বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৪

নগরকান্দা মেয়র খোকনের মৃত্যুদণ্ড


 মেহেদী হাসান, ১৩/১১/২০১৪
ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র জাহিদ হোসেন খোকনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ছয়টি অভিযোগে তাকে এ দণ্ড দেয়।  এছাড়া অপর চারটি অভিযোগে খোকনকে মোট ৪০ বছর কারাদণ্ড দেয়া  হয়েছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ  তার বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষনা করে।

বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে জাহিদ হোসেন খোকন পালাতক রয়েছেন। তার অনুপস্থিতিতেই বিচার সম্পন্ন করে ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করেন। খোকনের অনুপস্থিতে বিচারের জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে তার পক্ষে আবদুস শুকুর খানকে আইনজীবী নিয়োগ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র জাহিদ হাসান খোকন পৌর বিএনপির সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন।

ট্রাইব্যুনালে  জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে  ১০টি অভিযোগে দোষীসাব্যস্ত করে সাজা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া একটি অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় ওই অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।  

খোকনকে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরন, লুটপাট, হিন্দুদের দেশ থেকে জোর করে নির্বাসনে পাঠানো ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগের পৃথক ছয়টি অপরাধের ঘটনায় তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া একটি অভিযোগে ২০ বছর, একটিতে ১০ বছর এবং অপর দুটি অভিযোগে পৃথকভাবে ৫ বছর-৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।

সকাল ১১টা থেকে আদালত রায় প্রদান শুরু করেন। মোট ১০৯ পৃষ্ঠার রায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ট্রাইব্যুনাল পাঠ করেন।   
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, আসামি রায় ঘোষণার পর থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল আবেদন করতে পারবেন। যদি এ সময়ের মধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারে অথবা তিনি যদি আত্মসমর্পন বরেন তাহলে তিনি আপিলের সুযোগ পাবেন ।  এছাড়া যে দিন খোকন গ্রেফতার হবেন, সেই দিন থেকে রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া যাবে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

খোকনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগগুলো হল, ’৭১ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুলাই তারিখের মধ্যে ফরিদপুরের নগরকান্দায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, দেশত্যাগে বাধ্যকরা, অগ্নিসংযোগ নির্যাতনসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠন করেন। এর মধ্যে ১৬ জন নারী ও শিশুসহ ৫০ জন গ্রামবাসীকে হত্যা, তিনজনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, ২ জনকে ধর্ষণ, ১৭ জনকে আটক রেখে নির্যাতন, ৯ জনকে ধর্মান্তরিত করা, ২টি মন্দিরসহ ১০টি গ্রামের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, সাতজন গ্রামবাসীকে সপরিবারে দেশান্তরে বাধ্য করা ও ২৫ জনকে নির্যাতন।
জাহিদ হোসেন খোকনের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল বলেন,  এ মামলায় বেশিরভাগ ভিকটিম পরিবার সাক্ষ্য দিয়েছে। ’৭১ সালে জাহিদ হোসেন খোকন যে অপরাধ করেছেন, তা আজ রায়ের মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছে। এ রায়ে ভিকটিমের পরিবারের সাথে আমরাও সন্তুষ্ট।

অপর প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, আসামী অপরাধী না হলে পালাতক থাকতেন না। তার পলাতক থাকায় প্রমাণ হয় তিনি উল্লেখিত অপরাধ করেছেন। তিনি আরো বলেন, আসামী যে দিন গ্রেফতার হবে সেই দিন থেকে রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া যাবে।
অন্যদিকে খোকনের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস সুকুর খান রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ রায়ে আমি আমি খুশি নই। কারণ আসামী ন্যায় বিচার পাননি। ’৭১ সালে জাহিদ হোসেন খোকন আনসার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তিনি বলেন, এখন আসামীর উচিত আত্মসমর্পন করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল আবেদন করা। তাহলে আসামী ন্যায় বিচার পাবেন। সুকুর খান আরো বলেন, এ মামলায় আসামীর পরিবার থেকে কোনো সহায়তা পাননি। নিরাপত্তার কারণে আসামী পক্ষে সাক্ষ্য দেয়া সম্ভব হয়নি। আসামী পক্ষে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিলে এ মামলার রায় অন্যরকম হতে পারতো।

মামলার বিবরণ:
গত বছর ১৮ জুলাই জাহিদ হোসেন খোকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের ১১টি অভিযোগে খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়।
পালাতক জাহিদ হোসেন খোকনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই দুটি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে তাকে হাজির করতে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে দৈনিক জনকণ্ঠ ও ডেইলি স্টারে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু তিনি হাজির না হওয়ায়  ওই বছরের ১৪ আগস্ট তার অনুপস্থিতিতেই বিচার  শুরু করা নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে খোকনের পে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী আবদুস শুকুর খানকে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ২৩ জুন খোকনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দখিল করা হয়।
২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর খোকনের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তার মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর থেকে গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন দাশসহ খোকনের বিরুদ্ধে মোট ২৪ জন সাী সাক্ষ্য প্রদান করেন। 
গত ১৩ এপ্রিল থেকে খোকনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এরপর খোকনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আইনজীবী আবদুস শুকুর খান।
গত ১৭ এপ্রিল জাহিদ হোসেন খোকনের বিচার  কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে রায়ের জন্য অপেক্ষামান রাখা হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন