মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৪

কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ :রিভিউ’র অধিকার পাবে দন্ডিতরা

 
মেহেদী হাসান, ২৫/১১/২০১৪
আাপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ বা পুনরায় বিবেচনার জন্য  আবেদন করার সুযোগ পাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দন্ডিতরা।

আপিল বিভাগ আজ  আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে। রায়ে বলা হয়েছে রিভিউ আবেদন সমর্থনীয় (মেনটেনঅ্যাবল)। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবেনা। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে হবে। রায়ে আরো বলা হয়েছে ১৯৭৩ সালের আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দন্ডিতদের ক্ষেত্রে জেলকোডের সাত অথবা ২১ দিনের নিয়ম প্রযোজ্য নয়। রায়ে বলা হয়েছে  মেরিট না থাকায় আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করা হয়েছে । 

আপিল বিভাগের এ রায়ের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হল যে, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ এবং রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তির আগে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কোন সুযোগ নেই। সেই সাথে তিনি রিভিউ আবেদন করতে পারবেন কি পারবেননা তা নিয়ে বিতর্কেরও অবসান হল।

যুদ্ধাপরাধ তথা ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পরবর্তীতে যদি আপিল বিভাগ কোন রায় দেন তাহলে সে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করার সুযোগ থাকছে।  তবে রিভিউ’র এ সুযোগ আপিলের সমান নয় বলে আজকের  রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাধারনত কোন মামলায় আপিল বিভাগ কর্তৃক পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের  ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ করতে হয়। তবে আজকের  রায়ে আপিল বিভাগ উল্লেখ করেছেন ১৯৭৩ সালের আইনে দন্ডিতদের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য নয়। এ ক্ষেত্রে ৩০ দিনের পরিবর্তে ১৫ দিন কমিয়ে আনা হয়েছে। 

গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন। পাঁচ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। আট ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল থেকে মৃত্যুপরোয়ানা পাঠানো হয়। ১০ ডিসেম্বর সরকার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগ নেয়। রাত ১২টা এক মিনিটে ফাঁসি কার্যকরের সমস্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়। এর  প্রেক্ষিতে রাতেই আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে সিনিয়র আইনজীবীরা ছুটে যান চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর বাসায়। সেখানে তারা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত করা বিষয়ে এবং রিভিউ আবেদন জমা দেন। চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন রাত সাড়ে দশটায় আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর স্থগিত করে আদেশ দেন। পরের দিন ১১ ডিসেম্বর সকালে প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের  আপিল বেঞ্চে শুনানী শুরু হয়  রিভিউ আবেদন এবং মৃত্যুদণ্ড স্থগিত আদেশ এর মেয়াদ বাড়ানো বিষয়ক আবেদনের ওপর। ওইদিন শুনানী অসমাপ্ত অবস্থায় আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়। ১২ ডিসেম্বরও চলে শুনানী। শুনানী শেষে আদালত আব্দুল কাদের মোল্লার  রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। ওই দিন রাতেই কার্যকর করা হয় ফাঁসি।

পাঁচ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরপরই  তুমুল  বিতর্ক শুরু হয় আব্দুল কাদের মোল্লা রিভিউ করার সুযোগ পাবেন কি পাবেননা তা নিয়ে। আসামী পক্ষ দাবি করেন তিনি রিভিউ সুযোগ পাবেন। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অন্যান্যরা দাবি করেন তিনি এ সুযোগ পাবেননা। বিতর্কের এ পর্যায়ে এক পক্ষ মত দেন বিষয়টি এখন আপিল বিভাগই নিষ্পত্তি করতে পারে। এভাবে বিতর্ক নিষ্পত্তি হবার আগেই সরকার ১০ ডিসেম্বর ফাঁসি কার্যকরের ঘোষনা দেয়। আসামী পক্ষ অপেক্ষায় ছিল  ৩০ দিনের মাথায় তারা রিভিউ আবেদন করবে । কিন্তু ১০ তারিখ সরকার ফাঁসি কর্যকরের উদ্যোগ নেয়ায় তারা বাধ্য হয়ে ছুটে যান চেম্বার বিচারপতির কাছে এবং ওই রাতেই তারা রিভিউ আবেদন দায়ের করে। ১২ ডিসেম্বর আদালত রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। কিন্তু কোন গ্রাউন্ডে এটি খারিজ করা হয় সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত রায়ে তখন কোন কিছু উল্লেখ ছিলনা। রিভিউ আবেদন কি মেনটেন্যাবল নয় না কি এর কোন মেরিট নেই সে গ্রাউন্ডে খারিজ করা হয়েছে আবেদন তার কোন কিছু বলা হয়নি। গতকাল পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে আবেদনে মেরিট না থাকায় আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করা হয়েছে। তবে রিভিউ আবেদন মেনটেনঅ্যাবল।

গত ৩ নভেম্বর মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগ রায় ঘোষনা করেন। রায় ঘোষনার পর আবারো শুরু হয় রিভিউ নিয়ে বিতর্ক তুমুল। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বারবার স্পষ্ট করে বলেন, কামারুজ্জামান রিভিউ করার সুযোগ পাবেননা। ফাঁসি কার্যকরের জন্য পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষারও দরকার নেই। সংক্ষিপ্ত রায়ের কপি দিয়েই দণ্ড কার্যকর করা যাবে। কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও সাংবাদিকদের বলেন, কামারুজ্জামান প্রাণ ভিক্ষার জন্য সাত দিন সময় পাবেন। এরপরই তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। ফাঁসি কার্যকর করার জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে প্রস্তুতির নিদের্শ দেয়ার কথাও জানান তিনি।
অপর দিকে আসামী পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হয় কামারজ্জামান রিভিউ করার সুযোগ পাবেন এবং পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে দণ্ড কার্যকরের কোন সুযোগ নেই। এটা হবে বেআইনী । ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুরি জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে তার নির্দেশনাকেও আইন এবং কর্তৃত্ব বহির্ভূত হিসেবে আখ্যায়িত করেন আসামী পক্ষের আইনজীবী শিশির মনির। বির্তকের এক পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল তার অবস্থান থেকে সরে এসে শেষে বলেন রিভিউ করার সুযোগ পাবেন কি পাবেননা এ বিষয়টি আপিল বিভাগের ওপর নির্ভর করছে।
এ অবস্থায় আজ আপিল বিভাগ এ রায় প্রকাশ করলেন। আর এর মাধ্যমে রিভিউ এবং কামারুজ্জামানের ফাঁসি কবে কার্যকর হবে এ নিয়ে বিতর্কের অবসান হল।
আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন শুনানী গ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী।
মুহম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষে অ্যাডভোকেট শিশির মনির দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, মৃত্যু পরোয়ানা জারির পর ২১ দিনের আগে নয় এবং ২৮ দিনের পরে নয় এমন যেকোন সময় ফাঁসি কার্যকর করার বিধান। এর মধ্যে সাত দিন সময় থাকে প্রাণভিক্ষার আবেদনের জন্য। যেহেতু ১৯৭৩ সালের আইনে দন্ডিতদের ক্ষেত্রে জেলকোডের সাত অথবা ২১ দিনের বিষয়টি প্রযোজ্য নয় বলে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে তার মানে এটা এখন সরকারের হাতে। মৃত্যুপরোয়ানা জরির পর সরকার যখন চাইবে তখন ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে।
গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।  এ রায়কে কেন্দ্র করে  শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠে । আন্দোলনকারীদের দাবি আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে হবে। এ  দাবির প্রেক্ষিতে  ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়  সরকার পক্ষের জন্য আপিলের বিধান রেখে।  আইন সংশোধনের পর সরকার আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে আপিল আবেদন করে।  ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন  সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ডের রায় দেন।

১৯৭৩ সালের আইনে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা বলা আছে কিন্তু  রিভিউর কথা বলা নেই। অপরদিকে বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৫ ধারায় আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে নাগরিককে রিভিউ করার অধিকারের কথা বর্ণিত হয়েছে।

সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৪

মোবারক মৃত্যুদণ্ড

মেহেদী হাসান ২৪.১১.১৪
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং আরেকটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ  মোবারকের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের এ রায় ঘোষনা করেন।

১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা ও নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল মোবারকের বিরুদ্ধে। তিনটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। 

মোবারকের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগের মধ্যে ১নং অভিযোগ হল- আখাউড়া থানার টানমান্দাইল ও জাঙ্গাইল গ্রামে ৩৩ জনকে হত্যা এবং ৩নং অভিযোগ হল- ছাতিয়ান গ্রামের আবদুল খালেককে হত্যা। ট্রাইব্যুনালের রায়ে এই দুই অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের ২, ৪ ও ৫ নং অভিযোগ তিনটি প্রমাণিত না হওয়ায় এ অভিযোগগুলো থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ২নং অভিযোগ হল- আনন্দময়ী কালীবাড়ী রাজাকার ক্যাম্পে আশুরঞ্জন দেবকে নির্যাতন। ৪ নং অভিযোগ হল- শ্যামপুর গ্রামের দু’জনকে অপহরণ করে একজনকে হত্যা এবং ৫নং অভিযোগ হল- খরমপুর গ্রামের একজনকে আটক রেখে নির্যাতন।

যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড: ’৭১ সালের ২২ আগস্ট মোবারক হোসেনসহ অন্য রাজাকাররা আখাউড়ার টানমান্দাইল গ্রামে হাজি নূর বকশের বাড়িতে সভা ডাকেন। ওই বাড়িতে ১৩০ বা ১৩২ জন গ্রামবাসীকে জড়ো করা হয়। মোবারক ও তার সহযোগীরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামবাসীদের আটক করে গঙ্গাসাগর দীঘির কাছে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখেন। আটক ব্যক্তিদের মোবারক ও তার সহযোগীরা জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করেন। এছাড়া তিনি টানমান্দাইল গ্রামের ২৬ জন ও জাঙ্গাইল গ্রামের সাতজনসহ ৩৩ জনকে বাছাই করে তেরোঝুড়ি হাজতখানায় নিয়ে যান। ২৩ আগস্ট পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা ওই ৩৩ জনকে দিয়ে গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে গুলি করে হত্যা করে একটি গর্তে মাটি চাপা দেয়। এ অপরাধের দায়ে মোবারককে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

যে অভিযোগে যাবজ্জীবন: মোবারকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে তৃতীয় অভিযোগ হল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাতিয়ান গ্রামের আবদুল খালেক মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। ’৭১ সালের ১১ নভেম্বর রাত ৮টা বা ৯টার দিকে মোবারক সশস্ত্র রাজাকার সহযোগীদের নিয়ে খালেককে অপহরণ করে সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করেন। ওই রাতে খালেককে তিতাস নদীর পশ্চিম পাড়ে বাকাইল ঘাটে নিয়ে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। এই অভিযোগে মোবারককে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

মোবারকের বিরুদ্ধে মোট ৯২ পৃষ্ঠা রায়ে মূল অংশ আদালতে পড়ে শোনানো হয়। মোবারক ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় বসে রায় শোনেন। এর আগে সকাল ৯টায় তাকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। ট্রাইব্যুনালে মোবারকের দুই ছেলে আসাদুল্লাহ ও নজিবুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।  

ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর এ মামলার প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, দুই অভিযোগে একটিতে মোবারকে মৃত্যুদণ্ড এবং একটিতে যাবজ্জীবন কারা দণ্ড প্রদান করেছেন। এজন্য আমরা সন্তুষ্ট। যে তিনটি অভিযোগ থেকে মোবারককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তা আমরা পর্যালোচনা করব। মোবারকের বয়স সম্পার্কে তিনি বলেন, আসামীপক্ষ বলছে মোবারকের জন্ম ১ জুলাই ১৯৫৬ সালে। তারা বলতে চাইছে তিনি ঘটনার সময় নাবালোক ছিলেন। আমরা ভোটার লিস্ট ও অন্যান্য ডকুমেন্ট দিয়ে দেখিয়েছি মোবারকের জন্ম ১০ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে। আদালত এটি গ্রহণ করেছেন।

অন্যদিকে আসামীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ মোবারকের বিষয়ে যে সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করেছে তাতে কোনভাবেই আসামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায় না। এই মামলার সাক্ষ্য প্রমাণে যে নানা রকম বৈপরিত্য ও অসংগতি রয়েছে তা আমরা ট্রাইব্যুনালে দেখিয়েছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযুদ্ধের উপর যেসব বই রয়েছে তাতে এই পাঁচটি ঘটনার কথা উল্লেখ থকলেও একটি ঘটনায়ও মোবারকের নাম আসেনি। তিনি বলেন, আমরা তথ্য প্রমাণ দেখিয়ে বলেছি মোবারকের জন্ম তারিখ ১ জুলাই ১৯৫৬। এই হিসেবে ’৭১ সালে আসামীর বয়স ছিল ১৪ বা ১৫ বছর। তিনি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন এবং নাবালোক ছিলেন। তিনি আরো বলেন, রায়ের পর আমি মোবারক হোসেনের সাথে কথা বলেছি। তিনি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন দ্বায়ের করবেন। আসাকরি আপিলে আমরা ন্যায় বিচার পাব। 
এর আগে গত ২ জুন মোবারক হোসেনের মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষামান (সিএভি) রাখা হয়। রোববার মামলাটি ট্রাইব্যুনালের কার্যতালিকায় আসে এবং সোমবার আদালত রায় দেবেন বলে ঘোষণা দেন।
গত বছর ২০ মে মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের স্যাগ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন সাী মোবারকের বিরুদ্ধে স্যা দিয়েছে।
গত বছরের ১২ মার্চ মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
রাষ্ট্রক্ষর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ’৭১ সালের একটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে ২০০৯ সালের ৩ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মোবারকের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। তখন তিনি হাইকোর্ট থেকে অন্তবর্তীকালীন জামিন নেন। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর তার মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

মোবারক হোসেন ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার আখাউড়া থানার নয়াদিল গ্রামের সাদত আলীর ছেলে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করতেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তবে মোবারক হোসেনের ট্রাইব্যুনালে দাবি করেছিলেন তিনি কখনোই জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। পূর্ব থেকেই তিনি আওয়ামী লীগ করতেন।
আখাউড়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে হাজী মোবারক হোসেন আখাউড়া মোগড়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন ।

হাজী মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার চিফ জুড়িশিয়াল মেজিস্ট্রেট এর কাছে অভিযোগ করেন খোদেজা বেগম নামে জনৈক মহিলা। অভিযোগ মতে  খোদেজা বেগমের পিতা   আব্দুল খালেক ছিলেন আনছার কমান্ডার ।   যুদ্ধের সময় তার পিতা গ্রামে আসার পর  তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যা ঘটনায় হাজী মোবারককে অভিযুক্ত করে খোদেজা বেগম মামলা করেন।

মামলা দায়েরের পর হাজী মোবারক হোসেন হাইকোর্টে  হাজির হয়ে প্রথমে ছয় মাসের জামিন পান। এরপর কয়েকবার জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৪ জুলাই তাকে সংশ্লিষ্ট মেজিস্ট্রেট এর কাছে আত্মসমর্পনের নির্দেশ দিলে তিনি  ঐ বছর ১৯ অক্টেবার   আত্মসমপর্ন করেন।  সেই থেকে তিনি বন্দী  ছিলেন। বন্দী থাকা অবস্থায় ২০১২ সালে তার মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই থেকে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। একই বছর ১৬ জুলাই তিনি  ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে জামিনে মুক্তি পান। সেই থেকে তিনি গত ১২ মার্চ পযন্ত মুক্ত ছিলেন। ১২ মার্চ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। 


বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৪

নগরকান্দা মেয়র খোকনের মৃত্যুদণ্ড


 মেহেদী হাসান, ১৩/১১/২০১৪
ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র জাহিদ হোসেন খোকনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ছয়টি অভিযোগে তাকে এ দণ্ড দেয়।  এছাড়া অপর চারটি অভিযোগে খোকনকে মোট ৪০ বছর কারাদণ্ড দেয়া  হয়েছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ  তার বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষনা করে।

বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে জাহিদ হোসেন খোকন পালাতক রয়েছেন। তার অনুপস্থিতিতেই বিচার সম্পন্ন করে ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করেন। খোকনের অনুপস্থিতে বিচারের জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে তার পক্ষে আবদুস শুকুর খানকে আইনজীবী নিয়োগ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র জাহিদ হাসান খোকন পৌর বিএনপির সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন।

ট্রাইব্যুনালে  জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে  ১০টি অভিযোগে দোষীসাব্যস্ত করে সাজা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া একটি অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় ওই অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।  

খোকনকে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরন, লুটপাট, হিন্দুদের দেশ থেকে জোর করে নির্বাসনে পাঠানো ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগের পৃথক ছয়টি অপরাধের ঘটনায় তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া একটি অভিযোগে ২০ বছর, একটিতে ১০ বছর এবং অপর দুটি অভিযোগে পৃথকভাবে ৫ বছর-৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।

সকাল ১১টা থেকে আদালত রায় প্রদান শুরু করেন। মোট ১০৯ পৃষ্ঠার রায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ট্রাইব্যুনাল পাঠ করেন।   
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, আসামি রায় ঘোষণার পর থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল আবেদন করতে পারবেন। যদি এ সময়ের মধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারে অথবা তিনি যদি আত্মসমর্পন বরেন তাহলে তিনি আপিলের সুযোগ পাবেন ।  এছাড়া যে দিন খোকন গ্রেফতার হবেন, সেই দিন থেকে রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া যাবে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

খোকনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগগুলো হল, ’৭১ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুলাই তারিখের মধ্যে ফরিদপুরের নগরকান্দায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, দেশত্যাগে বাধ্যকরা, অগ্নিসংযোগ নির্যাতনসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠন করেন। এর মধ্যে ১৬ জন নারী ও শিশুসহ ৫০ জন গ্রামবাসীকে হত্যা, তিনজনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, ২ জনকে ধর্ষণ, ১৭ জনকে আটক রেখে নির্যাতন, ৯ জনকে ধর্মান্তরিত করা, ২টি মন্দিরসহ ১০টি গ্রামের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, সাতজন গ্রামবাসীকে সপরিবারে দেশান্তরে বাধ্য করা ও ২৫ জনকে নির্যাতন।
জাহিদ হোসেন খোকনের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল বলেন,  এ মামলায় বেশিরভাগ ভিকটিম পরিবার সাক্ষ্য দিয়েছে। ’৭১ সালে জাহিদ হোসেন খোকন যে অপরাধ করেছেন, তা আজ রায়ের মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছে। এ রায়ে ভিকটিমের পরিবারের সাথে আমরাও সন্তুষ্ট।

অপর প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, আসামী অপরাধী না হলে পালাতক থাকতেন না। তার পলাতক থাকায় প্রমাণ হয় তিনি উল্লেখিত অপরাধ করেছেন। তিনি আরো বলেন, আসামী যে দিন গ্রেফতার হবে সেই দিন থেকে রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া যাবে।
অন্যদিকে খোকনের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস সুকুর খান রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ রায়ে আমি আমি খুশি নই। কারণ আসামী ন্যায় বিচার পাননি। ’৭১ সালে জাহিদ হোসেন খোকন আনসার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তিনি বলেন, এখন আসামীর উচিত আত্মসমর্পন করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল আবেদন করা। তাহলে আসামী ন্যায় বিচার পাবেন। সুকুর খান আরো বলেন, এ মামলায় আসামীর পরিবার থেকে কোনো সহায়তা পাননি। নিরাপত্তার কারণে আসামী পক্ষে সাক্ষ্য দেয়া সম্ভব হয়নি। আসামী পক্ষে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিলে এ মামলার রায় অন্যরকম হতে পারতো।

মামলার বিবরণ:
গত বছর ১৮ জুলাই জাহিদ হোসেন খোকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের ১১টি অভিযোগে খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়।
পালাতক জাহিদ হোসেন খোকনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই দুটি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে তাকে হাজির করতে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে দৈনিক জনকণ্ঠ ও ডেইলি স্টারে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু তিনি হাজির না হওয়ায়  ওই বছরের ১৪ আগস্ট তার অনুপস্থিতিতেই বিচার  শুরু করা নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে খোকনের পে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী আবদুস শুকুর খানকে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ২৩ জুন খোকনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দখিল করা হয়।
২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর খোকনের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তার মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর থেকে গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন দাশসহ খোকনের বিরুদ্ধে মোট ২৪ জন সাী সাক্ষ্য প্রদান করেন। 
গত ১৩ এপ্রিল থেকে খোকনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এরপর খোকনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আইনজীবী আবদুস শুকুর খান।
গত ১৭ এপ্রিল জাহিদ হোসেন খোকনের বিচার  কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে রায়ের জন্য অপেক্ষামান রাখা হয়।

সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৪

কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল// আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়

মেহেদী হাসান  ০৩/১১/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামানের  মৃত্যুদণ্ড বহালা রাখা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ  সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রাখেন।

বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ আজ মুহম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। আজ আপিল বেঞ্চ এর মধ্যে একটি অভিযোগে ( ৩ নং অভিযোগ সোহাগপুর গণহত্যা)  তার মৃত্যুদণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বহাল রাখেন। মৃত্যুদন্ডের আরেকটি শাস্তি  বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া  হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মোট সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে  পাঁচটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা  দেয় ট্রাইব্যুনাল। ৩ এবং ৪ নং অভিযোগে  মৃত্যুদণ্ড, ১ এবং ৭ নং অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং ২ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
আজ আপিল বিভাগের রায়ে ২ এবং ৭ নং অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত  সাজা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে বহাল রাখা হয়। ১ নং অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়।
আপিল বিভাগের রায়ে যে অভিযোগে মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়েছে সেটিতে মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে সর্বসম্মতভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং  মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে। আর মৃত্যুদন্ডের যে সাজা বাতিল করে যাবজ্জীবন করা হয়েছে সেটিতে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে।

গত বছর ৯ মে ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়  ট্রাইব্যুনাল-২।

মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আপিল করে আসামী পক্ষ।  গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শেষে রায় ঘোষনা অপেক্ষমান রাখা হয়।

গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর  জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ মৃত্যুদন্ডের চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করেন।
আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় গত বছর ৫ ডিসেম্বর । পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রিভিউ আবেদন করা যাবে কি যাবেনা এ নিয়ে বিতর্ক চলা অবস্থায় ১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত ১২টার পর ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নেয়া হয় এবং সরকার ও জেল কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষনাও দেয়া হয়। ওই দিনই  রাত সোয়া দশটায় সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর পরের দিন বুধবার সকাল দশটা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। ১২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পর রাতে কার্যকর করা হয় আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও রায় :
রাষ্ট্রপক্ষের আনিত অভিযোগে এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ে মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক এবং তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ হিসেবে শেরপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, আলবদর এবং রাজাকার বাহিনী কর্তৃক স্বাধীনতাপন্থী লোকজনকে হত্যা, নির্যাতন, অপহরন গুম, ধর্ষনসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় আনা হয়েছে কামারুজ্জামানের ওপর।  শেরপুরে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের  মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড তার পরামর্শ এবং  সহযোতিায়  পরিচালিত হত বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়।

মুহম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনিত সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে সাজা দেয়। এ পাঁচটি অভিযোগ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল বিভাগের সাজা এখানে উল্লেখ করা হল।

১ নম্বর অভিযোগ : বদিউজ্জামানকে অপহরন করে আহমেদনগর আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা। এ হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে।

২ নম্বর অভিযোগ : শেরপর কলেজের অধ্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় উলঙ্গ করে শহরে প্রদণি করানো এবং পেটানো হয়।  এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগে এ সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
৩ নম্বর অভিযোগ : ১৯৭১ সালে কামারুজ্জামানের পরামর্শে পাকিস্তান আর্মি দেশীয় রাজাকার এবং আলবদর সদস্যদের সাথে নিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে অভিযান চালায়। অভিযানে ওই গ্রামে দেড়শতাধিক মানুষ নিহত হয় এবং অসংখ্য নারী ধর্ষনের শিকার হয়। এ গণহত্যার অভিযোগে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ সাজা বহাল রেখেছে।
৪ নম্বর অভিযোগ : শেরপর মোস্তফবাগ থেকে গোলাম মোস্তফাকে ধরে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। এরপর তাকে কামারুজ্জামানসহ অন্যান্যরা মিলে একটি ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে যাবজ্জীবন দিয়েছে।  
৭ নম্বর অভিযোগ : মুক্তিযুদ্ধচলাকালে ময়মনসিংহ গোলাপজান রোডে টেপা মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে টেপা মিয়া এবং তার ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলাপরিষদ ডাকবাংলায় অবস্থিত আলবদর ক্যাম্পে আনা হয়। পরেরদিন সকালে তারা দুজনসহ সাতজনকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর তীরে আনা হয়। এসময় টেপা মিয়া নদীতে ঝাপ দিয়ে রক্ষা পায় এবং বাকীদের হত্যা করা হয়। এ অভিযোগের সাথে সংশ্লিষ্টতার  ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ।  আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে এ দণ্ড বহাল রাখা হয়।




মুহম্বদ কামারুজ্জামানের আপিল শুনানীর জন্য বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের আপিল বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক ও বিচারপতি এএইচএম শাসসুদ্দীন চৌধুরী।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছর ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

কামারুজ্জামানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালে শেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি  জিকে স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এরপর জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে আইএসসি’তে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে নাসিরাবাদ কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন। কামারুজ্জামান গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা কিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাস করেন। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তিনি  সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি দৈনিক সংগ্রমের নির্বাহিী সম্পাদক ছিলেন। 



রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৪

মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড



 মেহেদী হাসান ০২/১১/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ একটি অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে সর্বসম্মতভাবে ও আরেকটি অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।

এছাড়া অপর আরো আটটি অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মোট ১৪টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে দুটিতে মৃত্যুদণ্ডসহ মোট ১০টি অভিযোগে তাকে সাজা দেয়া হয়েছে। অপর চারটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়। 

যে আটটি অভিযোগে তাকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে একটিতে ২০ বছর, একটিতে ১০ বছর এবং বাকী ছয়টির প্রত্যেকটিতে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। একটির পর একটি এ সাজা ভোগ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২  আজ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষনা করেন।

যে কারনে সাজা : রায়ে বলা হয়েছে মীর কাসেম আলী ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন এবং পরে একই কলেজে বিএসসি (সম্মান) ভর্তি হন। এসময় তিনি ১৯৭০ থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ মেয়াদে কলেজে তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর  তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারন সম্পাদক হন । রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আনা অভিযোগের বরাত দিয়ে  বলা হয় স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়  মীর কাসেম আলী রাজাকার বাহিনী, আলী আলবদর এবং আলশামসের কেন্দ্রীয় কমান্ডারদের একজন ছিলেন। চট্ট্রগ্রামে সংঘটিত  বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।  তার নেতৃত্বে, পরিকল্পনায় এবং নির্দেশে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় অবস্থিত মহামায়া বা ডালিম হোটেলে মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাপন্থী লোকজনকে অপহরন করে এনে নির্যাতন, হত্যা এবং গুম করা হয়। এক পর্যায়ে ডালিম হোটেলটি আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প এবং  নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতাপন্থী লোকজনের ওপর ধারাবাহিকভাবে নির্যাতন চালানো হয়। মীর কাসেম আলীর জ্ঞাতসারে  এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ডালিম হোটেলে সংঘটিত হয়েছে। তার নেতৃত্বে এসব অপরাধ পরিচালিত হয়েছে। তিনি ছিলেন এসব ক্ষেত্রে চালকের আসনে। আলবদর কমান্ডার হিসেবে এ বাহিনীর  সদস্যদের ওপর তার কার্যকরী নিয়ন্ত্রন ছিল। তাই উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায় হিসেবে এসব অপরাধের জন্য দায়ী মীর কাসেম আলী।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২ অভিযোগ : মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১১ এবং ১২ নং অভিযোগ ছিল নির্যাতন এবং হত্যার অভিযোগ। এ দুটি অভিযোগেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

১১ নং অভিযোগে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালে নভেম্বর মাসের কোন এক দিন মীর কাসেম আলীর পরিকল্পনায়  জসিম উদ্দিন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ঈদুল ফিতরের পর দিন অপহরন করে আলবদর ক্যাম্প ডালিম হোটেলে নিয়ে আসা হয়। মীর কাসেম আলীর নির্দেশে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাকে  নির্যতন করে হত্যা করে। পরে জসিমসহ আরো পাঁচজনের লাশ কর্নফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়ে। জসিমের সাথে অপর নিহত যে  পাঁচজনের লাশ নদীতে ফেলা হয় তারাও ডালিম হোটেলে বদর বাহিনীর নির্যাতনে নিহত হয়।
এ অভিযোগে মীল কাসেম আলীকে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সর্বসম্মতভাবে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।

১২ নং অভিযোগে বলা হয় মীর কাসেম আলীল পরিকল্পনা এবং নির্দেশে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের কোন একদিন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, টন্টু সেন ও রঞ্জিত দাসকে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসা হয়। জাহাঙ্গীর আলম পরে ছাড়া পেলেও টুন্টু সেন ও রঞ্জিত দাস নির্যাতনে নিহত হয়। পরে তাদের লাশ গুম করা হয়। এ অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সংখ্যাগরিষ্ঠের (২:১) ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়। 


নজিরবিহীন নিরাপত্তা : রায় ঘোষনা উপলক্ষে গতকাল ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। বিপুল সংখ্যক র‌্যাব, আর্মড পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য নিয়োজিত করা হয়। পাস নিয়ে যেসব সাংবাদিক, আইনজীবী এবং দর্শনার্থী ট্রাইব্যুনাল কক্ষে প্রবেশ করেন তাদের দেহ কঠোরভাবে তল্লাসী করা হয়। এর আগে দুই ট্রাইব্যুনাল মিলিয়ে আরো দশটি রায় ঘোষনা করা হয়েছে। তার কোনটিতেই নিরাপত্তা নিয়ে এত কড়াকড়ি লক্ষ্য করা যায়নি। গতকালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মত।
তাছাড়া আজকের  রায় ঘোষনার সাথে অতীতের রায় ঘোষনার ধরনের মধ্যে  কিছু ভিন্নতা লক্ষ্যনীয় ছিল। যেমন অতীতের সবগুলো রায় বেশ সময় নিয়ে ট্রাইব্যুনালে পড়ে শোনানো হয়েছে। আজ ৪০ মিনিটের মধ্যেই শেষ করা হয় রায় ঘোষনা। অতীতে তিনজন বিচারপতি পর্যায়ক্রমে রায় পড়ে শুনিয়েছেন। আজ  শুধুমাত্র চেয়ারম্যান (ট্রাইব্যুনাল-২) বিচারপতি ওবায়দুল হাসান রায় পড়ে শোনান। এসময়  ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মুজিবুর রহমান ও বিচারপতি শাহীনূর ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষনা উপলক্ষে মীর কাসেম আলীকৈ ১০টা ৪৩ মিনিটের সময় কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। এর অল্প  কিছুক্ষন পর  কোর্ট বসে। ট্রাইব্যুনাল কক্ষে আনার পর মীর কাসেম আলীকে সবাইকে উচ্চস্বরে সালাম দেন। রায় ঘোষনার পর মীর কাসেম আলী কাঠগড়ায় দাড়িয়ে বলেন, এটা একটা ফরমায়েসী রায়। সত্যের বিজয় হবে শীঘ্রই। এরপর তাকে আবার ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে দুপুরের খাবার গ্রহণ শেষে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত যে ১১টি রায় ঘোষনা করা হয়েছে তার অধিকাংশই জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে।

সাজাপ্রাপ্ত অপর আট অভিযোগ : মীর কাসেম আলীকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও অপর আটটি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। তবে এ সাজা একটির পর একটি ভোগ করতে হবেনা। আটটির মধ্যে যে অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজা  দেয়া হয়েছে সেটা ভোগ করলেই বাকীগুলো ওই সাজাভোগের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া আটটি অভিযোগ নিম্নে উল্লেখ করা হয়।
২ নং অভিযোগ : আসামীর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর চাকতাই থেকে লুৎফর রহমান ফারুককে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয় এবং বাড়িঘরে আগুন দেয়া  হয়। এ অভিযোগে ২০ বছর সাজা দেয়া হয়েছে।
৩ নং অভিযোগ : ২২ অথবা ২৩ নভেম্বর আসামীর নেতৃত্বে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে তার কদমতলা বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা দেয়া হয়েছে।
৪ নং    অভিযোগ :  ডাবলমুরিং থানায় সাইফুদ্দিন খানকে তার নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে আল বদর বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
৬ নং অভিযোগ : চট্টগ্রাম শহরের একটি চায়ের দোকান থেকে হারুনুর রশিদ নামে একজনকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেল এবং সালমা মঞ্জিলে নির্যাতন করা হয়। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
৭ নং অভিযোগ : মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে সাত/আট জন যুবক ডাবলমুরিং থানা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরী,  হাবিবুর রহমান, ইলিয়াসকে  ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়।  এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
৯ নং অভিযোগ : ২৯ নভেম্বর সৈয়দ মো : এমরান হোসেন, কামাল উদ্দিন, জামালউদ্দিন, সরওয়ার উদ্দিন,  গোলাম কিবরিয়া, গোলাম রহমান এ   ছয় জনকে অপহরন ও নির্যাতন। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
১০ নং অভিযোগ : আসামীর নির্দেশে মো : যাকারিয়া, এসকèাদার আলম, চারজনকে অপহরন ও নির্যাতন। এ অভিযোগে সাত বছর সাজা।
১৪ নং অভিযোগ ধ  নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরন ও নির্যাতন  । এ অভিযোগে ১০ বছর সাজা দেয়া হয়েছে মীর কাসেম আলীকে।

খালাস পাওয়া চার অভিযোগ : মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আনীত ১৪ টি অভিযোগ থেকে চারটিতে খালাস দেয়া হয়েছে । এগুলো হল
 ১ নং অভিযোগ  : মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর ওমরুল ইসলাম চৌধুরীকে  চাকতাই ঘাট থেকে অপহরন রা হয়। এরপর তাকে কয়েক দফায় চট্টগ্রামের আন্দর কিল্লাস্থ ডালিম হোটেল, পাচলাইশ থানার সালমা মঞ্জিল এবং একটি চামড়ার গুদামে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
৫ নং অভিযোগ : ২৫ নভেম্বর আনোয়ারা থানার আব্দুল জব্বারকে  তার নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে মীর কাসেম আলীর সামনে হাজির করা হয় । এরপর তাকে নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়া হয়।
৮ নং অভিযোগ : ২৯ নভেম্বর রাতে নুরুল কুদ্দুস, মো : নাসির, নুরুল হোসেনসহ চারজনকে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন।
১৩ নং     অভিযোগ : সুনীল কান্তিকে অপহরন ও নির্যাতন।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
গত চার মে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায় ঘোষনা অপেক্ষমান রাখা হয়। ২০১২ সালের   ১৭ জুন মীর কাসেম আলীকে  ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১  এর নির্দেশে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।

গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন  করে। এরপর এ মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় আসামী পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার মীর আহমাদ, আসাদ উদ্দিন, আবু বকর সিদ্দিক, হাসানুল বান্না প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, সুলতান মাহমুদ সিমন ও তুরিন আফরোজ।

মীর কাসেম আলীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
মীর কাসেম আলী ১৯৫২ সালে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার চাকরির সুবাদে তিনি ১৯৬৫ সাল থেকে  চট্টগ্রামে বসবাস করেন এবং ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করেন।

রাজনীতির অঙ্গন ছাড়াও একজন সংগঠক এবং  উদ্যোক্তা হিসেবে  ব্যাংকিং, চিকিৎসা, শিক্ষা, পুনর্বাসন, আবাসন, গণমাধ্যম, পর্যটন পরিবহন খাতসহ  আর্থ  সামাজিক বিভিন্ন  ক্ষেত্রে মীর কাসেম আলীর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রয়েছে।