শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

আহম্মেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

বৃহষ্পতিবার ৪ অক্টোবর ২০১২
আমার নাম আহম্মেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আমার বয়স ৫৭ বৎসর।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমার বয়স ছিল ১৫ বৎসরের একটু বেশি। আমি ¯œাতক পাশ। ১৯৭১ সালে আমি ঢাকার আজিমপুরস্থ ওয়েস্টটেন্ড হাইস্কুলে দশন শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। আমি একজন সুরকার, গীতিকার এবং সংগীত পরিচালক। ছোটকালে আমি দুরন্ত এবং নির্ভিক ছিলাম। আপনারা যারা ১৯৭১ সালের ২৫ শে এবং ২৬ শে মার্চ অবলোকন করেছেন এবং শিকার হয়েছেন তারাই শুধু অনুধাবন করতে পারবেন আমার বিষয়টি। আমার মানে পড়ে ২৭ শে মার্চ তারিখে কারফিউ শিথিল করা হয়েছিল কয়েক ঘন্টার জন্য। যখনি কারফিউ শিথিল করা হয়েছে তখন আমি আমার বাই সাইকেল নিয়ে প্রথম ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পরে পলাশী ফায়ার সার্ভিস স্টেশন তার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ এবং রোকেয়া হল এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের চতুর্দিক আমি ঘুরে দেখেছি এবং লাশের পর লাশ দেখেছি যা কিনা আপনারা ছবির মাধ্যমে দেখেছেন। তার পর আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেব। আমি ২৭ মার্চের বিকেল বেলা একজন বিহারীর বাসায় জোর পূর্বক ঢুকে তাদের বন্দুক ছিনতাই করি এবং একটি ক্ষুদ্র দল গঠন করি এবং তাদেরকে শেখাই আমাদের আরও অস্ত্রের প্রয়োজন। এর মধ্যে একজন বন্ধু যার নাম সজিব তাদের প্রধান করে আমরা বেশ কয়েকটি বিহারীর বাসা থেকে অস্ত্র ছিনতাই করি এবং জিঞ্জিরায় প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি প্রতিষ্ঠা করি। আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন জিঞ্জিরায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমন করেছিল সেটি আমাদেরই কারণে। আমরা সেই আক্রমনের মুখে টিকে থাকতে পারি নাই। আমরা সেই জায়গা পরিবর্তন করে জিঞ্জিরা অঞ্চলের কেট্টা নামক স্থানে চলে যাই। সেখান থেকে আমরা সমস্ত অস্ত্র বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিয়ে ঢাকায় চলে আসি। সেখান থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, আমাদের অনেক ভারি অস্ত্রের প্রয়োজন আছে। তা না হলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা যাবে না। এরপর আমরা পালিয়ে বেরিয়েছি বেশ বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকদিন। যখন বাসায় ফিরলাম তখন মায়ের নিকট জানতে পারলাম আমার ভাই ইফতেখার আহমেদ টুলটুল (বর্তমানে মৃত) মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে এবং সে ২৭ মার্চের রাতেই চলে গিয়েছিল। সেই থেকে আমার মনে একটা স্বপ্ন ছিল, আমার ভাই যখন ফিরে আসবে তার কাছে থেকে অস্ত্র শিক্ষা শিখে নেব এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করব। ভাইয়ের সাথে আমার মে মাসে দেখা হয়। তাকে আমি বিনীত অনুরোধ করলাম তার সঙ্গে আমাকে রাখার জন্য। আমার ভাই ক্রাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন। তাদের কমান্ডার হলেন মোফাজ্জেল হোসেন মায়া। আমার বড় ভাইয়ের সাথে আমি একটি অফিসে যোগ দিই। শুধু আমি ও আমার বড় ভাই। আমরা চেয়েছিলাম আজিমপুর গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকার অফিস উড়িয়ে দিব। সেই মোতাবেক আমি নিজেই ঐ অফিসে ডিনামাইট বসাই। কিন্তু সেই ডিনামাইট আমি চার্জ করতে পারি নাই, কারন কয়েকজন ছাত্রী এসে গিয়েছিল।পরবর্তীতে আমি ভাইয়ের কাছে অনুরোধ করি আমাকে কিছু গ্রেনেড দেওয়ার জন্য। আমার ভাই আমাকে মাহবুবকে এবং সরোয়ারকে একসাথে করে তিনটি গ্রেনেড দেয়। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সেই তিনটি গ্রেনেডের মধ্যে দুটি আমি এবং সরোয়ার (বর্তমান মৃত) নিউ মার্কেটের ১ নম্বর গেটের সামনে মাত্র বিশ ফিট দূরে থেকে পাকিস্তানের তিনটি লরির উপর আক্রমন চালাই। এই আক্রমনের হতাহতের খবর আমি জানি না। তারপর আমাদের পলাতক জীবন। আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি, মানিক মাহবুব এবং খোকা ভারতে চলে যাই এবং আগরগলা হয়ে মেলাঘরে ট্রেনিং নিয়ে আমরা ঢাকায় ফিরে আসি এবং সজিব বাহিনীতে যোগ দিই। লালবাগ এলাকায় কাজ করতে থাকি। আমাদের প্লাটুনকে ওয়াই (ইয়াং) প্লাটুন বলা হত। এরপর অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখে আবারো ভারতে যাবার সময় আমি, মানিক, মাহবুব এবং খোকা পাকিস্তান আর্মি এবং রাজাকারদের হাতে বন্দি হয়ে যাই কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মনবাড়িয়ার মাঝামাঝি তন্তর চেকপোষ্টে। তারা ঘন্টা খানেক জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে যখন আমরা বার বার বলেছিলাম যে, আমরা মুক্তিযোদ্ধা নই, তখন তারা আমাদের পাশবিক নির্যাতন শুরু করে এবং একটানা আড়াই থেকে তিন ঘন্টা নির্যাতনের পরে আমাদের চারজনকে উলঙ্গ করে ফেলে শুধুমাত্র আমাদের পরনে জাঙ্গিয়া ছিল। একজন সুবেদার মেজর আমাদেরকে গুলির হুকুম দেয়। সে মোতাবেক পাশের মসজিদ থেকে একজন ইমাম সাহেবকে নিয়ে আসা হয়। তারপর আমাদের গরম পানি দিয়ে গোসল করানো হয় এবং সুরা পড়ানো হয়। তারপর চোখে কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। তবে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আমাদের সামনে তিনজন মিলিটারি মেশিনগান ঐ জাতীয় কিছু তাক করেছিল। সেই মুহুর্তেও আমি বিচলিত হই নাই। আমি মৃত্যুর প্রহর গুনছিলাম। হটাৎ করে অনেক নিস্তবদ্ধতার ভিতর একটি ওয়ারলেসের শব্দ শুনতে পেলাম যাহা বেজে উঠেছিলাম।শুনতে পাই মুক্তিকো হেড কোয়ার্টার মে লে আও। তারপর আমাদেরকে গুলি না করে উলঙ্গ অবস্থায় প্রায় ৫ ঘন্টা বাসের ভিতরে নীচে বসিয়ে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসা হয় আমাকে সহ বাকি তিন জনকে। সেখানে নিয়ে আমাদেরকে ভিন্ন করে ফেলা হয়। আমাকে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সেখানে আমি একজন ক্যাপ্টেনকে চেয়ারে বসা দেখি। তার নাম ছিল ক্যাপ্টেন আলী রেজা। তার মাথায় চুল ছিল না এবং সামনে দাঁত ছিল না। প্রথমে সে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। আমাকে নাম জিজ্ঞাসা করায় আমি বললাম মাই নেম ইজ আহম্মেদ ইমতিয়াজ। আমি লিখা পড়া করি কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে আমি স্বীকার করি। তখন তিনি আমায় জিজ্ঞেস করেন শিক্ষিত ছেলে হয়ে তুমি কিভাবে ভাবলে যে, এতবড়  পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তোমরা জিততে পারবে। জবাবে আমি বলি স্যার আপনারা এখন কোন র‌্যাংকিয়ে নাই, আমরা আপনাদের যে র‌্যাংকিং দিব তাই হবে আপনার র‌্যাংকিং। তখন তিনি একটি গালি দেয়। সে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে কাল দেখে নেবে বলে হুমকি দেয়।
চারজনকে একত্র করে বাহ্মনবাড়িয়া জেলখানায় পাঠানো হয়। জেলখানায় ঢুকে আমি আমাদের মত ছাত্র ধরনের অসংখ্য বন্দি দেখতে পাই। ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে পরিচিত হই। তাদের মধ্যে যাদের সঙ্গে বেশি পরিচিত হই তারা হলেন নজরুল (শহীদ), আমার বয়সী এক ছেলে কামাল (শহীদ), তার বাবা সিরু মিয়া (শহীদ) এবং কুমিল্লার বাতেন ভাই, সফিউদ্দিন এবং আরও অনেকে। প্রদর্শনী- ৪৯৬ সিরিজে সিরু মিয়া, কামাল  এবং নজরুলের ছবি সহ অন্যদের ছবি আছে। সেই জেলখানায় তখন সম্ভবত আমরা ৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধা বন্দি ছিলাম। নজরুল, সিরু মিয়া এবং কামাল তন্তর চেকপোষ্টে আমাদের থেকে দুদিন আগে ধরা পড়েছিল মর্মে শুনেছিলাম। পরের দিন আমাকে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার পিস কমিটির অফিসে যাহা দানা মিয়ার বাড়ি নামে পরিচিত হাজির করা হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। সেখানে গিয়ে আমি যাকে প্রথম দেখি তিনি হলেন কুখ্যাত পেয়ারা মিয়া। তার অশ্রাব্য এবং নির্যাতনের কথা আমি সারা জীবন মনে রাখবো। ঐ পিস কমিটি অফিসে তিনি আমাকে অনকেক্ষন নির্যাতন করার পরেও যখন আমি কিছু বলি নাই তখন তিনি একঘন্টা পরে আবার আমাকে পাঠান আর্মিসেল অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। সেখানে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে লেঃ ইফতেখার। সেখানে আমার প্রতি একই ধরনের অত্যচার করা হয়। এভাবে আমাদের একজনকে দুবার, প্রথমবার পিস কমিটির পেয়ারা মিয়া কর্তৃক দানা মিয়ার বাড়িতে এবং দ্বিতীয়বারআর্মি সেল অফিসে মিলিটারি কর্তৃক নির্যাতন করা হতো, আমাদের শরীরে রক্ত শুকাতে পারতো না। আমাকে আরেকটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, সেটা হলো আর্মিদের সামনে দোভাষী হিসেবে কাজ করার জন্য এবং সেটাও আমাকে করতে হয়েছে। শহীদ নজরুল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। তাকে আমি একদিন বলেছিলাম এখান থেকে পালিয়ে যাও। সে আমাকে মার ধর করেছিল এবং বলেছিল মুক্তিযোদ্ধারা পালাতে শেখেনি। ফুলের মালা গলায় দিয়ে একদিন এখন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের মুক্ত করে নিয়ে যাবে। নজরুলের পিছনে আমরা নামাজ পড়তাম। তিনি ইফতারি বণ্টন করে দিতেন। তিনিই ছিলেন আমাদের নেতা। রোজার ঈদের দিন সন্ধ্যায় একটু পরে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার জেলের দরজা খুব শব্দ করে খুলে যায়। এবং আমরা সকলে চমকে উঠি। জেলের ভিতরে পাক হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে এবং উচ্চ স্বরে চিৎকার করে বলে লাইন আপ, লাইন আপ। এই শব্দটির সংঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম। ঐ কথা শুনেই আমরা জেলের গারদ থেকে বের হই। আমরা কংক্রিটের মেঝেতে লাইন দিয়ে বসে পড়ি। সেখানে ক্যাপ্টেন আলী রেজা এবং লে: ইফতেখারকে দেখতে পাই। এর একটু পরে দেখতে পাই ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহকে। এরপর অনেক রাজাকার সহ পেয়ারা মিয়াকেও দেখতে পাই। ক্যাপ্টেন আলী রেজা আঙুল তুলে এক একজনকে দাড় করাতে থাকে। এভাবে প্রায় ৪৩ জনকে আলাদা করা হয় আমাকে একা রেখে তখন আমি মনে করেছিলাম আমাকে বুঝি হত্যা করা হবে। আমি সাহস করে ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহকে প্রশ্ন করলাম, আপনারা কি আমাকে মারবেন নাকি ওদেরকে মারবেন? তখন ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ আমার হাতটা তার হাতে নিয়ে বলল আজকের দিনটা কত পবিত্র তা তুমি জান। আমি বললাম আমি তা জানি। তিনি বললেন ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই, আজ এই দিনে যদি কোন মানুষকে হত্যা করা হয় সে সরাসরি আল্লাহ পাকের কাছে চলে যায়। তখন আমি জিজ্ঞেস করি তবে কি এই ৪৩ জনকে আপনারা হত্যা করবেন? উনি হাসিমুখে বললেন সেটাই করব। তখন আমি আরেকটা প্রশ্ন করলাম, আমার সংগে তো মানিক, মাহবুব ও খোকন ছিল তবে তাদেরকে আমার সংগে রাখেন আপনারা তো আমাকে হত্যা করবেন। তখন উনি বললেন হ্যা তোমাকেও হত্যা করবো তবে দুই দিন পরে কারণ দুই দিন পরে তুমি ধরা পড়েছো। তখন আমি বলি তারাও তো দুইদিন পর আমার সাথে ধরা পড়েছে। তখন ঐ তিনজনকে ভিন্ন করে আমার সংগে রাখা হয়। এরপর আমি নজরুল ভাইয়ের সংগে কথা বলি এবং জিজ্ঞেস করি ভাই আপনিতো আমাকে পালিয়ে যেতে দিলেন না, তখন নজরুল ভাই আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে আমার কিছু বলার নাই রে, আমার এই লুঙ্গিটা আমার মায়ের কাছে পৌছে দিস, আর ছোট্ট সিগারেটের টুকরোটি দেখিয়ে সেটাও দিতে বললো কামালের বাবা সিরু মিয়া অঝোরে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন তোর মার তো আর কেউ থাকলো নারে। তখন কামাল তার বাবাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বলে বুলবুল তুই যদি কোন দিন রাস্তার কোন পাগলি দেখিস তাহলে  মনে করবি এটাই আমার মা। নজরুল বলেছিল যখন কোন পাক আর্মি দেখবি একটি করে মাথায় গুলি করবি। কুমিল্লার বাতেন ভাই তার গায়ের চাদরটি আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। সেই চাদর দিয়ে আমি তৎক্ষণাৎ প্রত্যেকের চোখের পানি মুছে দিয়েছিলাম। এরপর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আমাদের কে গারদে আটক করা হয়। তার পরদিন আমি জানতে পারি ষ্টেশনের পশ্চিমে পৌরতলা নামক স্থানে তাদেরকে এক নাগারে হত্যা করা হয়েছে। আমার জানা মতে তাদের একজনকে জেল গেট থেকে ছেড়ে দিয়েছিল। এর দুই দিন পর আমাদের চারজনকে পুনরায় দানা মিয়ার টর্চার সেলে অর্থাৎ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের টর্চার করা হয় এবং সেই রাত্রে আমরা সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হই। পালিয়ে আমরা আমার বন্ধু মাহবুবের বোনের বাড়িতে উঠি। সেখানে আমাদেরকে দুধ দিয়ে গোসল করানো হয়। তার পরদিন আমরা লুঙ্গি গেঞ্জি পরে নৌকা যোগে ঢাকায় রওনা হই এবং আমি আজিমপুর এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করি। মায়ের সংগে দেখা করে ঐ বাড়িতে থাকি এবং মাঝ রাত্রে আর্মিরা এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায় এবং তেজগাঁও এম,পি হোষ্টেলে নিয়ে যায়। সেখানে সাতদিন রেখে টর্চার করা হয়। ফলে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। হুশ হওয়ার পর দেখি আমি রমনা থানায়। টর্চারের ফলে আমার পিটে, পায়ের পেছনে কোন চামড়া ছিলনা। রমনা থানায় ৮৪ জন বন্দীকে দেখতে পাই। তাদের মধ্যে পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন পোল ভল্টার মিরাজউদ্দিনকে দেখতে পাই। মিরাজ ভাই আমাকে অর্ধেক সুস্থ করে তোলেন। মিরাজ ভাইকে দিয়ে পাকিস্তান বাহিনী একটি ইন্টারভিউ করেছিলেন। সেই ইন্টারভিউতে মিরাজ ভাই বলেছিলেন ভারত বাহিনী কর্তৃক জোর পূর্বক মুক্তি বাহিনী গঠন করা হয়েছে। আসলে মুক্তিবাহিনী বলতে কিছুই নাই। এই বক্তব্যটি প্রচারিত হয়েছিল। পাক বাহিনী মিরাজ ভাইকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, তাকে মুক্ত করে দিবে। হত্যা করিবে না। পরবর্তীতে রায়ের বাজারে নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করে চিরতরে মুক্তি দিয়েছে। রমনা থানায় যে ৮৪ জন ছিল এর মধ্যে প্রতিদিন ৭ জন করে নিয়ে হত্যা করা হতো। ওদের একটা গাড়ি এসে ৭ জন করে নিয়ে যেত । ৮৪ জন থেকে আমরা যখন ১৪ জনে আসলাম তখন যৌথ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। সেই আক্রমনের পর থেকে সেই গাড়ি আর আসে নাই। এই দেশে স্বাধীনতা উদযাপন করে ১৬ ই ডিসেম্বর আর আমি মুক্ত হয়েছি ১৭ ডিসেম্বর। পরবর্তীকালে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের অনেক আত্মীয় স্বজনরা আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। ২০০৮ সালে যখন আমি এই ঘটনা সমূহ টেলিভিশনে এক প্রোগ্রামে বলি তখন ঐ প্রোগ্রাম দেখে সিরু মিয়া এবং কামালের মা আমার সংগে যোগাযোগ করেন। তার নাম আমি জেনেছি। তার নাম আনোয়ারা বেগম। বিশদ আলোচনা না হলেও আমি এই ঘটনার কথা কিছু তাকে বলেছি। যেভাবে একজন মায়ের কাছে তার শহীদ ছেলের কথা এবং স্ত্রীর কাছে শহীদ স্বামীর কথা বলা যায়। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সংগে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমার জবানবন্দী নিয়েছেন।

জেরা
০৪-১০-২০১২ ইং ২.০০ মি. পুনরায় জেরা ঃ
ঢাকায় মিত্র বাহিনীর বিমান হামলা ৪ ঠা ডিসেম্বর হয়েছিল কিনা তা আমি নিশ্চিত নই। আমি মুক্ত হওয়ার পাঁচ/ছয় দিন পূর্বে বিমান হামলা হয়েছিল। আমি ব্রাহ্মনবাড়িয়া থেকে পালিয়ে নভেম্বরের ২৫/২৬ তারিখে ঢাকায় এসেছিলাম কিনা তা স্মরণ করতে পারছি না। আমি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কোন ইউনিটের সদস্য নই। তবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আমার নাম আছে।
২০০৮ সালে যখন আমি এই ঘটনা সমূহ টেলিভিশনে এক প্রোগ্রামে বলি তখন ঐ প্রোগ্রাম দেখে সিরু মিয়া এবং কামালের মা আমার সংগে যোগাযোগ করেন। তার নাম আমি জেনেছি। তার নাম আনোয়ারা বেগম। বিশদ আলোচনা না হলেও আমি এই ঘটনার কথা কিছু তাকে বলেছি। যেভাবে একজন মায়ের কাছে তার শহীদ ছেলের কথা এবং স্ত্রীর কাছে শহীদ স্বামীর কথা বলা যায়। এই কথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য। আমি অসত্য জবানবন্দী প্রদান করলাম, ইহা সত্য নহে। (সমাপ্ত)



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন