সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৪

মোবারক মৃত্যুদণ্ড

মেহেদী হাসান ২৪.১১.১৪
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং আরেকটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ  মোবারকের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের এ রায় ঘোষনা করেন।

১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা ও নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল মোবারকের বিরুদ্ধে। তিনটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। 

মোবারকের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগের মধ্যে ১নং অভিযোগ হল- আখাউড়া থানার টানমান্দাইল ও জাঙ্গাইল গ্রামে ৩৩ জনকে হত্যা এবং ৩নং অভিযোগ হল- ছাতিয়ান গ্রামের আবদুল খালেককে হত্যা। ট্রাইব্যুনালের রায়ে এই দুই অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের ২, ৪ ও ৫ নং অভিযোগ তিনটি প্রমাণিত না হওয়ায় এ অভিযোগগুলো থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ২নং অভিযোগ হল- আনন্দময়ী কালীবাড়ী রাজাকার ক্যাম্পে আশুরঞ্জন দেবকে নির্যাতন। ৪ নং অভিযোগ হল- শ্যামপুর গ্রামের দু’জনকে অপহরণ করে একজনকে হত্যা এবং ৫নং অভিযোগ হল- খরমপুর গ্রামের একজনকে আটক রেখে নির্যাতন।

যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড: ’৭১ সালের ২২ আগস্ট মোবারক হোসেনসহ অন্য রাজাকাররা আখাউড়ার টানমান্দাইল গ্রামে হাজি নূর বকশের বাড়িতে সভা ডাকেন। ওই বাড়িতে ১৩০ বা ১৩২ জন গ্রামবাসীকে জড়ো করা হয়। মোবারক ও তার সহযোগীরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামবাসীদের আটক করে গঙ্গাসাগর দীঘির কাছে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখেন। আটক ব্যক্তিদের মোবারক ও তার সহযোগীরা জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করেন। এছাড়া তিনি টানমান্দাইল গ্রামের ২৬ জন ও জাঙ্গাইল গ্রামের সাতজনসহ ৩৩ জনকে বাছাই করে তেরোঝুড়ি হাজতখানায় নিয়ে যান। ২৩ আগস্ট পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা ওই ৩৩ জনকে দিয়ে গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে গুলি করে হত্যা করে একটি গর্তে মাটি চাপা দেয়। এ অপরাধের দায়ে মোবারককে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

যে অভিযোগে যাবজ্জীবন: মোবারকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে তৃতীয় অভিযোগ হল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাতিয়ান গ্রামের আবদুল খালেক মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। ’৭১ সালের ১১ নভেম্বর রাত ৮টা বা ৯টার দিকে মোবারক সশস্ত্র রাজাকার সহযোগীদের নিয়ে খালেককে অপহরণ করে সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করেন। ওই রাতে খালেককে তিতাস নদীর পশ্চিম পাড়ে বাকাইল ঘাটে নিয়ে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। এই অভিযোগে মোবারককে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

মোবারকের বিরুদ্ধে মোট ৯২ পৃষ্ঠা রায়ে মূল অংশ আদালতে পড়ে শোনানো হয়। মোবারক ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় বসে রায় শোনেন। এর আগে সকাল ৯টায় তাকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। ট্রাইব্যুনালে মোবারকের দুই ছেলে আসাদুল্লাহ ও নজিবুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।  

ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর এ মামলার প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, দুই অভিযোগে একটিতে মোবারকে মৃত্যুদণ্ড এবং একটিতে যাবজ্জীবন কারা দণ্ড প্রদান করেছেন। এজন্য আমরা সন্তুষ্ট। যে তিনটি অভিযোগ থেকে মোবারককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তা আমরা পর্যালোচনা করব। মোবারকের বয়স সম্পার্কে তিনি বলেন, আসামীপক্ষ বলছে মোবারকের জন্ম ১ জুলাই ১৯৫৬ সালে। তারা বলতে চাইছে তিনি ঘটনার সময় নাবালোক ছিলেন। আমরা ভোটার লিস্ট ও অন্যান্য ডকুমেন্ট দিয়ে দেখিয়েছি মোবারকের জন্ম ১০ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে। আদালত এটি গ্রহণ করেছেন।

অন্যদিকে আসামীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ মোবারকের বিষয়ে যে সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করেছে তাতে কোনভাবেই আসামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায় না। এই মামলার সাক্ষ্য প্রমাণে যে নানা রকম বৈপরিত্য ও অসংগতি রয়েছে তা আমরা ট্রাইব্যুনালে দেখিয়েছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযুদ্ধের উপর যেসব বই রয়েছে তাতে এই পাঁচটি ঘটনার কথা উল্লেখ থকলেও একটি ঘটনায়ও মোবারকের নাম আসেনি। তিনি বলেন, আমরা তথ্য প্রমাণ দেখিয়ে বলেছি মোবারকের জন্ম তারিখ ১ জুলাই ১৯৫৬। এই হিসেবে ’৭১ সালে আসামীর বয়স ছিল ১৪ বা ১৫ বছর। তিনি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন এবং নাবালোক ছিলেন। তিনি আরো বলেন, রায়ের পর আমি মোবারক হোসেনের সাথে কথা বলেছি। তিনি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন দ্বায়ের করবেন। আসাকরি আপিলে আমরা ন্যায় বিচার পাব। 
এর আগে গত ২ জুন মোবারক হোসেনের মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষামান (সিএভি) রাখা হয়। রোববার মামলাটি ট্রাইব্যুনালের কার্যতালিকায় আসে এবং সোমবার আদালত রায় দেবেন বলে ঘোষণা দেন।
গত বছর ২০ মে মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের স্যাগ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন সাী মোবারকের বিরুদ্ধে স্যা দিয়েছে।
গত বছরের ১২ মার্চ মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
রাষ্ট্রক্ষর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ’৭১ সালের একটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে ২০০৯ সালের ৩ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মোবারকের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। তখন তিনি হাইকোর্ট থেকে অন্তবর্তীকালীন জামিন নেন। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর তার মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

মোবারক হোসেন ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার আখাউড়া থানার নয়াদিল গ্রামের সাদত আলীর ছেলে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করতেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তবে মোবারক হোসেনের ট্রাইব্যুনালে দাবি করেছিলেন তিনি কখনোই জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। পূর্ব থেকেই তিনি আওয়ামী লীগ করতেন।
আখাউড়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে হাজী মোবারক হোসেন আখাউড়া মোগড়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন ।

হাজী মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার চিফ জুড়িশিয়াল মেজিস্ট্রেট এর কাছে অভিযোগ করেন খোদেজা বেগম নামে জনৈক মহিলা। অভিযোগ মতে  খোদেজা বেগমের পিতা   আব্দুল খালেক ছিলেন আনছার কমান্ডার ।   যুদ্ধের সময় তার পিতা গ্রামে আসার পর  তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যা ঘটনায় হাজী মোবারককে অভিযুক্ত করে খোদেজা বেগম মামলা করেন।

মামলা দায়েরের পর হাজী মোবারক হোসেন হাইকোর্টে  হাজির হয়ে প্রথমে ছয় মাসের জামিন পান। এরপর কয়েকবার জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৪ জুলাই তাকে সংশ্লিষ্ট মেজিস্ট্রেট এর কাছে আত্মসমর্পনের নির্দেশ দিলে তিনি  ঐ বছর ১৯ অক্টেবার   আত্মসমপর্ন করেন।  সেই থেকে তিনি বন্দী  ছিলেন। বন্দী থাকা অবস্থায় ২০১২ সালে তার মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই থেকে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। একই বছর ১৬ জুলাই তিনি  ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে জামিনে মুক্তি পান। সেই থেকে তিনি গত ১২ মার্চ পযন্ত মুক্ত ছিলেন। ১২ মার্চ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন