শুক্রবার, ২১ জুন, ২০১৩

হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট

 

 হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট
মেহেদী হাসান

ভূমিকা:
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের কারণ খুঁজে বের করতে পাকিস্তান সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে।  যুদ্ধের পরপরই ১৯৭১ সালের  ২৬ ডিসেম্বর  প্রেসিডেন্টের আদেশে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে  এ কমিশন গঠন করা হয়। ২১৩ জন প্রত্যদর্শী সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তার স্ব্যাগ্রহণ শেষে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে কমিশন তাদের  প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়। । কমিশনের এ প্রতিবেদন পাকিস্তান সরকার কখনো জনসম্মুখে প্রাকাশ করেণি।

১৯৭৪ সালে  ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যে যুদ্ধবন্দী  হস্তান্তর বিষয়ক ত্রিদেশীয় চুক্তি স্বারের আগ পর্যন্ত  লে. জেনারেল নিয়াজীসহ সকল পাকিস্তানী উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা ভারতে  বন্দী ছিলেন।  এসব সেনা কমকর্তা পাকিস্তানে ফেরত আসার আগেই হামুদুর রহমান কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। ১৯৭৪ সালে ত্রিদেশীয় চুক্তির পর পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তারা দেশে ফেরত আসার পর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজী,  ইস্টার্ন কমান্ডের  রাজনৈতিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ মেজর জেনারেল জমশেদ, রিয়ার এডিমরাল শরিফ, এয়ার কমোডোর ইনামসহ ৭২  শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার  স্ব্যা গ্রহণ করে তদন্ত  কমিশন। এর ভিত্তিতে কমিশন নতুন করে ৫৪ পৃষ্ঠার আরেকটি সাপ্লিমেন্টারী প্রতিবেদন তৈরি করে এবং  ১৯৭৪ সালের ২৩ অক্টোবর এ প্রতিবেদন জমা দেয় । এই প্রতিবেদনটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়।    জেনারেলদের  নিজ  স্ব্যা  এবং জেনারেলদের বিরুদ্ধে তাদের  অধীনস্ত সেনা অফিসাররা যে স্ব্যা দিয়েছে কমিশনের কাছে তার  ভিত্তিতে প্রণীত  সাপ্লিমেন্টারি প্রতিবেদনের সার অংশ তুলে ধরা হল। ব্রিগেডিয়ার এবং তদুর্ধ্ব সেনা কর্মকর্তাদের  স্ব্যা  গ্রহণ করে কমিশন। (৫৪ পৃষ্ঠার ইংরেজি সাপ্লিমেন্টারি প্রতিবেদনটির ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।)

মূল বক্তব্য:
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার বীজ বপিত হয়। যে সামরিক কর্মকর্তাদের পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের জন্য পেরণ করা হয়েছিল তারা পশ্চিম পাকিস্তানে থাকতেই নানা বিতর্কিত এবং নৈতিকতা বিরোধী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তারা মদ, নারী, জমি, বাড়ি, দুর্ণীতি এবং সম্পদ অর্জনের দিকে ঝূকে পড়ে। সামরিক কর্মকর্তাদের ব্যারাক ছেড়ে যখন রাজনৈতিক ময়দানে পাঠানো হয় তার ফলে যা হবার তাই হয়েছিল। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অঙ্গনে থাকার ফলে এবং  লোভ লালসার সাথে জড়িয়ে পড়ায়  সামরিক পেশাদারিত্ব এবং দতা হারিয়ে ফেলে তারা।  এ জাতীয় একটি বাহিনীকে পাঠানো হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের জন্য। দেশ রা এবং যুদ্ধ জয়ের কোন উন্নত কৌশল তারা প্রণয়ন করতে পারেনি। পাশ্চিম পাকিস্তানে থাকতে এসব সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যেসব গুরুতর অভিযোগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে এসেও তারা একই অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। যুদ্ধের জন্য যেসব লজিষ্টিক সাপোর্ট দরকার অর্থাৎ ময়াদনে থাকার ব্যবস্থা, খাদ্য সরবরাহ এবং যুদ্ধযানের জন্য তেল ও অন্যান্য সামগ্রীর সুষ্ঠু সরবারের কোন  ব্যবস্থা না করেই সৈনিকরা মাঠে নেমে পড়ে যুদ্ধের জন্য। টিক্কা খানকে এসব সমস্যার কথা বলা হলে তিনি বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে কি কোন গুরু ছাগল নেই?” অর্থাৎ মানুষের বাড়ি ঘর, দোকান পাট লুটপাট করে খাদ্য তেল সংগ্রহ করার আদশে দেন তিনি। এছাড়া উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা লুটাপাট, নির্বিচারে মানুষের বাড়িঘর, হাটাবাজার জ্বালাও পোড়াও এবং নারী ভোগে মেতে ওঠে।  লে. জেনারেল নিয়াজী করাচী এবং শিয়ালকোটে জিওসি থাকা অবস্থায় সঈদা নামে এক মহিলার কাছে  যাতায়াত করতেন । সাঈদা একটি পতিতালয় পরিচালনা করতেন এবং সে  সেনা কর্মকর্তাদের সে সময়ে নারী সাপ্লাইয়ের কাজ করত। নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করতে এসেও  একই কাজে লিপ্ত হয়। তার অধীনস্তরা তার বিরুদ্ধে  স্ব্যা প্রদানকালে বলেছেন, সে ছিল একজন র্ধষক। এছাড়া সে পাকিস্তান এয়ার লাইন্সের মাধ্যমে পশিচ্ম পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সম্পদ পাচারে লিপ্ত ছিলেন। উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এমনকি তাদের স্ত্রীরা পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বর্ণালঙ্কার, মূল্যবান আসপাবপত্র, অর্থ পাচারে লিপ্ত ছিল। । পাকিস্তানে পাচারকৃত এসব সম্পত্তি অনেক সেনা কর্মকর্তাদের বাসা থেকে উদ্ধারও করা হয়েছে পরবর্তীতে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তারা যখন এ ধরণের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে তখন এর প্রভাব পড়ে অধীনস্তদের ওপরও। এবং হয়েছিলও তাই। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে এসব কর্মকর্তারা পূর্ব পাকিস্তানকে  নিজের দেশ মনে না করে শত্র“ দেশ মনে করে নির্বিচারে নৈরাজ্য চালিয়েছে এখানে। পূর্ব পাকিস্তানকে রার কোন চেষ্টা তারা করেনি।  যুদ্ধ জয়ের কোন উন্নত চিন্তা পরিকল্পনা তাদের ছিলনা।
প্রতিবেদনে  স্পষ্ট  করে  বলা  হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পনের কোন পরিস্থিতি ছিলনা। আত্মসমপর্ণের কোন নির্দেশও  পাকিস্তান সেনা সদরদপ্তর তেকে নিয়াজীকে দেয়া হয়নি। নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তানের সেসময়কার পরিস্থিতি  সম্পর্কে সেনাসদরে ভুর তথ্য পাঠিয়ে সেনা কর্তৃপকে বিভ্রান্ত করেছিলেন যাতে আত্মসমপর্ণের  অনুমতি পাওয়া যায়।  নিয়াজীর অধীনে  থাকা বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ডের কমান্ডারাও নিয়াজীকে ভুল তথ্য দিয়েছে এবং তাকে যুদ্ধ কৌশল নির্ধারণ এবং করণীয় বিষয়ে সঠিক পরামর্শ ও  বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেণি। কোন কোন কমান্ডার নিয়াজীর অনুমতি ছাড়াই ক্যান্টনমেনট্ গুটিয়ে ঢাকায় চলে এসেছে।   ভারতের আগ্রাসন বিষয়ে  ব্রিগেডিয়ার জিএম বাকির সিদ্দিকীকে রাওয়ালপিন্ডিতে একটি কনফারেন্সে খুব ভাল করে  বুঝিয়ে দেয়া  হয়েছে কিস্তু তিনি এ  বিষয়ে নিয়াজীকে ঢাকা গিয়ে অবহিত করেণনি।
ভারত আক্রমনের পর কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায় যুদ্ধকে আরো দীর্ঘায়িত করা যা সে বিষয়ে তাদের কোন পরিকল্পনা ছিলনা। প্রতিবেদনে ১৬ ডিসেম্বর আতসমপর্নের ঘটনা পাকস্তিানের সেনাবহিনীর ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে  আখ্যায়িত করা হয়েছে । যুদ্ধাপরাধের সাথে লিপ্ত হবার দায়ে অভিযুক্ত করে জেনারেল নিযাজীসহ সকল উচ্চ পদস্থ সেনাকর্মকতাদের কোর্ট মার্শাল এবং  অনেকের প্রকাশ্য বিচারের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এছাড়া যুদ্ধের  সময় মুক্তিবাহনী এবং আওয়ামী লীগের লোকজনের বিহারীদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ করা,  হিন্দুদের সম্পত্তি দখল এবং জোরপূর্বক অনেককে যুদ্ধে নামতে বাধ্য করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।  প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আগস্ট সেপ্টেম্বরের দিকে যুদ্ধ অনেকটা থিতিয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এটি  পানি বন্যার সময়। এছাড়া  মুক্তিবাহনীর পে দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন ছিল। এ বিষয়টি ভারত উপলব্ধি  করে যুদ্ধ আর দীর্ঘায়িত করা উপযুক্ত হবেনা এবং পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিতে পারে ভেবে তারা সরাসরি হস্তেেপর পরিকরল্পনা নেয় এবং  ১৯৭১ সালের আগস্টে ভারত-সোভিয়েত  চুক্তি হবার পর নভেম্বরে বাংলাদেশে সরারি আক্রমন করে ভারত।   

  
অধ্যায় ১
মদ, নারী, বাড়ি, জমি এবং দুর্ণীতি আসক্ত উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তার শুধু যে যুদ্ধের ইচ্ছাই  হারিয়ে ফেলেছিল তাই নয়  বরং এ ধরণের জটিল মুহুর্তকে মোকাবেলার জন্য যে ধরণের পেশাদারিত্ব থাকা দরকার ছিল তাও তাদের ছিলনা। প্রত্যদর্শীরা সাক্ষ্য  প্রদানকালে জোর দিয়ে বলেছেন এ ধরণের নৈতিকতা  বিরোধী জীবনে জড়িযে পড়া সেনাবাহিনীর পক্ষে বিজয় অর্জন করা সম্ভব ছিলনা।

কমিশনের সামনে উপস্থাপিত তথ্যা প্রমান বিশ্লেষন শেষে কমিমশন এই সিদ্ধান্তে  উপনীত হয়েছে যে, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর থেকেই  উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের নৈতিক অধপতনের যাত্রা শুরু হয়। এরপর আবার ১৯৬৯ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খঅনের সামরিক শাসন  চাপিয়ে দেয়ার ফলে অধপতনের এ মাত্রা  আরো বেগবান হয়। বিপুল সংখ্যক  উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তা শুধু  বিশাল পরিমান জমি, প্রতিপত্তি, বাড়ি দখল করেই  ান্ত হয়নি বরং তারা অনৈতিক এবং অনচারপূর্ণ জীবন যাপনের  সাথে জড়িয়ে ফেলে নিজেদের। ফলে তাদের পেশাদারিত্ব যেমন ধ্বংস হয় তেমনি ধ্বংস হয়েছে নেতৃত্বের গুনাবলী।
     মূল প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময়  লে. জেনারেল নিয়াজীসহ অন্যান্য সেনাকর্মকর্তাদের বিদ্ধুদ্ধে অভিযোগ বিষয়ে তাদের বক্তব্য নেয়ার সুযোগ ছিলনা । কারণ তখনো তারা ভারতে যুদ্ধথবন্দী  হিসেবে বন্দী ছিলেন। ভারত থেতে ফেরত আসার পর আমরা নিয়াজীসহ অন্যদেরাছে এ বিষয়ে জবাব তলব করি।

সামরিক  শাসনের প্রভাব:
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সামরিক অভিযানের ফলে বেসরমারিক শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের বেসরমারিক শাসনের বোঝা অর্পিত হয় সেনা বাহিনীর ওপর। প্রধান সচিব, আইজিপিসহ আরো বেশ কিছু বেসামরিক কর্মকর্তাদের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিসন্তানে পাঠানো সত্ত্বেও বেসরমারিক শাসনের ওপর সামরিক কর্তৃত্ব বাড়তেই থাকে।
আইজিপি এম এ কে চৌধুরী’র (স্বাী নম্বর ২১৯) মতে মার্চের পর পূর্ব পাকিস্তানে আইন শৃঙ্খলাসহ যাবতীয় বিষয় চলে যায় সামিরক আইন কর্তৃপ লে. জেনারেল নিয়াজীর নিয়ন্ত্রনে। এমনকি একটি কনফারেন্সে পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেলকেও আসতে অনুমিত দেয়নি সামরিক আইন কর্তৃপ। বেসামরিক প্রশাসন সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে। বাঙ্গালী অফিসারদের নির্বিচারে গ্রেফতার করা হয় তাদের ওপর অবিশ্বাসজনিত কারণে। এমনিক তাদের গ্রেফতারের আগে গর্ভনেরর বা  তাদের উপরস্থ অফিসারদের অনুমতিও  নেয়া হতনা।

ড.  এম এ মালেকের নেতৃত্বে একটি  পূর্ণ মন্ত্রীসভা গঠন করেও বেসামরিক প্রশাসন কার্যকর করা যায়নি।  জেনারেল নিয়াজীর বেসামরিক প্রশাসনের প্রতি কোন শ্রদ্ধা ছিলনা এবং  সামরিক মতার অপব্যবহারের রাজনৈনিত পরিণতি কি হতে পারে সে সম্পর্কেও তার কোন ধারণা ছিলনা।
  বেসামরিক প্রশাসনের ওপর তখন সামরিক কর্তৃত্বের মাত্রা বোঝা যায় ঢাকার  অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার মোহাম্মদ আশরাফের (স্বাী নম্বর ২৭৫) স্ব্যা থেকে। তিনি বলেন, “নতুন মন্ত্রী সভার প্রথম বৈঠকে দেখলাম গভর্নরের পাশে খুব আড়ম্বরের সাথে বসে আছেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। যদিও তিনি মন্ত্রী সভার কোন সদস্য নন।”
এভাবে  পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরুপে সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে চলে যাওয়া এখানে একটি চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যুদ্ধরত একটি সামরিক বাহিনী যখন  বেসামরিক কাজে জড়িয়ে  পড়ে তখন তাদের  পেশাদাত্বি  থাকবেনা এটিই স্বাভাবিক। তারা লিপ্ত হয় নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে।


পূর্ব পাকিস্তানে ২০৩ (এ) ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সলিমুল্লার স্ব্যা অনুযায়ী দীর্ঘদিন ধরে সামরিক বাহিনী বেসামরিক কাজে জড়িত থাকার ফলে তারা পেশাদারিত্ব হারিয়ে ফেলে। পূর্ব পাকিস্তান নৌবাহিনীর ফাগ কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল শরীফের (স্বাী নম্বর ২৮৩) মতে “ ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার বীজ বপিত হয়। রাজনীতির পাঠ রপ্ত করতে গিয়ে তারা তখন সৈনিকের প্রাথমিক পাঠ ভুলে যায়।”  কমিশনের সামনে স্বাী প্রদানকালে একই মত ব্যক্ত করেছেন কমোডোর মালিক, ব্রিগেডিয়ার কাশিম, কর্নেল মনসুরুল মালিক, কর্ণেল ইজাজ আহমেদ  প্রমুখ। সামরিক আইন জারির দায়িত্ব পালন এবং বেসামরিক প্রশাসন চালাতে গিয়ে তারা যেমন দুণীতিতে জড়িয়ে পড়ে তেমনি হারিয়ে ফেলে পেশাদারিত্ব।
আওয়ামী বিদ্রোহীদের  মোকাবেলায় ২৫ মার্চ রাতে সেনাবাহিনী সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট ছাড়াই। ফলে  প্রাথমিক অবস্থায় খাদ্য সামগ্রীসহ অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাধারণ মানুষের দোকন পাট এবং বাড়িঘর লুটপাট করে সংগ্রহ করতে থাকে তারা।  পরবর্তীতে এটি তাদের একটি অভ্যাসে পরিণত হয়। পরে যখন  লজিস্টিক সাপোটের আয়োজন সম্ভব ছিল তখনো তারা এভাবে জিনিসপত্র সংহ্রহ করত।   সাধারণ মানুষের  দোকান থেকে তেল এবং অন্যান্য খাদ্য সমাগ্রী  লুটপাটের সময় সেনাবহিনী তার কোন রেকর্ড রাখেনি ।  পরিসিস্থতি সাভাবিক হলে তাদের তিপুরণ প্রদানের কোন চিন্তা এবং পরিকল্পনা ছাড়াই এসব লুটপাট করা হয়।  জিনিসপত্র সংগ্রহের কোন নীতিমালা এবং নিয়মনীতি এবং রেকর্ড না রাখার কারণে অফিসার থেকে শুরু করে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যেও এ লুটপাটের প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে। তারা  ঢালাওভাবে  ইচ্ছামত এসব অপকর্ম করতে থাকে।  শেষ পর্যন্ত এটি একটি গণলুটপাটে পরিণত হল। যুদ্ধের  প্রয়োজন ছাড়াও অফিসারা   ব্যক্তিগত স্বার্থে  দামী জিনিসপত্রও লুটপাট শুরু করে।

 যুদ্ধের শুরুতে উর্ধ্বতন সেনা  অফিসারদের সম্মতি ছিল এ লুটপাটে। লে. জেনারেল নিয়াজী টিক্কা খানের কাছ থেকে দায়িত্ব নিয়ে প্রথম দিনই তিনি মন্তব্য করলেন, “র‌্যশন সঙ্কটের একি অভিযোগ আমি শুনছি?      পূর্ব পাকিস্তানে কি কোন গরু ছাগল নেই? যার  যা দরকার  যেমন করে পার নিয়ে নাও । বার্মায় তো আমরা এটিই করেছি।” নিয়াজী কমিশনের কাছে স্ব্যা প্রদানের সময় এ জাতীয়  কথা অস্বীকার করেণ। তবে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এটি প্রমানসহ উপস্থিত করেছেন। এছাড়া অন্যান্য অফিসাররাও এ বিষয়ে নিয়াজীর বিরুদ্ধে স্ব্যা দিয়েছেন। লে. কর্ণেল বুখারী বলেছেন, তাদেরকে এমনকি লিখিত অনুমতি  দেয়া হয়েছে এ বিষয়ে।


অবশ্য পরবর্তীতে এভাবে লুটপাটের বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং ব্যারাকে  অভিযান চালিয়ে সেনা অফিসারদের  কর্তৃক লুটকৃত জিনিপত্র উদ্ধারও করা হয়। উদ্ধারকৃত এসব জিনিসপত্রের মধ্যে স্বর্ণ, ঘড়ি, এসি, টিভি, টাইপরাইটারসও আরো বিভিন্ন জিনিসপত্র ছিল।  অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ বব্যবস্থা গ্রহণেরও উদ্যোগ নেয়া হয কিন্তু তা আর শেষ করা যায়নি পরাজয় ঘনিয়ে আসার কারণে।

 লে. জেনারেল নিয়াজী:   পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর  নিয়াজীকে প্রথমে শিয়ালকোটের জিওসি  পরে, পরে লাহোরের জিওসি এবং সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করায় হয়। এ দুই প্রদেশে দায়িত্ব পালনকালে সে অর্থ, জমি দখল  এবং নারী সম্ভোগে জড়িয়ে   পড়ে। লাহোর গুলবাগে  সাঈদা বুখারী নামে এক মহিলার  সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। সাঈদা ‘সিনোরিটা হোম’ নামে একটি পতিতালয় চালাত। এ মহিলা অন্যান্য সেনাকর্মকর্তাদের সাথেও  যোগাযোগ রাখত দালাল হিসেবে।   নিয়াজী শিয়ালকোটে থাকা  অবস্থায় শামিনী ফেরদৌস নামে আরেক মহিলার  কাছে যাতায়াত করত। সেও সাঈদার মতই একজন  পতিতালয় পরিচালনাকারী । পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্ব লাভের পর নিয়াজীর এ কুখ্যাতি ব্যাপক আকার  ধারণ করে। এমনকি রাতে সে যেসব জায়গায় যাতায়াত করত সেই একই স্থানে যাতায়াত করত তারই অধীনস্ত  জুনিয়র সেনা কর্মকর্তারা। স্বাী  আব্দুল কাইউম আরিফ, মনোয়ার হোসেন, আব্দুল হাফিজ, মেজর সাজ্জাদুল হক, স্কোয়াড্রন লিডার ওয়াহিদ, লে. কর্ণেল হালিজ আহমেদসহ আরো অনেকে তার বিরুদ্ধে এ স্ব্যা দিয়েছে। অবাধ যৌন  সম্ভোগে জড়িয়ে পড়া ছাড়াও সে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্যান চোরাচালন করত। এজন্য সে পাকিস্তান এয়ারলাইন্স ব্যবহার করত। 

নিয়াজীর বিরুদ্ধে অবধা যৌনাচারের এমনসব ভয়ঙ্কর অভিযোগ কমিশনের সামনে পেশ  করা হল যা বর্ণনাতীত। শুধু মাত্র কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার একটি  মন্তব্য তুলে ধরতে চাই এখানে। লে. কর্ণেল মনসুরুল হক,   নেভী কমান্ডার এ এ খান,  ব্রিগেডিয়ার আই আর শরীফ,  কমান্ডার মোহাম্মদ আশরাফ, লে. কর্ণেল আজিজ আহমেদ খান বলেন, “সৈনিকরা বলত নিয়াজী নিজেই যখন একজন ধর্ষক তখন সাধারণ সৈনিকদের থামাবেন কি করে?”  শিয়াল কোট এবং লাহোরেও তার   সম্পর্কে এ কথা প্রচলিত ছিল।

 মেজর জেনারেল কাজী আব্দুল মজিদ খান এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীও নিয়াজীর বিরুদ্ধে প্যান রপ্তানীর অভিযোগ করেছেন। মেজর জেনারেল আব্দুল মজিদের মতে ব্রিগেডিয়ার আসলাম নিয়াজী এবং সিনিয়র পুলিশ সুপার  দিলজান ঢাকায় নিয়াজীর সাথে  ফাগ স্টাফ হাউজে বাস করত। তারা নিয়াজীকে প্যান রপ্তানীতে সহায়তা করত।  মেজর এস এস হায়দার এবং ব্রিগেডিয়ার আতা মোম্মদের মতে নিয়াজীর এক পুত্র এমনকি ইন্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ বাকির সিদ্দিীকও নিয়াজীর প্যান রপ্তানীর দোসর ছিলেন। রাও ফরমান আলী বলেছেন, “প্যান রপ্তানীতে সাহায্য না করায় নিয়াজী আমার ওপর ুব্ধ ছিলেন। পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের ব্রিগেডিয়ার হামিদউদ্দীন আমার কাছে অভিযোগ করেছিলেন  প্যান রপ্তানীর জন্য বিমানের  অবৈধ ব্যবহার বিষয়ে।”
যৌনতাসহ এসব বিষয়ে  জেনারেল নিয়াজীর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি  অস্বীকার করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে দাযিত্ব পালনকালে আমি ধর্মের প্রতি অনেক বেশি অনুরক্ত হয়ে পড়ি যা আগে ছিলামনা।” প্যান রপ্তানীর কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, বরং ব্রিগেডিয়ার হামিদ উদ্দীন এবং এয়ার লাইন্সের অন্যান্য কর্মকর্তারা এ কাজে জড়িত ছিল।   
সামরিক ও বেসামরিক  মহল থেকে নিয়াজীর বিরুদ্ধে যে পরিমান অভিযোগ এসেছে তাতে কমশিন এসব অভিযোগ সত্য বলে মনে করে। তবে সরকার চাইলে এ বিষয়ে আরো তদন্ত করতে পারে। এ নিয়ে  আরো গভীরে যাওয়া কমিশনের কাজ নয়।

মেজর জেনারেল জমশদে:
মেজর জেনারেল জমশেদের স্ত্রী ১৬ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তান ফেরার পথে   সোনা নিয়ে আসেন সাথে করে। জমেশেদের বিরুদ্ধে অর্থ লুটপাটেরও  অভিযোগ করেছেন কর্ণেল বশির, কণেল রশিদসহ অনেকে। ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর হেলিকপ্টারযোগে আসা কয়েকজন সেনা অফিসারদের মধ্যে তিনি অর্থ বিতরণও করেছেন।

এছাড়া ব্রিগেডিয়ার জেহানজেব আরবাব, লে. কর্ণেল মুজাফফর আলী খান, লে. কর্ণেল বাশারাত, লে. কর্ণেল তাজ, লে. কর্ণেল তোফায়ে, মেজর মাদাদ হোসেনসহ আরো অনেকের  বিরুদ্ধে আর্থিক  লুটপাটের অভিযোগ করেছেন মেজর জেনারেল নজর শাহ, মেজর জেনারেল আনসারী, ব্রিগেডিয়ার বাকির। এসব কর্মকর্তা এবং তাদের ইউনিট ব্যাপক আর্থিক লুটপাটের সাথে জড়িত ছিল। সিরাজগঞ্জের ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ১ কোটি ৩৫ লাখ রুপী   লুট করা হয় মেজর মাদাদের নেতৃত্বে।

আওয়ামী লীগের  বিরুদ্ধে বর্বরতার অভিযোগ:
বিহারীসহ যেসব পাশ্চিম পাকিস্তানী  লোকজন ফেরত আসতে পেরেছে তারা আওয়ামী বাহিনীর বর্বরতার  বিষয়ে স্ব্যা দিয়েছে। সাংবাদিক কুতুব উদ্দীন আজিজ তার “ব্লাড এন্ড টিয়ারস” বইয়ে বিহারীদের নির্মম নিয়াতনের বিবরণ দিয়েছেন। তার বইয়ে এক থেকে ৫ লাখ বিহারী নিহত হবার কথা উল্লেখ আছে। এছড়া  আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিবাহিণীর বিরুদ্ধেও লুটপাট এবং ধর্ষনের  অভিযোগ রয়েছে ।


পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ:
ক. ১৯৭১ সালের ২৫ এবং ২৬ মার্চ মাত্রক্তরিক্ত সৈন্য এবং অস্ত্রের ব্যবহার
খ. দেশের অভ্যন্তরে নির্বিচারে বর্বর হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ পরিচালনা করা। যুদ্ধের শুরুতে এবং শেষ দিকে বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিকদের হত্যা করা এবং গণকবর দেয়া।
গ. নিরস্ত্রীকরণ অথবা বিদ্রোহ দমনের নামে ইস্ট বেঙ্গল  রেজিমেন্ট, ইস্ট  পাকিস্তান রাইফেলস ইস্ট পাকিস্তান পুলিশের বাঙ্গালী অফিসারদের হত্যা।
ঘ. ব্যাবসায়ী, বেসামরিক নাগরিক, শিল্পপতিদের হত্যা,  বাড়ি থেকে নিখোঁহ হয়ে যাওয়া
ঙ. প্রতিশোধ এবং  নির্যাতনের  অংশ হিসেবে পূব পাকিস্তানের নারীদের নির্বিচারে ধর্ষন।
চ. পরিকল্পিতভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের হত্যা করা।

লে. জেনারেল নিয়াজী এসবের জন্য তার পূর্ববর্তী কমান্ডার লে. জেনারেল  টিক্কা খানকে দায়ী করেছেন। তার মতে “সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়ির ফলে মানুষ আর্মির বিরুদ্ধে ভীষনভাবে েেপ গিয়েছিল।  ২৫ মার্চ রাতের ঘটনাসহ শুরুে দিকে সেনাবাহিনীর বর্বরতার ফলে  যে তি হয়েছে তা আর  পূরণ করা সম্ভব হয়নি।  সামরিক শাসক ‘চেঙ্গিস খান’ এবং  ‘কসাই’ উপাধি লাভ করে পূর্ব পাকিস্তানে।

  পূর্ব পাকিস্তান গভর্ণর এর উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর মতে “ধর্ষন, লুটপাট এবং  নির্যাতন  খুবই সাধারণ বিষয়ে পরিনত হল। এসবের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ এবং জনগণের  মন জয় করার বিষয়ে আমি একটি নির্দেশিকা তৈরি করলাম। জেনারেল টিক্কা খানের স্বারিত এ নির্দেশিকা ইস্টার্ন কমান্ডের কাছে পাঠানো হল। কিন্তু তার এ নির্দেশ অগ্রাহ্য করা হল। সামরিক বাহনীর বাড়াবাড়ি এবং নির্যাতনকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়া হল।”
 ব্রিগেডিয়ার তাসকীনুদ্দীনের মতে “ অনেক জুনিয়র অফিসার নিজ হাতে আইন তুলে নিলেন। প্রকাশ্য জনসম্মুখে  তারা  মানুষকে  জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করত। পাকিস্তান  সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ল। সেপ্টে¤র অক্টোবরে ধুমঘাটে অফিসাররা   বাংলাদেশীদের প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করত।
  মেজর জেনারেল নজর শাহ, ব্রিগেডিয়ার আব্দুল কাদির খান  কমিশনকে বলেছেন,  বাঙ্গালীদের বিনা বিচারে হত্যা করা হত। মানুষকে তুলে  এনে হত্যা করা হত। লে. কর্ণেল বোখারি বলেছেন, রংপুরে একটি ঘটনায় ২ জন বাঙ্গালী অফিসার এবং ৩০ জন সাধারণ মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হল। অন্যান্য স্টেশনেও এ জাতীয় ঘটনা ঘটতে পারে। লে. কর্ণেল নাঈম বলেছেন, ২৫ মার্চ রাতে সাধারণ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং এতে জনগণ  সেনাবাহিনীর প্রতি সম্পূণ বিরুপ হয়ে পড়ে।

লে. কর্ণেল মনসুরুল হক কমিশনকে বলেন, “উর্ধ্বতন কর্তপেরে অনুমতি ছাড়াই মুক্তিবাহনী বা আওয়ামী লীগের কর্মী ধরা পড়লে বিনা বিচারে হত্যা করা হত। নির্বিচার হত্যা এবং লুটপাট পাকিস্তানের শত্র“র সংখ্যাই কেবল বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে নিরব যে জনসধারণ ছিল তাদের সমর্থনও হারায় পাকিস্তান।”  বর্বরতার একটি উদাহরণ  দিয়ে তিনি বলেন, “২৭ এবং ২৮ মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ফিল্ড রেজিমেন্ট লে. জেনারেল ইয়াকুব মালিকের ্একটি মাত্র অঙ্গুলি নির্দেশে ১৭ জন বাঙ্গালী অফিসার এবং ৯১৫ জন সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হল। জেনারেলসহ সাধারণ সৈনিকদের মধ্যেও বাঙ্গালীদের সম্পর্কে প্রচন্ড ঘৃনা কাজ করত। হিন্দুদের নির্মুলের জন্য মৌখিক নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

সেনাবহিনী যখন দেশের অভ্যন্তরে  অগ্রসর হল তখন অতি নির্মমভাবে শরহ বন্দর গ্রাম জালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করতে করতে অগ্রসর হল। ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার মোহাম্মদ আশরাফ কমিশনে স্ব্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, সামরিক অভিযানের ফলে বাঙ্গালীরা নিজ দেশেই পরবাসী হয়ে গেল। সকলেরই  জীবন, সম্মান, সম্পদ অনিরাপদ হয়ে পড়ল-তা সে যত বড় সম্মানীত ব্যক্তিই হোক  না কেন। পূর্ব পাকিস্তানে আইনের শাসন বলতে তখন কিছু ছিলনা। মানুষকে ঘর থেকে তুলে  আনা হত সন্দেহবশত হত্যা এবং নির্যাতন করা হত। সেনাবাহিনীর তালিকায় কারোর নাম উঠলে তার আর রার কোন উপায় ছিলনা। সেনা গোয়েন্দায় যারা কাজ করত তারা এখানকার ভাষা, সংস্কৃতি এবং বাঙ্গালীদের আবেগ অনুভূতি সম্পর্কে সম্পূণ অজ্ঞ ছিল। 
ব্রিগেডিয়ার ইকবালুর রহিম অভিযোগ কর বলেন, “জেনারেল গুল হাসান তার অধীনস্ত সৈনিকদের বলত “আজ তুমি কতজন বাঙ্গালী হত্যা করলে ?”
লে. কর্ণেল আজিজ স্বাী দিতে গিয়ে বলেন, “ব্রিগেডিয়ার আরবাব আমাকে জয়দেবপুরের সব ঘরবাড়ি ধ্বংস করতে বললেন। আমি এ নির্দেশ পালন করেছি। জেনারেল নিয়াজী আমার ঠাকুরগাও এবং বগুড়া ইউনিট পরিদর্শন করেছেন। সে আমাদের জিজ্ঞেস করল তোমরা কতজন হিন্দু হত্যা করেছ।  হিন্দুদের হত্যার বিষয়ে মে মাসে আমাদের লিখিত নিদের্শ দেয়া হয়।

 বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ :

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর মতে “ডিসেম্বরের ৯ অথবা ১০ তারিখ  পূর্ব পাকিস্তানের উপ  সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জমশেদ আলী আমাকে  পিলখানা হেডকোয়ার্টারে  ডেকে পাঠালেন। আমি  পিলখানায় গিয়ে দেখতে পেলাম বেশ কিছু গাড়ি সেখানে পার্ক করা আছে।   মেজর জেনারেল জমশেদ আলী একটি গাড়িতে উঠছেন। আমাকে তার সাথে  যাওয়ার জন্য বললেন। আমি গাড়িতে উঠলাম। তিনি লে. জেনারেল নিয়াজীর কাছে যাচ্ছেন। পথে যেতে যেতে আমাকে জানালেন  নির্দিষ্ট কিছু  লোকজনকে গ্রেফতারের  পরিকল্পনা করেছেন তারা। বিষয়টি নিয়ে  নিয়াজির সাথে আলোচনা করতে হবে।  আমি তাকে একাজ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিলাম। নিয়াজির কাছে যাবার পরও আমি তাকে এ বিষয়ে বারণ করলাম। নিয়াজী চুপ করে রইলেন। জমশেদও কোন কথা বললেননা। এর পর আমি  হেডকোয়ার্টার থেকে চলে আসার পর কি পদপে তারা নিয়েছিল তা আর  জানতে পারিনি। তবে এ বিষয়ে  আর কোন পদপে নেয়া হয়নি বলে আমি মনে করি।”

 এ বিষয়ে নিয়াজীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি বলেন, কমান্ডাররা তার কাছে দু®কৃতিকারী, মুক্তিবাহিনীর প্রধানদের একটি তালিকা সরবরাহ করেছিল। কিন্তু কোন  বুদ্ধিজীবীর কোন তালিকা তিনি সংগ্রহ করেণনি এবং কোন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা বা গ্রেফতারেরও কোন হুকুম দেননি কাউকে।
  মেজর জেনারেল জমশেদ অবশ্য এ বিষয়ে  ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, ঢাকায় একটি গণঅভ্যুত্থানের আশঙ্কা করছিলেন জেনারেল নিয়াজী। সেজন্য তিনি ডিসেম্বরের ৯ এবং ১০  তারিখ আমাকে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা থেকে কাউকে গ্রেফতার করার দরকার আছে কিনা তার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বলেন। বিভিন্ন  আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সামরিক কর্তৃপ  এবং গোয়েন্দা সংস্থার কাছে  আগে থেকেই তাদের তালিকা ছিল।  ডিসেম্বরের ৯ এবং ১০ তারিখ ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি কনফারেন্সে এ তালিকা সরবরাহ করা হয় এবং তালিকায় দুই থেকে তিন হাজার লোকের নাম ছিল। আটকের জন্যই এদের তালিকা করা হয়েছিল।  কিন্তু  ভারতের আক্রমন  এবং ঢাকার তখনকার পরিস্থিতিতে  এ বিষয়ে আর অগ্রসর হওয়ার কোন সুযোগ পায়নি সামরিক কর্তৃপ এবং বিষয়টি পরিত্যক্ত ঘোষনা করা হয়।

    বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগের সাথে সরাসরি জড়িত  এই তিন কর্মকর্তার স্বা্েযর ভিত্তিতে কমিশন এটা মনে করে যে,  ভারতের  সাথে  যুদ্ধের  শেষ পর্যায়ে পাকিস্তান আর্মি যখন  বিপর্যস্ত এবং আত্মসমর্পনের   প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন তাদের পে  এ ধরণের একটি   অপারেশন পরিচালনা করার পে প্রতিষ্ঠিত কোন তথ্য প্রমান আমাদের নেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের  বুদ্ধিজীবীদের  গ্রেফতার  বা হত্যা  করেছে এ মর্মে বাংলাদেশ সরকারের কাছে  যদি কোন তথ্য  প্রমান থাকে এবং তারা যদি তা সরবরাহ না করে  তাহলে পাকিস্তান  সেনাবহিনীর  বিরুদ্ধে  বুদ্ধিজীবী  হত্যার  এই অভিযোগ যেরকর্ডভুক্ত করা  কমিশন সঠিক  মনে করেনা।  তবে পাকিস্তান  আর্মির  কমকর্তারা এটা আশঙ্কা  করেছিলেন যে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সেখানে ভারতীয়  আর্মির  সহায়তায়  আওয়ামী লীগ   এবং মুক্তিবাহিনী একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটবার চেষ্টা করছিল। সেজন্য আওয়ামী লীগ  এবং  মুক্তিবাহিনীর নেতাদের  গ্রেফতারের বিষয়েও  আলোচনা হয়েছে। কিন্তু  সেসময়ে বিদ্যামন পরিস্থিতি সেটি আর বাস্তবায়ন  সম্ভব হয়নি।

  নির¯ী¿করনের সময় বাঙ্গালী অফিসার এবং সৈনিক নিধনের অভিযোগ:

৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্ণেল ইয়াকুবের বিরুদ্ধে  অভিযোগ  তিনি ১৯৭১ সালে  মার্চ মাসে  কুমিল্লা  ক্যান্টনমেন্টে   নিরস্ত্রীকরণ  অভিযানের সময় ১৭ জন বাঙ্গালী অফিসার এবং আরো ৯১৫ জন সৈনিক হত্যা করেণ। এ  বিষয়ে তার কাছে কৈফিয়ত তলব করা হলে তিনি যথারীতি তা অস্বীকার  করেন। একই অভিযোগ রয়েছে  রংপুর সেনাক্যাম্পেও। সেখানকার কমান্ডিং অফিসর ব্রিগেডিয়ার সগিরও  তার বিরুদ্ধে বাঙ্গালী অফিসার এবং সৈনিক নিধন অভিযোগ অস্বীকার করেণ।  তারা দুজনেই পাকিস্তান আর্মিরও য়তির  বিষয়ে উল্লেখ করেণ অভিযান পরিচালনার সময়। কমিশন মনে করে এ বিষয়ে পাকিস্তান আর্মির  আরো গভীরভাবে বিষয়টি তদন্ত  করা দরকার।

৩০ লাখ বাঙ্গালী  হত্যা এবং ২ লাখ ধর্ষনের অভিযোগ বিষয়ে:
বাংলাদেশের প থেকে পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে যে ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যা এবং ২ লাখ নারী র্ধর্ষনের অভিযোগ করা হয়  কমিশন এটিকে নিছক বাড়াবাড়ি, কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছু মনে করেনা। আর্মি হেডকোয়াটার্র থেকে ২৬ হাজার মানুষ হত্যার তথ্য  সরবরাহ করা হয়েছে কমিশনের কাছে। এ তথ্য সঠিক মনে করে কমিশন।  আর্মি হেডকোয়ার্টারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে  নিয়মিত যে প্রতিবেদন পাঠানো হত তার ভিত্তিতে এ সংখ্যা নির্ধারিত  হয়েছে।  কমিশন মনে করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের  সহানুভূতি পাবার জন্য ঢাকা ৩০ লাখ  হত্যার গল্প প্রচার করছে ।  কমিশন এও মনে করে  পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেমন  অপরাধ করেছে পূর্বপাকিস্তানে  তেমনি আওয়ামী লীগ, মুক্তি বাহিনী এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরাও  পূর্বপাকিস্তানে অনেক  হত্যা, ধর্ষন, লুটাপাট  এবং অপরাধমূলক কার্মকান্ডের সাথে জড়িত ।

১৯৫ যুদ্ধাপরাধী প্রসঙ্গে
ঢাকা কর্তৃপ পাকিস্তানী ১৯৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে  তালিকাভুক্ত করেছে। তিন বছর থেকে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের নাম বিশ্ব শুনে আসছে। তবে সে তালিকা কমিশন পায়নি। তাই  এ বিষয়ে কমিশন তাদের অভিযুক্ত করে  কোন সিদ্ধান্ত নিতে  চায়না। তবে কমিশনের কাছে যেসব তথ্য আছে তাতে পাকিস্তানে ২৫ মার্চ অপারেশন এবং পরবর্তীতে যুদ্ধের সময় যেসব  নিষ্ঠুরতা চালানো হয়েছে তার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান, মেজর জেনারেল পীরজাদা, মেজর জেনারেল উমর, লে. জেনারেল মিঠঠাকে দায়ী মনে করে কমিশন। ২৫ মার্চ অপারেশন পরিকল্পনায় মিঠঠা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে কমিশনের কাছে প্রমান   আছে। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে অন্যান্য উল্লিখিত সেনা কর্মকর্তারা সরাসরিজ জড়িত অপারেশন পরিকল্পনায়।  ২৫ মার্চের  দুর্ভাগ্যজনক অপারেশনের তারিখ ঠিক  করে জেনারেল ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেণ। জেনারেল মিঠঠা সেখানে রয়ে যান অপারেশন পরিচালনার  জন্য। এছাড়া মেজর জেনারেল টিক্কা খান, মেজার জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেনও এ অপারেশন পরিকল্পনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

৭ মার্চ লে. জেনারেল ইয়াকুব খানের কাছ থেকে লে জেনারেল টিক্কা খান দায়িত্ব বুঝে নেন এবং ২৫ মার্চের এ   অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব তার ওপর  অর্পিত হয়। তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার  এবং সামরিক  আইন প্রশাসক ছিলেন। ৭  এপ্রিল টিক্কা খানের কাছ থেকে এ দায়িত্ব  অর্পিত হয় লে. জেনারেল নিয়াজীর ওপর।
এটা ঠিক যে জেনারেল টিক্কা খান বাড়াবাড়ি, হত্যা,  ধর্ষন বেং জ্বালাও পোড়াওয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি  এসব অপারাধের  জন্য দায়ীদের  শাস্তির  আওতায় আনার জন্য  কঠোর হুশিয়ারি দিয়েছেলেন । কিন্তু  পরবর্তীতে জেনারেল নিয়াজির কাজকর্ম এবং  সেনা অফিসারদের সাথে  তার কথাবার্তা  ধর্ষন এবং হত্যায় উৎসাহ যুগিয়েছে বলে কমিশনের কাছে প্রমান আছে।
সুতরাং যুদ্ধের সময় যেসব বাড়াবিড়র অভিযোগ পাওয়া গেছে তার জন্য সরাসরি এসব কর্মকর্তা দায়ী। এসব   সেনা কর্মকর্তারা শুধু সামরিক আইনেই অপরাধী নয় বরং সাধারণ ফৌজদারি অপরাধেও তারা অভিযুক্ত। পাকিস্তান সেনা আইনে যে সব অপরাধের জন্য  শাস্তির বিধান আছে তার আওতায়ও এসব অপরাধের জন্য তাদের  শাস্তি দেয়া যেতে পারে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়:
পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তারা  দায়িত্বপালনে ইচ্ছকৃতভাবে যে অবহেলা উদাসীনতা এবং অপেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে,   সাহসিকতার সাথে শত্র“র মোকাবেলা না করে শারিরীক ও মানসিক দেউলিয়াপনার শীকার হয়ে যে কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছে এবং সর্বোপরি আত্ম সমর্পনের কোন পরিস্থিতি না হওয়া সত্ত্বেও  এবং যুদ্ধের সমস্ত রশদ, পর্যাপ্ত সৈন্য সংখ্যা থাকা সত্ব্ওে  ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমপর্নের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইতিহাসে যে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছেন তার জন্য দায়ীদের অবশ্যই বিচার করা উচিত। তাদেরকে শুধুমাত্র বরখাস্ত করলে চলবেনা।  সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব  শৃঙ্খলা এবং ভবিষ্যতের এ জাতীয় কোন ঘটনার পুনরাবৃত্তিরোধে তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত বলে কমিশন মনে করে। 


কমিশনের  বিশ্লেষন মতে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমপর্ণের মত কোন পরিস্থিতি ছিলনা। আরো কমপে ১৫ দিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মত সমস্ত আয়োজন ছিল। এবং যুদ্ধকে র্দীঘসুত্র করতে পারলে ফলাফল অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু  ভারতের আক্রমনের মুখে করণীয় নির্ধারণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন সেনা কর্মকর্তারা । তাছাড়া লে. জেনারেল নিয়াজী আত্মসমপর্ন, অস্ত্র সমপর্ণের যে আনুষ্ঠানিক  আয়োজন করেছেন তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়।  জেনারেল অরোরাকে গর্ড অব অনার  এর আয়োজনের কোন দরকার ছিলনা।  যুদ্ধত্রে পরিত্যাগ,  যুদ্ধকালে উপরস্থ সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশ অমান্য, উদাসীনতা, কাপপুরুষতা,  দায়িত্বে অবহেলা, দুর্গ পরিত্যাগ, ঢাকাকে নিরাপত্তাহীন করা এবং দেশের অষন্ডতা রায় চূড়ান্ত অবহেলা ও তাচ্ছিল্যসহ যেসব কাজ পাকিস্তান সেনাবাহিনী করেছে তার সবিকছুর জন্যই  সেনা কর্মকর্তাদেও বিচার হওয়া উচিত এবং পাকিস্তানে সেনা আইনে  শৃঙখলা ভঙ্গের জন্য বিচারের ব্যবস্থা আছে।

যে কারণে  তাদের  বিরুদ্ধে  ব্যবস্থা নিতে  হবে :
জেনারেল নিয়াজী: পূর্ব পাকিস্তানে  ভারতীয়  আগ্রাসনের  বিষয়ে পাকিস্তান আর্মি সদরদপ্তর থেকে সমস্ত তথ্য তাকে সরবরাহ করা হয়েছে। তাছাড়া ১৯৭১ সালের  আগস্টে সোভিয়েত-ভারত চুক্তি, ভারতীয় বিমান, নৌ এবং স্থল বাহিনী  বাংলাদেশে  আগ্রাসন চালানোর সমস্ত প্রস্তুতি তখন প্রকাশ্যেই চলছিল। কিন্তু  এতসব সত্ত্বেও জেনারেল নিয়াজী ভারতের  আগ্রাসন মোকাবেলায় কোন  যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেণনি। সম্পূর্ণ উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন জেনেশুনে  ইচ্ছাকৃতভাবে। ভারতীয়  আগ্রাসন মোকাবেলায় এবং পূর্ব পাকিস্তান রায়  তাকে  সর্বাত্মক নির্দেশনা প্রদান সত্তেও তিনি সে দায়িত্ব পালন করেণনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেকগুলো ঘাটি পুরোপুরি অত  থাকা সত্ত্বেও তিনি ভারতের কাছে ১৬ ডিসেম্বর  আত্মসমর্পণ করেণ যদিও তখন  পর্যন্ত  আত্মসমর্পনের কোন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তাকে  আত্মসমপর্ণেও কোন নির্দেশনাও দেয়া হয়নি।

ঢাকা রায়  কোন  উন্নত  সমর পরিকল্পনা যেমন তিনি  গ্রহণ করতে পারেণনি তেমনি  একজন জেনারেলসুলভ নেতৃত্ব এবং দায়িত্বও তিনি পালন করতে পারেণনি। পাকিস্তান  সদরদপ্তর থেকে আরো  সৈন্য  সরবরাহ করার আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও ঢাকা রিজার্ভ সৈন্যের ৫৩ রেজিমেন্ট তিনি গুটিয়ে ফেললেন  তাড়িঘড়ি করে। নিয়াজী  উদ্দেশ্যমূলক  এবং ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তান সদরপপ্তরে  পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ  পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুল  তথ্য  পাঠিয়ে  বিভ্রান্ত  করেছেন। পাকিস্তান  সদরদপ্তরের  নিষেধাজ্ঞা  সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে তিনি অনেক অত  যুদ্ধাস্ত্র  ভারতীয়  বাহিনীর কাছে হস্তান্তর    করেণ  আত্মসপর্ণের সময়।
জেনারেল নিয়াজীর  যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব,   জেনারেল অরোরাকে ঢাকায় গার্ড অব অনার প্রদান এবং ভারতীয়  প্রস্তাব মত প্রকাশ্যে  আনুষ্ঠানিকভাবে   আত্ম সমর্পণে  অনুষ্ঠানে  রাজি হয়ে তিনি  পাকিস্তান সেনাবাহিনীর  ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছেন।
 জেনারেল নিয়য়াজীর মত পদমর্যাদার একজন সেনাকর্মকর্তা  যখন বেপরোয়া যৌন অনৈতিকতায় এবং  চোারচালানের সাথে  যুক্ত  হয় তখন তার অধীনস্তদের ওপর আর কেনা নেতৃত্ব থাকেনা এবং তাদের ওপরও  এর প্রভাব পড়ে। ভারতের  জবদলপুরে  ভারতীয় হেয়াজতে    থাকা  অবস্থায়  যুদ্ধে  পরাজয়ের বিষয়ে তিনি মিথ্যা গল্প সাজান এবং তার অধীনস্তদের সে মোতাবেক  প্রভাবিত করেণ যাতে তারা দেশে গিয়ে ভুল ব্যাখ্যা দেয়। জেনারেল নিয়াজীর অধীনস্তদের স্বা্েযর ভিত্তিতে এটা প্রমানতি হয়েছে যে কমিশনের কাছেও জেনারেল নিয়াজী মিথ্যা  স্ব্যা  দিয়েছেন সার্বিক পরিস্থিতি বিষয়ে। এসব অপরাধে  তার  বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করে কমিশন।

মেজর জেনারেল জমশেদ, সাবেক জিওসি ৩৬ ডিভিশন, ঢাকা
মেজর জেনারেল জমশেদ তার ওপর অর্পিত  দায়িত্ব পালনে অবহেলা  এবং ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি সমস্যাদি সুষ্ঠুভাবে চিহ্নিত করে,  কি কি লজিস্টি সার্পোট দরকার সে বিষয়ে সঠিকভাবে নিয়াজীকে অবহিত করেণনি এবং উপযুক্ত কোন যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়নে তাকে সহায়তা করেণনি। কোন  চিন্তা পরিকল্পনা ছাড়া   আকস্মিকভাবে তিনি  ৯৩ ডিভিশনকে জামালপুর থেকে ঢাকায় গুটিয়ে আনেন। অথচ ঢাকার  প্রতিরার জন্য জামালপুরের এই দুর্গ খুবই কার্যকরী ছিল কৌশলগতভাবে। তিনি জামালপুর ডিভিশন প্রত্যাহার করায় শত্র“পে খুব সহজে কোন বাঁধা ছাড়া ঢাকা দখলের  সুযোগ পায়।  জেনারেল নিয়াজীর মত তিনিও  দায়িত্ব পালনে  ইচ্ছাকৃতভাবে চরম অবহেলা এবং উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন।  যুদ্ধ  করার মত কোন মানসিক দৃঢ়তা তাদের আদৌ ছিলনা। সম্পূর্ণ কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছেন তারা। এছাড়া তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।

মেজর জেনারেল রহিম খান, সাবেক জিওসি
তিনি চাঁদপুর ডিভিশনের দায়িত্বে ছিলেন। তিনিও সেখান থেকে তার দুর্গ গুটিয়ে এনেছিলেন  তবে এেেত্র তিনি নিয়াজিীর অনুমতি নিয়েছিলেন। এই সেনাকর্মকতা স্বেচ্ছায় কমিশনের সামনে এসে তার অবস্থানের বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তার  দায়িত্ব পালনে কোন অবহেলা ছিল কিনা সে বিষয়ে আরো তদন্ত করা দরকার। তবে নিম্নলিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে তার কোর্ট মার্শাল হওয়া উচিত বলে মনে করে কমিশন। 

শত্র“পরে হুমকির কারণে তিনি তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার  কারণে চাঁদপুর  থেকে ডিভিশনটি গুটিয়ে আনেন ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। এর মাধ্যমে  নৌপথে ভারতের ঢাকা  আগ্রাসন সহজ করে দেন।  তিনি নিয়াজীর কাছে নিরাপত্তা দাবি করেছিলেন। যুদ্ধরত একজন সেনা কর্মকর্তার এ কাজ  কাপুরুষতার চরম দৃষ্টান্ত ছাড়া আর কিছূ নয়। এটি সম্পূর্ণ অসৈনিক আচরণ।
মুক্তিবাহিনী কর্তৃক হামলায় তার ডিভিশনের ১৪ জন নৌসেনা নিহত হওয়া, ভারতীয় বিমান বাহিনীর হামলার আশঙ্কার করণে তিনি সেখান থেকে ডিভিশনটি গুটিয়ে আনার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন।
আতঙ্কিত এই সেনা অফিসার যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ সব যন্ত্রপাতি ফেলে আকস্মিকভাবে  চাঁদপুর ক্যাম্প গুটিয়ে সেখান  থেকে এক প্রকার পলায়ন করেণ এবং তার অধীনস্ত সেনা কর্মকর্তাদের জীবনের নিরাপত্তার কথাও ভাবেননি। সেনা ক্যাম্প  গুটানোর বিষয়ে তিনি সবাইকে ঠিকমত অবহিতও  না করেই যোগাযোগের সিগনাল এবং যন্ত্রপাতি পরিত্যক্ত করেণ। ফলে  ক্যাম্পের  বাইরে অবস্থানকারী অনেক  জুৃনিয়র সেনা অফিসার সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তিনি চাঁদপুর থেকে চলে আসা বিষয়ে এবং সেখানকার বাস্তব অবস্থা  সম্পর্কে আর্মি সদরদপ্তরকে অবহিত না করে প্রকৃত সত্য গোপন রেখেছেন। ফলে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে তার ভূমিকা কি ছিল তা ভাল করে না জেনে তাকে পরবর্তীতে আবার সেনা কর্তৃপ চিফ অব জেনারেল অর্মি অফিসার করে। 

ব্রিগেডিয়ার জিএম বাকির সিদ্দিকী, সিওসি, ইস্টার্ণ কমান্ড, ঢাকা
 চিফ অব স্টাফ  জিএম বাকির ইচ্ছকৃতভাবে পাকিস্তান সদর দফতরে ভুল বার্তা পাঠিয়েছিলেন যাতে আত্মসমর্পনের অনুমতি পাওয়া যায়। দায়িত্ব পালনে কোন মেধা, দতা, দৃঢ়তার পরিচয় না দিয়ে কিভাবে যুদ্ধের  ইতিটানা যায় সে চিন্তায় তারা ছিলেন বিভোর। রাওয়ালপিন্ডিতে  একটি কনফারেন্সে ভারতীয় আগ্রাসন পরিকল্পনা বিষয়ে তাকে খুব ভাল করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি তা জেনারেল নিয়াজিকে অবগত করেণনি। তিনিও অজ্ঞাত কারণে  আত্মসমর্পনের পর মূল্যবান যুদ্ধাস্ত্র  ভারতীয় বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এর বিনিময়ে তিনি ভারতের হাতে বন্দী থাকা অবস্থায় কোলকাতায় শপিং করতে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন হয়ত। অন্য কোন সেনা কর্মকর্তাকে এ সুযোগ দেয়া  হয়নি ভারতে। তার সাথে ভারতীয় কর্তৃপ খুবই বন্ধুসুলভ আচরণ করে বলে কমিশনের কাছে তথ্য আছে।

ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ  হায়াত
 শত্রুসেনার গৌরীপুর আক্রমন মোকাবেলায় তিনি কোন পাল্টা  আক্রমন করেণনি। ফলে সাতটি ট্যাঙ্ক ধংসসহ বিপুল য়তি হয় পাকিস্তানপওে  এবং যশোর ডিভিশন অরতি হয়ে পড়ে। শত্র“প  যাশোর  প্রতিরাব্যুহ ভেঙ্গে ফেলেছে  এমন একটি খবরের ভিত্তিতে তিনি যশোর ডিভিশন পরিত্যক্ত  ঘোষনা করেন ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।  তথ্যটি সত্য কিনা সেটি যাচাইয়েরও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেণনি তিনি।   যশোর  দুর্গের সমস্ত  অত রশদ তিনি     শত্র“পরে কাছে তুলে দেন। আর তার ইউনিটের সৈন্যরা ঐ রাতে নিজেদের মত করে কোন নির্দেশনা  ছাড়াই সারারাত যুদ্ধ পরিচালনা করেছে।
চাঁদপুর এবং ত্রিপুরার মাঝে মুজফফরগঞ্জ রার জন্য তাকে  প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান সত্ত্বেও তিনি কোন পরিকল্পনা করেণনি এটি রার। ফলে ২৩ পাঞ্জাব কন্টিনজেন্ট ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় ইউনিটের কাছে  আত্মসমর্পনে বাধ্য হয়। তাদের কাছে খাদ্য ও গোলাগুলি ছিলনা।  কুমিল্লার লাকসাম  দুর্গ থেকে মাত্র  তিন কিলোমিটার দূরে ৪শ সৈন্য নিয়ে তিনি ভারতীয় বাহিনীর কাছে  আত্মসপর্ন করেণ। অথচ লাকসাম দুর্গে চার হাজার সৈনিক এবং অনেক যুদ্ধাস্ত্র  মজুদ ছিল। এসব যুদ্ধাস্ত্র তিনি ভারতীয় বাহিনীর হাতে তুলে দেন। দুগেরও  বাইরে তার এ আত্মসপর্নের কথা দুর্গের সৈনিকরা জানতেও পারেনি ঠিকমত।


  ব্রিগেডিয়ার  আব্দুল কাদের, ব্রিগেডিয়ার মনজুর আহমেদসা আরো অনেক সেনা কর্মকতা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেণনি। 

কমিশন তাদের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে আত্মসপর্নের কোন হুকুম নিয়াজীকে পাকিস্তান সদরদপ্তর থেকে দেয়া হয়নি। শুধু এটুকু অনুমতি দেয়া ছিল যে, যদি তিনি তার বিবেচনায় মনে করেণ  আতম্সমপর্ণের  কোন বিকল্প নেই তবেই কেবল তিনি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে  পারেন।
কমিশন উল্লেখ করেছেন মুল প্রতিবেদনে ১৯৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির পোপট,  পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার পেছনে সামরিক শাসন জারির ভূমিকা, আওয়ামী লীগ ও পিপলস পাটিরও ভূমিকা  এসব কিছুরই বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা করা হয়েছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রোপটে।


প্রকাশ্য  বিচার:
কমিশনের মতে  জেনারেল ইয়াহিয়া, জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, লে. জেনারেল পীরজাদা, লে জেনারেল গুল হাসান এবং মেজর জেনারেল মিঠঠা খানের প্রকাশ্যে বিচার করা উচিত ১৯৭১ সালের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের  জন্য।
   


এই সাইটের যেকোন লেখা, তথ্য উপাত্তা যেকেউ ব্যবহার, পুনমুদ্রন, পুন প্রচার, প্রকাশ করা যাবে; তবে শর্ত হল সূত্র হিসেবে Mehedy Hasan https//www.bangladeshwarcrimestrial.blogspot.com  উল্লেখ/লিঙ্ক  করতে হবে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন