রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সুখরঞ্জন বালীর জন্য অপেক্ষা

মেহেদী হাসান, ২১/৯/২০১৪
‘মোর স্বামীর পরানডা কি  আছে? আমনেগো পায় ধরি, মোর স্বামীরে আইন্যা দ্যান।  মোরে এটটু খবর  দ্যান।”
প্রায় দুই বছর আগে সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রী আরতী রানী  এই আকুতি প্রকাশ করেছিলেন। বালী নিখোঁজ হবার পর ২০১২ সালের   ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আরতী রানীকে ফোন করা হলে নিখোঁজ স্বামীর জন্য তিনি বিলাপ করে এভাবে আকুতি প্রকাশ করেছিলেন।

নিখোঁজ স্বামীর কোন সন্ধান ছাড়াই আরতী রানীর পর হয়ে যায় ছয় মাস।  এরপর ২০১৩ সালের ১৬ জুন ঢাকার নিউএজ পত্রিকায় খবর বের হয় সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি ভারতের কারাগারে বন্দী আছেন। 

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে ২০১২ সালের পাঁচ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরনের শিকার হন সুখরঞ্জন বালী। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় হয়েছে। কিন্তু বালীর জন্য অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি তার অসুস্থ স্ত্রী এবং সন্তানদের।

গত শুক্রবার সকালে আবার ফোনে যোগাযোগ করা হয় সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রী আরতী রানীর সাথে। স্বামীর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেই কান্নার  সুর ভেসে আসতে থাকে ফোনের ওপার থেকে।  “মোর স্বামীরে আইন্না এটটু দেহান মোরে। মোর অসুখ। মরার আগে স্বামীর মুখ দেখে যেন মরতে পারি হেই ব্যবস্থা করেন আমনেরা।”

সংসার কিভাবে চলছে জানতে চাইলে আরতী রানী জানান, তার স্বামী সুখরঞ্জন বালী কাঠমিস্ত্রীর কাজ করত। নিখোঁজ হবার আগে একটি ঘর বানিয়েছিলেন নিজেদের জন্য ।  কিন্তু সে ঘরে আজ নেই তিনি। স্বামী নিখোঁজের পর দিশাহীন অবস্থায় পাগলের মত এদিক সেদিক ঘুরেছেন আরতী রানী। বেহাল দশা নেমে আসে সংসারে। আগে থেকেই তার হাপানীসহ আরো রোগব্যাধি ছিল। স্বামীর শোক এবং সংসারের এ দুরবস্থার কারনে তার অসুস্থতার মাত্রা আরো বেড়ে যায়। অধিকাংশ সময় তিনি এখন শয্যাশায়ী ।  একমাত্র মেয়ে মনিকার বিয়ে হয়েছিল । সে স্বামীর বাড়ি না থেকে এখন বাপের বাড়ি থাকে তার দেখাশুনার জন্য। মনিকা ছাড়া তাদের  অপুর্ব নামে আরেকটি ছেলে আছে ১৬ বছর বয়সের।

আরতী রানী জানান, স্বামী কাঠ মিস্ত্রী বাবদ যে আয় করত তা দিয়েই চলত সংসার। জমিজমা নেই; সামান্য বাস্তুভিটা এবং একটা গরু আছে। স্বামী নিখোঁজ হবার পর অভাব অনটন নেমে আসে সংসারে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতে থাকে। গরুটি তিনি বেঁচতে চেয়েছিলেন। মেয়ে বলেছে বাবার স্মৃতি বেচা ঠিক হবেনা ।  একথা বলার সময় আবার কান্নার সুর ভেসে আসে ফোনে।

ফোনে কথা বলার সময় আরতি রানী প্রথমে কথা বলদে দ্বিধা এবং  জড়তা প্রকাশ করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান কত লোক কত কথা জানতে চায়। কার কাছে কি বললে কোন বিপদ নেমে আসে সে ভয়ে আছেন তারা। তার স্বামী মাওলানা সাঈদীর মামলার স্বাক্ষী হওয়া এবং নিঁেখাজ হবার পর অনেক লোক অনেক কথা বলেছে। অনেকে অনেক কিছু জানতে চেয়েছে তাদের কাছে।  অনেকে ভয়ভীতিও দেখিয়েছে।
আরতী রানী বলেন, তার সাথে এখনো অনেকে কথা বলেনা। এড়িয়ে চলে। কারণ এর ফলে যদি তাদেরও কোন বিপদ হয়। দোকানে কোন কিছূ কিনতে গেলে দোকানদার তাড়াতাড়ি সদায় দিয়ে বিদায় করতে চায়।
আরতী রানী জানান, সুস্থ থাকলে তিনি মানুষের বাড়িতে কিছু কাজ টাজ করেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তিনি এখন অসুস্থ। হাটাচলা করতে পারেননা ঠিকমত। কারণ হিসেবে সঙ্কোচের সাথে জানালেন তার জরায়ু অনেক নিচে নেমে গেছে অনেক দিন থেকে। কোন চিকিৎসা হয়নি। হাপানিরও কোন চিকিৎসা হচ্ছেনা। তুদপরি রয়েছে ঠিকমত খাবার না পাবার সমস্যা। আরতি রানী জানান তার বয়স ৫০ এর উপরে হবে।

কে সুখরঞ্জন বালী : মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে যেসব অভিযোগ আনে তার মধ্যে একটি অভিযোগ হল পিরোজপুরের উমেদপুর গ্রামে বিশাবালী নামে একজনকে  নারকেল গাছের সাথে বেঁধে রাজাকাররা  মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে তারই সামনে গুলি করে হত্যা করে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়। তার মধ্যে একটি হল এই বিশাবালী হত্যার অভিযোগ। আপিল বিভাগের রায়ে বিশবালী হত্যার অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে আজীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। সেই বিশাবালীর আপন ছোটভাই হলেন সুখরঞ্জন বালী। তিনি ছিলেন মাওলানা স্ঈাদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী।  কিন্তু তিনি পক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে আসেন। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে  সাক্ষ্য দিতে আসার দিন ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে তাকে অপহরন করা হয়। 

গোটা বিশ্বে এ নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে ঢাকার দৈনিক নিউএজ পত্রিকায় ডেভিড বার্গম্যানের একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয় সুখরঞ্জন বালী বিষয়ে। তাতে বলা হয় সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দমদম সংশোধন কেন্দ্রে রয়েছেন। সুখরঞ্জন বালীর সাথে তারা যোগাযোগ করলে বালী তাদের জানিয়েছেন ঢাকার আইনশঙ্খলা বাহিনী তাকে অপহরন করে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে।

ভারতে বালী : নিউএজ পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানানো হয় বালীকে ৫ নভেম্বর অপহরনের পর ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভারতে পাঠানো হয় জোর করে। অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের দায়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাকে গ্রেফতার করে উত্তর চব্বিশপরগনার বশিরহাট জেলে রাখে।  এরপর বশিরহাট আদালত ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল   অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বালীকে ১০৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়।  যেহেতু বিচার চলাকালে এই মেয়াদটা  তিনি কারাভোগ করেছেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে  তাকে যেকোনো দিন বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যেতে পারে বলে মত দেন আদালত।

সুখরঞ্জন বালীর ভারতে অবস্থানের বিষয়ে জানার পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের প্রতি অনুরোধ জানায় তাকে যেন বাংলাদেশে ফেরত না পাঠানো হয় কারণ তাতে তার জীবনের আশঙ্কা রয়েছে।

সুখরঞ্জন বালীকে সহায়তার জন্য এ পর্যায়ে বেশ কিছু মানবাধিকার সংস্থা এবং আইনজীবী এগিয়ে আসেন। সুখরঞ্জন বালীর কারাভোগের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আশঙ্কা তৈরি হয়। সেজন্য তিনি ভারতের সুপ্রীম কোর্টের দ্বারস্থ হন তার সাহায্যে এগিয়ে আসা আইনজীবীদের মাধ্যমে।  সুপ্রিম কোর্টে বালী অনুরোধ করেন তাকে যেন দেশে ফেরত পাঠানো না হয়। দেশে ফেরত পাঠালে তার জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে। ২০১৩ সালের ২রা আগস্ট শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট বালীকে দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি দুই সপ্তাহ স্থগিত করে আদেশ দেন।

এরপর কলকাতা হাইকোর্ট  ছয় আগস্ট এক আদেশে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ মেয়াদ শেষ হলে ২০ আগস্টের পর বালীকে দেশে পাঠানোর জন্য।
এ প্রেক্ষিতে বালী ১৩ আগস্ট ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবদন করেন এবং ১৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট  এক আদেশে বলেন তাকে দেশে ফেরত পাঠানো বা ভারতে রাখার বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা। সেই অবধি এখনো ভারতেই সরকারি হেফাজতে আছেন তিনি।

তবে বালীর জন্য অপেক্ষারত তার অসুস্থ স্ত্রী এবং সন্তানেরা চান বালী দেশে ফিরে আসুক এবং আগের মত যেন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন সে নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা হোক।




বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

ঘটনাবহুল আলোচিত একটি মামলা

 মেহেদী হাসান, ১৭/৯/২০১৪
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে আলোচিত মামলা  হিসেবে স্থান পেয়েছে  ১৯৭১ সালের  যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম।  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলা হয়েছে  তার মধ্যে নানা কারনে অন্যতম  আলোচিত এবং ঘটনাবহুল মামলায় পরিণত হয় মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা। ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে এ মামলার প্রতি মানুষের অধীর আগ্রহের মূলে সেটা গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় ছিলনা। ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীকে অপহরন করা, স্কাইপ কেলেঙ্কারি, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী গণেশ চন্দ্র  পক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়াসহ নানা কারনে বিশ্বজুড়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে এ মামলা। 

মামলার আসামী যেমন এ মামলায় মানুষের আকর্ষনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু তেমনি এ মামলার বিভিন্ন অভিযোগ এবং মামলাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত একের পর এক ঘটনা প্রবাহের  কারনেও এ মামলার খবরাখবর পাঠকের কাছে ছিল গভীর আগ্রহের বিষয়। ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ, ‘সাঈদী’ এবং ‘দেলু  শিকদার’ এসব বিষয়ও ছিল এ মামলার আলোচিত বিষয়।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ১৯৭১ সালের ৮ মে তার নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকজন পিরোজপুরের পাড়েরহাট বাজারের নিকটস্থ  চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এরপর সেখান থেকে ইব্রাহীম কুট্টি এবং মফিজউদ্দিন পসারীকে ধরে পাড়েরহাট বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা ওই বাড়িতে কাজ করত। পাড়েরহাট নেয়ার পর মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে । 
বিচার চলাকালে আসামী পক্ষ আদালতে জানান, ইব্রাহীম কট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই পিরোজপুরে একটি মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় তিনি পাকিস্তান আর্মিসহ মোট ১৪ জনকে আসামী করেছিলেন। আসামীর তালিকায়  আল্লামা সাঈদীর নাম নেই। ওই মামলার বিবরনে আরো বলা হয় ইব্রাহীম কুট্টিকে  ১৯৭১ সালে ১ অক্টোবর তার শশুরবাড়ি নলবুনিয়ায় হত্যা করা হয়। আসামী পক্ষ অভিযোগ করে মমতাজ বেগম এখনো জীবিত কিন্তু তাকে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হিসেবে হাজির করেনি।

মাওলানা সাঈদী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মোফাসসিরে কোরআন এবং সুললিত কণ্ঠস্বরের অধিকারী  হওয়ায় দেশে এবং বিদেশে অগণতি মানুষের নিয়মিত মনোযোগের বিষয়ে পরিণত হয়  এ মামলার কার্যক্রম ।
মাওলানা সাঈদীর বিচারে যখন সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় তখন এ বিষয়ক খবরের জন্য পাঠকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। জেরায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর মুখ থেকে আইনজীবী মিজানুল ইসলাম কি বের করে আনেন তা জানার জন্য পরের দিনের পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করেছেন অগণিত পাঠক। পিরোজপুরের বর্তমান এমপি একেএমএ আউয়াল মাওলানা সাঈদীর বিপক্ষে সাক্ষ্য দেন। মাওলান সাঈদীর পক্ষেও সাক্ষ্য দিয়েছেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তাছাড়া জেরায়  রাষ্ট্রপক্ষের বেশ কয়েকজন সাক্ষীর বিরুদ্ধে চুরি, জেল খাটাসহ আরো নানাবিধ তথ্য বের হয়ে আসে যা ছিল  পাঠকের কাছে বেশ  আকর্ষণীয়। 

ট্রাইব্যুনাল থেকে এ মামলার রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে দেড়শতাধিক মানুষ জীবন দেয়। সারা দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবাদে নেমে আসে রাজপথে।
বিচার চলাকালে  এবং বন্দী থাকা অবস্থায় মাওলানা সাঈদী প্রথমে তার মাকে হারান। এরপর  ২০১২ সালে  জুন মাসে বিচার চলাকালে  ট্রাইব্যুনালে বসে অসুস্থ হয়ে মুত্যৃর কোলে ঢলে পড়েন তার বড় ছেলে রাফিক বিন সাঈদী।

মামলা চলাকালে ২০১২ সালের  পাঁচ নভেম্বর মাওলানা সাঈদীর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন সুখরঞ্জন বালী। সেদিন তাকে ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরন করে নিয়ে যাওয়া হয়। বালী অপহরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাড়া ফেলে। কারণ সুখরঞ্জন বালী ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। তিনি পক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। আরো একটি কারনে বালী অপহরন ঘটনা মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে সেটি হল  তিনি ছিলেন বিশাবালীর আপন ভাই। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের  অভিযোগ ছিল তার নির্দেশে বিশাবালীকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়। সেই বিশাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালী এসেছিলেন মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে।
এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে ঢাকার দৈনিক নিউএজ পত্রিকায়  প্রকাশিত ডেভিড বার্গম্যানের  অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে  বলা হয় সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান  পাওয়া গেছে। তিনি ভারতের একটি কারাগারে বন্দী আছেন। বালী জানিয়েছেন তাকে আইনশঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরন করে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এরপর আবার নতুন করে শুরু হয় এ চাঞ্চল্যকর ঘটনা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। 

গণেশ চন্দ্র সাহা ছিলেন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আরেকজন সাক্ষী। কিন্তু গনেশ রাষ্ট্রপক্ষে  সাক্ষ্য না দিয়ে উল্টো মাওলানা সাঈদীর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন।  ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে একটি মর্মান্তিক হত্যাকান্ড হল ভাগিরথী হত্যাকান্ড। বিধবা ভাগীরথীকে পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্পে আটকে রেখে ইজ্জত হরন করে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য পাচারের অভিযোগে ভাগিরথীকে পাকিস্তান আর্মি গাড়ির পেছনে বেঁধে টেনে হিচড়ে হত্যা করে।  মাওলানা সাঈদীর সহায়তায় এই ভাগীরথীকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। সেই  ভাগিরথীর ছেলে হলেন সাক্ষী গনেশ চন্দ্র সাহা। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি কোর্টে এসে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে বললেন  মাওলানা সাঈদী তার মাকে মারেননি। পাকিস্তান আর্মিরাই তার মাকে মেরেছে।  এ ঘটনা তখন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। 

২০১২ সালের ছয় ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে এ মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ ঘোষনা করার কথা ছিল। সেদিন দেশ বিদেশের অসংখ্য সাংবাদিক হাজির হন ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু সেদিন ফাঁস হল স্কাইপ কেলেঙ্কারীর খবর।  ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নিজেই বিষয়টি ওপেন কোর্টে প্রকাশ করলেন সেদিন এ ঘটনা।  

বিচারপতি নিজামুল হক বলেন,   ব্রাসেলসে বসবাসরত আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে ট্রাইব্যুনালের  বিচার প্রকৃয়া চলাকালে এবং বিভিন্ন আদেশের  সময় সহায়তা নিয়েছেন তিনি। এ উপলক্ষে তাদের দুজনের মধ্যে স্কাইপের মাধ্যমে কথপোকথন হয়েছে। এ  তথ্য হ্যাক করে ইকনোমিস্ট হস্তগত করেছে বলে   উল্লেখ করেন তিনি ।
নয় ডিসেম্বর থেকে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে বিচারপতি নিজামুল হক ও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন।  এ নিয়ে দেশে বিদেশে তুমুল ঝড়  ওঠে।    বিচারপতি নিজামুল হকের কথোপোকথনের বিষয়বস্তু পড়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে গোটা জাতি। বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা একে  দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করেন। শুধু স্কাইপ সংলাপ নয় বিচারপতি নিজামুল হক এ বিচার বিষয়ে তার সাথে যেসব মেইল আদান প্রদান করেছেন তাও ফাঁস হয়ে যায়। বিচারের বিভিন্ন বিষয় বেলজিয়াম থেকে লিখে পাঠানোর ঘটনার চিত্র বের হয়ে পড়ে এতে । এ ঘটনার জের ধরে  ১১ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন তিনি।

২০১২ সালের ২০ মার্চ  রাষ্ট্রপক্ষ থেকে  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে   ৪৬ জন সাক্ষীর বিষয়ে একটি দরখাস্ত দাখিল করা হয়  ট্রাইব্যুনালে । দরখাস্তে নিবেদন করা হয়  ৪৬ জন সাক্ষীকে  ট্রাইব্যুনালে হাজির করা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। তাই এসব সাক্ষী  তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হোক।
সাক্ষী হাজির করতে না পারার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় কেউ নিখোঁজ, কেউ পলাতক, কেউ অসুস্থ, কেউবা চলে গেছে ভারতে।

ট্রাইব্যুনাল ২৯ মার্চ ১৫ জন সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী প্রদান করেন তা তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে আদেশ দেয়।

এরপর ৩রা জুন আসামী পক্ষ সেফহাউজের (ঢাকায় যেখানে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী  এনে রাখা হত)  বিশাল ডকুমেন্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়ে বলেন সাক্ষী হাজির করতে না পারা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যে কারণ দেখিয়েছে তা সম্পূর্ণ  মিথ্যা। সাক্ষীগন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ তাদেরকে আদালতে হাজির করেনি।   অনেক সাক্ষী তাদের হেফাজতেই ছিল এবং সেফহাউজের রেজিস্ট্রার বইয়ে  তার প্রমান রয়েছে।  কোন সাক্ষী কবে সেফহাউজে আসে, কতদিন থাকে,  কে কয়বেলা খেয়েছে তার সমস্ত তথ্য রেজিস্ট্রার বইয়ে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়।  আসামী পক্ষ রাষ্ট্রপক্ষের সেফহাউজ থেকে রেজিস্ট্রার খাতা সংগ্রহ করে ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।  অবশ্য রাষ্ট্রপক্ষ তাকে জাল হিসেবে আখ্যায়িত করে।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার একেবারে শুরুতে বিতর্ক শুরু হয় ট্রাইব্যুনালের তখনকার চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হককে নিয়ে।  বিচারপতি নিজামুল হক ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি  (ঘাদানিক)  গঠিত  জাতীয়  গণতদন্ত কমিশিনের সেক্রেটারিয়েট এর সদস্য ছিলেন।

এ তদন্ত কমিশন কারাবন্দী মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ  মোট ১৬ জনকে  যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে দুই দফা তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে ১৯৯৪ এবং ১৯৯৫ সালে। মাওলানা সাঈদীর আবেদনে  বলা হয় যিনি আগে থেকেই আসামীদের বিচারের সাথে জড়িত তার কাছ থেকে ন্যায় বিচার পওয়ার আশা করা যায়না। তাই তাকে সরে দাড়ানোর অনুরোধ করা হয়। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে ওয়াকআউট করার ঘটনাও ঘটে আসামী পক্ষের আইনজীবীদের।

মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

মাওলানা সাঈদীর আমত্যৃ জেল

মেহেদী হাসান, ১৭/৯/২০১৪
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনটি পৃথক অভিযোগে তাকে আমৃত্যু জেল, অপর  দুটি অভিযোগের একটিতে ১২ বছর এবং আরেকটিতে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাকান্ডে ১২ বছর জেল এবং বিশাবালী হত্যাকান্ডে আমৃত্যু জেল দেয়া হয়েছে। বিশাবালী হত্যার অভিযোগসহ আরো দুটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু কারান্দণ্ড  দেয়া হয়েছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ চূড়ান্ত এ রায় ঘোষনা করে আজ। 

রায়ে আসামী এবং রাষ্ট্রপক্ষ উভয়পক্ষের আবেদন আংশিকভাবে মঞ্জুর করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে মোট আটটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়। অপর ছয়টি অভিযোগে কোন সাজা  উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল।
আসামী পক্ষ মাওলানা সাঈদীকে বেকসুর খালাস এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছয়টি অভিযোগে সাজা উল্লেখের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করেছিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।

আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে আসামী পক্ষের আবেদন আংশিক গ্রহণ করে  মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে একটিতে আমত্যৃ জেল এবং আরেকটিতে ১২ বছর কারাদন্ড দেয়া হল।
অপরদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা উল্লেখ করা হয়নি এমন ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনও আংশিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। অপর তিনটি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২০টি অভিযোগ আনে। আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টির হত্যার অভিযোগ ছিল  আট নং অভিযোগ।  এ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মুত্যুদন্ড দেয়। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগে ১২ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। অপর দিকে বিশাবালীর অভিযোগটি ছিল ১০ নং অভিযোগ। এ অভিযোগেও ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল। আজকের রায়ে এ অভিযোগে আমৃত্য কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।

অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন গ্রহণ করে যে তিনটি অভিযোগে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল সাত, ১৬ এবং ১৯ নং অভিযোগ।
১৬ নং অভিযোগ হল  গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, আনু এবং কমলা নামে তিন বোনকে অপহরন করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগ। এ অভিযোগে  আপিল বিভাগের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্য জেল দেয়া হয়েছে। অপরদিকে  ১৯ নং অভিযোগ হল  মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরন। এ অভিযোগেও মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু জেলা দেয়া হয়েছে।
সাত নং অভিযোগ ছিল শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া। এ অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
সাত, ১৬ এবং ১৯ নং অভিযোগে ট্রাইবু্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও কোন সাজা উল্লেখ করেনি।  আপিল বিভাগর রায়ে  এ তিন অভিযোগের বিপরীতে সাজা  উল্লেখ করা হল।

এছাড়া আরো তিনটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও  সে তিনটি অভিযোগে আজকের  চূড়ান্ত রায়ে খালাস দেয়া হয়েছে।  এ অভিযোগ তিনটি হল  (৬) পাড়েরহাট বাজারে দোকানপাটে  লুটপাটে নেতৃত্ব প্রদান এবং অংশ নেয়া, (১১) মাহবুবুল আলম হাওলাদার বাড়িতে লুট এবং তার ভাইকে নির্যাতন  এবং (১৪)  ১৯৭১ সালে  হোগলাবুনিয়া এলাকায় হিন্দু পাড়ায় আক্রমন এবং শেফালী ঘরামী নামে একজন মহিলাকে রাজাকার কর্তৃক  ধর্ষনে সহায়তা এবং সেখানে উপস্থিত থাকা  ।

প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের  আপিল বেঞ্চ  সকালে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করে। সকাল ১০টা পাঁচ মিনিটের সময় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন। ১০টা সাত মিনিটের সময় সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষনা শুরু করেন। তিন মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায় রায় ঘোষনা। এসময় আদালত কক্ষে বিপুল সংখ্যক আইনজীবী এবং সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
গত ১৬ এপ্রিল আপিল বিভাগে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার  সমস্ত কার্যক্রম শেষে  রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়। ঠিক পাঁচ মাস শেষে  চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করা হল।

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে  মৃত্যুদন্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শুরু হয়। সাড়ে ছয় মাসেরও অধিক সময় পর আলোচিত এ মামলায় আপিল শুনানী শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয় গত  ১৬ এপ্রিল।

মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে  পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় তখন। বেঞ্চের  অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞ, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

ইবরাহীম কুট্টি ও বিশাবালী হত্যার অভিযোগ : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ বিষয়ে বলা হয়  ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা সাঈদীর  সাঈদীর নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি এবং শান্তি কমিটির লোকজন চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এরপর মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহীম কৃট্টি  এবং মফিজুল নামে দুজনকে  ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পাড়েরহাট বাজারে।  তারা ওই বাড়িতে কাজ করত। পাড়েরহাট বাজারে আনার পর  মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে।

১০ নং যে অভিযোগ বিষয়ে চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারে উল্লেখ করা হয়েছে   ১৯৭১ সালের ৬ জুন  সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর আগুন  দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়।

আপিল শুনানীর সময় আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে আসামী পক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করে জানায়  ইব্রাহিম কুট্টি ১৯৭১ সালে আট মে তার শশুরবাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছে। এ বিষয়ে তার স্ত্রী মমতকাজ বেগম ১৯৭২ সালে মামলা করে ১৩ জনকে আসামী করে তাতে মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। মমতাজ বেগম এখনো জীবিত আছেন।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন : ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের  ৬ ডিসেম্বর  মামলার সমস্ত  কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন ১১ ডিসেম্বর। এরপর মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি  উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি  উভয় পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে  সেদিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনার এক মাসের মাথায় নির্দিষ্ট করে তারিখ ঘোষনা করলেন ট্রাইব্যুনাল।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত  মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়।  ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্করির কারনে  পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি।

মানিক পসারী নামে এক লোক   পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে  ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট  মাওলানা  দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আরেকটি নালিশ দায়ের করেন পিরোজপুর নালিশী আদালতে।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে  মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার  ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবী করেন।  এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং  বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।

মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলের সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।
মাওলানা সাঈদী নিজ পিতার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ করার পর তিনি ১৯৬২ সালে মাদরাসা শিক্ষা শেষ করে গবেষণা কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৬৭ থেকে মাওলানা  সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে  মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর করেছেন।  তার ওয়াজ শুনে  অসংখ্য অনেক  হিন্দু  এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ওপর রচনা করেছেন অসংখ্য পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও  সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশে বিদেশে সর্বত্র।  দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগনিত ভক্ত অনুরাগী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের  আমন্ত্রনে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং  কোরআনের  তাফসির করেছেন।







মাওলানা সাঈদীর মামলায় চূড়ান্ত রায় কাল

মেহেদী হাসান, ১৬/৯/২০১৪
বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মোফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার  চূড়ান্ত রায় আগামীকাল ঘোষনা করা হবে। সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে আগামী কালের মামলার কার্যতালিকায় মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। 

আগামী কালের মামলার কার্যতালিকায় এক নং ক্রমিকে রয়েছে এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে একদিন আগেই  প্রকাশ করা হয়  পরবর্তী দিনের মামলার কার্যতালিকা।

গত ১৬ এপ্রিল আপিল বিভাগে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার  সমস্ত কার্যক্রম শেষে  রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়। প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ আপিল মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটাপাট, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরনসহ ২০টি অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে আটটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

মাওলানা সাঈদীর খালাস চেয়ে  ওই বছর ২৮ মার্চ আপিল বিভাগে আবেদন করে আসামি পক্ষ। যে ছয়টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে কিন্তু সাজা উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল  সেগুলোতে সাজা উল্লেখ করার দাবি জানিয়ে একই দিন রাষ্ট্রপক্ষও আপিল আবেদন করে।
ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শুরু হয়। সাড়ে ছয় মাসেরও অধিক সময় পর আলোচিত এ মামলায় আপিল শুনানী শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয় গত  ১৬ এপ্রিল।

মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে  পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল।  অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞ, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

মাওলানা সাঈদীকে দুটি হত্যার অভিযোগে মুত্যুদণ্ড  দেয় ট্রাইব্যুনাল-১।  এ দুটি অভিযোগ হল ইব্রাহীম কুট্টি  এবং বিশাবালী হত্যার ঘটনা। মাওলানা সাঈদীর উপস্থিতিতে, নির্দেশে এবং সহযোগিতায়  তাদের হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। এ অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় রায়ে।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মোট ২০টি অভিযোগে চার্জ গঠন হয়। এর মধ্যে আটটি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করেন ট্রাইব্যুনাল।  প্রমানিত আটটি অভিযোগের দুটি হত্যার অভিযোগ। দুটি  হত্যার অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির আদেশ দেয়ার কারনে বাকী ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হলেও তাতে কোন শাস্তির কথা উল্লেখ করেননি ট্রাইব্যুনাল। বাকী  যে ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ধর্মান্তরকরন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরন  প্রভৃতি।

১২টি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয় রায়ে। খালাস দেয়া অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের পিতা ফফজুর রহমানসহ পিরোজপুরের তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যার অভিযোগ, ভাগিরথী হত্যা এবং ভানুসাহাকে ধর্ষনের অভিযোগ।


যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যে ২০টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয় তার মধ্যে আট নং অভিযোগে বলা হয় ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা সাঈদীর  সাঈদীর নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি এবং শান্তি কমিটির লোকজন চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এখানে মানিক পসারীর বাড়িসহ ৫টি ঘর তারা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় লুটপাটের পর। মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহীম কৃট্টি  এবং মফিজুল নামে দুজনকে  ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরা দুজন  মানিক পসারীর বাড়িতে কাজ করত। মাওলানা সাঈদী এদের দুজনকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে পাড়েরহাট বাজারে নিয়ে যান  তার সাথে লোকজনের সহায়তায়। এরপর মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে। মফিজকে  আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের বেশ কয়েকজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। পালিয়ে আসা মফিজও সাক্ষ্য দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছেন  মফিজ এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী।  রায়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ  প্রমানিত হয়েছে উল্লেখ করে মাওলানা সাঈদীকে মুত্যৃ দণ্ড প্রদান করা হয়েছে।


অপর  ১০ নং যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে  সে বিষয়ে চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারে উল্লেখ করা হয়েছে   ১৯৭১ সালের ৬ জুন  সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর আগুন  দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়।


মুত্যৃদন্ডের অভিযোগ দুটি নিয়ে বিতর্ক : রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ এবং সাক্ষীরা বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টিকে ১৯৭১ সালের ৮ মে মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাড়েরহাট বাজারে মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অপর দিকে ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম বর্তমানে জীবিত। তিনি ১৯৭২ সালে তার স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে পিরোজপুরে একটি মামলা করেছিলেন । সে মামলায় তিনি উল্লেখ করেন ১৯৭১ সালে ১ অক্টোবর তার বাবার বাড়িতে থাকা অবস্থায়  শান্তি কমিটির লোকজন তার স্বামী ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা করে। এসময় তার মা সিতারা বেগম এবং ভাই সাহেব আলীকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাকে মাকে ছেড়ে দেয়া হলেও তার ভাই সাহেব আলীকে পিরোজপুরে হত্যা করে পাকিস্তান আর্মি। ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম  মামলায় ১৩ জনকে আসামী করেন।  আসামীর তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। মামলার সেই ডকুমেন্ট আসামী পক্ষ হাজির করেন ট্রাইব্যুনালে। এছাড়া মাওলানা সাঈদীর  পক্ষে বেশ কয়েকজন সাক্ষীও  সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টিকে নলবুনিয়া তার শশুর বাড়িতে থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়।  মাওলানা সাঈদী এর সাথে জড়িত ছিলনা।

মামলার আপিল শুনানীতেও আসামী পক্ষের আইনজীবীরা এ বিষয়ে তথ্য প্রমান তুলে ধরে যুক্তি উপস্থাপন করে।

এছাড়া বিশাবালী হত্যার ঘটনা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বিশাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালী ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে গত বছর ৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরনের শিকার হন।

অপর যে  ছয় অভিযোগ প্রমানিত : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে অপর যে ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল (অভিযোগ নং ৬) পাড়েরহাট বাজারে দোকানপাটে  লুটপাটে নেতৃত্ব প্রদান এবং অংশ নেয়া, (৭) শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া, (১১) মাহবুবুল আলম হাওলাদার বাড়িতে লুট এবং তার ভাইকে নির্যাতন (১৪)  ১৯৭১ সালে  হোগলাবুনিয়া এলাকায় হিন্দু পাড়ায় আক্রমন এবং শেফালী ঘরামী নামে একজন মহিলাকে রাজাকার কর্তৃক  ধর্ষনে সহায়তা এবং সেখানে উপস্থিত থাকা  (১৬) গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, আনু এবং কমলা নামে তিন বোনকে অপহরন করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়া এবং (১৯) মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরন। এসব অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে তবে শাস্তি প্রদান করা হয়নি।

খালাস ১২টি অভিযোগ : যে ১২টি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অভিযোগ হল  পিরোজপুরের পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান (হুমায়ূন আহমেদের পিতা), মেজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহামান  এবং এসডিও আব্দুর রাজ্জাককে হত্যার অভিযোগ। এছাড়া ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে নির্মম হত্যার শিকার ভাগিরথীকে হত্যা এবং  ভানু সাহাকে ধর্ষনের  অভিযোগ থেকেও খালাস দেয়া হয় মাওলানা সাঈদীকে। এছাড়া মাছিমপুর বাস স্ট্যান্ডের পেছনে, মাসিমপুর হিন্দুপাড়া এবং ধোপপাড়া এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সংখ্যাক হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেয়া, লুটপাট করা, হিন্দুদের  অনেক হিন্দুকে এক দড়িতে বেঁধে হত্যঅ করা, হত্যার উদ্দেশে হিন্দুদের  পাকিস্তান বাহিনীর হাতে তুলে দেয়াসহ মোট ১২টি অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ প্রমানিত হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।


মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের  ৬ ডিসেম্বর  মামলার সমস্ত  কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন। এরপর মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি  উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালের ১৩ ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি  উভয় পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে  সেদিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত  মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়।  ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্করির কারনে  পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি।

মানিক পসারী নামে এক লোক   পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক আদালতে   ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট  মাওলানা  দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুর নালিশী আদালতে একটি নালিশী দরখান্ত দাখিল করেন।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে  মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার  ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবী করেন।  এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং  বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

তদন্ত সংস্থা ১৪ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় এবং ৩/১০/২০১১ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে আদেশ দেয়া হয় ট্রাইব্যুনাল-১ এ।

এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২৮ জন সাক্ষী হাজির করে। এর মধ্যে ঘটনার সাক্ষী ছিল ২০ জন  । বাকীরা জব্দ তালিকার এবং একজন তদন্ত কর্মকর্তা। রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৬৮ জন ঘটনার সাক্ষীর তালিকা জমা দিয়েছিল ট্রাইব্যুনালে।   ৬৮ জনের মধ্য থেকে হাজির করা হয়নি এমন ১৬ জন সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
অপরদিকে আসামী পক্ষে মোট ২০ জন সাক্ষীর তালিকা নির্ধারন করে দেন ট্রাইবু্যুনাল এবং তার মধ্য থেকে ১৭ জন সাক্ষী হাজির করে আসামী পক্ষ।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে মামলায়  ট্রাইব্যুনালে যেসব আইনজীবী অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, মনজুর আহমেদ আনসারী, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন প্রমুথ।
অন্যদিকে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামালায় রাষ্ট্রপক্ষের নির্ধারিত আইনজীবী ছিলেন সৈয়দ  হায়দার আলী।

মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলের সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।
মাওলানা সাঈদী নিজ পিতার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ করার পর তিনি ১৯৬২ সালে মাদরাসা শিক্ষা শেষ করে গবেষণা কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৬৭ থেকে মাওলানা  সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে  মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর করেছেন।  তার ওয়াজ শুনে   অনেক  হিন্দু  এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ওপর রচনা করেছেন অসংখ্য পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও  সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশে বিদেশে সর্বত্র।  দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগনিত ভক্ত অনুরাগী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের  আমন্ত্রনে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং  কোরআনের  তাফসির করেছেন।

আপিল বিভাগে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে এ মামলায় শুনানী পেশ শুরু করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এরপর তার অনুপস্থিতিতে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান শুনানী পেশ এবং যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন। এছাড়া এ মামলার আপিল শুনানীর সময় বিভিন্ন পর্যায়ে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন অংশগ্রহণ করেছেন।
আসামী পক্ষে অন্যান্য আইনজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তাজুল ইসলাম, তারিকুল ইসলাম, মহিনুর ইসলাম, মতিয়ার রহমান, আবু বকর সিদ্দিক, মোসাদ্দেক বিল্লাহ।