনার কাছে? সংসদে এর উদ্দেশ্য নিয়ে কোন আলোচনা হয়েছিল না শুধু হাত তুলে হ্যা জয়যুক্ত হয়েছে বলে পাশ হয়েছিল? এটর্নি জেনারেল এসময় সংশোধনী আইন পাশের সময়কার সংসদীয় প্রসিডিংস উপস্থাপন করেন আদালতে।
কিন্তু তা পর্যালোচনা করে দেখা যায় তাতেও সংশোধনীটি পাশের ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন কিছু উল্লেখ নেই। আব্দুল কাদের মোল্লার রায় বের হবার পর সেক্ষেত্রে  সংশোধনী প্রযোজ্য হবে কি-না সে বিষয়ে কেউ কোন আলোচনাও পেশ করেননি সংসদে। তখন এমপিদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন।

এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিলটি পাশের ক্ষেত্রে সংসদের যে প্রসিডিংস উত্থাপন করেন আদালতে। তাতে  দেখা যায় মো : ফজলে রাব্বি মিয়া সংশোধনী প্রস্তাব বিল আকারে সংসদে উত্থোপন করেন। হুইপ আব্দুল ওয়াহাব  এর ওপর আলোচনা করেন। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সংশোধনী গ্রহনের জন্য স্পিকারের মাধ্যমে অনুরোধ জানান। এরপর কণ্ঠভোটে হ্যা জয়যুক্ত হয়েছে মর্মে বিলটি পাশ হয়। এছাড়া রাশেদ খান মেনন সংশোধনীতে ‘অর্গানাইজেশন’ শব্দটি যোগ করার জন্য প্রস্তাব করেন এবং এ বিষয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন। তা এটর্নি জেনারেল পড়ে শোনান আদালতে। তাতে দেখা যায় রাশেদ খান মেনন জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন। তিনি বলেন,  ১৯৭১ সালে  জামায়াতে ইসলামী সিদ্ধান্ত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে।  আল বদর, আল শাসস, রাজাকার গঠন করে। আজো তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে চলেছে। তাই সংগঠন হিসেবে তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তিনি সংশোধনীতে ‘অর্গানাইজেশন’ শব্দ যোগ করার প্রস্তাব করেন। তার বক্তব্য পাঠ শেষ হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, এসবতো বেখাপ্পা কথাবার্তা। অস্পষ্ট। এর মধ্যেতো সংশোধনী পাশের উদ্দেশ্য বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ নেই। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়াও  একই ধরননের মন্তব্য করেন এসময়।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধ আইনটি পাশের ক্ষেত্রে সংসদে আইনের উদ্দেশ্য নিয়ে কত সুন্দর  আলোচনা এবং বিতর্ক হয়। অনেক এমপি আইনের ক্ষেত্রে তাদের মতামত তুলে ধরেছিলেন। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরসহ অন্যরা  আইনটি বিষয়ে সংসদে কথা বলেছিলেন।
এসময় অপর বিচারপতি সুরেন্ত্র কুমার সিনহা  আফসোস করে বলেন, সেই সংসদ আর আজকের সংসদ; কোথায় এসে দাড়িয়েছে।
আদালতের নির্দেশে আইনটি পাশের  উদ্দেশ্য সম্পর্কে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ  এর বক্তব্য পড়ে শোনান এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সেখানে উল্লেখ আছে যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যানশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যক্ট প্রণয়ন করা হয়। .....উক্ত অ্যাক্টের অধীনে ট্রাইব্যুনাল গঠনক্রমে যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধেল সাথে জড়িতদের বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্য পড়ে শোনানোর পর বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া বলেন, এখানে ‘বিচার কার্যক্রম চলামান রয়েছে’ বলে একটি কথা আছে। এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মারাত্মক। তিনি বলেন, মিস্টার এটর্নি জেনারেল, এ থেকে যেটি স্পষ্ট তাহল ১৮ ফেব্রুয়ারির সংশোধনী ট্রাইব্যুনালের যেসব বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।  এ মামলার ক্ষেত্রে নয়।

১৮ ফেব্রুয়ারি সংশোধনী আব্দুল কাদের মোল্লা  মালার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি-না সে বিষয়ে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শেষমেষ তার  জবাবে বলেন- সংশোধনীটি আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।   ট্রাইব্যুনাল রায় প্রদানের পর  এ বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের সমান সুযোগ দিয়ে আইনের আপিল সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে এ সংশোধনী কার্যকর হবে। আপনাদের ধরে নিতে হবে এই সংশোধনী ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর আছে। কাদের মোল্লার রায় হবার আগে থেকেই অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে  রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সমান সুযোগ ছিল বলে ধরে নিতে হবে। সেখানে কবে রায় হল এবং কবে  আইন সংশোধন হল এটা অপ্রাসঙ্গিক  বিষয়। কারণ সংশোধনীতে বলা হয়েছে এ সংশোধনী ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর।

কিন্তু আদালত এটর্নি জেনারেল এর উদ্দেশে  বলেন, আপনার আবেদন গ্রহণ করা হলে আমাদেরকে আইন রিরাইট করতে হবে। আইন রিসেটেল এবং রিস্টাবলিশ করতে হবে।
আদালত আরো বলেন, মনে রাখবেন আমরা আজ  এ মামলায় এখান থেকে যে ব্যাখ্যা দেব তা আইন হয়ে যাবে।  ভবিষ্যতে এর অনেক প্রভাব আছে। সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তাই যা বলার সাবধানে বলবেন। আপনি রাষ্ট্রের এটর্নি জেনারেল। একই সাথে আপনি রাষ্ট্রের একজন নাগরিক। এ বিষয় মাথায় রেখে সাবমিশন রাখবেন।

আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এর আগে তার সাবমিশনের বলেছিলেন,  ট্রাইব্যুনালের সাজার বিরুদ্ধে পূর্বে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ ছিলনা। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধনের পর  রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সুযোগ পেয়েছে এবং তারা মৃত্যুদন্ডের দাবি করে আবেদন করেছে। ১৮ ফ্রেবুয়ারি যদি আইনটি সংশোধন না হত তাহলে কাদের মোল্লার ফাঁসির কোন সুযোগ ছিলনা। আপিল বিভাগকে হয় ট্রাইব্যুনালের সাজা যাবজ্জীবন বহাল রাখতে হত না হয় কমাতে হত। কিন্তু যাবজ্জীবন বাড়িয়ে ফাঁসি দিতে পারতনা। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধনের ফলে আসামীর অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায়কে কেন্দ্র করে আপিলের ধারা সংশোধন এবং এ নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্নের সুরাহাসহ অন্যান্য আইনগত বিষয়ে মতামত গ্রহনের জন্য অবশেষে গত ২০ জুন আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় সাতজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে  অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিলেন সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ। 
সরকার পক্ষ আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় আপিল আবেদন করে আরো একটি বিব্রতকর অবস্থার  মুখোমুখি হয়েছে।  বিশেষ করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল সে অভিযোগে শাস্তি দাবি করে আপিলের ক্ষেত্রে। আসামী পক্ষ যুক্তি পেশ করে বলেছে-খালাস দেয়া অভিযোগে শাস্তির দাবি চাইলে রাষ্ট্রপক্ষকে প্রমান করতে হবে ট্রাইব্যুনালের রায় সঠিক ছিলনা। ট্রাইব্যুনালের রায় ন্যায় এবং নীতিভ্রষ্ট । এখন এর জবাবে রাষ্ট্রপক্ষ কি বলবে? তারা কি বলবে ট্রাইব্যুনাল এ ক্ষেত্রে সঠিক রায় দেয়নি? তাহলে তো আর কিছুই রইলনা। কিন্তু তারা এর কোন জবাব দিতে পারছেনা। হ্যা বা না কিছুই বলার কোন উপায় নেই তাদের।

আরো বিষয় আছে। সেটা হল ট্রাইব্যুনালের আইনে বলা হয়েছে- আসামীকে সাজা দিলে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবেনা। খালাস দিলে করতে পারবে।  এখন খালাস মানে কি সব অভিযোগ থেকে  বেকসুর খালাস না দুয়েকটি অভিযোগ থেকে খালাস এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় রায়ের পরে।  একপক্ষের আইনজ্ঞদের মতে আসামীকে সব অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দিলেই কেবল রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবে। কিন্তু কোন একটি অভিযোগেও যদি ন্যুনতম কোন সাজা দেয় ট্রাইব্যুনাল তাহলে আর  রাষ্ট্রপক্ষ কোন আপিল করতে পারবেনা। কারণ কোন না কোন অভিযোগে আসামীকে সাজা দেয়া হয়েছে। আরেক পক্ষের আইনজ্ঞদের মতে একটি অভিযোগে যদি দণ্ড দেয় এবং একটি অভিযোগে যদি খালাস দেয় তাহলে খালাস দেয়া অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবে। ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে ৫টি অভিযোগে দণ্ড দেয় এবং একটি অভিযোগে খালাস দেয়। একপক্ষের আইনজ্ঞরা মত দেন সরকার এ খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেনা এবং আরেক পক্ষের আইনজ্ঞরা বলেন সরকার এ খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। খালাস দেয়া অভিযোগের ক্ষেত্রে সরকার আপিল করতে পারবে কি পারবেনা এ নিয়ে রায়ের পরপর প্রশ্ন দেখা দিলে দুই পক্ষের আইনজ্ঞদের কাছ থেকে  দুধরনের মতামত আসে। যহোক শেষ পর্যন্ত  সরকার খালাস দেয়া অভিযোগেও শাস্তি দাবি করে আপিল করেছে। আপিল বিভাগের শুনানীতে এ বিষয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে কোর্টের পক্ষ থেকে। এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে ভারতের কয়েকটি রেফারেন্স পেশ করেছেন। এ বিষয়ে শুনানীর সময় বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া বলেছেন, সাজার কোন সিঙ্গুলার পুলুরাল হয়না। সাজা মানে সাজা।
গত ২০ জন আদালতের কার্যক্রম শেষে ১৫ দিনের ছুটিতে চলে যায় হাইকোর্ট। আগামী ৭ জুলাই কোর্ট খোলার পর আবার আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায় আপিল শুনানী শুরু হবে। ৮ জুলাই থেকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীদের শুনানী পেশ করার কথা রয়েছে। আব্দুল কাদের মোল্লার মামলা আপিল শুনানী শেষ পর্যায়ে ছিল। ২০ জুন কোর্ট ছুটিতে যাবার আগেই আশা করা হয়েছিল উভয় পক্ষের শুনানী শেষ হয়ে যাবে এবং চূড়ান্ত রায়ের তারিখ নির্ধারন করা   হতে পারে। কিন্তু ছুটির আগে শেষ কর্মদিবসে সাত অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগের মাধ্যমে মামলাটির শুনানী নতুন পর্যায় লাভ করেছে।

ট্রাইব্যুনালের আইনের ধারা সংশোধন করে ২ মাসের মধ্যে আপিল আবেদন নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়।  ৪ মার্চ আসামী পক্ষ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায় রায়ের বিরুদ্ধে আসামী পক্ষ আপিল করে।  দুই মাস সময় পার হয়ে গেছে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে।  সম্প্রতি আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন দুই মাসের সময়সীমা মেনে চলতে আপিল বিভাগ বাধ্য নয়। সব মিলিয়ে বলা যায়  যুদ্ধাপরাধ মামলার আপিল শুনানী নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।

বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০১৩

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সালমান এফ রহমানসহ চার সাক্ষীর তালিকা জমা ট্রাইব্যুনালে

মেহেদী হাসান
বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে  প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ চারজন সাক্ষীর তালিকা ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া হয়েছে। আসামীর পক্ষে ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম আজ  সাক্ষীর এ তালিকা জমা দিয়েছেন। তালিকায় থাকা অপর তিনজন সাক্ষী হলেন, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি শামীম হাসনাইন, সাবেক প্রধান বিচারপতি মাঈনুর রেজা চৌধুরীর ভাই কাইউম রেজা চৌধুরী এবং নিজাম আহমেদ।

এফবিসিসিআই সাবেক সভাপতি সালমান এফ রহমান বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত  উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা। এসব ভিআইপি সাক্ষী সত্যিই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে আসবেন কি-না জানতে চাইলে ব্যারিস্টার  ফখরুল ইসলাম বলেন, তারা ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে যোগাযোগ করে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

তাদেরকে সাক্ষী করার কারণ কি জানতে চাইলে ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন এবং ১৯৭১ সালে তিনি পাঞ্জাবে ছিলেন। বিচারপতি শামীম হাসনাইনও একই সময়ে  পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন।  ১৯৭১ সালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী যে পাঞ্জাবে ছিলেন  সে বিষয়ে সাক্ষী বিচারপতি শামীম হাসনাইন। কারণ তিনিও তখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন।

এছাড়া সালমান এফ রহমান, কাইউম রেজা চৌধুরী নিজাম আহমেদ এরা প্রত্যেকেই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন । তারাও ১৯৭১ সালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পাঞ্জাবে অবস্থান বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী এবং কোর্টে তারা সাক্ষ্য দিতে আসলেই এসব তথ্য জানতে পারবেন।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে মোট এক হাজার ১৫৩ জন সাক্ষীর তালিকা জমা দেয়া হয়েছিল।  সে তালিকায়ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ অনেক সেলিব্রেটি ভিআইপি ব্যক্তিবর্গের নাম ছিল। সাক্ষীর এ তালিকা থেকে মোট পাঁচজন সাক্ষীর সংখ্যা নির্ধারন করে গত ১৩ জুন আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজে এক নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য প্রদান শুরু করেন গত ১৭ জুন।
আজ  অপর চার সাক্ষীর তালিকা জমা  দিলেন তারা।

গত বুধবার সাক্ষীর তালিকা জমা দেয়ার শেষ সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন শুনানী ১৮ জুলাই


দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান (এমসি) জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য  মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে  চার্জ গঠন শুনানীর তারিখ  আগামী ১৮ জুলাই  পুনরায় নির্ধারন করা হয়েছে। আজ  তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন শুনানী শুরু হবার কথা ছিল। তবে আসামী পক্ষ মামলা প্রস্তুতির জন্য আরো সময় প্রার্থনা করায় আগামী ১৮ জুলাই নতুন তারিখ ধার্য্য করা হয়েছে।

আজ  সকালে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম সময় চেয়ে দায়ের করা আবেদন উত্থাপন করেন। আদালত তিনসপ্তাহ সময় দিয়ে আবেদন মঞ্জুর করেন।
মীর কাসেম আলীর পক্ষে অপর আইনজীবী মীর আহমেদ বিন কাসেম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আমাদেরকে নির্ধারিত সময়ের এক সপ্তাহ পরে ডকুমেন্ট সরাবরাহ করেছে। তাছাড়া সরবরাহকৃত ডকুমেন্ট এর শতাধিক পৃষ্ঠা রয়েছে অস্পষ্ট। এসব কারনে আমরা মামলার জন্য পুরো প্রস্তুতি গ্রহনের সময় পাইনি। আরো সময় দরকার। তাই আমরা সময় চেয়ে আবেদন করেছি।

গত ২৫ মে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে চার্জ গঠনের শুনানীর দিন ধার্য্য করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

গত ১৬ মে রাষ্ট্রপক্ষ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে ফরমাল চার্জ দাখিল করে ট্রাইব্যুনালে।

গত বছর  ১৭ জুন মীর কাসেম আলীকে  ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১  এর নির্দেশে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।

চার্জ গঠন শুনানী উপলক্ষে গতকাল মীর কাসেম আলীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।


দেড় বছর বয়সেই নিজামীকে চিনতেন সাক্ষী!!!

মেহেদী হাসান
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ১১ তম সাক্ষী অ্যাডভোকেট শামছুল হক ওরফে নান্নু ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেব যখন বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়তেন তখন থেকেই তাকে আমি চিনতাম। তিনি আমার পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোক। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব যখন বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়তেন তখন তাকে কেউ মতি ডাকতেন এবং কেউ তাকে নিজামী ডাকতেন।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ছাড়াও তোফাজ্জল হোসেন নামে আরো এক ব্যক্তিকে বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়া অবস্থায় সাক্ষী চিনতেন বলে জানান।

সাক্ষী অ্যাডভোকেট শামছুল হক তার জবানবন্দীতে বলেছেন, বর্তমানে তার বয়স অনুমান ৬০  বছর। সে হিসেবে তার জন্ম সাল অনুমান ১৯৫৩ । মাওলানা নিজামীর পক্ষে আইনজীবী মিজানুল ইসলাম  আমাকে বলেন,  মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ১৯৫৫ সালে বোয়ালমারী মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেছেন এবং এরপর তিনি অন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। আর তোফাজ্জল হোসেন ১৯৫৪ সালে একই মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করে অপর আরেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। পাসপোর্ট এবং  জাতীয় পরিচয়পত্রে সাক্ষী শামছুল হকের  জন্ম তারিখ লেখা রয়েছে ১০ নভেম্বর ১৯৫৩। মিজানুল ইসলাম বলেন,  মাওলানা নিজামী  এবং তোফাজ্জাল হোসেন যখন বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়তেন তখন সাক্ষীর মুখের কথা এবং সনদ অনুযায়ী সাক্ষীর বয়স ছিল ছয় মাস থেকে দেড় বছর। আর মাদ্রাসাটির দূরত্ব সাক্ষীর বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার। কাজেই ছয় থেকে দেড় বছর বয়সের একজন শিশুর পক্ষে মাওলানা নিজামীকে মাদ্রায় ছাত্র থাকাকালে চেনার কথা অবিশ্বাস্য একটি ঘটনা।

গত ২০ জুন অ্যাডভোকেট শামছুল হক ওরফে নান্নু মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দী প্রদান করেন। গত বুধবার এবং  আজ   বৃহষ্পতিবারের জেরায়  তিনি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং তোফজ্জাল হোসেন নামে আরেকজনকে বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়া অবস্থায় চিনতেন বলে জানান। আজ  সাক্ষীর জেরা শেষ হয়েছে। সাক্ষীকে জেরা করেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। তাকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট মনজুর আহমেদ আনসারী, তারিকুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দিক, আসাদ উদ্দিন প্রমুখ।

আজ বৃহষ্পতিবারের জেরা (সংক্ষিপ্ত) :
প্রশ্ন : আলীয়া মাদ্রাসায় বৈঠকের খবর দিল যে সেকেন্দার আলী তার বাড়ি কোথায়?
উত্তর : শালগাড়িয়া।
প্রশ্ন : সেকেন্দার আলী বৈঠকের খবর কার কাছ থেকে কিভাবে পেয়েছিল তা জানতে পেরেছিলেন?
উত্তর : সে চায়ের দোকান দিত। বৈঠকে চা দিতে গিয়ে সে বৈঠকের খবর জানতে পারে।
প্রশ্ন : বৈঠকে যে সেল গঠিত হয়ে তাতে আপনার বর্নিত চারজন ছাড়া আর কারা ছিল?
উত্তর : এতদিন পর নাম স্মরন নেই। তবে মুসলিম লীগ, ছাত্রসংঘের লোকজন ছিল।
প্রশ্ন : ১১ এপ্রিলের পরে আপনি সর্বপ্রথম  কবে বাড়ি গেলেন?
উত্তর : স্মরন নেই।
প্রশ্ন : ১২ এপ্রিল আপনি কোথায় ছিলেন?
উত্তর : শহীদনগর ডাকবাংলোয়।
প্রশ্ন : ২৮ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?
উত্তর : ২ এপ্রিল নগরবাড়ি এমবুশ করি। ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। ১১ তারিখ যুদ্ধ শুরু হলে ওই দিন পাবনায় ফিরে আসি। পরে ডাববাগানে ক্যাম্প স্থাপন করি।
প্রশ্ন : আপনার বাড়ি পোড়ানো এবং আত্ময়স্বজনকে মারধোর করার খবর কার কাছ থেকে জানতে পারলেন?
উত্তর : আমি আমাদের বাড়ির পার্শবর্তী হরেন শাহার বাড়িতে পালিয়ে ছিলাম। তাদের বাড়ির ছাদ থেকে আমাদের বাড়ি পোড়ানো দেখতে পাই।
প্রশ্ন : আপনার দ্বিতীয় স্ত্রীর এক ভাই অ্যাডভোকেট ।
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে কতদিন ঘর সংসার করেছেন?
উত্তর : অনুমান ২৫ বছর । তিনি ক্যান্সারে মারা গেছেন।
প্রশ্ন : ২৫ বছরে দ্বিতীয় স্ত্রীর ভাইয়েরা কে কি করেন সে বিষয়ে খোজ নেননি?
উত্তর : আমি ঢাকা থেকেছি, কখনো বিদেশে থেকেছি ।
প্রশ্ন : আপনার প্রথম স্ত্রী কি জীবিত আছেন?
উত্তর : শুনেছি মারা গেছে। নিশ্চিত করে বলতে পারবনা জীবিত  না মৃত। প্রায় ৩০ বছর আগে তার সাথে আমরা বিচ্ছেদ হয়েছে।
প্রশ্ন : পাবনা জেলা জজ আদালতের অ্যাডভোকেট কে  হামিদুর রহমানকে চেনেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : পাবনা নোটারি পাবলিকের অ্যাডভোকেট এ কে এম শামসুল হুদাকে চেনেন?
উত্তর : মনে পড়ছেনা।
প্রশ্ন : পাবনায় সর্ব প্রথম শান্তি কমিটি কবে গঠিত হয়?
উত্তর : স্মরন নেই।
প্রশ্ন : পাবনা শান্তি কমিটির সভাপতি সেক্রেটারির নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : স্মরন নেই।
প্রশ্ন : সাথিয়া পাইলট হাইস্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেন  । তিনি যখন বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়তেন তখন তাকে চিনতেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : নিজামী সাহেব বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়া অবস্থায় ডাবল প্রমোশন হয়েছিল শুনেছেন?
উত্তর :  জানিনা তবে শুনেছি সে ট্যালেন্ট ছাত্র ছিল।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে পাবনার ঘটনা বিষয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফী ছাড়া অন্য কোন ভিডিও সাক্ষাতকার আপনি দিয়েছেন কখনো?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : অন্য কোন গণমাধ্যমেও কোন ভিডিও সাক্ষাতকার দেননি?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ন্যাশনাল জিওগ্রাফীতে দেয়া সাক্ষাতকারে আপনি নিজামী সাহেবের নাম বলেননি।
উত্তর : সে সাক্ষাতকার আশির দশকে দিয়েছিলাম। নিজামী সাহেবের নাম বলেছিলাম কি-না স্মরন নেই।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্বাদের সর্বশেষ যে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয়েছে তাতে আপনার নাম নেই।
উত্তর : সত্য নয়। আমি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাই।
প্রশ্ন : আপনার এসএসসি সনদে জন্ম সাল কত বলতে পারবেন?
উত্তর : মনে পড়ছেনা।
প্রশ্ন : পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ কত তাও মনে নেই?
উত্তর : মনে নেই।
প্রশ্ন : আপনার জন্ম সাল কত বলতে পারবেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দেয়ার আগে আপনাকে ডিজিএফআই’র লোকজন তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : তদন্ত কর্মকর্তার সাথে জবানবন্দী প্রদানের আগে আপনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : গত সংসদ নির্বাচনের আগে আপনার ছেলে প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষে আহত হয়েছিলেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনার এই ছেলে প্রতিপক্ষের একটি মামলার আসামী।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনার এই ছেলে বর্তমানে এএসপি।
প্রশ্ন : সত্য ।
প্রশ্ন : আপনি পাবনার ১৯৭১ সালের ঘটনা বিষয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছেন ১৯৭১ সালে আপনি নিজামী সাহেবকে পাবনায় দেখেননি। এমনকি এফিডেভিড করেও একথা বলেছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি যে এফিডেভিট করেছেন তা সনাক্ত করেছেন আপনার দ্বিতীয় স্ত্রীর ভাই অ্যাডভোকেট হামিদুর রহমান।
উত্তর : আমি উক্তরূপ কোন এফিডেভিট করিনি।
প্রশ্ন : পাবনার নোটারি পাবলিক অ্যাডভোকেট এ কে এম শামসুল হুদা আপনার নিকট আত্মীয় এবং কুটুম হন তা  ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করেছেন।

আজ সাক্ষীর জেরা শেষে আগামী সাত জুুলাই মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে পরবর্তী সাক্ষীর তারিখ ধার্য্য করা হয়েছে।

বুধবারের জেরা :
আইনজীবীর প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী যে উত্তর দেন এখানে শুধু সে উত্তরগুলো তুলে ধরা হল। উত্তর থেকেই আসা করে প্রশ্নটি কি ছিল তা বুঝে নিতে পারবেন।

রাজশাহী বারের এ্যাডভোকেট জনাব ফজলে রাব্বী সাহেবকে আমি চিনি। তিনি মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিলেন কিনা তাহা আমার জানা নাই। আমি জানি তিনি বৃহত্তর রাজশাহী জেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ষাটের দশকের প্রথম দিকে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালসহ সত্তর দশকের প্রথম দিকে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কে ছিলেন তাহা আমার স্মরণ নাই। এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী সাহেব আমার তৃতীয় শ্বশুর। তিনি বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী। এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী সাহেব কোন সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন না, তিনি সব সময় মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, ইহা সত্য নহে। তিনি মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দিতা করেছেন আমি সেটা জানা স্বত্ত্বেও গোপন করেছি, ইহা সত্য নহে।
আমি আমার গ্রামের বাড়ি থেকে প্রাথমিক লেখাপড়া করেছি। আমি ১৯৬৭ সালে অসুস্থতা জনিত কারণে এস.এস.সি পরীক্ষা দিতে পারি নাই। ১৯৬৮ সালে সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি পাশ করেছি। আমি সরকারী এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা থেকে এইচ.এস.সি পাশ করেছি। ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ছাত্র সংসদের কোন নির্বাচন হয়েছিল কিনা তাহা আমার মনে পড়ছে না। ঐ কলেজের ছাত্র সংসদের ভি.পি হিসেবে একজনকে চিনতাম তার নাম সোহরাব উদ্দিন সোবা, তবে তিনি কোন সময়ের ভি.পি ছিলেন তাহা স্মরণ নাই। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ ছাড়াও ছাত্র ইউনিয়ন, মেনন গ্রুপ ছিল এবং ছোট গ্রুপ হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপ ছিল। তাছাড়াও আমাদের কলেজে এন.এস.এফ নামে একটা ছাত্র সংগঠন ছিল। ১৯৬৯ সালে পাবনা সদরে সম্ভবত ক্যাপ্টেন সৈয়দ আজগর হোসেন জায়েদী এম.এন.এ থাকতে পারেন। ঐ সময় পাবনা সদরে এম.পি.এ কে ছিলেন তাহা আমি মনে করতে পারছি না। ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী সাহেবকে আমি ছোট বেলা থেকেই চিনতাম। তিনি আমার পিতার বন্ধু ছিলেন। তিনি আইনজীবী ছিলেন। ১৯৭০ সালে পাবনা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি কে ছিলেন মনে করতে পারছি না। ১৯৭০ সালে পাবনা শহরে এডওয়ার্ড কলেজ ছাড়া একটি মহিলা কলেজ ছিল। পাবনা শহর ও জেলা ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ছিল শাহাব উদ্দিন চুপ্পু। এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রলীগের সেক্রেটারী ছিলাম আমি এবং সভাপতি ছিলেন নজরুল ইসলাম। এডওয়ার্ড কলেজে ইসলামী ছাত্রসংঘ আন্ডার গ্রাউন্ড হিসাবে ছিল, প্রকাশ্য কার্যক্রম ছিল না। বিধায় তাদের কাউকে আমি চিনতাম না। শহর ইসলামী ছাত্রসংঘের কাউকে আমি চিনতাম না। জেলা শাখার আবু হানিফ নামে একজনের নাম মনে আছে, আরো অনেককেই চিনতাম তাদের নাম মনে নাই। ঐ আবু হানিফ সাহেব জীবিত আছেন। তবে কোথায় থাকেন তাহা বলতে পারব না। উল্লেখিত আবু হানিফ সাহেব ১৯৭২ সালে পলাতক ছিল বিধায় তাকে স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে গ্রেফতার করা সম্ভব হয় নাই। রফিকুন নবী বাবলুকে আমি ষাটের দশকের শুরু থেকে চিনতাম। তিনি আমার থেকে বয়সে সামান্য ছোট হতে পারেন। তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র ছিলেন কিনা তাহা আমার মনে নাই। তিনি পাবনা বা পার্শ্ববর্তী জেলার কোন কলেজের ছাত্র ছিলেন কিনা তাহা আমি মনে করতে পারছি না। তিনি কতদূর লেখাপড়া করেছেন সে সম্পর্কেও আমার কোন ধারণা নাই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ছাত্রলীগের নেতা হিসাবে আমি সমগ্র পাবনা জেলায় প্রচারণায় অংশ গ্রহণ করেছিলাম। তবে আমার নির্বাচনী এলাকা হিসাবে সুজানগর, সাঁথিয়া ও বেড়া এলাকায় বিশেষভাবে দায়িত্ব পালন করি। মাওলানা ইছহাক সাহেবকে আমি ষাটের দশকের গোড়ার দিক থেকে চিনতাম। তিনি জলসা করতেন এবং ইসলামী রাজনীতির সাথে জাড়িত ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেব জাতীয় পরিষদে সাঁথিয়া, বেড়া, সুজানগর আসনে নির্বাচন করেছিলেন এবং মাওলানা ইছহাক সাহেব পাবনা সদরে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহন করেছিলেন। অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেবের প্রতিদ্বন্দী ছিলেন এ্যাডভোকেট আনোয়ারুল হক সাহেব সহ আরও অনেকে। এ্যাডভোকেট আনোয়ারুল হক সাহেব সম্পর্কে আমার বিস্তারিত আর কিছু জানা নাই। ঐ প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুর রব বগা মিয়া বিজয়ী হয়েছিলেন। পাবনা শহরে জনাব আমজাদ হোসেন সাহেব এম.এন.এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দী কে ছিলেন দীর্ঘ দিন আগের ঘটনা হওয়ায় তাহা আমার স্মরণ নাই। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেব যখন বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়তেন তখন থেকেই তাকে আমি চিনতাম। তিনি আমার পার্শ্ববর্তি গ্রামের লোক। ঐ মাদ্রাসায় তিনি কোন কাস পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন তাহা আমি বলতে পারব না। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়াশুনা করার আগে অন্য কোথাও লেখাপড়া করেছেন কিনা সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নাই। বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়াশুনার পরে তিনি সাঁথিয়া উপজেলার বাহিরে কোন এক মাদ্রাসায় পড়াশুনা করতেন শুনেছি তবে নাম বলতে পারব না। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব যখন বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়তেন তখন তাকে কেউ মতি ডাকতেন এবং কেউ তাকে নিজামী ডাকতেন।
আমি আমার ছোট পাথাইলহাট বাড়ি থেকে স্থায়ীভাবে শালগাড়িয়ার বাড়িতে যাই এস,এস,সি টেস্ট পরীক্ষার পরে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমি মে মাসের শেষের দিকে উচ্চতর ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ভারতের কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে যাই। সেখানে আনুমানিক ১০ দিনের মত ছিলাম। সেখান থেকে ব্যারাকপুর যাই। তোফায়েল আহমেদ সাহেব রাজশাহী বিভাগের মুজিব বাহিনীর প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন। সিরাজুল আলম খান নামে একজনকে আমি যুদ্ধকালীন সময়ে চিনতাম যাকে আমরা দাদাভাই বলে ডাকতাম। তিনি সম্ভবত মুজিব বাহিনীর ঢাকা জোনের দায়িত্বে ছিলেন। জেনারেল ওবানের নাম ঐ সময় শুনেছি, ঐসময় তিনি জেনারেল ছিলেন না, তার পদবী কি ছিল তাহা আমার স্মরণ নাই। মুক্তিযোদ্ধা ডি,এস,পি মাহবুব সাহেবকে আমি এই মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছিনা। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে ঢাকা জেলার এস,পি মাহবুব উদ্দিন, বীর বিক্রমকে এই মুহূর্তে চিনতে পারছিনা, অনেক চেনা মুক্তিযোদ্ধার নাম আমি ভুলে গেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিকে সিরাজুল আলম খান দাদাভাইয়ের চিন্তাধারায় জেনারেল ওবানের সক্রিয় সহযোগীতায় বি,এল,এফ গঠিত হয়, ইহা সত্য নহে। মুজিব বাহিনী কত তারিখে গঠিত হয় তাহা আমি বলতে পারব না, তবে ১৯৭১ সালের মে মাসে গঠিত হয়েছিল। প্রথমে বি,এস,এফ গঠিত হয়, পরবর্তীতে উহা মুজিব বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। আমি ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম বি.এল.এফ সম্পর্কে শুনতে পাই, তখন জানতে পেরেছিলাম যে, ১৯৬২ সাল থেকে ছাত্রলীগের একটা অংশে বি,এল,এফ-এর চিন্তা-চেতনা ছিল। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চের আগে বি,এল,এফ সংগঠনটি ঢাকায় ছিল, তবে আন্ডারগ্রাউন্ড হিসাবে ছিল।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের সময় আমি সহ পাবনা ছাত্রলীগের আরও অনেকে রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলাম। ঐসময় আমি নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়তাম। ১৯৭১ সালে ৭ই মার্চের সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সম্ভবত শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ।
আমার শহরের বাড়ি থেকে আলিয়া মাদ্রাসার দূরত্ব আনুমানিক আধা কিলোমিটারের কিছু বেশি হবে। ১৯৭০-৭১ সালে পাবনা আলিয়া মাদ্রাসায় ছাত্রলীগের কোন সংগঠন ছিল না, তবে কয়েকজন ছাত্র ছাত্রলীগের সমর্থক ছিল। তাদের নাম আমার স্মরণ নাই। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্রসংঘের কোন নেতা তৎকালীন সরকার কিংবা সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেছিল এই মর্মে ডন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ আমি পাবনা পাবলিক লাইব্রেরীতে পড়েছি। ডন পত্রিকাটি করাচি থেকে ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত। সাক্ষাতকার রাওয়ালপিন্ডি নাকি ঢাকায় হয়েছিল তাহা আমার মনে নাই। উল্লেখিত সাক্ষাতকারে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সৈয়দ আবুল আ’লা মওদূদী এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের পক্ষ থেকে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেব উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে সৈয়দ আবুল আ’লা মওদূদী ঢাকায় এসেছিলেন মর্মে কোন খবর পত্র-পত্রিকায় দেখেছিলাম কিনা তাহা আমার মনে নাই। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিলেন কিংবা সেখানে কোন সভা সমাবেশ করেছিলেন মর্মে কোন খবর পত্র-পত্রিকায় দেখেছিলাম কিনা তাহা আমার মনে নাই। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত মতিউর রহমান নিজামী সাহেব পাকিস্তান সরকারের পক্ষে এবং আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কোন বিবৃতি দিয়েছিলেন কিনা সে সম্পর্কে কোন খবর আমার নজরে আসে নাই। ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় কার্যালয় কোথায় ছিল তাহা এতদিন পরে আমি স্মরণ করতে পারছিনা, তবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুইটি অফিস ছিল। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব যে ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন তাহা আমি কেন সকলেই জানতো। পাবনা জেলায় ইসলামী ছাত্রসংঘ আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রাবাসকে অফিস হিসাবে ব্যবহার করতো। পাবনা জেলার ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারী ও সভাপতি কে ছিলেন আমি এতদিন পরে স্মরণ করতে পারছি না। পাবনা জেলায় সর্বপ্রথম জুলাই মাসে আলিয়া মাদ্রাসায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছিল। পাবনা জেলার রাজাকার বাহিনীর প্রধান কে ছিলেন তাহা আমার এতদিন পরে স্মরণ নাই। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে স্থানীয় ট্রেনিংয়ের সময় কর্মরত আনছার বাহিনীর সদস্যরা আমাদের সহযোগীতা করেছিলেন কিনা তাহা সুনির্দিষ্টভাবে আমার স্মরণ নাই। পাবনাতে কোন ই,পি,আর ক্যাম্প ছিল না। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর থেকে ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত বেসামরিক জনগণের জন্য আরিচা নগরবাড়ী ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল, তবে সামরিক বাহিনীর জন্য ফেরী ব্যবহৃত হতে


 today's (Thursday) cross examination (full)
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত নগরবাড়ী ও আরিচা ফেরী ঘাট সামরিক বাহিনীর লোকজন নিয়ন্ত্রন করতো, তাদের নাম আমি বলতে পারব না। সেকেন্দার আলীর বাড়ি শালগাড়িয়া গ্রামে ছিল। সেকেন্দার চায়ের দোকানদার ছিল, তিনি ঐ মিটিংয়ে চা সরবরাহ করতে গিয়েছিলেন বিধায় বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন। যে সেল গঠন করা হয়েছিল দীর্ঘদিন হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের নাম আমার মনে নাই, তবে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের লোকজন ছিল। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত পাবনা শহর অসহযোগ আন্দোলনকারীদের আংশিক নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ পর্যন্ত পাবনা শহরে আর্মিরা কয়েকটি পয়েন্টে ছিল। তাদের মধ্যে বিসিক, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, অন্তর্ভূক্ত ছিল, ইহা ছাড়া তারা পেট্রোল ডিউটি করতো। ২৭শে মার্চ, ১৯৭১ তারিখের আগ পর্যন্ত পাবনা জেলা সামরিক আইন প্রশাসকের অফিস কোথায় ছিল তাহা আমার স্মরণ নাই। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে ২৮শে মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান আর্মিরা পাবনা শহরে স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের দ্বারা অবরুদ্ধ ছিল, তবে তাদের সহযোগীরা অবরুদ্ধ ছিল না। পাবনা শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ থেকে আলিয়া মাদ্রাসার দূরত্ব আধা কিলোমিটার, তবে কোন্ দিকে তাহা এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। ১৯৭১ সালে বিসিক এলাকা পাবনা পৌরসভার ভিতরে নাকি বাইরে ছিল তাহা এ মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছি না। আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বিসিক এলাকা প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে, তবে কোন্ দিকে তাহা স্মরণ নাই। ১৯৭১ সালে আলিয়া মাদ্রাসা এবং বিসিক এলাকার অবস্থান যেখানে ছিল এখনও সেখানেই আছে। অসহযোগ আন্দোলন শুরু থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত পাবনা শহরের স্বাধীনতার পক্ষের আন্দোলন কার্যক্রম মূলতঃ ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করতো মুরুব্বীদের পরামর্শ অনুযায়ী। মুনসুর আলী সাহেবের টেলিফোন পাওয়ার পর থেকে ২৭শে মার্চ পর্যন্ত আমি পাবনা শহরে ছিলাম। আমি ঐ সময় এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্রলীগ শাখা অফিসে থাকতাম। এডওয়ার্ড কলেজ শাখা ছাত্রলীগের অফিসটি ছিল মুসলিম হোস্টেলে। মুসলিম হোস্টেল থেকে আলিয়া মাদ্রাসার দূরত্ব আনুমানিক ২০০/২৫০ গজ। নগরবাড়ী থেকে পাবনা শহরে যাওয়ার একাধিক রাস্তা রয়েছে তার মধ্যে একটি রাস্তার পাশে আমার বাড়ি। ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল তারিখে যখন পাকিস্তান আর্মিরা পাবনা শহরে প্রবেশ করে তখন তারা নগরবাড়ী, কাশিনাথপুর, মুজাহিদ কাব ও আমার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিলের পরে সর্বপ্রথম আমি আমার বাড়িতে কবে গিয়েছিলাম তাহা স্মরণ করতে পারছি না। ১২ই এপ্রিল তারিখে আমি শহিদনগরে ডাব বাগানে এ্যামবুশ অবস্থায় ছিলাম। ১১ই এপ্রিল নগরবাড়ী ঘাট থেকে সরাসরি ডাব বাগানে এসেছিলাম কিনা তাহা আমার মনে পড়ছে না। পাবনা শহরে মার্চের ২৭ ও ২৮ তারিখে প্রতিরোধ যুদ্ধের পর আমরা ২রা এপ্রিল তারিখে নগরবাড়ী ঘাটে গিয়ে এ্যাম্বুশ করি এবং সেখানে আমরা ১১ই এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত অবস্থান করি, এরপর সেখানে প্রচন্ড যুদ্ধ হওয়ার কারণে আমরা পাবনা ফিরে আসি এবং সেখানে থেকে পাইকারহাট ডাব বাগানে (বর্তমানে শহীদনগর) এসে এ্যাম্বুশ করি। ১২ই এপ্রিল থেকে ১৯শে এপ্রিল পর্যন্ত আমি  ডাব বাগানে ছিলাম কিনা তাহা স্মরণ নাই। আমার শালগাড়িয়ার বাড়ি পোড়ানো এবং আত্মীয় স্বজনদের মারপিট করার ঘটনা আমি পার্শ্ববর্তী হরেন সাহার বাড়ির বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে দেখেছিলাম। নগরবাড়ী ঘাট থেকে আমার শালগাড়িয়ার বাড়ির দূরত্ব আনুমানিক ৫০/৫৫ কিঃমিঃ হবে। ১৯৭১ সালে আমার শালগাড়িয়ার বাড়ির উত্তর দিকে আফজাল হোসেন টিপু, দক্ষিণে খোলা মাঠ এবং তার দক্ষিণে ধোপা বাড়ি ছিল, নাম মনে নেই, পশ্চিমে রাস্তা এবং পশ্চিমে সোনা ধোপার বাড়ি, পূর্ব দিকে হরেন সাহার বাড়ি ছিল। আমার বাড়িতে ঐ সময় আমার মা-বাবা, ভাই-বোন সকলেই ছিল। ভাই-বোনদের মধ্যে আমি সবার বড়। আমার এক ভাই মারা গেছে এবং এক ভাই জীবিত আছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে আমাদের বাড়িটি পূন:র্নিমাণ করা হয়। ঐ বাড়িটি বর্তমানে আমাদের মালিকানায় নেই, বিক্রয় করে দিয়েছি। ঐ বাড়িটির বর্তমান মালিক একজন মহিলা, তিনি স্কুল শিক্ষিকা। ঐ বাড়িটিতে বর্তমানে কোন এ্যাডভোকেট থাকেন কিনা তাহা আমি জানি না। আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর কোন ভাই এ্যাডভোকেট কিনা তাহা আমার জানা নাই। দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে আনুমানিক ২৫ বৎসর ঘর সংসার করেছি। তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে ২৫ বৎসর ঘর সংসার করাকালীন আমি বিদেশে থেকেছি, ঢাকায় থেকেছি বিধায় তার ভাইয়েরা কে কি করেন তাহা খোঁজ খবর নেই নাই। আমার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে আনুমানিক ৩৫ বৎসর পূর্বে আমার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, এবং তিনি জীবিত আছেন কিনা আমি জানি না, তবে শুনেছি তিনি মারা গেছেন। আমার প্রথম স্ত্রীর ঘরে একটি ছেলে আছে। তার নাম মুনতাসির মামুন, শুনেছি সে তার মায়ের সঙ্গে থাকে এবং ব্যবসা করে। পাবনা জেলা জজ আদালতে প্রাকটিসরত এ্যাডভোকেট কে,এম হামিদুর রহমানকে আমি চিনি না। পাবনার নোটারী পাবলিক এ,কে,এম শামছুল হুদা সাহেবকে আমি মনে করতে পারছি না। ২৭ ও ২৮শে মার্চের প্রতিরোধ যুদ্ধে পাবনা শহরে যে সকল পাকিস্তান আর্মিরা ছিল তারা সকলেই নিহত হয়েছিল। ঐ প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকিস্তান আর্মিদের কোন সহযোগী বাঙ্গালী নিহত হয়েছিল কিনা তাহা মনে করতে পারছি না। পাকিস্তান আর্মিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য আমাদের সোর্স ছিল। সোর্সদের মধ্যে একজন ছিলেন অবসর প্রাপ্ত আর্মি আব্দুর রশিদ, তিনি বর্তমানে মৃত। ১৯৭১ সালের ২রা এপ্রিল থেকে ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত আমরা নগরবাড়ী ফেরী ঘাটেই অবস্থান করছিলাম। যে দুইজন অবজারভেটিব পারসনের কথা আমি বলেছি তাদের নাম এ মুহূর্তে আমার স্মরণ নাই।
পাবনা শহরে বা জেলায় সর্বপ্রথম কোন্ স্থানে কবে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল তাহা স্মরণ নাই এবং তাহার সভাপতি ও সেক্রেটারী কে ছিল তাহাও স্মরণ নাই। পাবনা শহরে শান্তি কমিটির অফিস কোথায় ছিল তাহা আমার স্মরণ নাই, তবে তারা প্রায় সময় আলিয়া মাদ্রাসায় তাদের কার্যক্রম চালাতো। আমাদের শালগাড়িয়া এলাকার সাত্তার মাস্টার শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। ঘেটু রাজাকারকে চিনতাম, তার বাড়িও শালগাড়িয়ায় ছিল। সাঁথিয়া এলাকার বাতেন নামে একজনকে চিনতাম সে মাওবাদী ছিল, তবে সে নকশাল ছিল কিনা তাহা আমি জানি না, তবে আমি তাকে কখনো দেখি নাই। আমাদের সাঁথিয়া পাইলট স্কুলের শরীর চর্চার শিক্ষক তোফাজ্জল হোসেন সাহেবকে তিনি যখন বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়তেন তখন থেকে চিনতাম। আমাদের ছোট পাথাইল হাট থেকে বোয়ালমারী মাদ্রাসার দূরত্ব আনুমানিক ৪ কিঃমিঃ হবে। আমাদের ছোট পাথাইলহাট গ্রাম থেকে মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের মনমথপুর গ্রামের দূরত্ব আনুমানিক দেড় কিলোমিটার। মাঝে কোন গ্রাম নাই ফাঁকা মাঠ। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব বোয়ালমারী মাদ্রাসায় পড়াশুনা করাকালীন একবার ডাবল প্রমোশন পেয়েছিলেন কিনা তাহা আমি জানি না, তবে তিনি একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন তাহা শুনেছিলাম। ১৯৭১ সালের ১৪ই মে তারিখের আগে মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে রুপসী, ডেমরা ও বাউশগাড়ী গ্রামের আজগর, আহেদ, ওয়াজ, আপেল, হোসেন, আব্দুল, মোকছেদ, খোরশেদ, আবুল, জামিরন, খুদে রায়, বলরাম রায়, দিলীপ রায়, মনিন্দ্র নাথ নন্দী, আলম প্রামানিক ও মলম প্রামানিকদের সাথে কথা বলতে দেখেছি কিনা তাহা স্মরন নাই। শহীদ জামিরনের বাড়ী কোন্ গ্রামে তাহা আমি জানি না, তার সঙ্গে আমার ডেমরা বাজারে দেখা হতো। তার স্বামীর নাম এতদিন পর আমি স্মরণ করতে পারছি না। ঐ তিন গ্রামে পাকিস্তান আর্মিরা বিভিন্ন দিক দিয়ে এসেছিল, তবে বেশীর ভাগ বাউশগাড়ী গ্রামের রাস্তা দিয়ে এসেছিল। ঐ তিন গ্রামে ১৯৭১ সালে আনুমানিক কত লোক বসবাস করতো তাহা এতদিন পরে বলা সম্ভব নহে। ঐ তিন গ্রামে পাকিস্তান আর্মিরা আক্রমণ করার ফলে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আমার বন্ধু শ্যামল কুন্ডুর বোন এবং সেকেন্দার সহ আরও অনেকে আহত হয়েছিল। তাদের সকলের নাম স্মরণ নাই। ঐ তিন গ্রামে ১৯৭১ সালে যাদের বয়স ১২ বৎসর বা তার বেশি ছিল তাদের মধ্যে অনেকে এখন জীবিত আছে। ঐ ঘটনার সময় যারা আহত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই এখনও জীবিত আছে। ঐ ঘটনায় শহীদদের আত্মীয় স্বজন অনেকে জীবিত আছে। বেণু রায়ের বাড়ি ডেমরা গ্রামে। ঐ ঘটনার আগে থেকে বেণু রায়ের বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। ১৯৭১ সালে বেণু রায়ের বাড়ির উত্তরে কার বাড়ি তাহা স্মরণ নাই, দক্ষিনে বাগান ছিল, পূর্বে বাশঝাড় এবং পশ্চিমে মেইন রোডে আসার জন্য একটা রাস্তা ছিল। ঐ রাস্তার দৈর্ঘ্য ছিল আনুমানিক ৩০০ গজের একটু বেশি।
১৯৭১ সালের ২রা নভেম্বর থেকে ৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাবনার সাথিয়া এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের আংশিক নিয়ন্ত্রনে ছিল। ঐ আংশিক এলাকার মধ্যে সাঁথিয়া সদর অন্তর্ভূক্ত ছিল কিনা তাহা এতদিন পরে মনে করতে পারছি না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় সাঁথিয়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন নিজাম উদ্দিন এবং মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন লোকমান হোসেন। পরবর্তীতে কমান্ড একিভূত করে নিজাম উদ্দিনকে কমান্ডার করা হয়। ১৯৭১ সালের ৮ই ডিসেম্বর সাঁথিয়ার মুক্ত অঞ্চল পাকিস্তান আর্মিরা দখল নেওয়ার জন্য আক্রমন করেছিল। সেই আক্রমনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের কারণে পাকিস্তান আর্মি এবং তাদের সহযোগীরা পালিয়েছিল। সেই আক্রমনে মুক্তিযোদ্ধাদের কেহ নিহত হয় নাই, তবে অনেকে আহত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২রা নভেম্বর থেকে ৮ই ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত সাঁথিয়া মুক্ত এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান আর্মি ও  তাদের সহযোগীদের আক্রমনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে যেখানে রাজাকার ক্যাম্প ছিল সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমন হয়েছিল এবং সাথে পাকিস্তান আর্মিরা ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ঐ সময় ধূলাউড়ি সহ বিভিন্ন জায়গায় আক্রমন করেছিল।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড সম্পর্কে আমি মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে জড়িয়ে যে জবানবন্দী দিয়েছি সেই বিষয়টি আমি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্স এবং গোয়েন্দা সোর্সের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম। আমরা ওয়ারলেসের মাধ্যমে এই সমস্ত খবর উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতাম। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের আগ পর্যন্ত মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে আল বদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। ১৯৭১ সালে আমি পত্র-পত্রিকা পড়তাম এবং মিডিয়া স্টাডী করতাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন সেই বিষয়ে দেশী পত্রিকায় পরিবেশিত সংবাদ পড়েছি। এই বিষয়টি ঐ সময় ভারতের কিছু পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয় এবং ঐ সময় স্বাধীন বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভারত থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলার বানী পত্রিকায় ঐ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। স্বাধীনতা উত্তরকালে বুদ্ধিজীবি হত্যার বিষয়ে ৪০টির বেশী মামলা হয়েছিল কিনা বা ঐ মামলা সমূহের কোনটিতে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আসামী ছিলেন কিনা তাহা আমার স্মরণ নাই। ১৯৭১ সালের মে মাসে যখন মতিউর রহমান নিজামী সাহেব এবং মাওলানা সোবহান সাহেব আলিয়া মাদ্রাসায় আলবদর বাহিনী গঠন করেন তখন আলবদর শব্দটি সর্বপ্রথম শুনতে পাই। পাবনা জেলা আলবদর বাহিনীর প্রধান কে ছিলেন তাহা আমি স্মরণ করতে পারছি না। দেশ স্বাধীনের পরে সাঁথিয়ার বিভিন্ন ঘটনায় প্রায় ৩০ জনের অধিক রাজাকারের বিরুদ্ধে দালাল আইনে মামলা হয়েছিল কিনা তাহা আমি স্মরণ করতে পারছি না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফী চ্যানেল ছাড়া অন্য কোন টিভি চ্যানেল বা অন্য কোথাও আমি ভিডিও সাক্ষাৎকার দেই নাই কিংবা অন্য কোন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেই নাই। ন্যাশনাল জিওগ্রাফী চ্যানেলে আমি আশির দশকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম, ঐ সাক্ষাৎকারে মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের নাম বলেছিলাম কিনা তাহা আমার স্মরণ নাই। স্যাটেলাইট টেলিভিশন এদেশে প্রথম কবে চালু হয় তাহা আমি বলতে পারব না। সর্বশেষ প্রকাশিত গেজেট সহ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সম্বলিত কোন গেজেটের প্রকাশিত তালিকায় আমার নাম নাই, ইহা সত্য নহে। এস,এস,সি সার্টিফিকেট জাতীয় পরিচয় পত্র এবং পাসপোর্টে আমার জন্ম তারিখ ও সাল কত উল্লেখ আছে তাহা এ মূহুর্তে মনে করতে পারছি না। আমার জন্ম তারিখ ১০-১১-১৯৫৩ ইহা জেনেও গোপন করছি, ইহা সত্য নহে।
“১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ ঢাকা থেকে শহীদ ক্যাপ্টেন মুনসুর আলীর নিকট থেকে একটি টেলিফোন পাই। ফোনে তিনি আমাকে বলেন যে, পাকিস্তানীদের সংগে আলোচনা সফল না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তোমরা সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও” বা “১৯৭১ সালের ৯ই এপ্রিল তারিখের পূর্বে আমরা উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার নগরবাড়ী ঘাটে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য অবস্থান নিই। প্রতিরোধের অংশ হিসাবে আরিচা ঘাটে ই,পি,আর, এর ওয়ারলেস সেট সহ একজন অবজারভেটিভ পারসন (ও,পি) নিযুক্ত করা হয়। ৯ই এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে আরিচা ঘাটের ওয়ারলেস অপারেটর নগরবাড়ী ঘাটের ওয়ারলেস অপারেটরকে এই মর্মে জানান যে অনুমান সকাল ৮:০০ ঘটিকার সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গানবোট ফেরী নিয়ে নগরবাড়ী ঘাটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের সাথে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব এবং তার দলবলের লোকজন আছে। এতে আমরা বুঝলাম মতিউর রহমান নিজামী সাহেব এবং তার দলবল পাকিস্তানী বাহিনীকে পাবনা আক্রমণ করার জন্য পথ দেখিয়ে নগরবাড়ী ঘাটের দিকে নিয়ে আসছে। ঐদিন বেলা অনুমান ১১:০০ টার দিকে তারা নগরবাড়ী ঘাটে এসে পৌঁছলে” বা “এই যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সহযোগীতা নেয়” বা “ই,পি,আর, অবসরপ্রাপ্ত বাঙ্গালী আর্মি, পুলিশের সদস্যসহ প্রায় দেড়শত নিরীহ নিরস্ত্র বাঙ্গালী শহীদ হন, যারা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহযোগীতা করেছিল। এই ধরনের বিমান থেকে গোলা বর্ষণ এবং আর্টিলারী আক্রমণে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান প্রত্যাহার করে পাইকারহাটি ডাব বাগানে (বর্তমান নাম শহীদ নগর) অবস্থান নিই। ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের সহযোগী মতিউর রহমান নিজামী এবং তাদের দলবলসহ পাবনা শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং তখন রাস্তার দুই পাশের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে থাকে। ঐদিন বিকাল বেলা তারা পাবনা শহরে প্রবেশ করে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক নারকীয় যজ্ঞের সৃষ্টি করে” বা “পরিবারের লোকজনকে মারধোর করে” বা “সেই সহযোগীদের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী সাহেবসহ তার দলবল ছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণ করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য সহযোগীতা করেছিল। আমি ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং প্রত্যক্ষভাবে ঐ ঘটনা দেখি। ১৯৭১ সালের মে মাসের ১০ তারিখে সকাল অনুমান ১০:০০/১১:০০টার সময় মতিউর রহমান নিজামী সাহেব, মাওলানা আব্দুস সোহবান, ইছহাক মাওলানা, রফিকুন নবী বাবলু, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কুখ্যাত দালাল আসাদসহ কিছু লোকজন নিয়ে রূপসী প্রাইমারী স্কুলে আসে। সেখানে এসে প্রধান শিক্ষকের অফিস কক্ষে লোকজন ডেকে নিয়ে মতিউর রহমান নিজামী বলেন যে, এখানে শান্তি কমিটি গঠন করতে হবে এবং অচিরেই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী এসে এ এলাকায় শান্তি স্থাপন করবে, লোকজনকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহযোগীতা করার জন্য নির্দেশ দেন। আমি ঐ সময় ডেমরা গ্রামে অবস্থান করছিলাম। নিজামী সাহেবদের আসার খবর পেয়ে আমি রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে যাই এবং দেখতে পাই যে মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা আব্দুস সোবহান, মাওলানা ইছহাক, রফিকুন নবী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কুখ্যাত দালাল হেডমাস্টারের অফিস থেকে বেরিয়ে সাঁথিয়ার দিকে যাচ্ছে। আমি তখন রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেড মাস্টার শামসুর রহমান সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি জানান যে, মতিউর রহমান নিজামী সাহেব তাদেরকে শান্তি কমিটি গঠন করার কথা বলেছেন, অচিরেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এই এলাকায় আসবে এবং শান্তি স্থাপন করবে” বা “এই আক্রমণ ছিল বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য” বা “এই আক্রমণটি ছিল প্রি-প্লানড, সিষ্টেমেটিক এবং ওয়াইডস্প্রেড। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে করুনতম দিন যা আমি ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের নিকট সাক্ষাতকারে বলেছিলাম, এটা বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্যতম গণহত্যা” বা “তাদের মধ্যে শিখা ও শিলা নামের দুইজন কলেজ ছাত্রীকে পাকিস্তান আর্মির লোকজন ধরে নিয়ে গিয়েছিল যাদের সন্ধান আজও পাওয়া যায় নাই। এই ঘটনার সময় আমার বন্ধু বেণু রায়ের বাড়িতে আমি অবস্থান করছিলাম। ভোর বেলায় চাইনিজ অটোমেটিক রাইফেলের ব্রাশ ফায়ারের শব্দে আমি বুঝতে পারি নিকটেই কোন জায়গায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ হয়েছে। তখন আমি ঐ বাড়ির লোকজনকে সর্তক করি এবং ওখানে থাকা নিরাপদ মনে না করে স্কেপ করার জন্য আমি নিজে রাস্তার দিকে বেরিয়ে আসি। রাস্তায় বেরিয়ে এসে আমি দেখতে পাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা ইছহাক, মাওলানা আব্দুস সোবহান, রফিকুন নবী, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দালাল আসাদকে দেখি এবং তারা যাদেরকে দেখিয়ে দিচ্ছিল পাকিস্তান আর্মিরা তাদেরকেই গুলি করে হত্যা করছিল। আমি তখন নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাদের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে ধান ক্ষেতের ড্রেনের ভিতর অবস্থান নিই। ঐখান থেকেও কিছু কিছু ঘটনা দেখা যাচ্ছিল, যেমন মানুষের পালিয়ে যাওয়া, মেয়েদের হাত ধরে টানতে টানতে পাকিস্তান আর্মিদের ধরে নিয়ে যাওয়া, গাছের নিচে বসিয়ে মেয়েদের শরীর থেকে গহনা খুলে নেওয়া, বাড়ি ঘরে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলা। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর লোকজন চলে যাওয়ার পর আমি গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করি এবং নারকীয় যজ্ঞের চিহ্ন দেখি” বা “১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০০/১৫০ রাজাকারসহ এসে রাজাকার ক্যাম্প উদ্বোধন করেন। ক্যাম্প উদ্বোধনী বক্তৃতায় মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোকদের হত্যা করতে হবে। আরও বলেন যে, যুবক ছেলেদের রাজাকারে ভর্তি করতে হবে” বা “১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সারা পাকিস্তানের ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেব পাবনা আলিয়া মাদ্রাসায় আলবদরের ক্যাম্প স্থাপন করেন। ঐ ক্যাম্প থেকে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের আদেশ নির্দেশে এবং ষড়যন্ত্রে বৃহত্তর পাবনা জেলার বিভিন্ন জায়গায় আলবদররা হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন প্রকার মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করতো। সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেব মাঝেমাঝে যেতেন এবং তারই আদেশ নির্দেশে ঐ ক্যাম্পের কমান্ডার সামাদ ফকির সাঁথিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করতো। আমি সাঁথিয়া পাইলট স্কুলের ছাত্র বিধায় সেদিন যখন সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প উদ্বোধন করা হয় তখন আমি খবর পেয়ে স্কুলের সংগে লাগোয়া একটি খালের ওপারে দাড়িয়ে অবলোকন করার চেষ্টা করি। উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত লোকজনের নিকট থেকে উল্লেখিত বিবরণ জানতে পারি” বা “এই ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা কর্মীদের নিয়ে তিনি সমগ্র বাংলাদেশে আলবদর বাহিনী গঠন করেন। তিনিই ছিলেন এই আলবদর বাহিনীর প্রধান। তারই আদেশ, নির্দেশ ও ষড়যন্ত্রে এই আলবদর বাহিনী সারা বাংলাদেশে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ইত্যাদি প্রকার মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এদেশকে মেধা শূন্য করার জন্য আলবদর বাহিনী পাকিস্তানী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এদেশের সূর্য সন্তান বুদ্ধিজীবীদের রায়ের বাজারসহ দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখে” এই কথাগুলি আমি তদন্ত কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে।
সেকেন্দার আলীর নিকট থেকে পাবনা আলিয়া মাদ্রাসায় স্বাধীনতা বিরোধী সেল গঠন করার বিষয় শোনার কথা তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে। ১১ই এপ্রিল তারিখে আমার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার কথা তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে।
অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদানের আগে ডি,জি,এফ,আই এর লোকজন আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, ইহা সত্য নহে। জবানবন্দী প্রদানের আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, ইহা সত্য নহে। ইহা সত্য নহে যে, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সময়ে আমার ছেলে প্রতিপক্ষের আক্রমনে আহত হয়েছিল। ইহা সত্য নহে যে, আমার ছেলে ঐ সময় প্রতিপক্ষের দেওয়া একটি মামলায় আসামী ছিল। আমার ছেলে নির্বাচন পরবর্তীকালে এ,এস,পি পদে নিয়োগ পায়। আমি বিভিন্ন টি,ভি চ্যানেল, গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে এমন কি এফিডেভিট সম্পাদন করে নিজামী সাহেবকে ১৯৭১ সালে দেখি নাই মর্মে বক্তব্য দিয়েছি, ইহা সত্য নহে। উক্তরুপ কোন এফিডেভিট আমি সম্পাদন করি নাই। উক্তরুপ এফিডেভিট আমি সম্পাদন করেছি এবং উহার সম্পাদনকারী এ্যাডভোকেট ছিল আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর বড় ভাই জনাব কে,এম হামিদুর রহমান, ইহা সত্য নহে (প্রসিকিউশনের আপত্তি সহকারে)। পাবনার নোটারী পাবলিক এ,কে,এম শাসছুল হুদা আমার নিকট আত্মীয় বা কুটুম হওয়া স্বত্বেও আমি গোপন করছি, ইহা সত্য নহে। আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারণে উর্দ্ধতন নেতাদের নির্দেশে মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে অসত্য জবানবন্দী দিয়েছি, ইহা সত্য নহে। (জেরা সমাপ্ত)





বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৩

শায়িত অবস্থায় ট্রাইব্যুনালে আনা হল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে

মেহেদী হাসান
বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আজ  ইজি চেয়ারে শায়িত  অবস্থায় ট্রাইব্যুনারের বিচার কক্ষে হাজির করা হয়। তার শারিরীক অবস্থা জবানবন্দী দেয়ার  পর্যায়ে না থাকায় বিচার কার্যক্রম মুলতবি  করা হয়।

গত সোমবার জবানবন্দী প্রদানের সময় কাঠগড়ায় হঠাৎ অসুস্থ  হয়ে পড়েন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আজ  তাকে সাড়ে ১১টার দিকে ট্রাইব্যুনালে আনার পর তিনি হাজতখানার ইজি চেয়ারে শুয়ে থাকেন।
সকালে মামলার কার্য তালিকায় প্রথমে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলা ছিল। কিন্তু কোর্ট শুরুর নির্ধারিত সময় সাড়ে দশটার মধ্যে তাকে জেল কর্তৃপক্ষ ট্রাইব্যুনারে  হাজির  করতে না পারায় মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মামলার কার্যক্রম শুরু করা হয়। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলা নিয়ে যাওয়া হয়  দুপুরের বিরতির পর।  দুপুরের বিরতির পর দুইটায় কোর্ট  বসলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীরা তার অসুস্থতার কথা জানান এবং বিচার কার্যক্রম মুলতবি রাখার অনুরোধ করেন।  ট্রাইব্যুনাল তাকে  কোর্টরুমে নিয়ে আসতে বলেন। নির্দেশ মোতাবেক  কয়েকজন পুলিশ ইজি চেয়ারে শায়িত থাকা অবস্থায় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দোতলার কোর্টরুমে নিয়ে আসেন নিচ তলা থেকে। কোর্টরুমে আনার পরও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী শুয়ে থাকেন। এসময় তিনি লুঙ্গি পরিহিত ছিলেন এবং তাকে বিপর্যস্ত  ও বিমর্শ দেখাচ্ছিল। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির জানতে চান তিনি জবানবন্দী প্রদানের মত অবস্থায় আছেন কি-না। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কোন কথা বলছিলেননা। এরপর ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সুলতান মাহমুদ সিমনকে বলেন তার কাছে গিয়ে তার শারিরীক অবস্থার খোঁজ নিতে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তখন বলেন, তার প্রেসার ওঠানাম করছে। মাথা ঘুরছে। সবকিছু ঠিকমত দেখতে পাচ্ছেননা। মাথা ঘুরছে। গতকাল নামাজের সময় পড়ে গিয়েছিলেন। কয়েকবার ¯েপ্র নিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালকে সুলতান মাহমুদ তার অবস্থা  জানানোর পর বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির তাকে আবার নিচে হাজতখানায়  নিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। এরপর তার সাথে আসা  অ্যাটেনডেন্সকে কোর্টে তলব করেন। জেলখানার ম্যোডিক্যাল অ্যাটেনডেন্স আসার পর বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির তার কাছে জানতে চান আসামীকে নিয়ে সকালে আপনারা কয়টায় রওয়ানা দিয়েছেন। তিনি জবাব দেন নয়টা ২২ মিনিটে। এরপর  কোর্ট জানতে চান তখন তার শারিরীক অবস্থা কেমন ছিল, সাক্ষ্য দেয়ার মত অবস্থা ছিল কি-না।  তিনি জবাব দেন- ভাল ছিল। সাক্ষ্য দেয়ার মত অবস্থায় ছিল। গাড়িতে তোলার পর তিনি পথে ঘুমিয়ে ছিলেন।
এরপর কোর্ট তার কাছে জানতে চান তিনি কখন অসুস্থ হলেন।
অ্যাটেনডেন্স জবাব দেন-ট্রাইব্যুনালে আসার পর তিনি অসুস্থ হন। বুকে ব্যথার কথা বলেন।
এরপর তাকে প্রশ্ন করেন এখন তার অবস্থা কেমন?
তিনি জবাব দেন তার প্রেসার ১০০ বাই ৭০।
তার এখন কি করা উচিত প্রশ্ন করা হলে অ্যাটেনডেন্স বলেন, হৃদরোগের ডাক্তার দেখানো উচিত।
এরপর কোর্ট তার চিকিৎসার যথাযথ নির্দেশ  বিষয়ে অর্ডার দেয়ার কথা বলে বিচার আগামী রোববার পর্যন্ত মুলতবি করেন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম এরপর দাড়িয়ে বলেন, জেলখানা থেকে তার সাথে একজন মেডিক্যাল এসিসট্যান্ট পাঠানোর বিষয়টি প্রমান করে তাকে যখন নিয়ে আসা হয় তখন তার শারিরীক অবস্থা  ভাল ছিলনা। তাকে আদালতে পাঠানোর সময় শারিরীক অবস্থা  ভাল থাকলে তার সাথে মেডিক্যাল এসিট্যান্ট পাঠানো হতনা।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গাজিপুরের কাসিমপুর কারাগারে রাখা হয়েছে।





রবিবার, ২৩ জুন, ২০১৩

নিজামীকে জড়িয়ে ট্রাইব্যুনালে এবং ট্রাইব্যুনালের বাইরে সাক্ষীর দুই ধরনের বক্তব্য


মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে  চলতি মাসের ২০ জুন  বৃহষ্পতিবার ১১ তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন মোঃ শামছুল হক ওরফে নান্নু । তিনি পেশায় অ্যাডভোকেট এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ  করেছেন বলে ট্রাইব্যুনালে জানান।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ  মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে তিনি তার জবানবন্দীতে অনেকগুলো অভিযোগ করেন। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তার জন্য মাওলানা নিজামীসহ অন্যান্যরা মিলে স্বাধীনতা বিরোধী সেল গঠন, সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প উদ্বোধন, রুপসী প্রাইমারি স্কুলে শান্তিকমিটি গঠনের নির্দেশ এবং আলবদর বাহিনী গঠনের নেতৃত্ব দান।  এছাড়া মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষনের নেতৃত্ব দানের বেশ কয়েকটি অভিযোগ করেন সাক্ষী। পাবনা এলাকায় সংঘটিত এসব অপরাধের নেতৃত্ব দানের সময় সাক্ষী মাওলানা নিজামীকে দেখেছেন বলে সাক্ষ্য দেন। তিনি বলেন,  ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনী গানবোট নিয়ে নগরবাড়ি ঘাটের দিকে অগ্রসর হয়।  মাওলানা নিজামী এবং তার দলবল তাদের সাথে থেকে তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। সেদিনের যুদ্ধে প্রায় দেড়শ লোক শহীদ হয়। ১১ এপ্রিল মাওলনা নিজামী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিয়ে পাবনা শহরে প্রবেশ করে এবং রাস্তার দুপাশের  ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, দোকানপাট লুটপাট করে। ১৯ এপ্রিল একইভাবে মাওলানা নিজামীর সহায়তায় ডাববাগান আক্রমন পরিচালনা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১৪ই মে, ১৯৭১ ফজরের আযানের পর সশস্ত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মতিউর রহমান নিজামী, রফিকুন নবী, কুখ্যাত দালাল আসাদ এবং তার দলবল রূপসী, বাউশগাড়ী এবং ডেমরা গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং ব্যাপক গোলাগুলি চালিয়ে নিরস্ত্র নীরিহ এবং নির্দোষ মানুষদেরকে হত্যা করে। এতে ৪৫০ জনের অধিক শহীদ হন ।  এভাবে আরো বেশ: কিছু ঘটনা উল্লেখ করে সাক্ষী বলেন, মাওলানা নিজামীর দেখানো মতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেককে হত্যা করে। এসব  অনেক  অপরাধ সংঘটনের সময় মাওলানা নিজামীকে তিনি দেখার কথা বলেছেন।


ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার পূর্বে সাক্ষী মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দেন এবং সে জবানবন্দীতেও মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য লিখিত আছে তার নামে।

ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার পূর্বে গত বছর জুলাই মাসে মোঃ শামছুল হক ওরফে নান্নু অ্যাডভোকেট দিগন্ত টেলিভিশনের সাথে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। সে সাক্ষাতকারে তিনি  বলেন, মাওলানা নিজামীকে  জড়িয়ে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কোন জবানবন্দী দেননি তিনি। ১৯৭১ সালে তিনি পাবনায় মাওলানা নিজামীকে দেখেননি। মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে তার নামে তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দীতে যদি কিছু লেখা থাকে তাহলে তা মিথ্যা। দিগন্ত টিভি কর্তৃক গ্রহণ করা তার সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়নি ; তবে সে সাক্ষাতকারটি এখন ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ইউটিউবে তার আরো একটি ভিডিও সাক্ষাকার  রয়েছে এবং সেখানেও তিনি মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে কোন কিছু বলার কথা অস্বীকার করছেন। তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দীতে তার  নামে মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে জবানবন্দী বিষয়টি নজরে আসার পর সাক্ষী মোঃ শামছুল হক ওরফে নান্নু অ্যাডভোকেট ২০১২ সালে একটি এফিডেভিট তৈরি করেন এবং সেখানে তিনি ঘোষনা করেন-   ১৯৭১ সালের ঘটনা বিষয়ে মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে তার নামে তদন্ত কমকর্তার  তৈরি করা জবানবন্দীতে যা আছে তা মিথ্যা। তিনি তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দী উল্লেখ করে বলেন তিনি এসব কথা তার কাছে বলেননি।

প্রথমে আসা যাক দিগন্ত টিভিতে ধারন করা ইউটিউবে প্রচারিত তার সাক্ষাতকার বিষয়ে। নিম্নের এ লিংক দুটিতে তার সাক্ষাতকার দেখা এবং শোনা যাবে।
http

http://www.youtube.com/watch?v=90QbqzX4Y7E://www.youtube.com/watch?v=VdCU_R-6OLg

দিগন্ত টিভিতে  প্রদত্ত সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, বাউশগাড়ী ঘেরাও করার সময়  পাকিস্তানী আর্মিকে  সাহায্য করছে বেড়ার আসাদ নাম করে একটা লোক। সে  ওদেরকে রাস্তা দেখায়ে নিয়ে আসছে। ... বিষয়টা হলো তখন পাকিস্তান মিলিটারীর দাবড় খাইয়া লোক যার যার মত লাইফ নিয়ে পালায়।  যেটা বাস্তবতা। পালায়ে চলে যায়। আসাদকে সামনা সামনি আমি দেখিনি, তবে লোক সবাই বলছে, যারা দেখছে যে, আসাদ ছিল। এইখানে মাওলানা নিজামী সাহেব, সোবহান সাহেব বা আদারস্ যারা আছে, ওদের ওখানে কেউ বলে নি যে, তারা ছিল বা আমরাও দেখিনি।....স্বাধীন হওয়ার পর যখন যাদের লোকজন মারা গেছে তারা আসাদকে দেখায়ে দিল যে এই লোকটি আনছিল, তখন মুক্তিযোদ্ধারা গণআদালতে আসাদের বিচার করে, বিচার করে তার মৃত্যুদ- দেয়।...ডেমরা হত্যাকান্ডে  পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে রাস্তা আসাদ দেখায়ে নিয়ে আসছে।

এক প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, এ ঘটনায় আমি মতিউর রহমান নিজামীর নাম বলিনি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, তখন আমি মাওলানা নিজামী সাহেবকে চিনতামও না।আরেক প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, আমি তো বললাম, একাত্তরে তার সাথে আমার পরিচয়ই ছিলো নাই।

সাক্ষী বলেন, যে আসাদ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু সে মারা যাবার আগে কখনো মাওলানা নিজামী, আব্দুস সোবহানের নাম বলেনি।

তার নামে তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক  জমা দেয়া জবানবন্দীতে মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে সরাসরি অনেক অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সাক্ষী বলেন, তিনি এটা বলেননি। যদি এধরনের কথা লেখা থাকে তাহলে তা  ঠিক নয় এবং তিনি এর প্রতিবাদ করবেন।

ইউটিউবে প্রচারিত তার আরেকটি সাক্ষাতকারে দেখা যায় যেখানে সাক্ষী বলছেন “তা তো তখন আমি কোন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমার সামনেও সে (নিজামী)  কোন দিন পড়ে নাই। তার কারণ তাকে কোথাও কোন দিন দেখিও নাই। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কিছু করার দেখি নাই বিরোধীতা করার কিছু করারও দেখি নাই।.. আমি নিজামী সাহেবকে কখনো দেখিনি। আমি একচুয়ালি যখন ওই যে পলিটিকস ওপেন হলো ৮৬ ইলেকশনে এ তখন থেকে তার সঙ্গে পরিচয়।

এফিডেভিট : সাক্ষী মো : মোঃ শামছুল হক ওরফে নান্নু  ২০১২ সালে ১ম শ্রেণীর মেজিস্ট্রেট/ নোটারি পাবলিক এর কার্যালয়, পাবনা একটি হলফনামা তৈরি করেন। ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে তৈরি করা সে হলফনামায় সাক্ষী মো : শামছুল হক ঘোষনা করেন- স্বাধীনতাবিরোধী সেল গঠন, বাউশগাড়ীসহ বিভিন্ন অপারেশনে মাওলানা নিজামী কর্তৃক পাকিস্তানী সেনাবাহিীনকে নিয়ে যাওয়া এবং পথ দেখিয়ে দেয়া, রাজাকার বাহিনী গঠনসহ মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে আমার নামে তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দীতে যা উল্লেখ রয়েছে তা মিথ্যা।

তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক  জমা দেয়া জবানবন্দী কোট করে তিনি  ঘোষনা করেন-“এ বিষয়ে আমার পরিস্কার বক্তব্য এই যে,  আমি অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জনাব আব্দুর রাজ্জাক খানের  নিকট প্রদত্ত জবানবন্দীকালে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে জড়াইয়া এ ধরনের কোন বক্তব্য প্রদান করিনাই। যদি আমার নামে উল্লিখিত কোন বক্তব্য লিখিত থাকে তাহা হইলে তা তদন্ত কর্মকর্তার মনগড়া বক্তব্য।
আমি এই মর্মে আরো ঘোষনা করিতেছি যে, আমি যে বক্তব্য প্রদান করিয়াছি তাহাতে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে জড়াইয়া কোন বক্তব্য  প্রদান করিনাই। কারণ তিনি উল্লিখিত ঘটনার সাথে কোনভাবেই জড়িত ছিলেননা।”

এফিডেভিট, দিগন্ত টিভিতে প্রদত্ত সাক্ষাতকার যা এখন ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে এ বিষয়ে সাক্ষীর মতামত জানানর জন্য তাকে ফোনে চেষ্টা করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।


ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ত জবানবন্দী :
২০/৬/২০১৩
আমার নাম মোঃ শামছুল হক ওরফে নান্নু, আমার বয়স অনুমান ৬০ বৎসর। আমার ঠিকানা- গ্রাম ছোট পাথাইল হাট, থানা- সাঁথিয়া, জেলা- পাবনা।
আমি পেশায় একজন আইনজীবী। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার সমিতির সদস্য। ঢাকা এবং নিজ জেলা পাবনায় আইন পেশায় নিয়োজিত আছি।
মহান মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন আমি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বি,এ, কাসের ছাত্র ছিলাম। আমি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ ঢাকা থেকে শহীদ ক্যাপ্টেন মুনসুর আলীর নিকট থেকে একটি টেলিফোন পাই। ফোনে তিনি আমাকে বলেন যে, পাকিস্তানীদের সংগে আলোচনা সফল না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তোমরা সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ সরকারী এডওয়ার্ড কলেজ শাখার ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পাবনা জেলায় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বি,এল,এফ) এর পাবান জেলা শাখা আমরা গঠন করি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির অংশ হিসাবে। ২৪শে মার্চ তারিখে পাবনা আলিয়া মাদ্রাসার নিকটবর্তী দোকানদার সেকেন্দার আলীর নিকট থেকে জানতে পারি যে ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সাহেব, মাওলানা আব্দুস সোবহান, মাওলানা ইছহাক, রফিকুন নবী ওরফে বাবলু পাবনা আলিয়া মাদ্রাসায় বসে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য ও সহযোগীতা করার জন্য একটি স্বাধীনতা বিরোধী সেল গঠন করে। ২৫শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে যখন পাকিস্তান আর্মিরা পাবনায় ক্রাকডাউন করে তখন ২৬ মার্চ পাবনা বাসিরা, পুলিশ ও আর্মি সদস্য (অবসর প্রাপ্ত) পাকিস্তান ক্যাডেট কোরের সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এতে ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ পাবনা সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত হয়। পাবনা হানাদার মুক্ত হওয়ার পর মতিউর রহমান নিজামী সাহেব, মাওলানা আব্দুস সোবহান, মাওলানা ইছহাক, রফিকুন নবী ওরফে বাবলু গং পাবনা থেকে পালিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ৯ই এপ্রিল তারিখের পূর্বে আমরা উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার নগরবাড়ী ঘাটে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য অবস্থান নিই। প্রতিরোধের অংশ হিসাবে আরিচা ঘাটে ই,পি,আর, এর ওয়ারলেস সেট সহ একজন অবজারভেটিভ পারসন (ও,পি) নিযুক্ত করা হয়। ৯ই এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে আরিচা ঘাটের ওয়ারলেস অপারেটর নগরবাড়ী ঘাটের ওয়ারলেস অপারেটরকে এই মর্মে জানান যে অনুমান সকাল ৮:০০ ঘটিকার সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গানবোট ফেরী নিয়ে নগরবাড়ী ঘাটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের সাথে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব এবং তার দলবলের লোকজন আছে। এতে আমরা বুঝলাম মতিউর রহমান নিজামী সাহেব এবং তার দলবল পাকিস্তানী বাহিনীকে পাবনা আক্রমণ করার জন্য পথ দেখিয়ে নগরবাড়ী ঘাটের দিকে নিয়ে আসছে। ঐদিন বেলা অনুমান ১১:০০ টার দিকে তারা নগরবাড়ী ঘাটে এসে পৌঁছলে সেখানে পাকিস্তানী সোনাবাহিনীর সংগে মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সহযোগীতা নেয়। সেই যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন, ই,পি,আর, অবসরপ্রাপ্ত বাঙ্গালী আর্মি, পুলিশের সদস্যসহ প্রায় দেড়শত নিরীহ নিরস্ত্র বাঙ্গালী শহীদ হন, যারা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহযোগীতা করেছিল। এই ধরনের বিমান থেকে গোলা বর্ষণ এবং আর্টিলারী আক্রমণে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান প্রত্যাহার করে পাইকারহাটি ডাব বাগানে (বর্তমান নাম শহীদ নগর) অবস্থান নিই। ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের সহযোগী মতিউর রহমান নিজামী এবং তাদের দলবলসহ পাবনা শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং তখন রাস্তার দুই পাশের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে থাকে। ঐদিন বিকাল বেলা তারা পাবনা শহরে প্রবেশ করে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক নারকীয় যজ্ঞের সৃষ্টি করে। ১১ই এপ্রিল বিকাল বেলা তারা আমার পাবনা শহরের শালগাড়িয়া বাসভবন আক্রমণ করে লুটপাট করে জ্বালিয়ে দেয় এবং পরিবারের লোকজনকে মারধোর করে। ঘটনার সময় পাকিস্তান আর্মিদের সংগে ছিল মতিউর রহমান নিজামী এবং তার দলবল। ১৯৭১ সালের সম্ভবত ১৯শে এপ্রিল দুপুর ২:০০ টার দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এদেশীয় সহযোগীদের সাথে করে পাইকারহাটি ডাব বাগানে (বর্তমান শহীদ নগর) মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর ব্যাপক সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। সেই সহযোগীদের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী সাহেবসহ তার দলবল ছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণ করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য সহযোগীতা করেছিল। আমি ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং প্রত্যক্ষভাবে ঐ ঘটনা দেখি। ১৯৭১ সালের মে মাসের ১০ তারিখে সকাল অনুমান ১০:০০/১১:০০টার সময় মতিউর রহমান নিজামী সাহেব, মাওলানা আব্দুস সোহবান, ইছহাক মাওলানা, রফিকুন নবী বাবলু, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কুখ্যাত দালাল আসাদসহ কিছু লোকজন নিয়ে রূপসী প্রাইমারী স্কুলে আসে। সেখানে এসে প্রধান শিক্ষকের অফিস কক্ষে লোকজন ডেকে নিয়ে মতিউর রহমান নিজামী বলেন যে, এখানে শান্তি কমিটি গঠন করতে হবে এবং অচিরেই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী এসে এ এলাকায় শান্তি স্থাপন করবে, লোকজনকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহযোগীতা করার জন্য নির্দেশ দেন। আমি ঐ সময় ডেমরা গ্রামে অবস্থান করছিলাম। নিজামী সাহেবদের আসার খবর পেয়ে আমি রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে যাই এবং দেখতে পাই যে মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা আব্দুস সোবহান, মাওলানা ইছহাক, রফিকুন নবী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কুখ্যাত দালাল হেডমাস্টারের অফিস থেকে বেরিয়ে সাঁথিয়ার দিকে যাচ্ছে। আমি তখন রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেড মাস্টার শামসুর রহমান সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি জানান যে, মতিউর রহমান নিজামী সাহেব তাদেরকে শান্তি কমিটি গঠন করার কথা বলেছেন, অচিরেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এই এলাকায় আসবে এবং শান্তি স্থাপন করবে।
এই ঘটনার চারদিন পর অর্থাৎ ১৪ই মে, ১৯৭১ ফজরের আযানের পর সশস্ত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংগে মতিউর রহমান নিজামী, রফিকুন নবী, কুখ্যাত দালাল আসাদ এবং তার দলবল রূপসী, বাউশগাড়ী এবং ডেমরা গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং ব্যাপক গোলাগুলি চালিয়ে নিরস্ত্র নীরিহ এবং নির্দোষ মানুষদেরকে হত্যা করে। এই আক্রমণ ছিল বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য। ঐ আক্রমণে আমার পরিচিত আজগর, আহেজ, ওয়াজ, আপেল, একেন, আব্দুল মোকছেদ, খোরশেদ, আবুল, জামিরন, খুদে রায়, বলরাম রায়, দিলীপ কুমার রায়, মনিন্দ্র নাথ নদী, আলম প্রামাণিক, মলম প্রামাণিকসহ মোট ৪৫০ জনের অধিক শহীদ হন। এই আক্রমণটি ছিল প্রি-প্লানড, সিষ্টেমেটিক এবং ওয়াইডস্প্রেড। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে করুনতম দিন যা আমি ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের নিকট সাক্ষাতকারে বলেছিলাম, এটা বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্যতম গণহত্যা। এই আক্রমণের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তার সহযোগী নিজামী সাহেব এবং তার দলবল ১৩৭টি বাড়িঘর, দোকানপাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার সময় লাগালাগি ঐ তিনটি গ্রামের ৩০/৪০ জন মেয়েকে ধর্ষণ করে। তাদের মধ্যে শিখা ও শিলা নামের দুইজন কলেজ ছাত্রীকে পাকিস্তান আর্মির লোকজন ধরে নিয়ে গিয়েছিল যাদের সন্ধান আজও পাওয়া যায় নাই। এই ঘটনার সময় আমার বন্ধু বেণু রায়ের বাড়িতে আমি অবস্থান করছিলাম। ভোর বেলায় চাইনিজ অটোমেটিক রাইফেলের ব্রাশ ফায়ারের শব্দে আমি বুঝতে পারি নিকটেই কোন জায়গায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ হয়েছে। তখন আমি ঐ বাড়ির লোকজনকে সর্তক করি এবং ওখানে থাকা নিরাপদ মনে না করে স্কেপ করার জন্য আমি নিজে রাস্তার দিকে বেরিয়ে আসি। রাস্তায় বেরিয়ে এসে আমি দেখতে পাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা ইছহাক, মাওলানা আব্দুস সোবহান, রফিকুন নবী, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দালাল আসাদকে দেখি এবং তারা যাদেরকে দেখিয়ে দিচ্ছিল পাকিস্তান আর্মিরা তাদেরকেই গুলি করে হত্যা করছিল। আমি তখন নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাদের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে ধান ক্ষেতের ড্রেনের ভিতর অবস্থান নিই। ঐখান থেকেও কিছু কিছু ঘটনা দেখা যাচ্ছিল, যেমন মানুষের পালিয়ে যাওয়া, মেয়েদের হাত ধরে টানতে টানতে পাকিস্তান আর্মিদের ধরে নিয়ে যাওয়া, গাছের নিচে বসিয়ে মেয়েদের শরীর থেকে গহনা খুলে নেওয়া, বাড়ি ঘরে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলা। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর লোকজন চলে যাওয়ার পর আমি গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করি এবং নারকীয় যজ্ঞের চিহ্ন দেখি।
১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০০/১৫০ রাজাকারসহ এসে রাজাকার ক্যাম্প উদ্বোধন করেন। ক্যাম্প উদ্বোধনী বক্তৃতায় মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোকদের হত্যা করতে হবে। আরও বলেন যে, যুবক ছেলেদের রাজাকারে ভর্তি করতে হবে। ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সারা পাকিস্তানের ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেব পাবনা আলিয়া মাদ্রাসায় আলবদরের ক্যাম্প স্থাপন করেন। ঐ ক্যাম্প থেকে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের আদেশ নির্দেশে এবং ষড়যন্ত্রে বৃহত্তর পাবনা জেলার বিভিন্ন জায়গায় আলবদররা হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন প্রকার মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করতো। সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেব মাঝেমাঝে যেতেন এবং তারই আদেশ নির্দেশে ঐ ক্যাম্পের কমান্ডার সামাদ ফকির সাঁথিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করতো। আমি সাঁথিয়া পাইলট স্কুলের ছাত্র বিধায় সেদিন যখন সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প উদ্বোধন করা হয় তখন আমি খবর পেয়ে স্কুলের সংগে লাগোয়া একটি খালের ওপারে দাড়িয়ে অবলোকন করার চেষ্টা করি। উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত লোকজনের নিকট থেকে উল্লেখিত বিবরণ জানতে পারি।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ১৯৭১ সালে সারা পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। এই ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা কর্মীদের নিয়ে তিনি সমগ্র বাংলাদেশে আলবদর বাহিনী গঠন করেন। তিনিই ছিলেন এই আলবদর বাহিনীর প্রধান। তারই আদেশ, নির্দেশ ও ষড়যন্ত্রে এই আলবদর বাহিনী সারা বাংলাদেশে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ইত্যাদি প্রকার মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এদেশকে মেধা শূন্য করার জন্য আলবদর বাহিনী পাকিস্তানী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এদেশের সূর্য সন্তান বুদ্ধিজীবীদের রায়ের বাজারসহ দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখে। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব অদ্য ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন (সনাক্তকৃত)। আমি অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি।


দিগন্ত টিভি সাক্ষাৎকার-শামসুল হক নান্নু ঃ
শামসুল হক নান্নু ঃ  তারা পুলিশ, বাঙ্গালী মেলেটারী এবং পাবনার ডিসি নুরুল কাদের খান, যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী এক্সাইল বাংলাদেশ গভমেন্টের সংস্থাপন সচিব হয়েছিলেন। তিনি এবং পাবনার এসপি এম.এ গোফার এরা সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিরোধ করে। প্রতিরোধের এ পর্যায়ে ২৭শে মার্চ পাবনা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্ত হয় এবং ২৯শে মার্চ সারা বাংলাদেশে মধ্য একমাত্র পাবনাতেই পাবনার জেলা প্রশাসক, এসপি, জেলা জজ, অল ম্যাজিস্টেস্, অল গভমেন্ট অফিসার্স এবং পুলিশের গার্ড অব অনারে স্বাধীন বাংলাদেশের পাবনা জেলা জজ কোর্টের উপরে উঠানো হয় এবং সিভিল প্রশাসন চালু করা হয়। তো সেই অবস্থা থেকে গনরবাড়ী ঘাটে তখন প্রতিরোধ, নগরবাড়ী ঘাট যেহেতু উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার ছিল প্রতিরোধ যোদ্ধারা ওই নগরবাড়ী ঘাটে অবস্থান নেয়। সম্ভবত অনেক দিনের ঘটনা, সবকিছু ঠিকঠাক মনে নেই। ৯ এপ্রিলের আগে, ৭ই এপ্রিল হতে পারে, সেই নগরীরঘাটে পাকিস্তানী এয়ার এটার্ক হয় এবং সম্মিলিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আক্রমণ হয়। তখন আমাদের এম্বুস উড্র করে আমরা পাইকের হাটি ডাববাগানে আসি। সেইখানে ইপিয়ারের বগুড়ার এবং বিভিন্ন জায়গার প্রতিরোধ করে। প্রতিরোধ যুদ্ধে সেখানে প্রতিরোধ ভাইঙ্গে পড়ে।
তার পরে হলো, সেটা বৈশাখ মাসের কয় তারিখ হইতে পারে ঠিক মনে নাই, আমি আমার দেশেরবাড়ী ডেমরার কাছে ছোট পাথালের বানাগডা ওখানে যায়।
চ্যানেল ঃ আচ্ছা এখানে ডেমরার এবং বাউসগাড়ী।
শামসুল হক নান্নু ঃ  হ্যা, ডেমরা এবং বাউসগাড়ী এডজাস্টেন।
চ্যানেল ঃ সেখানকার যে হত্যাকা- বা লুটপাট সেই প্রসঙ্গে ওই ঘটনার ক্ষেত্রে ওখানে কি ঘটেছিল?
শামসুল হক নান্নু ঃ  ওখানে ঘটেছিল, সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত। ওই ডেমরা গ্রামে চারদিক থেকে ধনাঢ্য হিন্দুরা এসে ওখানে সেল্টার নেই। এটা শোনা যাচ্ছিল যে, পাকিস্তানী মিলিটারী আসতে পারে। তো ওই দিনে দেখাগেলো যে, চাইনিস অটো রাইফেলের গুলির শব্দ। আমরা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম, সাউন্ডটা বুঝতে পারতাম, কোন পক্ষের বুলেট, তখন দেখাগেলো যে, গোট ডেমরা গ্রাম পাকিস্তানী মিলিটারী ঘিরে নিছে। এইটা ঘেরায় সাহায্য করছে বেড়ার আসাদ নাম করে একটা লোক ওদেরকে রাস্তা দেখায়ে নিয়ে আসছে। এই আসাদ যাদেরকে দেখায়ে দিছে তারা আর জানে বাঁচে নাই। তাদেরকে গুলি করে মাইরে ফেলছে। তো সেইখানে এবাউট সাড়ে চারশ লোক মারা যায়। প্রায় পৌনে দুইশ বাড়ীÑঘর পুড়ে যায়, বেশকিছু মেয়ে ধর্ষণ হয়। ডেমরা এবং বাউসগাড়ী পাশাপাশি দুইটি গ্রাম।
চ্যানেলঃ তো এখানে বলা হচ্ছে যে, এই ধর্ষণ, হত্যাকা- বা অগ্নিসংযোগ যেটা ঘটেছে তাতে একটি নাম বলেছেন, শোনা যাচ্ছে এই ঘটনার সাথে মতিউর রহমান নিজামী, তারপরে আরো মাওলানা সুবহানসহ আরো কয়েকজন ইনভলভ আছে। এই বিষয়ে আপনি একটু বলবেন..?
শামসুল হক নান্নু ঃ  বিষয়টা হলো তখন পাকিস্তান মিলিটারীর দাবড় খাইয়া লোক যার যার মত লাইফ নিয়ে... যেটা বাস্তবতা। পালায়ে চলে যায়। আসাদকে সামনা সামনি আমি দেখিনি, তবে লোক সবাই বলছে, যারা দেখছে যে, আসাদ ছিল। এইখানে মাওলানা নিজামী সাহেব, সোবহান সাহেব বা আদারস্ যারা আছে, ওদের ওখানে কেউ বলে নি যে, তারা ছিল বা আমরাও দেখিনি।
চ্যানেল ঃ ট্রাইব্যুনালের কাছে আপনি যে লিখিত স্টেটমেন্ট যেটা ট্রাইব্যুনালে পেশ করেছেন সেখানে স্বাক্ষী হিসেবে আপনার নাম আছে, এবং আপনি তাদের নাম বলেছেন এরকম স্টেটমেন্ট আছে।
শামসুল হক নান্নু ঃ  এধরনের স্টেটমেন্ট থাকলে স্টেটমেন্টটা ঠিক না। আমরা এধরনের স্টেটমেন্ট দেয়নি।
চ্যানেলঃ প্রসিকিউটর যে আদালতে দিল সেটা কতটুকু সত্য?
শামসুল হক নান্নু ঃ  আমাদের নাম দিয়ে যদি এ ধরনের কোন স্টেটমেন্ট দেয়, সেটা আমরা প্রটেস্ট করব। সেটা তারা দিলে এটা ঠিক করেনি।
চ্যালেনঃ আদালতকে তারা যে আপনাদের সাথেপ্রসিকিউটরের এ বিষয়ে কোন কথা হয়নি?
শামসুল হক নান্নু ঃ  প্রসিকিউটরের সাথে আপনি যেভাবে জিজ্ঞেস করলেন, এভাবে কথা হয়েছে। যে, ওখানে গণহত্যাটা কিভাবে হলো? তখন আমি আসাদের নাম বলছি। সেই রাস্তা দেখায়। এবং এই আসাদটা, আপনাকে আরো বলি, স্বাধীন হওয়ার পর যখন যাদের লোকজন মারা গেছে তারা আসাদকে দেখায়ে দিল যে এই লোকটি আনছিল, তখন মুক্তিযোদ্ধারা গণআদালতে আসাদের বিচার করে, বিচার করে তার মৃত্যুদ- দেয়।
চ্যানেলঃ প্রসিকিউশনের কাছে আপনি কি বলেছিলেন?
শামসুল হক নান্নু ঃ  প্রসিকিউশনের কাছে আমি বলছি যে, ডেমরা হত্যাকা-ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে রাস্তা আসাদ দেখায়ে নিয়ে আসছে।
চ্যানেলঃ সেখানে আপনি কি মতিউর রহমান নিজামীর নাম বলেছিলেন?
শামসুল হক নান্নু ঃ  না, আমি মতিউর রহমান নিজামীর নাম বলিনি।
চ্যানেলঃ তাহলে তার নামটা আপনার নাম দিয়ে কেন দিল?
শামসুল হক নান্নু ঃ  এটা তাদের বিষয়, দিয়ে থাকলে আমি এটা প্রটেস্ট করব।
চ্যানেলঃ তো অনেকদিন পরে, মানে এখন যে স্টেটমেন্ট, আপনি এখন যে জিনিসটা বলতেছেন, এটা এখন যে আপনি সাহস নিয়ে সততার পরিচয় দিয়ে বললেন, এটা কোন উপলব্ধি থেকে বললেন? বা আপনার এ ফিলিংসটা কেন আসল?
শামসুল হক নান্নু ঃ  আমরা যেটা সত্যিকারের ঘটনা সেটা প্রকাশ করার জন্য বললাম। যেটা বাস্তব সেটা লোক জানুক। ওই এলাকায় আপনি যদি কোন সময় যান আপনি টেলিভিশন টীম নিয়ে, তারাও বলবে যে, আসাদ নিয়ে আসছিল। এবং যারা শহীদ পরিবারের লোকজন তারাও বলবে যে, আসাদই নিয়ে আসছিল।
চ্যানেলঃ এইখানে যদি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বা সোবহান সাহেব এদের নাম জড়িয়ে মামলাটা পরিচালনা করা হয় আপনি তো একজন বিশিষ্ট আইনজীবীও, এ বিষয়টা আপনি কিভাবে দেখেন?
শামসুল হক নান্নু ঃ  এটা করা হলে সত্যের একটা অপলাপ হবে। যেহেতু আসাদ নিয়ে আসছিল, সেই আসাদকে গণআদালতে বিচার করে তখনই ৭১ সালেই ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে মৃত্যুদ- দেয় হয়। সেই বিষয়টি যদি অন্যের উপরদিয়ে ই-করা হয়, এটা একটা সত্যের অপলাপ হবে।
চ্যানেলঃ তো এ বিষয়ে আপনি কোন এপিটএভিট দিয়েছেন? যাতে সত্য জিনিসটা প্রকাশ পায়।
কামসুল হক নান্নু ঃ  প্রয়োজন হলে আমি দেব। আমি সত্যি কথাটা বলব।
চ্যানেলঃ তখন আপনি কি বলেছেন?
শামসুল হক নান্নু ঃ  এই কথাই বলছি।
চ্যানেলঃ এই বিচারটা, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, এই বিচারটা আপনি কেমনভাবে দেখতে চান?
শামসুল হক নান্নু ঃ  আমার বক্তব্যটা হলো, এই বিষয়ে স্বাধীন হওয়ার পরপর বাংলাদেশের পার্লামেন্টে একটা আইন হয়। সেই আইনে অনেকে গ্রেফতারও হয়, অনেকে কনভিউশন হয়, অনেকের একুইটাল হয়। ঐটা একটা বিষয় এমন এটা আগেই এ বিষয়ের যা কার্যক্রম বা একশান হয়ে গেছে। তো এতদিন পরে এ বিষয়টা নিয়ে টানাটানি করে জাতীকে দিধা বিভক্তি করা ওঃ রিষষ ষড়ংব ড়ঁৎ রহফবঢ়বহফবহপব. এটা আমার নিজেস্ব উপলব্ধি।
চ্যানেলঃ প্রসিকিউশনের সাথে আপনি যখন কথা বলেছেন, তখন আপনি একটা স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, যেখানে একজন সৎ সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনি সত্য কথাগুলো বলেছেন। তাহলে পরবর্তীতে আপনার স্টেটমেন্ট, এখন যেটা দেখা যাচ্ছে যেটা আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে, এই দুইটার মধ্যে গড়মিলটা কেন?
শামসুল হক নান্নু ঃ  এখন আমি একজন আইনজীবী হিসেবে বলতে চাই, যে ১৬১ করে যে আয়ু, সে তার কলমে অনেক কিছুই লিখতে পারে। পরবর্তীতে সে ১৬১টা আদালতে স্বাক্ষী দিয়ে প্রমাণিত হয়। আইনের দৃষ্টিতে পুলিশের কাছে দেয়া স্টেটমেন্টের আইনগত খুব একটা ভ্যালু নেই। আদালত যখন ১৬১ এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাক্ষ্য গ্রহণ করে, আদালতে যেটা স্বাক্ষ্য দেয় সেটাই হলো আসল কথা।
চ্যানেলঃ তো এখানে আপনার দেয়া লিখিত স্টেটমেন্ট যেটা আছে, সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ৩৫০ বা ৪৫০জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়েছে। ১৩৭টি বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
শামসুল হক নান্নু ঃ  এগুলো হয়েছে, কিন্তু এগুলোর নেতৃত্ব দিয়েছে আসাদ। পাকিস্তানী মিলিটারীর সাথে এসে ও লোক চিনায়েও দিয়ে যে, এই লোক এরকম, ও যাকে দেখায়ে দিয়েছে সে আর বাচেনিতো।
চ্যানেলঃ নিজামীর নাম আসলো কেন?
শামসুল হক নান্নু ঃ  এটা প্রসিকিউটর বলতে পরবে।
চ্যানেলঃ আপনি নিজামীর নাম বলেননি?
শামসুল হক নান্নু ঃ  না।
চ্যানেলঃ এখানে তো প্রসিকিউটর বলছে আপনিই বলছেন নিজামীর নাম।
শামসুল হক নান্নু ঃ  সেটা বললে বলতে পারে। আমি বলিনি। সেখানে তারা কেসটা সাজাইতে যে যে কৌশল নেওয়া লাগে সেভাবে হয়তো করছে।
চ্যানেলঃ আচ্ছা এটা কি আপনার কাছে খারাপ লাগতেছে যে, আপনি এত কষ্ট করে দেশ স্বাধীন করলেন, এত আপনি একজন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা, আপনার স্টেটমেন্টটা বিকৃত হলো।
শামসুল হক নান্নু ঃ  এটা পুলিশ কেসে প্রায় কেসেই এরকম হয়। একটা কেস সত্যি-মিথ্যা দিয়ে আদালতে খাড়া করে, পরে আদালতে স্বাক্ষী নিয়ে আদালত সেটা বিচার করে।
চ্যানেলঃ একেবারে লাস্ট, আমি আপনাকে কষ্ট দেব না, আপনি যদি একটু বলতেন, নিজামী বা মাওলানা সোবহান এদের নাম কি আসলে আপনি বলছিলেন?
শামসুল হক নান্নু ঃ  না, আসলে আমি কারো নাম বলি নাই, আমি আসাদের নাম বলছি এবং ওই এলাকার সবাই জানে যে, আসাদই ইনভলব এটার সাথে। তখন আমি মাওলানা নিজামী সাহেবকে চিনতামও না। শুনছি যে, উনি একজন ছাত্রনেতা, মাদ্রাসায় পড়ে, কিন্তু তার সাথে সামনা-সামনি আমার কোন সাক্ষাৎ হয়নি। পরিচয়ও ঘটেনি।
চ্যানেলঃ নিজামী সম্পর্কে আপনি যা জানেন, সেটা একটু বলবেন?
শামসুল হক নান্নু ঃ  আমি তার সম্পর্কে যেটুকু জানি, আমার এলাকায় প্রথম যখন উনি নির্বাচনে দাঁড়ায় তখনি তাকে দেখলাম। আমার একই নির্বাচনী এলাকার লোক। আমরা তখন অধ্যাপক আবু সাঈদের নির্বাচন করি, উনি উনার দলের নির্বাচন করেন। দেখা হলো, পরিচল হলো। লোক চিনালো যে, ইনি ক্যান্ডিডেট, ইনি জামায়াতে ইসলামীর ক্যান্ডিডেট। এলাকায় ওয়েল রেপুটেড লোক। তার ব্যক্তিগত কোন দূর্নীতির খবর আমার জানা নাই। ওয়েল রেপুটেড লোক। কাজেই ম্যান হিসেবে ভাল মানুষ। আবার উনি এমপিও হয়েছেন আমার এলাকা থেকে জনগনের ভোটে মন্ত্রীও হয়েছেন। এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজও করেছেন উনি। এটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলছি।
চ্যানেল ঃ একাত্তরের তিনি কোথায় ছিলেন ?
শামসুল হক নান্নু ঃ সে বিষয়ে আমার জানা নাই। আমি তো বললাম, একাত্তরে তার সাথে আমার পরিচয়ই ছিলো নাই। আমি তখন পড়তাম এডওয়ার্ড কলেজের বিএ কাসে। আমরা এক রাজনীতি করতাম উনারা একটা করত। দেখা সাক্ষাত হয় নি কোন সময়।
চ্যানেল ঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শামসুল হক নান্নু ঃ আমি সত্যি কথা যেটা সেটাই বললাম।

মাননীয় আদালত উনার কি বিচার করবেন সেটা তাদের ব্যাপার। আশা করি আদালত ফেয়ার বিচার করার চেষ্টা করবে।
আসাদকে যারা আমরা এরেস্ট করেছিলাম শরষিকান্ত থেকে, সাথিয়া থানার শরষিকান্ত থেকে। সে স্বিকারও করেছে করছে কিনা। তখন ইন্ট্রোগেশনও হয়েছে। আর কারা আছে ? আসাদ ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে ধরা পড়ে। যখন নিয়ে যাওয়া হয়..
চ্যানেল ঃ আসাদকে যখন জিজ্ঞেস করেছেন কারা কারা ছিল ? আসাদ কাদের কাদের নাম বলেছে?
শামসুল হক নান্নু ঃ সে সব হলো তারা পেটের দায়ে রাজাকার হয়েছিল এ রকম ধরনের কিছু বলেছিল।
চ্যানেল ঃ আসাদকে আপনারা ধরেছিলেন কিনা বা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন কিনা ?
শামসুল হক নান্নু ঃ আমি ঠিক ধরি নাই আমার সহযোগী সাথীরা ধরেছিল শরীষা গ্রাম থেকে, (কাকে?) আসাদকে। যে ডেমরা ও বাউশগাড়ি হত্যাকান্ডে পাকিস্তানী মিলিটারিকে রাস্তা দেখায়া নিয়ে যায়। তারপরে যেসব বাড়িতে রেইট করতে হবে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং ব্যাপক লুটতরাজের টাকা পয়শা বস্তা ভরে আসাদ নিয়েও গেছিলো। সেই টাকা পয়শা পরবর্তীতে যাদের হাতে পরে তারাই গোপন ইনফরমেশন দিয়ে আসাদকে ধরায় দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের। তার কারণ ধনাঢ্য হিন্দু গ্রাম ডেমরা হিন্দু অধূষ্যিত গ্রাম তো ঐখানে গিয়ে শেল্টার নিয়েছিল।
চ্যানেল ঃ আসাদ কি স্বিকার করেছিল ?
শামসুল হক নান্নু ঃ আসাদ স্বিকার করেছিল আমার সাথে দুটো লোক আছে সে দুটো লোক একদমই গরীব লোক বেড়াবাজারে কুলিগীরি করতো। তারা পেটের দায়ে আসাদের পিছ পিছ গেছে। তাদেরকে মৃত্যুদন্ড দেয়নি মুক্তিযোদ্ধারা তারা এখনও বেঁচে আছে। কিন্তু কোন সময়ই বলেনি আসাদ মুক্তিযোদ্ধাদের জিজ্ঞাসাবাদে, আমার সাথে ইন্ডায়রেক্টলি বা ডায়রেক্টলি যে মওলানা নিজামী, সুবহান সাহেবরা আছে হত্যাকান্ডের সাথে, কখনও বলেনি। (সমাপ্ত)


ইউটিউবে তার আরেকটি সাক্ষাতকার
নাম- আমি এডভোকেট শামছুল হক নান্নু, আমার গ্রামের বাড়ি- পাবলা জেলার সাঁথিয়া থানার ছোট পাথারিয়া গ্রামে,  পিতা-হাজি নিয়ামত আলী মরহুম।
প্রশ্নঃ আপনি তো পেশায়?
শামছুল হক নান্নুঃ আমি পেশায় আইনজীবী। সুপ্রীম কোর্ট বারের মেম্বার। সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী সাথে একজন মুক্তিযোদ্ধা গর্ভনমেন্টের সম্মানী ভাতা প্রাপ্ত।
প্রশ্নঃ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী? তখন উনি ছোট ছাত্র মানুষ। খুব ম্যাচিউট ছিলেন না আমার চেয়ে তার বয়সে খুবটা বেশি ডিফারেন্স হবে না। তা তো তখন আমি কোন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমার সামনেও সে কোন দিন পড়ে নাই। তার কারণ তাকে কোথাও কোন দিন দেখিও নাই। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কিছু করার দেখি নাই বিরোধীতা করার কিছু করারও দেখি নাই। তো ঐ সময় বিভিন্ন গ্রুপে ডেমাডলে হয়তো আমার বাসাটা পুড়ে গিয়েছিল কিন্তু কারা পোড়াইছে এটা আমি সঠিক বলতে পারিনা, দেখি নাই। তার কারণ আমি তখন যুদ্ধে ছিলাম আপনার ইতে ছিলাম না, আমার বাসাটা একচুয়ালি কারা পোড়া দিছে এটা আমি শুনিও নাই কেউ বলতেও পারে নাই অ্যা, এবং আপনি অভিযোগ করছেন কিনা না, আমি অভিযোগ করেছিলাম কিনা নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে না, নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে বাসা পোড়ানোর কোন অভিযোগ করিনি। সেটা ঔ সিচিওশনে নিজামী সাহেব ছিলেন না পাবনা সদরে, উনি তখন পাবনায় থাকতেন না।
প্রশ্নঃ আপনি কি কখনো নিজামী সাহেবকে কি দেখেছেন?
শামছুল হক নান্নুঃ না, আমি নিজামী সাহেবকে কখনো দেখিনি।
প্রশ্নঃ কবে ওনাকে প্রকৃত অর্থে চিনলেন?
শামছুল হক নান্নুঃ আমি একচুয়ালি যখন ওই যে পলিটিকস ওপেন হলো ৮৬ ইলেকশনে এ তখন থেকে তার সঙ্গে পরিচয়।
প্রশ্নঃ এর আগে উনি এরকম কোন পাবনায়?
শামছুল হক নান্নুঃ না, ডেমরা থানায় পাকিস্তানী পিরিউডে হত্যা যজ্ঞ করে, তাদেরকে যে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে পরবর্তীতে এবং তাদের গণআদালতে বিচার করে তাদের সাজা দেয়া হয় নাম ছিলো আসাদ। হাজার হাজার লোক জানে আসাদের গণআদালতে বিচার করে তখন মৃত্যু দন্ড দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা মৃত্যু দন্ড কার্যকরী করে। তখন নিজামী সাহেব, সোবহান সাহেব, সাঈদী সাহেব বা গোলাম আযম বা অন্য কারও নাম তখন ওঠেও নাই, জনগণ অভিযোগও করেনি। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল পাকিস্তান পিরিওডে তার হলো আসাদ। আসাদের বিরুদ্ধে জনগণ অভিযোগ করছিল, আসাদ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে এবং গণরায় তার মৃত্যু দন্ড দেয় এবং তা কার্যকরী করা হয়।
প্রশ্নঃ এই আসাদের বাড়ী কোথায় ছিল?
শামছুল হক নান্নুঃ আসাদের বাড়ি বেড়া। এটা সবাই এলাকার লোকজন জানে। এখানে যুদ্ধ হয় ঠিক ক্যালানী গ্রামে কিন্তু অন্য লোক পাকিস্তানীর বিরুদ্ধে গাইড করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই লোকটাকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে ১৮ই ডিসেম্বরে লোকটা ধরা পড়ে। তার নাম লোক জানিয়ে যায় যে, জানা জানি হয়ে যায় যে এই লোক নিয়ে গেছে। সে লোকটার সেখানে মৃত্যু দন্ড কার্যকরী করা হয় পরে মুক্তিযোদ্ধারা প্রকাশে, মুক্তিযুদ্ধটা কালিয়ানী গ্রামে হয়। গ্রামটার নাম হলো কল্যানী, লোকালী কালিয়ানী বলে ডাকে যে যুদ্ধের সময় নিজামী সাহেব ঐ এলাকায় যানও নাই এবং পাকিস্তানী মেলেটারীর সাথে যে লোক গেছিল সে লোক প্রকৃতই মেলেটারীকে গয়েন্দা সংস্থার লোক বাঙ্গালী, অ্যা, তাকেও ৭১ সালে যুদ্ধের পর জনগণ ধরে বিচার করে এবং কালিয়ানি প্রাইমারী স্কুলে তার মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়, অ্য, প্রকাশ্য মৃত্যুদন্ড কার্যকরী করা হয়। অ্যা, সে লোকটার নাম আমি স্মরণ করতে পারছি না। তবে এই ঘটনার সাথে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের যুদ্ধের দিনে বা সময়ে বা ঐ সময়ে ঐ এলাকায় উনি যাননি। আব্দুর রাজ্জাক খানের সামনে আমি যে বক্তব্য আমি দিয়েছি সে গুলো এ বক্তব্যের সাথে নিজামী সাহেব, গোলাম আযম সাহেব, সোবহান মাওলানা এদের নাম নাই। আমি, আমার শুধু কমপ্লেইনটা ছিল শুধু মাওলানা ইছহাকের বিরুদ্ধে। অ্যা, তখন উনি মিনিস্টার ছিলেন ঐ ড. মালেক মন্ত্রী সভার সেই সূত্রে আমার বাড়িঘর পুড়ে যায়। এই হিসাবে আমি অভিযোগ করেছিলাম। তাছাড়া নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে, গোলাম আযম সাহেবের বিরুদ্ধে, মাওলানা সোবহান সাবেবের বিরুদ্ধে, কি রফিকুন নবী এদের নামের বিরুদ্ধে আমি কখনো অভিযোগ করিনি। আমি আগেই বলেছি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেব একজন প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ। তাকে রাজনৈতিকভাবে ফাঁসানোর জন্য এই মোকদ্দমা খাড়া করা হয়েছে।
প্রশ্নঃ আপনি বলেছেন বলে এখানে এই সাক্ষীতে আসছে যে, ১৪ই মে ১৯৭১, বাংলা ২৩শে বৈশাখ ভোরে ফজরের নামাজের পরপর মুক্তিযোদ্ধাদের জিম্মি করার বা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য মাওলানা নিজামী, মাওলানা সোবহান, মাওলানা ইছহাক এর নেতৃত্বে প্রায় ১৫০ জন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ডেমরা ও বাউশগারী গ্রাম ঘিরে ফেলে তাদের দেখিয়ে দেয়া লোকদের যারা ১৯৭০ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কথা বলে তাদেরকে নিশৃংসভাবে হত্যা করে এবং নারী ধর্ষণ করে। এটা আপনি বলেছেন বলে?
শামছুল হক নান্নুঃ এই বিষয়টা হলো, এই বক্তব্যটা আমার বক্তব্য না, এই বক্তব্যটা পলিটিক্যালই জনাব মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আলেম এবং ইসলামী চিন্তাবিদ তাকে পলিটিক্যালই ঘায়েল করার জন্য এধরনের একটা বক্তব্য আইও এই কেসের তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়ে আসছে। এটা তার মনগড়া বক্তব্য এটা আমার বক্তব্য নয়। এই বিষয়ে কোন সময়ে যদি সাক্ষী হিসাবে প্রয়োগ করা হয় এটা আমার বক্তব্য নয়, আমি সর্ব আদালতে বলতে প্রস্তুত আছি এবং হ্যা যদি কোন লিখিত স্টেটমেন্ট দেয়া লাগে তবে তাও দিতে আমি প্রস্তুত আছি।
প্রশ্নঃ আপনি তো বলেছেন প্রকৃত অর্থে আপনি ১৯৮৬ সালের নির্বাচন থেকেই আমি তাকে প্রথম চিনি?
শামছুল হক নান্নুঃ আমি আগে তাকে চিনতাম না।
প্রশ্নঃ কাজেই এধরনের বক্তব্য আপনার?
শামছুল হক নান্নুঃ এটা আমার বক্তব্য না। এটা শুধু পলিটিক্যালই তাকে ঘায়েল করার জন্য বক্তব্যটা সাজানো হয়েছে এবং আমার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া গণআদালতে যদি সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয় এটা আমি চ্যালেঞ্জ করব যে, এটা আমার বক্তব্য নয়।
প্রশ্নঃ অন্য জায়গায় বলা হচ্ছে যে, আপনার বক্তব্যে আমি আসছি যে, মুক্তিযুদ্ধ থাকিয়া জানিতে পারি অধ্যাপক গোলাম আযমের নির্দেশ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা সোবহান, মাওলানা ইছহাক, শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আল-বদর বাহিনী গঠন করে মতিউর রহমান নিজামী আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন?
শামছুল হক নান্নুঃ আমি যুদ্ধে থাকাকালীন কোন দিন শুনিনি যে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আলবদর বাহিনীর কামান্ডার এবং ওনাকে কোন জায়গায় দেখিও নাই। উনি যে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যে পাকিস্তানীদের পক্ষে নেমে বিরুধীতা করা এটাও আমার এলাকার কোন লোকজন দেখে নাই, বলে আমার জানা নাই। কেউ বলে নাই যে আমি দেখিছি। আমি হলফ করে বলতে চাই যে এই কথা গুলো আমার না। এখানে ভুলভাবে সাজানো হয়েছে বক্তব্য। আমার কাছে এটা এইভাবে আসছে আমি যেটা অনুভব করি ধং ধ পড়হংপরড়ঁং পরঃরুবহ ড়ভ ঃযব পড়ঁহঃৎু এটা রাজনৈতিক নেতাকে ফাঁসানোর জন্য এই ধরনের বক্তব্য আইও খাড়া করছে কারও ডিরেকশন নাই। এটা আমার বক্তব্য নয় এবং কোন আদালতে যদি আমার বক্তব্য বলে চালানো হয় তবে আমি তার বিরুদ্ধে আইনীগতভাবে চ্যালেঞ্জ করব।