রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সুখরঞ্জন বালীর জন্য অপেক্ষা

মেহেদী হাসান, ২১/৯/২০১৪
‘মোর স্বামীর পরানডা কি  আছে? আমনেগো পায় ধরি, মোর স্বামীরে আইন্যা দ্যান।  মোরে এটটু খবর  দ্যান।”
প্রায় দুই বছর আগে সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রী আরতী রানী  এই আকুতি প্রকাশ করেছিলেন। বালী নিখোঁজ হবার পর ২০১২ সালের   ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আরতী রানীকে ফোন করা হলে নিখোঁজ স্বামীর জন্য তিনি বিলাপ করে এভাবে আকুতি প্রকাশ করেছিলেন।

নিখোঁজ স্বামীর কোন সন্ধান ছাড়াই আরতী রানীর পর হয়ে যায় ছয় মাস।  এরপর ২০১৩ সালের ১৬ জুন ঢাকার নিউএজ পত্রিকায় খবর বের হয় সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি ভারতের কারাগারে বন্দী আছেন। 

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে ২০১২ সালের পাঁচ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরনের শিকার হন সুখরঞ্জন বালী। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় হয়েছে। কিন্তু বালীর জন্য অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি তার অসুস্থ স্ত্রী এবং সন্তানদের।

গত শুক্রবার সকালে আবার ফোনে যোগাযোগ করা হয় সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রী আরতী রানীর সাথে। স্বামীর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেই কান্নার  সুর ভেসে আসতে থাকে ফোনের ওপার থেকে।  “মোর স্বামীরে আইন্না এটটু দেহান মোরে। মোর অসুখ। মরার আগে স্বামীর মুখ দেখে যেন মরতে পারি হেই ব্যবস্থা করেন আমনেরা।”

সংসার কিভাবে চলছে জানতে চাইলে আরতী রানী জানান, তার স্বামী সুখরঞ্জন বালী কাঠমিস্ত্রীর কাজ করত। নিখোঁজ হবার আগে একটি ঘর বানিয়েছিলেন নিজেদের জন্য ।  কিন্তু সে ঘরে আজ নেই তিনি। স্বামী নিখোঁজের পর দিশাহীন অবস্থায় পাগলের মত এদিক সেদিক ঘুরেছেন আরতী রানী। বেহাল দশা নেমে আসে সংসারে। আগে থেকেই তার হাপানীসহ আরো রোগব্যাধি ছিল। স্বামীর শোক এবং সংসারের এ দুরবস্থার কারনে তার অসুস্থতার মাত্রা আরো বেড়ে যায়। অধিকাংশ সময় তিনি এখন শয্যাশায়ী ।  একমাত্র মেয়ে মনিকার বিয়ে হয়েছিল । সে স্বামীর বাড়ি না থেকে এখন বাপের বাড়ি থাকে তার দেখাশুনার জন্য। মনিকা ছাড়া তাদের  অপুর্ব নামে আরেকটি ছেলে আছে ১৬ বছর বয়সের।

আরতী রানী জানান, স্বামী কাঠ মিস্ত্রী বাবদ যে আয় করত তা দিয়েই চলত সংসার। জমিজমা নেই; সামান্য বাস্তুভিটা এবং একটা গরু আছে। স্বামী নিখোঁজ হবার পর অভাব অনটন নেমে আসে সংসারে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতে থাকে। গরুটি তিনি বেঁচতে চেয়েছিলেন। মেয়ে বলেছে বাবার স্মৃতি বেচা ঠিক হবেনা ।  একথা বলার সময় আবার কান্নার সুর ভেসে আসে ফোনে।

ফোনে কথা বলার সময় আরতি রানী প্রথমে কথা বলদে দ্বিধা এবং  জড়তা প্রকাশ করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান কত লোক কত কথা জানতে চায়। কার কাছে কি বললে কোন বিপদ নেমে আসে সে ভয়ে আছেন তারা। তার স্বামী মাওলানা সাঈদীর মামলার স্বাক্ষী হওয়া এবং নিঁেখাজ হবার পর অনেক লোক অনেক কথা বলেছে। অনেকে অনেক কিছু জানতে চেয়েছে তাদের কাছে।  অনেকে ভয়ভীতিও দেখিয়েছে।
আরতী রানী বলেন, তার সাথে এখনো অনেকে কথা বলেনা। এড়িয়ে চলে। কারণ এর ফলে যদি তাদেরও কোন বিপদ হয়। দোকানে কোন কিছূ কিনতে গেলে দোকানদার তাড়াতাড়ি সদায় দিয়ে বিদায় করতে চায়।
আরতী রানী জানান, সুস্থ থাকলে তিনি মানুষের বাড়িতে কিছু কাজ টাজ করেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তিনি এখন অসুস্থ। হাটাচলা করতে পারেননা ঠিকমত। কারণ হিসেবে সঙ্কোচের সাথে জানালেন তার জরায়ু অনেক নিচে নেমে গেছে অনেক দিন থেকে। কোন চিকিৎসা হয়নি। হাপানিরও কোন চিকিৎসা হচ্ছেনা। তুদপরি রয়েছে ঠিকমত খাবার না পাবার সমস্যা। আরতি রানী জানান তার বয়স ৫০ এর উপরে হবে।

কে সুখরঞ্জন বালী : মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে যেসব অভিযোগ আনে তার মধ্যে একটি অভিযোগ হল পিরোজপুরের উমেদপুর গ্রামে বিশাবালী নামে একজনকে  নারকেল গাছের সাথে বেঁধে রাজাকাররা  মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে তারই সামনে গুলি করে হত্যা করে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়। তার মধ্যে একটি হল এই বিশাবালী হত্যার অভিযোগ। আপিল বিভাগের রায়ে বিশবালী হত্যার অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে আজীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। সেই বিশাবালীর আপন ছোটভাই হলেন সুখরঞ্জন বালী। তিনি ছিলেন মাওলানা স্ঈাদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী।  কিন্তু তিনি পক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে আসেন। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে  সাক্ষ্য দিতে আসার দিন ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে তাকে অপহরন করা হয়। 

গোটা বিশ্বে এ নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে ঢাকার দৈনিক নিউএজ পত্রিকায় ডেভিড বার্গম্যানের একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয় সুখরঞ্জন বালী বিষয়ে। তাতে বলা হয় সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দমদম সংশোধন কেন্দ্রে রয়েছেন। সুখরঞ্জন বালীর সাথে তারা যোগাযোগ করলে বালী তাদের জানিয়েছেন ঢাকার আইনশঙ্খলা বাহিনী তাকে অপহরন করে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে।

ভারতে বালী : নিউএজ পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানানো হয় বালীকে ৫ নভেম্বর অপহরনের পর ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভারতে পাঠানো হয় জোর করে। অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের দায়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাকে গ্রেফতার করে উত্তর চব্বিশপরগনার বশিরহাট জেলে রাখে।  এরপর বশিরহাট আদালত ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল   অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বালীকে ১০৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়।  যেহেতু বিচার চলাকালে এই মেয়াদটা  তিনি কারাভোগ করেছেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে  তাকে যেকোনো দিন বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যেতে পারে বলে মত দেন আদালত।

সুখরঞ্জন বালীর ভারতে অবস্থানের বিষয়ে জানার পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের প্রতি অনুরোধ জানায় তাকে যেন বাংলাদেশে ফেরত না পাঠানো হয় কারণ তাতে তার জীবনের আশঙ্কা রয়েছে।

সুখরঞ্জন বালীকে সহায়তার জন্য এ পর্যায়ে বেশ কিছু মানবাধিকার সংস্থা এবং আইনজীবী এগিয়ে আসেন। সুখরঞ্জন বালীর কারাভোগের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আশঙ্কা তৈরি হয়। সেজন্য তিনি ভারতের সুপ্রীম কোর্টের দ্বারস্থ হন তার সাহায্যে এগিয়ে আসা আইনজীবীদের মাধ্যমে।  সুপ্রিম কোর্টে বালী অনুরোধ করেন তাকে যেন দেশে ফেরত পাঠানো না হয়। দেশে ফেরত পাঠালে তার জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে। ২০১৩ সালের ২রা আগস্ট শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট বালীকে দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি দুই সপ্তাহ স্থগিত করে আদেশ দেন।

এরপর কলকাতা হাইকোর্ট  ছয় আগস্ট এক আদেশে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ মেয়াদ শেষ হলে ২০ আগস্টের পর বালীকে দেশে পাঠানোর জন্য।
এ প্রেক্ষিতে বালী ১৩ আগস্ট ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবদন করেন এবং ১৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট  এক আদেশে বলেন তাকে দেশে ফেরত পাঠানো বা ভারতে রাখার বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা। সেই অবধি এখনো ভারতেই সরকারি হেফাজতে আছেন তিনি।

তবে বালীর জন্য অপেক্ষারত তার অসুস্থ স্ত্রী এবং সন্তানেরা চান বালী দেশে ফিরে আসুক এবং আগের মত যেন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন সে নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা হোক।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন