মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

এটিএম আজহারের মৃত্যুদণ্ড

মেহেদী হাসান  ৩০.১২.১৪
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃতুদণ্ড দেয়া হয়েছে।   তিনটি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে মৃত্যুদণ্ড এবং অপর আরো দুটি অভিযোগে মোট ৩০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে  এটিএম আজহারকে।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ  এ রায় ঘোষণা করেন।  এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেয়া হয়েছে। অপর একটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে।

রায়ে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালে এটিএম আজহারুল ইসলাম রংপুর কারমাইকেল কলেজে এইচএসসি’র ছাত্র ছিলেন এবং রংপুর জেলা আলবদর কমান্ডার ছিলেন। সেই হিসেবে রংপুরে অঞ্চলে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগে তিনি নেত্বত্ব দেন তিনি।

পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে ২, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। ৫ নম্বর অভিযোগে ২৫ বছর ও ৬ নম্বর অভিযোগে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার সময় এটিএম আজহারুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে  উচ্চস্বরে বলেন এটা  ফরমায়েসি রায়, আমি স¤পূর্ণ নির্দোষ। আল্লাহর আদালতে আপনাদের একদিন বিচার হবে।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এর অপর দুই বিচারপতি হলেন বিচারপহি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। সকাল ১১টার দিকে এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে রায় পড়া শুরু হয় এবং পালাক্রমে এ তিনজন বিচারপতি রায় পড়ে শোনান।

দুই ট্রাইব্যুনাল মিলিয়ে এ পর্যন্ত মোট ১৫টি মামলার রায় দেয়া হল।

যে তিন অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড
এটিএম আজহারুল ইসলামকে হত্যা ও গণহত্যার তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। এই অভিযোগগুলো হল;
২ নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপড়ায় ১৫ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙ্গালীকে গুলি করে হত্যা।
৩ নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়–য়ার বিল এলাকায় ১২শ’র বেশী নিরীহ লোককে ধরে নিয়ে গণহত্যায় নেতৃত্ব দান। 
৪ নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপক পতœীকে ধরে দমদম ব্রীজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা।

দুই অভিযোগে ৩০ বছর কারাদণ্ড:
৫ নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর শহর ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মহিলাদের ধরে এনে টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরীক নির্যাতন। এসব ঘটনায় নেতৃত্বদানের অভিযোগে এটিএম আজহারকে দোষী সাব্যস্ত করে ২৫ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
৬ নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রংপুর শহরের গুপ্তাপাড়ায় একজনকে শারীরীকভাবে নির্যাতন করা হয়। এছাড়া ১ ডিসেম্বর রংপুর শহরের বেতপটি থেকে একজনকে অপহরণ। এই ঘটনায়ও এটিএম আজহারকে দোষী সাব্যস্ত করে ৫ বছর করাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
এছাড়া প্রমাণিত না হওয়ায় ১ নম্বর অভিযোগ ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সংঘটক ও বিশিষ্ট আইনজীবী মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে অপহরনের পর নির্যাতনের অভিযোগ থেকে আসামিকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।


সকাল ১১টা ১০ মিনিটে ট্রাইব্যুনাল রায় প্রদান শুরু করেন। প্রথমে ১৫৮ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পাঠ শুরু করেছেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক।

রায় প্রদানের শুরুতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বক্তব্য রাখেন।
তিনি বলেন, ফৌজদারি মামলায় সকল পক্ষকে খুশি করার সুযোগ নেই। উপস্থাপিত সাক্ষী, আইন ও  ঘটনর বিচার বিশ্লেষণ করার পর আমরা রায় প্রদান করি।
আমরা আশা করবো রায়ে যে পক্ষ অসন্তুষ্ট হবেন, তারা উচ্চ আপদালতে যাবেন। রায় পছন্দ না হলে সহিংস কর্মসূচি কাম্য নয়। এছাড়া এমন কোনো কর্মসূচি দেয়া উচিত নয়, যা বিচারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
তিনি বলেন, বাইরের কিছু মিডিয়া এমনভাবে রায়ের খবর উপস্থাপন করে যাতে বলা হয় এখানে  ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হচ্ছে। আমরা বিচার করছি ১৯৭১ সালে সংগঠিত অপরাধের। বিবৃতি দিয়ে বা সহিংস কর্মসূচি দিয়ে রায় পরিবর্তন করা যায় না। এজন্য আইনগতভাবেই অগ্রসর হতে হবে।
রায় ঘোষণার আগে আজ সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে এটিএম আজহারকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। 
সকালে দেশি বিদেশী গণমাধ্যমের শতাধিক সাংবাদিক ট্রাইব্যুনালে আসেন। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া ট্রাইব্যুনাল থেকে রায়ের খবর লাইভ প্রকার করে।

রায় উপলক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও এর আশেপাশের এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। হাইকোর্ট, কদম ফোয়ারা মোড় ও হাইকোর্ট মাজার গেটে বিপুল সংখ্যাক পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য মোতায়ন করা হয়। সকালে মাজার গেটদিয়ে সবাইকে তল্লাশি করে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের ভেতরেও বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। নগরীর সকল গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর এটিএম আজহারের মামলাটি বিচারিক কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে রায়ের জন্য অপেক্ষামান (সিএভি) ঘোষণা করা হয়।

এটিএম আজহারের পে ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট আবদুস সোবহান তরফদার, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট শিশির মনির, অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দিন, অ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন ও অ্যাডভোকেট মো: রায়হানুল ইসলাম।
রাষ্ট্রপে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ, জেয়াদ আল মালুম ও তাপস কান্তী বল।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর থেকে আজহারের বিরুদ্ধে স্যাগ্রহণ শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সর্বমোট ১৯ জন সাী সাক্ষ্য দেন। একই বছরের ১২ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যার, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের পৃথক ছয়টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়। 
রাষ্ট্রপক্ষের আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের ৬টি অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়।
২০১২ সালের ২২ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের আদেশে রাজধানীর মগবাজারস্থ নিজ বাসা থেকে এটিএম আজহারকে গ্রেফতার করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।

এটিম আজহারুল ইসলাম রংপুর বদরগঞ্জ উপজলোয় ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রংপুর  জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর  রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন।  ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৬৯-৭১ সালে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে এইচএসসির ছাত্র ছিলেন।
এটিএম আজহার ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরের অধিকারী এটিএম আজহারুল ইসলাম ১৯৯১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরীর আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে তিনি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন এবং মাঝখানে কিছুদিনের জন্য জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এর দায়িত্ব পালন করেন।
##





মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৪

কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ :রিভিউ’র অধিকার পাবে দন্ডিতরা

 
মেহেদী হাসান, ২৫/১১/২০১৪
আাপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ বা পুনরায় বিবেচনার জন্য  আবেদন করার সুযোগ পাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দন্ডিতরা।

আপিল বিভাগ আজ  আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে। রায়ে বলা হয়েছে রিভিউ আবেদন সমর্থনীয় (মেনটেনঅ্যাবল)। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবেনা। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে হবে। রায়ে আরো বলা হয়েছে ১৯৭৩ সালের আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দন্ডিতদের ক্ষেত্রে জেলকোডের সাত অথবা ২১ দিনের নিয়ম প্রযোজ্য নয়। রায়ে বলা হয়েছে  মেরিট না থাকায় আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করা হয়েছে । 

আপিল বিভাগের এ রায়ের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হল যে, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ এবং রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তির আগে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কোন সুযোগ নেই। সেই সাথে তিনি রিভিউ আবেদন করতে পারবেন কি পারবেননা তা নিয়ে বিতর্কেরও অবসান হল।

যুদ্ধাপরাধ তথা ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পরবর্তীতে যদি আপিল বিভাগ কোন রায় দেন তাহলে সে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করার সুযোগ থাকছে।  তবে রিভিউ’র এ সুযোগ আপিলের সমান নয় বলে আজকের  রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাধারনত কোন মামলায় আপিল বিভাগ কর্তৃক পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের  ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ করতে হয়। তবে আজকের  রায়ে আপিল বিভাগ উল্লেখ করেছেন ১৯৭৩ সালের আইনে দন্ডিতদের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য নয়। এ ক্ষেত্রে ৩০ দিনের পরিবর্তে ১৫ দিন কমিয়ে আনা হয়েছে। 

গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন। পাঁচ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। আট ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল থেকে মৃত্যুপরোয়ানা পাঠানো হয়। ১০ ডিসেম্বর সরকার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগ নেয়। রাত ১২টা এক মিনিটে ফাঁসি কার্যকরের সমস্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়। এর  প্রেক্ষিতে রাতেই আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে সিনিয়র আইনজীবীরা ছুটে যান চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর বাসায়। সেখানে তারা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত করা বিষয়ে এবং রিভিউ আবেদন জমা দেন। চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন রাত সাড়ে দশটায় আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর স্থগিত করে আদেশ দেন। পরের দিন ১১ ডিসেম্বর সকালে প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের  আপিল বেঞ্চে শুনানী শুরু হয়  রিভিউ আবেদন এবং মৃত্যুদণ্ড স্থগিত আদেশ এর মেয়াদ বাড়ানো বিষয়ক আবেদনের ওপর। ওইদিন শুনানী অসমাপ্ত অবস্থায় আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়। ১২ ডিসেম্বরও চলে শুনানী। শুনানী শেষে আদালত আব্দুল কাদের মোল্লার  রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। ওই দিন রাতেই কার্যকর করা হয় ফাঁসি।

পাঁচ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরপরই  তুমুল  বিতর্ক শুরু হয় আব্দুল কাদের মোল্লা রিভিউ করার সুযোগ পাবেন কি পাবেননা তা নিয়ে। আসামী পক্ষ দাবি করেন তিনি রিভিউ সুযোগ পাবেন। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অন্যান্যরা দাবি করেন তিনি এ সুযোগ পাবেননা। বিতর্কের এ পর্যায়ে এক পক্ষ মত দেন বিষয়টি এখন আপিল বিভাগই নিষ্পত্তি করতে পারে। এভাবে বিতর্ক নিষ্পত্তি হবার আগেই সরকার ১০ ডিসেম্বর ফাঁসি কার্যকরের ঘোষনা দেয়। আসামী পক্ষ অপেক্ষায় ছিল  ৩০ দিনের মাথায় তারা রিভিউ আবেদন করবে । কিন্তু ১০ তারিখ সরকার ফাঁসি কর্যকরের উদ্যোগ নেয়ায় তারা বাধ্য হয়ে ছুটে যান চেম্বার বিচারপতির কাছে এবং ওই রাতেই তারা রিভিউ আবেদন দায়ের করে। ১২ ডিসেম্বর আদালত রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। কিন্তু কোন গ্রাউন্ডে এটি খারিজ করা হয় সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত রায়ে তখন কোন কিছু উল্লেখ ছিলনা। রিভিউ আবেদন কি মেনটেন্যাবল নয় না কি এর কোন মেরিট নেই সে গ্রাউন্ডে খারিজ করা হয়েছে আবেদন তার কোন কিছু বলা হয়নি। গতকাল পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে আবেদনে মেরিট না থাকায় আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করা হয়েছে। তবে রিভিউ আবেদন মেনটেনঅ্যাবল।

গত ৩ নভেম্বর মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগ রায় ঘোষনা করেন। রায় ঘোষনার পর আবারো শুরু হয় রিভিউ নিয়ে বিতর্ক তুমুল। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বারবার স্পষ্ট করে বলেন, কামারুজ্জামান রিভিউ করার সুযোগ পাবেননা। ফাঁসি কার্যকরের জন্য পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষারও দরকার নেই। সংক্ষিপ্ত রায়ের কপি দিয়েই দণ্ড কার্যকর করা যাবে। কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও সাংবাদিকদের বলেন, কামারুজ্জামান প্রাণ ভিক্ষার জন্য সাত দিন সময় পাবেন। এরপরই তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। ফাঁসি কার্যকর করার জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে প্রস্তুতির নিদের্শ দেয়ার কথাও জানান তিনি।
অপর দিকে আসামী পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হয় কামারজ্জামান রিভিউ করার সুযোগ পাবেন এবং পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে দণ্ড কার্যকরের কোন সুযোগ নেই। এটা হবে বেআইনী । ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুরি জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে তার নির্দেশনাকেও আইন এবং কর্তৃত্ব বহির্ভূত হিসেবে আখ্যায়িত করেন আসামী পক্ষের আইনজীবী শিশির মনির। বির্তকের এক পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল তার অবস্থান থেকে সরে এসে শেষে বলেন রিভিউ করার সুযোগ পাবেন কি পাবেননা এ বিষয়টি আপিল বিভাগের ওপর নির্ভর করছে।
এ অবস্থায় আজ আপিল বিভাগ এ রায় প্রকাশ করলেন। আর এর মাধ্যমে রিভিউ এবং কামারুজ্জামানের ফাঁসি কবে কার্যকর হবে এ নিয়ে বিতর্কের অবসান হল।
আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন শুনানী গ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী।
মুহম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষে অ্যাডভোকেট শিশির মনির দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, মৃত্যু পরোয়ানা জারির পর ২১ দিনের আগে নয় এবং ২৮ দিনের পরে নয় এমন যেকোন সময় ফাঁসি কার্যকর করার বিধান। এর মধ্যে সাত দিন সময় থাকে প্রাণভিক্ষার আবেদনের জন্য। যেহেতু ১৯৭৩ সালের আইনে দন্ডিতদের ক্ষেত্রে জেলকোডের সাত অথবা ২১ দিনের বিষয়টি প্রযোজ্য নয় বলে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে তার মানে এটা এখন সরকারের হাতে। মৃত্যুপরোয়ানা জরির পর সরকার যখন চাইবে তখন ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে।
গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।  এ রায়কে কেন্দ্র করে  শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠে । আন্দোলনকারীদের দাবি আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে হবে। এ  দাবির প্রেক্ষিতে  ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়  সরকার পক্ষের জন্য আপিলের বিধান রেখে।  আইন সংশোধনের পর সরকার আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে আপিল আবেদন করে।  ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন  সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ডের রায় দেন।

১৯৭৩ সালের আইনে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা বলা আছে কিন্তু  রিভিউর কথা বলা নেই। অপরদিকে বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৫ ধারায় আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে নাগরিককে রিভিউ করার অধিকারের কথা বর্ণিত হয়েছে।

সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৪

মোবারক মৃত্যুদণ্ড

মেহেদী হাসান ২৪.১১.১৪
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং আরেকটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ  মোবারকের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের এ রায় ঘোষনা করেন।

১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা ও নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল মোবারকের বিরুদ্ধে। তিনটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। 

মোবারকের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগের মধ্যে ১নং অভিযোগ হল- আখাউড়া থানার টানমান্দাইল ও জাঙ্গাইল গ্রামে ৩৩ জনকে হত্যা এবং ৩নং অভিযোগ হল- ছাতিয়ান গ্রামের আবদুল খালেককে হত্যা। ট্রাইব্যুনালের রায়ে এই দুই অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের ২, ৪ ও ৫ নং অভিযোগ তিনটি প্রমাণিত না হওয়ায় এ অভিযোগগুলো থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ২নং অভিযোগ হল- আনন্দময়ী কালীবাড়ী রাজাকার ক্যাম্পে আশুরঞ্জন দেবকে নির্যাতন। ৪ নং অভিযোগ হল- শ্যামপুর গ্রামের দু’জনকে অপহরণ করে একজনকে হত্যা এবং ৫নং অভিযোগ হল- খরমপুর গ্রামের একজনকে আটক রেখে নির্যাতন।

যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড: ’৭১ সালের ২২ আগস্ট মোবারক হোসেনসহ অন্য রাজাকাররা আখাউড়ার টানমান্দাইল গ্রামে হাজি নূর বকশের বাড়িতে সভা ডাকেন। ওই বাড়িতে ১৩০ বা ১৩২ জন গ্রামবাসীকে জড়ো করা হয়। মোবারক ও তার সহযোগীরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামবাসীদের আটক করে গঙ্গাসাগর দীঘির কাছে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখেন। আটক ব্যক্তিদের মোবারক ও তার সহযোগীরা জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করেন। এছাড়া তিনি টানমান্দাইল গ্রামের ২৬ জন ও জাঙ্গাইল গ্রামের সাতজনসহ ৩৩ জনকে বাছাই করে তেরোঝুড়ি হাজতখানায় নিয়ে যান। ২৩ আগস্ট পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা ওই ৩৩ জনকে দিয়ে গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে গুলি করে হত্যা করে একটি গর্তে মাটি চাপা দেয়। এ অপরাধের দায়ে মোবারককে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

যে অভিযোগে যাবজ্জীবন: মোবারকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে তৃতীয় অভিযোগ হল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাতিয়ান গ্রামের আবদুল খালেক মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। ’৭১ সালের ১১ নভেম্বর রাত ৮টা বা ৯টার দিকে মোবারক সশস্ত্র রাজাকার সহযোগীদের নিয়ে খালেককে অপহরণ করে সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করেন। ওই রাতে খালেককে তিতাস নদীর পশ্চিম পাড়ে বাকাইল ঘাটে নিয়ে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। এই অভিযোগে মোবারককে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

মোবারকের বিরুদ্ধে মোট ৯২ পৃষ্ঠা রায়ে মূল অংশ আদালতে পড়ে শোনানো হয়। মোবারক ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় বসে রায় শোনেন। এর আগে সকাল ৯টায় তাকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। ট্রাইব্যুনালে মোবারকের দুই ছেলে আসাদুল্লাহ ও নজিবুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।  

ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর এ মামলার প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, দুই অভিযোগে একটিতে মোবারকে মৃত্যুদণ্ড এবং একটিতে যাবজ্জীবন কারা দণ্ড প্রদান করেছেন। এজন্য আমরা সন্তুষ্ট। যে তিনটি অভিযোগ থেকে মোবারককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তা আমরা পর্যালোচনা করব। মোবারকের বয়স সম্পার্কে তিনি বলেন, আসামীপক্ষ বলছে মোবারকের জন্ম ১ জুলাই ১৯৫৬ সালে। তারা বলতে চাইছে তিনি ঘটনার সময় নাবালোক ছিলেন। আমরা ভোটার লিস্ট ও অন্যান্য ডকুমেন্ট দিয়ে দেখিয়েছি মোবারকের জন্ম ১০ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে। আদালত এটি গ্রহণ করেছেন।

অন্যদিকে আসামীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ মোবারকের বিষয়ে যে সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করেছে তাতে কোনভাবেই আসামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায় না। এই মামলার সাক্ষ্য প্রমাণে যে নানা রকম বৈপরিত্য ও অসংগতি রয়েছে তা আমরা ট্রাইব্যুনালে দেখিয়েছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযুদ্ধের উপর যেসব বই রয়েছে তাতে এই পাঁচটি ঘটনার কথা উল্লেখ থকলেও একটি ঘটনায়ও মোবারকের নাম আসেনি। তিনি বলেন, আমরা তথ্য প্রমাণ দেখিয়ে বলেছি মোবারকের জন্ম তারিখ ১ জুলাই ১৯৫৬। এই হিসেবে ’৭১ সালে আসামীর বয়স ছিল ১৪ বা ১৫ বছর। তিনি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন এবং নাবালোক ছিলেন। তিনি আরো বলেন, রায়ের পর আমি মোবারক হোসেনের সাথে কথা বলেছি। তিনি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন দ্বায়ের করবেন। আসাকরি আপিলে আমরা ন্যায় বিচার পাব। 
এর আগে গত ২ জুন মোবারক হোসেনের মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষামান (সিএভি) রাখা হয়। রোববার মামলাটি ট্রাইব্যুনালের কার্যতালিকায় আসে এবং সোমবার আদালত রায় দেবেন বলে ঘোষণা দেন।
গত বছর ২০ মে মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের স্যাগ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন সাী মোবারকের বিরুদ্ধে স্যা দিয়েছে।
গত বছরের ১২ মার্চ মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
রাষ্ট্রক্ষর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ’৭১ সালের একটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে ২০০৯ সালের ৩ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মোবারকের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। তখন তিনি হাইকোর্ট থেকে অন্তবর্তীকালীন জামিন নেন। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর তার মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

মোবারক হোসেন ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার আখাউড়া থানার নয়াদিল গ্রামের সাদত আলীর ছেলে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করতেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তবে মোবারক হোসেনের ট্রাইব্যুনালে দাবি করেছিলেন তিনি কখনোই জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। পূর্ব থেকেই তিনি আওয়ামী লীগ করতেন।
আখাউড়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে হাজী মোবারক হোসেন আখাউড়া মোগড়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন ।

হাজী মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার চিফ জুড়িশিয়াল মেজিস্ট্রেট এর কাছে অভিযোগ করেন খোদেজা বেগম নামে জনৈক মহিলা। অভিযোগ মতে  খোদেজা বেগমের পিতা   আব্দুল খালেক ছিলেন আনছার কমান্ডার ।   যুদ্ধের সময় তার পিতা গ্রামে আসার পর  তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যা ঘটনায় হাজী মোবারককে অভিযুক্ত করে খোদেজা বেগম মামলা করেন।

মামলা দায়েরের পর হাজী মোবারক হোসেন হাইকোর্টে  হাজির হয়ে প্রথমে ছয় মাসের জামিন পান। এরপর কয়েকবার জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৪ জুলাই তাকে সংশ্লিষ্ট মেজিস্ট্রেট এর কাছে আত্মসমর্পনের নির্দেশ দিলে তিনি  ঐ বছর ১৯ অক্টেবার   আত্মসমপর্ন করেন।  সেই থেকে তিনি বন্দী  ছিলেন। বন্দী থাকা অবস্থায় ২০১২ সালে তার মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই থেকে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। একই বছর ১৬ জুলাই তিনি  ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে জামিনে মুক্তি পান। সেই থেকে তিনি গত ১২ মার্চ পযন্ত মুক্ত ছিলেন। ১২ মার্চ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। 


বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৪

নগরকান্দা মেয়র খোকনের মৃত্যুদণ্ড


 মেহেদী হাসান, ১৩/১১/২০১৪
ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র জাহিদ হোসেন খোকনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ছয়টি অভিযোগে তাকে এ দণ্ড দেয়।  এছাড়া অপর চারটি অভিযোগে খোকনকে মোট ৪০ বছর কারাদণ্ড দেয়া  হয়েছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ  তার বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষনা করে।

বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে জাহিদ হোসেন খোকন পালাতক রয়েছেন। তার অনুপস্থিতিতেই বিচার সম্পন্ন করে ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করেন। খোকনের অনুপস্থিতে বিচারের জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে তার পক্ষে আবদুস শুকুর খানকে আইনজীবী নিয়োগ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র জাহিদ হাসান খোকন পৌর বিএনপির সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন।

ট্রাইব্যুনালে  জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে  ১০টি অভিযোগে দোষীসাব্যস্ত করে সাজা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া একটি অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় ওই অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।  

খোকনকে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরন, লুটপাট, হিন্দুদের দেশ থেকে জোর করে নির্বাসনে পাঠানো ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগের পৃথক ছয়টি অপরাধের ঘটনায় তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া একটি অভিযোগে ২০ বছর, একটিতে ১০ বছর এবং অপর দুটি অভিযোগে পৃথকভাবে ৫ বছর-৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।

সকাল ১১টা থেকে আদালত রায় প্রদান শুরু করেন। মোট ১০৯ পৃষ্ঠার রায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ট্রাইব্যুনাল পাঠ করেন।   
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, আসামি রায় ঘোষণার পর থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল আবেদন করতে পারবেন। যদি এ সময়ের মধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারে অথবা তিনি যদি আত্মসমর্পন বরেন তাহলে তিনি আপিলের সুযোগ পাবেন ।  এছাড়া যে দিন খোকন গ্রেফতার হবেন, সেই দিন থেকে রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া যাবে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

খোকনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগগুলো হল, ’৭১ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুলাই তারিখের মধ্যে ফরিদপুরের নগরকান্দায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, দেশত্যাগে বাধ্যকরা, অগ্নিসংযোগ নির্যাতনসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠন করেন। এর মধ্যে ১৬ জন নারী ও শিশুসহ ৫০ জন গ্রামবাসীকে হত্যা, তিনজনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, ২ জনকে ধর্ষণ, ১৭ জনকে আটক রেখে নির্যাতন, ৯ জনকে ধর্মান্তরিত করা, ২টি মন্দিরসহ ১০টি গ্রামের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, সাতজন গ্রামবাসীকে সপরিবারে দেশান্তরে বাধ্য করা ও ২৫ জনকে নির্যাতন।
জাহিদ হোসেন খোকনের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল বলেন,  এ মামলায় বেশিরভাগ ভিকটিম পরিবার সাক্ষ্য দিয়েছে। ’৭১ সালে জাহিদ হোসেন খোকন যে অপরাধ করেছেন, তা আজ রায়ের মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছে। এ রায়ে ভিকটিমের পরিবারের সাথে আমরাও সন্তুষ্ট।

অপর প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, আসামী অপরাধী না হলে পালাতক থাকতেন না। তার পলাতক থাকায় প্রমাণ হয় তিনি উল্লেখিত অপরাধ করেছেন। তিনি আরো বলেন, আসামী যে দিন গ্রেফতার হবে সেই দিন থেকে রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া যাবে।
অন্যদিকে খোকনের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস সুকুর খান রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ রায়ে আমি আমি খুশি নই। কারণ আসামী ন্যায় বিচার পাননি। ’৭১ সালে জাহিদ হোসেন খোকন আনসার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তিনি বলেন, এখন আসামীর উচিত আত্মসমর্পন করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল আবেদন করা। তাহলে আসামী ন্যায় বিচার পাবেন। সুকুর খান আরো বলেন, এ মামলায় আসামীর পরিবার থেকে কোনো সহায়তা পাননি। নিরাপত্তার কারণে আসামী পক্ষে সাক্ষ্য দেয়া সম্ভব হয়নি। আসামী পক্ষে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিলে এ মামলার রায় অন্যরকম হতে পারতো।

মামলার বিবরণ:
গত বছর ১৮ জুলাই জাহিদ হোসেন খোকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের ১১টি অভিযোগে খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়।
পালাতক জাহিদ হোসেন খোকনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই দুটি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে তাকে হাজির করতে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে দৈনিক জনকণ্ঠ ও ডেইলি স্টারে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু তিনি হাজির না হওয়ায়  ওই বছরের ১৪ আগস্ট তার অনুপস্থিতিতেই বিচার  শুরু করা নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে খোকনের পে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী আবদুস শুকুর খানকে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ২৩ জুন খোকনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দখিল করা হয়।
২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর খোকনের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তার মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর থেকে গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন দাশসহ খোকনের বিরুদ্ধে মোট ২৪ জন সাী সাক্ষ্য প্রদান করেন। 
গত ১৩ এপ্রিল থেকে খোকনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এরপর খোকনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আইনজীবী আবদুস শুকুর খান।
গত ১৭ এপ্রিল জাহিদ হোসেন খোকনের বিচার  কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে রায়ের জন্য অপেক্ষামান রাখা হয়।

সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৪

কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল// আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়

মেহেদী হাসান  ০৩/১১/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামানের  মৃত্যুদণ্ড বহালা রাখা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ  সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রাখেন।

বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ আজ মুহম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। আজ আপিল বেঞ্চ এর মধ্যে একটি অভিযোগে ( ৩ নং অভিযোগ সোহাগপুর গণহত্যা)  তার মৃত্যুদণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বহাল রাখেন। মৃত্যুদন্ডের আরেকটি শাস্তি  বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া  হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মোট সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে  পাঁচটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা  দেয় ট্রাইব্যুনাল। ৩ এবং ৪ নং অভিযোগে  মৃত্যুদণ্ড, ১ এবং ৭ নং অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং ২ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
আজ আপিল বিভাগের রায়ে ২ এবং ৭ নং অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত  সাজা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে বহাল রাখা হয়। ১ নং অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়।
আপিল বিভাগের রায়ে যে অভিযোগে মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়েছে সেটিতে মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে সর্বসম্মতভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং  মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে। আর মৃত্যুদন্ডের যে সাজা বাতিল করে যাবজ্জীবন করা হয়েছে সেটিতে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে।

গত বছর ৯ মে ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়  ট্রাইব্যুনাল-২।

মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আপিল করে আসামী পক্ষ।  গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শেষে রায় ঘোষনা অপেক্ষমান রাখা হয়।

গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর  জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ মৃত্যুদন্ডের চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করেন।
আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় গত বছর ৫ ডিসেম্বর । পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রিভিউ আবেদন করা যাবে কি যাবেনা এ নিয়ে বিতর্ক চলা অবস্থায় ১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত ১২টার পর ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নেয়া হয় এবং সরকার ও জেল কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষনাও দেয়া হয়। ওই দিনই  রাত সোয়া দশটায় সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর পরের দিন বুধবার সকাল দশটা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। ১২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পর রাতে কার্যকর করা হয় আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও রায় :
রাষ্ট্রপক্ষের আনিত অভিযোগে এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ে মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক এবং তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ হিসেবে শেরপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, আলবদর এবং রাজাকার বাহিনী কর্তৃক স্বাধীনতাপন্থী লোকজনকে হত্যা, নির্যাতন, অপহরন গুম, ধর্ষনসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় আনা হয়েছে কামারুজ্জামানের ওপর।  শেরপুরে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের  মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড তার পরামর্শ এবং  সহযোতিায়  পরিচালিত হত বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়।

মুহম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনিত সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে সাজা দেয়। এ পাঁচটি অভিযোগ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল বিভাগের সাজা এখানে উল্লেখ করা হল।

১ নম্বর অভিযোগ : বদিউজ্জামানকে অপহরন করে আহমেদনগর আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা। এ হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে।

২ নম্বর অভিযোগ : শেরপর কলেজের অধ্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় উলঙ্গ করে শহরে প্রদণি করানো এবং পেটানো হয়।  এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগে এ সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
৩ নম্বর অভিযোগ : ১৯৭১ সালে কামারুজ্জামানের পরামর্শে পাকিস্তান আর্মি দেশীয় রাজাকার এবং আলবদর সদস্যদের সাথে নিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে অভিযান চালায়। অভিযানে ওই গ্রামে দেড়শতাধিক মানুষ নিহত হয় এবং অসংখ্য নারী ধর্ষনের শিকার হয়। এ গণহত্যার অভিযোগে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ সাজা বহাল রেখেছে।
৪ নম্বর অভিযোগ : শেরপর মোস্তফবাগ থেকে গোলাম মোস্তফাকে ধরে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। এরপর তাকে কামারুজ্জামানসহ অন্যান্যরা মিলে একটি ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে যাবজ্জীবন দিয়েছে।  
৭ নম্বর অভিযোগ : মুক্তিযুদ্ধচলাকালে ময়মনসিংহ গোলাপজান রোডে টেপা মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে টেপা মিয়া এবং তার ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলাপরিষদ ডাকবাংলায় অবস্থিত আলবদর ক্যাম্পে আনা হয়। পরেরদিন সকালে তারা দুজনসহ সাতজনকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর তীরে আনা হয়। এসময় টেপা মিয়া নদীতে ঝাপ দিয়ে রক্ষা পায় এবং বাকীদের হত্যা করা হয়। এ অভিযোগের সাথে সংশ্লিষ্টতার  ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ।  আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে এ দণ্ড বহাল রাখা হয়।




মুহম্বদ কামারুজ্জামানের আপিল শুনানীর জন্য বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের আপিল বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক ও বিচারপতি এএইচএম শাসসুদ্দীন চৌধুরী।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছর ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

কামারুজ্জামানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালে শেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি  জিকে স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এরপর জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে আইএসসি’তে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে নাসিরাবাদ কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন। কামারুজ্জামান গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা কিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাস করেন। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তিনি  সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি দৈনিক সংগ্রমের নির্বাহিী সম্পাদক ছিলেন। 



রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৪

মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড



 মেহেদী হাসান ০২/১১/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ একটি অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে সর্বসম্মতভাবে ও আরেকটি অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।

এছাড়া অপর আরো আটটি অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মোট ১৪টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে দুটিতে মৃত্যুদণ্ডসহ মোট ১০টি অভিযোগে তাকে সাজা দেয়া হয়েছে। অপর চারটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়। 

যে আটটি অভিযোগে তাকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে একটিতে ২০ বছর, একটিতে ১০ বছর এবং বাকী ছয়টির প্রত্যেকটিতে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। একটির পর একটি এ সাজা ভোগ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২  আজ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষনা করেন।

যে কারনে সাজা : রায়ে বলা হয়েছে মীর কাসেম আলী ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন এবং পরে একই কলেজে বিএসসি (সম্মান) ভর্তি হন। এসময় তিনি ১৯৭০ থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ মেয়াদে কলেজে তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর  তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারন সম্পাদক হন । রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আনা অভিযোগের বরাত দিয়ে  বলা হয় স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়  মীর কাসেম আলী রাজাকার বাহিনী, আলী আলবদর এবং আলশামসের কেন্দ্রীয় কমান্ডারদের একজন ছিলেন। চট্ট্রগ্রামে সংঘটিত  বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।  তার নেতৃত্বে, পরিকল্পনায় এবং নির্দেশে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় অবস্থিত মহামায়া বা ডালিম হোটেলে মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাপন্থী লোকজনকে অপহরন করে এনে নির্যাতন, হত্যা এবং গুম করা হয়। এক পর্যায়ে ডালিম হোটেলটি আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প এবং  নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতাপন্থী লোকজনের ওপর ধারাবাহিকভাবে নির্যাতন চালানো হয়। মীর কাসেম আলীর জ্ঞাতসারে  এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ডালিম হোটেলে সংঘটিত হয়েছে। তার নেতৃত্বে এসব অপরাধ পরিচালিত হয়েছে। তিনি ছিলেন এসব ক্ষেত্রে চালকের আসনে। আলবদর কমান্ডার হিসেবে এ বাহিনীর  সদস্যদের ওপর তার কার্যকরী নিয়ন্ত্রন ছিল। তাই উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায় হিসেবে এসব অপরাধের জন্য দায়ী মীর কাসেম আলী।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২ অভিযোগ : মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১১ এবং ১২ নং অভিযোগ ছিল নির্যাতন এবং হত্যার অভিযোগ। এ দুটি অভিযোগেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

১১ নং অভিযোগে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালে নভেম্বর মাসের কোন এক দিন মীর কাসেম আলীর পরিকল্পনায়  জসিম উদ্দিন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ঈদুল ফিতরের পর দিন অপহরন করে আলবদর ক্যাম্প ডালিম হোটেলে নিয়ে আসা হয়। মীর কাসেম আলীর নির্দেশে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাকে  নির্যতন করে হত্যা করে। পরে জসিমসহ আরো পাঁচজনের লাশ কর্নফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়ে। জসিমের সাথে অপর নিহত যে  পাঁচজনের লাশ নদীতে ফেলা হয় তারাও ডালিম হোটেলে বদর বাহিনীর নির্যাতনে নিহত হয়।
এ অভিযোগে মীল কাসেম আলীকে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সর্বসম্মতভাবে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।

১২ নং অভিযোগে বলা হয় মীর কাসেম আলীল পরিকল্পনা এবং নির্দেশে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের কোন একদিন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, টন্টু সেন ও রঞ্জিত দাসকে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসা হয়। জাহাঙ্গীর আলম পরে ছাড়া পেলেও টুন্টু সেন ও রঞ্জিত দাস নির্যাতনে নিহত হয়। পরে তাদের লাশ গুম করা হয়। এ অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সংখ্যাগরিষ্ঠের (২:১) ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়। 


নজিরবিহীন নিরাপত্তা : রায় ঘোষনা উপলক্ষে গতকাল ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। বিপুল সংখ্যক র‌্যাব, আর্মড পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য নিয়োজিত করা হয়। পাস নিয়ে যেসব সাংবাদিক, আইনজীবী এবং দর্শনার্থী ট্রাইব্যুনাল কক্ষে প্রবেশ করেন তাদের দেহ কঠোরভাবে তল্লাসী করা হয়। এর আগে দুই ট্রাইব্যুনাল মিলিয়ে আরো দশটি রায় ঘোষনা করা হয়েছে। তার কোনটিতেই নিরাপত্তা নিয়ে এত কড়াকড়ি লক্ষ্য করা যায়নি। গতকালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মত।
তাছাড়া আজকের  রায় ঘোষনার সাথে অতীতের রায় ঘোষনার ধরনের মধ্যে  কিছু ভিন্নতা লক্ষ্যনীয় ছিল। যেমন অতীতের সবগুলো রায় বেশ সময় নিয়ে ট্রাইব্যুনালে পড়ে শোনানো হয়েছে। আজ ৪০ মিনিটের মধ্যেই শেষ করা হয় রায় ঘোষনা। অতীতে তিনজন বিচারপতি পর্যায়ক্রমে রায় পড়ে শুনিয়েছেন। আজ  শুধুমাত্র চেয়ারম্যান (ট্রাইব্যুনাল-২) বিচারপতি ওবায়দুল হাসান রায় পড়ে শোনান। এসময়  ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মুজিবুর রহমান ও বিচারপতি শাহীনূর ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষনা উপলক্ষে মীর কাসেম আলীকৈ ১০টা ৪৩ মিনিটের সময় কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। এর অল্প  কিছুক্ষন পর  কোর্ট বসে। ট্রাইব্যুনাল কক্ষে আনার পর মীর কাসেম আলীকে সবাইকে উচ্চস্বরে সালাম দেন। রায় ঘোষনার পর মীর কাসেম আলী কাঠগড়ায় দাড়িয়ে বলেন, এটা একটা ফরমায়েসী রায়। সত্যের বিজয় হবে শীঘ্রই। এরপর তাকে আবার ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে দুপুরের খাবার গ্রহণ শেষে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত যে ১১টি রায় ঘোষনা করা হয়েছে তার অধিকাংশই জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে।

সাজাপ্রাপ্ত অপর আট অভিযোগ : মীর কাসেম আলীকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও অপর আটটি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। তবে এ সাজা একটির পর একটি ভোগ করতে হবেনা। আটটির মধ্যে যে অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজা  দেয়া হয়েছে সেটা ভোগ করলেই বাকীগুলো ওই সাজাভোগের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া আটটি অভিযোগ নিম্নে উল্লেখ করা হয়।
২ নং অভিযোগ : আসামীর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর চাকতাই থেকে লুৎফর রহমান ফারুককে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয় এবং বাড়িঘরে আগুন দেয়া  হয়। এ অভিযোগে ২০ বছর সাজা দেয়া হয়েছে।
৩ নং অভিযোগ : ২২ অথবা ২৩ নভেম্বর আসামীর নেতৃত্বে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে তার কদমতলা বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা দেয়া হয়েছে।
৪ নং    অভিযোগ :  ডাবলমুরিং থানায় সাইফুদ্দিন খানকে তার নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে আল বদর বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
৬ নং অভিযোগ : চট্টগ্রাম শহরের একটি চায়ের দোকান থেকে হারুনুর রশিদ নামে একজনকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেল এবং সালমা মঞ্জিলে নির্যাতন করা হয়। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
৭ নং অভিযোগ : মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে সাত/আট জন যুবক ডাবলমুরিং থানা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরী,  হাবিবুর রহমান, ইলিয়াসকে  ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়।  এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
৯ নং অভিযোগ : ২৯ নভেম্বর সৈয়দ মো : এমরান হোসেন, কামাল উদ্দিন, জামালউদ্দিন, সরওয়ার উদ্দিন,  গোলাম কিবরিয়া, গোলাম রহমান এ   ছয় জনকে অপহরন ও নির্যাতন। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
১০ নং অভিযোগ : আসামীর নির্দেশে মো : যাকারিয়া, এসকèাদার আলম, চারজনকে অপহরন ও নির্যাতন। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
১৪ নং অভিযোগ ধ  নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরন ও নির্যাতন  । এ অভিযোগে ১০ বছর সাজা দেয়া হয়েছে মীর কাসেম আলীকে।

খালাস পাওয়া চার অভিযোগ : মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আনীত ১৪ টি অভিযোগ থেকে চারটিতে খালাস দেয়া হয়েছে । এগুলো হল
 ১ নং অভিযোগ  : মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর ওমরুল ইসলাম চৌধুরীকে  চাকতাই ঘাট থেকে অপহরন রা হয়। এরপর তাকে কয়েক দফায় চট্টগ্রামের আন্দর কিল্লাস্থ ডালিম হোটেল, পাচলাইশ থানার সালমা মঞ্জিল এবং একটি চামড়ার গুদামে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
৫ নং অভিযোগ : ২৫ নভেম্বর আনোয়ারা থানার আব্দুল জব্বারকে  তার নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে মীর কাসেম আলীর সামনে হাজির করা হয় । এরপর তাকে নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়া হয়।
৮ নং অভিযোগ : ২৯ নভেম্বর রাতে নুরুল কুদ্দুস, মো : নাসির, নুরুল হোসেনসহ চারজনকে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন।
১৩ নং     অভিযোগ : সুনীল কান্তিকে অপহরন ও নির্যাতন।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
গত চার মে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায় ঘোষনা অপেক্ষমান রাখা হয়। ২০১২ সালের   ১৭ জুন মীর কাসেম আলীকে  ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১  এর নির্দেশে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।

গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন  করে। এরপর এ মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় আসামী পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার মীর আহমাদ, আসাদ উদ্দিন, আবু বকর সিদ্দিক, হাসানুল বান্না প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, সুলতান মাহমুদ সিমন ও তুরিন আফরোজ।

মীর কাসেম আলীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
মীর কাসেম আলী ১৯৫২ সালে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার চাকরির সুবাদে তিনি ১৯৬৫ সাল থেকে  চট্টগ্রামে বসবাস করেন এবং ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করেন।

রাজনীতির অঙ্গন ছাড়াও একজন সংগঠক এবং  উদ্যোক্তা হিসেবে  ব্যাংকিং, চিকিৎসা, শিক্ষা, পুনর্বাসন, আবাসন, গণমাধ্যম, পর্যটন পরিবহন খাতসহ  আর্থ  সামাজিক বিভিন্ন  ক্ষেত্রে মীর কাসেম আলীর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রয়েছে। 







বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৪

নিজামীর মৃত্যুদণ্ড

মেহেদী হাসান, ২৯/১০/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। চারটি অভিযোগের প্রতিটিতে মৃত্যুদণ্ড এবং অপর আরো চারটি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে মাওলানা নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১  আজ  তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের এ রায় ঘোষনা করেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যা, গনহত্যা, হত্যা,  ধর্ষণ ও মানবতাবিরোধী  অপরাধের নির্দেষদাতা, পরিকল্পনা,  ষড়যন্ত্র এবং  উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায়ে (সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি) মাওলানা নিজামীকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে মাওলানা নিজামী তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘ এবং আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। আলবদর বাহিনী একটি অপরাধী সংগঠন এবং এ বাহিনী কর্তৃক বুুদ্ধিজীবী হত্যায়  মাওলানা নিজামীর নৈতিক সমর্থন ছিল। ইসলামী ছাত্রসংঘ এবং     বদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে এসব সংগঠনের সদস্যদের ওপর তার নিয়ন্ত্রন ছিল। কাজেই উর্দ্ধতন নেতা হিসেবে মানবতাবিরোধী এসব  অপরাধের দায় তিনি এড়াতে পারেননা।  

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে মোট ১৬টি অভিযোগে চার্জ গঠন হয়েছিল। এর মধ্যে আটটি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। অপর আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে।

২০১২ সালের ২৮ মে বিচার শুরুর পর আড়াই বছরের মাথায় ট্রাইব্যুনালের অন্যতম আলোচিত এ মামলার রায় দেয়া হল। রায় ঘোষনা উপলক্ষে দেশী বিদেশী বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক, আইনজীবী, এবং বিভিন্ন শ্রেনিপেশার লোকজন  জড়ো হন ট্রাইব্যুনালে। সকাল ১১টা পাঁচ মিনিটের সময় জনাকীর্ণ ট্রাইব্যুনলে রায় ঘোষনা শুরু হয়। রায় প্রদান উপলক্ষে সুপ্রীম কোর্ট এলাকা এবং ট্রাইব্যুালের আশপাশে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়।

মৃত্যুদন্ডের চার অভিযোগ :
মাওলানা নিজামীকে ২, ৪, ৬ এবং ১৬ নং অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
দুই  নং অভিযোগে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালের  ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের  রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা অংশগ্রহণ করে। মাওলানা নিজামী সেখানে বক্তব্য রাখেন। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে  বাউশগাড়ি এবং রূপসী  গ্রামে পাকিস্তান আর্মি অভিযান চালিয়ে প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষ হত্যা ৪০ জনের মত নারী ধর্ষণ করা হয়। এ গনহত্যা বিষয়ে ষড়যন্ত্র এবং পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়েছে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে।

চতুর্থ অভিযোগ হল হত্যা ধর্ষণ এবং দেশান্তরকরন বিষয়ক। এতে বলা হয়েছে পাবনার করমজা গ্রামে মাওলানা  নিজামীর নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় হাবিবুর রহমান নামে একজনকে হত্যা করা হয়। ৮ মে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী করমজা গ্রাম ঘিরে ফেলে  মেঘা ঠাকুর, ষষ্ঠি হালদার, শান্তি হালদার, ফকির চাঁদসহ ৯ জন হিন্দুকে  হত্যা, মেঘা ঠাকুরের মেয়ে এবং আরেক ব্যক্তির স্ত্রীকে ধর্ষণ এবং বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়। মাওলানা নিজামীর র্নিদেশে রাজকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মানবতাবিরোধী এ অপরাধ করেছে। 

ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, মাওলানা  নিজামীর নির্দেশে ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে  মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে অভিযান চালায় রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা। এসময় ২৬ জন নিরস্ত্র নারী পুরুষকে হত্যা করা হয়।

১৬ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী । তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান  হিসেবে  মাওলানা নিজামী এ  গণহত্যার দায় এড়াতে পারেননা এবং এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। 

যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত চার অভিযোগ :
যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত চারটি অভিযোগ হল ১, ৩, ৭ এবং ৮।
১ নং অভিযোগে বলা হয়েছে  ১৯৭১ সালের ৪ জুন পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে পাকিস্তানী সেনারা অপহরন করে । মাওলানা নিজামীর উপস্থিতিতে ১০ জুন ইছামতি নদীর পাড়ে কছিমউদ্দিনসহ আরো দুইজনকে হত্যা করা হয়।

তৃতীয় অভিযোগে হল হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন এবং ষড়যন্ত্র বিষয়ক। এতে বলা হয়েছে  ১৯৭১ সালের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। মাওলানা নিজামী ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন।

সপ্তম অভিযোগে বলা হয়েছে, ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে নিজামীর তথ্যমতে পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম  ঘিরে ফেলে সোহরাব আলীকে আটক করে তার স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে হত্যা করে। এ ঘটনায় মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে নির্যাতন  এবং হত্যার দায় আনা হয়েছে। 

অষ্টম অভিযোগে বলা হয়েছে, ৩০ আগস্ট মাওলানা নিজামী নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে সেখানে আটক রুমী, বদি ও জয়েল  হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা  দেন।


মাওলানা নিজামীকে মন্ত্রী বানানো লজ্জার :
রায় ঘোষনার সময় রায়ের পর্যবেক্ষনে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন মাওলানা নিজামীকে তৎকালীন সরকারের সময় মন্ত্রী করা হয়েছিল। এটা ছিল একটা ভুল এবং দেশের জন্য লজ্জা ও কলঙ্কের। মুক্তিযুদ্দে ৩০ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছেন। মাওলানা নিজামী মনে প্রানে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন। জাময়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রসংঘ এবং আলবদর বাহিনীর সদস্যরা স্বাধীনতাযুদ্ধকালে হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যতান করেছে মানুষের ওপর। তারা কখনো মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি উচ্চারন করেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের তারা দুষ্কৃতকারী বলেছে। পাকিস্তানকে আল্লাহর ঘর বলেছে। হিন্দুদের মুসলমানদের এবং পাকিস্তানের শত্রু আখ্যায়িত করেছে। ইসলামের নামে তারা ভয়ঙ্কর সব অপরাধ করেছে। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার করেছে ১৯৭১ সালে।

উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায় :
রায় ঘোষনার সময় মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায় বা সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি বিষয়ে তুলে ধরেন  ট্রাইব্যুনাল। এসময় রায় থেকে ‘১৯৭১ সালে মাওলানা নিজামীর অবস্থান এবং ভূমিকা’ শীর্ষক অধ্যায় পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনাল। এতে ট্রাইব্যুনাল বলেন, মাওলানা নিজামী তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘ এবং আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। তিনি ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান ছিলেন। আলবদর বাহিনী একটি ক্রিমিনাল সংগঠন। ইসলামী ছাত্রসংঘ, আলবদর এবং জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা হত্যা, ধর্ষণ নির্যাতন সংঘটিত করেছে। মাওলানা নিজামী আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে এ বাহিনীর কর্মকান্ডের দায় এড়াতে পারেননা। ১৯৭১ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘ এবং বদরবাহিনীর প্রধান হিসেবে মাওলানা নিজামী উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায়ে অভিযুক্ত এবং এটা শাস্তিযোগ্য।  আলবদর বাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী  হত্যা বিষয়ে মাওলানা নিজামীর নৈতিক সমর্থন এবং উসকানি ছিল। ছাত্রসংঘ এবং বদরবাহিনীর হাইকমান্ড হিসেবে এ বাহিনীর সদস্যদের ওপর, অধীনস্ততের ওপর মাওলানা নিজামীর কার্যকরী নিয়ন্ত্রন ছিল। কাজেই এদের অপরাধের দায় তিনি এড়াতে পারেননা। অধীনস্তদের ওপর নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা হিসেবে ১৬ নং অভিযোগ যথা বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা তিনি ঠেকাতে পারতেনা কিন্তু প্রতিরোধ করেননি। একইভাবে মোহাম্মদপুরে ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে গড়ে তোলা নির্যাতন কেন্দ্রে তার সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত  অপরাধও তিনিি প্রতিরোধ করেননি। কাজেই তিনি উর্দ্ধতন নেতত্বের দায়ে দোষী ।

ট্রাইব্যুনালের এ পর্যবেক্ষন বিষয়ে মাওলানা নিজামীর পক্ষে আইনজীবী তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব ছিল  ১৯৭১ সালে মাওলানা নিজামী কোন অপরাধের সাথে জড়িত ছিল কি-না তার বিচার করা। কিন্তু মাওলানা নিজামীকে মন্ত্রী হওয়া বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল যে মন্তব্য করেছেন তার মাধ্যমে তারা তাদের ক্ষমতা এবং এখতিয়ারের বাইরে বিচরন করেছেন। মাওলানা নিজামী জনগনের ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। কাজেই তার মন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল যে মন্তব্য করলেন তার মাধ্যমে আসলে জনগনের রায়কে অস্বীকার করলেন। এর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের আবেগতাড়িত হওয়ার প্রমান মিলেছে এবং এ কারনে এ রায় বাতিল হওয়া উচিত ।

অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, ট্রাইব্যুনালই তার রায়ে বলেছেন, মাওলানা নিজামী ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। কাজেই ডিসেম্বর মাসে সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় তার ওপর আসে কিভাবে।
চেয়ারম্যান বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষনা করেন। অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
রায় ঘোষনার শুরুতে চেয়ারম্যান বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, রায় ঘোষনার বিলম্ব নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন কথা উঠেছে। । সেসবের জবাব দেয়ার সুযোগ আমাদের নেই। কারণ আমরা রাস্তায় গিয়ে কথা বলতে পারিনা। তিনি বলেন, আমাদের ওপর কারো নির্দেশ নেই। আমরা সংবিধান এবং আইনের নির্দেশ মেনে কাজ করি। তিনি বলেন, এর আগে এ ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রদত্ত তিনটি রায় দেয়া হয়েছে এবং  সংক্ষিপ্ত  রায় পড়ে শোনানো হয়েছে। মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে রায়টি ২০৪ পৃষ্ঠার। সংক্ষিপ্ত রায় তৈরি করা হয়নি। আমরা এখানে আমাদের পর্যবেক্ষন, অভিযোগ এবং রায় অংশ পড়ে শোনাব।
এরপর তিনজন বিচারপতি পালাক্রমে রায় থেকে পড়ে শোনান।

খালাস পাওয়া আট অভিযোগ :
খালাস পাওয়া আটটি অভিযোগ হল উসকানি বিষয়ক। এগুলো হল ১১, ১২, ১৩ এবং ১৪ নং অভিযোগ। এসব অভিযোগে বলা হয়েছে মাওলানা নিজামী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে ইসলামী ছাত্রসংঘ, রাজাকার এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী লোকজনকে নানাভাবে উসকানি এবং প্ররোচনা দিয়েছেন স্বাধীনতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে।
 এছাড়া খালাস পাওয়া অপর চারটি অভিযোগ হল ৫,  ৯, ১০, এবং ১৫ নং অভিযোগ।
 ৫ নং অভিযোগ তথা ঈশ্বরদী হত্যাকান্ড বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ কোন সাক্ষী হাজির করেনি।
নবম অভিযোগ হল  বৃশালিখা গ্রামে  ৭০ জনকে হত্যা ও ৭২টি ঘরে অগ্নিসংযোগ, দশম অভিযোগ হল মুক্তিযোদ্ধা অনিলের বাড়িতে আগুন দেয়া, ১৫ নং অভিযোগ হল পাবনার সাথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে গিয়ে মাওলানা নিজামী কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ষড়যন্ত্র করা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা করার অভিযোগ।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন:
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ সংক্রান্ত  মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে জাতীয় প্রেসকাবের সামনে থেকে গ্রেফতার  করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, গনহত্যা, অগ্নিসংযোগ, স্বাধীনতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডের জন্য উসকানি, পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র  এবং বৃদ্ধিজীবী হত্যাসহ মোট  ১৬টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয় ২০১২ সালের ২৮ মে। 

গত বছর ১৩ নভেম্বর এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুাল। কিন্তু রায় ঘোষনার আগে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বদল হওয়ায় পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন করা হয় এবং গত ২৪ মার্চ দ্বিতীয় দফায় মামলার  রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়।

গত ২৪ জুন মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষনার জন্য ধার্য্য করা হয়েছিল। মাওলানা নিজামী অসুস্থ থাকায়  তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে না পারায় ওইদিন রায় ঘোষনা থেকে বিরত থাকে ট্রাইব্যুনাল।

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৬৭ জন সাক্ষীর তালিকা দেয়। এখান থেকে ২৬ জনকে হাজির করে তারা। অপরদিকে আসামী পক্ষ ১০ হাজার ১১১ জন সাক্ষীর তালিকা দেয়। আসামী পক্ষে চারজন সাক্ষী  নির্ধারন করে দেয় ট্রাইব্যুনাল এবং তারা চারজন সাক্ষী হাজির করে।

মাওলানা নিজামীর পক্ষে এ মামলায় আইনজীবী হিসেবে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেম মনজুর আহমদ আনসারী, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, অ্যাডভোকেট তারিকুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দিন প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর হায়দার আলী, প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী,  প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন এ মামলায়।






শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪

অধ্যাপক আযমের জানাজা কাল // বাসায় হাজারো মানুষের ভিড়

মেহেদী হাসান  ২৪/১০/২০১৪
কাল জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে অধ্যাপক গোলাম আযমের জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। জোহরের নামাজের পর জানাজা হবে। অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী জানাজা নামাজের ইমামতি করবেন।
জানাজা শেষে বড়মগবাজার কাজী অফিস লেনের পারিবারিক গোরস্তানে তাকে দাফন করা হবে। আজ সন্ধ্যার পর আব্দুল্লাহিল আমান আযমী এ ঘোষনা দেন।   জানিয়েছেন।

আমান আযমী বলেন, তিনি ছাড়া তার অপর পাঁচভাই সপরিবারে বিদেশে বাস করেন। তাছাড়া তাদের আরো অনেক আত্মীয় স্বজন রয়েছে। তার আব্বার অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী আছেন দেশে বিদেশে। তারা সবাই আব্বার জানাজা এবং দাফনে অংশ নিতে চেয়েছেন। সেজন্য জানাজা এবং দাফনের জন্য অপেক্ষা করা হয়। কিন্তু তার ভাইয়েরা স্বল্প সময়ের নোটিশে ভিসা সংগ্রহ করে দেশে আসতে পারছেননা। তাই আর অপেক্ষা না করে আজ জানাজার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ।

নিজ বাসায় গোলাম আযম
অধ্যাপক গোলাম আযম নিজ বাসায় ফিরলেন। তবে লাশ হয়ে। পৌনে তিনবছর প্রিজন সেলে বন্দী থাকার পর আজ সকাল সাতটা ৫০ মিনিটে তার লাশ  বড়মগবাজারের কাজী অফিস লেনের নিজ বাসায় আনা হয়।

গত বৃহষ্পতিবার রাত ১০টা ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল  করেন অধ্যাপক গোলাম আযম। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি অধ্যাপক গোলাম আযমকে গ্রেফতার করা হয়।  গ্রেফতারের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত  নব্বয়োর্ধ অসুস্থ অধ্যাপক গোলাম আযমকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের প্রিজন সেলেই বন্দী ছিলেন। 

রাত দুইটা ৪৫ মিনিটের সময় অধ্যাপক গোলাম আযমের লাশ বিএসএমএমইউ থেকে পোস্ট মর্টেমের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পোস্ট মর্টেম সম্পন্ন করার পর সকাল সাতটা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে লাশ হস্তান্তর করা হয় অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর কাছে। এরপর সাতটা ৫০ মিনিটে তার লাশ বাসায় এসে পৌছে।
বাসায় আনার পর সর্বপ্রথম অধ্যাপক গোলাম আযমের লাশ গোসল করানো হয়। গোসল শেষে সকাল পৌনে ১১টায় তার লাশ বাসার সামনে নেয়া হয় এবং সেখানে বিপুল সংখ্যক ভক্ত অনুসারী তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ভ্রাম্যমান মরচুয়ারিতে করে ২০ মিনিটের মত বাড়ির সামনে রাখা হয় লাশ । এরপর লাশ আবার ভবনের নিচে নিয়ে যাওয়া হয়।

হাজারো মানুষের ভিড়
অধ্যাপক গোলাম আযমের লাশ নিজ বাসায় আনার পর বিশ্ববরেণ্য এ রাজনীতিবিদের প্রতি  শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করে হাজারো মানুষ।
তাকে শেষবারের মত দেখা এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সারাদিন অগনতি মানুষ ভিড় জমাতে থাকে কাজি অফিস লেনের বাসভবনের সামনে। জুমার নামাজের পর আবার তার লাশ বাসার সামনে আনা হয় ।  এসময় পুরো কাজী অফিস লেন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় তাকে শেষবারের মত দেখার জন্য। হাজার হাজার মানুষ দীর্ঘ সময় লাইনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করেন তাকে দেখার জন্য। জুমার নামাজের পর অধ্যাপক গোলাম আযমের জন্য মুনাজাত করেন বাড়ি সংলগ্ন মসজিদের খতিব। এসময় সেখানে আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। অনেকের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। এরপর ৯২ বছর বয়সে অসুস্থ অবস্থায় দীর্ঘ বন্দী জীবন এবং বন্দীত্ব অবস্থায় মৃত্যুর পর লাশ হয়ে বাসার ফেরার প্রসঙ্গ তুলে ধরে একজন বক্তব্য রাখার পর অনেকে হুহু করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
এরপর সারাদিনব্যাপী চলতে থাকে অগনিত মানুষের ভিড়।
নির্বাহী পরিষদ সদস্য ডা. আব্দুল্লাহ মো : তাহের, সাবেক এমপি হামিদুর রহমান  আযাদ. কর্মপরিষদ সদস্য ডা. অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, কর্মপরিষদ সদস্য ডা. রেদোয়ান উল্লাহ শাহেদী, ঢাকা মহানগর সেক্রেটারি মনজুরুল ইসলাম ভুইয়া, সেলিম উদ্দিন, ড. রেজাউল করিম, লেবার পার্টির সভাপতি ডা. মোস্তাফিজুর রহমান, জাগপা মহাসচিব খন্দকার লুৎফর রহমানসহ বিপুলসংখ্যক রাজনীতিবিদ নেতাকর্মী অধ্যাপক গোলাম আযমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আসেন।
আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বাসার সামনে উপস্থিত থেকে সাংবাদিকদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন।

পোষ্টমর্টেম :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান  মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রাত ২টায় অধ্যাপক গোলাম আযমের সুরতহাল প্রস্তুত করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তারেক হাসান। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন শাহবাগ থানার এসআই ফেরদৌস আলম।
পরে রাত  ৩টার দিকে এম্বুলেন্সে করে গোলাম আযমের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে সকাল পৌনে ৬টার দিকে অধ্যাপক গোলাম আযমের লাশ পোষ্টমর্টেম কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল সোয়া ৬টার দিকে লাশের পোষ্টমর্টেম শুরু হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: শফিউজ্জামান খায়ের এবং প্রভাষক ডা: প্রদীপ বিশ্বাসের নেতৃত্বে পোষ্টমর্টেম সম্পন্ন হয়। প্রায় ৩০ মিনিটে পোষ্টমর্টেম সম্পন্ন হয়।
মর্গ সূত্র জানায়, পোষ্টমর্টেমের সময় অধ্যাপক গোলাম আযমের লাং, হার্ট ও পাকস্থলির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে প্যাথলজি পরীক্ষার জন্য।
পোষ্টমর্টেম শেষে ৭-৪০ মিনিটে অধ্যাপক গোলাম আযমের লাশ হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের কাছে। সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী পিতার লাশ গ্রহণ করেন। এসময় কারাগারের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কারারক্ষি মো: জাকারিয়া ।
এদিকে অধ্যাপক গোলাম আযমের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নেয়ার পর সেখানে আত্মীয়-স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা ভিড় করেন। সকাল হলে ভিড় আরো বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে সেখানে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। 



মৃত্যুর ঘোষনা
গ্রেফতারের পর থেকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। গত দুই সেপ্টম্বর থেকে  ৯২ বছর বয়সী অধ্যাপক গোলাম আযমের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। এরপর থেকে তাকে বেশ কয়েকবার সিসিইউ, আইসিইউতে নেয়া হয়। গত বৃহষ্পতিবার অধ্যাপক গোলাম আযমের রক্তচাপ একেবারেই কমে যায় সকালে এক পর্যায়ে তার রক্তচাপ ৬০/৪০ এ নেমে আসে এবং সহজে কারো ডাকে সাড়া দিচ্ছিলেননা। অনেকক্ষন ডাকাডাকির পর মাঝে মাঝে তিনি চোখ তুলে তাকাতেন। এ পর্যায়ে চিকিৎসকরা ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে তার রক্তচাপ বাড়ানোর চেষ্টা করেন এবং পরবর্তীতে কৃত্রিম শ্বাসপ্রসাসের ব্যবস্থা করা হয়। বৃহষ্পতিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে অধ্যাপক গোলাম আযমের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে সংবাদ মাধ্যমে। ১০টার দিকে অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী জানান তার বাবা আর বেচে নেই। এরপর ডাক্তারা প্রথমে তাকে কিনিক্যালী ডেড ঘোষনা করে। রাত ১১টা ৫২ মিনিটের মিনিটে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আব্দুল মজিদ ভূইয়া তার মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষনা করেন। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাকের কারণে রাত ১০টা ১০ মিনিটে অধ্যাপক গোলাম আযম মৃত্যুবরণ করেছেন।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে  ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ অধ্যাপক গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করে।



বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৪

অধ্যাপক গোলাম আযমের ইন্তেকাল


মেহেদী হাসান
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১    বছর ১১ মাস। আজ  রাত ১১টা ৫২ মিনিটে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আব্দুল মজিদ ভূইয়া তার মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষনা করেন। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাকের কারণে রাত ১০টা ১০ মিনিটে অধ্যাপক গোলাম আযম মৃত্যুবরণ করেছেন। রাতেই কারা বিধি অনুযায়ী তার লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। যেহেতু তিনি একজন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি তাই পোস্ট মর্টেম হবে কিনা কারা কর্তৃপক্ষই তা নির্ধারণ করবেন বলে জানান তিনি।

বিএসএমএমইউ’র পরিচালকের বক্তব্যের কিছুক্ষণ পূর্বে অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী সাংবাদিকদের জানান, তার পিতা আর বেঁচে নেই। একজন মুসলমান হিসেবে যেভাবে দাফন-কাফন করা প্রয়োজন তারা সেটাই চান। তার এ বক্তব্যের কিছুক্ষণ পরই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক গোলাম আযমের মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষনা করেন।

গত কয়েকািদন ধরে মারাত্মক অসুস্থতার পর গতকাল সকাল থেকেই তার অবস্থার অবনতি ঘটে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাকের পর মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জানান, অধ্যাপক গোলাম আযম ‘কিনিক্যালি ডেড’। তবে তাকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। রাত ১০টার দিকে আইনজীবী তাজুল ইসলাম গোলাম আযমের ছেলে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনালের আব্দুল্লাহিল আমান আযমীকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, ‘আমার পিতা আর বেঁচে নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন তার মৃত্যুর ঘোষনা আনুষ্ঠানিকভাবে জানাচ্ছেননা তা আমরা জানিনা’।

এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আব্দুল মজিদ ভূইয়া রাত ৯টা ৫৮ মিনিটে অধ্যাপক গোলাম আযমের মৃত্যুর খবরটি গুজব বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি তখন জানান, তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি মারা যাননি’।

গত ৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন অধ্যাপক অধ্যাপক গোলাম আযমকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। সেদিন বিকাল ৪টার কিছু আগে তাকে প্রিজন সেল থেকে সিসিইউ-এ নেয়া হয়। তিনি দীর্ঘদিন থেকে নানা ধরনের অসুখে ভুগছেন। এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর শ্বাসকষ্ট হওয়ায় তাকে সিসিউি-এ চিকিৎসা দেয়া হয়। তার ছিল অতি উচ্চ রক্তচাপ (১৬০/১০৫), হৃদ স্পন্দন ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি (১৪০-১৪৩)। ফুসফুসে দেখা দেয় সংক্রমণ। তার নিউমোনিয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা।

অধ্যাপক গোলাম আযম বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক সুপরিচিত নাম। দেশের বাইরেও ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত কোটি কোটি মানুষের কাছেও তিনি ছিলেন সমাদৃত। ইসলামী আদর্শের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী ও নেতা হিসেবে বিশ্বের আনাচে-কানাচেও তার সুনাম ও সুখ্যাতি রয়েছে। বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের নেতা হিসেবেও সর্বত্র তাকে মান্য করা হয়।

 ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনে তার রয়েছে স্মরণীয় ভূমিকা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষে ভূমিকা রাখায় তিনি নাগরিকত্ব হারান। ১৯৯৪ সালে সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে নাগরিকত্ব ফিরে পান তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি দুইবার ডাকসুর জিএস নির্বাচিত হন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭১ সালের ভূমিকার কারণে তার বিচার শুরু হয় এবং তাকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
২০১২ সালের ১১ জানুয়ারী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আদেশে অধ্যাপক গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর থেকেই তাকে বিএসএমএমইউ’র প্রিজন সেলে রাখা হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।

জানাযা ও দাফন :
অধ্যাপক আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী জানান, জানাযার বিষয়ে আমার পিতা আমার কাছে অসিয়ত করেছেন যে, জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী যেন তারা জানাযায় ইমামতি করেন। তখন আমি তাকে জানাই মাওলানা নিজামীও কারাবন্দী। এটা শুনে আমার পিতা বলেন, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যেন তার জানাযা পড়ান। মাওলানা সাঈদীও কারাবন্দী জানানো হলে আমার পিতা জানাযার বিষয়ে আর কিছু বলেননি।

দাফনের বিষয়ে তিনি অসিয়ত করেছেন। মগবাজার কাজী অফিস লেনে আমার দাদার কবরের পাশে দাফন করার কথা বলেছেন।আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, আমরা ছয় ভাই। আমি ছাড়া অন্যরা প্রবাসে। তারা সবাই দেশে আসলে পিতার দাফনের ব্যবস্থা করা হবে।
ময়না তদন্ত বিষয়ে তিনি জানান, আমরা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছি, আমার পিতার যেন ময়না তদন্ত না করা হয়। তিনি হাসপাতালের সি ব্লকের সামনে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

হাসপাতাল ও বাসভবনে ভীড় : অধ্যাপক গোলাম আযমের স্বাস্থ্যের অবনতির খবর সকাল থেকেই গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে অধ্যাপক গোলাম আযমের পরিবার ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। তারা বিভিন্নভাবে তার শারীরিক অবস্থা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। সন্ধ্যার পর অনেকেই হাসপাতাল ও মগবাজার কাজী অফিস লেনের বাসভবনে ভীড় করতে থাকেন। উদ্বেগজনক খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার পর রাতে ভীড় আরো বেড়ে যায়। 
রাত ৯টা পর হাসপাতাল ও তার বাসভবনে অতিরিক্ত পুলিশ ও বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। এমনকি রাতে বিএসএমএমইউ’র সি ব্লক স¤পূর্ণটা পুলিশ ঘেরাও করে রাখে। তার স্বাস্থ্যের প্রকৃত অবস্থা জানতে দেশ-বিদেশের বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যম কর্মী হাসপাতালে ভড়ি জমান।

শোক : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ এবং ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারী জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে অধ্যাপক গোলাম আযমের ইন্তেকালে গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করেছেন। বিৃবতিতে তারা বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযমের এ মৃত্যু ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য এক অপুরণীয় ক্ষতি। তিনি ছিলেন এদেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের অভিভাবক তুল্য। মহাল আল্লাহ পাক এ মর্দে মুৃমিনকে জান্নাতে উত্তম প্রতিদান দিন। দলের পক্ষ থেকে আজ দেশ-বিদেশে সর্বত্রই গায়েবানা জানাযার আহবান জানানো হয়েছে।


অধ্যাপক গোলাম আযমের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি 

অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকার লক্ষ্মিবাজারে তার মাতুলালয় শাহ সাহেব বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস ব্রাèনবাড়িয়ার নবীনগরের বীরগাঁও গ্রামে।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে  ১৯৪৬ সালে বিএ ও  ১৯৪৮ সালে এমএ পাশ করেন। এর আগে ১৯৪৪ সালে ঢাকার তৎকালীন ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে মেধা তালিকায় দশম স্থানসহ ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৫০ থেকে ৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৪৭-৪৮ মেয়াদে ডাকসু’র জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৪৮-১৯৪৯ মেয়াদে তিনি পুনরায় এ পদে নির্বাচিত হন। তিনি অন্যতম একজন ভাষাসৈনিক। ডাকসু জিএস থাকাকালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে সকল ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষে তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে ঐতিহাসিক স্মারকলিপি উপস্থাপন করেন।  ভাষা আন্দোলনের কারণে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তাকে গ্রেফতার করা হয়। রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনার সময়ও তিনি কারাবরন করেন। জীবনের শুরুতে তিনি তাবলীগ জামায়াতের সাথে যুক্ত হন। পরে ১৯৫৪ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন এবং ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত  তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত একই দলের  সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জীবনে বহুবার তিনি রাজনৈতিক কারণে কারাবরণ করেছেন। 
জামায়াতে ইসলামীর আমিরসহ এ দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের পাশপাশি তিনি পাকিস্তান সরকার বিরোধী আন্দোলন এবং জাতীয় বিভিন্ন সঙ্কট উত্তোরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পক্ষে প্রচারণা, আইউব খান বিরোধী জোট ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি’র (ডাক) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, পাকিস্তান শাসক বিরোধী জোট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (ডিপিএম) এর সেক্রেটারি জেনারেল এর দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর তিনি পাকিস্তানের উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন এবং ১৯৭৩ সালে লন্ডন যান। ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং  আবার জামায়াতের আমির নিযুক্ত হন । ২০০১  সালে তিনি আমিরের দায়িত্ব থেকে অবসরে যান। ১৯৭৩ সালে অধ্যাপক গোলাম আযমের বাংলাদেশী নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয় এবং পরবর্তীতে নাগরিকত্ব বিষয়ে আলোচিত মামলায়  ১৯৯৪ সালে হাইকোর্ট  তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেন ।  

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার রূপকার  অধ্যাপক গোলাম আযমের পরিচিতি রয়েছে দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সুবাদে বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক  নেতৃবৃন্দের কাছে অধ্যাপক গোলাম আযম একজন ইসলামী রাজনীতিবিদ  হিসেবে খুবই পরিচিত একটি নাম।

জেনারেল এরশাদের শাসনামলে আশির দশকের মাঝামাঝি তিনি জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারণা প্রচার করেন। এরপর ১৯৯১ সালে এ ব্যবস্থার অধীনে বাংলাদেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যা স্বাধীন বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে মাইলফলক এবং যুগান্তকারী ঘটনা  হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এরপর তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় আরো তিনটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

অধ্যাপক গোলাম আযম  বেশ কিছু  আলোচিত  গ্রন্থের প্রণেতা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পলাশী থেকে বাংলাদেশ, ইকামতে দ্বীন, মনটাকে কাজ দিন, তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘জীবনে যা দেখলাম’। এছাড়া তার বেশ কিছু অনুবাদ গ্রন্থও রয়েছে।

অধ্যাপক গোলাম আযমের ছয় ছেলে। এর মধ্যে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী দেশে আছেন। তার স্ত্রী সৈয়দা আফিফা আযম জীবিত আছেন।

গ্রেফতার ও মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলার কার্যক্রম শুরু হলে অধ্যাপক গোলাম আযমকে ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ মোতাবেক তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির হলে সেদিনই  ট্রাইব্যুনাল তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে  ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ অধ্যাপক গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করে।

অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে পাঁচ ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। পাঁচ ধরনের অভিযোগ হল ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, সহযোগিতা এবং সিরু মিয়া দারোগা ও তার কিশোর পুত্র আনোয়ার কামালসহ মোট ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া কারাগারে হত্যার নির্দেশ।

উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায় হিসেবে ১৯৭১ সালের যাবতীয় অপরাধের দায় আনা হয়েছে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৩০ লাখ নরনারী হত্যা, ৪ লাখ নারী ধর্ষণসহ সমস্ত অপরাধ এবং  ধ্বংসযজ্ঞের দায়ভার চাপানো হয়েছে অধ্যাপক গোলাম আযমের ওপর ।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির রায় ঘোষনার সময় বলেছেন, অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়নি বা  অপরাধ স্থলে উপস্থিত থাকা বা তার কথায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে কেউ কোন অপরাধ সংঘটন করেছে সরাসরি এমন কোন অভিযোগও আনা হয়নি তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা হল- উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় বা সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’র অভিযোগ। তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির। এ দলের আমির হিসেবে রাজাকার, শান্তি কিমিটি, আল বদর, আল শামস প্রভৃতি বাহিনী গঠন এবং এসব বাহিনীর কার্যক্রমের ওপর তার নিয়ন্ত্রন ছিল। এসব বাহিনী ১৯৭১ সালে  পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে হত্যা, গনহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে। তাছাড়া সরাসরি জামায়াতে ইসলামও পাকিস্তানের সহযোগী বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। তাই এসব বাহিনীর অপরাধমূলক কর্মকান্ডের দায় তিনি এড়াতে পারেননা।











রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সুখরঞ্জন বালীর জন্য অপেক্ষা

মেহেদী হাসান, ২১/৯/২০১৪
‘মোর স্বামীর পরানডা কি  আছে? আমনেগো পায় ধরি, মোর স্বামীরে আইন্যা দ্যান।  মোরে এটটু খবর  দ্যান।”
প্রায় দুই বছর আগে সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রী আরতী রানী  এই আকুতি প্রকাশ করেছিলেন। বালী নিখোঁজ হবার পর ২০১২ সালের   ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আরতী রানীকে ফোন করা হলে নিখোঁজ স্বামীর জন্য তিনি বিলাপ করে এভাবে আকুতি প্রকাশ করেছিলেন।

নিখোঁজ স্বামীর কোন সন্ধান ছাড়াই আরতী রানীর পর হয়ে যায় ছয় মাস।  এরপর ২০১৩ সালের ১৬ জুন ঢাকার নিউএজ পত্রিকায় খবর বের হয় সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি ভারতের কারাগারে বন্দী আছেন। 

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে ২০১২ সালের পাঁচ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরনের শিকার হন সুখরঞ্জন বালী। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় হয়েছে। কিন্তু বালীর জন্য অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি তার অসুস্থ স্ত্রী এবং সন্তানদের।

গত শুক্রবার সকালে আবার ফোনে যোগাযোগ করা হয় সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রী আরতী রানীর সাথে। স্বামীর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেই কান্নার  সুর ভেসে আসতে থাকে ফোনের ওপার থেকে।  “মোর স্বামীরে আইন্না এটটু দেহান মোরে। মোর অসুখ। মরার আগে স্বামীর মুখ দেখে যেন মরতে পারি হেই ব্যবস্থা করেন আমনেরা।”

সংসার কিভাবে চলছে জানতে চাইলে আরতী রানী জানান, তার স্বামী সুখরঞ্জন বালী কাঠমিস্ত্রীর কাজ করত। নিখোঁজ হবার আগে একটি ঘর বানিয়েছিলেন নিজেদের জন্য ।  কিন্তু সে ঘরে আজ নেই তিনি। স্বামী নিখোঁজের পর দিশাহীন অবস্থায় পাগলের মত এদিক সেদিক ঘুরেছেন আরতী রানী। বেহাল দশা নেমে আসে সংসারে। আগে থেকেই তার হাপানীসহ আরো রোগব্যাধি ছিল। স্বামীর শোক এবং সংসারের এ দুরবস্থার কারনে তার অসুস্থতার মাত্রা আরো বেড়ে যায়। অধিকাংশ সময় তিনি এখন শয্যাশায়ী ।  একমাত্র মেয়ে মনিকার বিয়ে হয়েছিল । সে স্বামীর বাড়ি না থেকে এখন বাপের বাড়ি থাকে তার দেখাশুনার জন্য। মনিকা ছাড়া তাদের  অপুর্ব নামে আরেকটি ছেলে আছে ১৬ বছর বয়সের।

আরতী রানী জানান, স্বামী কাঠ মিস্ত্রী বাবদ যে আয় করত তা দিয়েই চলত সংসার। জমিজমা নেই; সামান্য বাস্তুভিটা এবং একটা গরু আছে। স্বামী নিখোঁজ হবার পর অভাব অনটন নেমে আসে সংসারে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতে থাকে। গরুটি তিনি বেঁচতে চেয়েছিলেন। মেয়ে বলেছে বাবার স্মৃতি বেচা ঠিক হবেনা ।  একথা বলার সময় আবার কান্নার সুর ভেসে আসে ফোনে।

ফোনে কথা বলার সময় আরতি রানী প্রথমে কথা বলদে দ্বিধা এবং  জড়তা প্রকাশ করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান কত লোক কত কথা জানতে চায়। কার কাছে কি বললে কোন বিপদ নেমে আসে সে ভয়ে আছেন তারা। তার স্বামী মাওলানা সাঈদীর মামলার স্বাক্ষী হওয়া এবং নিঁেখাজ হবার পর অনেক লোক অনেক কথা বলেছে। অনেকে অনেক কিছু জানতে চেয়েছে তাদের কাছে।  অনেকে ভয়ভীতিও দেখিয়েছে।
আরতী রানী বলেন, তার সাথে এখনো অনেকে কথা বলেনা। এড়িয়ে চলে। কারণ এর ফলে যদি তাদেরও কোন বিপদ হয়। দোকানে কোন কিছূ কিনতে গেলে দোকানদার তাড়াতাড়ি সদায় দিয়ে বিদায় করতে চায়।
আরতী রানী জানান, সুস্থ থাকলে তিনি মানুষের বাড়িতে কিছু কাজ টাজ করেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তিনি এখন অসুস্থ। হাটাচলা করতে পারেননা ঠিকমত। কারণ হিসেবে সঙ্কোচের সাথে জানালেন তার জরায়ু অনেক নিচে নেমে গেছে অনেক দিন থেকে। কোন চিকিৎসা হয়নি। হাপানিরও কোন চিকিৎসা হচ্ছেনা। তুদপরি রয়েছে ঠিকমত খাবার না পাবার সমস্যা। আরতি রানী জানান তার বয়স ৫০ এর উপরে হবে।

কে সুখরঞ্জন বালী : মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে যেসব অভিযোগ আনে তার মধ্যে একটি অভিযোগ হল পিরোজপুরের উমেদপুর গ্রামে বিশাবালী নামে একজনকে  নারকেল গাছের সাথে বেঁধে রাজাকাররা  মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে তারই সামনে গুলি করে হত্যা করে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়। তার মধ্যে একটি হল এই বিশাবালী হত্যার অভিযোগ। আপিল বিভাগের রায়ে বিশবালী হত্যার অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে আজীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। সেই বিশাবালীর আপন ছোটভাই হলেন সুখরঞ্জন বালী। তিনি ছিলেন মাওলানা স্ঈাদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী।  কিন্তু তিনি পক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে আসেন। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে  সাক্ষ্য দিতে আসার দিন ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে তাকে অপহরন করা হয়। 

গোটা বিশ্বে এ নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে ঢাকার দৈনিক নিউএজ পত্রিকায় ডেভিড বার্গম্যানের একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয় সুখরঞ্জন বালী বিষয়ে। তাতে বলা হয় সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দমদম সংশোধন কেন্দ্রে রয়েছেন। সুখরঞ্জন বালীর সাথে তারা যোগাযোগ করলে বালী তাদের জানিয়েছেন ঢাকার আইনশঙ্খলা বাহিনী তাকে অপহরন করে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে।

ভারতে বালী : নিউএজ পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানানো হয় বালীকে ৫ নভেম্বর অপহরনের পর ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভারতে পাঠানো হয় জোর করে। অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের দায়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাকে গ্রেফতার করে উত্তর চব্বিশপরগনার বশিরহাট জেলে রাখে।  এরপর বশিরহাট আদালত ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল   অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বালীকে ১০৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়।  যেহেতু বিচার চলাকালে এই মেয়াদটা  তিনি কারাভোগ করেছেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে  তাকে যেকোনো দিন বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যেতে পারে বলে মত দেন আদালত।

সুখরঞ্জন বালীর ভারতে অবস্থানের বিষয়ে জানার পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের প্রতি অনুরোধ জানায় তাকে যেন বাংলাদেশে ফেরত না পাঠানো হয় কারণ তাতে তার জীবনের আশঙ্কা রয়েছে।

সুখরঞ্জন বালীকে সহায়তার জন্য এ পর্যায়ে বেশ কিছু মানবাধিকার সংস্থা এবং আইনজীবী এগিয়ে আসেন। সুখরঞ্জন বালীর কারাভোগের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আশঙ্কা তৈরি হয়। সেজন্য তিনি ভারতের সুপ্রীম কোর্টের দ্বারস্থ হন তার সাহায্যে এগিয়ে আসা আইনজীবীদের মাধ্যমে।  সুপ্রিম কোর্টে বালী অনুরোধ করেন তাকে যেন দেশে ফেরত পাঠানো না হয়। দেশে ফেরত পাঠালে তার জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে। ২০১৩ সালের ২রা আগস্ট শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট বালীকে দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি দুই সপ্তাহ স্থগিত করে আদেশ দেন।

এরপর কলকাতা হাইকোর্ট  ছয় আগস্ট এক আদেশে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ মেয়াদ শেষ হলে ২০ আগস্টের পর বালীকে দেশে পাঠানোর জন্য।
এ প্রেক্ষিতে বালী ১৩ আগস্ট ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবদন করেন এবং ১৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট  এক আদেশে বলেন তাকে দেশে ফেরত পাঠানো বা ভারতে রাখার বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা। সেই অবধি এখনো ভারতেই সরকারি হেফাজতে আছেন তিনি।

তবে বালীর জন্য অপেক্ষারত তার অসুস্থ স্ত্রী এবং সন্তানেরা চান বালী দেশে ফিরে আসুক এবং আগের মত যেন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন সে নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা হোক।




বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

ঘটনাবহুল আলোচিত একটি মামলা

 মেহেদী হাসান, ১৭/৯/২০১৪
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে আলোচিত মামলা  হিসেবে স্থান পেয়েছে  ১৯৭১ সালের  যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম।  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলা হয়েছে  তার মধ্যে নানা কারনে অন্যতম  আলোচিত এবং ঘটনাবহুল মামলায় পরিণত হয় মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা। ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে এ মামলার প্রতি মানুষের অধীর আগ্রহের মূলে সেটা গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় ছিলনা। ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীকে অপহরন করা, স্কাইপ কেলেঙ্কারি, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী গণেশ চন্দ্র  পক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়াসহ নানা কারনে বিশ্বজুড়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে এ মামলা। 

মামলার আসামী যেমন এ মামলায় মানুষের আকর্ষনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু তেমনি এ মামলার বিভিন্ন অভিযোগ এবং মামলাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত একের পর এক ঘটনা প্রবাহের  কারনেও এ মামলার খবরাখবর পাঠকের কাছে ছিল গভীর আগ্রহের বিষয়। ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ, ‘সাঈদী’ এবং ‘দেলু  শিকদার’ এসব বিষয়ও ছিল এ মামলার আলোচিত বিষয়।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ১৯৭১ সালের ৮ মে তার নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকজন পিরোজপুরের পাড়েরহাট বাজারের নিকটস্থ  চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এরপর সেখান থেকে ইব্রাহীম কুট্টি এবং মফিজউদ্দিন পসারীকে ধরে পাড়েরহাট বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা ওই বাড়িতে কাজ করত। পাড়েরহাট নেয়ার পর মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে । 
বিচার চলাকালে আসামী পক্ষ আদালতে জানান, ইব্রাহীম কট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই পিরোজপুরে একটি মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় তিনি পাকিস্তান আর্মিসহ মোট ১৪ জনকে আসামী করেছিলেন। আসামীর তালিকায়  আল্লামা সাঈদীর নাম নেই। ওই মামলার বিবরনে আরো বলা হয় ইব্রাহীম কুট্টিকে  ১৯৭১ সালে ১ অক্টোবর তার শশুরবাড়ি নলবুনিয়ায় হত্যা করা হয়। আসামী পক্ষ অভিযোগ করে মমতাজ বেগম এখনো জীবিত কিন্তু তাকে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হিসেবে হাজির করেনি।

মাওলানা সাঈদী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মোফাসসিরে কোরআন এবং সুললিত কণ্ঠস্বরের অধিকারী  হওয়ায় দেশে এবং বিদেশে অগণতি মানুষের নিয়মিত মনোযোগের বিষয়ে পরিণত হয়  এ মামলার কার্যক্রম ।
মাওলানা সাঈদীর বিচারে যখন সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় তখন এ বিষয়ক খবরের জন্য পাঠকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। জেরায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর মুখ থেকে আইনজীবী মিজানুল ইসলাম কি বের করে আনেন তা জানার জন্য পরের দিনের পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করেছেন অগণিত পাঠক। পিরোজপুরের বর্তমান এমপি একেএমএ আউয়াল মাওলানা সাঈদীর বিপক্ষে সাক্ষ্য দেন। মাওলান সাঈদীর পক্ষেও সাক্ষ্য দিয়েছেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তাছাড়া জেরায়  রাষ্ট্রপক্ষের বেশ কয়েকজন সাক্ষীর বিরুদ্ধে চুরি, জেল খাটাসহ আরো নানাবিধ তথ্য বের হয়ে আসে যা ছিল  পাঠকের কাছে বেশ  আকর্ষণীয়। 

ট্রাইব্যুনাল থেকে এ মামলার রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে দেড়শতাধিক মানুষ জীবন দেয়। সারা দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবাদে নেমে আসে রাজপথে।
বিচার চলাকালে  এবং বন্দী থাকা অবস্থায় মাওলানা সাঈদী প্রথমে তার মাকে হারান। এরপর  ২০১২ সালে  জুন মাসে বিচার চলাকালে  ট্রাইব্যুনালে বসে অসুস্থ হয়ে মুত্যৃর কোলে ঢলে পড়েন তার বড় ছেলে রাফিক বিন সাঈদী।

মামলা চলাকালে ২০১২ সালের  পাঁচ নভেম্বর মাওলানা সাঈদীর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন সুখরঞ্জন বালী। সেদিন তাকে ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরন করে নিয়ে যাওয়া হয়। বালী অপহরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাড়া ফেলে। কারণ সুখরঞ্জন বালী ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। তিনি পক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। আরো একটি কারনে বালী অপহরন ঘটনা মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে সেটি হল  তিনি ছিলেন বিশাবালীর আপন ভাই। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের  অভিযোগ ছিল তার নির্দেশে বিশাবালীকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়। সেই বিশাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালী এসেছিলেন মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে।
এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে ঢাকার দৈনিক নিউএজ পত্রিকায়  প্রকাশিত ডেভিড বার্গম্যানের  অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে  বলা হয় সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান  পাওয়া গেছে। তিনি ভারতের একটি কারাগারে বন্দী আছেন। বালী জানিয়েছেন তাকে আইনশঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরন করে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এরপর আবার নতুন করে শুরু হয় এ চাঞ্চল্যকর ঘটনা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। 

গণেশ চন্দ্র সাহা ছিলেন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আরেকজন সাক্ষী। কিন্তু গনেশ রাষ্ট্রপক্ষে  সাক্ষ্য না দিয়ে উল্টো মাওলানা সাঈদীর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন।  ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে একটি মর্মান্তিক হত্যাকান্ড হল ভাগিরথী হত্যাকান্ড। বিধবা ভাগীরথীকে পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্পে আটকে রেখে ইজ্জত হরন করে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য পাচারের অভিযোগে ভাগিরথীকে পাকিস্তান আর্মি গাড়ির পেছনে বেঁধে টেনে হিচড়ে হত্যা করে।  মাওলানা সাঈদীর সহায়তায় এই ভাগীরথীকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। সেই  ভাগিরথীর ছেলে হলেন সাক্ষী গনেশ চন্দ্র সাহা। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি কোর্টে এসে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে বললেন  মাওলানা সাঈদী তার মাকে মারেননি। পাকিস্তান আর্মিরাই তার মাকে মেরেছে।  এ ঘটনা তখন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। 

২০১২ সালের ছয় ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে এ মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ ঘোষনা করার কথা ছিল। সেদিন দেশ বিদেশের অসংখ্য সাংবাদিক হাজির হন ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু সেদিন ফাঁস হল স্কাইপ কেলেঙ্কারীর খবর।  ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নিজেই বিষয়টি ওপেন কোর্টে প্রকাশ করলেন সেদিন এ ঘটনা।  

বিচারপতি নিজামুল হক বলেন,   ব্রাসেলসে বসবাসরত আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে ট্রাইব্যুনালের  বিচার প্রকৃয়া চলাকালে এবং বিভিন্ন আদেশের  সময় সহায়তা নিয়েছেন তিনি। এ উপলক্ষে তাদের দুজনের মধ্যে স্কাইপের মাধ্যমে কথপোকথন হয়েছে। এ  তথ্য হ্যাক করে ইকনোমিস্ট হস্তগত করেছে বলে   উল্লেখ করেন তিনি ।
নয় ডিসেম্বর থেকে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে বিচারপতি নিজামুল হক ও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন।  এ নিয়ে দেশে বিদেশে তুমুল ঝড়  ওঠে।    বিচারপতি নিজামুল হকের কথোপোকথনের বিষয়বস্তু পড়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে গোটা জাতি। বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা একে  দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করেন। শুধু স্কাইপ সংলাপ নয় বিচারপতি নিজামুল হক এ বিচার বিষয়ে তার সাথে যেসব মেইল আদান প্রদান করেছেন তাও ফাঁস হয়ে যায়। বিচারের বিভিন্ন বিষয় বেলজিয়াম থেকে লিখে পাঠানোর ঘটনার চিত্র বের হয়ে পড়ে এতে । এ ঘটনার জের ধরে  ১১ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন তিনি।

২০১২ সালের ২০ মার্চ  রাষ্ট্রপক্ষ থেকে  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে   ৪৬ জন সাক্ষীর বিষয়ে একটি দরখাস্ত দাখিল করা হয়  ট্রাইব্যুনালে । দরখাস্তে নিবেদন করা হয়  ৪৬ জন সাক্ষীকে  ট্রাইব্যুনালে হাজির করা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। তাই এসব সাক্ষী  তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হোক।
সাক্ষী হাজির করতে না পারার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় কেউ নিখোঁজ, কেউ পলাতক, কেউ অসুস্থ, কেউবা চলে গেছে ভারতে।

ট্রাইব্যুনাল ২৯ মার্চ ১৫ জন সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী প্রদান করেন তা তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে আদেশ দেয়।

এরপর ৩রা জুন আসামী পক্ষ সেফহাউজের (ঢাকায় যেখানে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী  এনে রাখা হত)  বিশাল ডকুমেন্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়ে বলেন সাক্ষী হাজির করতে না পারা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যে কারণ দেখিয়েছে তা সম্পূর্ণ  মিথ্যা। সাক্ষীগন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ তাদেরকে আদালতে হাজির করেনি।   অনেক সাক্ষী তাদের হেফাজতেই ছিল এবং সেফহাউজের রেজিস্ট্রার বইয়ে  তার প্রমান রয়েছে।  কোন সাক্ষী কবে সেফহাউজে আসে, কতদিন থাকে,  কে কয়বেলা খেয়েছে তার সমস্ত তথ্য রেজিস্ট্রার বইয়ে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়।  আসামী পক্ষ রাষ্ট্রপক্ষের সেফহাউজ থেকে রেজিস্ট্রার খাতা সংগ্রহ করে ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।  অবশ্য রাষ্ট্রপক্ষ তাকে জাল হিসেবে আখ্যায়িত করে।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার একেবারে শুরুতে বিতর্ক শুরু হয় ট্রাইব্যুনালের তখনকার চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হককে নিয়ে।  বিচারপতি নিজামুল হক ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি  (ঘাদানিক)  গঠিত  জাতীয়  গণতদন্ত কমিশিনের সেক্রেটারিয়েট এর সদস্য ছিলেন।

এ তদন্ত কমিশন কারাবন্দী মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ  মোট ১৬ জনকে  যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে দুই দফা তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে ১৯৯৪ এবং ১৯৯৫ সালে। মাওলানা সাঈদীর আবেদনে  বলা হয় যিনি আগে থেকেই আসামীদের বিচারের সাথে জড়িত তার কাছ থেকে ন্যায় বিচার পওয়ার আশা করা যায়না। তাই তাকে সরে দাড়ানোর অনুরোধ করা হয়। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে ওয়াকআউট করার ঘটনাও ঘটে আসামী পক্ষের আইনজীবীদের।

মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

মাওলানা সাঈদীর আমত্যৃ জেল

মেহেদী হাসান, ১৭/৯/২০১৪
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনটি পৃথক অভিযোগে তাকে আমৃত্যু জেল, অপর  দুটি অভিযোগের একটিতে ১২ বছর এবং আরেকটিতে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাকান্ডে ১২ বছর জেল এবং বিশাবালী হত্যাকান্ডে আমৃত্যু জেল দেয়া হয়েছে। বিশাবালী হত্যার অভিযোগসহ আরো দুটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু কারান্দণ্ড  দেয়া হয়েছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ চূড়ান্ত এ রায় ঘোষনা করে আজ। 

রায়ে আসামী এবং রাষ্ট্রপক্ষ উভয়পক্ষের আবেদন আংশিকভাবে মঞ্জুর করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে মোট আটটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়। অপর ছয়টি অভিযোগে কোন সাজা  উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল।
আসামী পক্ষ মাওলানা সাঈদীকে বেকসুর খালাস এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছয়টি অভিযোগে সাজা উল্লেখের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করেছিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।

আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে আসামী পক্ষের আবেদন আংশিক গ্রহণ করে  মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে একটিতে আমত্যৃ জেল এবং আরেকটিতে ১২ বছর কারাদন্ড দেয়া হল।
অপরদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা উল্লেখ করা হয়নি এমন ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনও আংশিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। অপর তিনটি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২০টি অভিযোগ আনে। আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টির হত্যার অভিযোগ ছিল  আট নং অভিযোগ।  এ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মুত্যুদন্ড দেয়। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগে ১২ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। অপর দিকে বিশাবালীর অভিযোগটি ছিল ১০ নং অভিযোগ। এ অভিযোগেও ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল। আজকের রায়ে এ অভিযোগে আমৃত্য কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।

অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন গ্রহণ করে যে তিনটি অভিযোগে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল সাত, ১৬ এবং ১৯ নং অভিযোগ।
১৬ নং অভিযোগ হল  গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, আনু এবং কমলা নামে তিন বোনকে অপহরন করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগ। এ অভিযোগে  আপিল বিভাগের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্য জেল দেয়া হয়েছে। অপরদিকে  ১৯ নং অভিযোগ হল  মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরন। এ অভিযোগেও মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু জেলা দেয়া হয়েছে।
সাত নং অভিযোগ ছিল শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া। এ অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
সাত, ১৬ এবং ১৯ নং অভিযোগে ট্রাইবু্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও কোন সাজা উল্লেখ করেনি।  আপিল বিভাগর রায়ে  এ তিন অভিযোগের বিপরীতে সাজা  উল্লেখ করা হল।

এছাড়া আরো তিনটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও  সে তিনটি অভিযোগে আজকের  চূড়ান্ত রায়ে খালাস দেয়া হয়েছে।  এ অভিযোগ তিনটি হল  (৬) পাড়েরহাট বাজারে দোকানপাটে  লুটপাটে নেতৃত্ব প্রদান এবং অংশ নেয়া, (১১) মাহবুবুল আলম হাওলাদার বাড়িতে লুট এবং তার ভাইকে নির্যাতন  এবং (১৪)  ১৯৭১ সালে  হোগলাবুনিয়া এলাকায় হিন্দু পাড়ায় আক্রমন এবং শেফালী ঘরামী নামে একজন মহিলাকে রাজাকার কর্তৃক  ধর্ষনে সহায়তা এবং সেখানে উপস্থিত থাকা  ।

প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের  আপিল বেঞ্চ  সকালে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করে। সকাল ১০টা পাঁচ মিনিটের সময় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন। ১০টা সাত মিনিটের সময় সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষনা শুরু করেন। তিন মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায় রায় ঘোষনা। এসময় আদালত কক্ষে বিপুল সংখ্যক আইনজীবী এবং সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
গত ১৬ এপ্রিল আপিল বিভাগে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার  সমস্ত কার্যক্রম শেষে  রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়। ঠিক পাঁচ মাস শেষে  চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করা হল।

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে  মৃত্যুদন্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শুরু হয়। সাড়ে ছয় মাসেরও অধিক সময় পর আলোচিত এ মামলায় আপিল শুনানী শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয় গত  ১৬ এপ্রিল।

মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে  পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় তখন। বেঞ্চের  অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞ, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

ইবরাহীম কুট্টি ও বিশাবালী হত্যার অভিযোগ : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ বিষয়ে বলা হয়  ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা সাঈদীর  সাঈদীর নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি এবং শান্তি কমিটির লোকজন চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এরপর মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহীম কৃট্টি  এবং মফিজুল নামে দুজনকে  ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পাড়েরহাট বাজারে।  তারা ওই বাড়িতে কাজ করত। পাড়েরহাট বাজারে আনার পর  মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে।

১০ নং যে অভিযোগ বিষয়ে চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারে উল্লেখ করা হয়েছে   ১৯৭১ সালের ৬ জুন  সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর আগুন  দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়।

আপিল শুনানীর সময় আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে আসামী পক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করে জানায়  ইব্রাহিম কুট্টি ১৯৭১ সালে আট মে তার শশুরবাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছে। এ বিষয়ে তার স্ত্রী মমতকাজ বেগম ১৯৭২ সালে মামলা করে ১৩ জনকে আসামী করে তাতে মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। মমতাজ বেগম এখনো জীবিত আছেন।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন : ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের  ৬ ডিসেম্বর  মামলার সমস্ত  কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন ১১ ডিসেম্বর। এরপর মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি  উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি  উভয় পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে  সেদিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনার এক মাসের মাথায় নির্দিষ্ট করে তারিখ ঘোষনা করলেন ট্রাইব্যুনাল।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত  মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়।  ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্করির কারনে  পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি।

মানিক পসারী নামে এক লোক   পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে  ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট  মাওলানা  দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আরেকটি নালিশ দায়ের করেন পিরোজপুর নালিশী আদালতে।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে  মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার  ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবী করেন।  এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং  বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।

মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলের সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।
মাওলানা সাঈদী নিজ পিতার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ করার পর তিনি ১৯৬২ সালে মাদরাসা শিক্ষা শেষ করে গবেষণা কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৬৭ থেকে মাওলানা  সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে  মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর করেছেন।  তার ওয়াজ শুনে  অসংখ্য অনেক  হিন্দু  এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ওপর রচনা করেছেন অসংখ্য পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও  সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশে বিদেশে সর্বত্র।  দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগনিত ভক্ত অনুরাগী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের  আমন্ত্রনে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং  কোরআনের  তাফসির করেছেন।







মাওলানা সাঈদীর মামলায় চূড়ান্ত রায় কাল

মেহেদী হাসান, ১৬/৯/২০১৪
বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মোফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার  চূড়ান্ত রায় আগামীকাল ঘোষনা করা হবে। সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে আগামী কালের মামলার কার্যতালিকায় মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। 

আগামী কালের মামলার কার্যতালিকায় এক নং ক্রমিকে রয়েছে এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে একদিন আগেই  প্রকাশ করা হয়  পরবর্তী দিনের মামলার কার্যতালিকা।

গত ১৬ এপ্রিল আপিল বিভাগে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার  সমস্ত কার্যক্রম শেষে  রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়। প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ আপিল মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটাপাট, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরনসহ ২০টি অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে আটটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

মাওলানা সাঈদীর খালাস চেয়ে  ওই বছর ২৮ মার্চ আপিল বিভাগে আবেদন করে আসামি পক্ষ। যে ছয়টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে কিন্তু সাজা উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল  সেগুলোতে সাজা উল্লেখ করার দাবি জানিয়ে একই দিন রাষ্ট্রপক্ষও আপিল আবেদন করে।
ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শুরু হয়। সাড়ে ছয় মাসেরও অধিক সময় পর আলোচিত এ মামলায় আপিল শুনানী শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয় গত  ১৬ এপ্রিল।

মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে  পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল।  অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞ, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

মাওলানা সাঈদীকে দুটি হত্যার অভিযোগে মুত্যুদণ্ড  দেয় ট্রাইব্যুনাল-১।  এ দুটি অভিযোগ হল ইব্রাহীম কুট্টি  এবং বিশাবালী হত্যার ঘটনা। মাওলানা সাঈদীর উপস্থিতিতে, নির্দেশে এবং সহযোগিতায়  তাদের হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। এ অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় রায়ে।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মোট ২০টি অভিযোগে চার্জ গঠন হয়। এর মধ্যে আটটি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করেন ট্রাইব্যুনাল।  প্রমানিত আটটি অভিযোগের দুটি হত্যার অভিযোগ। দুটি  হত্যার অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির আদেশ দেয়ার কারনে বাকী ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হলেও তাতে কোন শাস্তির কথা উল্লেখ করেননি ট্রাইব্যুনাল। বাকী  যে ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ধর্মান্তরকরন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরন  প্রভৃতি।

১২টি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয় রায়ে। খালাস দেয়া অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের পিতা ফফজুর রহমানসহ পিরোজপুরের তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যার অভিযোগ, ভাগিরথী হত্যা এবং ভানুসাহাকে ধর্ষনের অভিযোগ।


যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যে ২০টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয় তার মধ্যে আট নং অভিযোগে বলা হয় ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা সাঈদীর  সাঈদীর নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি এবং শান্তি কমিটির লোকজন চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এখানে মানিক পসারীর বাড়িসহ ৫টি ঘর তারা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় লুটপাটের পর। মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহীম কৃট্টি  এবং মফিজুল নামে দুজনকে  ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরা দুজন  মানিক পসারীর বাড়িতে কাজ করত। মাওলানা সাঈদী এদের দুজনকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে পাড়েরহাট বাজারে নিয়ে যান  তার সাথে লোকজনের সহায়তায়। এরপর মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে। মফিজকে  আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের বেশ কয়েকজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। পালিয়ে আসা মফিজও সাক্ষ্য দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছেন  মফিজ এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী।  রায়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ  প্রমানিত হয়েছে উল্লেখ করে মাওলানা সাঈদীকে মুত্যৃ দণ্ড প্রদান করা হয়েছে।


অপর  ১০ নং যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে  সে বিষয়ে চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারে উল্লেখ করা হয়েছে   ১৯৭১ সালের ৬ জুন  সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর আগুন  দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়।


মুত্যৃদন্ডের অভিযোগ দুটি নিয়ে বিতর্ক : রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ এবং সাক্ষীরা বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টিকে ১৯৭১ সালের ৮ মে মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাড়েরহাট বাজারে মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অপর দিকে ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম বর্তমানে জীবিত। তিনি ১৯৭২ সালে তার স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে পিরোজপুরে একটি মামলা করেছিলেন । সে মামলায় তিনি উল্লেখ করেন ১৯৭১ সালে ১ অক্টোবর তার বাবার বাড়িতে থাকা অবস্থায়  শান্তি কমিটির লোকজন তার স্বামী ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা করে। এসময় তার মা সিতারা বেগম এবং ভাই সাহেব আলীকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাকে মাকে ছেড়ে দেয়া হলেও তার ভাই সাহেব আলীকে পিরোজপুরে হত্যা করে পাকিস্তান আর্মি। ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম  মামলায় ১৩ জনকে আসামী করেন।  আসামীর তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। মামলার সেই ডকুমেন্ট আসামী পক্ষ হাজির করেন ট্রাইব্যুনালে। এছাড়া মাওলানা সাঈদীর  পক্ষে বেশ কয়েকজন সাক্ষীও  সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টিকে নলবুনিয়া তার শশুর বাড়িতে থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়।  মাওলানা সাঈদী এর সাথে জড়িত ছিলনা।

মামলার আপিল শুনানীতেও আসামী পক্ষের আইনজীবীরা এ বিষয়ে তথ্য প্রমান তুলে ধরে যুক্তি উপস্থাপন করে।

এছাড়া বিশাবালী হত্যার ঘটনা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বিশাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালী ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে গত বছর ৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরনের শিকার হন।

অপর যে  ছয় অভিযোগ প্রমানিত : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে অপর যে ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল (অভিযোগ নং ৬) পাড়েরহাট বাজারে দোকানপাটে  লুটপাটে নেতৃত্ব প্রদান এবং অংশ নেয়া, (৭) শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া, (১১) মাহবুবুল আলম হাওলাদার বাড়িতে লুট এবং তার ভাইকে নির্যাতন (১৪)  ১৯৭১ সালে  হোগলাবুনিয়া এলাকায় হিন্দু পাড়ায় আক্রমন এবং শেফালী ঘরামী নামে একজন মহিলাকে রাজাকার কর্তৃক  ধর্ষনে সহায়তা এবং সেখানে উপস্থিত থাকা  (১৬) গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, আনু এবং কমলা নামে তিন বোনকে অপহরন করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়া এবং (১৯) মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরন। এসব অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে তবে শাস্তি প্রদান করা হয়নি।

খালাস ১২টি অভিযোগ : যে ১২টি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অভিযোগ হল  পিরোজপুরের পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান (হুমায়ূন আহমেদের পিতা), মেজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহামান  এবং এসডিও আব্দুর রাজ্জাককে হত্যার অভিযোগ। এছাড়া ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে নির্মম হত্যার শিকার ভাগিরথীকে হত্যা এবং  ভানু সাহাকে ধর্ষনের  অভিযোগ থেকেও খালাস দেয়া হয় মাওলানা সাঈদীকে। এছাড়া মাছিমপুর বাস স্ট্যান্ডের পেছনে, মাসিমপুর হিন্দুপাড়া এবং ধোপপাড়া এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সংখ্যাক হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেয়া, লুটপাট করা, হিন্দুদের  অনেক হিন্দুকে এক দড়িতে বেঁধে হত্যঅ করা, হত্যার উদ্দেশে হিন্দুদের  পাকিস্তান বাহিনীর হাতে তুলে দেয়াসহ মোট ১২টি অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ প্রমানিত হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।


মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের  ৬ ডিসেম্বর  মামলার সমস্ত  কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন। এরপর মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি  উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালের ১৩ ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি  উভয় পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে  সেদিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত  মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়।  ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্করির কারনে  পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি।

মানিক পসারী নামে এক লোক   পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক আদালতে   ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট  মাওলানা  দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুর নালিশী আদালতে একটি নালিশী দরখান্ত দাখিল করেন।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে  মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার  ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবী করেন।  এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং  বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

তদন্ত সংস্থা ১৪ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় এবং ৩/১০/২০১১ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে আদেশ দেয়া হয় ট্রাইব্যুনাল-১ এ।

এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২৮ জন সাক্ষী হাজির করে। এর মধ্যে ঘটনার সাক্ষী ছিল ২০ জন  । বাকীরা জব্দ তালিকার এবং একজন তদন্ত কর্মকর্তা। রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৬৮ জন ঘটনার সাক্ষীর তালিকা জমা দিয়েছিল ট্রাইব্যুনালে।   ৬৮ জনের মধ্য থেকে হাজির করা হয়নি এমন ১৬ জন সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
অপরদিকে আসামী পক্ষে মোট ২০ জন সাক্ষীর তালিকা নির্ধারন করে দেন ট্রাইবু্যুনাল এবং তার মধ্য থেকে ১৭ জন সাক্ষী হাজির করে আসামী পক্ষ।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে মামলায়  ট্রাইব্যুনালে যেসব আইনজীবী অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, মনজুর আহমেদ আনসারী, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন প্রমুথ।
অন্যদিকে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামালায় রাষ্ট্রপক্ষের নির্ধারিত আইনজীবী ছিলেন সৈয়দ  হায়দার আলী।

মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলের সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।
মাওলানা সাঈদী নিজ পিতার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ করার পর তিনি ১৯৬২ সালে মাদরাসা শিক্ষা শেষ করে গবেষণা কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৬৭ থেকে মাওলানা  সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে  মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর করেছেন।  তার ওয়াজ শুনে   অনেক  হিন্দু  এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ওপর রচনা করেছেন অসংখ্য পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও  সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশে বিদেশে সর্বত্র।  দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগনিত ভক্ত অনুরাগী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের  আমন্ত্রনে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং  কোরআনের  তাফসির করেছেন।

আপিল বিভাগে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে এ মামলায় শুনানী পেশ শুরু করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এরপর তার অনুপস্থিতিতে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান শুনানী পেশ এবং যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন। এছাড়া এ মামলার আপিল শুনানীর সময় বিভিন্ন পর্যায়ে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন অংশগ্রহণ করেছেন।
আসামী পক্ষে অন্যান্য আইনজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তাজুল ইসলাম, তারিকুল ইসলাম, মহিনুর ইসলাম, মতিয়ার রহমান, আবু বকর সিদ্দিক, মোসাদ্দেক বিল্লাহ।