বুধবার, ৫ জুন, ২০১৩

কাদের মোল্লা মামলায় আপিল শুনানী/// ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগম বলেছেন তিনি হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী কিন্তু জল্লাদখানা ডকুমেন্টে লেখা রয়েছে তিনি ঘটনার ২ দিন আগে শশুর বাড়ি চলে যান


মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যে দুটি  অভিযোগে  যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান  করা হয়েছে তার মধ্যে একটি অভিযোগ হল মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী,  তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও    মেয়েদের ধর্ষনের ঘটনা।

এ ঘটনায় বেঁচে যায় হযরতী আলী লস্করের   বড় মেয়ে মোমেনা বেগম। মোমেনা বেগম ট্রাইব্যুনালে এসে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন এ ঘটনা বিষয়ে । ট্রাইবু্যুনালে মোমেনা বেগম বলেছেন ঘটনার সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং ধর্ষনের ঘটনা দেখেছেন। তিনি নিজেও  শারিরীক লাঞ্ছনার শীকার হন এবং এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়েন। একই সাক্ষী মোমেনা বেগম  তাদের  পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং ধর্ষনের ঘটনা সম্পর্কে  ২০০৭ সালে মিরপুর  জল্লাদখানা যাদুঘর (মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর এর অংশ) কর্তৃপক্ষের  কাছে বিবরন দেন। মোমেনা বেগমের  বরাত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষ এ ঘটনা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। সে প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায়  মোমেনা বেগম   ঘটনার দুই  দিন আগে  শশুরবাড়ি চলে যাওয়ায় প্রানে বেঁচে যান।

কোর্টে তিনি বললেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন আর মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত বক্তব্যে দেখা যায় তিনি ঘটনার দুই দিন আগে শশুর বাড়ি চলে যান।

আব্দুল কাদের মোল্লাকে  ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক যাবজ্জীবন কারাদান্ডের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন শুনানীর সময় আজ  ৬ নং অভিযোগ তথা হযরত আলী পরিবারের হত্যাকান্ডের বিষয়ে যুক্তি পেশ করেন আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।    এ ঘটনায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হযরত আলীর মেয়ে মোমেনা বেগমের ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ত জবানবন্দী এবং জল্লাদ খানা যাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্ট পড়ে শোনান তিনি।

প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহণ করেন।

৬ নং অভিযোগ হযরত আলী হত্যাকান্ড : ৬ নং অভিযোগ হযরত আলী হত্যাকান্ড বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগমের  জবানবন্দীর আজ আদালতে পড়ে শোনান ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। ঘটনাটি সংক্ষেপে নিম্নরূপ : ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘটনা ঘটে। মোমেনা বেগমরা তখন মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের  ৫ নং কালাপানি লেনে ২১ নম্বর বাসায় থাকতেন। মোমেনা বেগম কোর্টে সাক্ষ্য দিয়ে  ঘটনা বিষয়ে বলেন, সন্ধ্যার সময় তার পিতা হযরত আলী হন্তদন্ত হয়ে  ঘরে আসলেন এবং  বললেন কাদের মোল্লা তাকে মেরে ফেলবে। কাদের মোল্লা এবং তার বিহারী সাগরেদ আক্তার গুন্ডা তার পিতাকে হত্যার জন্য ধাওয়া করছে। তার পিতা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এরপর তারা বাইরে বোমা ফাটাল। দরজা খোলার জন্য গালিগালাজ করল। তার মা দাও  হাতে নিয়ে দরজা খুলল। তারা ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করল তার মাকে। কাদের মোল্লা তার পিতাকে কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। তার সঙ্গীরা তার বোন খাদিজা এবং তাসলিমাকে জবাই করল। দুই বছরের ভাইকে আছড়িয়ে হত্যা করে।
মোমেনা জানায় সে এবং তার  ১১ বছর বয়স্ক অপর বোন আমেনা খটের নিচে আশ্রয় নেয় ঘটনার সময়। আমেনা ভয়ে চিৎকার দেয়ায় তাকে খটের নিচ থেকে টেনে বের করে জামাকাপড় ছিড়ে ফেলে এবং এক পর্যায়ে তার কান্না থেমে যায়।  এক পর্যায়ে তাকেও টেনে বের করে এবং ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারায় এবং জ্ঞান ফিরে পেটে প্রচন্ড ব্যর্থা অনুভব করে। তার পরনের প্যাণ্ট ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পান তিনি। পরে এক  ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং তাদের সেবার মাধ্যমে কিছুটা সুস্থ হন। পরে তার শশুর খবর পেয়ে তাকে এসে নিয়ে যান।

মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টে যা রয়েছে :
মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত  পাম্প হাউজে  এনে ১৯৭১ সালে বিহারীরা বাঙ্গালীদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাংকি এবং পার্শবর্তী ডোবায়। ১৯৯০ দশকে  এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং  অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্প হাউজটিকে  জল্লাদখানা যাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ যাদু ঘরের অংশ।  জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে যাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবারে অনেক আত্মীয় স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন  সময়ে তাদের সাক্ষাতকার  বক্তব্য রেকর্ড করে তা যাদুঘরে সংরক্ষন করে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
হযরত আলী হত্যাকান্ডসহ আরো অনেক হত্যাকান্ড বিষয়ে  শহীদ পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের  সাক্ষাতকার,  লিখিত বক্তব্যের মূল কপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়া লিখিত  বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে। 

যে হযরত আলী হত্যাঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে সেই ঘটনার একটি বিবরন রক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে। হযরত আলীর বেঁচে যাওয়া একমাত্র মেয়ে মোমেনা বেগমের বরাত দিয়েই সে ঘটনার বর্ননা  লিপিবদ্ধ এবং সংরক্ষন করা হয়েছে।  মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার গ্রহনের মাধ্যমে এ ঘটনার বিবরন তারা সংগ্রহ করে।    মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে রক্ষিত সে ডকুমেন্টে  লেখা আছে ঘটনার দুই দিন আগে মোমেনা বেগম তার শশুর বাড়ি চলে যান।

হযরত আলী হত্যাকান্ড বিষয়ে তার মেয়ে মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার যাদুঘর কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে ২৮/৯/২০৭  তারিখ। তিনি তখন তাদের কাছে ঘটনার যে বিবরন দেন তা নিম্নরূপ।

‘ঘটনার বিবরণ : ১৯৭১ সালে মিরপুরের কালাপানি এলাকায় বিহারিদের সঙ্গে কিছু বাঙালি পরিবারও বাস করতো। ৭ মার্চ এর পর থেকে দেশের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে কিছু কিছু বাঙালি পরিবার এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অনেকের অন্যত্র যাওয়ার অবস্থা ছিল না ফলে এলাকায় রয়ে গেলেন। যে কয়েকটি পরিবার অন্যত্র যেতে পারলেন না তাদের মধ্যে একটি হযরত আলী লস্কর-এর পরিবার।
হযরত আলী লস্কর ছিলেন একজন দর্জি/খলিফা। মিরপুরেই তার দোকান ছিল। সকলে যখন এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন হযরত আলী লস্করকেও তারা চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর যাওয়ার জায়গা ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হয়ে গেলে ২৬ মার্চ সকাল সাতটার দিকে বিহারিরা হযরত আলী লস্কর-এর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই তারা তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা ও শিশু পুত্রকে ধরে নিয়ে যায় এবং সকলকে এক সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করে পাশের বাড়ির কুয়োতে সব লাশ ফেলে যায়। বিহারিরা তার দ্বিতীয় কন্যা আমেনা বেগমকে ঘরের ভতর সারাদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পরে তাকেও হত্যা করে সেই কুয়োতে ফেলে। হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম মাত্র দুইদিন আগে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ায় একমাত্র সেই প্রানে বেঁচে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত আলী স্ত্রী সে সময় অন্তঃসত্বা ছিল।
কয়েকদিন পরই এ খবর হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম জানতে পারেন। কিন্তু মিরপুরের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে তিনি বাড়ি আসতে পারলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ বাড়িতে এসে তিনি আর কিছুই অবশিষ্ট পেলেন না। ভগ্নহৃদয়ে ফিরে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে।”

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মোমেনা বেগম ট্রাইব্যুনালে বলেছেন তিনি ঘটনার তিন বছর পর পর্যন্ত পাগল ছিলেন। তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত। তিনি তার পিতার হত্যার ঘটনা দেখেননি। ঘটনার দিন তার পিতাকে ধরে নিয়ে যেতে দেকেছেন। কিন্তু কারা কিভাবে হত্যা করেছে তা তিনি দেখেননি। তিনি কামাল নামে একজনের কাছে শুনেছেন তার পিতার হত্যার ঘটনা।

আজ  ছয় নং অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপনের পূর্বে   পাঁচ নং অভিযোগ তথা আলুবদি অভিযোগ বিষয়ে অসমাপ্ত বক্তব্য পেশ করেন। এ ঘটনা বিষয়ে ৯ নং সাক্ষী আমির হোসেনর সাক্ষ্য এবং তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যের মধ্যে গরমিল তুলে ধরেন। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সাক্ষী বলেছেন তিনি ১৯৭০ সালে আব্দুল কাদের মোল্লাকে  চিনতেন। ঘটনার দিন আব্দুল কাদের মোল্লাকে তিনি রাইফেল হাতে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় বলেছেন এ কথা সাক্ষী তাকে বলেননি।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সাক্ষী আমির হোসেন মোল্লা বলেছেন তিনি ঘটনার দিন গ্রামের উত্তর পশ্চিম পাশে কচুরিপানার মধ্যে  লুকিয়ে থেকে ঘটনা দেখেছেন। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ঘটনার বিবরন অনুযায়ী পাকিস্তান আর্মি আসে  গ্রামের পশ্চিম দিক থেকে। আব্দুল কাদের মোল্লা আসে পূর্ব দিক থেকে। আর সাক্ষী ছিল গ্রামের উত্তর পশ্চিম পাশে কচুরিপানার মধ্যে। এভাবে কি কারো পক্ষে গ্রামের মধ্যে ঘটনা দেখা যায়?
এছাড়া ষষ্ঠ সাক্ষী শফিউদ্দিন মোল্লা বলেছেন তিনি ঝোপের মধ্যে  চারফিট গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থেকে দেকেছেন  ঘটনা। গ্রামের চারদিকে তখন ধানক্ষেত। সাক্ষীর কথা অনুযায়ী সে  ধানক্ষেত ছিল মানুষের সমান লম্বা। এভাবে গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থেকে ধান ক্ষেতের মাথার ওপর দিয়ে ঘটনা দেখা  এবং মানুষ চেনা কি করে সম্ভব হতে পারে>
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের সাবমিশন হল এ দুজন সাক্ষী বিশ্বাসযোগ্য নয় কোন অবস্থাতেই।
শুনানী শেষে অ্যাডভোটেক শিশির মো : মনির  সাংবাদিকদের জানান সাক্ষী আমির হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে তারা ১১টি মামলার রেকর্ড সংগ্রহ করেছেন। হাইকোর্টের একজন বিচারকের জমিদখলসহ তার বিরুদ্ধে আরো অনেক দখল, লুটপাটের মামলা হয়েছে। ইনকিলাবসহ বিভিন্ন পত্রিকায় তার অপরাধ বিষয়ে লিড নিউজ হয়েছে। সাক্ষী এলাকায় লাটভাই নামে পরিচিত।

যুক্তি উপস্থাপনে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাককে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, শিশির মো : মনির, সাজ্জাদ আলী চৌধুরী প্রমুখ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন