সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে চতুর্থ সাক্ষীর জবানবন্দী

১৭/২/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান (এমসি) মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে। আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ চতুর্থ সাক্ষী সুনীল কান্তি বর্ধন ওরফে দুলালের জবানবন্দী গ্রহনের পর তাকে জেরা শুরু করেন মীর কাসেম আলীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মূলতবি করা হয়েছে।

সাক্ষ্যগ্রহণের সময় মীর কাসেম আলী ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় বসে সাক্ষ্যগ্রহণ দেখেন। তার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম, অ্যাডভোকেট আসাদউদ্দিন ও অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও সুলতান মাহমুদ সিমন।

জবানবন্দী (সংক্ষিপ্ত): আমার নাম সুনীল কান্তি বর্ধন ওরফে দুলাল। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে চট্টগ্রাম শহরের অবস্থা আরো খারাপ হলে একদিন আমি আমার স্ত্রী বাচ্চা ও কাজের লোকসহ চাকতাই থেকে বাড়ী যাওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকাতে উঠছিলাম। তখন সশস্ত্র আল-বদররা আমাকে দেখে বলে এই যে মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া গেছে। এ সময় তারা আমাকে গালিগালাজ করে চোখ বেঁধে রিকসায় তুলে। আল-বদররা চামরা গুদাম এলাকায় দোস্ত পাঞ্জাবি বিল্ডিংয়ের আল-বদর ক্যাম্পে নিয়ে আমাকে প্রচুর মারধোর করে। এরপর আমাদেরকে যথারীতি আটক রাখা হয় এবং বিভিন্নভাবে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর আমি লক্ষ্য করলাম দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিংয়ের বাল্ড খুলে ফেলা হচ্ছিল। কামরুল নামে এক আল-বদর আমাকে মাঝে মধ্যে খাবার পানি ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করতো। কখনও সে চোখের বাঁধনও খুলে দিত। সে আমাকে ঐ দিন অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বর জানায় তোকে তো বাঁচাতে পারলাম না আজকে অথবা আগামী কাল তোদেরকে ডালিম হোটেেেল নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে মীর কাশেম আলী আছে সে তোদেরকে বাচতে দিবে না। দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিংয়ে রাত্রি যাপনের পর আনুমানিক ভোর ৫টার দিকে আমাদেরকে নিচে নামানো হয় এবং সেখানে বন্দীদেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি ট্রাকে ওঠানো হয এবং এই ট্রাকে করে আমাদেরকে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসা হয়। ডালিম হোটেলে আসার পর ট্রাক থেকে লাথি মেরে মেরে নামানো হয়। সেখানে আমাকে অন্য বন্দীদের সঙ্গে একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে মরী কাসেম আলী ছিলেন। তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করেন তোমরা কে কি জান বল। আমরা যখন কোন তথ্যই দিচ্ছিলাম না তখন মীর কাসেম  আলী বলেন তোদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। এমতাবস্থায় আমিসহ মোট ৬ জনকে ডালিম হোটেলের একটি কক্ষে বন্দী করা হয় সেখানে আগে থেকেই আরো কয়েকজন বন্দী ছিলেন। বাইরে থেকে কক্ষটি তালা মেরে আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে তারা তাদের যার যার কর্মস্থলে চলে যায়।

১৪ ডিসেম্বর রাত্রে আমরা আর কারো সাড়া শব্দ পাইনি। আমরা নিজেরা নিজেদের চোখের বাঁধন খুলে ফেলে ঘুমানোর চেষ্টা করি। ১৫ ডিসেম্বর সকাল থেকে আর কারো কোন সাড়া শব্দ পাইনি। বেলা ২ ঘটিকার সময় আমরা আমাদের কক্ষের একটি জানালা খুলি কিন্তু কারো কোন সাড়া না পেয়ে জানালা বন্ধ করে দিলাম। ১৬ ডিসেম্বর ভোরবেলা স্থানীয় লোকজন ও আমার প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধবরা আমাদের কক্ষের দরজা কুড়াল দিয়ে ভেঙ্গে আমাদের মুক্ত করে নিয়ে যায়। আমরা মুক্ত হয়ে আসার পর টুনটু সেন এবং রনজিত দাসের স্ত্রলা  আমাকে বলে যে, আপনারা তো মুক্ত হয়ে আসলেন তারা কোথায়? তখন আমি বলি আল-বদররা তাদেরকে মেরে ফেলেছে। তখন আমি তাদের কাছ থেকে আরো জানতে পারি মীর কাসেম আলীর নির্দেশে আল-বদররা চোখ বেঁধে টুনটু সেন ও রনজিত দাসকে  ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তারা আর ফিরে আসেনি।

জেরা:
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের হাজারী লেনের অজিত কুমার বনিক নামে কাউকে চিনতেন?
উত্তর: না, এখনও চিনিনা। তবে হাজারী লেনের অজিত দাসকে আমি চিনতাম।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের এক সপ্তাহের মধ্যে পাক সেনারা লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে।
উত্তর:  এক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তান আর্মির অত্যাচার শুরু হয়নি। তবে আমরা গ্রামে চলে যাওয়ার সপ্তাহ বা দশ দিন পর হয়েছে।
প্রশ্ন: পাকিস্তান আর্মির লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ শুরু করার পর ওই এলাকায় কোন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক থাকত না।
উত্তর: সত্য নয়।
প্রশ্ন: বাবুল কান্তি নাথ নামে হাজারী লেনের কাউকে চিনতেন?
উত্তর: না। হাজারী লেনে ১৯৭১ সালে ১৪ বা ১৫টি পরিবার বসবাস করত। আর ভাড়াটিয়া ছিল শ’ খানেকের বেশি। বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজার লোক বসবাস করে।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালের মার্চের পর আপনারা গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর আর কখনো হাজারী লেনের বাসায় এসেছেন?
উত্তর: দু’এক বার গিয়েছি।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে আপনাদের বাসা থেকে ডালিম হোটেল দেখা যেত, মাঝখানে কোন বাড়ীঘর ছিল না। 
উত্তর: সত্য।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে ডালিম হোটেলের মালিক কে ছিল?
উত্তর: একজন নাথ বাবু। তার পুরো নাম বলতে পারব না। ছেলে মেয়ে কয়জন তাও বলতে পারব না।
প্রশ্ন: আপনাকে যখন দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং থেকে ডালিম হোটেলে আনা হয় তখন আপনার সঙ্গে হাজারী লেনের কেউ ছিল কি ?
উত্তর: না।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালের কত আগে থেকে অপনারা হাজারী লেনের বাড়িতে বসবাস করেন?
উত্তর: ১৯৫২ সাল থেকে।
প্রশ্ন: যে দোকানী ১৯৭১ সালে বন্দী অবস্থায় আপনাদের বিড়ি সিগারেট ও মুড়ি দিয়েছিল সেই দোকানীর নাম বলতে পারবেন?
উত্তর: সেই দোকানীর নাম আমি বলতে পারব না।
প্রশ্ন: আপনি কি আপনার কর্মস্থলে ডালিম হোটেলের পাশ দিয়ে যেতেন?
উত্তর: না।
প্রশ্ন:১৯৭১ সালের ডালিম হোটেলের কোন কর্মচারীর নাম বলতে পারবেন?
উত্তর: না, বলতে পারব না।
প্রশ্ন: ডালিম হোটেলের পাশে টিএন্ডাট কোলোনি ছিল এবং সেখানে পাকিস্তান আর্মি অবস্থান করত। 
উত্তর: হ্যাঁ।
প্রশ্ন: হাজারী লেনের জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে চিনতেন?
উত্তর: চিনতাম, তিনি বর্তমানে মৃত।
প্রশ্ন: জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বাড়ী পাকিস্তান আর্মি বা অন্য কেউ কি পুড়িয়ে ছিল?
উত্তর: না, পাকিস্তান আর্মি বা অন্যকেউ পোড়ায়নি।
প্রশ্ন: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর স্ত্রী পারভিন চৌধুরীকে চেনেন?
উত্তর: চিনিনা। জাহাঙ্গীর চৌধুরী বিয়ে করেছেন এক বড়–য়া মেয়েকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন