রবিবার, ৩০ জুন, ২০১৩

অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ : কাদের মোল্লা মামলার আপিল শুনানী নতুন মোড় নিয়েছে



মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সাত বিশিষ্ট আইনবিদকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেয়ার মধ্য দিয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা মামলার আপিল শুনানী নতুন  পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।  ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ক্ষেত্রে পূর্বের বিধান ছিল- আসামী পক্ষ সাজার  বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আসামীকে সাজা দেয়া হলে রাষ্ট্রপক্ষ আর  আপিল করতে পারবেনা। ট্রাইব্যুনালের রায়ে যদি আসামীকে  খালাস দেয়া হয় শুধুমাত্র সেক্ষেত্রে সরকার পক্ষ বা অভিযোগকারী আপিল করার সুযোগ পাবে; অন্যথায় নয়। কিন্তু আব্দুল কাদের মোল্লাকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের পর তার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে  ওঠে।  সে প্রেক্ষিতে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইবুনাল আইনের আপিল সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করা হয় সংসদে।  সংশোধিত আইনে বলা হয়- আসামী পক্ষের মত সরকার পক্ষও আপিলের সমান সুযোগ পাবে। অর্থাৎ শুধু খালাসের ক্ষেত্রে নয়, ট্রাইব্যুনালের যেকোন রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষও আপিল করতে  পারবে । আপিল সংক্রান্ত বিধান সংশোধনী বিষয়ে বলা হয়েছে-এ সংশোধনী ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে কার্যকর ছিল বলে ধরে নিতে হবে।
এই যে ২০১৩ সালে আইন করে বলা হল ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর ছিল বলে ধরে নিতে হবে একেই বলে রিট্রোসপেক্টিবভ ইফেক্ট বা ভূতাপেক্ষতা।

আইনের আপিল সংক্রন্তা ধারা সংশোধনের পর সরকার পক্ষ আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করে। এছাড়া  কাদের মোল্লাকে যে একটি অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনাল খালাস দিয়েছে সেটিতেও সাজা দাবি করা হয়েছে সরকার পক্ষের আবেদনে।

আপিল শুনানীতে  রাষ্ট্রপক্ষ আদালতের কাছ থেকে অনেক আইনগত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে ।  এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হল- গত ১৮ ফেব্রুয়ারি যে আইন সংশোধন করা হয়েছে  তা আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় প্রযোজ্য কি-না।  এছাড়া অপর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপিত হয়েছে তাহল- আদালত  এটর্নি জেনারেল এর কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন- উপমহাদেশ বা ইংল্যান্ডের এমন কোন নিজর আছে কি-না যেখানে  রায় হবার পর এভাবে  আইন সংশোধন করে রিট্রোসপেকটিভ ইফেক্ট কার্যকর করা হয়েছে।

১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধনী করে সরকার পক্ষকে আপিলের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু এ সংশোধনী আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য কি-না এ প্রশ্নের জবাব   পাবার জন্য আদালত আইনটি পাশের সময় সংসদ প্রসিডিংস   হাজির করতে বলেন রাষ্ট্রপক্ষকে। কিন্তু সংসদীয় প্রসিডিংস পর্যালোচনা করে দেখা যায় সংশোধনী আইনটি আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য   না-কি চলমান অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সে বিষয়ে আইনে যেমন কোন কিছু নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি তেমনি সংসদ প্রসিডিংসেও কিছু  উল্লেখ নেই।

মজার বিষয় হল আব্দুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল আইনের আপিলের ধারা সংশোধন করা হয়েছে  কিন্তু আইনের সংশোধনিটি আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে  কি-না সে বিষয়ে কোথাও কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। আপিলের ধারা সংশোধনীতে বিরাট একটা ফাঁক বা দুর্বলতা রয়ে গেছে। এ বিষয়টি বেরিয়ে আসে আপিল শুনানীর সময়।

আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায়  আপিল  আবেদন শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি পেশ করছেন। শুনানীর সময়  আদালত তাকে প্রশ্ন করেন- আপনারা যে আইনের বলে আপিল আবেদন করেছেন তা আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি-না? কোন বিধান বলে আপনারা এই মামলার ক্ষেত্রে এ দরখাস্ত করেছেন।

তখন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জবাব দেন-এই যে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইনের আপিলের ধারা সংশোধন করা হয়েছে এবং সরকার পক্ষকে আপিলের সুযোগ দিয়েছে। এ সংশোধনী বলে আমরা আপিল করেছি। আর সংশোধনী আইনে বলা  আছে আছে- ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে এ সংশোধনী কার্যকর বলে ধরে নেয়া হবে।

এসময় আদালত জানতে চান  ১৮ ফেব্রুয়ারি সংশোধনী আইন পাশ  যে আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা  কোথায়  উল্লেখ আছে দেখান। এসময় আদালত আইনটি সংশোধনের  উদ্দেশ্য পড়ে শোনাতে বলেন এটর্নি জেনারেলকে। আইন পাশের উদ্দেশ্য পড়ে শোনানো হলে তাতে দেখা যায় আইনে যেমন এ বিষয়ে কোন কিছু বলা হয়নি তেমনি সংশোধনী আইন পাশের বিষয়েও আব্দুল কাদের মোল্লার মামলা বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ নেই। তখন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন বলেন, সংশোধনী পাশের সময় এর উদ্দেশ্য নিয়ে  সংসদে কি আলোচনা হয়েছিল তা আছে আপনার কাছে? সংসদে এর উদ্দেশ্য নিয়ে কোন আলোচনা হয়েছিল না শুধু হাত তুলে হ্যা জয়যুক্ত হয়েছে বলে পাশ হয়েছিল? এটর্নি জেনারেল এসময় সংশোধনী আইন পাশের সময়কার সংসদীয় প্রসিডিংস উপস্থাপন করেন আদালতে।
কিন্তু তা পর্যালোচনা করে দেখা যায় তাতেও সংশোধনীটি পাশের ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন কিছু উল্লেখ নেই। আব্দুল কাদের মোল্লার রায় বের হবার পর সেক্ষেত্রে  সংশোধনী প্রযোজ্য হবে কি-না সে বিষয়ে কেউ কোন আলোচনাও পেশ করেননি সংসদে। তখন এমপিদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন।

এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিলটি পাশের ক্ষেত্রে সংসদের যে প্রসিডিংস উত্থাপন করেন আদালতে। তাতে  দেখা যায় মো : ফজলে রাব্বি মিয়া সংশোধনী প্রস্তাব বিল আকারে সংসদে উত্থোপন করেন। হুইপ আব্দুল ওয়াহাব  এর ওপর আলোচনা করেন। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সংশোধনী গ্রহনের জন্য স্পিকারের মাধ্যমে অনুরোধ জানান। এরপর কণ্ঠভোটে হ্যা জয়যুক্ত হয়েছে মর্মে বিলটি পাশ হয়। এছাড়া রাশেদ খান মেনন সংশোধনীতে ‘অর্গানাইজেশন’ শব্দটি যোগ করার জন্য প্রস্তাব করেন এবং এ বিষয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন। তা এটর্নি জেনারেল পড়ে শোনান আদালতে। তাতে দেখা যায় রাশেদ খান মেনন জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন। তিনি বলেন,  ১৯৭১ সালে  জামায়াতে ইসলামী সিদ্ধান্ত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে।  আল বদর, আল শাসস, রাজাকার গঠন করে। আজো তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে চলেছে। তাই সংগঠন হিসেবে তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তিনি সংশোধনীতে ‘অর্গানাইজেশন’ শব্দ যোগ করার প্রস্তাব করেন। তার বক্তব্য পাঠ শেষ হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, এসবতো বেখাপ্পা কথাবার্তা। অস্পষ্ট। এর মধ্যেতো সংশোধনী পাশের উদ্দেশ্য বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ নেই। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়াও  একই ধরননের মন্তব্য করেন এসময়।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধ আইনটি পাশের ক্ষেত্রে সংসদে আইনের উদ্দেশ্য নিয়ে কত সুন্দর  আলোচনা এবং বিতর্ক হয়। অনেক এমপি আইনের ক্ষেত্রে তাদের মতামত তুলে ধরেছিলেন। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরসহ অন্যরা  আইনটি বিষয়ে সংসদে কথা বলেছিলেন।
এসময় অপর বিচারপতি সুরেন্ত্র কুমার সিনহা  আফসোস করে বলেন, সেই সংসদ আর আজকের সংসদ; কোথায় এসে দাড়িয়েছে।
আদালতের নির্দেশে আইনটি পাশের  উদ্দেশ্য সম্পর্কে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ  এর বক্তব্য পড়ে শোনান এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সেখানে উল্লেখ আছে যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যানশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যক্ট প্রণয়ন করা হয়। .....উক্ত অ্যাক্টের অধীনে ট্রাইব্যুনাল গঠনক্রমে যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধেল সাথে জড়িতদের বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্য পড়ে শোনানোর পর বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া বলেন, এখানে ‘বিচার কার্যক্রম চলামান রয়েছে’ বলে একটি কথা আছে। এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মারাত্মক। তিনি বলেন, মিস্টার এটর্নি জেনারেল, এ থেকে যেটি স্পষ্ট তাহল ১৮ ফেব্রুয়ারির সংশোধনী ট্রাইব্যুনালের যেসব বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।  এ মামলার ক্ষেত্রে নয়।

১৮ ফেব্রুয়ারি সংশোধনী আব্দুল কাদের মোল্লা  মালার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি-না সে বিষয়ে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শেষমেষ তার  জবাবে বলেন- সংশোধনীটি আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।   ট্রাইব্যুনাল রায় প্রদানের পর  এ বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের সমান সুযোগ দিয়ে আইনের আপিল সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে এ সংশোধনী কার্যকর হবে। আপনাদের ধরে নিতে হবে এই সংশোধনী ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর আছে। কাদের মোল্লার রায় হবার আগে থেকেই অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে  রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সমান সুযোগ ছিল বলে ধরে নিতে হবে। সেখানে কবে রায় হল এবং কবে  আইন সংশোধন হল এটা অপ্রাসঙ্গিক  বিষয়। কারণ সংশোধনীতে বলা হয়েছে এ সংশোধনী ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর।

কিন্তু আদালত এটর্নি জেনারেল এর উদ্দেশে  বলেন, আপনার আবেদন গ্রহণ করা হলে আমাদেরকে আইন রিরাইট করতে হবে। আইন রিসেটেল এবং রিস্টাবলিশ করতে হবে।
আদালত আরো বলেন, মনে রাখবেন আমরা আজ  এ মামলায় এখান থেকে যে ব্যাখ্যা দেব তা আইন হয়ে যাবে।  ভবিষ্যতে এর অনেক প্রভাব আছে। সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তাই যা বলার সাবধানে বলবেন। আপনি রাষ্ট্রের এটর্নি জেনারেল। একই সাথে আপনি রাষ্ট্রের একজন নাগরিক। এ বিষয় মাথায় রেখে সাবমিশন রাখবেন।

আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এর আগে তার সাবমিশনের বলেছিলেন,  ট্রাইব্যুনালের সাজার বিরুদ্ধে পূর্বে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ ছিলনা। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধনের পর  রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সুযোগ পেয়েছে এবং তারা মৃত্যুদন্ডের দাবি করে আবেদন করেছে। ১৮ ফ্রেবুয়ারি যদি আইনটি সংশোধন না হত তাহলে কাদের মোল্লার ফাঁসির কোন সুযোগ ছিলনা। আপিল বিভাগকে হয় ট্রাইব্যুনালের সাজা যাবজ্জীবন বহাল রাখতে হত না হয় কমাতে হত। কিন্তু যাবজ্জীবন বাড়িয়ে ফাঁসি দিতে পারতনা। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধনের ফলে আসামীর অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায়কে কেন্দ্র করে আপিলের ধারা সংশোধন এবং এ নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্নের সুরাহাসহ অন্যান্য আইনগত বিষয়ে মতামত গ্রহনের জন্য অবশেষে গত ২০ জুন আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় সাতজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে  অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিলেন সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ। 
সরকার পক্ষ আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় আপিল আবেদন করে আরো একটি বিব্রতকর অবস্থার  মুখোমুখি হয়েছে।  বিশেষ করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল সে অভিযোগে শাস্তি দাবি করে আপিলের ক্ষেত্রে। আসামী পক্ষ যুক্তি পেশ করে বলেছে-খালাস দেয়া অভিযোগে শাস্তির দাবি চাইলে রাষ্ট্রপক্ষকে প্রমান করতে হবে ট্রাইব্যুনালের রায় সঠিক ছিলনা। ট্রাইব্যুনালের রায় ন্যায় এবং নীতিভ্রষ্ট । এখন এর জবাবে রাষ্ট্রপক্ষ কি বলবে? তারা কি বলবে ট্রাইব্যুনাল এ ক্ষেত্রে সঠিক রায় দেয়নি? তাহলে তো আর কিছুই রইলনা। কিন্তু তারা এর কোন জবাব দিতে পারছেনা। হ্যা বা না কিছুই বলার কোন উপায় নেই তাদের।

আরো বিষয় আছে। সেটা হল ট্রাইব্যুনালের আইনে বলা হয়েছে- আসামীকে সাজা দিলে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবেনা। খালাস দিলে করতে পারবে।  এখন খালাস মানে কি সব অভিযোগ থেকে  বেকসুর খালাস না দুয়েকটি অভিযোগ থেকে খালাস এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় রায়ের পরে।  একপক্ষের আইনজ্ঞদের মতে আসামীকে সব অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দিলেই কেবল রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবে। কিন্তু কোন একটি অভিযোগেও যদি ন্যুনতম কোন সাজা দেয় ট্রাইব্যুনাল তাহলে আর  রাষ্ট্রপক্ষ কোন আপিল করতে পারবেনা। কারণ কোন না কোন অভিযোগে আসামীকে সাজা দেয়া হয়েছে। আরেক পক্ষের আইনজ্ঞদের মতে একটি অভিযোগে যদি দণ্ড দেয় এবং একটি অভিযোগে যদি খালাস দেয় তাহলে খালাস দেয়া অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবে। ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে ৫টি অভিযোগে দণ্ড দেয় এবং একটি অভিযোগে খালাস দেয়। একপক্ষের আইনজ্ঞরা মত দেন সরকার এ খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেনা এবং আরেক পক্ষের আইনজ্ঞরা বলেন সরকার এ খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। খালাস দেয়া অভিযোগের ক্ষেত্রে সরকার আপিল করতে পারবে কি পারবেনা এ নিয়ে রায়ের পরপর প্রশ্ন দেখা দিলে দুই পক্ষের আইনজ্ঞদের কাছ থেকে  দুধরনের মতামত আসে। যহোক শেষ পর্যন্ত  সরকার খালাস দেয়া অভিযোগেও শাস্তি দাবি করে আপিল করেছে। আপিল বিভাগের শুনানীতে এ বিষয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে কোর্টের পক্ষ থেকে। এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে ভারতের কয়েকটি রেফারেন্স পেশ করেছেন। এ বিষয়ে শুনানীর সময় বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া বলেছেন, সাজার কোন সিঙ্গুলার পুলুরাল হয়না। সাজা মানে সাজা।
গত ২০ জন আদালতের কার্যক্রম শেষে ১৫ দিনের ছুটিতে চলে যায় হাইকোর্ট। আগামী ৭ জুলাই কোর্ট খোলার পর আবার আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায় আপিল শুনানী শুরু হবে। ৮ জুলাই থেকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীদের শুনানী পেশ করার কথা রয়েছে। আব্দুল কাদের মোল্লার মামলা আপিল শুনানী শেষ পর্যায়ে ছিল। ২০ জুন কোর্ট ছুটিতে যাবার আগেই আশা করা হয়েছিল উভয় পক্ষের শুনানী শেষ হয়ে যাবে এবং চূড়ান্ত রায়ের তারিখ নির্ধারন করা   হতে পারে। কিন্তু ছুটির আগে শেষ কর্মদিবসে সাত অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগের মাধ্যমে মামলাটির শুনানী নতুন পর্যায় লাভ করেছে।

ট্রাইব্যুনালের আইনের ধারা সংশোধন করে ২ মাসের মধ্যে আপিল আবেদন নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়।  ৪ মার্চ আসামী পক্ষ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায় রায়ের বিরুদ্ধে আসামী পক্ষ আপিল করে।  দুই মাস সময় পার হয়ে গেছে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে।  সম্প্রতি আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন দুই মাসের সময়সীমা মেনে চলতে আপিল বিভাগ বাধ্য নয়। সব মিলিয়ে বলা যায়  যুদ্ধাপরাধ মামলার আপিল শুনানী নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।
অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ : কাদের মোল্লা মামলার আপিল শুনানী নতুন মোড় নিয়েছে

মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সাত বিশিষ্ট আইনবিদকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেয়ার মধ্য দিয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা মামলার আপিল শুনানী নতুন  পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।  ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ক্ষেত্রে পূর্বের বিধান ছিল- আসামী পক্ষ সাজার  বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আসামীকে সাজা দেয়া হলে রাষ্ট্রপক্ষ আর  আপিল করতে পারবেনা। ট্রাইব্যুনালের রায়ে যদি আসামীকে  খালাস দেয়া হয় শুধুমাত্র সেক্ষেত্রে সরকার পক্ষ বা অভিযোগকারী আপিল করার সুযোগ পাবে; অন্যথায় নয়। কিন্তু আব্দুল কাদের মোল্লাকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের পর তার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে  ওঠে।  সে প্রেক্ষিতে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইবুনাল আইনের আপিল সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করা হয় সংসদে।  সংশোধিত আইনে বলা হয়- আসামী পক্ষের মত সরকার পক্ষও আপিলের সমান সুযোগ পাবে। অর্থাৎ শুধু খালাসের ক্ষেত্রে নয়, ট্রাইব্যুনালের যেকোন রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষও আপিল করতে  পারবে । আপিল সংক্রান্ত বিধান সংশোধনী বিষয়ে বলা হয়েছে-এ সংশোধনী ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে কার্যকর ছিল বলে ধরে নিতে হবে।
এই যে ২০১৩ সালে আইন করে বলা হল ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর ছিল বলে ধরে নিতে হবে একেই বলে রিট্রোসপেক্টিবভ ইফেক্ট বা ভূতাপেক্ষতা।

আইনের আপিল সংক্রন্তা ধারা সংশোধনের পর সরকার পক্ষ আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করে। এছাড়া  কাদের মোল্লাকে যে একটি অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনাল খালাস দিয়েছে সেটিতেও সাজা দাবি করা হয়েছে সরকার পক্ষের আবেদনে।

আপিল শুনানীতে  রাষ্ট্রপক্ষ আদালতের কাছ থেকে অনেক আইনগত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে ।  এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হল- গত ১৮ ফেব্রুয়ারি যে আইন সংশোধন করা হয়েছে  তা আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় প্রযোজ্য কি-না।  এছাড়া অপর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপিত হয়েছে তাহল- আদালত  এটর্নি জেনারেল এর কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন- উপমহাদেশ বা ইংল্যান্ডের এমন কোন নিজর আছে কি-না যেখানে  রায় হবার পর এভাবে  আইন সংশোধন করে রিট্রোসপেকটিভ ইফেক্ট কার্যকর করা হয়েছে।

১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধনী করে সরকার পক্ষকে আপিলের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু এ সংশোধনী আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য কি-না এ প্রশ্নের জবাব   পাবার জন্য আদালত আইনটি পাশের সময় সংসদ প্রসিডিংস   হাজির করতে বলেন রাষ্ট্রপক্ষকে। কিন্তু সংসদীয় প্রসিডিংস পর্যালোচনা করে দেখা যায় সংশোধনী আইনটি আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য   না-কি চলমান অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সে বিষয়ে আইনে যেমন কোন কিছু নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি তেমনি সংসদ প্রসিডিংসেও কিছু  উল্লেখ নেই।

মজার বিষয় হল আব্দুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল আইনের আপিলের ধারা সংশোধন করা হয়েছে  কিন্তু আইনের সংশোধনিটি আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে  কি-না সে বিষয়ে কোথাও কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। আপিলের ধারা সংশোধনীতে বিরাট একটা ফাঁক বা দুর্বলতা রয়ে গেছে। এ বিষয়টি বেরিয়ে আসে আপিল শুনানীর সময়।

আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায়  আপিল  আবেদন শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি পেশ করছেন। শুনানীর সময়  আদালত তাকে প্রশ্ন করেন- আপনারা যে আইনের বলে আপিল আবেদন করেছেন তা আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি-না? কোন বিধান বলে আপনারা এই মামলার ক্ষেত্রে এ দরখাস্ত করেছেন।

তখন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জবাব দেন-এই যে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইনের আপিলের ধারা সংশোধন করা হয়েছে এবং সরকার পক্ষকে আপিলের সুযোগ দিয়েছে। এ সংশোধনী বলে আমরা আপিল করেছি। আর সংশোধনী আইনে বলা  আছে আছে- ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে এ সংশোধনী কার্যকর বলে ধরে নেয়া হবে।

এসময় আদালত জানতে চান  ১৮ ফেব্রুয়ারি সংশোধনী আইন পাশ  যে আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা  কোথায়  উল্লেখ আছে দেখান। এসময় আদালত আইনটি সংশোধনের  উদ্দেশ্য পড়ে শোনাতে বলেন এটর্নি জেনারেলকে। আইন পাশের উদ্দেশ্য পড়ে শোনানো হলে তাতে দেখা যায় আইনে যেমন এ বিষয়ে কোন কিছু বলা হয়নি তেমনি সংশোধনী আইন পাশের বিষয়েও আব্দুল কাদের মোল্লার মামলা বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ নেই। তখন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন বলেন, সংশোধনী পাশের সময় এর উদ্দেশ্য নিয়ে  সংসদে কি আলোচনা হয়েছিল তা আছে আপনার কাছে? সংসদে এর উদ্দেশ্য নিয়ে কোন আলোচনা হয়েছিল না শুধু হাত তুলে হ্যা জয়যুক্ত হয়েছে বলে পাশ হয়েছিল? এটর্নি জেনারেল এসময় সংশোধনী আইন পাশের সময়কার সংসদীয় প্রসিডিংস উপস্থাপন করেন আদালতে।
কিন্তু তা পর্যালোচনা করে দেখা যায় তাতেও সংশোধনীটি পাশের ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন কিছু উল্লেখ নেই। আব্দুল কাদের মোল্লার রায় বের হবার পর সেক্ষেত্রে  সংশোধনী প্রযোজ্য হবে কি-না সে বিষয়ে কেউ কোন আলোচনাও পেশ করেননি সংসদে। তখন এমপিদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন।

এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিলটি পাশের ক্ষেত্রে সংসদের যে প্রসিডিংস উত্থাপন করেন আদালতে। তাতে  দেখা যায় মো : ফজলে রাব্বি মিয়া সংশোধনী প্রস্তাব বিল আকারে সংসদে উত্থোপন করেন। হুইপ আব্দুল ওয়াহাব  এর ওপর আলোচনা করেন। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সংশোধনী গ্রহনের জন্য স্পিকারের মাধ্যমে অনুরোধ জানান। এরপর কণ্ঠভোটে হ্যা জয়যুক্ত হয়েছে মর্মে বিলটি পাশ হয়। এছাড়া রাশেদ খান মেনন সংশোধনীতে ‘অর্গানাইজেশন’ শব্দটি যোগ করার জন্য প্রস্তাব করেন এবং এ বিষয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন। তা এটর্নি জেনারেল পড়ে শোনান আদালতে। তাতে দেখা যায় রাশেদ খান মেনন জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন। তিনি বলেন,  ১৯৭১ সালে  জামায়াতে ইসলামী সিদ্ধান্ত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে।  আল বদর, আল শাসস, রাজাকার গঠন করে। আজো তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে চলেছে। তাই সংগঠন হিসেবে তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তিনি সংশোধনীতে ‘অর্গানাইজেশন’ শব্দ যোগ করার প্রস্তাব করেন। তার বক্তব্য পাঠ শেষ হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, এসবতো বেখাপ্পা কথাবার্তা। অস্পষ্ট। এর মধ্যেতো সংশোধনী পাশের উদ্দেশ্য বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ নেই। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়াও  একই ধরননের মন্তব্য করেন এসময়।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধ আইনটি পাশের ক্ষেত্রে সংসদে আইনের উদ্দেশ্য নিয়ে কত সুন্দর  আলোচনা এবং বিতর্ক হয়। অনেক এমপি আইনের ক্ষেত্রে তাদের মতামত তুলে ধরেছিলেন। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরসহ অন্যরা  আইনটি বিষয়ে সংসদে কথা বলেছিলেন।
এসময় অপর বিচারপতি সুরেন্ত্র কুমার সিনহা  আফসোস করে বলেন, সেই সংসদ আর আজকের সংসদ; কোথায় এসে দাড়িয়েছে।
আদালতের নির্দেশে আইনটি পাশের  উদ্দেশ্য সম্পর্কে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ  এর বক্তব্য পড়ে শোনান এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সেখানে উল্লেখ আছে যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যানশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যক্ট প্রণয়ন করা হয়। .....উক্ত অ্যাক্টের অধীনে ট্রাইব্যুনাল গঠনক্রমে যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধেল সাথে জড়িতদের বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্য পড়ে শোনানোর পর বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া বলেন, এখানে ‘বিচার কার্যক্রম চলামান রয়েছে’ বলে একটি কথা আছে। এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মারাত্মক। তিনি বলেন, মিস্টার এটর্নি জেনারেল, এ থেকে যেটি স্পষ্ট তাহল ১৮ ফেব্রুয়ারির সংশোধনী ট্রাইব্যুনালের যেসব বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।  এ মামলার ক্ষেত্রে নয়।

১৮ ফেব্রুয়ারি সংশোধনী আব্দুল কাদের মোল্লা  মালার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি-না সে বিষয়ে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শেষমেষ তার  জবাবে বলেন- সংশোধনীটি আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।   ট্রাইব্যুনাল রায় প্রদানের পর  এ বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের সমান সুযোগ দিয়ে আইনের আপিল সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে এ সংশোধনী কার্যকর হবে। আপনাদের ধরে নিতে হবে এই সংশোধনী ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর আছে। কাদের মোল্লার রায় হবার আগে থেকেই অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে  রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সমান সুযোগ ছিল বলে ধরে নিতে হবে। সেখানে কবে রায় হল এবং কবে  আইন সংশোধন হল এটা অপ্রাসঙ্গিক  বিষয়। কারণ সংশোধনীতে বলা হয়েছে এ সংশোধনী ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর।

কিন্তু আদালত এটর্নি জেনারেল এর উদ্দেশে  বলেন, আপনার আবেদন গ্রহণ করা হলে আমাদেরকে আইন রিরাইট করতে হবে। আইন রিসেটেল এবং রিস্টাবলিশ করতে হবে।
আদালত আরো বলেন, মনে রাখবেন আমরা আজ  এ মামলায় এখান থেকে যে ব্যাখ্যা দেব তা আইন হয়ে যাবে।  ভবিষ্যতে এর অনেক প্রভাব আছে। সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তাই যা বলার সাবধানে বলবেন। আপনি রাষ্ট্রের এটর্নি জেনারেল। একই সাথে আপনি রাষ্ট্রের একজন নাগরিক। এ বিষয় মাথায় রেখে সাবমিশন রাখবেন।

আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এর আগে তার সাবমিশনের বলেছিলেন,  ট্রাইব্যুনালের সাজার বিরুদ্ধে পূর্বে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ ছিলনা। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধনের পর  রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সুযোগ পেয়েছে এবং তারা মৃত্যুদন্ডের দাবি করে আবেদন করেছে। ১৮ ফ্রেবুয়ারি যদি আইনটি সংশোধন না হত তাহলে কাদের মোল্লার ফাঁসির কোন সুযোগ ছিলনা। আপিল বিভাগকে হয় ট্রাইব্যুনালের সাজা যাবজ্জীবন বহাল রাখতে হত না হয় কমাতে হত। কিন্তু যাবজ্জীবন বাড়িয়ে ফাঁসি দিতে পারতনা। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধনের ফলে আসামীর অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায়কে কেন্দ্র করে আপিলের ধারা সংশোধন এবং এ নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্নের সুরাহাসহ অন্যান্য আইনগত বিষয়ে মতামত গ্রহনের জন্য অবশেষে গত ২০ জুন আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় সাতজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে  অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিলেন সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ। 
সরকার পক্ষ আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় আপিল আবেদন করে আরো একটি বিব্রতকর অবস্থার  মুখোমুখি হয়েছে।  বিশেষ করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল সে অভিযোগে শাস্তি দাবি করে আপিলের ক্ষেত্রে। আসামী পক্ষ যুক্তি পেশ করে বলেছে-খালাস দেয়া অভিযোগে শাস্তির দাবি চাইলে রাষ্ট্রপক্ষকে প্রমান করতে হবে ট্রাইব্যুনালের রায় সঠিক ছিলনা। ট্রাইব্যুনালের রায় ন্যায় এবং নীতিভ্রষ্ট । এখন এর জবাবে রাষ্ট্রপক্ষ কি বলবে? তারা কি বলবে ট্রাইব্যুনাল এ ক্ষেত্রে সঠিক রায় দেয়নি? তাহলে তো আর কিছুই রইলনা। কিন্তু তারা এর কোন জবাব দিতে পারছেনা। হ্যা বা না কিছুই বলার কোন উপায় নেই তাদের।

আরো বিষয় আছে। সেটা হল ট্রাইব্যুনালের আইনে বলা হয়েছে- আসামীকে সাজা দিলে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবেনা। খালাস দিলে করতে পারবে।  এখন খালাস মানে কি সব অভিযোগ থেকে  বেকসুর খালাস না দুয়েকটি অভিযোগ থেকে খালাস এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় রায়ের পরে।  একপক্ষের আইনজ্ঞদের মতে আসামীকে সব অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দিলেই কেবল রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবে। কিন্তু কোন একটি অভিযোগেও যদি ন্যুনতম কোন সাজা দেয় ট্রাইব্যুনাল তাহলে আর  রাষ্ট্রপক্ষ কোন আপিল করতে পারবেনা। কারণ কোন না কোন অভিযোগে আসামীকে সাজা দেয়া হয়েছে। আরেক পক্ষের আইনজ্ঞদের মতে একটি অভিযোগে যদি দণ্ড দেয় এবং একটি অভিযোগে যদি খালাস দেয় তাহলে খালাস দেয়া অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবে। ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে ৫টি অভিযোগে দণ্ড দেয় এবং একটি অভিযোগে খালাস দেয়। একপক্ষের আইনজ্ঞরা মত দেন সরকার এ খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেনা এবং আরেক পক্ষের আইনজ্ঞরা বলেন সরকার এ খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। খালাস দেয়া অভিযোগের ক্ষেত্রে সরকার আপিল করতে পারবে কি পারবেনা এ নিয়ে রায়ের পরপর প্রশ্ন দেখা দিলে দুই পক্ষের আইনজ্ঞদের কাছ থেকে  দুধরনের মতামত আসে। যহোক শেষ পর্যন্ত  সরকার খালাস দেয়া অভিযোগেও শাস্তি দাবি করে আপিল করেছে। আপিল বিভাগের শুনানীতে এ বিষয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে কোর্টের পক্ষ থেকে। এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে ভারতের কয়েকটি রেফারেন্স পেশ করেছেন। এ বিষয়ে শুনানীর সময় বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া বলেছেন, সাজার কোন সিঙ্গুলার পুলুরাল হয়না। সাজা মানে সাজা।
গত ২০ জন আদালতের কার্যক্রম শেষে ১৫ দিনের ছুটিতে চলে যায় হাইকোর্ট। আগামী ৭ জুলাই কোর্ট খোলার পর আবার আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায় আপিল শুনানী শুরু হবে। ৮ জুলাই থেকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীদের শুনানী পেশ করার কথা রয়েছে। আব্দুল কাদের মোল্লার মামলা আপিল শুনানী শেষ পর্যায়ে ছিল। ২০ জুন কোর্ট ছুটিতে যাবার আগেই আশা করা হয়েছিল উভয় পক্ষের শুনানী শেষ হয়ে যাবে এবং চূড়ান্ত রায়ের তারিখ নির্ধারন করা   হতে পারে। কিন্তু ছুটির আগে শেষ কর্মদিবসে সাত অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগের মাধ্যমে মামলাটির শুনানী নতুন পর্যায় লাভ করেছে।

ট্রাইব্যুনালের আইনের ধারা সংশোধন করে ২ মাসের মধ্যে আপিল আবেদন নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়।  ৪ মার্চ আসামী পক্ষ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায় রায়ের বিরুদ্ধে আসামী পক্ষ আপিল করে।  দুই মাস সময় পার হয়ে গেছে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে।  সম্প্রতি আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন দুই মাসের সময়সীমা মেনে চলতে আপিল বিভাগ বাধ্য নয়। সব মিলিয়ে বলা যায়  যুদ্ধাপরাধ মামলার আপিল শুনানী নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন