মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

এটিএম আজহারের মৃত্যুদণ্ড

মেহেদী হাসান  ৩০.১২.১৪
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃতুদণ্ড দেয়া হয়েছে।   তিনটি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে মৃত্যুদণ্ড এবং অপর আরো দুটি অভিযোগে মোট ৩০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে  এটিএম আজহারকে।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ  এ রায় ঘোষণা করেন।  এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেয়া হয়েছে। অপর একটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে।

রায়ে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালে এটিএম আজহারুল ইসলাম রংপুর কারমাইকেল কলেজে এইচএসসি’র ছাত্র ছিলেন এবং রংপুর জেলা আলবদর কমান্ডার ছিলেন। সেই হিসেবে রংপুরে অঞ্চলে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগে তিনি নেত্বত্ব দেন তিনি।

পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে ২, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। ৫ নম্বর অভিযোগে ২৫ বছর ও ৬ নম্বর অভিযোগে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার সময় এটিএম আজহারুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে  উচ্চস্বরে বলেন এটা  ফরমায়েসি রায়, আমি স¤পূর্ণ নির্দোষ। আল্লাহর আদালতে আপনাদের একদিন বিচার হবে।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এর অপর দুই বিচারপতি হলেন বিচারপহি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। সকাল ১১টার দিকে এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে রায় পড়া শুরু হয় এবং পালাক্রমে এ তিনজন বিচারপতি রায় পড়ে শোনান।

দুই ট্রাইব্যুনাল মিলিয়ে এ পর্যন্ত মোট ১৫টি মামলার রায় দেয়া হল।

যে তিন অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড
এটিএম আজহারুল ইসলামকে হত্যা ও গণহত্যার তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। এই অভিযোগগুলো হল;
২ নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপড়ায় ১৫ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙ্গালীকে গুলি করে হত্যা।
৩ নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়–য়ার বিল এলাকায় ১২শ’র বেশী নিরীহ লোককে ধরে নিয়ে গণহত্যায় নেতৃত্ব দান। 
৪ নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপক পতœীকে ধরে দমদম ব্রীজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা।

দুই অভিযোগে ৩০ বছর কারাদণ্ড:
৫ নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর শহর ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মহিলাদের ধরে এনে টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরীক নির্যাতন। এসব ঘটনায় নেতৃত্বদানের অভিযোগে এটিএম আজহারকে দোষী সাব্যস্ত করে ২৫ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
৬ নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রংপুর শহরের গুপ্তাপাড়ায় একজনকে শারীরীকভাবে নির্যাতন করা হয়। এছাড়া ১ ডিসেম্বর রংপুর শহরের বেতপটি থেকে একজনকে অপহরণ। এই ঘটনায়ও এটিএম আজহারকে দোষী সাব্যস্ত করে ৫ বছর করাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
এছাড়া প্রমাণিত না হওয়ায় ১ নম্বর অভিযোগ ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সংঘটক ও বিশিষ্ট আইনজীবী মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে অপহরনের পর নির্যাতনের অভিযোগ থেকে আসামিকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।


সকাল ১১টা ১০ মিনিটে ট্রাইব্যুনাল রায় প্রদান শুরু করেন। প্রথমে ১৫৮ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পাঠ শুরু করেছেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক।

রায় প্রদানের শুরুতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বক্তব্য রাখেন।
তিনি বলেন, ফৌজদারি মামলায় সকল পক্ষকে খুশি করার সুযোগ নেই। উপস্থাপিত সাক্ষী, আইন ও  ঘটনর বিচার বিশ্লেষণ করার পর আমরা রায় প্রদান করি।
আমরা আশা করবো রায়ে যে পক্ষ অসন্তুষ্ট হবেন, তারা উচ্চ আপদালতে যাবেন। রায় পছন্দ না হলে সহিংস কর্মসূচি কাম্য নয়। এছাড়া এমন কোনো কর্মসূচি দেয়া উচিত নয়, যা বিচারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
তিনি বলেন, বাইরের কিছু মিডিয়া এমনভাবে রায়ের খবর উপস্থাপন করে যাতে বলা হয় এখানে  ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হচ্ছে। আমরা বিচার করছি ১৯৭১ সালে সংগঠিত অপরাধের। বিবৃতি দিয়ে বা সহিংস কর্মসূচি দিয়ে রায় পরিবর্তন করা যায় না। এজন্য আইনগতভাবেই অগ্রসর হতে হবে।
রায় ঘোষণার আগে আজ সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে এটিএম আজহারকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। 
সকালে দেশি বিদেশী গণমাধ্যমের শতাধিক সাংবাদিক ট্রাইব্যুনালে আসেন। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া ট্রাইব্যুনাল থেকে রায়ের খবর লাইভ প্রকার করে।

রায় উপলক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও এর আশেপাশের এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। হাইকোর্ট, কদম ফোয়ারা মোড় ও হাইকোর্ট মাজার গেটে বিপুল সংখ্যাক পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য মোতায়ন করা হয়। সকালে মাজার গেটদিয়ে সবাইকে তল্লাশি করে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের ভেতরেও বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। নগরীর সকল গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর এটিএম আজহারের মামলাটি বিচারিক কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে রায়ের জন্য অপেক্ষামান (সিএভি) ঘোষণা করা হয়।

এটিএম আজহারের পে ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট আবদুস সোবহান তরফদার, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট শিশির মনির, অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দিন, অ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন ও অ্যাডভোকেট মো: রায়হানুল ইসলাম।
রাষ্ট্রপে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ, জেয়াদ আল মালুম ও তাপস কান্তী বল।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর থেকে আজহারের বিরুদ্ধে স্যাগ্রহণ শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সর্বমোট ১৯ জন সাী সাক্ষ্য দেন। একই বছরের ১২ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যার, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের পৃথক ছয়টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়। 
রাষ্ট্রপক্ষের আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের ৬টি অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়।
২০১২ সালের ২২ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের আদেশে রাজধানীর মগবাজারস্থ নিজ বাসা থেকে এটিএম আজহারকে গ্রেফতার করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।

এটিম আজহারুল ইসলাম রংপুর বদরগঞ্জ উপজলোয় ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রংপুর  জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর  রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন।  ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৬৯-৭১ সালে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে এইচএসসির ছাত্র ছিলেন।
এটিএম আজহার ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরের অধিকারী এটিএম আজহারুল ইসলাম ১৯৯১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরীর আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে তিনি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন এবং মাঝখানে কিছুদিনের জন্য জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এর দায়িত্ব পালন করেন।
##