শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সফিউদ্দিন আহমেদ,

বুধবার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২
আমার নাম সফিউদ্দিন আহমেদ, আমার বয়স-৫৮ বৎসর।
আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার হোমনা থানাধীন রামনগর গ্রামে। আমি ১৯৬৯ সালে আমাদের গ্রামের রামকৃষ্ণপুর কে,কে,আর,কে উচ্চ বিদ্যালয় হতে এস,এস,সি, পাশ করি। ১৯৭০ সালে আমি তদানিন্তন পাকিস্তানের করাচিতে সরকারি বাংলা মহাবিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হই। ১৯৭১ সালের জুন মাসে আমি পি,আই,এ, বিমান যোগে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আসিয়া আমার গ্রামের বাড়িতে যাই। আমার পার্শ্ববর্তী গ্রাম রামকৃষ্ণপুর শহীদ সিরু মিয়া দারোগার বাড়িতে অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ছিল। আমি সেখানে যোগাযোগ করি। ওখানে আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সকল কাজ শুরু করি। আমার কাজ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঐ ক্যাম্প থেকে মুজিব নগর সরকারের প্রধান মন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদের স্ত্রী জোহরা তাজুদ্দিনকে আমরা ভারতে পাঠিয়ে দিই। এর কিছুদিন পরে সাবেক রাষ্ট্রপতি জনাব বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে তার পরিবার পরিজন সহ একই ভাবে ভারতে পাঠিয়ে দিই। ঐ ক্যাম্প থেকে সিরু মিয়া দারোগার সংগে আমি সহ মোট ২৫জন ২৫শে অক্টোবর রাতে ভারতের উদ্দেশ্যে নৌকা যোগে রওনা করি। অন্যরা ছিলেন জনাব সিরু মিয়ার সন্তান শহীদ আনোয়ার কামাল, দাউদকান্দি থানার মুজিব বাহিনীর কমান্ডার শহীদ নজরুল ইসলাম, শহীদ আবুল কাশেম, জাহাঙ্গীর সেলিম। আমরা প্রথমে সিমান্তবর্তী এলাকায় ছত্রা গ্রামে পৌঁছি এবং সেখানে ২৬শে অক্টোবর অবস্থান করি। ২৭শে অক্টোবর আমরা সিমান্তের দিকে রওনা করি। আমাদের সাথে ছিলেন আমাদের গাইডম্যান তালেব। সে এসে আমাদেরকে খবর দেয় রাস্তা কিয়ার। তখন আমরা সেই রাস্তা দিয়ে রওনা করি। রওনা করার আগে সিরু মিয়া দারোগা তার স্ত্রীর কাছে একটি চিঠি লিখে চিঠিটি তালেবকে দেয় তার স্ত্রীর নিকট পৌঁছাবার জন্য। রাস্তার উপর উঠার সংগে সংগে রাজাকারদের চেক পোষ্ট তন্তরে পৌঁছালে হঠাৎ ২০/২৫ জন রাজাকার আমাদের ৬জনকে ঘিরিয়া ফেলে এবং আমাদের দুইজন দুইজন করে বেঁধে ফেলে। সিরু মিয়াকে তার ছেলে আনোয়ার কামালের সংগে, নজরুলকে জাহাঙ্গীর সেলিমের সংগে এবং আমাকে আবুল কাশেমের সংগে বাঁধে। ৫/১০ মিনিট পরে কুমিল্লার দিক থেকে একটি পাকিস্তান আর্মির জীপ আসে এবং সেই জীপ থেকে ৫/৬ জন আর্মি নামে। নজরুল এবং সিরু মিয়া দারোগার কাছে দুটি রিভলবার ছিল। তারা রিভরবার দুটি নিয়ে নেয়। এরপরে আমাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গামী একটি চাউলের ট্রাকে তোলা হয় এবং সংগে ৫/৭ জন রাজাকারকে আমাদেরকে পাহারা দেওয়ার জন্য দেয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রথম প্রান্তে আমাদেরকে ট্রাক হতে নামায়ে নেয় এবং তৎপর পায়ে হাটিয়ে  আমাদেরকে কোর্ট বিল্ডিংয়ে নিয়ে যায়। সেখানে আমদেরকে মাঠে রাখা হয়, অনেক লোকজন আমাদেরকে দেখতে আসে। এরমধ্যে সাদা পাঞ্জাবী পরা হাতে বেত সহ এক ব্যক্তি আসেন এবং তিনি আমদেরকে গালাগালি করেন। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি সেই লোকটির নাম পেয়ারা মিয়া। পেয়ারা মিয়ার সংগে ৫/৭ জন যুবক বয়সের ছেলে ছিল। তারা আমাদের হাতের ঘড়ি ও আংটি ছিনিয়ে নেয়। এরপরে আমাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা স্কুলের সামনে কালি বাড়ি, তখনকার নাম ছিল রাজাকার মঞ্জিল সেখানে হাটিয়ে নিয়ে যায়। পথে হ্যান্ড মাইক দিয়ে ঘোষণা করা হয় স্পেশাল বাহিনীর ৬জন অস্ত্র সহ ধরা পড়েছে। তখন আমাদের দেখার জন্য প্রচুর লোকজন সমাগম হয়। ঐরাত্রে আমরা রাজাকার মঞ্জিলে অবস্থান করি। পরদিন সকাল ১০-০০টার দিকে আমাদেরকে আগে পিছে আর্মি স্কট দিয়ে পায়ে হাটিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের সামনে দানা মিয়ার বাড়িতে নেয়া হয়। সেটা ছিল আর্মির নির্যাতন ক্যাম্প। আমাদের ৬জনকে একটি রুমে নেয়া হয়। তখন সেখানে আসেন পাকিস্তান আর্মির ক্যাপ্টেন আলী রেজা, ব্রিগেডিয়ার সাদাৎ উল্লাহ, মেজর আব্দুল্লাহ, হাবিলদার বশিরউদ্দিন। উনারা এসে আমাদেরকে নির্যাতন করা শুরু করে। নির্যাতনের ফলে আমরা অজ্ঞান হয়ে পড়লে উনারা বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে চলে যায়। সন্ধ্যায় দিকে আমাদের জ্ঞান ফিরলে আর্মির গাড়িতে আমাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানা হাজতে পাঠানো হয়। পরের দিন সকালে পুনরায় দানা মিয়ার বাড়িতে আনা হয়। এইভাবে আমাদেরকে দানা মিয়ার বাড়িতে ২/৩দিন নির্যাতন করা হয়। এরপর আমি ছাড়া আমার সাথী বাকী ৫জনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে পাঠানো হয়। দুইদিন পর আমাকেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে পাঠানো হয়। হঠাৎ একদিন আর্মির গাড়ি আসে জেলখানার গেট খুলে দেওয়া হয় এবং আমি সহ ৩০/৩৫ জন মুক্তিবাহিনীর লোককে জেলখানা হতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে মেড্ডা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর আমাদেরকে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে প্রত্যেকের শরীর থেকে সিরিজ দিয়ে রক্ত নেওয়া হয়। এরপর আমাদেরকে পুনরায় জেলখানায় পাঠানো হয়। আরও কিছুদিন পর ২১শে নভেম্বর রোজার ঈদের দিনে দিবাগত রাত্রে পাকিস্তান আর্মির গাড়ি আসলে জেলখানার গেট খুলে দেওয়া হয়। নাম ডেকে ডেকে আমাদের ৪০জন বন্দিকে রশি দিয়ে বাঁধা হয় এবং সবাইকে আর্মির গাড়িতে তোলা হয়। এক পর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার সাদ উল্লাহ আমাকে দেখে বলেন “ফেরেস্তাকো ছোড় দো।” এরপর আমার বাঁধন খুলে আমাকে ৪ নম্বর সেলে ঢোকানো হয়। সেলের ভিতরে আমি একজন লোককে দেখতে পাই, তার পরিচয় জানতে চাইলে সে বলে তার নাম মেজর অনন্ত সিংহ, তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য। সিমান্ত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে। পরদিন সাকালে জেল গেটে শুনতে পাই যে ৩৯ জনকে রাত্রে নেয়া হয়েছিল তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্বাধীন হওয়ার পর আমি জেল থেকে মুক্তি পাই। অসুস্থ অবস্থায় এক সাথী মুক্তিযোদ্ধা আমাকে নবীনগর ক্যাম্পে পাঠায়। সেখান থেকে আমি আমার গ্রামের বাড়ি চলে আসি। যে ৩৯ জন নিহত হয়েছেন মর্মে আমি বলেছি তাদের মধ্যে থেকে একচন বেঁচে যায় মর্মে আমি জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরে শুনি। আনুমানিক ৪/৫ মাস পরে তার সংগে আমার ঢাকায় দেখা হয়, তার নাম ছিল চিনু। সে তার বাম পাজরে গুরির চিহ্ন আমাকে দেখায়। সে কিভাবে বেঁচে যায় সে ঘটনার পুরা বর্ণনা আমাকে বলে। সে আমাকে জানায় যে ৩৮জনকে গুলি হত্যা করে পৈরতলায় মাটি চাপা দেয় হয়েছিল। আরও জানলাম সেই ৩৮ জনের ভিতর আমার ৪ সাথী ছিল তারা হলেন ১। শহীদ সিরু মিয়া দারোগা, ২। তার ছেলে শীহদ আনোয়ার কামাল, ৩। শহীদ নজরুল ইসলাম ও ৪। শহীদ আবুল কাশেম। আমি যে পেয়ারা মিয়ার কথা বলেছি তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। জেল হতে বের হয়ে জানতে পারি পেয়ারা মিয়া শান্তি কমিটির লোক ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শহীদ সিরু মিয়া দারোগার স্ত্রীর নিকট থেকে আমি জানতে পারি যে, তিনি তার স্বামী এবং সন্তানকে বাঁচাবার জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের নিকট থেকে একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের ছবি আমি পত্র পত্রিকায় দেখেছি। অদ্য আমি তাকে ট্রাইব্যুনালে দেখেছি। আমি অত্র মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি।
জেরা-(চলবে)

জেরা
১৯৭১ সালে বা তার আগে সাধারণভাবে আমাদের সঙ্গে ব্রাহ্মাণবাড়িয়ার যোগাযোগ ছিল। যেখান থেকে আমাদের আটক করা হয়েছিল সেখানে আমি ঐদিনই প্রথম যাই। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পূর্বে আমি কোন দিন ব্রাহ্মাণবাড়িয়ায় যাই নাই। ১৯৭১ সাল বা তার আগে ব্রাহ্মাণবাড়িয়ায় রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং তাদের নেতাদের সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শহীদ সিরু মিয়া দারোগার স্ত্রীর নিকট থেকে আমি জানতে পারি যে, তিনি তার স্বামী এবং সন্তানকে বাঁচাবার জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের নিকট থেকে একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। একথা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য। তবে অদ্য আদালতে আমি সত্য কথাই বলেছি। একথাগুলি প্রসিকিউশনের শিখানো মতে বলেছি, ইহা সত্য নহে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন