মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৩

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ষষ্ঠ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ///ব্যাংক লুট যোগসাজসের অভিযোগে চাকরি যায় সাক্ষীর

মেহেদী হাসান, ৩০/৪/২০১৩
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ষষ্ঠ সাক্ষী শাহজাহান আলীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে  আজ। । আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সাক্ষীর জবানবন্দী শেষে জেরা শুরু হয়েছে।
সাক্ষী তার জবানবন্দীতে অভিযোগ করেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর উপস্থিতিতে রাজাকাররা তাকে বেয়নেট চার্জ করে এবং ছুরি দিয়ে গলা কাটে। এসময় তার সাথে অন্যতিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।
অপর দিকে জেরায় সাক্ষী স্বীকার করেন ব্যাংক লুটে ম্যানেজারের সাথে  যোগসাজসের অভিযোগে ১৯৮৪ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে তার এবং শাখা ম্যানেজারকে  চাকরিচ্যুত করা হয়।

জবানবন্দী : সাক্ষী বলেন, আমার গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার সাথিয়া থানায়। আমি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং বর্তমানে অসুস্থ। ১৯৭১ সালে আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। ২৮ নভেম্বর আমি ধুলাউড়ি গ্রামে যাই। সেখানে পাকিস্তান বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আমিসহ আটজন মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়ি শেষ রাতে। ধরার পর আমাকে পেটানো হয়। মতিউর রহমান নিজামীর কথামত সাতটা রাজাকার আমিসহ চারজনকে নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে মতিউর রহমান নিজামী উপস্থিত ছিল। আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে বেয়নেট চার্জ করার পর ছুরি দিয়ে গলা কাটে। আমার সাথে নিয়ে আসা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে ফেলা হয়। আমার গলাকাটার পর পাবলিক এসে আমাকে নিয়ে গেল ফুলবাড়ি গ্রামের রঞ্জিতের বাড়ি। পাবনা হাসপাতালে একমাস রাখার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়। সেখানে চার বছর আমার চিকিৎসা চলে।

সাক্ষী বলেন,  ওইদিনের যুদ্ধে ধুলাউড়ি গ্রামের চার/পাঁচশ লোক মারা যায়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি বর্তমানে মাসে পৌনে দশহাজার টাকা ভাতা পান বলে জবানবন্দীতে উল্লেখ করেন।

সাক্ষীর গলায় সমস্যার কারনে জোরে কথা বলতে পারেননা। তিনি ফিস ফিস করে কথা বলছিলেন। সেজন্য ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে বলেন খুব সংক্ষেপে  যেন আসল কথা বলে সাক্ষী জবানবন্দী প্রদান করেন।

জবানবন্দী শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর পক্ষে আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। তাকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট মনজুর আহমেদ আনসারী, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন প্রমুখ।

জেরা :
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালে আপনি ভোটার ছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালে আপনি কোথায় পড়ালেখা করতেন?
উত্তর : মিয়াপুর হাজি জসিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে।
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালে কোন কাসে পড়তেন?
উত্তর : এইটে না নাইনে মনে নেই।
প্রশ্ন : এসএসসি পাশ করেন কোন সালে?
উত্তর : ১৯৭২ সালে।
প্রশ্ন : কোন ব্যাসে?
উত্তর : দ্বিতীয় ব্যাসে।
প্রশ্ন : এরপর আর পড়ালেখা করেছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : স্বাধীনতার পর কি করতেন আপনি?
উত্তর : ব্যাংকে চাকরি করতাম।
প্রশ্ন : কোন সালে চাকরিতে যোগদেন?
উত্তর : ১৯৭৩ সালে।
প্রশ্ন : প্রথম কর্মস্থল কোথায় ছিল?
উত্তর : সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিস ঢাকায়।
প্রশ্ন : ঢাকায় কতদিন ছিলেন?
উত্তর : প্রায় দুই বছর।
প্রশ্ন : তারপর পাবনা বদলী হন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : সর্বশেষ কর্মস্থল কোথায় ছিল?
উত্তর : বেড়া, পাবনা।
প্রশ্ন : আপনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেননি?
উত্তর : না। আমার চাকরি চলে গেছে।
প্রশ্ন : আপনার চাকরি চলে যাবার সময় বেড়া শাখার ম্যানেজার ছিলেন মকবুল এবং তারও চাকরি চলে গেছে আপনার সাথে।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : আপনি তখন ক্যাশিয়ার পদে ছিলেন।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : অভিযোগ ছিল আপনি এবং ম্যানেজারের যোগসাজসে ব্যাংক লুট হয়।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : চাকরিচ্যুতির বিরুদ্ধে আপনি কোন বিভাগীয় আপিল করেননি।
উত্তর : না।
প্রশ্ন : চাকরিচ্যুতি আদেশের বিরুদ্ধে আপনি কোন আদালতেরও আশ্রয় নেননি।
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটে ১৯৮৩ সালে এবং আপনার চাকরি চলে যায় ১৯৮৪ সালে।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত আপনি কোথায় থাকতেন?
উত্তর : নজি বাড়িতে।
প্রশ্ন : আপনি ওই সময় কোন রাজনৈতিক দলের সাথে আপনি জড়িত ছিলেন?
উত্তর : হ্যা। আওয়ামী লীগ।
প্রশ্ন : এখনো  এ দলের সাথে  যুক্ত আছেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের নির্বাচনের সময় বয়স না হওয়ায় আপনি ভোটার হননি।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : নাজিব উদ্দিন খাত্তাবকে চেনেন?
উত্তর : চিনি।
প্রশ্ন : স্বাধীনতার আগে থেকেই তাকে চিনতেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ওনার সাথে কতদিনের পরিচয়?
উত্তর : চার/পাঁচ বছর।
প্রশ্ন : আপনি মুক্তিযুদ্ধে কবে গেলেন?
উত্তর : ১৪ জুন ১৯৭১।
প্রশ্ন : ১৪ জুন পর্যন্ত নিজ বাড়িতেই ছিলেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : এখন যে ঠিকানায় থাকেন ১৯৭১ সালেও কি সেই ঠিকানায় থাকতেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে আপনি পদ্মভিলায় থাকতেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : ১৪ জুন যুদ্ধে যাবার আগে অধ্যাপক আবু সাঈদের সাথে আপনার নিয়মিত দেখা সাক্ষাত হত?
উত্তর : হত।
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অধ্যাপক আবু সাঈদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন নেজামে ইসলামের মাওলানা ইসহাক।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : ওই সময় আপনার এলাকায় জামায়াতের তেমন প্রভাব ছিলনা।
প্রশ্ন : ছিল ছিল।
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালের  আগে মতিউর রহমান নিজামীকে কোনদিন দেখেননি।
উত্তর : দেখিনি।
প্রশ্ন : নামও শোনেননি।
উত্তর : নাম শুনেছি।
প্রশ্ন : তার বাড়ি কোনদিন দেখেছেন?
উত্তর : না। তবে শুনেছি তার বাড়ি মনমথপুর।
প্রশ্ন : স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পূর্বে কোনদিন সাথিয়া সদরে গেছেন?
উত্তর : গেছি।
প্রশ্ন : আপনি এএসসি রেজিস্ট্রেশন কবে করেছেন?
উত্তর : দেশ স্বাধীনের পরে।
প্রশ্ন :  সেখানে  জন্ম তারিখ কত উল্লেখ করেছিলেন ?
উত্তর :  মনে নেই।  রেজিস্ট্রেশন কার্ড, এএসসি সার্টিফিকেট  হারিয়ে গেছে।
প্রশ্ন : কিভাবে হারিয়ে গেছে তাও মনে নেই।
প্রশ্ন : মনে নেই।
প্রশ্ন : সাথিয়া থানা পিস কমিটির সভাপতি কে ছিল বলতে পারবেন?
উত্তর : মনে নেই।
প্রশ্ন : আপনাদের ইউনিয়ন কোনটি?
উত্তর : আর আতাইকুলা।
প্রশ্ন : ইউনিয়ন পিস কমিটির সভাপতির নাম মনে আছে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে আপনাদের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কে ছিলেন?
উত্তর : মোহাম্মদ  আলী শেখ।
প্রশ্ন : তিনি কি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তিনি আওয়ামী লীগ করতেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : আপনাদের গ্রামে কোন রাজাকার ছিলনা?
উত্তর : মনে পড়েনা।
প্রশ্ন : আল বদর, পিস কমিটির কোন লোক ছিল কি-না তাও মনে পড়েনা?
উত্তর : মনে পড়েনা।
প্রশ্ন : যুদ্ধ শুরুর আগে সাথিয়া থানায় স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর কোন প্রশিক্ষন হয়েছিল?
উত্তর : মনে নেই।
প্রশ্ন : আপনাদের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ কে সংগঠিত করত?
উত্তর : অধ্যাপক আবু সাঈদ।
প্রশ্ন : আপনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের আগে সাথিয়া থানায় মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান আর্মির কোন যুদ্ধের কথা শুনেছেন?
উত্তর : একটি যুদ্ধের কথা শুনেছি। ডাববাগান যুদ্ধ।
প্রশ্ন :  ১৯ এপ্রিল হয়েছিল এ যুদ্ধ।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : এখানে কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিল  বলতে পারবেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : এখানে শহীদ কোন মুক্তিযোদ্ধার নামও আপনার মনে নেই।
উত্তর : মনে নেই।
প্রশ্ন : ১৯ এপ্রিলের আগে সাথিয়ার কোন এলাকায় রাজাকার ক্যাম্প ছিল?
উত্তর : মহালবাড়িয়ায় ছিল।
প্রশ্ন : মহালবাড়িয়া আপনার বাড়ি থেকে কতদূর?
উত্তর : এক মাইল।
প্রশ্ন : ওটা কি বাড়ি ছিল?
উত্তর : না, মক্তব।
প্রশ্ন : আপনি বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্য কেউ ওই বাড়ি আক্রমনের জন্য যাননি।
উত্তর : যাইনি।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে সাথিয়ায় ইপিআর ক্যাম্প ছিল?
উত্তর : ডাববাগানে ছিল।
প্রশ্ন : ওই ক্যাম্পটি ১৯ এপ্রিলের  কতদিন আগে হয়?
উত্তর : তিন/চারদিন আগে।
প্রশ্ন : ওই ক্যাম্পের দায়িত্বে কে ছিল?
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : হাবিলদার আকবর নামে কাউকে চিনতেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সাথিয়ার গোলাম মোস্তফা নামের কাউকে চিনতেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের আগে আপনাদের গ্রামে বাইরের কোন রাজাকার বা পাকিস্তান আর্মি প্রবেশ করেনি।
উত্তর : করেনি।

এ পর্যন্ত জেরার পর জেরা বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।






সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৩১তম সাক্ষীর জেরা

মেহেদী হাসান, ৩০/৪/২০১৩
বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৩১ তম সাক্ষী সুজিত মহাজনকে আজ জেরা করেন অ্যাডভোকেট আহসানুল হক হেনা। ২৯ এপ্রিল তর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়।  আজ জেরায় বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী যে উত্তর দেন তা এখানে তুলে ধরা হল। 

আমি গৌরী শংকর বাজারে ছোটখাট মুদির দোকানদারী করি, আমি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছি। আমাদের এলাকাটি পৌর এলাকার বাইরে বিধায় ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে হাফিজ বজলুর রহমান সড়ক থেকে আমাদের বাড়ীতে যাওয়ার পথে দোকানপাট ছিল। কাপ্তাই রোডটি দুই পার্শ্বের জমি থেকে উঁচু। গৌরী শংকর বাজারটি আমার বাড়ী থেকে উত্তর পার্শ্বে কোয়ার্টার কিলোমিটার দূরে। ১৯৭১ সালে রাউজান সদর এবং গহিরায় যেতে হলে হাফিজ বজলুর রহমান সড়ক দিয়ে যেতে হতো কিনা তাহা আমি জানিনা। আমাদের বাড়ী থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবের বাড়ীর দূরত্ব সড়ক পথে আনুমানিক ১২ কিলোমিটার হবে। আমাদের বাড়ী থেকে হাফিজ বজলুর রহমান সড়ক দেখা যায়।
ঘটনার দিন আর্মিরা পশ্চিম দিক থেকে এসেছিল। ঘটনার দিন আমি কোন আর্মির গাড়ি দেখিনাই। আমার বাড়ির পূর্ব পার্শ্বে চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ অবস্থিত যার সোজাসুজি দূরত্ব হবে আধা কিলোমিটার। উল্লেখিত ঘটনার পূর্বে আর্মিরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ দখল করে নিয়েছিল ১১ই এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে। আমরা মোট ৫ ভাই ১ বোন, তার মধ্যে বড় ভাই আমার বৈমাত্রের ভাই। তার নাম রঞ্জিত দ্বিতীয় বিবাহ করেন। আমার বোন বয়সে আমার চেয়ে ছোট। আমার বোন ১৯৭১ সালে বিবাহিতা ছিলনা। আমার পিতার মৃত্যুর সময়ে আমাদের জায়গা জমি ছিল। বাড়ীর ভিটা সব মিলিয়ে দুই/আড়াই কানি জমি ছিল। বর্তমানেও একই পরিমান জমি আছে। আমি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ওয়ারিশান সার্টিফিকেট নিইনাই। আমার দরকার না হওয়ায় সাকসেশন সার্টিফিকেট নিইনাই। ১৯৭১ সালে আমার পিতার নামে ব্যাংকে কোন একাউন্ট ছিলনা। চট্টগ্রামে যারা সুদের ব্যবসা করে তাদের মহাজন বলা হয় কিনা তাহা আমি জানিনা। আমাদের বাড়ী থেকে রাউজান থানার দূরত্ব আনুমানিক ৮ কিঃ মিঃ হবে। দেশ স্বাধীনের আগে বা পরে আমি বা আমার আত্মীয় স্বজন আমার পিতা ও বড় ভাইয়ের হত্যাকান্ডের বিষয়ে কোন মামলা করিনাই। আমাদের উনসত্তর পাড়ায় একটি মন্দিও আছে। ১৯৭১ সালে ঐ মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন দেবেন্দ্র চক্রবর্তী, কৃঞ্চচন্দ্র ভট্টাচার্য কৃঞ্চচন্দ্র ৬৯ পাড়ায় হত্যাকান্ডের ব্যাপাওে রাউজান থানার মামলা নং-২২, তারিখ ২০-০২-১৯৭২, ধারা ঃ ৩০২/৩৭৬ দঃ বিঃ তৎসহ দালাল আইনের ১১ ধারার আসামী লেঃ কর্ণেল ফাতেমী (পাকিস্তান আর্মি), আব্দুর রাজ্জাক মকবুল আহম্মদ, মোঃ ইউসুফ, জহির আহম্মদ, পিয়ারু মিয়া, মবকুল এবং ফজর আলীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন কিনাতাহা আমি জানিনা। উল্লেখিথ মামলার বিষয়ে জেনেও আমি তথ্য গোপন করছি, ইহা সত্য নহে। ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল তারিখে উনসত্তরপাড়ায় কোন ঘটনা ঘটে নাই, ইহা সত্য নহে। বর্ণিত ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে উনসত্তরপাড়ায় পাকিস্তান আর্মিরা গিয়েছিল কিনা তাহা আমার জানা নাই। বর্ণিত ঘটনার দিন পাকিস্তান আর্মিরা কোন মহিলাকে হত্যা করেছিল কিনা তাহা আমি জানিনা। ঘটনার দিন আমার মায়ের গুলি খাওয়ার কথা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলিনাই, ইহা সত্য নহে। ঘটনার প্রায় একঘন্টা পর আমার বৌদি, কাকিমা এবং বোনের সংগে দেখা হয়েছিল। তখন তারা আমাকে ঘটনার কথা বলে নাই, কারণ তখন মা আহত ছিল। আমাদের পাড়ার মধ্যে ঘটনার দিন আমার বর্ণিত জায়গা ছাড়া আমাদের পাড়ার মধ্যে অন্য কোন বাড়ীতে আমি কোন মৃতদেহ দেখিনাই। ১৯৭১ সাওেল উনসত্তর পাড়ার হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন সম্ভবত পটল বড়–য়া, তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে রাউজানস্থ পল্লী বিদ্যুতের কমপাউন্ডের ভিতওে একটি বিল্ডিংয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, ঐ জবানবন্দী প্রদানের সময় আমার সংগে কেউ ছিলনা। ঐ দিন আমি সেখানে হাইস্কুলের কোন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে দেখিনাই। ১৯৭১ সালে আমার বাড়ী থেকে সবচেয়ে নিকটতম মসজিদেও দূরত্ব ছিল প্রায় এক কিলোমিটার। হাইস্কুলের উত্তর পার্শ্বে রাস্তা আছে ১৯৭১ সালে হাফিজ বজলুর রহমান সড়ক থেকে আমাদের বাড়ী পর্যন্ত গাড়ি যেত, রোডটি আমাদের বাড়ীর সংলগ্ন, ক্ষিতিশ মহাজনের বাড়ী ও আমাদের বাড়ী পাশাপাশি। উল্লেখিত ঘটনার দিন তার বাড়ীর ভিতওে কোন হত্যাযজ্ঞ হয়নাই, পুকুর পাড়ে হয়েছিল, সে টিউবওয়েলের পাশে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল সেই টিউবওয়েলটি আমাদের বাড়ীর ১০০ গজ পশ্চিমে ছিল। পুকুরপাড়টি টিউবওয়েল থেকে ১৫০ ফিট দূওে ছিল, ঘটনার পওে আমি  পুকুর পাড়ে যাইনাই। টিউবওয়েল থেকে সেই জায়গায় দেখা যাচ্ছিল। আমি গোলার পাশে লুকিয়ে থাকার কথা তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলি নাই, ইহা সত্য নহে। আমি যে ধানের গোলের পাশে লুকিয়ে ছিলাম তার দৈঘ্য প্রস্থ কত তাহা বলতে পারবনা। ঐ গোলার মধ্যে ৩০/৩৫ আড়ি ধান বা চাউল রাখা যেতো। আমার মা ১৯৯০ সালে মারা গেছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী দেওয়ার সময় আমার মা মৃত তাহা বলেছিলাম, তিনি লিখেছেন কিনা তাহা আমি জানিনা। আমি আমার মায়ের মৃত্যু সনদ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে গ্রহণ করিনাই। আমার মা ২০১১ সালে মারা গেছেন, ইহা সত্য নহে। আমার বৌদি মিনতি মহাজন এবং আমার বোন জীবিত আছে। ঐ কাকিমার ছেলে মেয়ে জীবিত আছে। আমার আহত মায়ের চিকিৎসার কোন সনদপত্র তদন্তকারী কর্মকর্তাকে প্রদান করিনাই। তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থল টিউবওয়েল ও পুকুরপাড় আমি দেখাইনাই। আমার মা আহত অবস্থায় যে জমিতে পড়েছিল, সেই জমিটি ক্ষিতিশ মহাজনের। আমার মা, বৌদি এবং কাকিমাকে পাকিস্তান আর্মিরা ধওে নিয়ে যাওয়া অসত্য, ইহা সত্য নহে। পাকিস্তান আর্মিরা যখন আমাদের পাড়ায় যায় তখন আমি আমাদের পাড়ায় হৈ চৈ শুনি নাই। হাফিজ বজলুর রহমান সড়কে ঘটনার সময় কোন লোকজন দৌরাদৌড়ি করেছিল কিনা তাহা আমি দেখিনাই। কারণ তখন আমি বাড়ীর মধ্যে ছিলাম। হাফিজ বজলুর রহমান সড়ক ১০০ গজ দূওে। আমার ঘর থেকে ক্ষিতিশ মহাজনের ঘরের দূরত্ব আনুমানিক ৩০/৩৫ ফিট দক্ষিনে। ঐ সময় বাড়ী থেকে ডাঃ টেইলরের মিশনারী হাসপাতালের দূরত্ব ঐ সময় আনুমানিক ১৭ মাইল ছিল। বাসে বা গাড়ীতে গেলে একঘন্টার মত সময় লাগে। আমি মহামনি নাম শুনেছি। আমার বাড়ী থেকে মহামনির দূরত্ব আনুমানিক দেড়মাইল দক্ষিনে। আমাদের গ্রাম থেকে মহামনি পর্যন্ত রিক্সা, বেবিটেক্সি এবং গাড়ী চলাচল করতো কিনা তাহা আমি জানি না। মহামনিতে একটি ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল হাসপাতাল এবং ডাঃ আব্দুল্লাহিল কাফি কর্মরত ছিল কিনা তাহা আমি জানিনা। ১৯৭১ সালে গৌরী শংকর হাটের দক্ষিণ পাশে কোন চেকপোষ্ট ছিল কিনা তাহা আমি জানিনা। উনসত্তর পাড়ায় চিতাখোলা পাড়ার কোন লোক মারা গেলে কোথায় তাদের দাহ করা হতো তাহা আমি জানিনা। হত্যাকান্ডের পর মৃতদেহগুলি কারা মাটিচাপা দিয়েছিল তাহা আমি জানিনা। ১৯৭১ সালে উনসত্তর পাড়ায় কতগুলি মুসলমান পরিবার ছিল তাহা আমি গণনা করিনাই, আন্দোজেও বলতে পারবনা। ক্ষিতিশ মহাজনের পুকুরপাড়ে ১৯৭১ সালে অনেকগুলি ঝোপ এবং বড়বড় গাছপালা ছিল। আমার পিতার চাচারা ৪ ভাই ছিলেন। আমার বাড়ী থেকে পশ্চিম-উত্তরে আধা কিলোমিটার দূরে কুমার পাড়া অবস্থিত শীলপাড়া এক কিলোমিটার থেকে কিছু কম হবে। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পরে আমি শীল পাড়ায় গিয়েছিলাম। উনসত্তর পাড়া থেকে নিকটতম মুসলিম পাড়ার দূরত্ব এক কিলোমিটার। উনসত্তর পাড়ায় ১৯৭১ সালে মুসলি পরিবার বাস করতো। ডাক্তার নিরঞ্জন দত্ত গুপ্ত এর নাম শুনেছি। ঘটনার কয়েকদিন আগে আমাদের পাড়ায় হিন্দুরা অন্যত্র চলে গিয়েছিল শুনেছি। ডাক্তার নিরঞ্জন দত্ত গুপ্তের আহবানে পুনরায় সবাই ফিরে এসেছিল শুনেছি। পাকিস্তান আর্মিরা আমাদের পাড়ায় এক ঘন্টার মত ছিল। আর্মির ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়ার পর পুকুরপাড়ে বাহিরের কোন লোকজন এসেছিল কিনা তাহা আমি দেখিনাই। উনসত্তর পাড়া একটি গ্রাম। আমাদের বাবুল মালির নাম শুনেছিল তিনিও নিহত হয়েছিলেন। ক্ষিতিশ মহাজন আমার খুড়তাতো ভাই।
‘‘কিছুক্ষন পরে পশ্চিম দিক হতে পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান শুনতে পাই” বা ‘‘আমি ভয়ে রান্না ঘরের পাশে ধানের গোলার পাশে লুকিয়ে থাকি ” বা ‘‘আমার বাবা এবং বড় ভাইকে ক্ষিতিশ মহাজনের পুকুরের উত্তর পাড়ে আরো অনেক লোকজন জড়ো করে ” বা ‘‘আমার মা হরিলতা মহাজনকে তখন গুলিবিদ্ধ আহত অবস্থায় পুকুড় পাড়ের পাশের একটি জমিতে পড়ে থাকতে দেখতে পাই। পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখি ৬০/৬২ জন মানুষের লাশ পুকুরের উত্তর পাড়ে এবং কিছু পানিতে পড়ে আছে। তখন সন্ধ্যা প্রায় হয় হয় অবস্থায় আমি আমার আহত মাতাকে শীল পাড়ায় নিয়ে যাই। ঘটনার প্রায় দুই/তিন দিন পরে প্রতিবেশীরা পুকুরের পাড়ে গর্ত করে লাশগুলি মাটি চাপা দেয়। মাকে একটু সুস্থ করে তোলার পর তিন/চারদিন পর মায়ের নিকট থেকে জানতে পারি বাঙ্গালীদের মধ্যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেব এবং তাহার সহযোগীরা ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। আহতদের মধ্যে জানতী বালা সহ আরও কয়েকজন ছিল। আমি পরবর্তীতে জানতে পেরেছি যে, একই দিনে মধ্য গহিরা, কুন্ডেশ্বরী, জগৎমল্লপাড়া, বণিক পাড়া, উনসত্তরপাড়াতে একই ভাবে পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় দেড়শতাধিক সংখ্যালঘু লোককে গণহত্যা করেছে” একথাগুলি অসত্য এবং তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলিনাই, ইহা সত্য নহে। প্রসিকিউশনের শিখানো মতে আমি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবের অত্র ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান কররি, ইহা সত্য নহে। আমার মায়ের সাথে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবের বন্ধুত্বছিল কিনা বা তাহার সহিত লেখাপড়া করতো কিনা তাহা আমি জানিনা। ১৯৭১ সালের আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেব কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিল কিনা তাহা আমি জানিনা। আমার মা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবকে চিনতেননা বা আমার মা আমাকে ঘটনার কথা বলেনাই, ইহা সত্য নহে। ঘটনার আগের আমাদের পাড়ায় হিন্দুরা পালিয়ে যাওয়ার সময় আমি তাদের সংগে পালিয়েছি বিধায় আমি ঘটনার সময় বাড়ীতে ছিলামনা, ইহা সত্য নহে। উনসত্তর পাড়ার ঘটনাটি ঘটেছিল ১৫ই এপ্রিল তারিখ, ১৩ ই এপ্রিল তারিখ, ইহা সত্য নহে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবের ১৬ই এপ্রিল তারিখে উনসত্তরপাড়ায় কোন ঘটনা ঘটেনাই, ইহা সত্য নহে। আমি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্ররোচনায় মিথ্যা মামলার মিথ্যা সাক্ষ্য দিলাম, ইহা সত্য নহে।  

সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৩

রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধ//পর্ব৬-বাংলাদেশে প্রথম সংবিধান সংশোধন করা হয় যুদ্ধাপরাধ বিচারকে কেন্দ্র করে

মেহেদী হাসান
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের  লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ১৮ জুলাই সংসদের একটি আইন পাশ হয়। এর নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রাইমস (ট্রাইবিউনালস ) এ্যাক্ট ১৯৭৩’। আইনটি পাশের জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের  সংশোধন করতে হয়েছিল। আইনটি পাশ হয় ১৯৭৩ সালের ১৮ জুলাই। এর তিনদিন আগে ১৫ জুলাই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রথমবারের মত সংশোধন করা হয়। একটি আইন পাশ করতে সংবিধানে সংশোধনী আনার প্রয়োজন হয়েছিল কেন?

যুদ্ধাপরাধ বিচার বিষয়ে এ পর্যন্ত দেশী বিদেশী যেসব সংস্থা এবং  আইনজ্ঞ  মতামত প্রদান করেছেন তাদের মতে ১৯৭৩ সালের আইনে এমন কিছু ধারা আছে যা বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।  সংবিধানে যে সর্বজনীন মৌলিক মানাবধিকারের ঘোষনা রয়েছে তা   ৭৩ সালের আইনে রহিত করা হয়েছে। সেজন্য ৭৩ সালের আইন পাশ এবং আইনটিকে সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে সংশোধনী আনতে হয়েছিল। সংবিধান সংশোধন করে ৪৭ (ক) ও ৪৭ (৩ ) নামে দুটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়।  সংবিধান এবং আইনবিশেষজ্ঞদের মতে  এই ধারা দুটি সয়ং সংবিধানের ৩৫, ৩১, ৩৩ এবং ৪৪ ধারা   এবং সংবিধানের  মূল চেতনার পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক।  সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে মানবাধিকার বিষয়ক সংবিধানের বেশ কিছু ধারা অকার্যকর ঘোষনা করা হয়।

আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ স্টিভেন কে কিউসি, টবি ক্যাডম্যান,   বিচারপতি মাইকেল বেলফ,   বিশ্বে আইনজীবীদের সবচেয়ে বড় সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশন (আইবিএ), হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আরো বিভিন্ন  মানবাধিকার ও আইন বিষয়ক সংস্থা এবং আইনবিদদের মতে ১৯৭৩ সালের আইনে বাংলাদেশের সংবিধানে ঘোষিত কিছু মৌলিক অধিকার রহিত করা হয়েছে।  ৭৩ সালের  আইনে এমন কিছু ধারা আছে যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার সাথে সাংঘষিক। সেজন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে প্রণীত এ আইনকে যাতে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে এবং  আইনের অসাংবিধানিক  ধারাগুলোকে সুরক্ষার জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। 

কী আছে প্রথম সংবিধান  সংশোধনীতে?
সংবিধানে নতুনভাবে সংযোজিত  ৪৭ (৩) ধারায় বলা হয়েছে “ এই সংবিধানে যাহা বলা
হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবাতা বিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক  আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা  বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক ফৌজদারীতে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করিবার বিধান সংবলিত কোন
আইন বা আইনের বিধান সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া  গণ্য হইবেনা  কিংবা কখনো বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবেনা।”

নতুভাবে সংযোজিত ৪৭ (ক) এ ১ ও ২ নামে দুটি উপধারা রয়েছে। ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে  “এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের  (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়,  এই সংবিধানের  অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবেনা।”

৪৭ ক (১) ধারায় বলা হয়েছে “যে বক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) ধারায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ, ৩৫ অনুচ্ছেদের (১) ও (৩) দফা, এবং ৪৪ অনুচ্ছেদের অধীনে নিশ্চয়কৃত অধিকারসমূহ প্রযোজ্য ইবেনা। ”

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে  বলা হয়েছে “অপরাধের দায়যুক্ত কর্মসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবেনা  এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দন্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবেনা।”
অর্থাৎ পূর্বে সংঘটিত অপরাধের জন্য পরে আইন করে শাস্তি দেয়া যাবেনা। সংবিধানের এই ৩৫ ধারাসহ  ৩১, ৩৩ এবং ৪৪ ধারায় বর্ণিত আরো কিছু মৌলিক  রহিত করা হয়েছে ১৯৭৩ সালের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে।

বিশেষজ্ঞদের মতে  সংবিধানে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদ সংযোজনের ফলে জুডিশিয়াল রিভিউর অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যেতে পারবেনা অভিযুক্ত ব্যক্তি।    বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বিষয়ে যে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করা হয়েছে তাতে এই  জুডিশিয়াল রিভিউকে সংবিধানের মূল কাঠামো হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর  এই জুৃডিশিয়াল রিভিউর বিধান রাখা হয়নি ১৯৭৩ সালের আইনে। এছাড়া সংবিধান সংশোধন করে ১৯৭৩ সালের আইনকে প্রটেকশন দেয়ার ফলে ট্রাইব্যুনাল গঠন, বিচারক নিয়োগ এবং রায় নিয়ে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবেনা।
যুক্তরাজ্য রানীর সাবেক কাউন্সেলর এবং  বিচারপতি মাইকেল জে বেলফ ১৯৭৩ সালের আইনে জুডিশিয়াল রিভিউ’র ক্ষমতা খর্ব করে  সংবিধানে যে প্রটেকশন দেয়া হয়েছে তাকে অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
যুগোশ্লাভিয়া এবং  রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনজীবী, যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ স্টিভেন  কিউসি  বলেন,  ১৯৭৩ সালের আইন এবং এ আইনকে সুরক্ষার জন্য যে সংবিধান সংশোধন করা হল তার মাধ্যমে এই প্রথমবারের মত বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ‘অসাম্য’  প্রবর্তন করা হল।
১৯৭৩ সালের সংবিধানে নতুনভাবে সংযোজিত ৪৭  ক (১) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে  সংবিধানে অন্যান্য যেসব মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে  নির্দিষ্ট কিছু 

লোকের ক্ষেত্রে। যুদ্ধাপরাধের বিচার যাতে কেউ উচ্চ আদালতে  চ্যালেঞ্জ করতে না পারে তার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে সংবিধানের এসব  ধারা সংযোজনের মাধ্যমে।
 ১৯৭৩ সালের সংবিধানে প্রথম যে সংশোধনী আনা হয়েছে তা যে বাংলাদেশের সযং ঐ সংবিধানেরই বিরোধী তা বোঝাতে স্টিভেন  ১৯৭২ সালের সংবিধানের  কয়েকটি ধারা উদাহরণ হিসেবে তুরে ধরেণ। যেমন , সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৭ অনুচ্ছেদে ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ শিরোনামে  মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে পুনরায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।”
২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামাঞ্জস্য  সকল  প্রচলিত আইন যতখানি অসামাঞ্জস্যপূর্ণ , এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হাইয়া যাইবে (১) । রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামাঞ্জস্যপূর্ণ কোন  আইন প্রনয়ন  করিবেন না  এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত  যতখানি অসামাঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হাইয়া যাইবে (২)।
স্টিভেন বলেন, তথাপি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে যে প্রথম সংশোধনী আনা হয়  তাতে  সকল নাগরিক সমান- সাম্যের এই   আকাঙ্খা   রহিত করা হয়েছে।


পূর্বের  অপরাধের বিচার পরে আইন করে করা যায়না
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে  বলা হয়েছে “অপরাধের দায়যুক্ত কর্মসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবেনা  এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দন্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবেনা।”
অর্থাৎ পূর্বে সংঘটিত অপরাধের জন্য পরে আইন করে শাস্তি দেয়া যাবেনা। অপরাধ সংঘটনের সময় বিদ্যমান আইনে যে শাস্তির বিধান থাকে পরে আইন করে তার চেয়ে বেশি শাস্তি দেয়া যায়না। সারা বিশ্বে আইনের মূলনীতি এটি।  বাংলাদেশের সংবিধানেও   নিশ্চয়তা রাখা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালের সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ৩৫ ধারায় ঘোষিত এ নিশ্চয়তা  অকার্যকর  ঘোষনা করা হয়েছে। কারণ অপরাধ সংঘটন হয়েছে ১৯৭১ সালে। আর অপরাধের বিচারের জন্য আইন করা হয়েছে ১৯৭৩ সালে। পূর্বের অপরাধ পরে  আইন করে বিচারের সুযোগ রাখার জন্য এ সংশোধনী আনা হয়।  আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতি বিরোধী এটি।

যেমন জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০০২ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) ।  এ আদালতে ২০০২ সালের পূর্বে সংঘটিত কোন অপরাধের বিচার করা যাবেনা। ২০০৯ সালের  ডিসেম্বর মাসে আইসিসির প্রধান বিচারপতি স্যাং হুন সং বাংলাদেশ সফরের সময় বলেছেন, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা এবং সে সুযোগও নেই।  সরকারকে ডিঙ্গিয়ে ৩৮ বছর আগের বিষয় নিয়ে কাজ করা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পরেনা।


এই সাইটের যেকোন লেখা, তথ্য উপাত্তা যেকেউ ব্যবহার, পুনমুদ্রন, পুন প্রচার, প্রকাশ করা যাবে; তবে শর্ত হল সূত্র হিসেবে Mehedy Hasan https//www.bangladeshwarcrimestrial.blogspot.com  উল্লেখ/লিঙ্ক  করতে হবে।


রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৩

রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধ//পর্ব৫-দালাল আইনে সাজাভোগকারীর কি আবার বিচার হবে?

মেহেদী হাসান
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তার অভিযোগে  এদেশীয় সহযোগীদের বিচারের জন্য  দালাল আইন প্রণয়ন করা হয়। স্বাধীনতা লাভের দেড় মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ কোলাবোরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার নামে এ দালাল আইন  প্রণয়ন করা হয়। 

দালাল আইন প্রণয়নের সাথে সাথে সারা দেশে তখন ব্যাপক ধরপাকড় এবং  গ্রেফতার অভিযান  শুরু হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৪১ হাজার দালাল গ্রেফতার হবার কথা জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান (৪ অক্টোবর, দৈনিক বাংলা) ।  তখনকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মালেক উকিল কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়  দালাল আইনে  লক্ষাধিক লোক গ্রেফতার  হয়।  তার মধ্যে ৩৭ হাজার ৪৭১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। অভিযুক্ত এ ৩৭ হাজারের মধ্য থেকে  ৩৪ হাজার ৬২৩ জনের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী প্রমান না থাকায় কোন মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়নি। ২ হাজার ৮৪৮ জনকে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হয়। বিচারে ৭৫২ জনের শাস্তি হয় এবং বাকী এক লাখ বন্দীদের  বেকসুর  খালাস দেয়া হয়।

সারা দেশে ব্যাপকভাবে দালাল আইনে ধরপাকড়ের ফলে সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে একটা  অস্থির পরিবেশ  সৃষ্টি হয়। ধরপাকড়দের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোক থাকায় সরকারি কাজকর্মেও বিশৃংখলা এবং নৈরাজ্য দেখা দেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধীতা করছে কিন্তু কোন অপরাধমূলক কাজে অংশ নেয়নি এমন  লোকদেরও বিভিন্ন  মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে গ্রেফতার চলতে থাকে। অসংখ্য লোক গ্রেফতার এড়াতে  আত্মপোগন করে। সব মিলিয়ে দেশে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যা একটি সদ্য স্বাধীন দেশ গড়ার পক্ষে বিরাট অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। নতুন করে হানাহানি, বিভক্তি, অনৈক্য এবং প্রতিহিংসা মাথচাড়া দিয়ে ওঠে।  বিভিন্ন মহল থেকে দালাল আইনের বিরুদ্ধে কথা ওঠে এবং এ আইন সংশোধনের  প্রস্তাব দেয়া হয়। এমনি পরিস্থিতিতে  আসে সাধারণ ক্ষমার বিষয়। দেশের সকল অনৈক্য বিভক্তি,  সন্দেহ মুছে ফেলে সবাইকে  একতাবদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার কাজে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করেন।
১৯৭৩ সালের পয়লা ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় এ বিষয়ে পরিবেশিত  খবরে বলা  হয় “সরকার দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত এবং বিচারাধীন সকল আটক ব্যক্তির প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করেছেন। তবে ধর্ষণ, হত্যা, অগ্নিসংযোগের অভিযোগে যারা সাজা ভোগ করছে কিংবা বিচারাধীন রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এ ক্ষমা প্রদর্শণ কার্যকর হবেনা। তৃতীয় বিজয় দিবস উৎসবে যাতে তারা শরীক হতে পারে সেজন্য ১৬ ডিসেম্বরের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান তাদের মুক্তির ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র   মন্ত্রণালয়কে। যারা পলাতক তারা আদালতে উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেই এ ক্ষমার আওতায় পড়বে।”
 ”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের নেতৃবৃন্দ বলছেন, বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করলেও হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সাথে জড়িতদের ক্ষমা করা হয়নি।  একথা সত্য। সাধারণ ক্ষমা ঘোষনায় বলা হয়েছে “ ধর্ষণ, হত্যা, অগ্নিসংযোগের অভিযোগে যারা সাজা ভোগ করছে কিংবা বিচারাধীন রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এ ক্ষমা প্রদর্শণ কার্যকর হবেনা।” তার মানে এসব অপরাধে অভিযুক্তদের তখন বিচার হয়েছে।  বিচারে কেউ সাজা ভোগ করেছ আর কেউ  অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছে।  তাহলে নতুন করে কি  আবার তাদের বিচার করা হবে যারা এসব অভিযোগে একবার বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন এবং সাজা ভোগ করেছেন অথবা অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন? যাদের বিরুদ্ধে  এসব অভিযোগের কোন প্রমান পাওয়া যায়নি    অর্থাৎ শুধুমাত্র পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করা হয়েছে।  কাউকে সাধারণ ক্ষমা এবং  গুরুতর অভিযুক্তদের বিচারের মাধ্যমে  বিষয়টি পুরোপুরি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে ১৯৭৩ সালেই। এরপর ৯১৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিলও করে দেয়া হয়। কারণ সাধারন ক্ষমা ঘোষনা এবং বাকী অভিযুক্তদের বিচার নিষ্পত্তি এবং সাজাভোগের পর এ আইনের আর কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়নি।
বর্তমানে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হচ্ছে এদের কারো বিরুদ্ধে স্বাধনীতা পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের কোন অভিযোগ করা হয়েছে এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়না। এমনকি দুয়েক জন ছাড়া দালাল আইনেও কারো বিরুদ্ধে কোথাও কোন মামলা হয়নি এমনকি কারো বিরুদ্ধে জিডিরও কোন রেকর্ড নেই। মালেক সরকারের মন্ত্রী সভায় যোগ দেয়ার অভিযোগে  বর্তমানে অভিযুক্তদের  দুয়েকজনের  সাজা হয়েছিল। অথচ  সাজাভোগকারী এসব ব্যক্তিদেরও যুদ্ধাপারধীদের তালিকায় রাখা হয়েছে  ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে যেখানে একজন লোক  বিচারের মাধ্যমে সাজা ভোগ করেছেন এবং আদালতের মাধ্যমে অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন  তাকে কি করে আবার একই অভিযোগে অভিযুক্ত করে পুনরায় বিচারের আয়োজন চলতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধে এদেশীয় সহযোগীদের বিচারের জন্য হয়েছিল দালাল আইন। আর পাকিস্তানী সেনাকর্মকর্তাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের জন্য হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) এ্যাক্ট। দুটি আইনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন । দালাল আইনে এদেশীয় সহযোগীদের বিচার ফয়সালা হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী আইনে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি । তাদের সবাইকে ক্ষমা করা হয়।  এখন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য যে আইন হয়েছিল সেই আইনে এদেশীয় সহযোগীদের  বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একজনের বিচারের জন্য তৈরি আইনের মাধ্যমে অন্য আরেকজনের বিচারের  প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে ।

১৯৭৩ সালের যে আইনে এদেশীয় সহযোগীদের বিচার চলছে সে আইন নিয়ে দেশে এবং বিদেশে চলছে তীব্র সমালোচনার ঝড়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন এবং মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গ সকলেই অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন ১৯৭৩ সালের ঐ আইন দিয়ে   ন্যায় বিচার সম্ভব নয়।


সাইটের যেকোন লেখা, তথ্য উপাত্তা যেকেউ ব্যবহার, পুনমুদ্রন, পুন প্রচার, প্রকাশ করা যাবে; তবে শর্ত হল সূত্র হিসেবে Mehedy Hasan https//www.bangladeshwarcrimestrial.blogspot.com  উল্লেখ/লিঙ্ক  করতে হবে।




জেরায় সাক্ষী//সামরিক বেসারিক বাংলা শব্দ কি-না তাও বলতে পারবনা

মেহেদী হাসান, ২৮/৪/২০১৩
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী’র  বিরুদ্ধে পঞ্চম সাক্ষী নাজিম উদ্দিন খাত্তাব এর জেরা আজ শেষ হয়েছে। সাক্ষী তার জবানবন্দীতে নিজেকে এসএসসি পাশ দাবি করলেও তিনি সামরিক ও বেসমাকি শব্দের মধ্যে কি পার্থক্য তা বলতে পারলেননা। এমনকি ‘সামরিক’  এবং ‘বেসামরিক’ শব্দ দুটি বাংলা কি-না তাও তিনি বোঝেননা  বলে জবাব দেন। 

মাওলানা নিজামীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সাক্ষীকে প্রশ্ন করেন, সামরিক  এবং বেসামরিক এর মধ্যে পার্থক্য  আপনি  বোঝেন?। তখন সাক্ষী বলেন, না আমি বুঝিনা। বাংলায় বলেন।  বাংলায় বুঝিয়ে বলেন। তখন মিজানুল ইসলাম বলেন, আমি তো বাংলায়ই বলছি। সামরিক ও বেসামরিক বাংলা শব্দ।
সাক্ষী তখন বলেন, এগুলো বাংলা শব্দ কি-না তাও আমি বুঝিনা।  এরপর মিজানুল ইসলাম সামরিক ও বেসামরিক শব্দের স্থলে ইংরেজি বলে প্রশ্ন করলে সাক্ষী ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন,  আমি আর আপনার প্রশ্নের কোন জবাবই দেবনা।

এছাড়া সাক্ষী এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিলের আগেই তিনি রাজাকার, আলবদর আল শামসের নাম শুনেছেন। মিজানুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, আসলে এসব বাহিনী ১৯ এপ্রিলের পরে গঠিত হয়েছিল। তিনি কি করে ১৯ এপ্রিলের আগে এসবের নাম শুনতে পেলেন তা আমাদোর বুঝে আসছেনা।

গত ২৫ তারিখ বৃহষ্পতিবার নাজিম উদ্দিন খাত্তাবের জবানবন্দী শেষে তার জেরা শুরু হয়। আজ  তার জেরা শেষ হয়েছে। তাকে  জেরায় অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলামকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট মনজুর  আহমদ আনসারী, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন প্রমুখ।

জেরা (সংক্ষিপ্ত) :
প্রশ্ন : আপনি পিস কমিটির নাম প্রথম কবে শুনেছেন?
উত্তর : ডাববাগান যুদ্ধের আগে অর্থাৎ ১৯ এপ্রিলের আগেই শুনেছি। একই সাথে রাজাকার, আলবদর, আল শামসের নামও শুনেছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে খাবার সরবরাহ করা ছাড়া আপনি কি তাদের কাছে রাজাকার, পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থান গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করতেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : প্রণব এবং দুলাল ভারতের কোথায় থাকে?
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের ৮ মে’র ঘটনার পর আর তাদের সাথে দেখা হয়নি?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : মেগা ঠাকুরের ওই বাড়ির মালিক এখন কে?
উত্তর : বাড়ি জবর দখল হয়ে গেছে।
প্রশ্ন : কারা দখল করেছে?
উত্তর : মুসা এবং দারগা আলীর ছেলে।
প্রশ্ন : এরা কোন দল করে?
উত্তর : একজন বাইরে বাইরে আওয়ামী লীগ করে আরেকজন ফুল বিএনপি করে।
প্রশ্ন : তারিনী চৌধুরী এবং জগমায়া দেবী’র নাম শুনেছেন?
উত্তর : জগমায়াকে আমি দেখেছি। তারা ভাইবোন। তাদের পিতা আমাদের এলাকার জমিদার ছিলেন।
প্রশ্ন : তারিনী চৌধুরী কবে দেশত্যাগ করেন?
উত্তর : পাকিস্তান পিরিয়ডে। তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন : আমি বলছি মেগা ঠাকুর কখনো জমিদার ছিলেননা।
প্রশ্ন : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি যেসব ঘটনার বিবরন দিলেন সে বিষয়ে কখনো মামলার উদ্যোগ নিয়েছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন হয়েছে মর্মে কোন কমিটির নাম আপনি শুনেছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ষষ্ঠি হালদারের নাম শুনেছেন?
উত্তর :  তাকে দেখেছি।
প্রশ্ন : তার মেয়ে পার্বতী আপনাদের এলাকায় থাকে?
উত্তর : না ।
প্রশ্ন : দুলালী বেগমকে চেনেন?
উত্তর : চিনি।
প্রশ্ন : মেগা ঠাকুরের কয় মেয়ে?
উত্তর : তিন মেয়ে।
প্রশ্ন : মেগা ঠাকুরের এক মেয়ে বানীর ছেলে দুলাল ঠিকতো?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : বানী ও দুলাল ঢাকায় থাকে?
উত্তর : বানী পাবনা আর দুলাল ঢাকায় থাকে।
প্রশ্ন : আপনার মামলার লাশ আপনার নানার বাড়ি নিয়ে যাবার সময় আপনার সাথে  আর কারা ছিল?
উত্তর : মনে নেই।
প্রশ্ন : আপনার মামারা কয়ভাই?
উত্তর : চার ভাই।
প্রশ্ন : পুরো স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে নিজামী সাহেবকে আপনার এলাকায় দেখেছেন?
উত্তর : মাত্র দুইবার দেখেছি।
প্রশ্ন : কখন?
উত্তর : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভোট চাওয়ার দিন আর  একবার যুদ্ধের সময় মিটিংয়ে দেখেছি।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে ওই একবার দেখা ছাড়া বাকী সময় নিজামী সাহেব কোথায় থাকতেন কি করতেন তার কিছুই আপনি জানেননা?
উত্তর : না জানিনা।
প্রশ্ন : স্বাধীনতার পর প্রথম কবে কোথায় দেখলেন তাকে?
উত্তর : মনে নেই।
প্রশ্ন : স্বাধীনতার পর নিজামী সাহেব কোথায় কি করতেন সে বিষয়ে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছেন?
উত্তর ধ না।
প্রশ্ন : খোদা বক্স প্রামানিকের অফিসে কখনো  যাননি আপনি।
উত্তর : মাঝে মাঝে যেতাম।
প্রশ্ন : কেন যেতেন?
উত্তর : আমি যে গ্রামে অবস্থান করছি তা বোঝানোর জন্য।
প্রশ্ন : সাধারন মানুষকে কি তখন আইডি কার্ড দেয়া হত।
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : কোন রাজাকারের কাড় আপনি দেখেননি।
উত্তর : আমাকে পেলেতো তারা মেরে ফেলত।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে করমজায় কয়জন চকিদার ছিল?
উত্তর : পচা চকিদার, পাচশোনাথ এবং  তোনা চকিদার
উত্তর : পচা আর পাচশোনাথ চকিদারকে খোদাবক্স  কার্ড সই করে দিয়েছিল?
উত্তর : না, তাদের কার্ডে নিজামী সাহেবের নাম ছিল।
উত্তর : নিজামী সাহেবের সই আগে কখনো দেখেছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : স্বাধীনতার পর কোন রাজাকার, আলবদর, আল শামস এবং পিস কমিটির সদস্যকে  গ্রেফতার করে থানা হাজতে পাঠানোর কথা শুনেছেন বা দেখেছেন কি-না।
উত্তর : না। কারণ সবাই পলাতক ছিল।
প্রশ্ন : আপনাদের এলাকায় ১৯৭১ সালের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ ব্যক্তিবর্গের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছিল?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : আপনার মামা আপনার বর্নিত মতে নিহত হননি।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : শহীদ ব্যক্তিবর্গের তালিকায় আপনার মামার নাম নেই।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : আপনি কি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীতে সই করেছিলেন?
উত্তর : মনে হয় করেছি।
প্রশ্ন : আপনি এসএসসি পাশ, ক্যাম্পে খাবার সরবরাহ করা, মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষন নেয়ার কথা তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেননি।
উত্তর : বলেছি।
প্রশ্ন : সামরিক বেসমারিক এর মধ্যে পার্থক্য বোঝেন?
উত্তর : না বুঝিনা। বাংলায় বলেন। বাংলায় বুঝিয়ে বলেন।
প্রশ্ন : আমি তো বাংলায়ই বলেছি। এগুলোতো বাংলা শব্দ। আপনি এসএসসি পাশ করেছেন বলছেন। এগুলোতো বোঝার কথা।
উত্তর : ওগুলো বাংলা কি-না তাও আমি বুঝিনা।
প্রশ্ন : আমর্ড পারসন ও সিভিলিয়ান পারসন বলতে কি বোঝায় জানেন?
উত্তর : বুঝিনা। (সাক্ষী এসময় বিরক্ত হয়ে বলেন, আমি আর আপনার প্রশ্নের জবাব দেবনা।)
এরপর মিজানুল ইসলাম  আরো কয়েকটি প্রশ্নের পর ডিনায়াল এবং সাজেশন দিয়ে জেরা শেষ করেন। আগামীকাল মঙ্গলবার মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ষষ্ঠ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহনের কথা রয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।




শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৩

রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধী-৪//১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমার পেক্ষাপট////১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, গণকণ্ঠ এবং সংবাদে যুদ্ধাপরাধ বিষযক প্রকাশিত খবর বিশ্লেষন

মেহেদী হাসান
১৯৫ জন  পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের  দিক থেকে বিবেচ্য বিষয় ছিল  পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের ¯ীকৃতি আদায় এবং  পাকিস্তানে আটকে পড়া বাংলাদেশী সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকদের ফিরিয়ে আনা। অন্যদিকে  ভারত  তখন পাকিস্তান ভাঙ্গতে পারার আনন্দে বিভোর।  যুদ্ধাপরাধের বিচার  নিয়ে আর বেশি ঘাটাঘাটি  করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে বিজয়কে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ঝুকি নিতে চায়নি  তারা ।  ভারতের সেনাবাহিনী এবং সোভিয়েত উইনয়নও তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার পক্ষে ছিলনা।  তাছাড়া পাকিস্তান বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরে স্বীকৃতি না দেয়ায় পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পুনরায় হামলার আশঙ্কাও  করেছিল ভারত। সর্বোপরি শত্রু রাষ্ট্রে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ভারত তখন এক প্রকার  বিরূপ পরিস্থিতির  মুখে পড়ে। সেসময়কার সংবাদপত্রের খবর বিশ্লেষন করলে এসব চিত্র  বেরিয়ে আসে।
পাকিস্তান বাংলাদেশকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত  স্বীকৃতি দেয়নি। পরাজিত  এবং ুব্ধ পাকিস্তান বাংলাদেশকে নিজের দেশ দাবি করে আবার যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ের পক্ষ থেকে।
যেমন ১৯৭৩ সালের ২ এপ্রিল দৈনিক বাংলা পত্রিকার একটি  খবরের হেডলাইন “পিন্ডির যুদ্ধ উন্মাদনা এখনো শেষ হয়নি। আবার আঘাত হানতে পারে-  ভারতীয় সমর বিশেষজ্ঞদের অভিমত।”   প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে “ তাদের পক্ষ থেকে এখনো বিপদের আশঙ্কা রয়েছে । ভারতের দুর্বল  স্থানে আঘাত হানতে পারে। চন্ডীগড় থেকে ইউএনআই পরিবেশিত খবরে বলা হয় ফিল্ড মার্শাল মানকেশ আজ এখানে বলেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের নিকট পরাজয়কে পাকিস্তান যে এখনো স্বীকার করতে পারেনি সে বিষয়ে তিনি একমত”।
১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল  ঢাকা দিল্লী যৌথ ঘোষনা বলা হয়- উপমহাদেশের বাস্তবতাকে স্বীকৃতিদানে ব্যর্থতার দরুণ  উপমহাদেশে বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির কাজে কোন অগ্রগতি হয়নি। পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের প্রতি শত্রুতা অব্যাহ রেখেছে। ভারতের প্রতিও সে শত্রুতা বহাল রেখেছে। (সূত্র দৈনিক বাংলা ১৮ এপ্রিল)

এমনকি  পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় ছাড়াই ভারত পাকস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার পক্ষপাতি ছিল। ১৯৭৩ সালের ২২ জানুয়ারি দৈনিক বাংলা পত্রিকায় এ মর্মে একটি খবর বের হয়। পাকিস্তানী সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরন সিং বলেছেন “যদি ভারত-পাকিস্তান বাংলাদেশ সমঝোতা সম্ভব হয় তবে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকতি ছাড়াই যুদ্ধবন্দীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন সম্ভব।” অবশ্য নয়াদিল্লীতে অবস্থানরত বাসসের তখনকার প্রতিনিধি আতাউস সামাদের কাছে প্রদত্ত একটি সাক্ষাতকারে শরণ সিং এ কথা  অস্বীকার করেন। ২৪ জানুয়ারি দৈনিক বাংলায় এ খবর প্রচারিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধীর অন্য এক বিবৃেিত শরন সিং যে একথা বলেছিলেন তার সত্যতা ধরা পড়ে। ১৯৭৩ সালের ২৮ মে নয়াদিল্লীতে অস্ট্রেলীয় ব্রডকাস্টিং
করপোরেশনের সাথে সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনেকখানি ছাড় দিয়েছে। আগে স্বীকৃতি দিতে হবে সে শর্তও বাদ দিয়েছে” ।

যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে ভারতও তখন যে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ে তাতে তাদের অবস্থান ছিল ছেড়ে দিতে পারলেই যেন বাঁচি অবস্থা। বিষয়টি সুরাহা করার জন্য মুসলিম বিশ্বসহ অনেক দেশ থেকে তাদের ওপর চাপ আসে।   ভারত বাংলাদেশ মিলে তাদের বিচারের উদ্যোগ নিলে  উপমহাদেশ দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত এবং অশান্তির দিকে পা বাড়াবে বলে মনে করে ভারত।

যুদ্ধবন্দীদের বিচারের বিষয়ে বাংলাদেশের সামনে প্রধানত তিনটি সমস্যার উদ্ভব হয়। প্রথমত পাকিস্তান থেকে স্বীকৃতি না পাওয়া, দ্বিতীয়ত পাকিস্তানে আটকে পড়া সামরিক ও বেসামরিক লোকদের ফেরত আনা এবং  তৃতীয়ত সৌদী আরবসহ  মুসলিম বিশ্ব থেকে স্বীকৃতি না পাওয়ার সমস্যা।
পাকিস্তান বাংলাদেশের  জাতিসংঘের  সদস্য হবার বিরুদ্ধে লবিং করছে বলে অভিযোগ করা হয় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে। এছাড়া পাকিস্তানে আটক বাংলাদেশী সেনা সদস্যদের প্রতি নির্মম আচরণের পথ বেছে নেয় পাকিস্তান। ১৯৭৩ সালে ১০ এপ্রিল খবর বের হয়- পাকিস্তান সরকার সেখানে আটক ৫ জন বাঙ্গালী সেনা অফিসারকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাংলাদেশ যুদ্ধবন্দীদের বিচার করলে পাকিস্তানও সেখানে আটক বাংলাদেশীদের বিচার করবে বলে হুমকি দেয় ভুট্টো। ১৯৭২ সালে ২ জুলাই  ভারতের সিমলায় তিনি বলেন“ বাংলাদেশে পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌছব যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব হবেনা।
যুদ্ধবন্দীদের বিচারের জন্য ভারত যাতে পাকিস্তানী   সৈন্যদের বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর  না করে সেজন্য ভারতের কাছে  পাকিস্তান জোরালো লবিং করে আসছিল।
১৯৭৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, “ যুদ্ধাপরাধের দয়ে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর পরিকল্পিত বিচার বাতিল করা হইবে এই মর্মে  দৃঢ় আশ্বাসের বিনিময়ে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করিবেন। এই প্রতিশ্রুতি কেবল বাংলাদেশকই দিতে হইবে এমন কোন কথা নয়। যেকোন দেশ এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারে।” সূত্র ইত্তেফাক, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪)।

যুদ্ধাপরাযুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার বিষয়টি যে ভারতের নিয়ন্ত্রনে ছিল সে বিষয়ে সাবেক সচিব আসাফ্  উদ্দৌলাহ  একটি  প্রবন্ধে লিখেছেন, “১৯৭৪ সালে মে মাসে দিল্লীর রাষ্ট্রপতি ভবনে  যখন মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তখন সেই ঐতিহাসিক সভায় যোগদানের সুযোগ আমার হয়েছিল।...... সে  সময় হঠাৎ করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার সরওয়ান সিং বঙ্গবন্ধুকে বললেন, লাহোরে তার ওআইসির সম্মেলনে যোগদান নিয়ে ভারতের জনমনে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি  হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারত সরকার এরকম একটি সমঝোতায় পৌছায় যে, উভয় সরকার তাদের বৈদেশিক নীতি অনুসরনে একে অন্যের সাথে আলোচনা ও সমন্বয় সাধন করবে। সরওয়ান সিং জানান, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করার বিষয়ে সেই সমন্বয় সাধন হয়নি। বঙ্গবন্ধু এর জবাবে ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন, “আমিও তাহলে আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করব। বাংলার জনমানুষকে  আমি জোরগলায় জসসভায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম  পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে বাংলার মাটিতেই। অথচ আপনি ও ভুট্টো সিমলায় স্থির করলেন যে, চিহ্নিত ১৯৫ জন সহ সব পাকিস্তানী সৈনিককে বিনা বিচারে পাকস্তানে চলে যেতে দেয়া হবে। আর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হল আমাকে না জানিয়ে।” (সূত্র বিবেচনা ও বিদ্বেষ, দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৮ এপ্রিল ২০১০।

 সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীরে ক্ষমার পক্ষে অবস্থান নেয়।
১৯৭২ সালের ১৯  নভেম্বর  জুলিও কুরি শান্তি পদক লাভ  উপলক্ষে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে  বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর উদ্দেশে বলেন  “গণহত্যাকারীরা প্রকাশ্যে মাফ চাও, বাঙ্গালী ক্ষমা করতেও পারে।” এ থেকে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু তাদের মাফ করার  পক্ষেই ছিলেন। (সূত্র দৈনিক বাংলা ২০ নভেম্বর,৭২) ।


১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমার জন্য ত্রিদেশীয় চুক্তি :
১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ ভারত এবং পাকিস্তানেবর মধ্যে  ত্রিদেশীয় দিল্লী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।   চুক্তি অনুযয়ী বাংলাদেশে  ১৯৭১ সালের যুদ্ধে  গণহত্যা,   মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং  যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনাকর্মকর্তাকে ক্ষমা করে বাংলাদেশ।  চুক্তিতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের বেদনায়ক  ঘটনার কারণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কাছে  ‘ক্ষমা কর এবং ভুলে যাও’ আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ তাদের বিচার না করে   ক্ষমা করে দিয়েছে। যুদ্ধের কারণে  ভারতে আটক ৯২ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যসহ ৩০ লাখের উপরে বেসামরিক নাগরিক তখন তিন দেশে  আটকা পড়ে ছিল ।  ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরপরই ১৯৭২ সালে ভারত- পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর হয় এবং চুক্তিতে   দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং  সম্প্রীতি  স্থাপনে সব ধরণের প্রতিশ্রুতির কথা ব্যক্ত করা হয় উভয় দেশের পক্ষ থেকে।   কিন্তু তার কোনটিই বাস্তবায়ন সম্ভব হয়না  বাংলাদেশকেন্দ্রিক যুদ্ধউত্তর সমস্যার সমাধান না হওয়ায় । যুদ্ধউত্তর সমস্যার সমাধান এবং তা নিয়ে তিন দেশের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিরসনে ১৯৭২ সাল থেকে  দফায় দফায় আলোচনাসহ নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয় এবং সবশেষে তা পূর্ণতা পায়  ১৯৭৪ সালের  ত্রিদেশীয় চুক্তির মাধ্যমে।  চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর দিল্লী, ইসলামাবাদ এবং ঢাকা থেকে তা  একযোগে প্রকাশ করা হয়। চুক্তিতে মোট   ১৬টি দফা ছিল। 

১৩ দফায় বলা হয় “উপমহাদেশে  শান্তি এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যে  এবং তিন দেশের মধ্যে  আশু বন্ধুত্বপূর্ণ  সম্পর্ক ও সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়টি  নিয়ে তিন দেশের তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী  আলোচনা করেণ।  বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বৈঠকে বলেন যে, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাব, আন্তর্জাতিক আইন, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যাজনিত অপরাধ বিষয়ে যত আইন আছে তার সবগুলোর বিবেচনাতেই ১৯৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য অপরাধী । ঐসব আইনে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যার সংজ্ঞায় যেসব অপরাধের নাম আছে এবং যারা ঐসব অপরাধ করবে তাদের যথাযথ আইনী প্রকৃয়ায়  বিচারের আওতায় আনার বিষয়ে সারা বিশ্ব সর্বসম্মতভাবে একমত। আর ১৯৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য ঐসব আইনে বর্ণিত অনেক অপরাধ করেছে।  পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এসব ঘটনাকে তার  সরকার কঠোরভাবে নিন্দা জানায়  এবং এ জাতীয় অপরাধ হয়ে থাকলে তার জন্য পাকিস্তান গভীরভাবে অনুতপ্ত।

১৪ তম দফায় বলা হয় “তিন মন্ত্রী একমত হন যে,  উপমহাদেশে শান্তি ও অগ্রগতির স্বার্থে তিন দেশের মধ্যে যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে তার আলোকেই ১৯৫ জন সৈনিকের বিষয়টি  বিবেচনা করা উচিত। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর  আমন্ত্রনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শীঘ্রই বাংলাদেশ ভ্রমনে যাবার ঘোষনা দিয়েছেন  এবং   আপনার দেশের নাগরিকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার  আবেদন জানাবেন । একইভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী  পাকিস্তানীদের  প্রতি ক্ষমা  প্রার্থনার  আহবান জানিয়ে ঘোষনা দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের মানুষ   ক্ষমা করতে  জানে।  তাই নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করার জন্য ১৯৭১ বাংলাদেশে যে   বর্বরতা এবং  ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ হয়েছে তা তিনি তার দেশের নাগরিকদের ভুলে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

১৫ তম দফায় বলা হয়-   ‘ক্ষমা করো এবং ভুলে যাও’  বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এই আবেদন এবং মনোভাবের  প্রেক্ষিতে  বাংলাদেশ সরকার ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধপারাধীর বিচার  না করে  ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে  বলে ঘোষনা করেণ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।   অত:পর দিল্লী সমঝোতার আলোকে অন্যান্য যুদ্ধবন্দীদের সাথে এই ১৯৫ জন সেনাকর্মকর্তাদেরও  ভারত হতে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

চুক্তিতে স্বাক্ষর করেণ: ড. কামাল হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশ সরকার, সরদার শরণ সিং, বিদেশমন্ত্রী, ভারত সরকার এবং আজিজ আহমেদ, পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, পাকিস্তান সরকার।



এই সাইটের যেকোন লেখা, তথ্য উপাত্তা যেকেউ ব্যবহার, পুনমুদ্রন, পুন প্রচার, প্রকাশ করা যাবে; তবে শর্ত হল সূত্র হিসেবে Mehedy Hasan https//www.bangladeshwarcrimestrial.blogspot.com  উল্লেখ/লিঙ্ক  করতে হবে।




রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধী-৩///বিচার নিয়ে দৃঢ প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও আসল যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করা হয়

মেহেদী হাসান
পাকিস্তানী ১৯৫ জন  সেনা কর্মকর্তার  বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের ১৮ জুলাই   ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রাইমস (ট্রাইবিউনালস ) এ্যাক্ট  আইন পাশ হয় সংসদে।

কিন্তু ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লীতে  ভারত-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিদেশীয় চুক্তির মাধ্যমে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সাথে জড়িত এসব যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা ঘোষনা করা হয়।  চুক্তির ১৩, ১৪ এবং ১৫ দফায় বলা হয়েছে “পাকিস্তান স্বীয় সামরিক বাহিনীর অপরাধের নিন্দা জ্ঞাপন ও উহার জন্য  গভীর অনুশোচনা ও দুংখ প্রকাশ  করেছে।  ইসলামাবাদ সরকারের এই মনোভাব এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ‘ক্ষমা করো এবং ভুলে যাও’ আবেদনের প্রেক্ষিতে  বাংলাদেশ সরকার ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধপারাধীর বিচার  না করে  ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।  অত:পর অন্যান্য যুদ্ধবন্দীদের সাথে তাদেরও ভারত হতে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে।  উপমাহাদেশে শান্তি,  স্থিতি এবং অগ্রগতির লক্ষ্যে  এ চুক্তি করা   হয়েছে।”

১৯৭৪ সালের ১২ এপ্রিল  দৈনিক ইত্তেফাক  পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম হল “ক্ষমা প্রদর্শন করিয়া আমরা বিশ্বের  প্রশংসা অর্জন করিয়াছি-ড. কামাল হোসেন”। প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে-“পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলিয়াছেন,  বাংলাদেশের জনগণের উপর সামরিক বাহিনী যে অত্যাচার করিয়াছে পাকিস্তান সরকার সেজন্য দোষ স্বীকার করিয়া লইয়াছেন, ক্ষমার আবেদন জানাইয়াছেন। ঐ দেশের প্রধানমন্ত্রী সমগ্র বাঙ্গালী জাতির  কাছে ক্ষমা  চাহিয়াছেন। আমরা সুবিচার প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিয়াছিলাম, প্রতিহিংসা চাইনা। ক্ষমা চাওয়া হইয়াছে ক্ষমা দেওয়া হইয়াছে।”

পররাষ্ট্র  মন্ত্রী  বলিয়াছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করিলে তিনটি বিষয় প্রতিষ্ঠা করা যায়। প্রথমত ইতিহাসে ইহার স্থান দেওয়া, দ্বিতীয়ত যে দেশের লোক এই অন্যায় করিয়াছে তাহা প্রমান করা এবং তৃতীয়ত আমাদের অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতির প্রমান দেওয়া। যেহেতু এ ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার কোন চ্যালেঞ্জ করেনাই বরং সকল অন্যায় স্বীকার করিয়া নিয়াছে তখন আর বিচার করার সঙ্গত কোন কারণ নাই।  এতে কোন লাভ হইবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করায় বাংলাদেশ বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করিয়াছে। এর ফলে উপমহাদেশে স্বাভাবিকতা ফিরিয়া আসিবে। এটা সকলে চায়। দিল্লী চুক্তি সকলে গ্রহণ করিয়াছে।”

যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করা বিষয়ক ১৬ দফার ত্রিপাক্ষিক চুক্তির তিনটি মূল কপি  দিল্লী, ইসলামাবাদ এবং ঢাকা থেকে  একযোগে  পূর্ণ বিবরণসহ প্রকাশিত হয়। চুক্তি ১৩ দফায়  লেখা হয়েছে-“বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (ড. কামালা হোসেন) বলেন যে,  পাকিন্তানী  যুদ্ধাপরাধীরা  বিভিন্ন ধরণের অপরাধ যেমন যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যার মত অপরাধ করেছে।”

পাকিস্তানী ১৯৫ জন সেনা কর্মকর্তার বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রাইমস (ট্রাইবিউনালস ) এ্যাক্ট পাশ করা হলেও তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে সেই আইনে এখন বিচার চলছে এদেশীয় লোকজনের .



এই সাইটের যেকোন লেখা, তথ্য উপাত্তা যেকেউ ব্যবহার, পুনমুদ্রন, পুন প্রচার, প্রকাশ করা যাবে; তবে শর্ত হল সূত্র হিসেবে Mehedy Hasan https//www.bangladeshwarcrimestrial.blogspot.com  উল্লেখ/লিঙ্ক  করতে হবে।
 

রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধী-২ যুদ্ধাপরাধ থেকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ

মেহেদী হাসান
যুদ্ধাপরাধী এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এদেশীয় সহযোগী সম্পূর্ণ ভিন্ন  দুটি বিষয় । সেজন্য তাদের বিচারের  জন্য  দুটি পৃথক আইন হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সহযোগীদের বিচারের জন্য করা হয় দালাল আইন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালল) এ্যাক্ট। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে  যাদের চিহ্নিত  করা হয়েছিল তারা সকলেই (১৯৫ জন) ছিল পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা।

বর্তমান সরকার এদেশীয় সহযোগীদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে। যুদ্ধপারধী বলতে যেহেতু পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের বোঝায় তাই  সরকার যুদ্ধাপরাধী শব্দের বদলে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ শব্দটি ব্যবহারের কৌশল নিয়েছে। কিন্তু মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী বলতেও  মূলত পাকিস্তানী ঐ সেনাকর্মকর্তাদেরই বোঝানো হয়েছে সবসময়।  অতীতে কখনোই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এদেশীয় সহযোগী বা পাকিস্তান সমর্থনকারীদের যুদ্ধাপরাধী বা মনাবতার বিরুদ্ধে অপরাধী হিসেবে অভিহিত করা হয়নি। এমনকি বর্তমানে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের  তো নয়ই। ১৯৭৪ সালে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় চুক্তি, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা,  পাকিস্তানের হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট,  দালাল আইন, দালাল আইনে করা অসংখ্য মামলা এবং সেসময়কার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরা-খবর এর  স্বাক্ষর বহন করছে।  

যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করা বিষয়ক ১৯৭৪ সালে দিল্লীতে স্বাক্ষরিত ত্রিদেশীয়  চুক্তির   ১৩ দফায়  লেখা হয়েছে-“বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (ড. কামালা হোসেন) বলেন যে,  পাকিন্তানী  যুদ্ধাপরাধীরা  বিভিন্ন ধরণের অপরাধ যেমন যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যার মত অপরাধ করেছে।”  চুক্তির এ ধারায়ও  মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী বলতে  পাকিস্তানী ঐ সেনাকর্মর্তাদের বোঝানো হয়েছে। বাংলাদেশী সহযোগীদের নয়।

১০ জুন  ১৯৭৪ সালের ইত্তেফাক পত্রিকার একটি  খবরের শিরোনাম হল “পাকিস্তান মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করিয়াছে: এ্যমনেস্টি  ইন্টারন্যাশনাল সম্মেলনে অভিমত। প্রতিবদেনে লেখা  হয়েছে-প্যারিসে
এ্যমনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত নির্যাতনের অবসান সম্মেলনে এ অভিযোগ করা হয়েছে। সম্মেলনে বলা হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে।

এছাড়া বাংলাদেশে পাকিস্তানের পরাজয়  এবং ভারতের কাছে পাকিস্তানী সৈন্যদের  আত্মসমর্পনের কারণ খুঁজে বের করতে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসেই  পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। হামুদুর রহমান কমিশন প্রতিবেদনেও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে পাকিস্তানী সেনাকর্মকর্তাদের চিহ্ণিত করা হয়েছে।
সুতরাং  যুদ্ধাপরাধীর পরিবর্তে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ শব্দ ব্যবহার করলেই যুদ্ধাপরাধের দায় একজনের ওপর থেকে অপরজনের ওপর বর্তাবে বিষয়টি এমন কি?


এই সাইটের যেকোন লেখা, তথ্য উপাত্তা যেকেউ ব্যবহার, পুনমুদ্রন, পুন প্রচার, প্রকাশ করা যাবে; তবে শর্ত হল সূত্র হিসেবে Mehedy Hasan https//www.bangladeshwarcrimestrial.blogspot.com  উল্লেখ/লিঙ্ক  করতে হবে।


রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধী-১ যুদ্ধাপরাধী কে?///১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, গণকণ্ঠ এবং সংবাদে যুদ্ধাপরাধ বিষযক প্রকাশিত খবর বিশ্লেষন

মেহেদী হাসান
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে  মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের দায়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়  স্বাধীনতা পরবর্তী  বাংলাদেশ সরকার। বেসামরিক নাগরিক হত্যা, ধর্ষন, লুটাপাট এবং  অগ্নিসংযোগের মত  মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। তাদের বিচারের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বারবার বিভিন্ন জনসভায় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে   দৃঢ  প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন ।  কিন্তু  ১৯৭৪ সালে তাদের সকলকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।  কিন্তু কেন?

১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত দৈনিক  ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা. দৈনিক গণকণ্ঠ এবং দৈনিক সংবাদ  এ প্রকাশিত খবরের আলোকে  ১৯৫ জন যুদ্ধপরাধীদের ক্ষমার প্রেক্ষাপট, দালাল আইন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ  সেদিন কি বলেছিলেন তা  এখানে তুলে ধরা হল । এছাড়া সিমলা চুক্তি, ১৯৭৪ সালের ত্রিদেশীয় চুক্তি, হামুদুর রহমান কমিশন প্রতিবেদন প্রভৃতি থেকে দেখার চেষ্টা করা হবে আসল যুদ্ধাপরাধী কারা।

যুদ্ধাপরাধীদের  বাছাই  করার জন্য স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে  একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।   কমিটি বিচার বিশ্লেষন করে যুদ্ধাপারধীদের একটি তালিকা তৈরি করে। প্রথমে ৪০০ এবং পরে তা থেকে ১৯৫  জন যুদ্ধাপরাধীর  একটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করে। এরা সকলেই ছিল পাকিস্তানী উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তা যারা বাংলাদেশে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে ছিল।  ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে  সরকার যুদ্বাপরাধী হিসেবে ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তার চূড়ান্ত তালিকা  তৈরি এবং তাদের বিচারের কথা ঘোষনা করে। ১৮  এপ্রিল দৈনিক  বাংলা পত্রিকায় এ বিষয়ে পরিবেশিত খবরে বলা হয়- “তদন্ত শেষে স্বাক্ষী প্রমানের ভিত্তিতে ১৯৫ জন ব্যক্তির বিচার অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত   হয়েছে।  তাদের   অপরাধের মধ্যে  রয়েছে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, জেনেভা কনভেনশনের ৩ নং ধারা লঙ্ঘন, নরহত্য, বলাৎকার ও বাড়িঘর পোড়ানো। ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাদের বিচার করবে। মে মাসের শেষের দিকে তাদের  ট্রাব্যুনালের সামনে হাজির করা হতে পারে।”
সরকারি এ প্রতিবেদনে যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে পাকিস্তানী  ১৯৫ জন সেনাকর্মকর্তাদের।

মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য এসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সে সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যে দাবি এবং প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন তার কয়েকটি উদাহরণ  সে সময়ের সংবাদপত্র থেকে এখানে  তুলে ধরা হল।

দৈনিক বাংলায় ১৯৭২ সালের  ৩ জুলাই একটি খবরের  হেডলাইন হল “যুদ্ধবন্দীদের বিচার হবেই-কুষ্টিয়া জনসভায় বঙ্গবন্ধু।” ঐ বছর ৩০ নভেম্বর একই  পত্রিকার আরেকটি  খবরের শিরোনাম হল “হত্যা ধর্ষণ লন্ঠনকারী যুদ্ধাপরাধীদের রেহাই দেয়া হবেনা-পাবনার জনসভায় মনসুর আলী।”  খবরে লেখা হয় যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টন মনসুর   আলী বলেন, পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যরা এখানে মানবতা বিরোধী জঘন্যতম অপরাধেথ লিপ্ত হয়েছিল। মানবতার স্বার্থেই তাদের বিচার করা উচিত।

দৈনিক বাংলা, ৭ জুন ১৯৭২: “শীঘ্রই যুদ্ধাপরাধীদের প্রকাশ্যে বিচার করা হবে। কুয়লালামপুরে সাংবাদিকদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামাদ আজাদ।”
১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলা পত্রিকার  আরেকটি  খবরের শিরোনাম হল “বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই- টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু।” একই বছর ঐ পত্রিকার  আরেকটি খবরের শিরোনাম হল “১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবেই-নয়া দিল্লীতে বঙ্গবন্ধু।” 
এভাবে ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালের বিভিন্ন পত্রিকায় থেকে  যুদ্ধাপরাধীদের বিচার  বিষয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অসংখ্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করার উদাহরণ দেয়া যায়।


এই সাইটের যেকোন লেখা, তথ্য উপাত্তা যেকেউ ব্যবহার, পুনমুদ্রন, পুন প্রচার, প্রকাশ করা যাবে; তবে শর্ত হল সূত্র হিসেবে Mehedy Hasan https//www.bangladeshwarcrimestrial.blogspot.com  উল্লেখ/লিঙ্ক  করতে হবে।












বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৩

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ৫ম সাক্ষী জবানবন্দী গ্রহণ শেষে জেরা শুরু

মেহেদী হাসান, ২৫/৪/২০১৩, ঢাকা:
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ৫ম সাক্ষী নাজিম উদ্দিন খাত্তাবের  জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে  আজ। জবানবন্দী শেষে সাক্ষীর জেরা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আজ  জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় বিচার কার্যক্রম মুলতবি করা হয়।

জবানবন্দী :
আমার নাম নাজিম উদ্দিন  খাত্তাব। আমার বয়স আনুমানিক ৬৩ বৎসর। আমার ঠিকানা- সাং করমজা মধ্যপাড়া, থানা সাথিয়া, জেলা পাবনা।
আমি এস,এস,সি পাশ। আমি মেরিন ট্রেড কোর্স সমাপ্ত করেছি। আমি ম্যাকানিকের কাজ করি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত আমি নিজের বাড়ি ও পাশের গ্রামে থাকতাম এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে খাবার সরবরাহ করতাম। আমি নিজে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন খোদা বক্স প্রামানিক। তিনি পিস কমিটির চেয়ারম্যান ও মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে এপ্রিল তারিখ বেলা আনুমানিক ১০.০০ ঘটিকার সময় আমার বাড়ির পাশের চৌকিদার পঁচা বিশ্বাস আমার বাড়িতে এসে বলে যে, নিজামী সাহেব এসেছেন বোর্ড অফিসে মিটিং করবেন তোমাদেরকে সেখানে যেতে হবে। আনুমানিক আধা ঘন্টা পর রফিকুন নবী বাবলু, মতিউর রহমান নিজামী সাহেব, আছাদ, আফজাল, মোসলেম, শুকুর, সিরাজ ডাক্তার গং বোর্ড অফিসের দরজা খুলে বারান্দায় আসেন। ইতোমধ্যে উল্লেখিত রফিকুন নবী বাবলু অকথ্য ভাষায় আমাদের গালি গালাজ আরম্ভ করে, কারণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমরা আওয়ামী লীগ করতাম এবং নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিলাম। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব তখন বলেন তোমরা যদি গ্রাম ছেড়ে চলে যাও তাহা হলে ধরে নিব তোমরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছ এবং তোমাদের পিতা-মাতা ভাই-বোনদের হত্যা করব এবং বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হবে আর যদি বাড়িতে থাক তাহলে কোন অসুবিধা হবে না। ইউনিয়ন বোর্ড অফিসের চেয়ারম্যানের বাড়ি, বোর্ড অফিস, পোষ্ট অফিস এবং খানকা শরীফ একই কমপাউন্ডের মধ্যে অবস্থিত ছিল। ঐ ঘটনার তিনদিন পরে ২৮শে এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে আনুমানিক সকাল ৮-০০ টার দিকে আমার আপন মামা হাবিবুর রহমান সর্দার আনছার ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং তার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস দুজনে একত্রে আমার মামা বাড়ি থেকে সি এন্ড বি বাস ষ্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের নির্দেশে রাজাকার এবং দালাল আফজাল অন্যান্য রাজাকার এবং পাকিস্তানি আর্মিরা আমার মামা ও আক্কাসকে বাসস্ট্যান্ডের নিকট থেকে ধরে ফেলে এবং সেখানে তাদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ঐ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আবু সামা ফকির এবং অন্যান্য স্থানীয় লোকজন আমার নানার বাড়িতে ঐ ঘটনার সংবাদ দেয়। ঐ সময় আমি আমার নিজ বাড়িতে ছিলাম এবং অন্য লোক মারফতে ঘটনার বিষয় শুনতে পাই। তখণ আমি দৌড়ায়ে সি এন্ড বি বাস ষ্ট্যান্ডের দিকে আসি এবং দেখি আমার মামা এবং আক্কাসের লাশ পড়ে আছে। তারপর আমার মামার লাশ আমি স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ধরাধরি করে আমার নানার বাড়িতে নিয়ে আসি। আমার সমস্ত শরীরে মামার গুলিবিদ্ধ লাশের রক্ত মেখে যায়। মামার মৃতদেহ জড়ায়ে ধরে আমি চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। মামার লাশটি নানা বাড়িতে রেখে নানীর কথামত আমি পালিয়ে যাই, মামার লাশ আমি মাটি দিতে পারি নাই।

১৯৭১ সালের মে মাসের ৮ তারিখে আমার গ্রামে গণহত্যা, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ সব ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। ঐদিন রাত্রে আমাদের গ্রামের জমিদার শৈলেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্যের ছেলে প্রনব ভট্টাচার্য এবং নাতি দুলাল চক্রবর্তী আমার বাড়িতে এসে রাত্রে আমার সংগে ঘুমায়। ফজরের আজানের সময় হৈ চৈ কান্নাকাটির শব্দ শুনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন আমরা তিনজনই জমিদার বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে থাকি। পথিমধ্যে ঐ দুজনকে আমার বাড়ির নিকটবর্তী স্থানে রেখে আমি একাই জমিদার বাড়ির দিকে অগ্রসর হই। তখন দেখতে পাই প্রনব ভট্টাচার্যের মা বিবস্ত্র অবস্থায় তাদের বাড়ির পার্শ্বে গেটের সামনে চিৎকার করছে। আরও লক্ষ্য করি সেই মহিলার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছে রফিকুন নবী বাবলু যিনি তিনটি থানার আলবদরের কমান্ডার ছিলেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মোসলেম, আছাদ ও আফজাল ও পাকিস্তানি আর্মিরা। তারপর আমি ঐ অবস্থা দেখে সেখান থেকে আমার বাড়ির দিকে ফিরে এসে প্রনব ও দুলালকে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিই। তারপর আমার বাবা-মা, ভাই-বোনদেরকে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বললে তারা পালিয়ে যায় এবং সর্বশেষ আমি নিজেও পালিয়ে বাড়ি থেকে আধা মাইল দূরে কাঁটাজোলা মাঠে চলে যাই। কিছুক্ষন পরে খোজ করে প্রনব ও দুলাল আমার নিকট আসে। তখন আমার মাঠের মধ্যে হাজরা গাছের (তেতুল গাছ) নীচে অবস্থান করি। এর কিছুক্ষনের মধ্যে প্রচুর গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাই। তারপর জমিদার বাড়ির দিকে একটু একটু করে অগ্রসর হতে থাকি এবং ছোনের ভিটায় এসে দাঁড়াই। ঐ সময় সেখানে রক্তাক্ত অবস্থায় তারা হালদারকে দেখতে পাই। আমাদেরকে দেখে তিনি বলেন তোমরা ঐদিকে আগায়ে যেয়ো না এবং আরও বলেন যে, মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের উপস্থিতিতে রফিকুন নবী বাবলু, আছাদ, আফজাল, মোসলেম এবং পাকিস্তানি আর্মিরা সমগ্র গ্রাম ঘিরে ফেলেছে এবং তারা হালদার আরও বলেন যে, তাকে সহ তার দাদা ষষ্টি হালদার, দুই ভাতিজা আদু ও কার্তিক এবং দাদা শান্তি হালদার, জমিদার শৈলেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য ওরফে মেঘা ঠাকুর, তার ছেলে দিজেন্দ্র নাথ ভট্টচার্য ও করু ঠাকুর, আবু জাফর, মোরালী চন্দ্র দাস (মালী), সুরেশ চন্দ্র হালদার, ফকির চাঁদ গং কে ধরে নিয়ে এসে শৈলেন্দ্র নাথ ভট্টচার্যের পূজা ঘরের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। ইতোমধ্যে জাফরকে তার শ্বশুর মোসলেম দালাল লাইন থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। তারপর লাইনে দাঁড় করানো লোকদেরকে আর্মিরা বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে এবং ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। তারা হালদার আরও বলে যে, তিনি ঐ লাইন থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তারপর ধীরে ধীরে আমরা তিনজন জমিদার বাড়ির ঘটনাস্থলে আসি। এসে দেখি কারো নাড়ি ভূড়ি বাহির হয়ে গেছে, কারো মাথার খুলি উড়ে গেছে, কেউ কেউ বিবস্ত্র অবস্থায় ছড়ায়ে ছিটায়ে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ভিতর বাড়িতে ঢুকে দেখি জমিদারের মেয়ে শিবানী এবং পুত্রবধু ও জনৈক আজগরের স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এই ঘটনা দেখে প্রনব ও দুলাল তাদের পরিবারের জীবিত সদস্যদেরকে নিয়ে পালিয়ে ভারতে চলে যায়। তখন ঐ মৃতদেহগুলির মধ্যে ৮জনকে একটা কুয়ার মত গর্ত করে পূজাঘরের পাশে মাটি চাপা দেওয়া হয় এবং অপর একজন নীচু জাতের হওয়ায় আপত্তির মুখে আলাদাভাবে মাটি চাপা দেওয়া হয় এবং আমি সেখান থেকে পালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে চলে যাই।

১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে জানতে পারি মতিউর রহমান নিজামী সাহেব সমগ্র পাকিস্তানের আলবদরের কমান্ডার এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় আমি অধ্যাপক আবু সাইদের পক্ষে নৌকা মার্কায় প্রচার কাজ পরিচালনা করতাম। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব ঐ নির্বাচনে আনোয়ারুল হক আনোয়ারের পক্ষে দাড়িপাল্লায় কাজ করতেন। তখন থেকে আমি তাকে চিনি। মাতিউর রহমান নিজামী সাহেবের স্বাক্ষরিত আই,ডি, কার্ড পচাঁ বিশ্বাস ও খোদা বক্সের নিকট আমি দেখেছি।

২০০০ সালের ৭ই ডিসেম্বর তারিখে আমি, অধ্যাপক আবু সাইদ, গনেশ মৈত্র, পাবনা জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, স্থানীয় প্রশাসন, মুক্তিযুদ্ধকালীন দুই থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে যে স্থানে নিহতদের মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল সেই গর্ত থেকে তাদের মাথার খুলি এবং হাড়গোড় তুলে অধ্যাপক আবু সাইদ এর নিকট দিলে তিনি উহা থানায় জমা দেন। আমি আমার মামা সহ পাবনা জেলার যত নিরিহ জনগণকে আলবদর ও রাজাকাররা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব অদ্য ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন (সনাক্তকৃত)। আমি অত্র মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি ২০১০ সালের নভেম্বর মাসের ৬ তারিখে বোধ হয়।

জবানবন্দী শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। তাকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট মনজুর আহমদ আনসারী, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন প্রমুখ।

জেরা :
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আপনার  নাম নাই।
উত্তর :  নাই।
প্রশ্ন : শামসুল হক টুকু সাহেব আপনাকে কথা দিয়েছেন পরের তালিকায় আপনার নাম রাখা হবে।
উত্তর : শামসুল হক টুকু নয়, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কথা দিয়েছেন পরের তালিকায় আমার নাম  রাখা হবে।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের নাম কি?
উত্তর : সাথিয়া থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের (ভারপ্রাপ্ত) নাম জহুরুল হক।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমান হাবিবকে চেনেন?
উত্তর : চিনি তিনি জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হাবিবুর রহমান হাবিব কোন কমান্ডের দায়িত্বে ছিলেন কিনা বলতে পারেন?
উত্তর :  আমার জানা নাই।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধকালে তার সাথে দেখা হয়েছিল?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তার সাথে কতদিনের পরিচয় আপনার?
উত্তর : আট/দশ বছর।
প্রশ্ন : তার পিতা ১৯৭১ সালে নকশালদের দ্বারা নিহত হয়েছিলেন কিনা শুনেছেন?
উত্তর :  আমার জানা নাই।
প্রশ্ন : তার পিতার মৃত্যু সম্পর্কে আপনার কোন  ধারণা আছে?
উত্তর :  নাই।
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালে পাবনা শহরে আপনার যাতায়াত ছিল?
উত্তর : না।
প্রশ্ন :  আবু সাঈদ সাহেব ১৯৭০ সালে নির্বাচিত হওয়ার আগে ঐ এলাকায় এম.এন.এ কে ছিলেন  বলতে পারবেন?
উত্তর : আমার জানা নাই।
প্রশ্ন : আপনাদের এলাকায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অধ্যাপক আবু সাঈদ, আনোয়ারুল হক ছাড়া আর কারা প্রার্থী ছিল?
উত্তর :  মুসলিম লীগের শুকুর ছাড়া আরও প্রার্থী ছিলেন তবে তাদের নাম আমার মনে নাই।
প্রশ্ন : আবু সাঈদ সাহেব ছাড়া  আর কেউ জিতেছিল?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ৬/৭ দিন পর আবার ভোট হয়নি?
উত্তর : তিনি  নির্বাচিত হওয়ার পরে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ঐ এলাকায় আর কোন নির্বাচন হয় নাই।
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালে আপনি কি করতেন?
উত্তর : দশম শ্রেণিতে পড়তাম।
উত্তর : কোন স্কুলে?
উত্তর : বেড়া বিপিন বিহারী হাইস্কুলে।
প্রশ্ন : এসএসসি পাশ করেছেন কবে?
উত্তর : ১৯৭৩ সালে
প্রশ্ন : কোন স্কুল থেকে?
উত্তর :  এমএ হাইস্কুল থেকে ।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে আপনি কোন স্কুলের ছাত্র ছিলেননা।
উত্তর : ছিলামনা।
প্রশ্ন : খোদা বক্সকে কতদিন থেকে চিনতেন?
উত্তর : ছোট বেলা থেকেই ।
প্রশ্ন : দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আপনার  মামা হাবিবুর রহমানকে হত্যার অভিযোগে খোদাবক্স প্রমাণিক ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে মামলা এবং গ্রেফতার করা হয়েছিল?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আপনাদের  এলাকার কোন স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়েছিল বা  এবং কেউ আটক হয়েছিল?
উত্তর : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের এলাকার কোন স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয় নাই বা কাউকে আটক করা হয় নাই। শুধুমাত্র খোদাবক্সকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল এবং ঐদিনই তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে খোদাবক্স প্রামাণিকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়।
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালে আপনি ভোটার ছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : এস.এস.সি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনে আপনার জন্ম তারিখ কত লেখা আছে?
উত্তর : মনে নাই।
প্রশ্ন : আপনার এস.এস.সি সার্টিফিকেট আছে?
উত্তর : হারিয়ে গেছে।
প্রশ্ন : কিভাবে হারাল?
উত্তর :  কিভাবে হারিয়ে গেছে তা আমার মনে নাই।
প্রশ্ন : আনছার মোস্তফা কামাল মুক্তিযুদ্ধ করেনি।
উত্তর : করেছে। সে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিত।
প্রশ্ন : কোথায় যুদ্ধ  করেছে সে?
উত্তর :  বেড়া, সাথিয়া ও শাহাজাদপুরের অংশ বিশেষ এলাকায়
এ পর্যন্ত জেরার পর আগামী রোববার পর্যন্ত জেরা মুলতবি করা হয়।


সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৩০ তম সাক্ষীর জেরা সম্পন্ন

মেহেদী হাসান, ২৫/৪/২০১৩
গত বুধবার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৩০ তম সাক্ষী নাজিম উদ্দিনের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। আজ তাকে জেরা করে আইনজীবী আহসানুল হক হেনা।
জেরা :
প্রশ্ন : আপনি আপনার জবানবন্দীতে যা কিছু বলেছেন তা সব শোনা কথা।
উত্তর : সব শোনা কথা।
প্রশ্ন : আপনার ফুফার পিতা সোনা মিয়া ১৯৭২ সালে একটি মামলা করেছিল আপনার ফুফার  হত্যার বিচার চেয়ে তা জানেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আমি বলছি ওই মামলায় সাতজন আসামী ছিল।  মামলার  এজাহার বা চার্জশিটে কোথাও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নাম ছিলনা।
উত্তর : আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : আপনি যে নামজমার কথা বলেছেন সেই নাজমাকে তার দুই সন্তানসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় মেরে ফেলা হয়েছে।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : নাজমা কোনদিন গুডসহিলে যায়নি।
প্রশ্ন : উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি কোনদিন নাজমাকে দেখেছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনার ফুফাকে ধরে নিয়ে যাবার খবর আপনাদের বাড়িতে কে নিয়ে এসেছিল তার নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : না।
আগামী সোমবার ৩১ তম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহনের কথা রয়েছে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে।




বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৩

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুই সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ

মেহেদী হাসান, ২৪ এপ্রিল ২০১৩, ঢাকা :
বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আজ ২৯ এবং ৩০ তম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহন করা হয়েছে। এরা হলেন সুবল ও মো: নাজিম উদ্দিন।

সুবলের জবানবন্দী :
আমার নাম সুবল, আমার বয়স-৫১ বৎসর, আমার ঠিকানা-মধ্য গহিরা, থানা রাউজান, জেলা চট্টগ্রাম।
আমি গৃহস্থলি করি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ৯ বৎসর। ১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন চারিদিকে গোলাগুলি হচ্ছিল। তখন আমার বাবা আমাদেরকে বলেন বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়। তখন আমরা আমার বাবার সংগে আশ্রয়ের জন্য বিনাজুড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। কিছুদুর যাওয়ার পর গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। বাবা বললেন মনে হয় আমাদের বাড়ির দিকে গোলাগুলি হচ্ছে। তখন আমরা ঝোপের আড়ালে বাবা-মা সহ আশ্রয় নিই। ঝোপের আড়ালে আমরা ঘন্টা খানেক ছিলাম। আমার বাবা বললেন বাড়িতে কি ঘটনা হয়েছে দেখে আসা দরকার। তারপর আমরা বাবার সংগে বাড়িতে যাই। বাড়িতে গিেেয় দেখি উঠানে চারজনের গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে এবং দুইজন আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। আহত দুইজনের নাম জয়ন্ত ও মাখন লাল। নিহত চারজনের নাম যথা পঞ্চবালা, সুনিল, দুলাল এবং জ্যোতিলাল। লাশগুলি দেখার পর আমরা বাড়ি থেকে চলে যাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়িতে ফিরে এসে শুনেছি কাজী ফরিদ নাকি আমাদের পুকুর পাড়ে ঐ লাশগুলি মাটিচাপা দিয়েছে। আড়ি তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দিয়েছি।


জেরা
জেরায় আইনজীবীর প্রশ্নের জবাবে সুবল যেসব উত্তর দিয়েছেন তা এখানে  তুলে ধরা হল।
নিহত দুলালের বাড়ি হাটহাজারী থানায়। তিনি মামা বাড়ি গহিরাতে থাকতেন। স্বাধীনতার পর আহত জয়ন্ত মারা হেছে। মাখনলাল কখন মারা যায় আমি জানিনা। ঘটনাস্থলটি উঠান। ঐ উঠান কত বড় আমি বলতে পারবনা। ঘটনার সময় আমার বয়স ছিল ৯ বৎসর। আমার জন্ম ১৯৬২ সালে, তবে কোন মাসে তাহা বলতে পারবনা। ঘটনাস্থল নাপিতপাড়ার মধ্যে অবস্থিত। রাঙ্গামাটি রোড থেকে নাপিতপাড়ার দূরত্ব আধা কিলোমিটার মত হবে। সেখানে গাড়ি চলাচলের রাস্তা আছে। গোলাগুলির শব্দ প্রায় দশ মিনিটের মত চলেছিল। আমি মেলিটারী চিনিনা, মুক্তিযোদ্ধাও চিনতামনা। ঘটনার প্রায় ঘন্টখানেক পরে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। আমাদের নাপিত পাড়ায় অনেক ঘরবাড়ি ছিল। প্রায় ১৫০ মত লোক সেখানে বসবাস করত। ঘটনাস্থল উঠানের পূর্ব ও পশ্চিম পার্শ্বে ঘরবাড়ি ছিল। আমরা ঘটনার পর যখন ঘটনাস্থলে যাই তখন পূর্ব ও পশ্চিম পার্শ্বে বসবাসকারী কোন লোকজনকে দেখিনাই। আমরা ছাড়া সেখানে কোন লোক দেখিনাই, সকলে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। নাপিতপাড়া থেকে মুসলিম পাড়ার দূরত্ব আনুমানিক পাঁচ কানি জমি দূরে। এই ঘটনার আগে অনেক লোক প্রাণের ভয়ে ভারতে পালিয়ে যায়, ইহা সত্য। ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল তারিখে রাঙ্গামাটি রোডে আর্মিদের গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ি চলাচল করেছিল কিনা তাহা আমি বলতে পারবনা। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্ররোচনায় এই মিথ্যা মামলায় মিথ্যা স্যা দিলাম, ইহা সত্য নহে। আামার কথিত দিনে, কথিত সময়ে, কথিত প্রকারে কোন ঘটনা ঘটেনাই, ইহা সত্য নহে। (সমাপ্ত)



নাজিম উদ্দিনের জবানবন্দী :
আমার নাম মোঃ নাজিমুদ্দিন, আমার বয়স-৫৭ বৎসর, আমার ঠিকানা-কাশেম ফকিরের বাড়ি,  মধ্যম মাদার্শা, থানা হাটহাজারী, জেলা চট্টগ্রাম।
১৯৭১ সালে আমি ৮ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। ১৯৭০ সালে আমার ফুফু নূর বেগমের সাথে রাউজান থানাধীন কর্তার দীঘির পাড় পথের হাট গ্রামের হানিফের বিবাহ হয়।  ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল আমার ফুফা আমার ফুফুকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে  চলে আসেন। মুন্সি ও ফয়েজ নামে ফুফার দুইজন বন্ধু আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করতোএবং তার সংগে কথাবার্তা বলত। কথাবার্তা বলার পরে একদিন আমার ফুফা আমার ফুফুকে নিয়ে তার নিজ বাড়িতে চলে যান। ১৯৭১ সালের মে মাসের ২০ তারিখের দিকে আমরা খবর পাই যে আমার ফুপাকে পাকিস্তান আর্মিরা ধরে নিয়ে গেছে। এই সংবাদ পাওয়ার পরে পরের দিন আমার নান আব্দুল কুদ্দুস, চাচা আব্দুল করিম সহ ফুফুকে আনতে ফুফার বাড়িতে যাই। সেখানে যাওয়ার পরে শুনলাম ফয়েজ আহম্মদ এবং মুন্সি মিয়া রাজাকার ও  পাকিস্তান আর্মি সহ এসে আমার  ফুপাকে ধরে নিয়ে গেছে। আমি আরো শুনেছি  আমার  ফুপাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় রাজাকার ও আর্মিদের সংগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেব গাড়িতে ছিলেন। ফুফা হানিফের পিতা সোনা মিয়া সওদাগর আন্ধার মানিকের জনৈক নাজমা বেগমকে গুডস হিলে পাঠান আমার ফুফাকে উদ্ধার করার জন্য। অনেক চেষ্টা করার পর সেই মহিলা আমার ফুফাকে উদ্ধার করতে পারেননাই, তিনি গুডস হিলে আমার ফুফাকে অত্যাচার করতে দেখেছেন। আমার ফুফা আর কোনদিন ফেরত আসেননাই।  আমি অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী করেছি। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবকে আমি চিনি, তিনি অদ্য ট্রাইব্যুনালের ডকে উপস্থিত আছেন।
আজ নাজিম উদ্দিনকে একটি প্রশ্নের মাধ্যমে জেরা শুরু করেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী। এরপর বিচার কার্যক্রম মুলতবি করা  হয়।






মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ৯ মে ফরমাল চার্জ দাখিলের নির্দেশ

মেহেদী হাসান, ২৪/৪/২০১৩, ঢাকা:
দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান (এমসি) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য  মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আগামী ৯ মে  ফরমাল  চার্য  দাখিলের জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের  নির্দেশ দিয়েছেন  আন্তর্জাতিক অপরাধ  ট্রাইব্যুনাল -১।

আজ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন বা ফরমাল চার্জ দাখিলের জন্য ধার্য্য ছিল। সকালে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে  রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সুলতান মাহমুদ সিমন ট্রাইব্যুনালকে জানান, মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ শেষ হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনও পাওয়া গেছে এবং তদন্ত  অগ্রগতি প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে।   ফরমাল চার্জ  প্রস্তুত এবং জমা দিতে আরো দুই সপ্তাহ সময় দরকার। এরপর ট্রাইব্যুনাল ৯ মে তারিখ নির্ধারন করেন ফরমাল চার্জ দাখিলের জন্য।

মমালার তারিখ উপলক্ষে গতকাল ট্রাইব্যুনালে আনা হয় মীর কাসেম আলীকে। তবে তাকে ট্রাইব্যুনালের কক্ষে হাজির করানো  হয়নি। ট্রাইব্যুনালের হাজতখানা থেকে আর ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। হরতালের কারনে মীর কাসেম আলীর পক্ষে কোন সিনিয়র আইনজীবী ট্রাইব্যুনালে আসেননি। হাজতখানায় তার সাথে একজন জুনিয়র আইনজীবী সাক্ষাৎ করেন।

গত বছর  ১৭ জুন মীর কাসেম আলীকে  ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১  এর নির্দেশে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।