মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৩

মাওলানা আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন// আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা

মেহেদী হাসান, ৩১/১২/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে হত্যা, গনহত্যা, এবং মানবতাবিরোধী বিভিন্ন  অপরাধসহ মোট নয়টি অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১  তার বিরুদ্ধে আজ অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেয়। আগামী ২৮ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য এবং সাক্ষ্য গ্রহনের জন্য ধার্য্য করা হয়েছে।

অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার শুরু হল মাওলানা আবদুস সোবহানের।

মাওলানা আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে নয়টি অভিযোগ পড়ে শোনানো শেষে ট্রাইব্যুনাল তার কাছে জানতে চান আপনি কি দোষী না নির্দোষ দাবি করেন?
জবাবে মাওলানা আবদুস সোবহান বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা  মিথ্যা। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। এর সাথে আমার কোন রকম সম্পর্ক ছিলনা।

চার্জ গঠন আদেশ উপলক্ষে মাওলানা আবদুস সোবহানকে আজ ট্রাইব্যুনালে আসামীর কাঠগড়া থেকে সামনের দিকে সাক্ষী কাঠগড়ায় এনে বসানো হয়।

ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির অভিযোগ পড়ে শোনান এবং চার্জ গঠন করে আদেশ দেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মাওলানা আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে মোট নয়টি অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং নয়টি অভিযোগেই চার্জ গঠন করা হয়েছে।

১৯৭১ সালে মাওলানা আবদুস সোবহান পাবনা জেলা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির ছিলেন। সেই হিসেবে তার পরামর্শ,  নির্দেশে এবং নেতৃত্বে পাকিস্তান আর্মি  পাবনায় স্বাধীনতাপন্থীদের দমন এবং নির্মূলের জন্য ও হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট অগ্নিসংযোগ, অপহরন নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী নানাবিধ অপরাধ সংঘটন করে মর্মে অভিযোগ গঠন আদেশে  উল্লেখ করা হয়েছে। পাকিস্তান আর্মি ছাড়াও মাওলানা আবদুস সোবহানের সহযোগী হিসেবে খোদাবক্স খান এবং পাবনার অনেক  বিহারীর নাম  উল্লেখ করা হয়েছে যারা অনেক অপরাধমূলক কর্মকান্ড সংঘটিত করেছে ।

অভিযোগ :
অভিযোগ ১ : ১৯৭১ সালের ১৭ এবং ১৮ এপ্রিল যথাক্রমে পাবনার ঈশ্বরদী রেলওয়ে তেলডিপো  থেকে মোয়াজ্জেম হোসেন এবং ঈশ্বরদী জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়া মোতালেব খানকে  মাওলানা আবদুস সোবহানের নির্দেশে অপহরন করে হত্যা।

অভিযোগ ২ : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল ঈশ্বরদীর গোপালপুর এবং যুক্তিতলা গ্রামে বিভিন্ন বাড়িতে মাওলানা আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে লুটপাট এবং হামলা চালানো হয়। এতে অনেকে নিহত হয়। এ ঘটনায় আটজন নিহতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগ ৩ : ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে খোদাবক্স খানকে সাথে নিয়ে মাওলানা আবদুস সোবহান আলাউদ্দিন এবং  রিয়াজউদ্দিন মেম্বারের বাড়ি লুট করে। এছাড়া  জয়নুদ্দিন, নুরু, আনসার কমান্ডারসহ অনেককে অপরহরন করে নির্যাতান করা হয়। এ অভিযোগে ২ জন নিহতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগ ৪ : মাওলানা আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তান আর্মি ইশ্বরদীর শাহপুর গ্রামে অপারেশন পরিচালনা করে। এসময় বিভিন্ন বাড়িঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে গণহত্যা পরিচালনা করা হয়। এ ঘটনায় সাতজন নিহতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগ ৫ : মাওলানা আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তান আর্মি পাবনা সদরের কুলনিয়া এবং দোগাছি গ্রামে অভিযান চালায়। এসময় পাকিস্তান আর্মি স্বাধীনতাপন্থী অনেককে গুলি করে হত্যা করে। বাড়িঘরে আগুন দেয়।  এ ঘটনায় সাতজন নিহতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগ ৬ : ১৯৭১ সালের ১২ মে পাকিস্তান আর্মি ৩০০ সৈন্য নিয়ে সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালায়। এসময় বিভিন্ন বাড়ি ঘর লুটপাট করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় পরিচালিত গণহত্যায় কয়েকশ লোক নিহহ হয়। এদের মধ্যে ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগে।

অভিযোগ ৭ : পাবনার আটঘরিয়া ইউনিয়নে ২১ মে পাকিস্তান আর্মি অপারেশন পরিচালনা করে ১৯ জনকে হত্যা করে।
অভিযোগ ৮ :  সাবেক পাবনা সদর বর্তমানে আতাকুলা থানার দুবলিয়া বাজার থেকে দুই জন স্বাধীনতাপন্থীকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ ৯ : ১৯৭১ সালেল ২১ নভেম্বর পাবনার বেতবাড়িয়া গ্রামে পরিচালিত অপারেশনে বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট শেষে আগুন দেয়া হয়। এসময় চারজনকে অপহরন করে হত্যা করা হয়।

২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন  মাওলানা  আব্দুস সোবহানকে টাঙ্গাইল থেকে আটক করে। ২০০৩ সালে পাবনা থানায় দায়েরকৃত  মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।

২৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী (চিফ প্রসিকিউটর) গোলাম আরিফ টিপু মাওলানা আব্দুস সোবহানকে  গ্রেফতার দেখানোর (শোন অ্যারেস্ট)  আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে প্রডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যু করে ওইদিন এবং তাকে ট্রাইব্যুনালের মামলায় আটক দেখানো হয়। ২৩ তারিখে ট্রাইব্যুনালের  আদেশের প্রেক্ষিতে ৩০ সেপ্টেম্বর মাওলানা আবদুস সোবহানকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।




রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৩

ইকোনমিস্টকে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি

২৯/১২/২০১৩
লন্ডন থেকে প্রকাশিত বিশ্বখ্যাত সাময়িকী দ্যি ইকোনমিস্টকে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বহুল আলোচিত স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে  বিচার কাজে বাঁধা দান এবং আদালত অবমাননার অভিযোগে ইকনোমিস্ট এর দুজন সাংবাদিক এর বিরুদ্ধে এক বছর আগে রুল জারি  করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আজ তাদেরকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিষয়টির নিস্পত্তি করা হয়।

বিচারপতি নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান থাকাকালে তার নেতৃত্বে  গত বছর ৬ ডিসেম্বর ইকোনমিস্টের চিফ এডিটর রব গিফর্ড এবং দণি এশিয়া ব্যুরো চিফ এ্যাডাম রবার্টের  প্রতি রুল জারি করা হয়। আজ  ইকনোমিস্ট এর দুই সংবাদিককে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হলেও ট্রাইব্যুনাল কয়েকটি পর্যবেক্ষন তুলে ধরেন আদেশে। এগুলো হল ট্রাইব্যুনালের কোনো বিচারপতির সঙ্গে কোনো সাংবাদিক ফোনে, ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারবেন না। মামলাসংক্রান্ত কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে রেজিস্ট্রারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। আইন লঙ্ঘন করে কোনো তথ্য সংগ্রহ করে তা গণমাধ্যমে প্রচার করা উচিত হবে না এবং ট্রাাইব্যুনাল কার্যক্রম নিয়ে খবর প্রকাশের  ক্ষেত্রে সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।

চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল আজ  বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন। 

বিচারপতি নিজামুল হক  ট্রাইব্যুনাল এর চলমান  বিচার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বেলজিয়ামে বসবাসরত ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে দীর্ঘ সময় নিয়ে স্কাইপ সংলাপ করেন এবং ইমেইল আদান প্রদান করেন। তাদের দুজনের এ স্কাইপ সংলাপ এর রেকর্ড  এবং ইমেইল এর বিষয়বস্তু  হস্তগত হয়  ইকনোমিস্ট কর্তৃপক্ষের। এ বিষয়ে খোঁজ খবর জানার জন্য ইকনোমিস্ট এর  সাংবাদিক বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন।

গত বছর ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি নিজামুল হক ওপেন কোর্টে এ স্কাইপ এবং ইমেইল ফাঁস হওয়ার ঘটনা প্রকাশ করে বলেন তার স্কাইপ কথপোকথন এবং  কম্পিউটার হ্যাক করেছে ইকনোমিস্ট।  ইকোনমিস্ট তার কাছে এ বিষয়ে টেলিফোন করেছে। ওইদিন বিচারপতি নিজামুল হক স্কাইপ সংলাপ এবং ইমেইল ডকুমেন্ট প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইকোনমিস্টের প্রতি রুল জারি করেন। একই সাথে স্কাইপ ও  ইমেইল  হ্যাকিং বিষয়ে  ব্যাখ্যা চাওয়া হয় তাদের কাছে।

আদেশে বলা হয়, ইমেইল, স্কাইপ, কম্পিউটার হ্যাক করা, চেয়ারম্যানের কাছ থেকে অবৈধভাবে ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করা   ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন এবং  বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতিকে প্রভাবিত করার শামিল। টেলিফোনে চেয়ারম্যানের সাথে যিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি  নিজেকে চেয়ারম্যানের সাথে কথপোকথনে লিপ্ত করেছেন এবং আইন অনুযায়ী তিনি এটি পারেননা। চেয়্যাারম্যান আরো জানতে পেরেছেন যে, ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের ইমেইল, স্কাইপ এবং কম্পিউটারও হ্যাক হয়েছে। এতে এটি পরিষ্কার যে, যারা এ  ট্রাইব্যুনালের চলমান  বিচার কার্যক্রমকে ব্যহত করার কাজে লিপ্ত তারা এর সাথে জড়িত । এটা কোনমতেই  মেনে নেয়া যায়না। কাজেই  ইকোনমিস্টের  সাউথ এশিয়া ব্যুরো চিফ এ্যাডাম রবার্টস এবং ইকোনমিস্টের চিফ এডিটর রব গিফর্ডের প্রতি আমরা নোটিশ জারি করছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ১১(৪) ধারা মোতাবেক কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রকৃয়া শুরু করা হবেনা  সে মর্মে তিন সপ্তাহের মধ্যে  জবাব দিতে হবে। তারা  ইমেইল, স্কাইপি একাউন্টস এবং  চেয়ারম্যানের কম্পিউটর  থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাও গোপন রাখার নির্দেশ দেয়া হল।


এ রুল জারির এক সপ্তাহের মধ্যে পদত্যাগ করেন বিচারপতি নিজামুল হক। ৯ ডিসেম্বর থেকে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ শুরু হলে তীব্র সমালোচনার মুখে তিনি পদত্যাগ করেন।

এদিকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ  মাওলানা একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে আরো  তিনজন সাক্ষীর জেরা সম্পন্ন হয়েছে। সাক্ষীদের জেরা করেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। একই ট্রাইব্যুনালে   দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশন এর সাবেক চেয়ারম্যান (এমসি) মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য্য করা হয়েছে ১৫ জানুয়ারি।

শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৩

এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু

২৬/১২/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের  বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ  রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ক্যামেরা ট্রায়ালের (রুদ্ধদ্বার কক্ষে) মাধ্যমে একজন মহিলা সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। সাক্ষ্য গ্রহনের শুরুতে উভয় পক্ষের আইনজীবীদের ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ দেন এ বিষয়ে তাদের কেউ যেন সংবাদ মাধ্যমের কাছে কোন কিছু প্রকাশ না করে। ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে গ্রহণ করা সাক্ষ্যের কোন কিছু প্রকাশে সংবাদমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা থাকায় আদালত কক্ষে কোন সাংবাদিক বা দর্শনার্থীর অবস্থান করাও নিষিদ্ধ।

চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার চলছে এটিএম আজহারুল ইসলামের।

কে আসল মোমেনা

মেহেদী হাসান
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী প্রকৃত মোমেনা বেগমকে হাজির না করে তার স্থলে অপর এক মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে হাজির করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ করেছে আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবার।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন মিলনায়তনে গত ৯ ডিসেম্বর জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে  রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী নিয়ে জালিয়াতির গুরুতর এ অভিযোগ উত্থাপন করেন আব্দুল কাদের মোল্লার স্ত্রী সানোয়ার জাহান।

রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগের পক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয় প্রকৃত মোমেনা বেগমের ছবি মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে যে মোমেনা বেগমের ছবি রয়েছে তাকে হাজির করা হয়নি। তার স্থলে অপর মহিলাকে হাজির করা হয়েছে মোমেনা বেগম সাজিয়ে। তিনি বলেন, জল্লাদখানা যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের ছবির সন্ধান পাওয়ার পরই তারা সাক্ষী নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে সানোয়ার জাহান দাবি করেন, সর্বশেষ আমরা জানতে পেরেছি যে, একমাত্র সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেই মোমেনা বেগম আদৌ আদালতে সাক্ষী দিতেই আসনেনি। ক্যামেরা ট্রাইয়ালের নামে গোপন বিচারে ভুয়া একজন মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে আদালতে বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে ।  কিন্তু পরবর্তীতে জল্লাদখানায় সংরক্ষিত প্রকৃত মোমেনা বেগমের ছবি দেখে আমাদের আইনজীবীরা নিশ্চিত করেছেন আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া মোমেনা বেগম প্রকৃত মোমেনা বেগম ছিলেন না।

আবদুল কাদের মোল্লাকে দুটি  অভিযোগে  যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান  করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ গত ৫ ফেব্রুয়ারি।  এর মধ্যে একটি অভিযোগ হল মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী,  তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও    মেয়েদের ধর্ষনের ঘটনা। দেশের সর্বোচ্চা আদালত বা বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের  আপিল বিভাগ হযরত আলী পরিবারের হত্যা ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করে গত ১৭ সেপ্টেম্বর।

হযরত আলী পরিবার হত্যা ঘটনায়  বেঁচে যায় হযরতী আলী লস্করের   বড় মেয়ে মোমেনা বেগম।
রাষ্ট্রপক্ষ এ ঘটনায় একমাত্র সাক্ষী হিসেবে মোমেনা বেগমকে হাজির করে এবং ১৭ জুলাই ২০১২। ওইদিনই তার জবানবন্দী এবং জেরা সম্পন্ন হয়। 

ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে অর্থাৎ রুদ্ধদ্বার বিচার কক্ষে মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। মোমেনা বেগমকে লম্বা নেবাকসহ  কালো বোরখা পড়িয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে রাষ্ট্রপক্ষ। আসামী পক্ষের  আইনজীবী জেরার সময়  চ্যালেঞ্জ  করেছিলেন এই মোমেনা আসল মোমেনা বেগম নয়। কিন্তু তখন তারা এর পক্ষে কোন ডকুমেন্ট হাজির করতে পারেনি।

রুদ্ধদ্বার বিচার কক্ষে মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহনের সময় ট্রাইব্যুনালে শুধুমাত্রা রাষ্ট্রপক্ষের এবং আসামী পক্ষের আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। বিচারক, কোর্ট রুমে উপস্থিত অন্যান্য স্টাফ এবং আইনজীবীরা সাক্ষী মোমেনা বেগমের চেহারা দেখেছেন। অন্য কারোর সামনে রাষ্ট্রপক্ষ তার চেহারা উন্মুক্ত করেনি তখন। আসামী পক্ষের দাবি  মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের ছবি তারা কয়েকদিন আগে সংগ্রহ করতে পেরেছেন । আসামী পক্ষের যেসব আইনজীবী মোমেনা বেগমের সাক্ষ্যের সময়  ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন তারা নিশ্চিত করেছেন যে,  ট্রাইব্যুনালে  মোমেনা বেগম নামে যাকে হাজির করা হয়েছে সে প্রকৃতপক্ষে আসল মোমেনা বেগম নয়। রুদ্ধদ্বার বিচার কক্ষে মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহনের সময় আসামী পক্ষের তিনজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। এরা হলেন, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, একরামুল হক এবং সাজ্জাদ আলী চৌধুরী। তারা সবাই বলেছেন ট্রাইব্যুনালে তারা যে মোমেনা বেগমকে দেখেছেন সে মোমোনে বেগমের সাথে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের কোন মিল নেই।
সানোয়ার জাহান দাবি করেন মোমেন বেগম নামে যাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে তিন জায়গায় তার তিনরকম বক্তব্য পাওয়া গেছে। তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দী, ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ত জবানবন্দী এবং জল্লাদখানা যাদুঘরে মোমেনা বেগমের বরাতে যে প্রতিবেদন রয়েছে তার কোনটির সাথে কোনটির মিল নেই। যেমন ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগম আব্দুল কাদের মোল্লার নাম বললেও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে তার নাম বলেননি। এইরকম একজন ভুয়া স্বাক্ষীর তিন জায়গায় প্রদত্ত তিনরকমের বক্তব্যে পরে শুধুমাত্র তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। আমরা মনে করি তা নজিরবীহিন এবং এটি একটি ভুল রায়। আমরা মনে করি সংবিধান প্রদত্ত রিভিউ এর সুযোগ পেলে সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়গুলি তুলে ধরার মাধ্যমে আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় পাল্টে যাওয়া সম্ভব।

মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের কথা : মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত  পাম্প হাউজে  এনে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে  বিহারীরা বাঙ্গালীদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাংকি এবং পার্শবর্তী ডোবায়। ১৯৯০ দশকে  এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং  অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্প হাউজটিকে  জল্লাদখানা যাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের অংশ।  জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে যাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবারে অনেক আত্মীয় স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন  সময়ে তাদের সাক্ষাতকার,  বক্তব্য রেকর্ড করে তা যাদুঘরে সংরক্ষন করে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষ। শহীদ পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের  সাক্ষাতকার,  লিখিত বক্তব্যের মূল কপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়া লিখিত  বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে।

যে হযরত আলী লস্করের পরিবার হত্যা ঘটনায় আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক  যাবজ্জীবন কারাদণ্ড  এবং আপিল বিভাগে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়েছে সেই ঘটনার একটি বিবরন রক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে। হযরত আলীর বেঁচে যাওয়া একমাত্র মেয়ে মোমেনা বেগমের বরাত দিয়েই সে ঘটনার বর্ননা  লিপিবদ্ধ করে প্রতিবেদন আকারে  সংরক্ষন করা হয়েছে। এখানে হযরত আলী পরিবার হত্যার ঘটনার বিবরন রয়েছে।  মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার গ্রহনের মাধ্যমে এ ঘটনার বিবরন তারা সংগ্রহ করে।    মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে রক্ষিত সে ডকুমেন্টে বা প্রতিবেদনে  লেখা আছে ঘটনার দুই দিন আগে মোমেনা বেগম তার শশুর বাড়ি চলে যান। ঘটনার সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেননা। ফলে একমাত্র তিনিই বেঁচে যান গোটা পরিবারের এ হত্যাকান্ড থেকে।  মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর সাথে তার একটি ছবিও সেখানে  সংযুক্ত রয়েছে।

হযরত আলী হত্যাকান্ড বিষয়ে তার মেয়ে মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার যাদুঘর কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে ২৮/৯/২০০৭  তারিখ। তিনি তখন তাদের কাছে ঘটনার যে বিবরন দেন তার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ যাদঘুর কর্তৃপক্ষ যে প্রতিবেদন তৈরি করে এবং এখনো ডকুমেন্ট আকারে সংরক্ষিত রয়েছে তা  নিম্নরূপ।

ঘটনার বিবরণ : ১৯৭১ সালে মিরপুরের কালাপানি এলাকায় বিহারিদের সঙ্গে কিছু বাঙালি পরিবারও বাস করতো। ৭ মার্চ এর পর থেকে দেশের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে কিছু কিছু বাঙালি পরিবার এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অনেকের অন্যত্র যাওয়ার অবস্থা ছিল না ফলে এলাকায় রয়ে গেলেন। যে কয়েকটি পরিবার অন্যত্র যেতে পারলেন না তাদের মধ্যে একটি হযরত আলী লস্কর-এর পরিবার।
হযরত আলী লস্কর ছিলেন একজন দর্জি/খলিফা। মিরপুরেই তার দোকান ছিল। সকলে যখন এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন হযরত আলী লস্করকেও তারা চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর যাওয়ার জায়গা ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হয়ে গেলে ২৬ মার্চ সকাল সাতটার দিকে বিহারিরা হযরত আলী লস্কর-এর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই তারা তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা ও শিশু পুত্রকে ধরে নিয়ে যায় এবং সকলকে এক সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করে পাশের বাড়ির কুয়োতে সব লাশ ফেলে যায়। বিহারিরা তার দ্বিতীয় কন্যা আমেনা বেগমকে ঘরের ভেতর সারাদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পরে তাকেও হত্যা করে সেই কুয়োতে ফেলে। হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম মাত্র দুইদিন আগে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ায় একমাত্র সেই প্রানে বেঁচে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত আলী স্ত্রী সে সময় অন্তঃসত্বা ছিল।

কয়েকদিন পরই এ খবর হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম জানতে পারেন। কিন্তু মিরপুরের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে তিনি বাড়ি আসতে পারলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ বাড়িতে এসে তিনি আর কিছুই অবশিষ্ট পেলেন না। ভগ্নহৃদয়ে ফিরে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে।”

ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা মোমেনা বেগম যা বলেছেন : ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে (রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার পরিচালনা)  মোমেন বেগমের  সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় ট্রাইব্যুনালে।  ফলে সেসময় মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশিত হয়নি। তবে মোমেনা বেগম কোর্টে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ে  বর্ননা করা হয়েছে বিস্তারিতভাবে।

ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগমের  জবানবন্দীর উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘটনা ঘটে। মোমেনা বেগমরা তখন মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের  ৫ নং কালাপানি লেনে ২১ নম্বর বাসায় থাকতেন। মোমেনা বেগম কোর্টে সাক্ষ্য দিয়ে  ঘটনা বিষয়ে বলেন, সন্ধ্যার সময় তার পিতা হযরত আলী হন্তদন্ত হয়ে  ঘরে আসলেন এবং বললেন কাদের মোল্লা তাকে মেরে ফেলবে। কাদের মোল্লা এবং তার বিহারী সাগরেদ আক্তার গুন্ডা তার পিতাকে হত্যার জন্য ধাওয়া করছে। তার পিতা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এরপর তারা বাইরো বোমা ফাটাল। দরজা খোলার জন্য গালিগালাজ করল। তার মা দাও  হাতে নিয়ে দরজা খুলল। তারা ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করল তার মাকে। কাদের মোল্লা তার পিতাকে কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। তার সঙ্গীরা তার বোন খাদিজা এবং তাসলিমাকে জবাই করল। দুই বছরের ভাইকে আছড়িয়ে হত্যা করে।

মোমেনা জানায় সে এবং তার  ১১ বছর বয়স্ক অপর বোন আমেনা খাটের নিচে আশ্রয় নেয় ঘটনার সময়। আমেনা ভয়ে চিৎকার দেয়ায় তাকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করে জামাকাপড় ছিড়ে ফেলে এবং এক পর্যায়ে তার কান্না থেমে যায়।  এক পর্যায়ে তাকেও টেনে বের করে এবং ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারায় এবং জ্ঞান ফিরে পেটে প্রচন্ড ব্যর্থা অনুভব করে। তার পরনের প্যাণ্ট ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পান তিনি। পরে এক  ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং তাদের সেবার মাধ্যমে কিছুটা সুস্থ হন। পরে তার শশুর খবর পেয়ে তাকে এসে নিয়ে যান।

ট্রাইব্যুনালে হাজির করা সাক্ষী মোমেনা বেগমের জবানবন্দী এবং মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টে সম্পূর্ণ বিপরতী তথ্য : ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা মোমেনা বেগমের জবানবন্দী এবং মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী তথ্য রয়েছে।

যেমন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী মোমেনা বেগম তার জবানবন্দীতে  বলেছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যার সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। খাটের নিচে লুকিয়ে থেকে পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং তার বোনকে  ধর্ষনের  ঘটনা দেখেছেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজেও ধর্ষনের শিকার হন এবং পরে  অচেতন হয়ে পড়েন। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে মোমেনা বেগম নামে যার জবানবন্দী রক্ষিত রয়েছে তাতে দেখা যায়  মোমেনা বেগম ঘটনার দুই দিন আগে তার শশুর বাড়িতে চলে যান । ফলে তিনি প্রানে বেঁচে যান এ ঘটনা থেকে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের প্রতিবেদনে দেখা যায় মোমেনা বেগম তাদের পরিবারের হত্যার জন্য বিহারীদের দায়ী করেছেন। সেখানে কাদের মোল্লার কোন নাম গন্ধই নেই। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে  মোমেনা বেগম নামে যাকে  হাজির করা হয়েছে সে তার জবানবন্দীতে বলছে কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে এবং  নেতৃত্বে এ হত্যাকান্ড হয়েছে।

আসামী পক্ষের পরিবার এবং আইনজীবীরা বলছেন আমরা দাবি করছি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে যে মোমেনা বেগমের ছবি রয়েছে সে-ই হল আসল মোমেনা বেগম। রাষ্ট্রপক্ষ  মোমেনা বেগম নামে যাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করেছিল বোরখা পড়িয়ে তার রেকর্ড ট্রাইব্যুনাল কক্ষের সিসি ক্যামেরায় ধারন করা রয়েছে। ট্রাইব্যুনালে হাজির করা  মোমেনার সাথে জল্লাদখানায় রক্ষিত মোমেনার ছবি তুলনা করলেই প্রমান হবে আমাদের দাবি সত্য না মিথ্যা।

মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে আরো ২ সাক্ষীর জেরা সম্পন্ন

২৪/১২/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে  আমির মাওলানা একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে ১৩ তম সাক্ষী সুধাংশু মন্ডল এবং ১৪ তম সাক্ষী বাবুল কুমার মিস্ত্রীর জেরা শেষ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম সাক্ষীদের জেরা করেন। তাকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট গাজি এমএইচ তামিম।

জেরা :
প্রশ্ন : পাকিস্তান সেনাবাহিনী রামপাল এবং বাগেরহাট আসার আগে স্বাধীনতাবিরোধীদের ওই এলাকায় কোন তৎপরতা ছিলনা।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে ১৩ অক্টোবরের পূর্বে কোথায় ছিলেন?
উত্তর : স্মরন করতে পারছিনা। তবে ওই সময় আমরা যত্রতত্র ঘোরাফেরা করছিলাম এবং আমাদের কমান্ডার আফজাল সাহেবের সঙ্গেই ছিলাম।
প্রশ্ন : কালেখার দিঘি থেকে ঘনশ্যামপর স্কুল কোন দিকে কতমাইল?
উত্তর : উতরে ১০ মাইল হবে।
প্রশ্ন : কন্যাডুবি গ্রাম রামপাল থানার গৌশম্ভা ইউনিয়নে অবস্থিত।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : ঘনশ্যামপুর থেকে পশ্চিম দিকে ভোলা নদী অতিক্রম করে কন্যাডুবি যেতে হয়।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে কন্যাডুবি খেয়াঘাট ছিল?
উত্তর : ছিল।
প্রশ্ন : ঘনশ্যামপুর স্কুল থেকে কন্যাডুবি খেয়াঘাট কোন দিকে কতদূরে?
উত্তর :   দক্ষিনে ৬/৭ মাইল দূরে।
প্রশ্ন : শাহাদাত কাজী ওরফে বাশার কাজী ১৯৭১ সালে মেম্বার ছিল এবং সে মুসলিম লীগ করত।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : সিদ্দিক মাস্টারও মুসলিম লীগ করতেন।
উত্তর : সত্য ।
প্রশ্ন : তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং শান্তি কমিটিরও চেয়ারম্যান ছিলেন।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : বাশার কাজী  বর্তমানে জীবিত আছেন?
উত্তর : জীবিত।
ট্রাইব্যুনালের প্রশ্ন : আপনি জবানবন্দীতে শাহাদাত কাজী ওরফে বাশার কাজীকে একই ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন এটা কি ঠিক?
উত্তর : শাহাদাত কাজী এবং বাশার কাজী একই ব্যক্তি নন। শাহাদাত কাজী বর্তমানে মৃত।

চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এর নেতৃত্বে  তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৩

একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে ১২ তম সাক্ষীর জেরা

23/12/2013
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে ১২ তম সাক্ষীর জেরা সম্পন্ন হয়েছে। সাক্ষীর নাম শেখ আফজাল হোসেন।  গত ২৫ নভেম্বর তার জবানবন্দী গ্রহণ করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ। 
অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম সাক্ষীকে জেরা করেন। তাকে সহায়তা করেন গাজী এমএইচ তামিম।

জেরা :
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে ইপিআর এ কোন পদে ছিলেন?
উত্তর : হাবিলদার।
প্রশ্ন : ১৯৭২ সালে বিডিআর এ যোগ দিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : বিডিআর থেকে আপনি কোন অবসার ভাতা পাননা।
উত্তর : পাইনা।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের আগেই আপনাকে ইপিআর থেকে বরখাস্ত করা হয়? 
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সাক্ষী সুধাংশু মন্ডলকে কতদিন ধরে চেনেন?
উত্তর : মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচয় হয়।
প্রশ্ন : তিনি বর্তমানে বাগেরহাট অ্যাডভোকেট জ্ঞানেন্দ্রনাথ মন্ডলের সহকারি।
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : স্বরোচিশ সরকার নামে কারোর নাম শুনেছেন যিনি একাত্তরে বাগেরহাট নামে বই লিখেছেন?
উত্তর : শুনে থাকতে পারি। এখন মনে নেই।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কোন লেখক বা সাংবাদিকের কাছে ঘটনা বর্ননা করেছেন কখনো?
উত্তর : ৫/৭/১০ বছর আগে সাংবাদিকরা এসেছিলেন। তখন কিছু কথা বলেছিলাম।
প্রশ্ন : ভারত থেকে কোন পথে দেশে আসলেন?
উত্তর :  ধুমঘাট মুন্সিগঞ্জ
প্রশ্ন : কালেখার দিঘির পাড় থেকে চুলকাঠি বাজারের দূরত্ব কত?
উত্তর : ১২/১৩ মাইল।
প্রশ্ন : কালেখার দিঘির ১২/১৩ মাইলের মধ্যে কোন আর্মি বা রাজাকার ক্যাম্প ছিল?
উত্তর : এটা তখন জানার অবস্থা আমার ছিলনা।
প্রশ্ন আপনারা কি আর্মি বা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমনের জন্য বাগেরহাট গিয়েছিলেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : ঘনশ্যামপুর হাইস্কুল থেকে চুলকাঠির দূরত্ব এক মাইল এবং মাঝে নদী আছে।
উত্তর : ১ মাইলের বেশি হবে। মাঝে নদী নাই।
প্রশ্ন : আপনারা যে মাঝির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার দূরত্ব ঘনশ্যামপুর স্কুল থেকে কতদূরে?
উত্তর : ২ মাইল দূরে মরাপশুর নদীর কন্যাডুবি ঘাটের খেয়া মাঝির বাড়িতে আমরা ১২/১৩ জন আশ্রয় নিয়েছিলাম।
প্রশ্ন : নদীর ধারা এবং ঘনশ্যামপুর স্কুলের মাঝে চুলকাঠি বাজার।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : নদীর ধারে মাঝির বাড়ি থেকে ঘনশ্যামপুর স্কুল কোন দিকে কতদূর?
উত্তর : দণি পশ্চিম দিকে দেড় মাইল।
প্রশ্ন : ঘনশ্যামপুর স্কুল থেকে চুলকাঠি বাজার কোন দিকে?
উত্তর : পূর্ব দিকে।
প্রশ্ন : মরা পশুর নদীর পার হয়েছিলেন ভারতে যাবার সময়?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে রজব আলী ফকিরের নাম শুনেছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালে সে মুসলিম লীগের সদস্য হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থী ছিলেন তা কি ১৯৭১ সালে শুনেছেন?
উত্তর : তখন তো সে রাজাকার ছিল। কালেখার দিঘির কাছে প্রায়ই সে আমাদের ওপর আক্রমন পরিচালনা করত।
প্রশ্ন : আহত হবার কতদিন পর স্বাভাবিক চলাফেরা শুরু করেন আপনি ?
উত্তর : দেড়/দুই মাস।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের আগে খান এ সবুর খান, একেএম ইউসুফ সাহেবকে চিনতেন?
উত্তর : খান এ সবুরের নাম শুনেছি চিনতামনা । ইউসুফ সাহেবের নাম শুনিনি।
প্রশ্ন : আপনার ভগ্নিপতির ভাই আশরাফুলের বাড়ি কোথায়?
উত্তর : ঘনশ্যামপুর।
প্রশ্ন : সে জীবিত?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : সে কি মুক্তিযুদ্ধ করেছে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ঘনশ্যামপুর স্কুলে পরে আর গিয়েছিলেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : আপনাদের সেট করা বোমায় স্কুল বিধ্বস্ত হয়?
উত্তর : চেয়ার টেবিল বিধ্বস্ত হয়।
প্রশ্ন : আপনি জবানবন্দীতে বলেছেন, রাজাকারদের মধ্যে দেখলাম পাজামা পাঞ্জাবী পরা মুখে সামান্য দাড়ি সে অন্যদের বলল এদের বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি? গুলি কর। এ তথ্য আপনি তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়েছেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : ভগ্নিপতির ভাই বলল সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা লোকটি একেম ইউসুফ। তার নির্দেশে এ হত্যাকান্ড হয়েছে। এ তথ্য কি তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়েছেন?
উত্তর : দিয়েছি।
প্রশ্ন : জবানবন্দীতে বলেছেন, স্থানীয় চেয়ারম্যানের ভাতিজা জানিয়েছে  ইউসুফ সাহেবের নির্দেশে রাজাকার চারদিক থেকে ঘিরে ফিলেছে। ইউসুফ সাহেব কোথায় কার সামনে বসে রাজাকারদের আক্রমন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তা কি আপনার ভাতিজা আপনাকে বলেছিলেন?
উত্তর : রাজাকারদের আসার খবর দিয়ে সাথে সাথে সে চলে যায়। একথা বলার অবস্থা ছিলনা।

প্রশ্ন : চেয়ারম্যানের ভাতিজাকে আগে কখনো দেখেছিলেন?
উত্তর : ওইদিন ওই সময়ই প্রথম দেখা।
প্রশ্ন : ইউসুফ সাহেব খুলনায় অবস্থান করতেন।
উত্তর : শুনেছি খুলনায় ভুতের বাড়ির সামনে থাকতেন।
প্রশ্ন : একেএম ইউসুফ সাহেবের নির্দেশ ঘনশ্যামপুর হাইস্কুলে আক্রমন করার কথা অসত্য।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরা মুখে সামান্য দাড়ি দাড়িওয়ালা লোকটি ছিল একেএম ইউসুফ। সে বলল এদের বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি। গুলি কর। আপনার একথা অসত্য।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : ইউসুফ সাহেব কখনো বাগেরহাটের কোথাও  যাননি।
উত্তর : অসত্য।

সাড়ে ১২টার দিকে জেরা শেষ হলে বিকালের সেশনে  মুলতবি আবেদন জানিয়ে মিজানুল ইসলাম বলেন, আগামীকাল ১৩ ও ১৪ তম সাক্ষীর তিনি জেরা করতে চাচ্ছেন। কোর্ট আবেদন মঞ্জুর করেন।
ট্রাইব্যুনাল-২ চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সদস্য বিচারপতি মুজিবুর রহমান ও বিচারপতি শাহীনূর ইসলাম বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।


মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৩

৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে ৭ সাক্ষীর জেরার সুযোগ আসামী পক্ষের

১৭/১২/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাত সাক্ষীকে  জেরা করার অনুমতি পেয়েছে আসামী পক্ষ। এজন্য আসামী পক্ষকে ৪০ হাজার টাকা খরচ ধার্য্য করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

হরতাল অবরোধের কারনে আসামী পক্ষের সিনিয়র আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকেন। এসময় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জবানবন্দী গ্রহণ করা হলেও আসামী পক্ষের সিনিয়র আইনজীবী না থাকায় তাদের জেরা করা হয়নি। বিভিন্ন সময় জুনিয়র আইনজীবী গাজী এমএইচ  তামিম দুয়েকটি প্রশ্নের মাধ্যমে জেরা করে মুলতবি আবেদন করেন। ট্রাইব্যুনালও বিভিন্ন সময় মুলতবি করে আসামী পক্ষকে সময় দিয়েছেন এবং জেরার জন্য পরবর্তী তারিখ ধার্য্য করেছেন। কিন্তু টানা হরতাল অবরোধ চলতে থাকায় জেরার জন্য নির্ধারিত তারিখে আসামী পক্ষের সংশ্লিষ্ট আইনজীবী উপস্থিত হননি। ফলে এভাবে রাষ্ট্রপক্ষের সাতজন সাক্ষীর জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় বন্ধ ঘোষনা করা হয়।
এছাড়া মাওলানা ইউসুফের পক্ষে আইনজীবী সৈয়দ মিজানুর রহমানের ওপরও  ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
এ পরিস্থিতিতে আসামী পক্ষ বন্ধ ঘোষনা করা সাক্ষীদের জেরার সুযোগ এবং মিজানুর রহমানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা আদেশ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করে। মিজানুর রহমানের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার আবেদন খারিজ করে দেয় ট্রাইব্যুনাল।
অপরদিকে সাক্ষীদের জেরা করার সুযোগ চেয়ে দায়ের করা আবেদন গ্রহণ করা হয়। তবে তাদের জেরার জন্য সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষের ১২,১৩,১৪ এবং ১৫ নং সাক্ষীকে ২৩ ও ২৪ ডিসেম্বর এবং ১৬,১৭ ও ১৮ নং সাক্ষীকে ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর জেরার জন্য ধার্য্য করে দেয়া হয়।
এদিকে সৈয়দ মিজানুর রহমানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় মাওলানা ইউসুফের পক্ষে মিজানুল ইসলামকে নতুন আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আজ মিজানুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন ট্রাইব্যুনাল -২ এ।
সৈয়দ মিজানুর রহমানের ওপর নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে আসামী পক্ষের রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানী করেন অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান। তিনি বলেন, সৈয়দ মিজানুর রহমানকে যদি ভবিষ্যতে এ মামলায় বা অপর কেউ ট্রাইব্যুনালের মামলা পরিচালনায় নিয়োগ দিতে চায় সে সুযোগ যেন দেয়া হয়। মিজানুর রহমানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
তখন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, তাকে আর এ ট্রাইব্যুনালে দেখতে চাইনা। এই কোর্ট ওনার প্রতি গোসসা।
সাইফুর রহমান তখন বলেন, আমরা আপনাদের গোসসা ভাঙ্গাতে এসেছি।
এরপর ট্রাইব্যুনাল তার বিষয়ক আবেদন খারিজ করে দেয়।
এদিকে  জাতীয় পার্টির সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মো: কায়সারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের চার্জ গঠন শুনানী শেষ হয়েছে আজ। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রানাদাস গুপ্ত শুনানী পেশ করেন । ১৯৭১ সালে হত্যা, গনহত্যাসহ মানবতাবিরোধী ১৮টি অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
আগামী ১৯ ডিসেম্বর আসামী পক্ষের শুনানীর জন্য ধার্য্য করা হয়েছে।

সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

বিশ্বজুড়ে আলোচিত একটি ফাঁসি

মেহেদী হাসান, ১৬/১২/২০১৩
নানাবিধ কারনে আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে আলোচিত ছিল আবদুল কাদের মোল্লা মামলা। ফাঁসির পর তো বটেই ফাঁসির আগেও আরো একবার গোটা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এ মামলা। ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার  মাত্র দেড়ঘন্টা আগে ফাঁসি কার্যকর স্থগিত করার ঘটনা এ মামলার ইতিহাসে যোগ করেছে আরো একটি স্মরনীয় অধ্যায়।

গভীর রাতে দাফন
১২ ডিসেম্বর বৃহষ্পতিবার দিবাগত রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হল আবদুল কাদের মোল্লার । সকালে রিভিউ আবেদন খারিজের পর রাতেই কার্যকর করা হলো তার ফাঁসি। কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে ফাঁসি সম্পন্নের পর রাত সোয়া এগারটায় পুলিশ, বিজিবি ও এপিবিএন সদস্যরা ১৫টি গাড়িযোগে কাদের মোল্লার লাশ নিয়ে রওয়ানা হয় ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায়। লাশ পৌছার আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কবর খুড়ে রাখে। রাত তিনটায় আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌছার পর গভির রাতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যে এবং তাদের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয় জানাজা নামাজ।  লাশ নিয়ে যাতে কোন ভিন্ন পরিস্থিতির অবতারনা না হয় সেজন্য রাত ৩টা ৫৭ মিনিটে জানাজার পরপরই আইনশঙ্খলা বাহিনী লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে। ফাঁসির পর লাশ নিয়ে রওয়ানার খবর পেয়েই রাতের শীত উপেক্ষা করে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন ছুটতে থাকে আমিরাবাদের দিকে। কিন্তু সমস্ত রাস্তায় পুলিশ প্রহরা বসিয়ে তাদের আটকে দেয়া হয়। 

আরো একটি স্মরনীয় অধ্যায় 
সরকারের নির্দেশে ১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাতেই আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। রাত ৮টায় আত্মীস্বজনদের সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাদের চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠানো হয় ওই দিন। ওই দিন জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের দু’জন প্রতিমন্ত্রীও ঘোষণা করেন রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হবে। দেশের এবং বিদেশের অসংখ্য সাংবাদিক ভিড় করেছে আলোচিত এ ফাঁসর খবর সংগ্রহের জন্য। এদিকে ফাঁসির যখন এ আয়োজন প্রায় সম্মন্ন তখন আসামী পক্ষের আইনজীবীরা হন্যে হয়ে ছুটে যান চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর বাসভবনের দিকে ফাঁসি কার্যকর স্থগিত এবং রিভিউ আবেদন নিয়ে। ফাঁসি কার্যকরের মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। এর মাধ্যমে আরো একবার বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষন করে  ঘটনাবহুল এবং আলোচিত এ মামলাটি।

বুধবার গোটা দেশবাসীর  দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সুপ্রিম কোর্টের প্রতি। সকালে প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে শুরু হয় রিভিউ আবেদনের শুনানি। এ ছাড়া আসামিপক্ষ স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানোরও আবেদন করে। রিভিউ আবেদন চলবে কি চলবে না এ বিষয়ে বুধবার শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করায় ফাঁসি স্থগিতাদেশও বহাল থাকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার সকালে আবার শুরু হয় রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি। শুনানি শেষে ১২টা ৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করেন আবেদন ডিসমিসড।

এরপরই সরকার পক্ষ থেকে ঘোষনা করা হয় ফাঁসি কার্যকরে আর কোন বাঁধা নেই এবং যেকোন সময়ই তা করা হবে। অপরদিকে আসামী পক্ষ দাবি করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে জেল কর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকর করতে পারবেনা। কারণ কোর্টের আদেশে ফাঁসি স্থগিত রয়েছে ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি। তাই কোর্ট থেকে কোন নির্দেশনা সেখানে না গেলে তারা ফাঁসি কার্যকর করতে পারবেনা।
তবে সব বিতর্ক শেষ হয়ে যায় যখন খবর বের হয় বিকেল ৩টার পরে  রিভিউ আবেদন খারিজের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তৃপক্ষ, রাষ্ট্রপক্ষ, আসামিপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অফিসে পাঠানো হয়েছে সুপ্রীম কোর্ট রেজিস্ট্রার অফিস থেকে। তখনই নিশ্চিত হয়ে যায় রাতেই কার্যকর হচ্ছে ফাঁসি।

যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদন্ড 
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আবদুল কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়।  প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ ১৭ সেপ্টেম্বর এ রায় ঘোষনা করে। 
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।  আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দিলো। রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ছয়টি অভিযোগ এনেছিল। ট্রাইব্যুনাল একটি অভিযোগ থেকে আবদুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছিল। কিন্তু আপিল খালাস দেয়া সে অভিযোগটিতেও যাবজ্জীবন সাজাসহ  ছয়টি অভিযোগেই তাকে সাজা দিয়েছে।

পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে (৪ : ১) আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। অর্থাৎ চারজন বিচারপতি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে এবং একজন বিচারপতি (বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা)  মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে রয়েছেন।

ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লাকে দুইটি অভিযোগে যাবজ্জীবন, তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড এবং একটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছিল। আপিল বিভাগের রায়ে একটি যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। এ অভিযোগটি হলো মিরপুরে কালাপানি লেনে হজরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা। এটি ছিল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ছয় নম্বর অভিযোগ।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে চার নম্বর অভিযোগ (কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর হত্যাকাণ্ড) থেকে আবদুল কাদের মোল্লাকে খালাস দেয়া হয়েছিল। আপিল বিভাগের রায়ে খালাস দেয়া এ অভিযোগটিতে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া অপর যে চারটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল সাজা দিয়েছিল তা বহাল রাখা হয়েছে আপিল বিভাগের রায়ে।

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ :
গত ৫ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়টি মোট ৭৯০  পৃষ্ঠার।   এর মধ্যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ২৫২ পৃষ্ঠা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা ২২৭ পৃষ্ঠা এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী ৩১০ পৃষ্ঠা লিখেছেন।

৫ অভিযোগে খালাস দিলেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা

বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা  আপিল বিভাগের অপর চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে ৫টিতেই খালাস দিয়েছেন । একটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত যাবজ্জীবন সাজা বহাল রেখেছেন  এবং এ ক্ষেত্রেও তিনি আপিল বেঞ্চের অপর বিচারপতিদের সাথে ভিন্নমত পোষন করে ভিন্ন রায় দিয়েছেন।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ১ নং অভিযোগ যথা মিরপুরে  পল্লব হত্যার দায়ে ১৫ বছর জেল দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ এ রায় বহাল রেখেছেন। অপরদিকে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছেন তার রায়ে। তিনি বলেছেন রাষ্ট্রপক্ষ এ অভিযোগ প্রমানে ব্যর্থ হয়েছে এবং ট্রাইব্যুনাল অন্যায়ভাবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ২ নং অভিযোগ তথা কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগে ১৫ বছর দণ্ড দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনালের  এ দণ্ড  বহাল রাখা হয়েছে । বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্ব মিঞা এ অভিযোগেও  আপিল বেঞ্চের অপর চার বিচারপতির সাথে  ভিন্নমত পোষন করে  আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি।
আব্দুল কাদের মোল্লাকে ৩ নং অভিযোগ যথা সাংবাদিক খন্দকার  আবু তালেব হত্যার অভিযোগে ১৫ বছর সাজা দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ে এ দণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগেও আপিল বিভাগের চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আসামীকে খালাস দিয়েছেন অভিযোগ থেকে।
চার নং অভিযোগ যথা কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর হত্যাকান্ডের অভিযোগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। আপিল বিভাগ এ অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন আব্দুল কাদের মোল্লাকে। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা ট্রাইব্যুনালের  দেয়া খালাস রায় বহাল রেখেছেন; অর্থাৎ তিনিও খালাস দিলেন।

৫ নং অভিযোগ যথা  মিরপুর আলুবদি হত্যাকান্ডের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে।  আপিল বিভাগ এ রায় বহাল রেখেছেন। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগ থেকেও আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়ে লিখেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা সেখানে উপস্থিত ছিল এবং এ গনহত্যায় কোন সহযোগিতা করেছে এ মর্মে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি। ট্রাইব্যুনাল ভুল করেছে এ সাজা দিয়ে।
মিরপুরে হযরত আলী পরিবারের হত্যাকান্ডে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় আব্দুল কাদের মোল্লাকে। আপিল বিভাগের রায়ে এ সাজা বাড়িয়ে সর্বোচ্চা সাজা মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ ট্রাইব্যুনালের এ রায় বহাল রাখেন।

আলোচিত ঘটনাবহুল একটি মামলা
নানা কারণে শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ্বে একটি আলোচিত ও ঘটনাবহুল মামলা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে আবদুল কাদের মোল্লার মামলাটি। এ মামলাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনার কারনে বারবার বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম হয়  মামলাটি।  ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন। যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে উত্থান হয় হেফাজতে ইসলাম এবং শেষ পর্যন্ত যা গড়ায় অপারেশন শাপলা পর্যন্ত। যুদ্ধাপরাধ ইস্যু, আবদুল কাদের মোল্লা মামলা এবং এরই ধারাবাহিকতায় একের পর এক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে আবির্ভূত হয়। শাহবাগের ধারাবাহিকতায় অপারেশন শাপলা এবং এর পরে অনুষ্ঠিত চারটি সিটি নির্বাচনে সরকারের ধরাশয়ী হওয়ার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যু তথা আবদুল কাদের মোল্লা ইস্যু তাই বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ভোটের বাক্স নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় পরিণত হয়েছে। এটি ছাড়াও আইনি গুরুত্বের কারণে এ মামলা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি আলোচিত ঘটনা হিসেবে স্থান করে নেবে ভবিষ্যতে। কারণ এই বিচারের রায় হয়ে যাওয়ার পর আইন সংশোধন করা হয়েছে। বিচারিক আদালতের সাজা বাড়িয়ে আসামীকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, যা অতীতে এ দেশে কখনো হয়নি বলে জানিয়েছে আসামিপক্ষ।
চলতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীন সাজার রায় দেয়া হয়। এ রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনকারীদের দাবি আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে হবে। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয় সরকারপক্ষের জন্য আপিলের বিধান রেখে। আইন সংশোধনের পর সরকার আবদুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে আপিল আবেদন করে।
ট্রাইব্যুনাল আইনে আগের বিধান ছিল আসামিপক্ষ সাজার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আসামির সাজা হলে রাষ্ট্রপক্ষের জন্য আপিলের বিধান ছিল না। আসামিকে খালাস দেয়া হলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের জন্য আপিলের বিধান ছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধন করে উভয় পক্ষকে আপিলের সমান সুযোগ দেয়া হয় এবং আইনের সংশোধনীকে ২০০৯ সাল থেকে কার্যকারিতা প্রদান করা হয়।
আইনের সংশোধনীর কারণে আবদুল কাদের মোল্লার আপিল শুনানি শেষ পর্যন্ত অ্যামিকাস কিউরি পর্যন্ত গড়ায়। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইনের যে সংশোধন করা হয়েছে তা আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না জানতে চেয়ে ২০ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের সাতজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেয় আপিল বিভাগ। এরা হলেন, সাবেক বিচারপতি টি এইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল প্রবীণ আইনবিদ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি।

সবশেষ ফাঁসি কার্যকর করার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করা এবং ফাঁসির মঞ্চে তোলার মাত্র দেড়ঘন্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন কর্তৃক ফাঁসি কার্যকর স্থগিতাদেশের মাধ্যমে আরো একবার বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ মামলা।

আসামিপক্ষের অভিযোগ
আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক রায়ের পর বলেছেন, বিচারিক আদালত কর্তৃক প্রদত্ত যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্র্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রদানের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম এবং বিচার বিভাগের জন্য এটি একটি দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়।
আপিল বিভাগে আবদুল কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পরপরই সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক লিখিত বক্তব্যে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে আবদুল কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু এটি একটি ভুল রায়। আমরা এ রায়ে সংুব্ধ। আমরা বিস্মিত। আমরা মনে করিÑ এ রায় ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
বিচারিক আদালত যেখানে মৃত্যুদণ্ড দেননি সেখানে প্রথমবারের মতো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মৃত্যুদণ্ড প্রদান বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তা ছাড়া স্কাইপ কেলেঙ্কারির পরও ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান আইনের শাসনের পরিপন্থী। আমাদের সমাপনী বক্তব্যে আমরা বলেছিলামÑ যে সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার ভিত্তিতে আবদুল কাদের মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, আজ তাকে শুধু দোষী সাব্যস্তই করা হয়নি, মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়েছে। বিচারের ইতিহাসে এটি একটি দুঃখজনক অধ্যায়।

অভিযোগ : ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়
রাষ্ট্রপক্ষ আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ আনে। ট্রাইব্যুনাল এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে তাকে সাজা দেয়। এসব অভিযোগ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগ কর্তৃক সাজা বিষয়ে নি¤েœ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো।

১ নম্বর অভিযোগ পল্লব হত্যা :
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যার ঘটনা। অভিযোগে বলা হয়, আবদুল কাদের মোল্লার নির্দেশে তার সাঙ্গোপাঙ্গ মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে নওয়াবপুর থেকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করে।
ট্রাইব্যুনালের রায় : ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ হত্যা ঘটনার সাথে আবদুল কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তাকে ১৫ বছরের জেল দেয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে পল্লব হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে উল্লেখ করা হয়েছে এ হত্যা ঘটনার অভিযোগের ভিত্তি হলো শোনা কথা। ট্রাইব্যুনালের হাতে যা এসেছে তাতে দেখা যায় আবদুল কাদের মোল্লা ব্যক্তিগতভাবে কোনো অপরাধ সংঘটন করেছেন এমন অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত নন।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে পল্লব হত্যা বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত ১৫ বছরের সাজা বহাল রাখা হয়েছে।

২ নম্বর অভিযোগ কবি মেহের হত্যাকাণ্ড :
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ আবদুল কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে নিজ ঘরে থাকা অবস্থায় স্বাধীনতাপন্থী কবি মেহেরুননিসা, তার মা ও দুই ভাইকে হত্যা করে মর্মে অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।
ট্রাইব্যুনালের রায় : ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লাকে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লাকে দণ্ডিত করে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত রায়ে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন্নেসার ঘরে নিজে প্রবেশ করেননি হত্যাকাণ্ডের সময়। হত্যাকাণ্ডে কাদের মোল্লা নিজে সশরীরে অংশগ্রহণও করেননি। তবে যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদেরকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে গেছেন এবং এ কাজে তার নৈতিক সমর্থন ছিল। কাদের মোল্লা নিজে এ অপরাধে অংশ নিয়েছেন সে মর্মে প্রমাণ নেই।
রায়ে আরো বলা হয়েছে, এ হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ তিনজন শোনা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। অর্থাৎ অভিযোগের ভিত্তি হলো সাক্ষীদের শোনা কথা।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত ১৫ বছরের সাজা বহাল রাখা হয়েছে।

৩ নম্বর অভিযোগ সাংবাদিক আবু তালেব হত্যা :
১৯৭১ সালে ২৯ মার্চ সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব তার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনে অবস্থিত বাসা থেকে আরামবাগ যাচ্ছিলেন। তিনি মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার পর আবদুল কাদের মোল্লা অন্যান্য আল বদর সদস্য, রাজাকার, দুষ্কৃতকারী এবং বিহারিদের সাথে নিয়ে তাকে ধরে মিরপুর জল্লাদখানা পাম্প হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে সেখানে হত্যা করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায় : এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে ১৫ বছরের সাজা দিয়েছে। এ ঘটনায়ও আবদুল কাদের মোল্লাকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে দু’জন সাক্ষীর শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনালের এ সাজা বহাল রাখা হয়েছে।

৪ নম্বর অভিযোগ ঘাটারচরে শতাধিক মানুষ হত্যা :
 ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর আবদুল কাদের মোল্লা ৬০-৭০ জন রাজাকার বাহিনী সদস্য নিয়ে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর এবং ভাওয়াল দু’টি গ্রামে হামলা চালিয়ে দু’জন মুক্তিযোদ্ধাসহ শতাধিক গ্রামবাসীকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায় : এ অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে খালাস দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষ এ ঘটনায় তিনজন সাক্ষী হাজির করে। এদের একজন প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করা হয়। বাকি দু’জন শোনা সাক্ষী। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আবদুল মজিদ পালওয়ান সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন ঘটনার দিন যখন গ্রামের উত্তর দিক থেকে গুলি আসতে শুরু করে তখন তিনি যে দিক থেকে গুলি আসে সে দিকে এগিয়ে যান।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ সাক্ষীর সাক্ষ্য পর্যালোচনায় বলা হয়েছে একবার সাক্ষী বলেছেন সকাল ১১টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে অপরাধীরা চলে যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন দুষ্কৃতকারীদের সাথে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটা ছিল আবদুল কাদের মোল্লা। আবার আরেক জায়গায় বলেছেন, তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে রাইফেল হাতে দেখেছেন। একবার বলেছেন ঘটনা ঘটার পর জানতে পেরেছেন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটা ছিল কাদের মোল্লা আবার আরেকবার বলেছেন তিনি তাকে রাইফেল হাতে দেখেছেন।
ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করেছেন কোনটা সত্য? তা ছাড়া এ ধরনের অভিযানের সময় যখন সাধারণত মানুষ জীবন বাঁচাতে পেছনের দিকে পালিয়ে যায় তখন সাক্ষী বলছেন তিনি গুলির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এটিও একটি অস্বাভাবিক ঘটনা এবং আপিল বিভাগের শুনানির সময়ও এ সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।
আপিল বিভাগের রায় : ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ অভিযোগ থেকে আবদুল কাদের মোল্লাকে খালাস দেয়া হলেও আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে।

৫ নম্বর অভিযোগ আলুবদি হত্যাকাণ্ড :
 এতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৪টার সময় আবদুল কাদের মোল্লার সদস্যরা (মেম্বারস) পাকিস্তান আর্মি সাথে নিয়ে মিরপুর পল্লবীর আলুবদি গ্রামে নিরীহ বেসামরিক লোকজনের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। আক্রমণের অংশ হিসেবে তারা নির্বিচারে গুলি চালায় এবং এতে ৩৪৪ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায় : ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ অভিযোগে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে এ সাজা বহাল রাখা হয়েছে।

৬ নম্বর অভিযোগ হজরত আলী হত্যাকাণ্ড :
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘটনা ঘটে। মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৫ নম্বর কালাপানি লেনে ২১ নম্বর বাসায় হজরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে আবদুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে।
ট্রাইব্যুনালের রায় : এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। রায়ে বলা হয়েছে, কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে, সহায়তায় এবং নৈতিক সমর্থনে এ হত্যার ঘটনা ঘটে।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।

একদিন তোমার গলায়ও উঠতে পারে দড়ি
তখন আমার ছাত্র জীবন। একিদন  মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড  নেতা  সাইয়্যেদ মোহাম্মদ কুতুব শহীদের শাহাদাতের ঘটনা বর্ননা করছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। বর্ননার সময় এক পর্যায়ে অধ্যাপক  গোলাম আযম আমার গলায় হাত রেখে বলেছিলেন একদিন তোমার গলায়ও উঠতে পারে এ দড়ি।
১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সকালে আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে তার আইনজীবী দেখা করতে গেলে তাদেরকে তিনি এ ঘটনার কথা বলেন।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম জানান আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে সাক্ষাত করেন সেদিন। আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা বিষয়ে তাজুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে  বলেন, সাক্ষাতের সময় কাদের মোল্লা সাহেব আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলেছেন, আমার জীবনে যদি সত্যিকার অর্থে এরকম কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে তাহলে তোমরা সেদিন আমার চোখে পানি দেখতে পাবেনা। আমার মাথা সারা জীবন উচু ছিল উচু থাকবে। আমি জানি আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তার সাথে সত্যের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে যদি আমার জীবন দিতে হয় তবে তার চেয়ে বড় সৌভাগ্যের আর কি হতে পারে। মানব জীবনে শাহাদাতের মৃত্যুর চেয়ে উত্তম এবং বড় আর কিছুই হতে পারেনা। ইসলামী আন্দোলনের একজন  কর্মী হিসেবে মহান আল্লাহর কাছে এটাই ছিল আমার সারা জীবনের কামনা। মহান আল্লাহ যদি আমার সে প্রার্থনা কবুল করে থাকেন তবে এর চেয়ে বড় কোন পাওয়া আর আমার জন্য হতে পারেনা। এটা হলে আমি সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হব। মিশরসহ বিশ্বের  ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদসহ সমকালীন আরো অনেকের ইতিহাস আমার সামনে আছে। মৃত্যু নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই। এমন মৃত্যু আনন্দের, সৌভাগ্যের।

১০ ডিসেম্বর রাতেই আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। তবে সেদিন তার ফাঁসি কার্যকর না হলেও আইনজীবীদের সাথে এটাই ছিল তার শেষ সাক্ষাৎ। ১২ ডিসেম্ব রাতে  ফাঁসি কার্যকরের খবর শুনে আইনজীবীরা রাত সাড়ে আটটায় আবার জেলখানায় ছুটে যান তার সাথে সাক্ষাতের জন্য। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়ে দেয় আর সম্ভব নয়। ফাঁসির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। তবে কয়েকজন আত্মীয় স্বজনের সাথে তাকে ওইদিন রাতে আবারো শেষ সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়।

আসল মোমেনা নকল মোমেনা
আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী নিয়ে জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে ।  আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী প্রকৃত মোমেনা বেগমকে হাজির না করে তার স্থলে অপর এক মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে হাজির করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ করেছে আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবার।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন মিলনায়তনে গত ৯ ডিসেম্বর জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ অভিযোগ উত্থাপন করেন আব্দুল কাদের মোল্লার স্ত্রী সানোয়ার জাহান।

রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগের পক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয় প্রকৃত মোমেনা বেগমের ছবি মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে যে মোমেনা বেগমের ছবি রয়েছে তাকে হাজির করা হয়নি। তার স্থলে অপর মহিলাকে হাজির করা হয়েছে মোমেনা বেগম সাজিয়ে। তিনি বলেন, জল্লাদখানা যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের ছবির সন্ধান পাওয়ার পরই তারা সাক্ষী নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে সানোয়ার জাহান দাবি করেন, সর্বশেষ আমরা জানতে পেরেছি যে, একমাত্র সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেই মোমেনা বেগম আদৌ আদালতে সাক্ষী দিতেই আসনেনি। ক্যামেরা ট্রাইয়ালের নামে গোপন বিচারে ভুয়া একজন মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে আদালতে বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে ।  কিন্তু পরবর্তীতে জল্লাদখানায় সংরক্ষিত প্রকৃত মোমেনা বেগমের ছবি দেখে আমাদের আইনজীবীরা নিশ্চিত করেছেন আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া মোমেনা বেগম প্রকৃত মোমেনা বেগম ছিলেন না।

আবদুল কাদের মোল্লাকে দুটি  অভিযোগে  যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান  করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ গত ৫ ফেব্রুয়ারি।  এর মধ্যে একটি অভিযোগ হল মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী,  তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও    মেয়েদের ধর্ষনের ঘটনা। দেশের সর্বোচ্চা আদালত বা বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের  আপিল বিভাগ হযরত আলী পরিবারের হত্যা ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করে গত ১৭ সেপ্টেম্বর।

হযরত আলী পরিবার হত্যা ঘটনায়  বেঁচে যায় হযরতী আলী লস্করের   বড় মেয়ে মোমেনা বেগম।
রাষ্ট্রপক্ষ এ ঘটনায় একমাত্র সাক্ষী হিসেবে মোমেনা বেগমকে হাজির করে এবং ১৭ জুলাই ২০১২। ওইদিনই তার জবানবন্দী এবং জেরা সম্পন্ন হয়। 

ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে অর্থাৎ রুদ্ধদ্বার বিচার কক্ষে মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। মোমেনা বেগমকে লম্বা নেবাকসহ  কালো বোরখা পড়িয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে রাষ্ট্রপক্ষ। আসামী পক্ষের  আইনজীবী জেরার সময়  চ্যালেঞ্জ  করেছিলেন এই মোমেনা আসল মোমেনা বেগম নয়। কিন্তু তখন তারা এর পক্ষে কোন ডকুমেন্ট হাজির করতে পারেনি।

রুদ্ধদ্বার বিচার কক্ষে মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহনের সময় ট্রাইব্যুনালে শুধুমাত্রা রাষ্ট্রপক্ষের এবং আসামী পক্ষের আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। বিচারক, কোর্ট রুমে উপস্থিত অন্যান্য স্টাফ এবং আইনজীবীরা সাক্ষী মোমেনা বেগমের চেহারা দেখেছেন। অন্য কারোর সামনে রাষ্ট্রপক্ষ তার চেহারা উন্মুক্ত করেনি তখন। আসামী পক্ষের দাবি  মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের ছবি তারা কয়েকদিন আগে সংগ্রহ করতে পেরেছেন । আসামী পক্ষের যেসব আইনজীবী মোমেনা বেগমের সাক্ষ্যের সময়  ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন তারা নিশ্চিত করেছেন যে,  ট্রাইব্যুনালে  মোমেনা বেগম নামে যাকে হাজির করা হয়েছে সে প্রকৃতপক্ষে আসল মোমেনা বেগম নয়। রুদ্ধদ্বার বিচার কক্ষে মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহনের সময় আসামী পক্ষের তিনজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। এরা হলেন, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, একরামুল হক এবং সাজ্জাদ আলী চৌধুরী। তারা সবাই বলেছেন ট্রাইব্যুনালে তারা যে মোমেনা বেগমকে দেখেছেন সে মোমোনে বেগমের সাথে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের কোন মিল নেই।
সানোয়ার জাহান দাবি করেন এইরকম একজন ভুয়া স্বাক্ষীর তিন জায়গায় প্রদত্ত তিনরকমের বক্তব্যে পরে শুধুমাত্র তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। আমরা মনে করি তা নজিরবীহিন এবং এটি একটি ভুল রায়। আমরা মনে করি সংবিধান প্রদত্ত রিভিউ এর সুযোগ পেলে সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়গুলি তুলে ধরার মাধ্যমে আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় পাল্টে যাওয়া সম্ভব।

মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের কথা : মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত  পাম্প হাউজে  এনে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে  বিহারীরা বাঙ্গালীদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাংকি এবং পার্শবর্তী ডোবায়। ১৯৯০ দশকে  এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং  অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্প হাউজটিকে  জল্লাদখানা যাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের অংশ।  জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে যাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবারে অনেক আত্মীয় স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন  সময়ে তাদের সাক্ষাতকার,  বক্তব্য রেকর্ড করে তা যাদুঘরে সংরক্ষন করে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষ। শহীদ পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের  সাক্ষাতকার,  লিখিত বক্তব্যের মূল কপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়া লিখিত  বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে।

যে হযরত আলী লস্করের পরিবার হত্যা ঘটনায় আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক  যাবজ্জীবন কারাদণ্ড  এবং আপিল বিভাগে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়েছে সেই ঘটনার একটি বিবরন রক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে। হযরত আলীর বেঁচে যাওয়া একমাত্র মেয়ে মোমেনা বেগমের বরাত দিয়েই সে ঘটনার বর্ননা  লিপিবদ্ধ করে প্রতিবেদন আকারে  সংরক্ষন করা হয়েছে। এখানে হযরত আলী পরিবার হত্যার ঘটনার বিবরন রয়েছে।  মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার গ্রহনের মাধ্যমে এ ঘটনার বিবরন তারা সংগ্রহ করে।    মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে রক্ষিত সে ডকুমেন্টে বা প্রতিবেদনে  লেখা আছে ঘটনার দুই দিন আগে মোমেনা বেগম তার শশুর বাড়ি চলে যান। ঘটনার সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেননা। ফলে একমাত্র তিনিই বেঁচে যান গোটা পরিবারের এ হত্যাকান্ড থেকে।  মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর সাথে তার একটি ছবিও সেখানে  সংযুক্ত রয়েছে।

হযরত আলী হত্যাকান্ড বিষয়ে তার মেয়ে মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার যাদুঘর কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে ২৮/৯/২০০৭  তারিখ। তিনি তখন তাদের কাছে ঘটনার যে বিবরন দেন তার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ যাদঘুর কর্তৃপক্ষ যে প্রতিবেদন তৈরি করে এবং এখনো ডকুমেন্ট আকারে সংরক্ষিত রয়েছে তা  নিম্নরূপ।

ঘটনার বিবরণ : ১৯৭১ সালে মিরপুরের কালাপানি এলাকায় বিহারিদের সঙ্গে কিছু বাঙালি পরিবারও বাস করতো। ৭ মার্চ এর পর থেকে দেশের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে কিছু কিছু বাঙালি পরিবার এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অনেকের অন্যত্র যাওয়ার অবস্থা ছিল না ফলে এলাকায় রয়ে গেলেন। যে কয়েকটি পরিবার অন্যত্র যেতে পারলেন না তাদের মধ্যে একটি হযরত আলী লস্কর-এর পরিবার।
হযরত আলী লস্কর ছিলেন একজন দর্জি/খলিফা। মিরপুরেই তার দোকান ছিল। সকলে যখন এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন হযরত আলী লস্করকেও তারা চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর যাওয়ার জায়গা ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হয়ে গেলে ২৬ মার্চ সকাল সাতটার দিকে বিহারিরা হযরত আলী লস্কর-এর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই তারা তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা ও শিশু পুত্রকে ধরে নিয়ে যায় এবং সকলকে এক সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করে পাশের বাড়ির কুয়োতে সব লাশ ফেলে যায়। বিহারিরা তার দ্বিতীয় কন্যা আমেনা বেগমকে ঘরের ভেতর সারাদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পরে তাকেও হত্যা করে সেই কুয়োতে ফেলে। হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম মাত্র দুইদিন আগে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ায় একমাত্র সেই প্রানে বেঁচে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত আলী স্ত্রী সে সময় অন্তঃসত্বা ছিল।

কয়েকদিন পরই এ খবর হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম জানতে পারেন। কিন্তু মিরপুরের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে তিনি বাড়ি আসতে পারলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ বাড়িতে এসে তিনি আর কিছুই অবশিষ্ট পেলেন না। ভগ্নহৃদয়ে ফিরে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে।”

ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা মোমেনা বেগম যা বলেছেন : ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে (রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার পরিচালনা)  মোমেন বেগমের  সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় ট্রাইব্যুনালে।  ফলে সেসময় মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশিত হয়নি। তবে মোমেনা বেগম কোর্টে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ে  বর্ননা করা হয়েছে বিস্তারিতভাবে।

ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগমের  জবানবন্দীর উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘটনা ঘটে। মোমেনা বেগমরা তখন মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের  ৫ নং কালাপানি লেনে ২১ নম্বর বাসায় থাকতেন। মোমেনা বেগম কোর্টে সাক্ষ্য দিয়ে  ঘটনা বিষয়ে বলেন, সন্ধ্যার সময় তার পিতা হযরত আলী হন্তদন্ত হয়ে  ঘরে আসলেন এবং বললেন কাদের মোল্লা তাকে মেরে ফেলবে। কাদের মোল্লা এবং তার বিহারী সাগরেদ আক্তার গুন্ডা তার পিতাকে হত্যার জন্য ধাওয়া করছে। তার পিতা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এরপর তারা বাইরো বোমা ফাটাল। দরজা খোলার জন্য গালিগালাজ করল। তার মা দাও  হাতে নিয়ে দরজা খুলল। তারা ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করল তার মাকে। কাদের মোল্লা তার পিতাকে কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। তার সঙ্গীরা তার বোন খাদিজা এবং তাসলিমাকে জবাই করল। দুই বছরের ভাইকে আছড়িয়ে হত্যা করে।

মোমেনা জানায় সে এবং তার  ১১ বছর বয়স্ক অপর বোন আমেনা খাটের নিচে আশ্রয় নেয় ঘটনার সময়। আমেনা ভয়ে চিৎকার দেয়ায় তাকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করে জামাকাপড় ছিড়ে ফেলে এবং এক পর্যায়ে তার কান্না থেমে যায়।  এক পর্যায়ে তাকেও টেনে বের করে এবং ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারায় এবং জ্ঞান ফিরে পেটে প্রচন্ড ব্যর্থা অনুভব করে। তার পরনের প্যাণ্ট ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পান তিনি। পরে এক  ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং তাদের সেবার মাধ্যমে কিছুটা সুস্থ হন। পরে তার শশুর খবর পেয়ে তাকে এসে নিয়ে যান।

ট্রাইব্যুনালে হাজির করা সাক্ষী মোমেনা বেগমের জবানবন্দী এবং মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টে সম্পূর্ণ বিপরতী তথ্য : ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা মোমেনা বেগমের জবানবন্দী এবং মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী তথ্য রয়েছে।

যেমন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী মোমেনা বেগম তার জবানবন্দীতে  বলেছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যার সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। খাটের নিচে লুকিয়ে থেকে পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং তার বোনকে  ধর্ষনের  ঘটনা দেখেছেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজেও ধর্ষনের শিকার হন এবং পরে  অচেতন হয়ে পড়েন। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে মোমেনা বেগম নামে যার জবানবন্দী রক্ষিত রয়েছে তাতে দেখা যায়  মোমেনা বেগম ঘটনার দুই দিন আগে তার শশুর বাড়িতে চলে যান । ফলে তিনি প্রানে বেঁচে যান এ ঘটনা থেকে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের প্রতিবেদনে দেখা যায় মোমেনা বেগম তাদের পরিবারের হত্যার জন্য বিহারীদের দায়ী করেছেন। সেখানে কাদের মোল্লার কোন নাম গন্ধই নেই। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে  মোমেনা বেগম নামে যাকে  হাজির করা হয়েছে সে তার জবানবন্দীতে বলছে কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে এবং  নেতৃত্বে এ হত্যাকান্ড হয়েছে।

আসামী পক্ষের পরিবার এবং আইনজীবীরা বলছেন আমরা দাবি করছি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে যে মোমেনা বেগমের ছবি রয়েছে সে-ই হল আসল মোমেনা বেগম। রাষ্ট্রপক্ষ  মোমেনা বেগম নামে যাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করেছিল বোরখা পড়িয়ে তার রেকর্ড ট্রাইব্যুনাল কক্ষের সিসি ক্যামেরায় ধারন করা রয়েছে। ট্রাইব্যুনালে হাজির করা  মোমেনার সাথে জল্লাদখানায় রক্ষিত মোমেনার ছবি তুলনা করলেই প্রমান হবে আমাদের দাবি সত্য না মিথ্যা।

আপিল বিভাগেও আসামিপক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর বরাতে তৈরি করা প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছিল। শুনানির সময় আদালত এ রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাদুঘরের যে লোক এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাকে হাজির করা হয়েছিল কি না জানতে চেয়েছেন। জবাবে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন আমারা এ রিপোর্ট সংগ্রহ করেছি। এখন এ রিপোর্ট সত্য কি না তা প্রমাণের দায়িত্ব কোর্টের। কোর্ট এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারেন। কোর্ট জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে তলব করতে পারেন এবং তাদের কাছে জানতে চাইতে পারেন যে, তাদের কাছে এ ধরনের রিপোর্ট আছে কি না। তাহলেই বের হয়ে যাবে আমাদের রিপোর্ট সত্য কি মিথ্যা।

কিন্তু আদালত মন্তব্য করেছেন মোমেনা বেগম কোর্টে এসে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, সেটাই আসল বিবেচ্য। শেষ পর্যন্ত এ ঘটনাতেই আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।

আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হজরত আলী হত্যা ঘটনাটি ছিল ছয় নম্বর অভিযোগ । হজরত আলী লস্কর আওয়ামী লীগ করার কারণে এবং স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে আবদুল কাদের মোল্লা বিহারি এবং আর্মিদের সাথে নিয়ে তাকেসহ পরিবারের লোকজনকে হত্যা করে মর্মে অভিযোগ করা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
২০১০ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেট থেকে কাদের মোল্লাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ট্রাইব্যুনালে তদন্তকারী সংস্থার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আটক রাখার আদেশ দেয়া হয়।
২০১২ সালের গত ২৮ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের ঘটনায় চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন এবং আসামিপক্ষে ছয়জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেন।
এর আগে ২০১২ সালের ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৫ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ মামলাটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়।

কাদের মোল্লার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
আবদুল কাদের মোল্লার জন্ম ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায়। তিনি প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করার পর ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাস করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হন। মেধাবী ছাত্র আবদুল কাদের মোল্লা প্রাইমারি ও জুনিয়র স্কুল পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে।
১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর (ইনস্টিটিট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ)-এ ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন (সোস্যাল সায়েন্স)-এ ভর্তি হই। ১৯৭৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এ কোর্সে। এরপর তিনি ১৯৭৭ সালে এডুকেশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
আবদুল কাদের মোল্লা স্কুলজীবনে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। ১৯৬৬ সালে তিনি তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সাথে জড়িত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।
বিডিআর সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উদয়ন বিদ্যালয়ে ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া বাইশরশি শিবসুন্দরী অ্যাকাডেমিতে শিক্ষকতা এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনেও চাকরি করেছেন তিনি।
আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৮২-৮৩ সালে পরপর দুইবার ঢাকা ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট (ডিউজে) সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবনে আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৮৩ সালে ঢাকা মহানগর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৮৭ একই শাখার আমির নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। জামায়াতের নেতৃত্বপর্যায়ের ভূমিকা পালনের সময় তিনি বিভিন্নপর্যায়ে জোটগত রাজনীতির কারণে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতার ভূমিকাও পালন করেছেন।
১৯৬৪ সালে আইউববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কারণে তাকে চারবার কারাবরণ করতে হয়েছে।
আবদুল কাদের মোল্লা চার মেয়ে ও দুই পুত্রসন্তানের জনক।
আবদুল কাদের মোল্লা মামলায় আসামিপক্ষে প্রধান আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এ ছাড়া অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, তাজুল ইসলাম, শিশির মো: মনির, সাজ্জাদ আলী চৌধুরী প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, মোহাম্মদ আলী প্রমুখ।

কাদের মোল্লার ফাঁসি স্থগিত

মেহেদী হাসান, ১০/১২/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড বাস্তবায়নের কার্যক্রম আগামীকাল সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।  বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন আজ রাত সোয়া দশটায় এ আদেশ দেন।

আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি স্থগিত করা এবং রিভিউ আবেদন নিয়ে রাতে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর বাসায় যান আসামী পক্ষের আইনজীবীরা। সেখানে শুনানী শেষে আগামীকাল সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়।  মৃত্যুদন্ড কার্যকর স্থগিত হওয়ার পর এ বিষয়ক আবেদনের ওপর আগামীকাল সুপ্রীম কোর্টে  শুনানী হবে বলে জানিয়েছেন  সরকার  এবং আসামী পক্ষের  আইনজীবীরা।

আজ রাতে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর বাসভবন থেকে বের হয়ে আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী  খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের  মৃত্যুদন্ড   কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার আদেশের বিষয়ে অবহিত করেন।
এসময়  অপক্ষেমান সাংবাদিকদের খন্দকার মাহবুব হোসেন ও ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক  আদেশের কপি প্রদর্শন করেন।  ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক  সাংবাদিকদের বলেন,  আজ  (মঙ্গলবার) রাতে ফাঁসি কার্যকরের যে প্রস্তুতি চলছিল তা বুধবার সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত স্থগিত করেছেন চেম্বার বিচারপতি। আমরা এখনই এ আদেশ নিয়ে সুপ্রীম কোর্টে যাব এবং  কিছু  আনুষ্ঠানিকতা  শেষে দ্রুত জেলগেটে পৌছানোর ব্যবস্থা করব। 

ঘড়ির কাটায় তখন দ্রুত পার হচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে আইনজীবীরা সুপ্রীম কোর্টের একজন কর্মকর্তাকে  সাথে নিয়ে  প্রথমে যান সুপ্রীম কোর্টে। সেখান থেকে কোর্টের কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে তারা দ্রুততার সাথে ছুটে যান কেন্দ্রীয় কারাগারে। সিনিয়র জেল সুপার অন্যান্য কারা কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে আইজি প্রিজনস এর সাথে দেখা করতে চলে যান। রাত পৌনে ১২টায় সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী সাংবাদিকদের জানান তারা চেম্বার জজের আদেশ  পরীক্ষা করে দেখেছেন। সব কিছু ঠিক হওয়ায় রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা যাচ্ছেনা।

এদিকে অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এবং ট্রাইব্যুনালে সরকার পক্ষের আইনজীবীদের সমন্বয়কারী এম কে রহমান এর কাছে  গতকাল মধ্যরাতে সাংবাদিকরা  যান তার মতামত জানতে।  সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেহেতু স্থগিত হয়েছে তাই বুধবার সাড়ে দশটার মধ্যে রায় আর কার্যকর হচ্ছেনা।

মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার ঘোষনা  এবং পরের দৃশ্যপট :
সরকারের নির্দেশে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয়  কারাগারে আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে জেল কর্তৃপক্ষ। স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এবং সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলীর পক্ষ থেকেও গতকাল রাতে ঘোষনা দেয়া হয় রাতেই ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে।  দেশে এবং বিদেশে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে। ফাঁসি কার্যকরের পূর্বে আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবারের সদস্যদের রাতে ডেকে পাঠানো হয় আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য।  ফাঁসি কার্যকরের জন্য যখন আর মাত্র ঘন্টা দেড়েক মাত্র বাকি ঠিক এমন সময়  স্থগিতাদেশের ঘোষনা আসে।

বিকেলে আব্দুল কাদের মোল্লার মগবাজারস্থ বাসভবনে তার স্ত্রী সানোয়ার জাহানের কাছে চিঠি পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। চিঠিতে আব্দুল কাদের মোল্লার স্ত্রী এবং নিকটাত্মীয়দের রাত ৮টার মধ্যে আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করার জন্য অনুরোধ করা হয়।  সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে পরিবারের পক্ষ থেকে এ চিঠির খবর আব্দুল কাদের মোল্লার আইনজীবীরা জানানো হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। এরই মধ্যে বিভিন্ন টিভির খবরে প্রচারিত হতে থাকে রাতেই রায় কার্যকরের  খবর। কাদের মোল্লার পরিবারকে চিঠি দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সাক্ষাতের খবর পাওয়ার পরপরই আসামী পক্ষের সকল আইনজীবী ছুটে যান সুপ্রীম কোর্টের চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর কাকরাইল বাসভবনে।  রাতের মধ্যে রায় কার্যকর স্থগিত করা এবং রিভিউ আবেদন শুনানী নিয়ে  সন্ধ্যার পর তারা রওয়ানা দেন চেম্বার জজের বাসায়।  আবেদন নিয়ে যাবার পর বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তাদেরকে নির্দেশ দেন আবেদনের কপি  নিয়ে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে  আলমের বাসায় যাবার জন্য। কিন্তু মাহবুবে আলমকে বাসায় না পেয়ে তারা তাৎক্ষনিকভাবে আবার  ফিরে আসেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর বাসভবনে। এরপর  রাত সোয়া দশটার দিকে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন  আদেশ দেন  মৃত্যুদন্ড  কার্যক্রম স্থগিত করার বিষয়ে। 

মঙ্গলবার রাত ১০ টা ৫০ মিনিটে এডভোকেট এডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান ও  তাজুল ইসলাম ও কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন। এর কিছুক্ষণ পর ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন কারাগারে প্রবেশ করেন। এ সময় আইনজীবী টিমের আরো ৪ সদস্য বাইরে অপেক্ষারত ছিলেন।

জেল থেকে বের হয়ে ব্যারিস্টার রাজ্জাক  বলেন, যেহেতু আদালত বন্ধ রয়েছে, আদেশের সার্টিফাইড কপি পাওয়া যাবেনা। সেজন্য আদালতের এ্যসিসট্যান্ট ইসলাম উদ্দিনকে দিয়ে আদেশের একটি কপি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছি। ইসলাম উদ্দিন আদেশের কপি আইজি প্রিজনস এর  কাছে নিয়ে গিয়েছেন। এতে আর বুঝতে বাকি রইলনা আদেশের বিরুদ্ধে আর কিছু করা যাবেনা। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অপেক্ষা করুন। আগামীকাল সুপ্রীমকোর্ট কি আদেশ দেন তার জন্য। আমরা সকালে যাব সুপ্রীম কোর্টে শুনানীর জন্য। এ বিষয়ে এখনি কিছু বলা যাচ্ছেনা। আমরা নিয়ম অনুযায়ী রিভিউ পিটিশন দাখিল করেছি। এখন আদেশের বাইরে কারা কর্তৃপক্ষের কিছু করার নেই।

বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর বাসায়  সিনিয়র আইনজীবীদের সাথে আসামী পক্ষে আরো যাবা ছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এর এসিসট্যান্ট সেক্রেটারি সাইফুর রহমান, অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান করিব, ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিক, ইমরান সিদ্দিক, শিশির মনির, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসিম, অ্যাডভোকেট সাজ্জাদ আলী চৌধুরী, অ্যাডভোকেট তারিকুল ইসলাম, আসাদ উদ্দিন, গাজি এমএইচ তামিম, আমির হোসেন মানিক প্রমুখ ।

স্থগিতাদেশ এর আগের দৃশ্যপট:
গতকাল সোমবার রাতেই খবর ছড়িয়ে পড়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ওই রাতেই ফাঁসি দেয়া হতে পারে। সোমবার রাতে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত করা, মঞ্চে লাইট লাগানো, ফাঁসির মহড়া প্রভৃতি ঘটনার আলোকে খবর বের হয় রাতেই ফাঁসি কার্যকর করা হতে পারে।

অবশেষে আজ কর্তৃপক্ষ  মঙ্গলবার রাতে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষনা দেয়। দেশের এবং বিদেশের সকল সংবাদ মাধ্যমের বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক ভিড় করেন কেন্দ্রীয় কারাগার এর সামনে। রাতে  ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটক থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান  রাত ৮টায় সিনিয়র জেল সুপার সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাত ১২টা ১ মিনিটে আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। তিনি জানান, আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে দেখা করার জন্য তার স্ত্রী সানোয়ার জাহান, ছেলে জামিল হাসান, মেয়ে আমাত উল্লাহ পারভিনসহ মোট ২৩ জন নিকটাত্মীয় জেল অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন সন্ধ্যা ৭টা ৫২ মিনিটে। তারা এখন আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে কথা বলছেন।

সিনিয়র জেল সুপার আরো জানান, নিরাপত্তার স্বার্থে জেলখানার আশপাশ এলাকায় যারা বসবাস করেন তাদের নিজ নিজ বাসায় প্রবশে করতে অনুরোধ করা হয়েছে এবং সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

এ দিকে কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশে বিপুলসংখ্যক র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন নিয়োজিত রয়েছেন। নাজিম উদ্দিন রোড, বেগম বাজার, চকবাজার প্রভৃতি এলাকায় প্রধান প্রধান সড়ক ব্লক করে দেয়া হয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র জানিয়েছে, বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে লাল কাপড়ে মোড়া খামের ওপর লাল কালিতে লেখা চিঠি ঢাকা জেলার ডিসি, লালবাগ জোনের ডিসি, পুলিশ সুপার, চকবাজার থানার ওসি, সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্ট অফিসে কারাগারের মেসেঞ্জার মারফত পাঠানো হয়েছে।

ফাঁসি কার্যকরের জন্য ছয়জন জল্লাদ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এরা হলোÑ শাহজাহান ভূঁইয়া, মনোয়ার হোসেন, ফয়েজ আহমেদ, হাফিজ উদ্দিন, রাজু ও জনি। মূল জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে তারা গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো ফাঁসির মঞ্চে আব্দুল কাদের মোল্লার ওজনের সমান বালুর বস্তা ও কলাগাছ ঝুলিয়ে মহড়া চালিয়েছে। ফাঁসির ম্যানিলা রশি পিচ্ছিল করতে দেয়া হয়েছে তেল। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত চলে ফাঁসির মঞ্চ ধোয়ামোছার কাজ।

আজ বিকেলে আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবারের কাছে চিঠি পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। চিঠিতে আব্দুল কাদের মোল্লার স্ত্রী এবং নিকটাত্মীয়দের রাত ৮টার মধ্যে আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করা হয়। চিঠি পেয়ে তারা রাতে  তারা দেখা করেন আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে।

জোর করে হত্যা করা হচ্ছে আমার আব্বুকে : রাতে সাক্ষাতের পর ছেলে হাসান জামিল
রাত ৮টা ৫০ মিনিটে আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে দেখা করে জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসেন আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজন। এ সময় সাংবাদিকেরা তাদের ঘিরে ধরেন। আব্দুল কাদের মোল্লার বড় জেলে হাসান জামিল জানান, শুধু ইসলামি আন্দোলন করার কারণে আমার আব্বুকে হত্যা করা হচ্ছে। তিনি যদি ইসলামি আন্দোলন না করে অন্য কোনো দল করতেন তাহলে তিনি অনেক ভালো থাকতেন। হাসান জামিল বলেন, ‘আজ (গতকাল) সকালে আমার পিতার সাথে আমাদের আইনজীবীরা সাক্ষাৎ করেছেন। তখন জেল কর্তৃপক্ষ আমার আব্বু ও আইনজীবীদের বলেছিলেন, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মার্সি পিটিশনের জন্য সাত দিন সময় পাবেন। কিন্তু সেই সময়টুকুও না দিয়েই আজ রাতেই আমাদের ডেকে আনা হলো সাক্ষাতের জন্য। জোর করে আমার আব্বুকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হত্যার জন্য। এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যা। আমাদের আইনজীবী এবং আমার আব্বুকে এখনো রায়ের কপি দেয়া হয়নি। রায় না পড়ে কিভাবে আমার পিতা মার্সি পিটিশন করবেন?’ হাসান জামিল বলেন, আমার আব্বুর মামলার ক্ষেত্রে যেমন অনিয়ম হয়েছে, তেমনি জেল কর্তৃপক্ষও অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন। অনৈতিকভাবে তাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে। (গতকাল) সকালে আইনজীবীদের ডাকা হয়েছিল তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। এরপর কিভাবে বিকেলেই পরিবারের সদস্যদের তারা ডেকে পাঠায় সাক্ষাতের জন্য?

আব্দুল কাদের মোল্লার আত্মীয় স্বজন দেখা করার আগে সকালে তার সাথে দেখা করেন দুই আইনজীবী।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড  প্রদান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ড দেয় কাদের মোল্লাকে। গত ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয। এরপর রিভিউ আবেদন  এবং জেলকোডের প্রয়োগ নিয়ে দেশে এবং বিদেশে বিতর্ক অব্যাহত থাকা  অবস্থায়  এবং দেশে বিরাজমান চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মাঝে সরকার তাড়িঘড়ি করে মঙ্গলবার  রাতেই আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের  সিদ্ধান্ত নেয়।

বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৩

কাদের মোল্লার ফাঁসি

মেহেদী হাসান, ১২/১২/২০১৩,  বৃহষ্পতিবার  দিবাগরত রাত ১২টা ৩৫ মিনিট

আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
আজ সকালে রিভিউ আবেদন খারিজের পর রাতেই কার্যকর করা হলো তার ফাঁসি।
জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের সব অনুরোধ এবং আপত্তি উপেক্ষা করে  সরকার আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করল।

রাত ১১টা ১৩ মিনিটের সময় আবদুল কাদের মোল্লার লাশ অ্যাম্বুলেন্সযোগে তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয় কড়া নিরাপত্তায় ব্যবস্থায়। এসময় কারাগার থেকে ১৪টি গাড়ির বহর  বের হয়ে লাশবাহী গাড়ির সাথে। ফাঁসি কার্যকরের সময় কেন্দ্রীয় কারাগারের চারপাশ এবং আশপাশের সব এলাকায় বিপুল সংখ্যক  র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের  সমন্বয়ে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়।

ফাঁসি কার্যকরের পর সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশঙ্খলা বাহিনীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা প্রধান কারা ফটকের সামনে  আসেন। এসময় বিপূল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেল গেটের দুই দিকে সারিবদ্ধ হয়ে দাড়ান। লাশবাহী গাড়ি বের হয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করেন তারা। ঢাকা জেলা প্রশাসক ইউসুফ হারুন এসময় সাংবাদিকদের জানান  মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ১০টা ১ মিনিট থেকে পরবর্তী ২০ মিনিট পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা হয়  কাদের মোল্লার দেহ। মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে এ মর্মে ডাক্তার কর্তৃক পরীক্ষার পর  পাঁচজন জল্লাদ নামিয়ে আনে লাশ।
সূত্র জানায় এরপর পায়ের রগ কর্তনসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে  গোসল এবং কাফনের কাপড় পড়িয়ে স্বজনদের কাছে লাশ পৌছানোর জন্য  অ্যাম্বুলেন্সে করে রওয়ানা দেয়া হয়। শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঢামে ছ/৭১-০৬৫৪ নম্বরধারী অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে  যাওয়া হয় লাশ।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আজ দুপুর ১২টায় কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পরপরই শুরু হয়ে যায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি। রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাবার পর সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়ে বৃহস্পতিবার রাতেই কার্যকর করা হবে ফাঁসি। সরকারের পক্ষ থেকেও ঘোষণা করা হয় রিভিউ আবেদন খারিজের পর ফাঁসি কার্যকরে আর কোনো বাঁধা নেই। সন্ধ্যার পর আবদুল কাদের মোল্লার পরিবারের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখা করেন তার সাথে। কাদের মোল্লা তার আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাতের সময় আইনজীবীদের সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সে অনুযায়ী রাত সাড়ে ৮টার দিকে আইনজীবীরা তার সাথে সাক্ষাতের জন্য গেলে জেল কর্তৃপক্ষ সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। কারা কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়ে দেন ফাঁসির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। তাই আর দেখা করার অনুমতি নেই। আইনজীবীদের কাছে উপস্থিত সাংবাদিকেরা এ কথা জানার পরই সবাই নিশ্চিত হয়ে যায় যে, রাতেই কার্যকর করা হবে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড। গত মঙ্গলবার রাতে ফাঁসি কার্যকর করার উদ্যোগ বিষয়ে সরকার এবং জেল কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হলেও গতকাল আগে থেকে কোনো কিছু গণমাধ্যম বা অন্য কাউকে জানায়নি জেল কর্তৃপক্ষ বা সরকারের অন্য কেউ। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, শিশির মো: মুনির, মতিউর রহমান আকন্দ ও ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন গিয়েছিলেন আবদুল কাদের মোল্লার সাথে সাক্ষাতের জন্য।

সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল নয়া দিগন্তকে জানান, আমরা আব্বুর সাথে  দেখা করার আবেদন করেছিলাম। আমাদের ছয়-সাতজনকে দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন জেল কর্তৃপক্ষ। আমরা যাচ্ছি দেখা করার জন্য। কারাগারের সামনে থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন ৬টা ২২ মিনিটের সমায় আবদুল কাদের মোল্লার আত্মীয়স্বজন কারাগারে প্রবেশ করেন এবং ৭টার দিকে তারা বের হন। স্ত্রী সানোয়ার জাহান, ছেলে এবং মেয়েসহ ১০ জন নিকটাত্মীয় তার সাথে সাক্ষাৎ করে বের হয়ে যান। 

কারা ফটকের সামনে থেকে আমাদের প্রতিবেদক জানান, রাত ৮টা ৫৬ মিনিটের সময় ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার, অতিরিক্ত আইজি প্রিজন কর্নেল ইফতেখার আলম কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। একই সময় ঢাকা জেলা প্রশাসক ইউসুফ হারুন ও কেন্দ্রীয় কারা মসজিদের ইমাম মনির হোসেন মূল ফটক দিয়ে কারাগারে প্রবেশ করেন। রাত সোয়া ৯টার দিকে সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক মোল্লা প্রবেশ করেন। এ সময় কারাগারের  একটি সূত্র জানায়, ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত। রাতেই কার্যকর করা হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী যাদের উপস্থিত থাকার কথা তারা সবাই উপস্থিত হয়েছেন।

রিভিউ আবেদন খারিজের পর সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার শামসুল ইসলাম গনমাধ্যমকে জানান বিকেল ৩টার পরে আমরা রিভিউ আবেদন খারিজের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তৃপক্ষ, রাষ্ট্রপক্ষ, আসামিপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অফিসে পাঠিয়েছি।

সরকারের নির্দেশে মঙ্গলবার রাতেই আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। রাত ৮টায় আত্মীস্বজনদের সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাদের চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠানো হয় ওই দিন। তার আগে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত করে দেয়া হয় মহড়া। ছয়জন জল্লাদকে কারাগারে আনা হয়। ওই দিন জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের দু’জন প্রতিমন্ত্রীও ঘোষণা করেন রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হবে। কিন্তু ফাঁসি কার্যকরের মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। ফলে আবারো আলোচনায় চলে আসে ঘটনাবহুল এবং আলোচিত এ মামলাটি। গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সুপ্রিম কোর্টের প্রতি। বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে শুরু হয় রিভিউ আবেদনের শুনানি। এ ছাড়া আসামিপক্ষ স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানোরও আবেদন করে। রিভিউ আবেদন চলবে কি চলবে না এ বিষয়ে বুধবার শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করায় ফাঁসি স্থগিতাদেশও বহাল থাকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার সকালে আবার শুরু হয় রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি। শুনানি শেষে ১২টা ৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করেন আবেদন ডিসমিসড।
এর পরপরই সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ভবনে সরকার এবং সরকারবিরোধী আইনজীবীদের শুরু হয় মিছিল-পাল্টামিছিল এবং পরস্পর বিরোধী স্লোগান। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে মিছিল স্লোগান, ধস্তাধস্তি এবং হট্টগোল। রিভিউ আবেদন শুনানি উপলক্ষে গতকাল হাইকোর্ট অঙ্গনে বিপুল সংখ্যক র‌্যাব পুলিশি, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা বলয়।

সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকা থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, (বৃহস্পতিবার) রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রস্ততি উপলক্ষে জেলখানার আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। আশপাশের সব সড়কে  বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সাধারণ লোকজন এবং যানবাহন চলাচল সীমিত করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মোড়ে ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। কারাগারের আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী ছাড়া কাউকে ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এলাকায় প্রবেশের পূর্বে তাদের তল্লাশি করা হচ্ছে। নাজিম উদ্দিন রোড, বেগম বাজার, চকবাজার প্রভৃতি এলাকায় প্রধান প্রধান সড়ক ব্লক করে দেয়া হয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। 

এ ছাড়া ফাঁসি কার্যকরের খবর উপলক্ষে সন্ধ্যার আগে থেকেই দেশের এবং বিদেশের বিপুল সাংবাদিক ভিড় করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে।

গত মঙ্গলবার আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের জন্য ছয়জন জল্লাদ প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এরা হলেন শাহজাহান ভূইয়া, মনোয়ার হোসেন, ফয়েজ আহমেদ, হাফিজ উদ্দিন, রাজু ও জনি। মূল জল্লাদ শাহজাহান ভুইয়ার নেতৃত্বে তারা রোববার এবং সোমবার ফাঁসির মঞ্চে আবদুল কাদের মোল্লার ওজনের সমান বালুর বস্তা ও কলাগাছ ঝুলিয়ে মহড়া চালিয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত চলে ফাঁসির মঞ্চ ধোয়া মোছার কাজ।

রিভিউ আবেদন শুনানি : রিভিউ আবেদনের বিষয়ে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ আবেদন করার কোনো সুযোগ নেই। এটি একটি বিশেষ আইন এবং বিশেষ আদালত। সংবিধানের ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে  ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের  (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়,  এই সংবিধানের  অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবে না।’  তাই রিভিউ আবেদন চলতে পারে না বলে তিনি যুক্তি তুলে ধরেন।

অপর দিকে আসামিপক্ষে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সংবিধানের ১০৫ ধারায় বলা হয়েছে ‘সংসদের যেকোন আইনের বিধানাবলীর-সাপেক্ষে  এবং আপিল বিভাগ কর্তৃক যে কোন বিধি-সাপেক্ষে আপিল বিভাগের ঘোষিত কোন রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে।’ 
তা ছাড়া আজ  কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে জেল প্রয়োগেরও আবেদন করে আসামিপক্ষ। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কাদের মোল্লাকে জেলকোডের বিধান মেনেই এত দিন জেলে রাখা হয়েছে। দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে কেন প্রয়োগ করা হবে না?
এর বিরোধিতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানিতে বলেন, ট্রাইব্যুনালের দণ্ডাদেশ বাস্তবায়ন সরকার করবে বলে আইনে বলা হয়েছে। জেলকোড প্রয়োগ করার দরকার নেই।

সরকারের শীর্ষপর্যায়ে বৈঠক  : এ দিকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ  রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয়ে জরুরি এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর আইনবিষয়ক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সভাপতিত্বে প্রায় দুই ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে চলা বৈঠকে কাদের মোল্লার রায় কার্যকরে আইনগত দিক নিয়ে আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এর আগে একই বিষয় নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে গত ৯ ও ১০ ডিসেম্বর পরপর দুই দিন রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ। এসব বৈঠকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া এবং আইনশৃঙ্খলার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়াও রায় কার্যকরের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) ও  জেলকোডসহ ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়।

আজকের  বৈঠকে আইন উপদেষ্টা ছাড়াও আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো: কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম এবং দুই মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

পরপর দুই দিনের বৈঠকে কেউ কোনো কথা না বললেও আজ  বৈঠকের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছেন, এখানে জেলকোড এপ্লিকেবল না। কাদের মোল্লার প্রাণ ভিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। তাকে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার কথা আগে থেকেই বলা হয়েছে; কিন্তু তিনি (কাদের মোল্লা) এর কোনো সুযোগ নেননি। এখন আর কোনো সুযোগ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এ দিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের রায় জেল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পর রিভিউ আবেদনের আগেই রায় কার্যকরের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।

মামলার বিবরণ : ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড  প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন কাদের মোল্লাকে। ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। এরপরই শুরু হয়ে যায় ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি।

রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে  আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের  মোট ছয়টি অভিযোগ আনে। ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লাকে দুইটি অভিযোগে যাবজ্জীবন, তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড এবং একটি অভিযোগ থেকে খালাস দেয়।  আপিল বিভাগের রায়ে একটি যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এ অভিযোগটি হলো মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী,  তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা। এটি ছিল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ছয় নম্বর অভিযোগ। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনাল চার নম্বর অভিযোগ কেরানীগঞ্জ ঘাটারচর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ খালাস বাতিল করে যাবজ্জীবন সাজা দেন। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত অপর একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে দণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ।
ছয়টি অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লার সাজা হয় ৪:১ ভিত্তিতে। অর্থাৎ বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা আপিল বিভাগের ছয়টি সাজার ক্ষেত্রেই ভিন্ন মত এবং ভিন্ন রায় প্রদান করেন। ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে পাঁচটি অভিযোগ থেকে তিনি আবদুল কাদের মোল্লাকে সম্পূর্ণরূপে খালাস দেন। এগুলো হলো মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যা, মিরপুরে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা, মিরপুরে সাংবাদিক  আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব হত্যা, কেরানীগঞ্জে ঘাটারচর গণহত্যা হত্যা এবং মিরপুর আলুবদি গ্রামে গণহত্যা। একটি অভিযোগ যথা মিরপুরে হযরত আলী পরিবার হত্যার অভিযোগে তিনি ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখেন।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেট থেকে কাদের মোল্লাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ট্রাইব্যুনালে তদন্তকারী সংস্থার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আটক রাখার আদেশ দেয়া হয়।
২০১২ সালের ২৮ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের ঘটনায় চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন এবং আসামিপক্ষে ছয়জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেন।
এর আগে ২০১২ সালের  ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৫ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ মামলাটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়।
গত ৩১ মার্চ প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় আপিল আবেদন শুনানির জন্য। ১ এপ্রিল থেকে শুনানি শুরু হয়।

বিশ্বজুড়ে আলোচিত ঘটনাবহুল একটি মামলা

মেহেদী হাসান, ১২/১২/২০১৩
নানা কারনে শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ্বজুড়ে একটি আলোচিত এবং ঘটনাবহুল  মামলা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে  মামলাটি। এ মামলাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনার কারনে বারবার বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম হয়  মামলাটি।  সর্বশেষ মৃত্যুদন্ড কার্যকরের মাত্র দেড়ঘন্টা আগে তা স্থগিত হওয়ায় আবারো এ মামলা দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিশ্বসম্প্রদায়ের।

ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন। যার প্রতিকৃয়া হিসেবে উত্থান হয় হেফাজতে ইসলাম এবং শেষ পর্যন্ত যা গড়ায় অপারেশন শাপলা পর্যন্ত। যুদ্ধাপরাধ ইস্যু, আব্দুল কাদের মোল্লা মামলা এবং এরই  ধারাবাহিকতায় একের পর এক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা শেষ পর্যন্ত এক সময় বাংলাদেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতিরও অন্যতম নির্ধারক হিসেবে আবির্ভূত   হয়। শাহবাগের ধারাবাহিকতায় অপারেশন শাপলা এবং এর পরে অনুষ্ঠিত চারটি সিটি নির্বাচনে সরকারের ধরাশয়ী হবার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বলেই প্রতীয়মান হয়েছে তখন। এসব ঘটনা ছাড়াও  আইনী গুরুত্বের কারনে এ মামলা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি আলোচিত ঘটনা হিসেবে স্থান করে নেয়। কারণ এই বিচারের রায় হয়ে যাবার পর  আইন সংশোধন করা হয়েছে। বিচারিক আদালতের সাজা বাড়িয়ে আসামীকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে যা অতীতে এদেশে কখনো হয়নি বলে দাবি করে  আসাসী পক্ষ।

চলতি বছর পাঁচ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীন সাজার রায় দেয়া হয়। এ রায়কে কেন্দ্র করে  শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠে । আন্দোলনকারীদের দাবি আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে হবে। এ  দাবির প্রেক্ষিতে  ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়  সরকার পক্ষের জন্য আপিলের বিধান রেখে।  আইন সংশোধনের পর সরকার আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে আপিল আবেদন করে। 

ট্রাইব্যুনাল আইনে পূর্বের বিধান ছিল আসামী পক্ষ সাজার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আসামীর সাজা হলে রাষ্ট্রপক্ষের জন্য আপিলের বিধান ছিলনা। আসামীকে খালাস দেয়া হলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের জন্য আপিলের বিধান ছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধন করে উভয় পক্ষকে আপিলের সমান সুযোগ দেয়া হয় এবং আইনের সংশোধনীকে  ২০০৯ সাল থেকে কার্যাকারিতা  প্রদান করা হয়।

আইনের সংশোধনীর কারনে আব্দুল কাদের মোল্লার আপিল শুনানী শেষ পর্যন্ত অ্যামিকাস কিউরি পর্যন্ত গড়ায়। এটিও ছিল এ মামলার অন্যতম একটি আলোচিত অধ্যায়।  ১৮ ফেব্রুয়ারি আইনের যে সংশোধন করা হয়েছে তা আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি-না জানতে চেয়ে ২০ জুলাই সুপ্রীম কোর্টের সাতজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেয় আপিল বিভাগ। এরা হলেন, সাবেক বিচারপতি  টি এইচ খান, সাবেক এটর্নি জেনারেল প্রবীন আইনবিদ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ।

ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড প্রদান করে। এরপরই শুরু হয় রিভিউ আবেদন  নিয়ে বিতর্ক। ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রায় কার্যকরিতার উদ্যোগ নেয়ার সাথে সাথে জেলকোড প্রয়োগ  না করা নিয়ে বিতর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। আসামী পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয় আপিল বিভাগ মৃত্যুদন্ড দিয়েছে তাই ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক জারি করা মৃত্যু পরোয়ানা বেআইনী। তাছাড়া এতদিন জেলকোড মেনে তাকে জেলে রাখা হলেও মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে জেলকোড না মানা তার প্রতি অবিচার। এ বিতর্ক অবসানের পূর্বেই ১০ ডিসম্বের রাতে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের উদ্যোগ নেয় সরকার। এ পরিস্থিতিতে রাতে আসামী পক্ষের আইনজীবীরা দণ্ড স্থগিত করার আবেদন এবং রিভিউ আবেদন নিয়ে ছুটে যান চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর বাসভবনে। রাত সোয়া দশটার দিকে তিনি মৃত্যুদন্ড কার্যকর স্থগিত করে আদেশ দিলে আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয় এ মামলা।

সর্বশেষ গত ৯ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী নিয়ে জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে ।  আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী প্রকৃত মোমেনা বেগমকে হাজির না করে তার স্থলে অপর এক মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে হাজির করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ করেছে আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবার।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন মিলনায়তনে জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ অভিযোগ উত্থাপন করেন আব্দুল কাদের মোল্লার স্ত্রী সানোয়ার জাহান।

রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগের পক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয় প্রকৃত মোমেনা বেগমের ছবি মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে যে মোমেনা বেগমের ছবি রয়েছে তাকে হাজির করা হয়নি। তার স্থলে অপর মহিলাকে হাজির করা হয়েছে মোমেনা বেগম সাজিয়ে। তিনি বলেন, জল্লাদখানা যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের ছবির সন্ধান পাওয়ার পরই তারা সাক্ষী নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে সানোয়ার জাহান দাবি করেন, সর্বশেষ আমরা জানতে পেরেছি যে, একমাত্র সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেই মোমেনা বেগম আদৌ আদালতে সাক্ষী দিতেই আসনেনি। ক্যামেরা ট্রাইয়ালের নামে গোপন বিচারে ভুয়া একজন মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে আদালতে বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে ।  কিন্তু পরবর্তীতে জল্লাদখানায় সংরক্ষিত প্রকৃত মোমেনা বেগমের ছবি দেখে আমাদের আইনজীবীরা নিশ্চিত করেছেন আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া মোমেনা বেগম প্রকৃত মোমেনা বেগম ছিলেন না। অথচ এইরকম একজন ভুয়া স্বাক্ষীর তিন জায়গায় প্রদত্ত তিনরকমের বক্তব্যে পরে শুধুমাত্র তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। আমরা মনে করি তা নজিরবীহিন এবং এটি একটি ভুল রায়। আমরা মনে করি সংবিধান প্রদত্ত রিভিউ এর সুযোগ পেলে সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়গুলি তুলে ধরার মাধ্যমে আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় পাল্টে যাওয়া সম্ভব।

একদিন তোমার গলায়ও উঠতে পারে দড়ি

মেহেদী হাসান
তখন আমার ছাত্র জীবন। একিদন  মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড  নেতা  সাইয়্যেদ মোহাম্মদ কুতুব শহীদের শাহাদাতের ঘটনা বর্ননা করছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। বর্ননার সময় এক পর্যায়ে অধ্যাপক  গোলাম আযম আমার গলায় হাত রেখে বলেছিলেন একদিন তোমার গলায়ও উঠতে পারে এ দড়ি।

গত মঙ্গলবার সকালে আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে তার আইনজীবী দেখা করতে গেলে তাদেরকে তিনি এ ঘটনার কথা বলেন। ওইদিন রাতেই আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম জানান আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে সাক্ষাত করেন সেদিন। আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা বিষয়ে তাজুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে  বলেন, সাক্ষাতের সময় কাদের মোল্লা সাহেব আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলেছেন, আমার জীবনে যদি সত্যিকার অর্থে এরকম কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে তাহলে তোমরা সেদিন আমার চোখে পানি দেখতে পাবেনা। আমার মাথা সারা জীবন উচু ছিল উচু থাকবে। আমি জানি আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তার সাথে সত্যের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে যদি আমার জীবন দিতে হয় তবে তার চেয়ে বড় সৌভাগ্যের আর কি হতে পারে। মানব জীবনে শাহাদাতের মৃত্যুর চেয়ে উত্তম এবং বড় আর কিছুই হতে পারেনা। ইসলামী আন্দোলনের একজন  কর্মী হিসেবে মহান আল্লাহর কাছে এটাই ছিল আমার সারা জীবনের কামনা। মহান আল্লাহ যদি আমার সে প্রার্থনা কবুল করে থাকেন তবে এর চেয়ে বড় কোন পাওয়া আর আমার জন্য হতে পারেনা। এটা হলে আমি সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হব। মিশরসহ বিশ্বের  ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদসহ সমকালীন আরো অনেকের ইতিহাস আমার সামনে আছে। মৃত্যু নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই। এমন মৃত্যু আনন্দের, সৌভাগ্যের।

রিভিউ আবদেন খারিজ// কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রস্তুতি সম্পন্ন

মেহেদী হাসান, ২১/১২/২০১৩

জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বৃহষ্পতিবার রাতে যেকোন সময় ফাঁসি কার্যকর করার লক্ষ্যে সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং সরকারি সূত্রে জানা গেছে। 

সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ আজ দুপুর ১২ টায় কাদের মোল্লার  রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পরপরই শুরু হয়ে যায় মৃত্যুদন্ড কার্যকরের প্রস্তুতি।  সন্ধ্যার পর আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবারের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখা করেন তার সাথে। সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল জানিয়েছেন আমরা দেখা করার আবেদন জানিয়েছিলাম। আমাদের ছয়/সাতজনকে দেখা করার অনুমিত দিয়েছেন। আমরা যাচ্ছি দেখা করার জন্য।  কারাগারের সামনে থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন ৬টা ২২ মিনিটের সমায় আব্দুল কাদের মোল্লার আত্মীয় স্বজন কারাগারে প্রবেশ করেন এবং সাতটার দিকে তারা বের হন।

সুপ্রীম কোর্ট রেজিস্ট্রার শামসুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিকাল তিনটার পরে আমরা রিভিউ আবেদন খারিজের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তপক্ষ, রাষ্ট্রাপক্ষ, আসামীপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অফিসে পাঠিয়েছি।

সকালে কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজের সাথে সাথেই  খবর ছড়িয়ে পড়ে  আজ (বৃহষ্পতিবার) রাতেই ফাঁসি কার্যকর করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও ঘোষনা করা হয় রিভিউ আবেদন খারিজের পর ফাঁসি কার্যকরে আর কোন বাঁধা নেই।

সরকারের নির্দেশে মঙ্গলবার রাতেই আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। রাত আটটায় আত্মীস্বজনদের সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য জরুরিভিত্তিতে তাদের চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠানো হয়।  তার আগে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত করে দেয়া হয় মহড়া। ছয় জন জল্লাদকে কারাগারে আনা হয়। ওইদিন জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের দুজন  প্রতিমন্ত্রীও ঘোষনা করেন রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হবে। কিন্তু কার্যকরের মাত্র দেড়ঘন্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। ফলে  আবারো আলোচনায় চলে আসে ঘটনাবহুল এবং আলোচিত এ মামলাটি। গোটা দেশবাসীর  দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সুপ্রীম কোর্টের প্রতি। বুধবার  সকালে প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে শুরু হয় রিভিউ আবেদন এর শুনানী। এছাড়া আসামী পক্ষ স্থগিতাদেশ এর মেয়াদ বাড়ানোরও আবেদন করে। রিভিউ আবেদন  চলবে কি চলবেনা এ বিষয়ে বুধবার শুনানী শেষে বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করায় ফাঁসি স্থগিতাদেশও বহাল থাকে বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত। বৃহষ্পিতবার সকালে আবার শুরু হয় রিভিউ আবেদন এর ওপর শুনানী। শুনানী শেষে ১২টা ৭ মিনিটের সময় প্রধান বিচারপতি ঘোষনা করেন আবেদন  ডিসমিসড।

এরপরপরই সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন ভবনে সরকার এবং সরকার বিরোধী আইনজীবীদের শুরু হয় মিছিল পাল্টা মিছিল এবং পরষ্পর বিরোধী স্লোগান। দীর্ঘক্ষন ধরে চলে মিছিল স্লোগান, ধস্তাধস্তি এবং হট্টগোল। রিভিউ আবেদন শুনানী উপলক্ষে গতকাল হাইকোর্ট অঙ্গনে গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

আজ  সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকা  থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান, আজ রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রস্ততি উপলক্ষে জেলখানার আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। আশপাশের বিভিন্ন রাস্তায় বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সাধারন লোকজন এবং যানবাহন চলাচল সীমিত করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ন বিভিন্ন মোড়ে ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। কারাগারের আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী ছাড়া কাউকে ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছেনা। প্রবেশের পূর্বে তাদের তল্লাসী করা হচ্ছে। নাজিম উদ্দিন রোড, বেগম বাজার, চকবাজার প্রভৃতি এলাকায় প্রধান প্রধান সড়ক ব্লক করে দেয়া হয়েছে।
এছাড়া ফাঁসি কার্যকরের খবর উপলক্ষে সন্ধ্যার আগে থেকেই দেশের এবং বিদেশের বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক ভিড় করেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে। 

গত মঙ্গলবার আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের জন্য ছয়জন জল্লাদ প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এরা হলেন, শাহজাহান ভূইয়া, মনোয়ার হোসেন, ফয়েজ আহমেদ, হাফিজ উদ্দিন, রাজু ও জনি। মুল জল্লাদ শাহজাহান ভুইয়ার নেতৃত্বে তারা রোববার এবং সোমবার  ফাঁসির মঞ্চে আব্দুল কাদের মোলার ওজনের সমান বালুর বস্তা ও কলাগাছ ঝুলিয়ে মহড়া চালিয়েছে।  ফাঁসির রোপ ম্যানিলা রশি পিচ্ছিল করতে দেয়া হয়েছে তেল। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত চলে  ফাঁসির মঞ্চ ধোঁয়া মোছার কাজ।


রিভিউ আবেদন শুনানী :
রিভিউ আবেদনের বিষয়ে শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ আবেদন করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে  “এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের  (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়,  এই সংবিধানের  অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবেনা।”  তাই রিভিউ আবেদন চলতে পারেনা বলে তিনি যুক্তি তুলে ধরেন।
অপর দিকে আসামী পক্ষে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সংবিধানের ১০৫ ধারায় বলা হয়েছে ‘সংসদের যেকোন আইনের বিধানাবলীর-সাপেক্ষে  এবং আপিল বিভাগ কর্তৃক যে কোন বিধি-সাপেক্ষে আপিল বিভাগের ঘোষিত কোন রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে।’ 
তাছাড়া আজ কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে জেল প্রয়োগেরও আবেদন করে আসামী পক্ষ। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন কাদের মোল্লাকে জেলকোডের বিধান মেনেই এতদিন জেলে রাখা হয়েছে। দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে কেন প্রয়োগ করা হবেন?
এর বিরোধীতা করে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানীতে বলেন, ট্রাইব্যুনালের দন্ডাদেশ বাস্তবায়ন সরকার করবে বলে আইনে বলা হয়েছে। জেল কোড প্রয়োগ করার দরকার নেই।

সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক :
এদিকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয়ে জরুরী এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদের সভাপতিত্বে প্রায় দুই ঘন্টারও অধিক সময় ধরে চলা বৈঠকে কাদের মোল্লার রায় কার্যকরে আইনগত দিক নিয়ে আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এর আগে একই বিষয় নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে গত ৯ ও ১০ ডিসেম্বর পরপর দুই দিন রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ। এসব বৈঠকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া এবং আইন শৃঙ্খলার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়াও রায় কার্যকরের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) ও  জেলকোড সহ ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়।

আজকের  বৈঠকে আইন উপদেষ্টা ছাড়াও, আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুক, অ্যাটর্নী জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম এবং দুই মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
পরপর দুই দিনের বৈঠকে কেউ কোনো কথা না বললেও গতকাল বৈঠকের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছেন, এখানে জেল কোড এপ্লিকেবল না। কাদের মোল্লার প্রাণ ভিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। তাকে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার কথা আগে থেকেই বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি (কাদের মোল্লা) এর কোনো সুযোগ নেননি। এখন আর কোনো সুযোগ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এদিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের রায় জেল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পর রিভিউ আবেদনের আগেই রায় কার্যকরের জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।
                                     
মামলার বিবরন :
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড  প্রদান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ড দেয় কাদের মোল্লাকে। ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। এরপরই শুরু হয়ে যায় ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি।

রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে  আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের  মোট ছয়টি অভিযোগ এনেছিল। ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে দুইটি অভিযোগে যাবজ্জীবন, তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদন্ড এবং একটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছিল। আপিল বিভাগের   রায়ে একটি যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। এ অভিযোগটি হল  মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী,  তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও    মেয়েদের ধর্ষনের ঘটনা । এটি ছিল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ছয় নং অভিযোগ। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল চার নং অভিযোগ কেরানীগঞ্জ ঘাটার চর হত্যাকান্ডের  অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছিল। আপিল বিভাগ খালাস বাতিল করে যাবজ্জীবন সাজা দেয়। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত অপর একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে দণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ।
ছয়টি অভিযোগে আব্দুল কাদের মোল্লার সাজা হয় ৪:১ ভিত্তিতে। অর্থাৎ বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা আপিল বিভাগের ছয়টি সাজার ক্ষেত্রেই ভিন্ন মত এবং ভিন্ন রায় প্রদান করেন। ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে পাঁচটি অভিযোগ থেকে তিনি আব্দুল কাদের মোল্লাকে সম্পূর্ণরুপে খালাস দেন। এগুলো হল মিপুর বাংলা কলেজের ছাত্র  পল্লব হত্যা, মিরপুরে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা, মিরপুরে সাংবাদিক  আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব হত্যা, কেরানীগঞ্জে ঘাটারচর গনহত্যা হত্যা এবং মিরপুর আলুবদি গনহত্যা। একটি অভিযোগ যথা মিরপুরে হযরত আলী পরিবার হত্যার অভিযোগে তিনি ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখেন।

২০১০ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিমকোর্টের প্রধান গেট থেকে কাদের মোল্লাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ট্রাইব্যুনালে তদন্তকারী সংস্থার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগষ্ট কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আটক রাখার আদেশ দেয়া হয়।

২০১২ সালের গত ২৮ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের ঘটনায় চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন এবং আসামী পক্ষে ছয় জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করে।

এর আগে ২০১২ সালের  ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৫ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ মামলাটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়।

গত ৩১ মার্চ প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় আপিল আবেদন শুনানীর জন্য। ১ এাপ্রিল থেকে শুনানী শুরু হয়।



কাদের মোল্লার পরিচিতি :

মুক্তিযুদ্ধের পুরো দশকই এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সুতিকাগারখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কাটান আবদুল কাদের মোল্লা। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এই বেলাভ’মিতে সকলের কাছে তিনি অত্যন্ত মেধাবি হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন তিনি। শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত উদয়ন বিদ্যালয়ে যোগদান করেন ১৯৭৪ সালে।
১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (আইইআর) থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন (সোস্যাল সাইন্স) সম্পন্ন করেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে  এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন এডুকেশনাল এডমিনিস্ট্রেশন থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র।
১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার আমিরাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৬৪ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন জেলার বাইশরশি শিব সুন্দরী একাডেমী থেকে। ওই সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৬ সালে এইচএসসি ও ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাস করেন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে। মেধাবী ছাত্র আব্দুল কাদের মোল্লা প্রাইমারী এবং জুনিয়র স্কুল পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৫৯ এবং ১৯৬১ সালে।
কিছু সময়ের জন্য প্রিয় শিক্ষায়তন শিব সুন্দরী একাডেমীতে গেলেও শিক্ষকতা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলো তিনি কাটিয়েছেন উদয়ন স্কুল এবং তৎকালীন রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে (বর্তমানে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ)। সিনিয়র শিক্ষক পদে যোগদান করে এ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। চাকুরি করেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনেও। সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকার সময়ে ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে পরপর দুই বার ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আবদুল কাদের মোল্লা।
জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৮৩ সালে ঢাকা মহানগর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৮৭ সালে একই শাখার আমির নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। জামায়াতের রাজনীতিতে তিনি অত্যন্ত দক্ষ সংগঠক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জোটগত রাজনীতিতে বরাবরই তার অবস্থান ছিল মধ্যস্থতাকারীর ভ’মিকায়। এরশাদবিরোধি আন্দোলন থেকে শুরু করে সব পর্যায়েই লিয়াজোঁ রক্ষাকারী দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে আইউব বিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কারনে তাকে  চারবার কারাবরন করতে হয়। ২০১০ সালের ১৩ জুলাই থেকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত কারা অভ্যন্তরেই কাটান তিনি। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি চার কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক।