রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৪

মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড



 মেহেদী হাসান ০২/১১/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ একটি অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে সর্বসম্মতভাবে ও আরেকটি অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।

এছাড়া অপর আরো আটটি অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মোট ১৪টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে দুটিতে মৃত্যুদণ্ডসহ মোট ১০টি অভিযোগে তাকে সাজা দেয়া হয়েছে। অপর চারটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়। 

যে আটটি অভিযোগে তাকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে একটিতে ২০ বছর, একটিতে ১০ বছর এবং বাকী ছয়টির প্রত্যেকটিতে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। একটির পর একটি এ সাজা ভোগ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২  আজ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষনা করেন।

যে কারনে সাজা : রায়ে বলা হয়েছে মীর কাসেম আলী ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন এবং পরে একই কলেজে বিএসসি (সম্মান) ভর্তি হন। এসময় তিনি ১৯৭০ থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ মেয়াদে কলেজে তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর  তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারন সম্পাদক হন । রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আনা অভিযোগের বরাত দিয়ে  বলা হয় স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়  মীর কাসেম আলী রাজাকার বাহিনী, আলী আলবদর এবং আলশামসের কেন্দ্রীয় কমান্ডারদের একজন ছিলেন। চট্ট্রগ্রামে সংঘটিত  বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।  তার নেতৃত্বে, পরিকল্পনায় এবং নির্দেশে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় অবস্থিত মহামায়া বা ডালিম হোটেলে মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাপন্থী লোকজনকে অপহরন করে এনে নির্যাতন, হত্যা এবং গুম করা হয়। এক পর্যায়ে ডালিম হোটেলটি আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প এবং  নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতাপন্থী লোকজনের ওপর ধারাবাহিকভাবে নির্যাতন চালানো হয়। মীর কাসেম আলীর জ্ঞাতসারে  এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ডালিম হোটেলে সংঘটিত হয়েছে। তার নেতৃত্বে এসব অপরাধ পরিচালিত হয়েছে। তিনি ছিলেন এসব ক্ষেত্রে চালকের আসনে। আলবদর কমান্ডার হিসেবে এ বাহিনীর  সদস্যদের ওপর তার কার্যকরী নিয়ন্ত্রন ছিল। তাই উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায় হিসেবে এসব অপরাধের জন্য দায়ী মীর কাসেম আলী।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২ অভিযোগ : মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১১ এবং ১২ নং অভিযোগ ছিল নির্যাতন এবং হত্যার অভিযোগ। এ দুটি অভিযোগেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

১১ নং অভিযোগে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালে নভেম্বর মাসের কোন এক দিন মীর কাসেম আলীর পরিকল্পনায়  জসিম উদ্দিন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ঈদুল ফিতরের পর দিন অপহরন করে আলবদর ক্যাম্প ডালিম হোটেলে নিয়ে আসা হয়। মীর কাসেম আলীর নির্দেশে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাকে  নির্যতন করে হত্যা করে। পরে জসিমসহ আরো পাঁচজনের লাশ কর্নফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়ে। জসিমের সাথে অপর নিহত যে  পাঁচজনের লাশ নদীতে ফেলা হয় তারাও ডালিম হোটেলে বদর বাহিনীর নির্যাতনে নিহত হয়।
এ অভিযোগে মীল কাসেম আলীকে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সর্বসম্মতভাবে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।

১২ নং অভিযোগে বলা হয় মীর কাসেম আলীল পরিকল্পনা এবং নির্দেশে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের কোন একদিন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, টন্টু সেন ও রঞ্জিত দাসকে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসা হয়। জাহাঙ্গীর আলম পরে ছাড়া পেলেও টুন্টু সেন ও রঞ্জিত দাস নির্যাতনে নিহত হয়। পরে তাদের লাশ গুম করা হয়। এ অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সংখ্যাগরিষ্ঠের (২:১) ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়। 


নজিরবিহীন নিরাপত্তা : রায় ঘোষনা উপলক্ষে গতকাল ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। বিপুল সংখ্যক র‌্যাব, আর্মড পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য নিয়োজিত করা হয়। পাস নিয়ে যেসব সাংবাদিক, আইনজীবী এবং দর্শনার্থী ট্রাইব্যুনাল কক্ষে প্রবেশ করেন তাদের দেহ কঠোরভাবে তল্লাসী করা হয়। এর আগে দুই ট্রাইব্যুনাল মিলিয়ে আরো দশটি রায় ঘোষনা করা হয়েছে। তার কোনটিতেই নিরাপত্তা নিয়ে এত কড়াকড়ি লক্ষ্য করা যায়নি। গতকালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মত।
তাছাড়া আজকের  রায় ঘোষনার সাথে অতীতের রায় ঘোষনার ধরনের মধ্যে  কিছু ভিন্নতা লক্ষ্যনীয় ছিল। যেমন অতীতের সবগুলো রায় বেশ সময় নিয়ে ট্রাইব্যুনালে পড়ে শোনানো হয়েছে। আজ ৪০ মিনিটের মধ্যেই শেষ করা হয় রায় ঘোষনা। অতীতে তিনজন বিচারপতি পর্যায়ক্রমে রায় পড়ে শুনিয়েছেন। আজ  শুধুমাত্র চেয়ারম্যান (ট্রাইব্যুনাল-২) বিচারপতি ওবায়দুল হাসান রায় পড়ে শোনান। এসময়  ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মুজিবুর রহমান ও বিচারপতি শাহীনূর ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষনা উপলক্ষে মীর কাসেম আলীকৈ ১০টা ৪৩ মিনিটের সময় কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। এর অল্প  কিছুক্ষন পর  কোর্ট বসে। ট্রাইব্যুনাল কক্ষে আনার পর মীর কাসেম আলীকে সবাইকে উচ্চস্বরে সালাম দেন। রায় ঘোষনার পর মীর কাসেম আলী কাঠগড়ায় দাড়িয়ে বলেন, এটা একটা ফরমায়েসী রায়। সত্যের বিজয় হবে শীঘ্রই। এরপর তাকে আবার ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে দুপুরের খাবার গ্রহণ শেষে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত যে ১১টি রায় ঘোষনা করা হয়েছে তার অধিকাংশই জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে।

সাজাপ্রাপ্ত অপর আট অভিযোগ : মীর কাসেম আলীকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও অপর আটটি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। তবে এ সাজা একটির পর একটি ভোগ করতে হবেনা। আটটির মধ্যে যে অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজা  দেয়া হয়েছে সেটা ভোগ করলেই বাকীগুলো ওই সাজাভোগের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া আটটি অভিযোগ নিম্নে উল্লেখ করা হয়।
২ নং অভিযোগ : আসামীর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর চাকতাই থেকে লুৎফর রহমান ফারুককে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয় এবং বাড়িঘরে আগুন দেয়া  হয়। এ অভিযোগে ২০ বছর সাজা দেয়া হয়েছে।
৩ নং অভিযোগ : ২২ অথবা ২৩ নভেম্বর আসামীর নেতৃত্বে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে তার কদমতলা বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা দেয়া হয়েছে।
৪ নং    অভিযোগ :  ডাবলমুরিং থানায় সাইফুদ্দিন খানকে তার নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে আল বদর বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
৬ নং অভিযোগ : চট্টগ্রাম শহরের একটি চায়ের দোকান থেকে হারুনুর রশিদ নামে একজনকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেল এবং সালমা মঞ্জিলে নির্যাতন করা হয়। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
৭ নং অভিযোগ : মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে সাত/আট জন যুবক ডাবলমুরিং থানা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরী,  হাবিবুর রহমান, ইলিয়াসকে  ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়।  এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
৯ নং অভিযোগ : ২৯ নভেম্বর সৈয়দ মো : এমরান হোসেন, কামাল উদ্দিন, জামালউদ্দিন, সরওয়ার উদ্দিন,  গোলাম কিবরিয়া, গোলাম রহমান এ   ছয় জনকে অপহরন ও নির্যাতন। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
১০ নং অভিযোগ : আসামীর নির্দেশে মো : যাকারিয়া, এসকèাদার আলম, চারজনকে অপহরন ও নির্যাতন। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
১৪ নং অভিযোগ ধ  নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরন ও নির্যাতন  । এ অভিযোগে ১০ বছর সাজা দেয়া হয়েছে মীর কাসেম আলীকে।

খালাস পাওয়া চার অভিযোগ : মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আনীত ১৪ টি অভিযোগ থেকে চারটিতে খালাস দেয়া হয়েছে । এগুলো হল
 ১ নং অভিযোগ  : মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর ওমরুল ইসলাম চৌধুরীকে  চাকতাই ঘাট থেকে অপহরন রা হয়। এরপর তাকে কয়েক দফায় চট্টগ্রামের আন্দর কিল্লাস্থ ডালিম হোটেল, পাচলাইশ থানার সালমা মঞ্জিল এবং একটি চামড়ার গুদামে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
৫ নং অভিযোগ : ২৫ নভেম্বর আনোয়ারা থানার আব্দুল জব্বারকে  তার নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে মীর কাসেম আলীর সামনে হাজির করা হয় । এরপর তাকে নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়া হয়।
৮ নং অভিযোগ : ২৯ নভেম্বর রাতে নুরুল কুদ্দুস, মো : নাসির, নুরুল হোসেনসহ চারজনকে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন।
১৩ নং     অভিযোগ : সুনীল কান্তিকে অপহরন ও নির্যাতন।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
গত চার মে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায় ঘোষনা অপেক্ষমান রাখা হয়। ২০১২ সালের   ১৭ জুন মীর কাসেম আলীকে  ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১  এর নির্দেশে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।

গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন  করে। এরপর এ মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় আসামী পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার মীর আহমাদ, আসাদ উদ্দিন, আবু বকর সিদ্দিক, হাসানুল বান্না প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, সুলতান মাহমুদ সিমন ও তুরিন আফরোজ।

মীর কাসেম আলীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
মীর কাসেম আলী ১৯৫২ সালে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার চাকরির সুবাদে তিনি ১৯৬৫ সাল থেকে  চট্টগ্রামে বসবাস করেন এবং ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করেন।

রাজনীতির অঙ্গন ছাড়াও একজন সংগঠক এবং  উদ্যোক্তা হিসেবে  ব্যাংকিং, চিকিৎসা, শিক্ষা, পুনর্বাসন, আবাসন, গণমাধ্যম, পর্যটন পরিবহন খাতসহ  আর্থ  সামাজিক বিভিন্ন  ক্ষেত্রে মীর কাসেম আলীর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রয়েছে। 







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন