বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০১৫

আপিল বিভাগের রায় : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড বহাল


মেহেদী হাসান ২৯/৭/২০১৫
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয়েছে  দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের রায়ে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ আজ এ রায় ঘোষনা করেন।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুাল  (১) ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে চারটি অভিযোগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এর সবগুলিই বহাল রাখা হয়েছে আপিল বিভাগের রায়ে। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায়ে তিনটি অভিযোগের প্রতিটিতে ২০ বছর এবং আরো দুটি অভিযোগে ৫ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। আপিল বিভাগের রায়ে ২০ বছর সাজা পাওয়া তিনটি অভিযোগের  একটি থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে । সব মিলিয়ে ট্রাইব্যুনাল মোট নয়টি অভিযোগে দণ্ড দিয়েছিল এবং সেখান থেকে একটি বাদে বাকী আটটি দণ্ড বহালা রাখা হয়েছে আপিল বিভাগের রায়ে।
সকাল নয়টায় আপিল বেঞ্চ সংক্ষিপ্ত রায় দেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

নিয়ম অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে আসামী পক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন  করতে পারবেন এবং রিভিউ রায়ই হবে সর্বশেষ রায়।  রিভিউ রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে সামনে  থাকবে আলোচিত ঘটনাবহুল  এ মামলার রায় কার্যকরের পর্ব।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে  চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া এবং বোয়ালিয়া থানায় হত্যা, গনহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরন, নির্যতান দেশান্তরকরনসহ মানবতাবিরোধী মোট ৩২টি অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। সেখান থেকে ২৩টি অভিযোগে চার্জ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগের মধ্য থেকে ১৭টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষী হাজির করে । ১৭টি অভিযোগ থেকে  তাকে মোট ৯টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বাকী আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া  হয়।

২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোরে গ্রেফতার করা হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। ২০ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধ অভিযোগে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।

এখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধ মামলায়  মোট  তিনটি  মামলার চূাড়ান্ত  নিষ্পত্তি করা হয়েছে। সেগুলো হল আবদুল কাদের মোল্লা, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং  মুহম্মদ কামারুজ্জামান । এর মধ্যে আব্দুল কাদেরর মোল্লা ও মুহম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।  এছাড়া আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধেও আপিল মামলার রায় হয়েছে তবে এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রাকশ এবং তৎপরবর্তী রিভিউ  আবেদন বাকী রয়েছে।


মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ৪ অভিযোগ : 
ট্রাইব্যুনালের রায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যে চারটি অভিযোগে মুত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে সেগুলো হল ৩, ৫, ৬ এবং ৮ নং অভিযোগ।
অভিযোগ-৩  :  রাষ্ট্রপক্ষের এ অভিযোগে বলা হয় ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে এবং নির্দেশে রাউজানের গহিরায় অবস্থিত কুন্ডেশ্বরী কমপ্লেক্স এর প্রতিষ্ঠাতা সমাজসেবক অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে পাকিস্তান আর্মি গুলি করে হত্যা করে।  সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজেও  তাকে গুলি করে । 

অভিযোগ-৫ :  এ অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয় ১৯৭১ সালে ১৩ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কতিপয় অনুসারীদের নিয়ে রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে  হামলা চালিয়ে  তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে। 
অভিযোগ-৬  : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে  রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় সশস্ত্র অভিযান চালান হয়। এসময় ৫০ থেকে ৫৫ জন হিন্দুকে  ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-৮  :  ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ তার পুত্র শেখ আলমগীরসহ তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য প্রাাইভেটকারযোগে চট্টগ্রামের রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসছিলেন। পথে হাটহাজারী থানার খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি তিন রাস্তার মোড়ে সকাল অনুমান ১১টার দিকে পৌঁছামাত্র আসামি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যরা তাদের প্রাাইভেট গাড়িটি অবরোধ করে শেখ মোজাফফর আহম্মেদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আটক করে স্থানীয় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে আর তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

আপিল বিভাগের আজকের  রায়ে মৃত্যুদণ্ডের সবগুলো সাজা বহাল রাখা হয়েছে।

২০ বছর করাদণ্ডের  ৩ অভিযোগ :
২, ৪ এবং ৭ নং অভিযোগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
অভিযোগ ২ :   ১৯৭১ সালের  ১৩ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তান  সেনাবাহিনীর একদল সদস্য রাউজানের গহিরা  গ্রামের  হিন্দু  পাড়ায় সশস্ত্র অভিযান চালায়। এসময়  পঞ্চবালা শর্মা, সুনীল শর্মা, মতিলাল শর্মা ও দুলাল শর্মা  তিন চারদিন পর মারা যায়।

অভিযোগ ৪ : এ অভিযোগে বলা হয় ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী স্থানীয় সহযোগী এবং  পাকিস্তানি  সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত জগৎমলপাড়ায় অভিযান চালান। এসময় ৩২ জনকে হত্যা করা হয়।

অভিযোগ ৭ : ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল  সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি সেনা সদস্য রাউজান পৌরসভা এলাকার সতীশ চন্দ্র পালিতের বাড়িতে  প্রবেশ করে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয।
আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে।

পাঁচ বছর কারাদান্ডের ২  অভিযোগ :
১৭ এবং ১৮ নং অভিযোগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ১৭ নং অভিযোগে বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে বন্দী করে রাখা হয়। ১৮ নং অভিযোগে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম জেলার চান্দগাঁও থানার মোহারা গ্রামের  সালেহউদ্দিনকে অপহরণ করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক বাসভবন গুড়সহিলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার গালে চড় মারেন।

আপিল বিভাগের রায়ে ১৭ এবং ১৮ নং অভিযোগের সাজা বহাল রাখা হয়েছে।

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি পরিচিত নাম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি পরপর ছয়বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি আলোচিত একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।  ১৯৭৩ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যু হয়।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তৎকালীন পূর্ব  পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজে (বর্তমানে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ) ভর্তি  হন ১৯৬০ সালে এবং সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর  নটরডেম কলেজে ১৯৬৬ সালে ভর্তি হন।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্নাসে ভর্তির পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলি হন এবং সেখানে অধ্যয়ন শেষে ১৯৭১ সালে অক্টোবর মাসে লন্ডনের লিঙ্কন ইনে ভর্র্তি  হন ব্যারিস্টারি পড়ালেখার জন্য। তবে তা শেষ করেননি তিনি।  ক্যাডেট কলেজে ভর্তির আগে তিনি পাকিস্তানের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাদিক পাবলিক স্কুলে পড়াশুনা করেন।

ছাত্রজীবনে তিনি সরাসরি কোন ছাত্রসংগঠনের সাথে জড়িত  না থাকলেও আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন বলে ট্রাইব্যুনালে দেয়া জবানবন্দীতে জানান তিনি।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৫৯ সালে ১৩ মার্চ  চট্টগ্রামের রাউজান থানায় জন্মগ্রহণ করেণ। দুই বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ২ ছেলে এবং এক কন্যা সন্তানের পিতা।