সোমবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৩

সাক্ষী নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ কাদের মোল্লার পরিবারের// অপর এক মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে// প্রকৃত মোমেনা বেগম ট্রাইব্যুনালে আসেননি//

মেহেদী হাসান, ৯/১২/২০১৩
আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী নিয়ে জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে ।  আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী প্রকৃত মোমেনা বেগমকে হাজির না করে তার স্থলে অপর এক মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে হাজির করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ করেছে আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবার।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন মিলনায়তনে আজ জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ অভিযোগ উত্থাপন করেন আব্দুল কাদের মোল্লার স্ত্রী সানোয়ার জাহান।

রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগের পক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয় প্রকৃত মোমেনা বেগমের ছবি মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে যে মোমেনা বেগমের ছবি রয়েছে তাকে হাজির করা হয়নি। তার স্থলে অপর মহিলাকে হাজির করা হয়েছে মোমেনা বেগম সাজিয়ে। তিনি বলেন, জল্লাদখানা যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের ছবির সন্ধান পাওয়ার পরই তারা সাক্ষী নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে সানোয়ার জাহান দাবি করেন, সর্বশেষ আমরা জানতে পেরেছি যে, একমাত্র সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেই মোমেনা বেগম আদৌ আদালতে সাক্ষী দিতেই আসনেনি। ক্যামেরা ট্রাইয়ালের নামে গোপন বিচারে ভুয়া একজন মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে আদালতে বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে ।  কিন্তু পরবর্তীতে জল্লাদখানায় সংরক্ষিত প্রকৃত মোমেনা বেগমের ছবি দেখে আমাদের আইনজীবীরা নিশ্চিত করেছেন আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া মোমেনা বেগম প্রকৃত মোমেনা বেগম ছিলেন না। অথচ এইরকম একজন ভুয়া স্বাক্ষীর তিন জায়গায় প্রদত্ত তিনরকমের বক্তব্যে পরে শুধুমাত্র তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। আমরা মনে করি তা নজিরবীহিন এবং এটি একটি ভুল রায়। আমরা মনে করি সংবিধান প্রদত্ত রিভিউ এর সুযোগ পেলে সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়গুলি তুলে ধরার মাধ্যমে আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় পাল্টে যাওয়া সম্ভব।
সানোয়ার জাহান বলেন, এমতাবস্থায় আমরা সরকার, মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশের সকল আইনজীবী এবং মানবাধিকার সংগঠনসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি যে, যে বিচার প্রক্রিয়া এবং সাক্ষী নিয়ে এতবড় জালিয়াতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে একজন নির্দোষ মানুষের জীবন বাচানোর স্বার্থে এই রিভিউ গ্রহণ করে একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্তসংস্থার মাধ্যমে এই ভয়াবহ জালিয়াতির বিষয়ে তদন্ত করে সত্য উদঘাটন পূর্বক মামলার সঠিক এবং পুন:বিচার করা হোক।
সংবাদ সম্মেলনে আব্দুল কাদের মোল্লার বড় ছেলে হাসান জামিল ও কন্যা আমাত উল্লাহ পারভিন উপস্থিত ছিলেন। সানোর জাহানের চোখের সমস্যার কারনে হাসান জামিল তার পক্ষে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান।
লিখিত বক্তব্যের শুরুতে বলা হয়, গভীর দু:খ এবং বেদনা নিয়ে কিছু কথা বলার জন্য আজকে আমি আপনদের সামেন উপস্থিত হয়েছে। আপনারা  ইতোমধ্যে জেনেছেন আমার স্বামী আব্দুল কাদের  মোল্লাকে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ৪:১ সংখ্যাগরিষ্ঠর ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। যদিও বিচারিক আদালত আমার স্বামীকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছিল। কিন্তু বিচার বিভাগের ইতিহাসে কালিমা লেপন করে তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চের চাপে পড়ে সরকার আইন পরিবর্তন করে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপীল করে। এই আপীলের প্রেক্ষিতে সুপ্রীম কোর্ট আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।

আমাদের জানা মতে বাংলাদেশে শুধু নয় এই উপমহাদেশের ইতিহাসে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়া সত্তেও সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক মুত্যুদণ্ড প্রদানের এটাই একমাত্র ঘটনা। এই রায়ের বিরুদ্ধে আমাদের কোথাও আপীল করার সুযোগ নেই। তার অর্থ হচ্ছে আমার স্বামীর হাতে যখন মৃত্যুপরোয়ানা পৌছবে কেবল তখনই তিনি জানবেন কেন তাকে মুত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদলতে আপীল করার সুযোগ তিনি পাবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করার অধিকার আমার স্বামীর রয়েছে। আর যেহেতু একজন বিচারপতি ইতিমধ্যেই আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের বিরোধীতা করেছেন এবং অন্য ৫টি অভিযোগ থেকেও খালাস প্রদান করেছেন এবং সর্বোপরি এই রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপীল করার সুযোগ নেই, তাই রিভিউ দায়েরের বিষয়টি এখানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সরকার এই সাংবিধানিক অধিকার থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি করে  তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের চেষ্টা করছেন বলে আমরা জানতে পারছি। আমরা মনে করি সংবিধান স্বীকৃত রিভিউ এর অধিকার না দিয়ে এবং জেলকোডের বিধান অনুসরণ না করে তড়িঘড়ি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের যে চেষ্টা করা হচ্ছে তা শুধু অবৈধই নয় তা সার্বজনীন মাবাধিকারের নুন্যতম ধারারও পরিপন্থি।

লিখিত বক্তব্যে সানোয়ার জাহান বলেন,  জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার জীবন সব সময়ই প্রকাশ্য এবং স্বচ্ছ। তিনি কোন গোপন আন্দোলনের সদস্য কিংবা কোন গোপন ব্যক্তি নন। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনেক সিনিয়ন নেতাই তাকে কাছে থেকে চেনন এবং জানেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে উদয়ন স্কুল, ১৯৭৭ সালে রাইফেলস স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি ১৯৮২-৮৩ সালে সাংবাদিক নেতা হিসাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ আন্দোলনে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। অথচ এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কেউ কখনও তাকে যুদ্ধপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করেননি অথবা “কসাই কাদের মোল্লা” বলেও ডাকেনি। বিগত ৪০ বছরের তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বা মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি অভিযোগও কোথাও উত্থাপিত হয়নি। অথচ আজকে কথিত মোমেনা বেগম নামে একজন মহিলার অসমর্থিত ও অনির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাকে ভয়ঙ্কর খুনি হিসাবে চিহ্নিত করে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে সানোয়ার জাহান বলেন, দুনিয়ার সকল মানুষের সামনে আল্লাহ তাআলাকে স্বাক্ষী রেখে আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, আব্দুল কাদের মোল্লা খুনি হওয়া তো দুরে থাক কথিত অভিযোগসহ কোন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে কোন দিন জড়িত ছিলেন না। শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলনের নেতা হওয়ার কারণে এবং আওয়ামী বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে আমার নির্দোষ স্বামীকে বৈরী মিডিয়াকে ব্যবহার করে খুনি হিসাবে জাতীর সামনে উপস্থাপিত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, যে বিচারে আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং পরবর্তীতে ঐ একই সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সেই বিচারের প্রক্রিয়া বরাবরই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। স্কাইপ কেলেঙ্কারী, সেইফ হাউজ কেলেঙ্কারী, সাক্ষী অপহরণ এবং জোরপূর্বক ভয়ভীতি দেখিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার ঘটনা দিয়ে এই ট্রাইব্যুনালের ইতিহাস যেমন কলঙ্কিত হয়েছে তেমনিভাবে গোটা দুনিয়ার সকল মানবাধকার সংগঠনসমহ বিশ্ব সম্প্রদায় এই ত্রুটিপূর্ণ বিচারের সমালোচনা করেছেন।

লিখিত বক্তব্য পাঠ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হাসান জামিল বলেন, স্বাধীনতার পর সারা দেশে হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে দালাল আইনে অসংখ্য মামলা হয়েছে। মিরপুরেও বিহারী, আক্তার গুন্ডাসহ অসংখ্য লোকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমার পিতার  বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি আক্তার গুন্ডাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আক্তার গুন্ডার বিরুদ্ধে মামলা হল আর আমার পিতার বিরুদ্ধে কোন মামলা হলনা কেন স্বাধীনতার পর? সারা দেশে এত মামলা হল কিন্তু আমার পিতার বিরুদ্ধে শত শত লোক হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, জ্বালাও পেড়াওয়ের এত বড় বড়  অভিযোগ থাকাও সত্ত্বেও কেন কেউ কোন মামলা করেনি? আজকের এই আধুনিক যুগে ২৩/২৪ বছরের একজন যুবকের পক্ষে কি করা সম্ভব? আর ১৯৭১ সালে তো আরো পেছনে ছিলেন তারা। অথচ আমার পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি পাকিস্তানী সেনাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন অপরাধ সংঘটনে, বিহারীদের এলাকায় নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এত বড় বড় অপরাধ সংঘটন করিয়েছেন। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আমার পিতা যদি এতলুটপাট এবং এতই প্রভাবশালী হয়ে থাকেন সেসময় তাহলে সে অনুযযায়ী সেখানে তার কিছু বিষয় সম্পত্তিও থাকার কথা। কিন্তু কেউ কি প্রমান করতে পারবেন মিরপুরে  বা অন্য কোথাও আমাদের বিপুল কোন সহায় সম্পত্তি আছে?
তিনি বলেন আমাদের পরিবারের কেউ কোনকালে মিরপুরে থাকেনি। আমার পিতা তখন ফরিদপুরে ছিলেন।
হাসান জামিল সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা বিষয়টি ভাল করে তদন্ত করে দেখুন তাহলে আপনাদের সামনে সত্য উদঘাটিত হবে। আপনারা এ বিষয়টা নিয়ে একটু কাজ করুন তাহলে সত্য জানতে পারবেন। তিনি বলেন, আমরা বৈরি মিডিয়ার অপপ্রচারেরও শিকার হয়েছি।

আরেক প্রশ্নের জবাবে হাসান জামিল বলেন, এক সময় আমার পিতা আজকের আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেন গুপ্তসহ অনেকের সাথে একসাথে চলাফেরা করেছেন, মিটিং করেছেন, গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু তখন তো আওয়ামী লীগের কোন নেতা বলেননি যে আব্দুল কাদের মোল্লা যুদ্ধাপরাধী তার সাথে আমরা কোন আলোচনায় বসবনা? এখন কেন এসব অভিযোগ করা হচ্ছে? হাসান জামিল বলেন, শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারনেই আজ এ মিথ্যা অভিযোগে আমার পিতার বিচার করা হয়েছে। তিনি অন্য কোন দল করলে আজ তার এ বিচার হতনা।
সংবাদ সম্মেলনে অ্যাডভোকেট মশিউল আলম, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ মিঠু, ফরিদ উদ্দিন খান, এস এম শাহজাহান কবির, তারিকুল ইসলামসহ বিপুল সংখ্যক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন