বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সাঈদীর আপিল আবেদন// ৬ নং অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন শেষ রাষ্ট্রপক্ষের

মেহেদী হাসান, ২৭/২/২০১৪
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম  ছয় নং অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেছেন।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ছয় নং অভিযোগ হল পাড়েরহাট বাজারে হিন্দুদের দোকানপাট ও বসতবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব প্রদান।
প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহণ করেন।
গতকাল বুধবারের  ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আজ মাহবুবে আলম যুক্তি পেশ শুরু করেন।
তিনি বলেন, আসামী পক্ষ অভিযোগ করেছে রাষ্ট্রপক্ষের নবম সাক্ষী ছয় নং অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু তারপরও ছয়  নং অভিযোগ প্রমানের ক্ষেত্রে তাকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। তাদের এ অভিযোগ ঠিক নয়। নবম  নং সাক্ষী ছয়  নং অভিযোগ বিষয়ে তার জবানবন্দীতে বলেছেন। আমি আপনাদের পড়ে শোনাচ্ছি তার জবানবন্দী থেকে।
নবম সাক্ষী আলতাফ হোসেন ছয় নং অভিযোগ বিষয়ে  বলেছেন, ‘মে মাসের  সাত তারিখ পাক আর্মি পারেরহাট বাজারে আসে। পাক আর্মি আসার  ছয়/সাত দিন আগে  সেকেন্দার শিকদার, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মোসলেম মাওলানা, দানেশ আলী মোল্লার নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠন হয়। তারপর রেজাকার বাহিনী গঠন হয় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নেতত্বে। শান্তি কমিটির লোকজনই রেজাকার বাহিনী গঠন করে।

এ বাহিনী গঠনের পর পারেরহাট বন্দরে ৩০/৩৫টি  দোকান ঘর  এবং ববাসা বাড়ি লুটপাট করে । পারেরহাট এবং তার আশপাশে যা কিছুই ঘটে যেমন অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষন সবই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।’
অ্যঅটর্নি জেনারেল জেরা থেকে পড়ে শুনিয়ে বলেন, এ সাক্ষী জেরায়ও ছয়  নং অভিযোগ বিষয়ে বলেছেন।

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাওলানা সাঈদীর পক্ষের কয়েকজন সাক্ষীদের বক্তব্য বিষয়ে যুক্তি পেশ করেন। তিনি বলেন, আসামী পক্ষের এক নং সাক্ষী শামসুল আলম তালুকদার জেরায় বলেছেন,  ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাওলানা ভাসানী যখন পার্টির প্রধান ছিলেন তখন মশিউর রহমান  যাদু মিয়া পার্টির সেক্রেটারি  ছিলেন। মশিউর রহমান যাদু মিয়া মুক্তিযুদ্ধের পরে কারাগারে আটক ছিলেন জানি তবে কি করনে তা জানা নেই। আমি ভাসানী ন্যাপের পরে  জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট হয়ে বিএনপিতে  যোগদান করি ১৯৭৯ সালে ।  বিএনপিতে  যোগ দেয়ার পর বাগেরহাট জেলা সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হই।’

জেরা থেকে এ পর্যন্ত পড়ে শুনিয়ে অ্যটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এ সাক্ষী বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জোটবদ্ধ রাজনীতি করছে।

জেরায় তাকে সাজেশন দিয়ে আমরা বলেছি ‘বিএনপি জামায়াতের জোট থাকায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকান্ড জানা থাকা সত্ত্বেও আপনি তা গোপন করেছেন ইচ্ছাকৃতভাবে।’ সাক্ষী বলেছেন সত্য নয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এরপর সাক্ষী শামসুল আলম তালুকদার জবানবন্দী থেকে পড়ে শোনান আদালতকে । শামসুল আলম তালুকদার তার জবানবন্দীতে বলেছেন, ‘এই অবস্থায় আমরা ৮ই ডিসেম্বর মেজর জিয়াউদ্দিনসহ পিরোজপুরের পাড়েরহাটে যাই। মেজর জিয়াউদ্দিন ১০/১৫ মিনিট ছিলেন। আমাকে উনি সমস্ত অবস্থা জেনে ২/৩ ঘন্টা পরে পিরোজপুরে আসতে বলেছিলেন। সেখানে আমাদের কমান্ডার খসরু, মোকাররম, লিয়াকত আলী বাদশা, বাতেন, মুনাম, সানু খোন্দকার সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও অনেক জনসাধারন তাদের অবস্থা বর্ণনা করে। আমি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শন করি। মোসলেম মওলানা, দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, রাজ্জাক, দুইজন চৌকিদারসহ আরও কয়েকজন কে কি অত্যাচার করেছে তার বর্ণনা করে। ঐ সময়ে দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সম্পর্কে আমাকে কেউ কিছু বলে নাই। ঐ দিন আমরা রাত্রে পিরোজপুরে অবস্থান করি। পরবর্তীতে আমরা সমস্ত অস্ত্র সারেন্ডার করি।
দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সাহেবের ছেলে মাসুদ সাঈদী আমাকে তার পিতার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়ার অনুরোধ করে বলেছেন যে,  যা সত্য আমি যেন তাই বলি ট্রাইব্যুনালে গিয়ে। তাই এখানে এসে সাক্ষ্য দিলাম।  আমি সাক্ষ্য দিতে এসে একটিও মিথ্যা কথা বলিনি। যদি সাঈদী সাহেব কোন অন্যায় কাজ করতেন তাহলে আমি কমান্ডার, লোকজন তখন আমার নিকট তা বলতো।’

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মেজর জিয়াউদ্দিনের লেখা বই থেকে  ৮ ডিসেম্বর তার পাড়েরহাট গমন সংক্রান্ত অংশ পড়ে শোনান।  অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মেজর জিয়াউদ্দিনের এ লেখার সাথে সাক্ষী শামসুল আলম তালূকদারের দাবির মিল নেই।
তিনি বলেন, মেজর জিয়াউদ্দিনের এ বইটি আসামী পক্ষই ডকুমেন্ট হিসেবে জমা দিয়েছে আদালতে। তারা দেখাতে চেয়েছে মেজর জিয়াউদ্দিনের লেখায় কোথাও সাঈদী সাহেবের নাম নেই।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আসামী পক্ষের সাক্ষী নরুল হক হাওলাদার জেরায় বলেছেন, তিনি কখনো পাড়েরহাট রাজাকার ক্যাম্প বা শন্তি কমিটির অফিসে যাননি। কাজেই কারা শান্তি কমিটি রাজাকার কমিটির সদস্য তা তার চেনার কথা নয়। সুতরাং মাওলানা সাঈদী রাজাকার বা শান্তি কমিটিতে ছিলনা মর্মে তার যে দাবি তাও সঠিক হতে পারেনা।

মাওলানা সাঈদীর ছেলে  মাসুদ সাঈদী তার পিতার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে বলেছেন,  তার পিতার পেশা লেখক। তিনি ৭২টি বই লিখেছেন। তিনি বলেছেন লেখালেখি ছাড়া তার পিতার আর কোন পেশা নেই এবং অতীতেও ছিলনা। কিন্তু আসামী পক্ষের ১৪ নং সাক্ষী এমরান হোসেন বলেছেন মাওলানা সাঈদী ১৯৬৯-৭০ সালে যশোরে থাকতেন এবং সেখানে তিনি ধর্মসভা করতেন।

এ সময় একজন বিচারপতি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ১৫ নং সাক্ষী ছয় নং অভিযোগ বিষয়ে বলেছেন। কিন্তু সেটা ট্রাইব্যুনাল বিবেবচনা করেনি। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল ১৫ নং সাক্ষীর জবানবন্দী থেকে ছয়  নং অভিযোগ বিষয়ে পড়ে শোনান যেখানে সাক্ষী বলেছেন, ৭ই মে তারিখে পাক সেনারা পাড়েরহাটে আসে। তাদের সহযোগিতায় পাড়েরহাটের কিছু সংখ্যক লোক দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, মোসলেম মাওলানা, গণি গাজি, আসমত আলী মুন্সি, মালেক শিকদার পাড়েরহাটের ৫/৬টি হিন্দুর দোকান লুট করে। লুটপাটের পরে পাক সেনারা আবার পিরোজপুরের দিকে রওনা করে যায়। যাদের দোকান লুট করে তারা হলেন মাখন সাহা, নারায়ন সাহা, মদন সাহা, বিজয় মাস্টার, গৌরাঙ্গ পাল প্রমুখ। লুটপাটের পরের দিন আবার পাক সেনারা পাড়েরহাটে আসে।’
অ্যটার্নি জেনারেল বলেন, হ্যা এ সাক্ষী ছয়  নং অভিযোগ বিষয়ে বলেছেন এবং অনেক দোকান মালিকের নামও বলেছেন। তার সাক্ষ্য বিবেবচনায় নেয়া উচিত ছিল ট্রাইব্যুনালের। কেন নিলনা বুঝতে পারলামনা।
তখন একজন বিচারপতি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরাও দানেশ মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দোর শিকদার এদের নাম বলেছেন এবং আসামী পক্ষের সাক্ষীও এদের নাম বলেছেন। পার্থক্য হল আসামী পক্ষের সাক্ষী শুধুমাত্র মাওলানা সাঈদীর  নাম বলেননি। আর সব ঠিক আছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হ্যা, তারাও ঘটনা স্বীকার করেছে। ঘটনা ঘটেছে এটা সত্য। তাদের দাবি সেখানে আসামী সাঈদী ছিলেননা।

এ পর্যন্ত শুনানী শেষে আগামী রোববার পর্যন্ত শুনানী মুলতবি করা হয়।







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন