শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৩

আল্লামা সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড// উত্তর মেলেনি অনেক প্রশ্নের

রায় পর্যালোচনা

মেহেদী হাসান৪/৪/২০১৩
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মোফাসসিরে কোরআন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলমীর নায়েবে আমির আল্লামা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বহুল আলোচিত এবং ঘটনাবহুল এ মামলার রায় ঘোষনা করলেন।

আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে  ২০টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়েছিল।  এর মধ্যে আটটি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে  উল্লেখ করা হয়েছে।  প্রমানিত আটটি অভিযোগের দুটি অভিযোগ হত্যা বিষয়ক।  ইব্রাহীম কুট্টি এবং বিশাবালী   হত্যার অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে  আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে।  বাকী ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হলেও তাতে কোন শাস্তির কথা উল্লেখ করেননি ট্রাইব্যুনাল।  এ  ছয়টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে  ধর্মান্তরকরন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরন, ধর্ষনে সহায়তাকরন  প্রভৃতি।

১২টি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয় রায়ে। খালাস দেয়া অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের পিতা এসডিপিও ফফজুর রহমানসহ পিরোজপুরের তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যার অভিযোগ, ভাগিরথী হত্যা এবং ভানুসাহাকে ধর্ষনের অভিযোগ।


মৃত্যুদন্ড  প্রদান করা দুটি হত্যার অভিযোগসহ অন্যান্য যেসব অভিযোগে আল্লামা সাঈদীকে  দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সেসব বিষয়ে অনেক মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে যার কোন উত্তর মিলছেনা। তাই সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে  বলে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির রায় প্রদানের পরও  মৌলিক কিছু প্রশ্নের  কোন সদুত্তর না মেলায় সাঈদীর দোষী বিষয়ে মানুষের মন থেকে সন্দেহ সংশয় দূর হচ্ছেনা। উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর উত্তর না মেলায় বরং মানুষের মনে পাল্টা যে প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে তা হল আসলেই কি আল্লামা সাঈদী ১৯৭১ সালে অপরাধের সাথে জড়ি ছিল?

আসুন আমরা প্রথমে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হই এবং বিবেকের কাছে তার জবাব খোঁজার চেষ্টা করি।

যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড

১. ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার ঘটনা :
আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ১৯৭১ সালের ৮ মে তার  নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকজন পিরোজপুরের পাড়েরহাট বাজারের নিকটস্থ  চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এখানে মানিক পসারীর বাড়িসহ ৫টি ঘর তারা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় লুটপাটের পর। মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহীম কৃট্টি  এবং মফিজ নামে দুজনকে  ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরা দুজন  মানিক পসারীর বাড়িতে কাজ করত। আল্লামা  সাঈদী এদের দুজনকে ধরে এক দড়িতে বেঁধে  পাড়েরহাট বাজারে নিয়ে যান । এরপর আল্লামা  সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে পাড়েরহাট বাজারে ব্রিজের কাছে। হত্যার পর তার লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। মফিজকে  হত্যা না করে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে  সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

রায়ে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার এ অভিযোগ  প্রমানিত হয়েছে উল্লেখ করে  আল্লামা সাঈদীকে মুত্যৃ দণ্ড প্রদান করা হয়েছে।


উত্তর মেলেনি  যেসব  প্রশ্নের :
ইব্রাহীম কট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম তার  স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই পিরোজপুরে একটি মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় তিনি পাকিস্তান আর্মিসহ মোট ১৪ জনকে আসামী করেন তখন মমতাজ বেগম স্বামী হত্যায় যাদের আসামী করেন সেই  আসামীর তালিকায়  আল্লামা সাঈদীর নাম নেই। এমনকি মামলার বিবরনে  আল্লামা সাঈদী বিষয়ে একটি শব্দও উল্লেখ নেই। সেই মামলার অভিযোগ তদন্ত করে চার্জশিট গঠন করা হয়েছিল। তাতেও আল্লামা সাঈদীর নাম ছিলনা। মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে চারজনের সাজা হয়েছিল। সেই মামলার সমস্ত ডকুমেন্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া হয়েছিল আসামী পক্ষ থেকে। কিন্তু তার কোন কিছূ আমলে নেননি ট্রাইব্যুনাল। কেন?

ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ঘটনার যে বিবরন দেয়া হয়েছে এবং রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা ট্রাইব্যুনালে যা বলেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে  ১৯৭১ সালের আট মে মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাড়েরহাট বাজারে তাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু  মমতাজ বেগম তার মামলার বিবরনে উল্লেখ করেছেন- ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর তার বাবার বাড়ি (ইব্রাহীমের শ্বশুরবাড়ি) নলবুনিয়া গ্রামে থাকা অবস্থায়  পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকজন তাকে  হত্যা করে। তার স্বামীকে হত্যার সময় স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে মমতাজ বেগমের   হাতেও গুলি লাগে। একই ঘটনায় মমতাজ বেগমের  ভাই শিহাব আলী  ওরফে সিরাজ এবং মা সিতারা বেগমকে পিরোজপুরে ধরে নিয়ে যায় আর্মি। পরে  পাকিস্তান আর্মি তার মা সিতারা বেগমকে ছেড়ে দিলেও ভাই শিহাব আলীকে পিরোজপুরে গুলি করে হত্যা করে।
রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করছে ইব্রুহীমকে পাড়েরহাট বাজারে ১৯৭১ সালের ৮ মে হত্যা করা হয়েছে। আর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং তার স্ত্রী মমতাজ বেগম দাবি করেছেন তার স্বামীকে  নলবুনিয়ায় তার বাবার বাড়ি  থাকা অবস্থায় ১ অক্টোবার হত্যা করা হয়। কার কথা সত্য ? ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইব্রাহীমের স্ত্রী মমতাজ বেগম না  রাষ্ট্রপক্ষের?

সবচেয়ে বড় বিষয় হল মমতাজ বেগম এখনো জীবিত। কিন্তু তাকে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হিসেবে হাজির করেনি। কেন?

শুধু মমতাজ বেগম নয় ঘটনার শীকার এবং প্রত্যক্ষদর্শী মমতাজ বেগমের মা সিতারা বেগম, মমতাজ বেগমের বোন রানী বেগম অন্যান্য ভাই এবং পরিবারের সদস্যরাও জীবিত। তাদের কাউকেই এ ঘটনা বিষয়ে সাক্ষী হিসেবে হাজির করেনি রাষ্ট্রপক্ষ । কেন?

অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ যাদেরকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করেছে তাদের কেউ কলা চোর, কেউ ট্রলার চোর, কেউ স্ত্রী হত্যা চেষ্টা মামলা, কেউ যৌতুক মামলাসহ বিভিন্ন অপরাধের দায়ে সাজাভোগ করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরায় আরো বের হয়ে এসেছে সাক্ষ্য দেয়ার বিনিময়ে তারা কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে  সনদ পেয়েছেন মামলা শুরুর পর।  কেউ কেউ  একটি বাড়ি একটি খামার   প্রকল্প, আশ্রয়ন প্রকল্পসহ বিভিন্ন সরকারি অনুদান থেকে বরাদ্দ পেয়েছেন।  কারো ব্যাংক লোন মাফ হয়েছে। এসব সাক্ষী এসে বলেছে তারা দেখেছে  আল্লামা সাঈদীর নির্দেশে ইব্রাহীমকে পাড়েরহাট বাজারে হত্যা করা হয়। তারা কেউ ইব্রাহীমের কোন আত্মীয় স্বজন বা নিকট প্রতিবেশীও না।  মানুষের মনে প্রশ্ন বিভিন্ন অপরাধে জেলখাটা, সাক্ষী হবার বিনিয়ে নানা সুযোগসুবিধা ভোগকারী এসব লোকের কথা সত্য হয়ে গেল; আর ইব্রাহীমের স্ত্রীর মামলার ডকুমেন্ট এর কোন মূল্য নেই?

এছাড়া আল্লামা সাঈদীর পক্ষেও চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন ইব্রাীহমকে নলবুনিয়ায় তার শ্বশুরবাড়ি থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পরদিন তারা সকলেই মমতাজ বেগমের বাড়িতে সরাসরি হাজির হয়ে  ঘটনা বিষয়ে মমতাজ বেগমের পরিবারের সদস্য এবং অন্যান্য লোকজনের কাছ থেকে জেনেছেন।  এ হত্যা ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে  কোনদিন তারা আল্লামা সাঈদীর নাম শোনেননি। তারা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন মাওলানা সাঈদী কোন মতেই ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার সাথে জড়িত নন। মানুষের মনে প্রশ্ন আল্লামা সাঈদীর পক্ষের এসব সাক্ষীদের সব কথা মিথ্যা আর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সব কথা সত্য হয়ে গেল?
তাদের মনে আরো প্রশ্ন আল্লামা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীরা তাকে নির্দোষ দাবি করে যেসব কথা বলেছেন তার একটি কথাও কেন রায়ে উল্লেখ করা হলনা?


মমতাজ বেগমের মামলায় আসামী ছিল যারা:
ইব্রাহীম কুট্টির  স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে স্বামী এবং ভাই হত্যার বিচার চেয়ে পিরোজপুরে দায়ের করা মামলায় এক নম্বর আসামী করেছিলেন পাকিস্তান আর্মি।
মমতাজ বেগম তার স্বামীর হত্যা মামলায় অন্য যাদের আসামী করেছেন তারা হলেন, দানেশ মোল্লা,  আতাহার আল, আশ্রাব আলী, আব্দুল মান্নান, আইউব আলী কালাম চৌধুরী, রুহুল আমিন, আব্দুল হাকিম মুন্সি, মমিন উদ্দিন, সেকোন্দার আলী শিকদার, শামসুর রহমান এসআই, মোসলেম মাওলানা।  আসামীদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। আসামীর তালিকায় আল্লামা সাঈদীর নাম নেই।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষীরা যা বলেছিল :
ইব্রাহীম কুট্টির হত্যার বিবরন দিয়ে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে মোট চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টি তার শশুর বাড়ি নলবুনিয়ায় থাকা অবস্থায় আশ্বিন মাসের দিকে নিহত হন। ইব্রাহীম কুট্টির শশুরের নাম ছিল আজহার আলী। এখানে আসামী পক্ষের একজন সাক্ষীর বরাত দিয়ে ঘটনাটি উল্লেখ করা হল।
২০১২ সালের  নয় অক্টোবর ১১ তম সাক্ষী গোলাম মোস্তাফা মাওলানা সাঈদীপর পক্ষে  সাক্ষ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ অক্টোবর আমার গ্রাম নলবুনিয়ায় আজাহার আলী হাওলাদারের (ইব্রাহীম কুট্টির শশুর)  বাড়িতে একটি ঘটনা ঘটে। ওইদিন ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্তে এক প্রচন্ড শব্দ শুনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠার পরেই মসজিদে আযান হলে মসজিদে নামায পড়তে যাই। নামাজের পরে মুসল্লিদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হতে থাকে যে, আযানের পূর্বে কোথায় এই প্রচন্ড শব্দটি হলো। এই আলাপ আলোচনা করতে করতে আমরা মসজিদের সামান্য দূরে খালের পাড়ের রাস্তায় আসি। একটু পরেই দেখতে পাই  উত্তর দিক থেকে দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দার শিকদার, রুহুল আমীন, মোমিন,  আজহার আলী হাওলাদারের ছেলে সাহেব  আলী এবং তার মাকে  নিয়ে পাড়েরহাটের দিকে যাচ্ছে। তার ৫/৭ মিনিট পরে নৌকায় করে আইউব আলী  চকিদার, কালাম   চকিদার, হামিক মুন্সি, আব্দুল মান্নান, আশরাফ আল মিলে আজহার আল হাওলাদারের জামাই ইব্রাহীম কুট্টির লাশ নিয়ে যাচ্ছে।
এরপর আমরা কায়েকজন আজহার হাওলাদারের বাড়ি যাই। সেখানে  গিয়ে বাড়িভর্তি মানুষ এবং ঘরে কান্নার রোল শুনতে পাই। লোকজন বলাবলি করতেছে আজহার হাওলাদারের জামাই ইব্রাহীম কুট্টি  মেরে ফেলেছে। ইব্রাহীমের স্ত্রী মমতাজ বেগমও সেকথা জানায়।

এরপর আমরা সেখান থেকে চলে আসি।  বিকালের দিকে শুনি সাহেব আলীকে (মমতাজ বেগমের ভাই এবং ইব্রাহীমের শ্যালক)  এবং তার মাকে রাজাকাররা পিরোজপুরে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। পরের দিন শুনি  সাহেব আলীর মা সিতারা বেগম ফিরে এসেছে এবং সাহেব আলীকে পাকিস্তানী বাহিনী পিরোজপুরে গুলি করে মেরেছে। 
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অন্য তিন সাক্ষীও ঘটনার প্রায়  একই বর্ননা দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী : সরাসরি ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা এবং মানিক পসারীর বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা বর্ননা করে রাষ্ট্রপক্ষে যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা হলেন, মানিক পসারী,  মফিজ উদ্দিন, সুলতান হাওলাদার এবং মোস্তফা হাওলাদার। রায়ে এদেরসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট নয়জন সাক্ষীর সাক্ষ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার  অভিযোগ বিষয়ে।  নিহত ইব্রাহীম কুট্টি এবং মফিজ উদ্দিন মানিক পসারীর বাড়িতে কাজ করত। মফিজ উদ্দিন পসারীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হলেও সে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন বলে উল্লেখ করেন। রায়ে মফিজউদ্দিনকে চাুস সাক্ষী হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে তাকে অবিশ্বাস করা যায়না।

ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা যা বলেছেন :
২০১১ সালের  ২৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের  ষষ্ঠ সাক্ষী  মানিক পসারী তার জবানবন্দীতে বলেন,  ১৯৭১ সালে ৮ মে পাক সেনাবাহিনী নিয়ে দেলোয়ার শিকদার বর্তমানে সাঈদী, সেকেন্দার শিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, রেজাকার  মবিন, হাকিম কারী, সোবহান মাওলানাসহ আরো অনেক রেজাকার আমার বাড়িতে   প্রবেশ করে। তাদের আসতে দেখে আমি বাড়ির  পাশে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকি এবং সব ঘটনা  দেখতে  থাকি। তারা আমার বাড়িতে প্রবেশ করে আমার ফুফাত ভাই মফিজ উদ্দিন (  বাড়িতে কাজ করত)  এবং অপর কাজের লোক ইব্রাহিম কুট্টিকে আর্মিরা ধরে একই দড়িতে বাঁধে। তারপর  লুটপাট করে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।  মফিজ ও ইব্রাহিম কুট্টিকে  বেঁধে পাড়েরহাট নিয়ে যাবার সময় আমি তাদের পেছনে পেছনে যেতে থাকি। তাকে পাড়েরহাট বাজারের মধ্যে  ব্রিজের ওপারে নিয়ে যায়।  আমি  এপারে বসে তাদের লক্ষ্য করি। দেলোয়ার  হোসেন শিকদারকে আর্মির সাথে পরামর্শ করতে দেখি। তারপর দেলোয়ার হোসেন শিকদার, সেকেন্দার শিকদারের সাথে পরামর্শক্রমে পাক আর্মিরা  ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে। ইব্রাহিম চিৎকার মারে। তারপর লাশ নদীতে ফেলে দেয়।

২০১১ সালের ২১  ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্র্থ সাক্ষী সুলতান আহমদ হাওলাদার বলেন, মানিক পসারীর  বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দেখি দানেশ আলী মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন  শিকদার বর্তমান সাঈদী, মোসলেম মাওলানাসহ অনেক রাজাকার বাহিনী  মানিক পসারীর বাড়ির  কর্মচারী ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাজারের দিকে। আমি তাদের পিছু পিছু  যেতে থাকি। বাজারের ব্রিজ পার হয়ে পশ্চিম দিকে যাবার পর আমি এপার বসে  থাকি। উত্তর দিকে থানার ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাবার পর  দেলোয়ার হোসেন শিকদার বর্তমানে সাঈদী সাহেব পাক আর্মির সাথে কি যেন বলাবলি করছে দেখতে পাই। তখনই বিকট  গুলির শব্দ এবং চিৎকার শুনতে পাই।     এরপর   ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসার পর পরের দিন শুনতে পাই মানিক পসারীর বাড়ির কাজের লোক ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা করে পানিতে ফেলে দিয়েছে।

একই বছর ২৯ ডিসেম্বর   সাক্ষ্য দেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মফিজউদ্দিন পসারী। মফিজ মানিক পসারীর ফুফাত ভাই এবং সে  মানিক পসারীদের বাড়িতে  কাজ করত বলে দাবি করেছেন মানিক পসারী। ইব্রাহীম কুট্টির সাথে তাকেও ৮ মে পাড়েরহাট ধরে নিয়ে যায় মর্মে দুজন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্যে বলেছেন। তবে মফিজ উদ্দিন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।
মফিজ উদ্দিন তার জবনাবনন্দীতে বলেন,  ১৯৭১ সালের ৮ মে সকালে   গরু মহিষ  নিয়ে চরে যাই। সাথে ইব্রাহিম কুট্টিও ছিল। কিন্তু  আনুমানিক ১০/১১টার দিকে  চরে বসে বসে মামার   বাড়িতে আগুন  এবং  ধোয়া দেখতে পাই। তারপর মামার বাড়ির দিকে ফিরে আসি।  এসময় দেখি ১২/১৪ জন পাক আর্মি, ২০/২২ জন রাজাকার মামার বাড়ি যাচ্ছে । তার মধ্যে দিলু  শিকদার ছিল। আমরা পালাতে চাইলে পাক আর্মি ধরে ফেলে। আমাদের দুজনকে এক দড়িতে  বাঁধে।  এরপর রাজাকাররা ঘরে ঢুকে  লুটপাট করে এবং কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।  আমাদের দুজনকে পারেরহট বাজারে নিয়ে যায়।   পুল থেকে নামিয়ে দিলু শিকদার (তাদের ভাষায় দিলু শিকদার মানে মাওলানা সাঈদী) সেকেন্দার শিকাদর উর্দুতে কি যেন বলল। আমি উর্দু বুঝিনা এবং কি বলেছিল তা  শুনতে পাইনি। এরপর ইব্রাহিমকে  দড়ি থেকে খুলে ছেড়ে দিল এবং আমাকে নিয়ে সামনের দিকে গেল। তারপর গুলির  শব্দ শুনতে পাই। ইব্রাহিম মা বলে চিৎকার করে। পেছনে তাকিয়ে দেখি ইব্রাহিমকে গুলি করছে। সেনাবানিহনী লাথি মেরে লাশ নদীতে ফেলে দিল।


২০১২ সালের  ১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন  মো: মোস্তফা হাওলাদার।  মোস্তফা হাওলাদার  জবানবন্দীতে বলেন, আমি ১৯৭১ সালে পারেরহাট বাজারে বুটমুড়ি ফেরি করে বিক্রি করতাম।  মে মাসের সাত তারিখ  শান্তি কমিটির দেলোয়ার  শিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা এরা  বাজারের উত্তর মাথায় রিক্সা স্ট্যান্ডের কাছে যায়। কিছুক্ষন পর ২৬টি  রিক্সায় ৫২ জন পাক আর্মি আসে।..... অর্মির অর্ডারে শুরু হয় লুটপাট। ....... আমরা খালের ওপারে বসে ধোয়া এবং আগুন দেখতে পাই নুরু খার ঘরের। আগুন আর ধোয়া দেখার পর দেখি  লুটপাট করে লোকজন রইজুদ্দীন কোম্পানীর বাড়ির দিকে যাচ্ছে। রইজুদ্দীন সইজুদ্দীন পসারীর বাড়িতে (মানিক পসারীদের বাড়ি) দুজন লোক থাকত মফিজ উদ্দিন এবং ইব্রাহীম কুট্টি নামে। তারা চরে গিয়েছিল গরু চড়াতে। তারা আগুন দেখে দৌড়ে আসে। এসময় দেলোয়ার শিকদার তাদের চাইপপা ধরে এবং মফিজ উবরাইয়া পরে যায়।  পাক আর্মি ধরে ইব্রাহিম কুট্টিকে। তাদের এক দাড়িতে বেঁধে পারেরহাট বাজারে নিয়ে যায়। তারপর মফিজকে পারেরহাট রাজাকার ক্যাম্পে আর ইব্রাহিমকে নেয়া হয় থানার ঘাটের দিকে। তারপর গুলির শব্দ শুনি। থানার ঘাটের কাছে ব্রিজের গোড়ায় ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে লাথি মেরে পানিতে ফেলে দেয়।

আসামী পক্ষের সাক্ষী : ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার ঘটনার সাথে মাওলানা সাঈদী জাড়িত নয় দাবি করে এবং এ ঘটনার বিবরন দিয়ে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে মোট চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। এরা হলেন, গোলাম মোস্তফা, আব্দুর রাজ্জাক আকন,  জামাল ফকির এবং আব্দুস সালাম হাওলাদার।


মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষীরা যা বলেছেন :

২০১১ সালের ৯ অক্টোবর ১১ তম সাক্ষী গোলাম মোস্তাফার তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ অক্টোবর আমার গ্রাম নলবুনিয়ায় আজাহার আলী হাওলাদারের (ইব্রাহীম কুট্টির শশুর) বাড়িতে একটি ঘটনা ঘটে। ওইদিন ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্তে এক প্রচন্ড শব্দ শুনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠার পরেই মসজিদে আযান হলে মসজিদে নামায পড়তে যাই। নামাজের পরে মুসল্লিদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হতে থাকে যে, আযানের পূর্বে কোথায় এই প্রচন্ড শব্দটি হলো। এই আলাপ আলোচনা করতে করতে আমরা মসজিদের সামান্য দূরে খালের পাড়ের রাস্তায় আসি। একটু পরেই দেখতে পাই  উত্তর দিক থেকে দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দার শিকদার, রুহুল আমীন, মোমিন,  আজহার আলী হাওলাদারের ছেলে সাহেব  আলী এবং তার মাকে  নিয়ে পাড়েরহাটের দিকে যাচ্ছে। তার ৫/৭ মিনিট পরে নৌকায় করে আইউব আলী  চকিদার, কালাম   চকিদার, হামিক মুন্সি, আব্দুল মান্নান, আশরাফ আল মিলে আজহার আল হাওলাদারের জামাই ইব্রাহীম কুট্টির লাশ নিয়ে যাচ্ছে।
এরপর আমরা কায়েকজন আজহার হাওলাদারের বাড়ি যাই। সেখানে  গিয়ে বাড়িভর্তি মানুষ এবং ঘরে কান্নার রোল শুনতে পাই। লোকজন বলাবলি করতেছে আজহার হাওলাদারের জামাই ইব্রাহীম কুট্টিকে   মেরে ফেলেছে। ইব্রাহীমের স্ত্রী মমতাজ বেগমও সেকথা জানায়।

এরপর আমরা সেখান থেকে চলে আসি।  বিকালের দিকে শুনি সাহেব আলীকে (মমতাজ বেগমের ভাই এবং ইব্রাহীমের শ্যালক)   এবং তার মাকে রাজাকাররা পিরোজপুরে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। পরের দিন শুনি  সাহেব আলীর মা সিতারা বেগম ফিরে এসেছে এবং সাহেব আলীকে পাকিস্তানী বাহিনী পিরোজপুরে গুলি করে মেরেছে। 

এছাড়া মাওলানা সাঈদীর পক্ষে দ্বিতীয় সাক্ষী আব্দুর রাজ্জাক আঁকনও গত ৫  অক্টোবার ইব্রাহীম কুট্টি  হত্যা বিষয়ে একই ধরনের জবানবন্দী প্রদান করেন।

ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার বিবরন তুলে ধরে ২০১১ সালের ২ অক্টোবর  মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সপ্তম সাক্ষী হিসেবে  সাক্ষ্য  দেন পিরোজপুর নলবুনিয়ার জামাল হোসেন ফকির।
তিনি বলেন, আমার বাড়ি পিরোজপুর জেলার নলবুনিয়া গ্রামে অবস্থিত। আমি জমাজমি চাষাবাদ করি এবং মাঝে মধ্যে মাছ ধরি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি একই কাজ করতাম। আমাদের দেশে আশ্বিন মাসে খালে বিলে প্রচুর পানি থাকে।  ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমি আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাত্রের প্রথম ভাগে বিলে বড়শি পেতে আসি। রাত্রের শেষ ভাগে আমি নৌকা নিয়ে বড়শি তুলে বাড়ির কাছাকাছি আসলে বিশাল একটা শব্দ শুনতে পাই। শব্দ শুনে আমি খেয়াল করি আমার পাশ লাগানো আজহার আলী হাওলাদারের বাড়িতে কান্নাকাটির শব্দ শোনা যায়। আমি ঘরে চলে আসি। আমার আব্বা বলেন, আজহার মামার বাড়ি বড় একটা শব্দ শোনা গেছে এবং কান্নাকাটিরও শব্দ শোনা যাচ্ছে । চলো গিয়ে দেখে আসি। আজহার আলীর বাড়ি গিয়ে দেখি ইব্রাহিম কুট্টির লাশ আইয়ুব আলী চৌকিদার, কালাম চৌকিদার, হাকিম মুন্সি, মান্নান ও আশরাফ আলী খালের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তার পিছে দানেশ মোল্লা, সেকান্দার শিকদার, মোসলেম মওলানা, রুহুল আমিন, মোমিনরা মিলে সাহবে আলীকে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে তার মাকেসহ পাড়েরহাটে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সামনে এগিয়ে দেখি ইব্রাহিম কুট্টির লাশ নৌকায় তুলে পাড়েরহাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সাহেব আলীদের ঘরে চলে আসি। ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতেছে এবং তার হাত দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছে। তার বোন রানী বেগম মমতাজের হাত বেঁধে দিচ্ছে । তখন আমি ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগমকে জিজ্ঞাসা করলাম, ফুফু তোমার কি হয়েছে? তখন মমতাজ বেগম উত্তর দেয় যে গুলিতে ইব্রাহিম কুট্টি মারা গেছে সেই গুলি তার হাতেও লেগেছে, লাঠি দিয়ে তার আব্বার গায়েও আঘাত করেছে। ঐখানে তখন পাড়া প্রতিবেশী অনেক লোকজন জমায়েত হয়। আমরা বাড়িতে চলে যাই। বিকালে শুনতে পাই যে, সাহেব আলী ও তার আম্মাকে পিরোজপুরে নিয়ে গেছে। ইব্রাহিম কুট্টির লাশ পাড়েরহাট বাদুরা পোলের সাথে নৌকায় বেঁধে রেখেছে। তারপরদিন বেলা এগারোটার দিকে শুনতে পাই যে, সাহেব আলীর আম্মা বাড়িতে ফিরেছে। তারপর আমরা তাদের বাড়িতে যাই। জিজ্ঞাসা করি বুয়া (সাহেব আলীর আম্মা) আপনি এসেছেন, সাহেব আলী চাচা কৈ। তারপর সে বলে যে, পিরোজপুর নিয়া সাহেব আলীকে মিলিটারীরা গুলি  করে মারছে।  এর কিছুদিন পরে দেশ স্বাধীন হয়।


রায়ে সাক্ষী পর্যালোচনায় তারতম্য :

 আট নং অভিযোগ (ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা)  বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষে মোট ৯ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের জবানবন্দীর সার সংক্ষেপ রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। অপর দিকে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা, মানিক পসারীর বাড়িতে আগুন দেয়া বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। মাওলান সাঈদী এ ঘটনার সাথে জড়িত নয় দাবি করে তারা যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা থেকে একটি শব্দও উল্লেখ করা হয়নি রায়ে।


পিরোজপুরে মানিক পসারীর মামলা এবং মফিজ প্রসঙ্গ :  মানিক পসারীর বাড়িতে আগুন দেয়া এবং ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যার ঘটনার বিষয়ে মানিক পসারী ২০০৯ সালে পিরোজপুরে একটি মামলা করেন। কিন্তু সেই মামলায় তিনি মফিজের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেননি। যদিও  মানিক পসারী, মফিজ এবং অন্য সাক্ষীরা  ট্রাইব্যুনালে এসে বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টির সাথে মফিজকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তিনি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসেন। মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, একসাথে দুইজন লোককে ধরে নিয়ে যাওয়া হল। তাদের একজন পালিয়ে এলেন। সে জীবিত। ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিলেন।  কিন্তু ওই ঘটনার এত বড় একজন  ভুক্তভোগী এবং যে কি-না মানিক পসারীর ফুফাত ভাই আবেং তাদের বাড়িতেই কাজ করত আর তার বিষয়ে মানিক পসারী পিরোজপুরের মামলায় কিছু বললেননা। এটা কি করে সম্ভব হতে পারে?   পরে মানিক পসারী মফিজের মামলায় পিরোজপর মেজিস্ট্রেট এর কাছে জবানবন্দীতে বলেছিলেন ইব্রাহীমের কি হয়েছে তা তিনি জানেননা। অথচ  তিনি ট্রাইব্যুনালে এসে বলেছেন তার সামনে ইব্রাহীমকে গুলি করে মারা হয়েছে। মিজানুল ইসলাম বলেন, মফিজ পিরোজপুরে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা আমরা এখানে জমা দিয়েছে এবং প্রদর্শনও হয়েছে। কিন্তু  রায়ে এ বিষয়েও কিছু উল্লেখ নেই।


২. বিশাবালী হত্যার ঘটনা :

অপর যে   অভিযোগে আল্লামা সাঈদীকে  মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেটি হল বিশাবালী হত্যাকান্ড। এ অভিযোগ বিষয়ে  উল্লেখ করা হয়েছে   ১৯৭১ সালের ৬ জুন  সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে হিন্দুপাড়ায়  সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর আগুন  দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে তাদের বাড়ির সামনে  নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়। সাঈদীর নির্দেশে  একজন রাজাকার তাকে গুলি করে হত্যা করে।
আল্লামা  সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায়ে বলা হয়েছে এ অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে এবং মাওলানা সাঈদীকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করা হয়েছে।


এ ঘটনাওয় উত্তর মেলেনি যেসব প্রশ্নের :
নিহত বিশাবালীর ছোট ভাই’র নাম  সুখরঞ্জন বালী।  সুখরঞ্জন বালী বর্তমানে জীবিত এবং তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে সাক্ষ্য দিতে না এসে মাওলানা সাঈদীপর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন গত  পাঁচ নভেম্বর (২০১২)। সেদিন তাকে গোয়েন্দা পুলিশ অপহরন করে নিয়ে যায় ট্রাইব্যুালের গেট থেকে।

কয়েকটি সংবাদপত্র এবং একটি টেলিভিশন সুখরঞ্জন বালীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিল সে অপহরনের  আগের দিন। সাক্ষাৎকারে সুরখরঞ্জন বালী বলেছিলেন  তার ভাই বিশাবালীকে সাঈদী  সাহেব মারেনি।  পাকিস্তান আর্মি এবং দেশীয় রাজাকাররা তার ভাইকে ধরে নিয়ে বলেশ্বর নদীর তীরে হত্যা করে। তিনি জানান  তার ভাই হত্যা বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে সত্য সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তিনি এসেছেন। রাষ্ট্রপক্ষ তাকে দিয়ে মিথ্যা কথা বলাতে চেয়েছিল সেজন্য তিনি তাদের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে আসেননি। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে এসে এসব কথা প্রকাশ করার আগেই তাকে অপহরন করে নিয়ে গেল পুলিশ। আজ পর্যন্ত তার কোন খোঁজ নেই।
তাকে কেন অপহরন করল গোয়েন্দা পুলিশ? ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাবে সেজন্য?

ট্রাইব্যুালের  চার দিকে কয়েকডজন গোপন সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেখানে রেকর্ড হয়ে আছে কে বা কারা তাকে অপহরন করেছে। সাঈদীর আইনজীবীসহ বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে তা দেখে কেন ঘটনা ফাঁস করার নির্দেশ দিলনা ট্রাইব্যুনাল? জনগনের প্রশ্ন আপন ভাই হত্যা বিষয়ে এতড় একজন সাক্ষী  ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরও তার কোন হদিস না নিয়ে কিভাবে তার ভাই হত্যার সাথে  আল্লামা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা যায় অন্য সাক্ষীদের কথার ওপর ভিত্তি করে?

৫ নভেম্বর অপহরনের আগে সুখরঞ্জন বালীর গ্রহণ করা সাক্ষাৎকার  দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ৬ নভেম্বর। আমার দেশ পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে সুখরঞ্জন বালী বলেছিলেন “সাঈদী সাইব মোর ভাই বিশাবালীরে খুন করে নাই এডা ডাহা মিথ্যা কতা। মুই মোর ভাইর মরন লইয়া এই রহমের মিত্যা কতা কইতে পারমুনা।”
তিনি বলেছিলেন, মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার আমাকে  বলতে বলে সাঈদী সাহেব ছিল এই কথা বলবা। আমাকে দিয়া তারা মিথ্যা কথা বলানোর জন্য চেষ্টা করছে । তাতে রাজি না হওয়ায় আমারে তারা আনেনাই। আমিও   হেদিকে  যাই নাই ।

সুখরঞ্জন বালী বলেন, আমার ভাইয়ের হত্যার সাথে সাঈদী সাহেব কোন ভাবেই জড়িত ছিলেন না। এতটি বছরে আমার ভাইয়ের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে মাওলানা সাঈদী জড়িত ছিলেন বলে আমরা শুনতে পাইনি।

সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রী যা বললেন : নিখোজ সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রীর নাম  রীতা। রীতা বলেন, আমার শ্বাশুড়ী আমাকে বলেছেন  ঘটনার সময়  বিশাবালী অসুস্থ ছিলেন। তাকে গুলি করে মারা হয়নি। তাকে বন্দুক দিয়ে  পাক বাহিনী বুকে তিনটি ঘা মারে।  এর তিনঘন্টা পর তিনি মারা যান। গুলি করার কথা সত্য নয়। সেখানে সেসময় কারা ছিল তাদের তিনি দেখেনওনি চেনেনওনি।
আরো মজার ঘটনা হল রাষ্ট্রপক্ষের যেসব সাক্ষী  বলেছেন  আল্লামা সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালীকে হত্যা করা হয় তারা কেউ জেরায় বলতে পারেননি বিশাবালীর কবর এখন কোথায়। তারা কেউ বলতে পারেননি কোন রাজাকার বিশবালীকে গুলি করেছিল। আল্লামা সাঈদী গুলি করতে নির্দেশ দিল এবং তাকে তারা চিনল তখন কিন্তু কে   গুলি করে মারল তা  কেউই চিনলনা?


একজন বিচারকও মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িত ছিলেননা:
তিনজন বিচারক নিয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল-১ আল্লামা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।  কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল এই তিনজন বিচারকের একজনও  আল্লামা সাঈদীর মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেউ জড়িত ছিলেন। কেউ পুরো মামলার সাক্ষ্য প্রমান  শুনতে বা দেখতে  পারেননি। অথচ তারাই একজন মানুষকে মুত্যৃদণ্ড দিয়ে দিলেন। গোটা বিশ্বের আইনজ্ঞদের কাছে এটা বিস্ময়কর ঘটনা। কারণ সাক্ষী যখন কোর্টে এসে সাক্ষ্য দেয় এবং তার জেরা  হয় তখন তার চেহারা সুরত এবং কথা বলার ধরন থেকেই বিচারক অনেক কিছু বুঝে যান যে, সে সত্য বলছে না মিথ্যা বলছে। কিন্তু তাদের বক্তব্য সরাসরি না  শুনে এবং না দেখে  লিখিত জবানবন্দী এবং জেরা পড়ে সঠিকভাবে অনেক কিছু বোঝা যায়না বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। 

যে তিনজন বিচারক মিলে আল্লামা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন  তাদের একজন হলেন চেয়ারম্যান এটিএম ফজলে কবির। তিনি  ২০১০ সালের মার্চ মাসে ট্রাইব্যুনাল গঠনের  শুরু থেকে ২০১২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ছিলেন। ২০১২ সালের মার্চ মাসে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের সময় তাকে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে বদলী করা হয়। এরপর স্কাইপ কেলেঙ্কারির কলঙ্ক মাথায় নিয়ে ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর   ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করার পর দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল থেকে এটিএম ফজলে কবিরকে আবার আনা হয় ট্রাইব্যুনাল-১ এ। তাকে ট্রাইব্যুনাল -১ এর চেয়ারম্যান করা হয়। তিনি যখন ট্রাইব্যুনাল -১ এ আসলেন তখন আল্লামা সাঈদীর বিচার কার্যক্রম শেষ এবং যেকোন দিন রায় ঘোষনা করা হবে বলে রায়ের তারিখ উহ্য অবস্থায় ছিল।  ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।  দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে বদলি হবার আগ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপক্ষের অধিকাংশ সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ দেখেছেন কিন্তু আসামী পক্ষের কোন সাক্ষ্য গ্রহণ তিনি দেখেননি। তিনি ট্রাইব্যুনাল-১  চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করার পর আসামী পক্ষ পুরো মামলার কার্যক্রম নতুন করে শুরুর আবেদন করে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, আমি আমার কলিগদের কাছ থেকে শুনে নেব এবং পড়ে নেব। এরপর তিনি শুধুমাত্র যুক্তি উপস্থাপন পুনরায় শুরুর নির্দেশ দেন।

ট্রাইব্যুনালের আরেকজন বিচারক হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনিও মামলার শুরু থেকে ছিলেননা। ২০১২ সালের ২৮ আগস্ট বিচারক একেএম জহির আহমেদকে সরকার জোর করে সরিয়ে  দেয়ার পর তাকে তার স্থলে নিয়োগ দেন।
আরেক বিচারক হলেন আনোয়ারুল হক । তিনিও শুরু থেকে ছিলেননা। ২০১২ সালের মার্চ মাসে এটিএম ফজলে কবিরকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ বদলী করার পর তার স্থলে তাকে তখন নিয়োগ দেয়া হয়।
সুতরাং কেউই পুরো মামলার কার্যক্রম সরাসরি না দেখে এবং না শুনে একজনকে মৃত্যুদন্ডের রায় দিলেন যা গোটা বিশ্বের কাছে বিস্ময়কর।  লন্ডনের বিশ্বখ্যাত সামিয়কীসহ অনেক প্রভাবশালী মিডিয়ায় এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে।


উত্তর মেলেনি আরো অনেক প্রশ্নের :

মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশীয় দৃস্কৃতকারী, পাকিস্তানন আর্মির সহযোগী, রাজাকার, পিস কমিটির লোকজনের বিচারের জন্য স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দালাল আইন প্রনয়ন করা  হয়। লক্ষ লক্ষ লোককে দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয়। ৩৭ হাজার ৪৭১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। পিরোজপুরেও শত শত রাজাকার এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। কিন্তু আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে তখন কেউ একটি মামলাও করলনা কেউ?
রাষ্ট্রপক্ষের দাবি মতে সাঈদীই তখন পিরোজপুরের স্বাধীনতা বিরোধী সমস্ত কর্মকান্ডের হোতা ছিলেন। তার নির্দেশে এবং অঙ্গুলি হেলনে  পিরোজপুরে পাকিস্তান আর্মি চলত, সমস্ত অপারেশ চালাত।  পাড়েরহাটে পাকিস্তান আর্মি আসার পর তিনি তাদের অভ্যর্থনা জানান। ক্যাপ্টেন এজাজের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে তিনি উর্দু ভাল জানার কারনে। আল্লামা সাঈদীর নির্দেশেই পাড়েরহাটে রাজার এবং পিস কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন এসবের তাত্ত্বিক নেতা।  পাড়েরহাটের আশপাশের সমস্ত লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরনের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন আল্লামা সাঈদী। এতবড় মাপের একজন স্বাধীনতা বিরোধী, জঘন্য অপরাধী, সকল কুকর্মের  চিহ্নিত হোতাকে সবারই চেনার কথা। কিন্তিু স্বাধীনতার পর   কেউ তার বিরুদ্ধে একটি জিড়িও কেউ  কেন  করলনা?

সুন্দরবন সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের পর পিরোজপুরে যেসব বড় বড় রাজাকার, লুটপাটকারী, ধর্ষণকারী এবং বিভিন্ন অপরাধের হোতা ছিল তাদেরকে নৌকা ভরে ভরে সুন্দরবন নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সাঈদী সেরকম কিছু  হলে তার এতদিন বেঁচে থাকার কথা নয়। এছাড়া পিরোজপুরেও সাধারন মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের রোষে পড়ে, গণপিটুনিতে অনেক রাজাকার, লুটপাটকারী ধর্ষণকারী নিহত হয়েছে। জনগনের প্রশ্ন সাঈদীর মত এতবড় অপরাধী কিভাবে পার পেল? এতবড় অপরাধী কিছুদিন পালিয়ে থেকে আবার আত্মপ্রকাশ করল এবং সবাই সব কিছু ভুলে গিয়ে তাকে  ফুল দিয়ে বরন করে নিল এবং হিন্দুরাসহ সবাই তাকে ভোট দিয়ে দুই বার এমপি বানাল? এসব প্রশ্নের উত্তর কি?

মেজর জিয়াউদ্দিন, হুমায়ুন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজসহ অনেকে পিরোজপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং ঘটনাবলী নিয়ে অনেক বই রচনা করেছেন, গবেষনা করেছেন।  আল্লামা সাঈদী এতবড় অপরাধী  আর তার কোন বিববরন তো দূরের কথা নামটি পর্যন্ত নেই কোন তাদের বইয়ে? কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত  প্রমান্য দলিল স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রে  পিরোজপুর অধ্যায়ে নেই কেন সাঈদীর নাম?

মেজর জিয়াউদ্দিন কেন সাক্ষ্য দিতে আসলেননা যখন তিনি প্রায়ই ঢাকায় বসে টিভিতে টকশো করেন? সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি হুমায়ুন আহমেদের পিতাকে হত্যা করেছেন। কিন্তু তার ছেলে হুমায়ুন আহমেদ তখনো জীবিত ছিলেন। এখনো জীবিত  আছেন অন্য ছেলে জাফর ইকবাল, আহসান হাবিব, বোন সুফিয়া হায়দার এবং হুমায়ুন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ। তারা কেউ কেন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে না এসে টিভি টকশোতে/ শাহবাগে বলে বেড়িয়েছে  সাঈদী তার পিতাকে হত্যা করেছে? হুমায়ুন আহমেদের বড় দুলাভাই আলী হায়দার সাহেব হাইকোর্টে প্রাকটিস করেন। তার বাড়ি পিরোজপুর।  তিনিই বা কেন আসলেননা তার শ্বশুরের হত্যা বিষয়ে সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে?


সাঈদী এবং শিকদার প্রসঙ্গ :
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারে একটি আলোচিত বিষয় হল ‘সাঈদী’ এবং ‘শিকদার’  নামের প্রসঙ্গ।  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বাধীনতার পূর্বে তার নাম ছিল দেলোয়ার   শিকদার বা দেলোয়ার হোসেন।  স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে পরবর্তীতে আশির দশকে  তিনি নামের শেষে  শিকদার শব্দ বাদ দিয়ে ‘সাঈদী’ যোগ করে ভুয়া মাওলানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।  এরপর থেকে তিনি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নামে পরিচিতি লাভ করেন।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের  বেশ কয়েকজন  সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং চার্জশিটেও  বিষয়টি উল্লেখ  আছে।  ট্রাইব্যুনালও রায়ে বলেছেন  আমরা ৪০ বছর আগের দেলোয়ার হোসেন নামে এক যুবকের বিচার করছি। বর্তমান সাঈদীর নয়। তখন তাকে দেলু নামে লোকজন  ডাকত। পিরোজপুরে পরিচালিত সবগুলো অপারেশনের সাথে সে জড়িত ছিল। রাষ্ট্রপক্ষ সাঈদীকে দেলোয়ার শিকদার বলে আখ্যায়িত করলেও সে বিষয়ে কোন প্রমান দিয়েছে মর্মে রায়ে কোন কিছু নেই।

জনমনে এ নিয়ে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তাহল রাষ্ট্রপক্ষ  দেলোয়ার শিকদার নামে একজনকে বিচারের নামে হাজির করেছে যিনি বর্তমানে সাঈদী নাম ধারন করেছে এবং সাঈদী নামে পরিচিতি। অপর দিকে আসামী পক্ষ এবং রাষ্ট্রপক্ষেরও  সমস্ত ডকুমেন্ট থেকে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ দেলোয়ার শিকদার বলে যাকে দাবি করেছে সে এবং বর্তমান সাঈদী এক ব্যক্তি নয়। দেলোয়ার শিকদার নামে  কুখ্যাত একজন রাজাকার ছিল । তার পিতার নাম রসুল শিকদার।  তাকে স্বাধীনতার পর ুব্ধ জনতা পিটিয়ে হত্যা করে তার অপকর্মের কারনে। অপর দিকে আল্লামা সাঈদীর নাম জন্মের পর থেকেই সাঈদী এবং তার পিতার নাম ইউসুফ সাঈদী।   কিন্তু এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে রায়ে বর্তমান সাঈদীকে দেলু আখ্যায়িত করার বিষয়ে সাধারন মানুষ  কোন কিছু মেলাতে পারছেনা। তাদের প্রশ্ন নিহত দেলোয়ার শিকদারের অপরাধ আল্লামা সাঈদীর ওপর চাপিয়ে কি তাকে সাজা দেয়া হল?


দেলোয়ার শিকদার সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য:

মুক্তিযোদ্ধা  সংসদ পিরোজপুর জেলা কমান্ড কাউন্সিলের  প্রস্তুতকৃত পিরোজপুরের  রাজাকারদের  তালিকায় রাজাকার দেলোয়ার শিকদারের নাম রয়েছে । সেখানে দেলোয়ার শিকদারের পিতার নাম রসুল শিকদার  উল্লেখ রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের  আইনজীবীরা মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের যে ডকুমেন্ট সরবরাহ করেছেন  তার ভলিউম-৩, পৃষ্ঠা ২১৩ তেও রাজাকার তালিকায় দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল শিকদারের নাম উল্লেখ আছে।
পিরোজপুর এবং পাড়েরহাটের প্রবীণ স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপ করে রাজাকার দেলোয়ার শিকদার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। রাজাকার দেলোয়ার শিকদারকে স্থানীয় লোকজন  ‘দেউল্লা’ ‘দেইল্লা’  বা দেলু রাজাকার নামে চেনেন। তবে দেউল্লা রাজাকার নামে বেশি  পরিচিত সে। তার পিতার নাম  রসুল শিকদার (মৃত)।  তাদের বাড়ি পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজ রোড দিয়ে এগিয়ে গেলে চিলাগ্রামের শিকদার বাড়ি। ১৯৭১ সালে  মুক্তিযুদ্ধের  সময় নাজিরপুর থেকে পারেরহাট পর্যন্ত এলাকার দায়িত্ব ছিল রাজাকার দেলোয়ার শিকদার ওরফে দেউল্লার। তবে পাড়েরহাট বন্দরেই সে  অত্যাচার নির্যাতন বেশি পরিচালনা করে।

স্থানীয় সূত্র জানায় পাক আর্মিদের  ক্যাম্পে মেয়েদের তুলে দেয়া, হিন্দুদের ধরিয়ে দেয়া, হিন্দু  সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি দোকানপাট দেখিয়ে দেয়া,  হিন্দু পাড়ায় হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের যেসব অভিযোগ রয়েছে তার  অনেক ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল এই দেলোয়ার  শিকদার ওরফে দেউল্লা রাজাকার। অনেক হিন্দুদের বাড়িতে রাজাকার এবং  পাক আর্মি নিয়ে যাবার  বিষয়ে সে নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।  স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়     তার ব্যক্তিগত অনেক অপকর্ম যা ভুক্তভোগী এবং স্থানীয়রা জানত কিন্তু তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি। অনেকে মুখবুজে সহ্য করেছে কোথাও প্রকাশও করেনি মান  সম্মানের কারনে।

পিরোজপুর পাড়েরহাট, উমেদপুর, মাছিমপুর, শঙ্করপাশা প্রভৃতি এলাকায় হিন্দু পাড়া জ্বালিয়ে দেয়া, লুটাপাট, হিন্দুদের হত্যা  বিষয়ে  রাজাকার দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল শিকদার, রাজ্জাক রাজাকার, মবিন রাজাকার, মোসলেম মাওলানা, দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার  সরাসরি জড়িত বলে স্থানীয় প্রবীনদের কাছে তথ্য পাওয়া গেছে।

মাছিমপুরে ১৩  জন হিন্দুকে হত্যা, উমেদপুরে চিত্তরঞ্জন তালুকদার, জহর তালুকদার, হরেন ঠাকুর, অনিল মন্ডল, সতিষ বালাদের বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনায় দেলোয়ার, রাজ্জাক এবং  মবিন রাজাকারের জড়িত থাকার বিষয়ে অভিযোগ করেছে  স্থানীয় লোকজন। পারেরহাট বাজারে হিন্দু  পাড়ায় হরলাল মালাকার, অরুন কুমার, তরনী কান্ত, নন্দ কুমারসহ মোট ১৩ জন হিন্দুকে এক  দড়িতে বেঁেধ নিয়ে পাক আর্মিদের হাতে তুলে দেয়া এবং হত্যার ঘটনার সাথেও  রাজাকার দেলোয়ার শিকদারের  জড়িত থাকা বিষয়ে জানিয়ছেন এলাকাবাসী।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তার এসব অপকর্মের  বিষয়ে এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের  কাছে অভিযোগ করেন। । রাজাকার দেলোয়ার শিকদার  পালিয়ে যাবার সময় কদমতলায় সে ধরা পড়ে  এবং মুক্তিযোদ্ধা আবেদ আলীর গুলিতে সে নিহত হয় বলে জানিয়েছে সূত্র ।

পিরোজপুর এবং পাড়েরহাটের প্রবীণ স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপ করে রাজাকার দেলোয়ার শিকদার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। রাজাকার দেলোয়ার শিকদারকে স্থানীয় লোকজন  ‘দেউল্লা’ ‘দেইল্লা’  বা দেলু রাজাকার নামে চেনেন। তবে দেউল্লা রাজাকার নামে বেশি  পরিচিত সে। তার পিতার নাম  রসুল শিকদার (মৃত)।  তাদের বাড়ি পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজ রোড দিয়ে এগিয়ে গেলে চিলাগ্রামের শিকদার বাড়ি। ১৯৭১ সালে  মুক্তিযুদ্ধের  সময় নাজিরপুর থেকে পারেরহাট পর্যন্ত এলাকার দায়িত্ব ছিল রাজাকার দেলোয়ার শিকদার ওরফে দেউল্লার। তবে পাড়েরহাট বন্দরেই সে  অত্যাচার নির্যাতন বেশি পরিচালনা করে। তার অন্যান্য ভাইয়েরা হলেন এনায়েত শিকদার (পিরোজপুর শহরে চালের দোকানদার), বেলায়েত শিকদার, মতি শিকদার, চান শিকদার, ফুলু শিকদার (মৃত) এবং লাল মিয়া (মৃত) ।

স্থানীয় সূত্র জানায় পাক আর্মিদের  ক্যাম্পে মেয়েদের তুলে দেয়া, হিন্দুদের ধরিয়ে দেয়া, হিন্দু  সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি দোকানপাট দেখিয়ে দেয়া,  হিন্দু পাড়ায় হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের যেসব অভিযোগ রয়েছে তার  অনেক ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল এই দেলোয়ার  শিকদার ওরফে দেউল্লা রাজাকার। ।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তার এসব অপকর্মের  বিষয়ে এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের  কাছে অভিযোগ করেন। । রাজাকার দেলোয়ার শিকদার  পালিয়ে যাবার সময় কদমতলায় সে ধরা পড়ে  এবং মুক্তিযোদ্ধা আবেদ আলীর গুলিতে সে নিহত হয় বলে জানিয়েছে সূত্র ।

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে  গত ১ ফেব্রুয়ারি   আদালতে সাক্ষ্য দেন  ৮১ বছর বয়স্ক আলোচিত সাক্ষী  মধুসূদন ঘরামী।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে   প্রবীন সাক্ষী মধুসূদন ঘরামী দেলোয়ার শিকদার, পিতা রসুল শিকদার নামে পিরোজপুরে   একজন রাজাকার থাকার কথা স্বীকার করেছেন সাক্ষী  মধুসূদন ঘরামী। সে গনরোষে পিরোজপুর নিহত হয়ে থাকতে পারে বলেও স্বীকার করেছেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের জেরার সময়।

জন্ম থেকেই তিনি সাঈদী :
সাঈদী  শব্দটি নামের সাথে  পূর্বে ছিল না পরবর্তীতে যোগ করা হয়েছে এ বিষয়ে অনুসন্ধানে  জানা গেছে  ‘দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী’ এটি তার জন্মগত নাম। জন্মের পর এ নাম রাখা হয়  এবং  ডকুমেন্টারি যেসব স্থানে তার নাম লিখতে হয়েছে তার সকল স্থানে  নামের শেষে সাঈদী শব্দটি পাওয়া গেছে। তার পিতার নামের শেষেও সাঈদী শব্দ যুক্ত রয়েছে। মাওলানা সাঈদীর ১৯৫৭ সালের দাখিল সনদ, ১৯৬০ সালের  আলিম সনদ, ১৯৬৪ সালের ওয়াজ মাহফিলের লিফলেট এবং   পাসপোর্টে তার নামের   শেষে সাঈদী পাওয়া গেছে। স্বাধীনতার পূর্ব এবং পরে  বিভিন্ন সময় ওয়াজ মাহফিল নিয়ে পত্রপত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতেও ‘মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী’ লেখা  হয়েছে। 

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৫৭ সালে দাখিল পাশ করেন পিরোজপুরের স্বরূপকাঠীতে অবস্থিত ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত আলীয়া মাদ্রাসা (শর্ষিণ  নামে পরিচিত) )  থেকে।  ১৯৫৭ সালের দাখিল সনদে তার নাম লেখা রয়েছে “দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী”।

১৯৬৪ সালে (বাংলা ১৩৬৯, ১৪ ফালগুন) যশোরের কেশবপুর থানার ফতেহপুর গ্রামে ফতেহপুর মসজিদ প্রাঙ্গনে একটি আজিমুশ্ শান জলসার আয়োজন করা হয়। সে জলসা উপলক্ষে তখন লিফলেট প্রচার করা হয় এলাকায়। যশোর  আল আমিন আর্ট প্রেস কর্তৃক  ছাপাকৃত সেই লিফলেটের একটি কপি  পাওয়া গেছে।  লিফলেটে  ওয়াজ মাহফিলে দুজন বক্তার পরিচিতি তুলে ধরা হয়।  একজন হলেন মাওলানা মো: নুরুল ইসলাম ফারুকী এবং অপরজন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। লিফলেটে  “মাওলানা মো: দেলওয়ার হোসেন সাইদী” এভাবে নামটি  লেখা আছে। অর্থাৎ সেখানেও নামের সাথে সাঈদী শব্দটি ছিল।
ফতেহপুর মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে  প্রচার করা হয় এ লিফলেট।

আরামানিটোলায় ১৯৭৩ সালের ওয়াজ মাহফিল, মতিঝিল কলোনী মাঠে ১৯৭৪ সালের ওয়াজ মাহফিল এর খবর তখন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেখানে মাওলানা সাঈদী ওয়াজ  পেশ করেন এবং তার নামের শেষে সাঈদী লেখা আছে।

কাজেই আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন স্বাধীনতার  পর দীর্ঘদিন পালিয়ে থেকে শিকদার নাম বাদ দিয়ে সাঈদী নাম ধারন করে ভুয়া মাওলানা হিসেবে আত্মপ্রকাশের যে দাবি রাষ্ট্রপক্ষ করেছে এবং রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা যে সাক্ষ্য দিয়েছে তা মিথ্যা প্রমান করতে সাক্ষম হয়েছে বলে  দাবি আসামী পক্ষের আইনজীবীদের। আসামী পক্ষ থেকে সমস্ত প্রমান হাজির করে প্রমান করা হয়েছে যে, দেলোযার শিকদার নামে আরেকজন লোক ছিল। তার পিতার নাম ছিল রুসল শিকদার।  বর্তমান সাঈদী এবং সেই দেলোয়ার শিকদার এক ব্যক্তি নয়। কিন্তু তারপরও  ট্রাইব্যুনাল রায়ের সময় বললেন আমরা ৪০ বছর আগের দেলোয়ার হোসেন নামে এক যুবকের বিচার করছি। বর্তমান সাঈদীর নয়। তখন তাকে দেলু নামে লোকজন  ডাকত। পিরোজপুরে পরিচালিত সবগুলো অপারেশনের সাথে সে জড়িত ছিল।

সাক্ষী সাবুদনামা :
রাষ্ট্রপক্ষ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০ জন ঘটনার সাক্ষী হাজির করে।  তার মধ্যে পাঁচজনের  বিরুদ্ধে জেল খাটার তথ্য বের হয়ে আসে জেরায়। চারজনের  বিরুদ্ধে  চুরির মামলা হয়েছিল এবং অপরাধ  প্রমান শেষে কারো কারো সাজাও হয়েছে।  অপর আরো এক সাক্ষীর বিরুদ্ধে জেল খাটার অভিযোগ করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা।  কজন হত্যা প্রচেষ্টা মামলায় সাত মাস সাজাভোগ করেন।
তিনজন সাক্ষী আদালতে স্বীকার করেছেন তারা  মুক্তিযোদ্ধা নন। কিন্তু মামলা শুরু হবার  পর তাদেরকে   মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত  করার জন্য স্থানীয় এমপি এম এ আউয়াল তাদের ডিও লেটার দিয়েছেন ।
কয়েকজন স্বীকার করেছেন তারা মামলা শুরুর পর  সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা গ্রহণ করেছেন। 

মামলার বাদী এবং প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার চুরির মামলায় জেল খেটেছেন।  এছাড়া স্ত্রীর যৌতুক মামলায় তার সাজা বহাল রয়েছে  এবং বর্তমানে মামলাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।

অপরদিকে আসামী পক্ষে মোট ২০ জন সাক্ষীর তালিকা নির্ধারন করে দেন ট্রাইবু্যুনাল এবং তার মধ্য থেকে ১৭ জন সাক্ষী হাজির করে আসামী পক্ষ। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য  হলেন সুন্দরবন সাবসেক্টর কমান্ডর মেজর (অব) জিয়াউদ্দিনের সেকেন্ড ইন কমান্ড শামসুল আলম তালুকদার।
জনমনে প্রশ্ন আল্লামা সাঈদীর পক্ষে ১৭ জন সাক্ষীর একটি কথাও সত্য নয় আর রাষ্ট্রপক্ষের সব সাক্ষী  যাদের অনেকে চুরির অপরাধে জেল খেটেছে, সাক্ষী হবার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটসহ রাষ্ট্রীয় নানা সুযোগসুবিধা পেয়েছে তাদের  কথা সত্য?


ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর সাড়াজাগানো   বক্তব্য
২০১২ সালে ৬ ডিসেম্বর রায়ের তারিখ ঘোষনার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ট্রাইব্যুনালের অনুমতি নিয়ে মাত্র আড়াই থেকে তিন মিনিট  আবেগময়ী এবং মর্মস্পর্শী   বক্তব্য রাখেন।    নিজেকে বিশ্বাসের চূড়ান্ত এবং শেষ স্তরে সপে দিয়ে মাওলানা সাঈদী  অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারন করেন  আমার বিরুদ্ধে যে ২০টি অভিযোগ আনা হয়েছে তার একটিও যদি সত্য হয় তাহলে আমি যেন ঈমান নিয়ে মরতে না পারি । রোজ কিয়াকমতের দিন যেন রসুল (সা) এর শাফায়াত  আমি না পাই। আর যারা আমার বিরুদ্ধে  মিথ্যা অভিযোগ  এনেছে  তারা যদি তওবা না করে এবং তওবা যদি তাদের নসিব না হয় তাহলে  গত দুইটি বছর  আমি এবং আমার সন্তানরা যে যন্ত্রনা ভোগ করেছি, আমার যে পরিমান  চোখের পানি ঝরেছে, আমার সন্তানদের যে চোখের  পানি ঝরেছে, তার  প্রতিটি ফোটা অভিশাপের বহ্নিশিখা হয়ে  আমার থেকে শতগুন যন্ত্রনা এবং কষ্ট ভোগের আগে যেন তাদের মৃত্যু না হয়। আর জাহান্নাম হয় যেন তাদের চির ঠিকানা।

মাওলানা সাঈদী বলেন, যদি আমার প্রতি  জুলুম করা হয় করা  হয় তাহলে এ বিচারের দুইটি পর্ব হবে। আজ এখানে একটি পর্ব শেষ হবে। আর কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর দরবারে আরেকটি বিচার বসবে। সেই বিচারে আমি হব বাদী। আর আমার বিরুদ্ধে যারা জুলুম করেছে তারা হবে আসামী।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ২৯ জানুয়ারি রায়ের তারিখ  বিষয়ে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।  রায়ের তারিখ বিষয়ে আদেশ ঘোষনার আগ  মুহুর্তে কাঠগড়ায় অপেক্ষমান মাওলানা সাঈদী দাড়িয়ে বলেন, আমি হাজার বার ফাঁসির মঞ্চে দাড়াতে প্রস্তুত আছি। আমি মৃত্যুকে পরোয়া করিনা। মৃত্যু নিয়ে কোন ভয়ভীতি আমার নেই। আমি আমার যৌবন কাল থেকে শুরু করে  আজ ৭৩ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষকে পবিত্র কোরআনের দাওয়াত দিয়েছি।   কোরআনের একজন খাদেম হিসেবে গত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কোরআনের দাওয়াত পৌছে দিয়েছি।  লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার মাহফিলে যোগ দেয়। অসংখ্য মানুষ এসব মাহফিল থেকে সঠিক পথের দিশা পেয়েছে।  দেশ বিদেশের লক্ষ কোটি মানুষ আমাকে  ভালবাসেন। আমি সাঈদী লক্ষ কোটি মানুষের চোখের পানি মিশ্রিত দোয়া ও ভালবাসায় সিক্ত।  এটাই কি আমার অপরাধ? আমি  কোরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি। এটাই কি আমার অপরাধ? এটা যদি আমার অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে এ অপরাধে অপরাধী হয়ে হাজার বার ফাঁসির মঞ্চে যেতে আমি রাজি আছি।
আজ আমি আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে আপনাদের সামনে বলতে চাই, সরকার ও তার রাষ্ট্র যন্ত্র কর্তৃক চিত্রিত ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের হত্যাকারী, লুন্ঠন, গণ হত্যাকারী, ধর্ষক, অগ্নি সংযোগকারী, দেলোয়ার শিকদার বা ‘দেলু’ বা দেইল্যা রাজাকার আমি নই। আমি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রিয় জন্মভূমি এই বাংলাদেশের আপামর জনসাধারনের নিকট চিরচেনা পবিত্র কোরআনের একজন তাফসীরকারক, কোরআনের  একজন খাদেম, কোরআনের পথে মানুষকে আহ্বানকারী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
তিনি বলেন,  দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই ৪২ বছরের মধ্যে আমার বিরুদ্ধে কোন বিষয়েই কোন মামলা ছিলো না। সামান্য একটি জিডিও ছিলো না। গণতন্ত্রের লেবাসধারী বর্তমান এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের বদান্যতায়, মহানুভবতায় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আজ আমি ১৭টি মামলার আসামী। সেই জুন ২০১০ থেকে অদ্যাবধি কথিত মানবতাবিরোধী ২০ টি অপরাধের অভিযোগসহ ১৭টি মামলা আমার বিরুদ্ধে দায়ের করে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে সরকার আমাকে তাদের এক রাজনৈতিক তামাশার পাত্রে পরিনত করেছে, যা আজ দেশবাসীর কাছে মেঘমুক্ত আকাশে দ্বিপ্রহরের সূর্যের মতই স্পষ্ট।
যে ২০টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আজ আপনাদের সম্মুখে আমি দন্ডায়মান, সেগুলো সরকারের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই সাজানো। ১৯৭১ সনে পিরোজপুর বা পাড়েরহাটে পাক বাহিনী যা ঘটিয়েছে, সেসব কাহিনী সৃজন করে চরম মিথ্যাবাদী ও প্রতারক এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও তার সহযোগীরা নীতি নৈতিকতার মূলে পদাঘাত করে আমার নামটি জুড়ে দিয়েছেন। 


মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ :

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে বিচার হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুর জেলার পাড়েরহাট বন্দর এলাকায়   রাজাকার ও শান্তি কমিটি গঠনে নেতৃত্ব প্রদান, পাড়েরহাট ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগ এবং  মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনেকে হত্যা, নির্যাতনে  নেতৃত্ব প্রদান এবং এসবে অংশগ্রহণ।  পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার এবং  শান্তি কমিটির লোকজন নিয়ে পাড়েরহাট বাজারে  হিন্দু  সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগ এবং  মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের  দোকানপাট লুটপাট, বাড়িঘরে  অগ্নিসংযোগ ।  এসব বাড়িঘর  দোকানপাট লুটপাটে নেতৃত্বদান এবং সরাসরি  অংশগ্রহনের অভিযোগ।  ভানুসাহাসহ বিভিন্ন মেয়েদের  ধর্ষন  এবং ধর্ষনের উদ্দেশে গ্রামের  অনেক নারীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর  ক্যাম্পে  তুলে দেয়ার অভিযোগ।  হত্যা, গণহত্যা,  মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে নিজে জড়িত থাকাসহ এসবে নেতৃত্ব প্রদান, পরিচালনা  এবং পাকিস্তান আর্মিকে এসব অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করার অভিযোগ।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে চার্জশিটে ৩২টি অভিযোগ জমা দেয়া হয় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে। এখান থেকে ২০টি অভিযোগ নিয়ে  তার বিরুদ্ধে চার্জশিট গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এ ২০টি অভিযোগ হল

১.    ১৯৭১ সালের ৪ মে মাওলানা সাঈদীর  নেতৃত্বের লোকজন পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে পিরোজপুর মাছিমপুর বাস স্ট্যান্ডের পেছনে যায়। সেখানে পরিকল্পিতভাবে আগে থেকে লোকজন জড়ো করে ২০ জন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
২.    একই তারিখে  মাওলানা সাঈদী ও তার দল পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে মাসিমপুর হিন্দুপাড়ায় যায়। সেখানে হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়।   এসময় পলায়নপর লোকজনের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হলে ১৩ জন মারা যায়।
৩.    একই দিন সাঈদী নিজে মাসিমপুর মনীন্দ্রনাথ ও সুরেশ চন্দ্র মন্ডলের বাড়ি লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় আশপাশের আরো অনেক বাড়িতে আগুন ধরানো হয়।
৪.    একই দিন সাঈদী তার রাজাকার বাহিনী  পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে  ধোপাবাড়ি  সামনে এবং এলজিইডি ভবনের পেছনের হিন্দুপাড়া ঘিরে ফেলে। এসময়  তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হলে দেবেন্দ্রনাথ  মন্ডল, পলিন বিহারী, জগেন্দ্র  মন্ডল, মুকুন্দ বালা মারা যায়।
৫.    পরের দিন  ৫ মে সাঈদী ও তার সহযোগী শান্তি কমিটির মন্নাফ কয়েকজন পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ে পিরোজপুর হাসপাতালে যায়। সেখান থেকে তারা সাইফ মিজানুর রহমানকে ধরে  বলেশ্বর নদীর তীরে  নিয়ে যায়। সাইফ মিজানুর রহমান ছিলেন  সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতা। একই দিন লেখক হুমায়ুন আহমেদের পিতা পিরোজপুরের সাবডিভিশন পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) ফয়জুর রহমান এবং ভারপ্রাপ্ত এসডিও আব্দুর রাজ্জাককে কর্মস্থল থেকে ধরে নিয়ে বলেশ্বর নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। মাওলানা সাঈদীর উপস্থিতিতে এ তিন সরকারী কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
৬.    দুই দিন পর ৭ মে সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির একটি দল পাড়েরহাট বাজারে হিন্দু সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘরববাড়ি  দেখিয়ে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে। এরপর সেসব প্রতিষ্ঠানে নির্বিচানের লুটপাট চালানো হয়। পরে আগুন দেয়া হয়। লুটপাটে  সাঈদী নিজে অংশ নেন। মাখনলাল সাহার দোকান থেকে ২২ সের ¯¦র্ণ লুট করা হয়। মাওলানা সাঈদীর নেতৃত্বে  শান্তি কমিটির লোকজন দোকানপাট লুটে অংশ নেয়।
৭.    পরের দিন ৮ মে  বেলা দেড়টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী নিয়ে বাদুরিয়া গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে শহিদুল ইসলাম সেলিম খানের বাড়িতে যায়। নুরুল ইসলামকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে এবং পরে তাকে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। এরপর তাদের বাড়ি আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
৮.    একই দিন বেলা  তিনটার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এখানে ৫টি ঘর তারা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় লুটপাটের পর। মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহীম কৃট্টি  এবং মফিজুল নামে দুজনকে  ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সাঈদীর প্ররোচনায় ইব্রাহীমকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং মফিজকে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া  হয়।
৯.    ২ জুন সকাল ৯টায়  নলবুনিয়া গ্রামের আব্দুল হালিমের বাড়িতে মূল্যবান জিনিস লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
১০.    একই দিন সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর আগুন  দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়।
১১.    একই দিন সাঈদী  পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে টেংরাটিলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে যায় ।   তার বড় ভাই মাহবুবুল আলম হাওলাদারকে নির্যাতন এবং বাড়িতে লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেয়া  হয়।
১২.     সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল পাড়েরহটা বাজারের  ১৪ জন হিন্দুকে  এক দড়িতে বেধে গুলি করে হত্যার পর নদীতে ফেলে দেয়া  হয়।
১৩.    যুদ্ধ  শুরুর ২/৩ মাস পর সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তানী সেনা দল নলবুনিয়া গ্রামের আজহার আলীর বাড়িতে যায়। আজহার আলীর ছেলে সাহেব আলীকে পিরোজপুর  নিয়ে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
১৪.    মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি রাজাকার দল হোগলাবুনিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায়  যায়। এখানে মহিলাদের ধর্ষণ করা হয় এবং তাদের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়।
১৫.     মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সাঈদীর নেতত্বে ১৫ /২০ জনের একটি দল হোগলাবুনিয়ার গ্রামের ১০  জন হিন্দুকে  ধরে পাকিস্তান সেনাদের হাতে  তুলে দেয়া হয় এবং তাদের হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
১৬.    সাঈদীর নেতৃত্বে পারেরহাট বাজারের গৌরাঙ্গ সাহার তিনবোনকে ধরে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দেয়া হয । তিনবোনকে তিন দিন ক্যাম্পে আটকে রেখে ধর্ষনের পর ছেড়ে দেয়া হয়।
১৭.    সাঈদী ও তার নেতৃত্বের রাজাকাররা পাড়েরহাট বাজারের বিপদ  সাহার  মেয়ে ভানুস সাহাকে  তার বাড়িতে আটকে রেখে নিয়মিত ধর্ষণ করত।
১৮.    ভাগীরথী নামে একটি মেয়ে পাকিস্তান সেনা ক্যাম্পে কাজ করত। সাঈদী পাকিস্তানী সেনাদের খবর দেয় যে, ভাগীরথী  মুক্তিযোদ্ধাদের চর হিসেবে পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পের খবর  মুক্তিযোদ্ধাদের পৌছে দেয়। এরপর পাকিস্তান সেনারা তাকে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
১৯.    সাঈদীর  ১০০ থেকে ১০৫ জন হিন্দুকে জোর করে মুসলমান বানায় এবং তাদের মসজিদে নামাজ পড়তে বাধ্য করে।
২০.     নভেম্বরের শেষের দিকে সাঈদী খবর পান  মানুষজন ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। তার নেতৃত্বে ১০ /১২ জনের একটি দল ইন্দুরকানী গ্রামে  তালুকদার বাড়িতে আক্রমন চালায়। ৮৫ জনকে আটক করা হয়। ১০/১২ জন বাদ দিয়ে বাকীদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।

প্রমানিত অভিযোগ:  উপরোক্ত ২০টি অভিযোগ থেকে আটটি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। ইব্রাহীম কুট্টি এবং বিশাবালী হত্যা ছাড়া  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে অপর যে ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল (অভিযোগ নং ৬) পাড়েরহাট বাজারে হিন্দু ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের  দোকানপাট, বাড়িঘরে লুটপাট এবং আগুন দেয়ার বিষয়ে নেতৃত্ব প্রদান এবং অংশ নেয়া, (৭) শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া, (১১) মাহবুবুল আলম হাওলাদার বাড়িতে লুট এবং তার ভাইকে নির্যাতন (১৪)  ১৯৭১ সালে  হোগলাবুনিয়া এলাকায় হিন্দু পাড়ায় আক্রমন এবং শেফালী ঘরামী নামে একজন মহিলাকে রাজাকার কর্তৃক  ধর্ষনে সহায়তা এবং সেখানে উপস্থিত থাকা  (১৬) গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, অন্নরানী  এবং কমলা নামে তিন বোনকে অপহরন করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়া  এবং তিনদিন ক্যাম্পে রেখে পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক ধর্ষনের পর ছেড়ে দেয়ার ঘটনা এবং (১৯) মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরন। এসব অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে তবে শাস্তি প্রদান করা হয়নি।

খালাস ১২টি অভিযোগ : যে ১২টি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অভিযোগ হল  পিরোজপুরের পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান (হুমায়ূন আহমেদের পিতা), মেজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহামান  এবং এসডিও আব্দুর রাজ্জাককে হত্যার অভিযোগ। এছাড়া ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে নির্মম হত্যার শিকার ভাগিরথীকে হত্যা এবং  ভানু সাহাকে ধর্ষনের  অভিযোগ থেকেও খালাস দেয়া হয় মাওলানা সাঈদীকে। এছাড়া মাছিমপুর বাস স্ট্যান্ডের পেছনে, মাসিমপুর হিন্দুপাড়া এবং ধোপপাড়া এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সংখ্যাক হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেয়া, লুটপাট করা, হিন্দুদের  অনেক হিন্দুকে এক দড়িতে বেঁধে হত্যঅ করা, হত্যার উদ্দেশে হিন্দুদের  পাকিস্তান বাহিনীর হাতে তুলে দেয়াসহ মোট ১২টি অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ প্রমানিত হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

আলোচিত এবং ঘটনাবহুল একটি মামলা :

১৯৭১ সালে সংঘটিত মাবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এবং ২ এ যে কয়টি মামলা হয়েছে এখন পর্যন্ত তার মধ্যে নানা কারনে সবচেয়ে আলোচিত এবং ঘটনাবহুল মামলা ছিল মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা।  মাওলানা সাঈদী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মোফাসসিরে কোরআন এবং সুললিত কণ্ঠস্বরের অধিকারী  হওয়ায় গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ মামলা।

এই মামলার শুরুতেই প্রশ্ন ওঠে  ট্রাইব্যুনালের পদত্যাগী  চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নিরপেক্ষতা নিয়ে। ১৯৯২ সালে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচারের জন্য জাহানারা ঈমামের নেতৃত্বে গঠিত গনআদালত  এবং পরর্তীতে  মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য জামায়াত নেতাদের বিচারের জন্য  গঠিত গণতদন্ত কমিশনের সাথে জড়িত ছিলেন বিচারপতি নিজামুল হক।

এরপর সর্বশেষ স্কাইপ কেলেঙ্কারি এবং ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে মাওলানা সাঈদীর পক্ষের  একজন হিন্দু সাক্ষী অপহরনের ঘটনা,  রাষ্ট্রপক্ষের হিন্দু সাক্ষী  গণেশ চন্দ্র মাওলানা সাঈদীর পক্ষে এসে সাক্ষ্য দেয়ার ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বিদেশী গনমাধ্যমেও স্থান পায় স্কাইপ কেলেঙ্কারি এবং সাক্ষী অপহরনের ঘটনা। স্কাইপ কেলেঙ্কারির কারনে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুলক হককে। মাওলানা সাঈদীর মামলার বিচারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল হক থাকলেও তিনি এ মামলার রায় ঘোষনা করতে পারলেননা। স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে তাকে  পদত্যাগ করতে হয়  এবং ট্রাইব্যুনালে নতুন চেয়ারম্যান  হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এটিএম ফজলে কবিরকে। নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের কারনে মাওলানা সাঈদীর   বিচার কার্যক্রম শেষ হবার পরও আবার নতুন করে শুরু করতে হয় যুক্তি তর্ক  উপস্থাপন। এছাড়া বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালের আরেক সদস্য বিচারক জহির আহমেদ পদতাগ করেন। বিচার বিষয়ে অন্য বিচারকদের সাথে মতভিন্নতা এবং কিছুটা নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বনের চেষ্টার কারনে তাকে সরকার পদত্যাগে বাধ্য করে বলে পরবর্তীতে প্রমানিত হয়েছে।  বিচারক জহির আহমেদকে সরিয়ে দেয়ার পর নতুন বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান  জাহাঙ্গীর হোসেন । এসব কারনে  ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলা হওয়া সত্ত্বেও মাওলানা সাঈদীর মামলার রায় ঘোষনার পূর্বে ট্রাইব্যুনাল-২ এ অন্য দুটি মামলার রায় ঘোষনা করা হয়েছে।

এছাড়া আসামী পক্ষ কর্তৃক সেফ হাউজের  ডকুমেন্ট উদ্ধারের ঘটনাও এ মামলার একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছিল।  রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ৪৬ জন সাক্ষীর ব্যাপারে লিখিত দরখাস্ত দিয়ে  ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে বলা হয় তাদের হাজির করা আদৌ সম্ভব নয়। কারণ তাদের অনেকে  মাওলানা সাঈদীর সন্ত্রাসীর ভয়ে বাড়িছাড়া, নিখোঁজ, পলাতক। কেউবা অসুস্থ। তাই তারা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে  যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা যেন তাদের অনুপস্থিতিতেই সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সেখান থেকে ১৫ জনের জবানবন্দী (পরে আরেকজন বেড়েছে) সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। পরবর্তীতে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা  একটি ডকুমেন্ট হাজির করে দেখান যে, ৪৬ জন সাক্ষীদের অনেককে ঢাকায় একটি সেফ হাউজে দীর্ঘদিন রেখেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু তারা তাদের শেখানো মতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় তাদের হাজির করেনি রাষ্ট্রপক্ষ। সেফ হাউজের এ ডকুমেন্ট নিয়ে তখন সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

১৫ জন সাক্ষীকে  ট্রাইব্যুনালে হাজির না  করে তাদের জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার ঘটনাও বেশ সমালোচনার জন্ম দেয় এ মামলার ক্ষেত্রে।
মাওলানা সাঈদীর মামলায় উভয় পক্ষের হাজির করা সাক্ষীদের জেরা বছরজুড়ে পাঠকের কাছে ছিল  আকর্ষনীয় বিষয় । পিরোজপুরের বর্তমান এমপি একেএমএ আউয়াল মাওলানা সাঈদীর বিপক্ষে সাক্ষ্য দেন। মাওলান সাঈদীর পক্ষেও সাক্ষ্য দিয়েছেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের    শুরুতে আইন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তবে  ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে শুরু হওয়া সব বিতর্ক ছাপিয়ে যায় বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ কেলেঙ্কারির ঘটনা। বিচারের বিভিন্ন  আদেশ/বিষয় আসয় বেলজিয়াম থেকে লিখে পাঠানোর ঘটনার চিত্র বের হয়ে পড়ে এতে। বিচার কাজে সরকার এবং বাইরের বিভিন্ন ব্যক্তি এবং মহলের যোগসাজস এবং নিয়ন্ত্রনের ঘটনায় দেশ এবং বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিচার বিভাগের ইতিহাসে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা অতীতে আর কখনো ঘটেনি বলে  মন্তব্য করেন আইনজ্ঞরা।

এ বিচার চলাকালে  এবং বন্দী থাকা অবস্থায় মাওলানা সাঈদী প্রথমে তার মাকে হারান। এরপর গত বছর জুন মাসে বিচার চলাকালে  ট্রাইব্যুনালে বসে অসুস্থ হয়ে মুত্যৃর কোলে ঢলে পড়েন তার বড় ছেলে রাফিক বিন সাঈদী। রাফিক বিন সাঈদী মারা যাবার পর মাওলানা সাঈদী কারাবন্দী থাকা অবস্থায়  গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন তাকে   হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়। বর্তমানে মাওলানা সাঈদীর বড় ছেলে শামীম সাঈদীও কারাগারে বন্দী রয়েছেন।

মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় :

মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলের সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।
মাওলানা সাঈদী নিজ পিতার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ  করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠীতে অবস্থিত শর্ষিণা (ছারছিনা) মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেন। এরপর তিনি খুলনার একটি মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করেন। 
১৯৬৭ থেকে মাওলানা  সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে  মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর করেছেন।  তার ওয়াজ শুনে  অনেক  হিন্দু  এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ওপর রচনা করেছেন অসংখ্য পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও  সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশে বিদেশে সর্বত্র।  দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগনিত ভক্ত অনুরাগী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের  আমন্ত্রনে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং  কোরআনের  তাফসির করেছেন।
মাওলানা সাঈদী ১৯৭৯ সালে সাধারন সমর্থক হিসেবে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন এবং  ১৯৮৯ সালে মজলিসে শুরায় সদস্য নির্বাচিত  হন।  তিনি দুই বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি তিন সন্তানের পিতা। বিচার চলাকালে তার বড় ছেলে রাফিক বিন সাঈদী ইন্তেকাল করেছেন।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের  ৬ ডিসেম্বর  মামলার সমস্ত  কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন ১১ ডিসেম্বর। এরপর মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি  উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি  উভয় পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে  সেদিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনার এক মাসের মাথায় রায় ঘোষনা করলেন ট্রাইব্যুনাল।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত  মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়।  ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্করির কারনে  পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি।

মানিক পসারী নামে এক লোক   পিরোজপুরের মেজিস্ট্রেট আদালতে  ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট  মাওলানা  দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের করেন পিরোজপুর  মেজিস্ট্রেট আদালতে।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে  মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার  ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবী করেন।  এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং  বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ১৪ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় প্রসিকিউশনের কাছে এবং ৩/১০/২০১১ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে আদেশ দেয়া হয় ট্রাইব্যুনাল-১ এ।

এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে। সেই থেকে তিনি বন্দী ছিলেন রায় ঘোষনার দিন পর্যন্ত।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২৮ জন সাক্ষী হাজির করে। এর মধ্যে ঘটনার সাক্ষী ছিল ২০ জন  (গতকাল আমরা ভুলক্রমে ১৮ জন লিখেছিলাম) । বাকীরা জব্দ তালিকার এবং একজন তদন্ত কর্মকর্তা। রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৬৮ জন ঘটনার সাক্ষীর তালিকা জমা দিয়েছিল ট্রাইব্যুনালে।   ৬৮ জনের মধ্য থেকে হাজির করা হয়নি এমন ১৬ জন সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
অপরদিকে আসামী পক্ষে মোট ২০ জন সাক্ষীর তালিকা নির্ধারন করে দেন ট্রাইবু্যুনাল এবং তার মধ্য থেকে ১৭ জন সাক্ষী হাজির করে আসামী পক্ষ।


মামলা শুরু যেভাবেমাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই চিকিৎসার জন্য  সৌদি আরব যাচ্ছিলেন। এয়ারপোর্টে তাকে আটকে দেয়া হল। তিনি আদালতের স্মরনাপন্ন হলেন। ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট হাইকোর্ট তাকে  বিদেশ গমনে বাঁধাদানকে অবৈধ উল্লেখ করে  তার পক্ষে রায় দেন। রায়ে তাকে বিদেশ গমন এবং বিদেশ থেকে ফেরত আসা বিষয়ে  কোন প্রকাশ  বাঁধা না দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন আদালত। হাইকোর্টের এ আদেশের আড়াই ঘন্টার মাথায়  সুপ্রীম কোর্টের চেম্বার বেঞ্চ স্থগিত করেন সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে।

দুপুর বারটার দিকে হাইকোর্ট তাকে বিদেশ যাবার অনুমতি দিয়ে রায় দেয়ার পর আড়াইটার দিকে চেম্বার বেঞ্চ  কর্তৃক তা স্থগিত করে দেয়া হল।  বিদেশ গমনে বাঁধা বিষয়ক শুনানীতে অংশ নিয়ে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন তার বিরুদ্ধে কোন  অভিযোগ নেই এবং কোন মামলাও নেই। এর জবাবে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সেদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন মামলা নেই কিন্তু মামলা হতে কতক্ষন।

এটর্নি জেনারেল এর মন্তব্যের কয়েক ঘন্টার মধ্যে সেদিনই অর্থাৎ  ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট পিরোজপুরে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হল  ১৯৭১ সালের ঘটনা বিষয়ে। মানিক পশারী নামে এক লোক   পিরোজপুর মুখ্য বিচারকি হাকিমের  আদালতে  মাওলানা  দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীসহ ৫ জনের  বিরুদ্ধে এ মামলাটি করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয় ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা  সাঈদী  পাকিস্তান আর্মি নিয়ে তাদের বাড়িতে যায়। বাড়ি লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। বাড়ির কাজের লোক ইব্রাহীম কুট্টিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি তাকে  পাড়েরহাট বাজারে হত্যা করে।

মানিক পশারীর এ মামলা দায়েরের  কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম হাওলাদার  নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও অন্য তিনজনের বিরুদ্ধে  পিরোজপুর নালিশী আদালতে একটি নালিশী দরখান্ত দাখিল করেন। এটিও ১৯৭১ সালের ঘটনা বিষয়ে।

২০১০ সালের মার্চ মাসে গঠিত হয়  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ট্রাইব্যুনাল  গঠনের পর মাহবুবুল আলম হাওলাদার  ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে একটি দরখাস্ত দাখিল করেন। দরখাস্তে তিনি মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবি করেন।  তার এ দরখাস্তের সূত্র ধরে মাওলানা  হোসাইন সাঈদীর  বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে । এরপর ২০১০ সালের ২১ জুলাই থেকে  তদন্ত সংস্থা মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে শুরু করে তদন্ত কাজ। ২০১১ সালের  ৩ অক্টোবর চার্জ গঠনের মাধ্যমে শুরু হয়  বিচার কার্যক্রম। 

পিরোজপুরের মামলা বিষয়ে আসামী পক্ষের অভিযোগ
মানিক পশারী এবং মাহবুবুল আলম হাওলাদার ২০০৯ সালে পিরোজপুরে মাওলানা  সাঈদীর বিরুদ্ধে যে দুটি মামলা দায়ের করেন সে বিষয়ে আসামী পক্ষ থেকে  বিভিন্ন সময় ট্রাইব্যুনালে  অভিযোগ করে বলা  হয়েছে- এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম  সাংবাদিকদের সামনে  বলেন- মামলা  নেই কিন্তু মামলা হতে কতক্ষন। তিনি একথা বলার কয়েক ঘন্টার মধেই পিরোজপুরে তার বিরুদ্ধে মানিক পশারী মামলা করেন। এ থেকে বোঝা যায় এটর্নি জেনারেল এবং মানিক পশারীর মামলার সাথে একটি যোগসূত্র রয়েছে। মানিক পশারী কর্তৃক মামলা  দায়ের করার এক মাসের মধ্যে  মাহবুবুল আলম হাওলাদার যে আরেকটি মামলা করেন সেটিও সরকারের নির্দেশে তাকে দিয়ে করানো হয়েছে বলে আসামী পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।

যেভাবে গ্রেফতার 
তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব রেজাউল হক চাঁদপুরী ২০১০ সালের ২১ মার্চ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের  পাঁচ নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে। মামলার আসামীরা হলেন, জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, ঢাকা মহনগর জামায়াতের আমির রফিকুল ইসলাম খান এবং ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগর দক্ষিনের সভাপতি আ স ম ইয়াহিয়া।

মামলায় বলা হয়, ১৭ মার্চ (২০১০)  সিরাতুন্নবী (সা.) উপলে ছাত্রশিবিরের আলোচনা সভায় রফিকুল ইসলাম খান মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আমির নিজামীকে তুলনা করেন, যা ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিতে আঘাত করেছে। ওই সভায় নিজামীসহ অন্য আসামিরা উপস্থিত ছিলেন। মামলার পর মহানগর হাকিম তাদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। ২৯ জুন  তাদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য ধার্য্য করা হয়। আ স ম ইয়াহিয়া ছাড়া জামায়াতের চার নেতা হাজির না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এরপর মাওলানা সাঈদীকে ওইদিন অর্থাৎ ২৯ জুন বিকালে শহীদবাগের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে প্রেসকাবের সামনে থেকে এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে সাভার থেকে বাড়ি যাবার পথে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর পুলিশের কর্তব্য কাজে বাঁধাদান, গাড়ি ভাংচুর, উত্তরা ষড়যন্ত্রের সাথে জাড়িত থাকাসহ বিভিন্ন মামলায় মাওলানা সাঈদীসহ অন্য দুই নেতার প্রত্যেককে ১৬ দিন করে রিমান্ড প্রদান করেন আদালত।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে মামলায়  যেসব আইনজীবী অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, মনজুর আহমেদ আনসারী, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন প্রমুথ।
অন্যদিকে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামালায় রাষ্ট্রপক্ষের নির্ধারিত আইনজীবী ছিলেন সৈয়দ  হায়দার আলী।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন