বুধবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

কামারুজ্জামানের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

মেহেদী হাসান, ১৮/২/২০১৫
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন আপিল বিভাগ। আজ  দুপুরের পর রায়ের কপি প্রকাশ করা হয়।

রায় প্রকাশের দিন থেকে পরবর্তী  ১৫ দিনের মধ্যে আসামী পক্ষ এর বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনরায় বিবেচনা) আবেদন করার সুযোগ পাবেন।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালের  ৯ মে  মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন আসামী পক্ষ। আপিল শুনানী শেষে গত বছর ৩ নভেম্বর মুত্যদন্ড বহাল রেখে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রায় দেন আপিল বিভাগ। সে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি আজ  প্রকাশ করা হল।

বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র  (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মুহম্মদ কামারুজ্জামানের শুনানী গ্রহণ করেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি মো : আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচম শামসুিদ্দন চৌধুরী।

চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ  সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রেখে রায় দেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়।  গত ৩ নভেম্বরের রায়ে  আপিল বেঞ্চ এর মধ্যে একটি অভিযোগে ( ৩ নং অভিযোগ সোহাগপুর গণহত্যা)  তার মৃত্যুদণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বহাল রাখেন। মৃত্যুদন্ডের আরেকটি শাস্তি  বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মোট সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে  পাঁচটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা  দেয় ট্রাইব্যুনাল। ৩ এবং ৪ নং অভিযোগে  মৃত্যুদণ্ড, ১ এবং ৭ নং অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং ২ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
আপিল বিভাগের রায়ে ২ এবং ৭ নং অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত  সাজা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে বহাল রাখা হয়। ১ নং অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়।
আপিল বিভাগের রায়ে যে অভিযোগে মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়েছে সেটিতে মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে সর্বসম্মতভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং  মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে। আর মৃত্যুদন্ডের যে সাজা বাতিল করে যাবজ্জীবন করা হয়েছে সেটিতে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে।

গতকাল কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ডের যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে সেটি মোট ৫৭৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন ১৮৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যে রায় লিখেছেন তার সাথে একমত পোষন করেছেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। বিচারপতি এএইচএম শামসুিদ্দন চৌধুরীও  বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে সম্পূর্ণ একমত পোষন করেছেন। তবে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি বিষয়ে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার যে মূল্যায়ন তার সাথে তিনি ভিন্নমত পোষন করে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন তিনি।

অপরদিকে বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা চারটি অভিযোগের ক্ষেত্রে বেঞ্চের অপর তিন বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে ভিন্ন রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে তিনটি অভিযোগ থেকে তিনি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সম্পূর্ণ খালাস দিয়েছেন। একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন।


১ নং অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। আপিল বিভাগ এ অভিযোগ থেকে কামারুজাম্মানকে খালাস দিয়েছেন। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এ অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে যে রায় লিখেছেন সে বিষয়ে বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা সম্পূর্ণ একমত পোষন করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে তিনি নতুন করে কিছু লেখেননি। অপর যে চারটি অভিযোগের ক্ষেত্রে তিনি ভিন্নমত পোষন করে ভিন্ন রায় দিয়েছেন সেক্ষেত্রে তিনি তার ব্যাখ্যা এবং মূল্যায়ন  তুলে ধরেছেন।

সব মিলিয়ে  বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা মোট চারটি অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দিলেন। একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন।

৫৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে ১৮৮ থেকে ৪৫৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত রায় লিখেছেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা।


কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও রায় :

১ নম্বর অভিযোগ : বদিউজ্জামানকে অপহরন করে আহমেদনগর আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা। এ হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে সর্বসম্মতভাবে।

২ নম্বর অভিযোগ : শেরপর কলেজের অধ্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় উলঙ্গ করে শহরে প্রদণি করানো এবং পেটানো হয়।  এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগে এ সাজা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে বহাল রাখা হয়েছে।
বিচরপতি  আবদুল ওয়াহহাব মিঞা এ অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছেন আসামীকে।

৩ নম্বর অভিযোগ : ১৯৭১ সালে কামারুজ্জামানের পরামর্শে পাকিস্তান আর্মি দেশীয় রাজাকার এবং আলবদর সদস্যদের সাথে নিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে অভিযান চালায়। অভিযানে ওই গ্রামে দেড়শতাধিক মানুষ নিহত হয় এবং অসংখ্য নারী ধর্ষনের শিকার হয়। এ গণহত্যার অভিযোগে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ সাজা বহাল রেখেছে।
বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা এ অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন।

৪ নম্বর অভিযোগ : শেরপর মোস্তফাবাগ থেকে গোলাম মোস্তফাকে ধরে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। এরপর তাকে কামারুজ্জামানসহ অন্যান্যরা মিলে একটি ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে যাবজ্জীবন দিয়েছে।  
বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা এ অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েচেন।

৭ নম্বর অভিযোগ : মুক্তিযুদ্ধচলাকালে ময়মনসিংহ গোলাপজান রোডে টেপা মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে টেপা মিয়া এবং তার ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলাপরিষদ ডাকবাংলায় অবস্থিত আলবদর ক্যাম্পে আনা হয়। পরেরদিন সকালে তারা দুজনসহ সাতজনকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর তীরে আনা হয়। এসময় টেপা মিয়া নদীতে ঝাপ দিয়ে রক্ষা পায় এবং বাকীদের হত্যা করা হয়। এ অভিযোগের সাথে সংশ্লিষ্টতার  ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ।  আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে এ দণ্ড বহাল রাখা হয়।
বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছেন।

রিভিউ আবেদন
গত বছর ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ থেকে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্দে চূড়ান্ত রায় প্রকাশের পর পরই রিভিউ আবেদন এবং তার ফাঁসি কার্যকর নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ক্রামগতভাবে দাবি করা হয় কামারুজ্জামান রিভিউর সুযোগ পাবেননা। এমনকি আইনমন্ত্রী ফাঁসি কার্যকরের জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে প্রস্তুতির নির্দেশে দিয়েছেন বলেও জানান গণমাধ্যমে।
এ বিতর্ক চলা অবস্থায় ২৫ নভেম্বর আপিল বিভাগ আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। এতে বলা হয় আাপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ বা পুনরায় বিবেচনার জন্য  আবেদন করার সুযোগ পাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দন্ডিতরা।

রায়ে বলা হয়েছে রিভিউ আবেদন সমর্থনীয় (মেনটেনঅ্যাবল)। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবেনা।


কামারুজ্জামানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালে শেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি  জিকে স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এরপর জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে আইএসসি’তে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে নাসিরাবাদ কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন। কামারুজ্জামান গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা কিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাস করেন। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তিনি  সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি দৈনিক সংগ্রমের নির্বাহিী সম্পাদক ছিলেন। 

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছর ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।