রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৩

একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে একটি ঘটনায় ৫০০/৬০০ হিন্দু হত্যার অভিযোগ

মেহেদী হাসান, ১/১২/২০১৩
জামায়াতে ইসলামের নায়েবে আমির একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে আজ ১৩ তম সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।  সাক্ষী একটি ঘটনায় ইউসুফের বিরুদ্ধে ৫ থেকে ৬শ হিন্দু হত্যার নির্দেশ দানের অভিযোগ আনেন।

জবানবন্দী :
আমার নাম শুধাংসু মন্ডল। পিতা মৃত ভবনাথ মন্ডল। ঠিকানা গ্রাম টেংরামারি, থানা রামপাল, জেলা বাগেরহাট। বংস ৫৯। আমি কৃষি কাজ করি।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পর এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষনার পর আমি স্থানীয় জবেদ কমান্ডারের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হই। ১৯ এপ্রিল ১৯৭১ আমি জানতে পারি রামপাল অডিটোরিয়াম হলে শান্তি  মিটিং হবে। ওই দিন বেলা দুইটা আড়াইটার সময় আমাদের এলাকার সব লোকজন ওই মিটিংয়ে উপস্থিত হই। বেলা তিনটা সাড়ে তিনটার সময় বাগেরহাট থেকে একটি লঞ্চ ৩০-৩৫ জন লোক নিয়ে রামপাল কলেজ ঘাটে ভেড়ে। ওই লঞ্চ থেকে ৩০-৩৫ জন লোক নামে। তারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ, একেএম ইউসুফ আলী জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে অডিটোরিয়াম সভাপস্থলে উপস্থিত হয়। ওই মিটিংয়ে রজ্জব আলী (মৃত), মোজাম ডাক্তার, মোসলেম ডাক্তার বক্তব্য দেয়ার পর সর্বশেষ বক্তব্য রাখেন এ কে এম ইউসুফ আলী। বক্তব্যে ইউসুফ আলী বলেন, মালায়ন খতম কর। এদেশ হিন্দুদের নয়। এদেশ মুসলমানদের। হিন্দুদের মালামাল, মহিলা গনিমতের মাল। এসবই ভোগ করতে পারে যেকেউ।  এতে কোন অপরাধ নেই। সর্বশেষ বলে লোটোপাট খাও, মালায়ন খতম কর। একথা বলার পর নারায়ে তকবির দিয়ে ইউসুফের সঙ্গীয় লোকজন স্থানীয় রামপাল সদরে অবস্থিত যাদব মিস্ত্রি, কৃষ্ণধন মিস্ত্রিী এদের বাড়ির ওপর চড়াও হয়ে ঘরবাড়ি তছনছ করে মালামাল নিয়ে লঞ্চযোগে বাগেরহাটের দিকে চলে যায়। এরপর আমি বাড়িতে এসে সবাইকে এ ঘটনার কথা খুলে বলি।
একেএম ইউসুফ আলী খুলনা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হন এবং বিভিন্ন এলাকার লোকজন নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। রাজাকার বাহিনীকে ইউসুফ আলী নির্দেশ দেয় হিন্দুদের বাড়ি নষ্ট করবা এবং যেখানে পাবা তাদের হত্যা করবা, এদেশ পাকিস্তান।

২১ মে ১৯৭১ রামপাল থানাধীন ডাকরা কালিবাড়িতে হাজার হাজার হিন্দুরা এসে আশ্রয় নেয় সেখান থেকে ভারতে চলে যাবার জন্য। একেএম ইউসুফ বাগেরহাটের রাজাকার রজ্জব আলী, সিরাজ মাস্টারকে নির্দেশ দেন ডাকরা কালিবাড়িতে আশ্রয় গ্রহণকারী ব্যক্তিদেরকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য। এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে রাজাকাররা ২১ মে, ১৯৭১ তারিখে ডাকরা কালিবাড়িতে আক্রমন করে ৫০০/৬০০ হিন্দুদের হত্যা করে। ওই হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া একজনের নাম আমি বলতে পারি। সে হল নারায়ন চৌকিদার যার বাড়ি আমার বাড়ি থেকে দুই মাইল দূরে।
এসময় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসান সাক্ষীকে প্রশ্ন করেন, ইউসুফ সাহেব যে নির্দেশ দিলেন তা আপনি জানলেন কি করে? আপনি তো র্নিদেশ দেয়ার সময় উপস্থিত ছিলেননা।
তখন সাক্ষী বলেন, আমাদের এলাকার শান্তি কমিটির নেতা সিদ্দিক মাস্টার, শাহাদাত কাজী ওরফে বাসার কাজী  প্রমুখদের কাছ থেকে শুনেছি ইউসুফ সাহেবের নির্দেশে রাজাকাররাও ওইসব ঘটনা ঘটায়।
ট্রাইব্যুনাল আবার প্রশ্ন করেন, যে দুই জনের নাম বললেন তারা কি জীবিত না মৃত। সাক্ষী বলেন, মৃত।

এরপর সাক্ষী বলেন, ২২ মে ১৯৭১ সকাল বেলা নারায়ন চৌকিদার আমাদের বাড়িতে এসে সবাইকে বলল এদেশে  আর থাকা যাবেনা। সবাইকে ভারতে চলে যেতে হ।ে তারপর আমরা আমাদের গ্রামের সবাইকে নিয়ে ভারতে চলে যাই। ভারতের বশিরহাটে আশ্রয় নেই। সেখানে আমার বাবা মাকে রেখে আমি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য বিহারের চালুকিয়াতে চলে যাই। ২৭ দিন ট্রেনিং শেষে আফজাল কমান্ডারের সঙ্গে ৯ নং সেক্টর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। দেশে এসে বিভিন্ন রনাঙ্গনে যুদ্ধ করি।
সর্বশেষ ১৩ অক্টেবার ১৯৭১ বাগেরহাট থানার ঘনশ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি করে। ওই দিনই বাগেরহাট থেকে রাজাকার রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে রাজাকাররা আমাদের ঘিরে ফেলে চারদিক থেকে। রাজাকারদের সাথে আমাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। জায়গাটি অচেনা বিধায় আমরা যুদ্ধে টিকতে না পেরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাই। আমরা চার/পাঁচজন পাশের একটি সুপারি বাগানে আশ্রয় নেই। পরদিন ১৪ অক্টোবর ভোরে একটি লোক আমাদের দেখে ফেলে। সে আমাদেরকে জানায় যেখানে আছেন সেখান থেকে নডবেননা। আপনাদের বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় লোকজনকে ধরৈ রাজাকাররা চুলকাঠি বাজারে নিয়ে গেছে। সেখানে তাদেরকে হত্যা করে হবে বলে শুনেছি। এই লোকটি পরে আমাদেরকে এসে জানায় ইউসুফের নির্দেশে চুলকাঠি বাজারের কাছে একটি কাঠের ব্রিজের ওপর মোট সাতজনকে রাজাকাররা হত্যা করেছে। এর মধ্যে বিজয় দাস ও সুনীল নামে দুজনের নাম সে আমাদেরকে বলতে পেরেছে। বাকিদের নাম বলতে পারেনি। ওই লোকটি আমাদেরকে ১৪ অক্টোবর একটি নৌকাযোগে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটায় পৌছে দেয়।

অবরোধের কারনে আসামী পক্ষের সিনিয়র কোন আইনজীবী উপস্থিত ছিলনা ট্রাইব্যুনালে। আসামী পক্ষে গাজী এম এইচ তামিম নামে একজন মাত্র জুনিয়র আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। তিনি সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন।
জেরা :
প্রশ্ন : ১৩ অক্টোবরের যে ঘটনা আপনি বললেন তা সত্য নয়।
উত্তর : অসত্য।
প্রশ্ন : ১৯ এপ্রিল সমাবেশে এ কে এম ইউসুফের বক্তব্য দেয়ার ঘটনাও সত্য নয়।
উত্তর : অসত্য।
প্রশ্ন : ওই বক্তব্য দিয়েছিল রজ্জব এবং মোজাম ডাক্তার। ইউসুফ সাহেব নয়।
উত্তর : অসত্য।
প্রশ্ন : ওই দিন ছাড়া আর কোন শান্তি কমিটির মিটিংয়ে গেছেন কখনো?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনার জানামতে  আর কোন হিন্দু কি শান্তি কমিটির মিটিংয়ে গেছে কখনো?
উত্তর : আমরা ভারতে যাবার আগ পর্যন্ত রামপালের ওই সমাবেশ ছাড়া   শান্তি কমিটির আর কোন মটিং হয়নি।
এ পর্যন্ত জেরার পর গাজি তামিম আদালতের কাছে আবেদন করেন যেহেতু সিনিয়র আইনজীবী নেই তাই জেরা দুই দিন মুলতবি রাখার জন্য। তখন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসান বলেন, আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হল। গাজি তামিম আরো সময় প্রার্থনা করলে তিনি বলেন, নো। কাল না আসলে জেরা কোজ করা হবে। উকিল না আসার কারনে বিচারকদের উঠে যেতে হবে এটা আনহার্ড।
এসময় গাজি তামিম অবরোধের সময় সহিংসতার চিত্র তুলে ধরে তাদের চলাচালে রসমস্যার কথা বলেন। তখন চেয়ারম্যান বলেন, পেছনে তাকিয়ে দেখেন সব লোক এসেছে। রাস্তায় হরদম যানবাহন চলছে। অবরোধে রাজধানীর ভেতরে দোকানপাট খোলা রাখা যাবে, যানবাহন চলতে পারবে এটা বলা আছ।গাজি তামিম বলেন দোকানপাট খোলা কিন্তু যানবাহন চলতে পারেনা। খুব কম চলছে। চেয়ারম্যান এ দাবির বিরোধীতা করে বলেন, আপনারা সব জায়গায় যেতে পারেন, টকশোতে যেতে পারেন আর ট্রাইব্যুনালে আসতে পারেননা এটা হবেনা। কাল না আসলে জেরা কোজ।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন