শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৩

হুমায়ুন আহমেদ’র পিতা হত্যার অভিযোগ এবং আয়েশা ফয়েজের বইয়ে যা রয়েছে



 Mehedy Hasan
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে বর্তমানে যেসব অভিযোগে বিচার করা হয়েছে  তার মধ্যে  একটি অভিযোগ হল নন্দিত কথা সাহিত্যিক মরহুম  হুমায়ূন আহমেদের পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদসহ  পিরোজপুরে তিনজন সরকারী কর্মকর্তাকে হত্যায়  সহায়তা করা। শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ  ১৯৭১ সালে পিরোজপুর মহকুমার পুলিশ  প্রধান  (এসডিপিও, সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার) ছিলেন।  ১৯৭১ সালে  ৫ মে  বলেশ্বর নদীর তীরে তাকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তান  মিলিটারি সদস্যরা। 

ট্রাইব্যুনাল  (১) কর্তৃক মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যে চার্জ গঠন করা হয়েছে তাতে  উল্লেখ করা হয়েছে মাওলানা সাঈদীর উপস্থিতিতে ফয়জুর রহমানকে হত্যা করা হয়। ট্রাইব্যুনালে একজন সাক্ষী বলেছেন ফয়ুজর রহমানসহ অন্য দুই সরকারি কর্মকর্তাকে ধরে নিয়ে যাবার সময় পাকিস্তান আর্মিদের গাড়িতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও ছিলেন।

মাওলানা সাঈদীর যখন বিচার চলে তখনও হুময়ূন আহমেদ জীবিত ছিলেন। বর্তমানে জীবিত রয়েছেন, হুমায়ূন আহমেদের মা শহীদ ফয়জুর রহমানের স্ত্রী আয়েশা ফয়েজ, হুমায়ূন আহমেদ এর দুই ছোট ভাই প্রফেসর ড. জাফর ইকবাল, আহসান হাবিব, বোন সুফিয়া হায়দার, ভগ্নিপতি অ্যাডভোকেট আলী হায়দার খান। কিন্তু তারা কেউই শহীদ ফয়জুর রহমান বিষযে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে আসেননি।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে ‘জীবন যে রকম’ শীর্ষক একটি বই জমা দেয়া হয়েছে। বইটি লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ এর মা শহীদ ফয়জুর রহমানের স্ত্রী আয়েশা ফয়েজ। শহীদ ফয়জুর রহমান এর পিরোজপুরে চাকরির সুবাদে তারা পিরোজপুরে থাকতেন সরকারি বাসায় সপরিবারে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর শহীদ ফয়জুর রহমানকে ধরে নিয়ে যাওয়া, যুদ্ধের কারনে পিরোজপুরের নিভৃত একটি গ্রামে হুমায়ূন আহমেদ এর মা আয়েশা ফয়েজ এর আশ্রয় গ্রহণ, ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে এ বাড়ি থেকে সে বাড়িতে পালিয়ে বেড়ানোর অবর্ননীয় দুখ কস্টের স্মৃতিসহ অনেক বিষয় বর্ননা করা হয়েছে বইটিতে।
শহীদ ফয়জুর রহমানের স্ত্রী হুমায়ুন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ ‘জীবন যে রকম’ নামে যে বই লিখেছেন তাতে তার স্বামীর হত্যা বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তো  দূরের কথা বইয়ে একটি বারের জন্য তিনি  মাওলানা সাঈদীর নামটি পর্যন্ত  উল্লেখ করেননি।  স্বামী হত্যা বিষয়ে স্বাধীনতার পর পিরোজপুরে তিনি যে কেস ফাইল করেন তাতে তিনি দুজন প্রধান আসামীর নাম উল্লেখ করেছেন যথা ব্রিগেডিয়ার আতিক রশিদ এবং মেজর এজাজ। স্বামী হত্যার জন্য তিনি  তার বইতে পাকিস্তানী সেনাদের অভিযুক্ত করেছেন।  এছাড়া এদেশীয় অন্যান্য যারা জড়িত ছিল তাদের নাম ধামও পরিস্কার করে বর্ননা করেছেন।
এসব বিষয় নিয়ে কোর্টে আর্গুমেন্ট হয়েছে। এছাড়া হুমায়ূন আহমেদ এর নিজের লেখা  ইতিহাস বিষয়ক বই জোছনা ও জননীর গল্পসহ আরো কিছু বই আসামী পক্ষ জমা দিয়ে প্রমানের চেষ্টা করেছেন শহীদ ফয়জুর রহমান হত্যার সাথে কোনক্রমেই মাওলানা সাঈদী জড়িত ছিলেননা। আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন ডা. জাফর ইকবাল,  আয়েশা ফয়েজসহ অনেকে টিভি টকশোতে বলে বেড়াচ্ছেন শহীদ ফয়জুর রহমানকে সাঈদী সাহেব হত্যা  করেছেন। কিন্তু তাদের নিজেদের লেখা বইতে তারা কোথাও  সাঈদীর  নাম উল্লেখ করেননি এবং কোর্টে আসেননি।
আসুন দেখা যাক আয়েশা ফয়েজ তার বইতে কি লিখেছিলেন। সুপাঠ্য এ বইটি আমি আগাগোড়া পড়েছি এবং এখানে সংশ্লিষ্ট অংশ আপনাদের সামনে তুলে ধরা হল।

বইটিতে সরাসরি যাবার আগে সংক্ষেপে জেনে নেয়া দরকার শহীদ ফয়জুর রহমান হত্যা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ চার্জশিটে মাওলান সাঈদীর বিরুদ্ধে কি বলেছিল এবং সাক্ষীরাও বা কি বলেছিল।

ফয়জুর রহমান হত্যা বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর  বিরুদ্ধে চার্জ :
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল -১  গত ৩/১০/২০১১ তারিখ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগ গঠন করে। এর মধ্যে একটি অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে “১৯৭১ সালের ৫ মে সাঈদী ও তার সহযোগী শান্তি কমিটির মন্নাফ কয়েকজন পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ে পিরোজপুর হাসপাতালে যায়। সেখান থেকে তারা সাইফ মিজানুর রহমানকে ধরে  বলেশ্বর নদীর তীরে  নিয়ে যায়। সাইফ মিজান সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতা। একই দিন লেখক হুমায়ুন আহমেদের পিতা পিরোজপুরের সাবডিভিশন পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) ফয়জুর রহমান এবং ভারপ্রাপ্ত এসডিও আব্দুর রাজ্জাককে কর্মস্থল থেকে ধরে নিয়ে বলেশ্বর নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। সাঈদীর উপস্থিতিতে এ তিন সরকারী কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।”

ফয়জুর রহমান হত্যা বিষয়ে সাক্ষী যা বলেছেন:
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগ সহসভাপতি এবং নড়াইল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন।  সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন  আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে জানান, তার ভাই  সাঈফ মিজানুর রহমান ১৯৭১ সালে পিরোজপুর জেলা মেজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর  ছিলেন।

খান বাহাদুর আফজালের (পিরোজপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান)  কাছ থেকে জানতে পারি আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা  করার কারনে এবং ট্রেজারি থেকে অস্ত্র বের করে দেয়ার কারনে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আমার বড় ভাই মিজানুর রহমান, এসডিও আব্দুর রাজ্জাক, এসডিপিও ফয়জুর রহমানকে বলেশ্বর নদীতে নিয়ে যায়। তাদেরকে  ধরে গাড়িতে নিয়ে যাবার সময় গাড়িতে পাক আর্মি ছিল। দেলোয়ার হোসেন ও মন্নাফ রাজাকারও  ছিল গাড়িতে। মন্নাফের কাছে শুনতে পাই। ওনাদেরকে গ্রেফতার করে ঐ গাড়িতে করে বলেশ্বর নদীতে নিয়ে হত্যা করা হয়।

শাহরিয়ার কবির  যা বললেন: গত ২১ জুলাই শাহরিয়ার কবির একটি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে বলেছেন আয়েশা ফয়েজ স্বামী হত্যার বিষয়ে ১৯৭২ সালে যে মামলা করেন তাতে দ্বিতীয় আসামী হল মাওলানা সাঈদী।  অথচ আয়েশা ফয়েজ তার বইয়ে প্রধান আসামীর সাথে  দ্বিতীয় যার নাম উল্লেখ করেছেন  তার নাম মেজর এজাজ।
এভাবে শহীদ ফয়জুর রহমানকে হত্যা বিষয়ে ঢালাওভাবে মাওলানা সাঈদীকে জড়িয়ে যে যার খুসীমত   বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে চলেছেন।

ফয়জুর রহমান হত্যা বিষয়ে আয়েশা ফয়েজের বইয়ে যা রয়েছে :

শহীদ ফয়জুর রহমানের স্ত্রী আয়েশা ফয়েজের বইটি ২০০৮ সালে প্রথম মুদ্রিত হয়।  পান্ডুলিপি প্রকাশের উপযোগী করেন তার ছেলে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। প্রকাশক : সময় প্রকাশন। এখানে বইটি থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ তুলে ধরা হল।

চারদিকে গুজব। মিলিটারি বাগেরহাটে এসে গেছে। পিরোজপুর আসবে যেকোন সময়।... স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্য করার জন্য অস্ত্রাগার খুলে দেয়া হয়েছে। তরুনরা সেই রাইফেল কাাঁধে নিয়ে সারা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শহরে উত্তেজনা এবং খানিকটা বিশঙ্খলা। কাজলের আব্বা সব দেখেশুনে আমাকে  বাচ্চাকে নিয়ে গ্রামের দিকে চলে যেতে বললেন। আমি রাজি হইনা। আল্লাহর ওপর ভরসা করে সবাই একসাথে থাকার আমার ইচ্ছা। সে আমাকে বোঝালো আমাদের তিন তিনজন ছেলে মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মিলিটারির অন্ধরাগ তাদের ওপর। হঠা? করে মিলিটারি আসলে যাবার কোন উপায় থাকবেনা (পৃষ্ঠা ৫৭)।

....অনেক বোঝানোর পর আমি রাজি হলাম। আমি আমার ছেলে মেয়েদের নিয়ে নাজিরপুর (পিরোজপুর) থানায়  হাজির হলাম। ...সেখানে প্রায় মাসখানেক ছিলাম (পৃ ৬৮) ।
....মে মাসের প্রথম দিকে পিরোজপুরের আলী হায়দার খান একটা কাগজ নিয়ে হাজির হল। তাকে কাজলের আব্বা এক লাইন লিখেছে, আয়েশা এই ছেলেটা যা বলবে তাই করবে। ..আলী হায়দার খান আমাদের সবাইকে নিয়ে বাবলা নামক এক গহিন গ্রামে মুবারক খান নামে এক গ্রাম্য  মাদব্বরের বাসায় পৌছে দিল। বিপদের সময় এগিয়ে আসা এই তরুন অ্যাডভোকেট আমাদের জীবনের সাথে নানাভাবে জড়িত। যুদ্ধের পর তার সাথে আমার বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছি।
...শেষ পর্যন্ত একদিন কাজলের বাবা বাবলায় আমাদের কাছে এসে হাজির হল।..... কাজলের আব্বা খুব চিন্তিত। মিলিটারি আসবে যেকোন মুহুর্তে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করা হয়েছিল যে,  থানা খালি করে সবাই চলে যাবে।
ভোর দশটার দিকে একজন লোক একটা চিঠি নিয়ে এল। চিঠি লিখেছেন থানার ওসি তফাজ্জল হোসেন। তিনি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী থানা খালি না করে সেখানে রয়ে  গেছেন। কোর্ট ইনেসপেক্টর আলাউদ্দিন এবং সিআই আব্দুল হালিমও  এসে গেছে। মিলিটারিরা এসেছে এবং কোন সমস্যা হয়নি। ওসি লিখেছেন কাজলের আব্বা যেন অবিলম্বে চলে  আসেন। কারণ অন্য সবাই চলে এসেছে কোন সমস্যা হবেনা (পৃ ৫৯)।
চিঠিটা আমাদের খুব চিন্তিত করে দিল। প্রথমত এখানে গোপনে থাকা হচ্ছে। চিঠি নিয়ে কেউ যদি চলে আসে সেটা গোপন হতে পারেনা। আমি বললাম এখন কি করবা?
কাজলের আব্বা বললেন যদি না যাই আমার নামে হুলিয়া নিয়ে ধরার জন্য চলে আসবে। ছেলে মেয়ে সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে। কোথায় পালাব আমরা এতগুলো মানুষ? আমাকে যেতে হবে।
..... একটু পরে কাজলের আব্বা ইকবালকে সাথে নিয়ে নৌকা করে রওয়ানা হল। আমার আল্লাহর ওপর খুব বিশ্বাস। নফল নামাজ পড়েছি। রোজা রাখছি। ...পরদিন বিকালে ইকবাল একা ফিরে এল। খালি পা. গায়ে একা ছেড়া শার্ট, পরনে লুঙ্গি। গ্রামের মাঝ দিয়ে একজন মাঝিকে দিয়ে পালিয়ে এসেছে। তাকে এভাবে দেখে আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। নি:শ্বাস আটকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে ইকবাল?
ইকবাল একটা লম্বা নি:শ্বাস নিয়ে বলল , আব্বা কালকে বিকালে মিটিংয়ে গিয়েছেন আর ফিরে আসেননি। সবাই বলেছে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে। ...কাল রাত নেমে এল। রাত শেষ হয়না। আমি বসে আছি। ভোরের আলো ফুটে উঠতেই আমি নৌকা করে পিরোজপুরে রওয়ান দিলাম। ........দীর্ঘ সময় লাগল পিরোজপুর পৌছতে। রিক্সা করে বাসায় পৌছতে বুকটা হা হা করে উঠল। যে বিছনায়

কাজলের বাবা শুয়েছিল এখনো সেই বিছানা এলামেলো হয়ে আছে। .. আমি  থানায় ফোন করলাম। ফোন ধরলেন থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেন। আমার গলার স্বর শুনেই ফোনটা রেখে দিল। এরপর যতবার ফোন করি অন্য একজন ফোন করে বলে ওসি নেই। আমি তখন সিআই হালিম সাহেবকে চাইলাম। তিনিও নেই। অনেকবার চেষ্টা করে আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, ঠিক আছে আমি থানায় আসছি। দেখি কে আছে। সাথে সাথে সিআই হালিম সাহেব ফোন করলেন। বললেন ভাবী আপনি কখন এলেন। বাচ্চারা কোথায়?
আমি তাকে কাজলের আব্বার কথা জিজ্ঞেস করলাম, এসডিপিও সাহেব কোথায়। ঠিক করে বলেন তার কি হয়েছে?
স্যার আছেন, আর্মির ব্যাপারতো ? তারা সাথে রেখেছে।
আমি শুনেছি আপনি নতুন এসডিপিও হয়েছেন।
কে বলে এসব? বাজে কথা।
ঠিক আছে আমি মিলিটারি কর্নেল আতিক রশীদের সাথে দেখা করতে চাই। একটা ব্যবস্থা করেন।
শুনে তিনি হা হা করে উঠলেন। বললেন দাড়ান আসছি। প্রায় সাথে সাথে তিনি বাসায় এসে হাজির  হলেন। বললেন কর্নেলের সাথে দেখা করলে ব্যাপারাটা খুব খারাপ হবে। ওরা হয়ত রেগে যাবে। আপনি খাওয়া দাওয়া করেন। আমি  খাবার পাঠাচ্ছি। বাচ্চাদের রেখে এলেন কেন? কালকেই একটা নৌকা পাঠিয়ে ওদের নিয়ে আসা যাবে। স্যারের কোন বিপদ হলে আমরা এখানে থাকতাম নাকি? আবার আসব আমি।
তিনি আর আসেননি। ফোন করে জানিয়েছেন মিলিটারিরা এখন আমার সাথে দেখা করবেনা।
আমি তখন গেলাম প্রাক্তন মুসলিম লীগের মন্ত্রী বর্তমান শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আফজাল সাহেবের বাসায়। আমাদের বাসার সামনেই তার বাসা। বাবার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। আমাকে দেখে একেবারে হকচকিয়ে গেলেন। আপনি?
জি, আমি জানতে  এসেছি এসডিপিও সাহেবের কি হয়েছে।
আপনি ভয় পাবেননা। সব ঠিক  আছে।
তাকে কি মেরে ফেলেছে?
না মরেনি।
তাহলে তিনি কোথায়?
কোথায় তো জানিনা। তারপর বিরক্ত হয়ে বললেন দেশের সত্যি খবরটা তো রাখেননা।  শুধু ইন্ডিয়ার রেডিও শোনেন। এখন আপনার বাচ্চাদের নিয়ে দেশে যান। আমি আপনার বাবাকে খবর দিই।
আমার বাবাকে আপনার খবর দিতে হবেনা। তিনি নিজেই আসবেন। আপনার  কাছে যেটা জানতে চেয়েছি সেটা বলেন। এসডিপিও সাহেবকে কি মেরে ফেলা হয়েছে?
তিনি বললেন, না মরেনি।
কাজলের আব্বাকে মে মাসের পাঁচ তারিখ বিকেল পাঁচটায় বলেশ্বর নদীর তীরে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। সবাই সেটা জানত। আমাকে সামনাসামনি সেটা বলার কারো সাহস হয়নি  (পৃ ৬০-৬৩)।

স্বাধীনতার পর ফেব্রুয়ারি মাসে পিরোজপুর রওয়ান দিলাম। আমি ডাক্তার সাহেবের বাসায় উঠেছি। নির্জন নদী তীরে যেখানে  কাজলের বাবাকে কবর দেয়া হয়েছে সেখান থেকে দেহাবশেষ তুলে আমি দেশে নিয়ে যেতে চাই তা সবাইকে জানালাম। মুক্তিযোদ্ধারা বললেন স্যার আমাদের এলাকার প্রথম শহীদ। তাকে নেবেননা। এখানেই রেখে যান। ....আমি রাজি হলাম। সবাই মিলে তখন আরেকটি  প্রস্তাব দিল। এদেশে পাকিস্তান মিলিটারি লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরেছে। কিন্তু হত্যাকান্ডের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করা যায় সেরকম সাক্ষ্য প্রমান কারো বিরুদ্ধে নেই। কাজলের (হুমায়ূন আহমেদ) বাবার হত্যাকান্ডের সাক্ষী প্রমান  রয়েছে। কে মেরেছে, কারা মেরেছে, কিভাবে মেরেছে তাও জানা আছে। সে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান অল্প কিছু মানুষের একজন যার মৃতদেহ শুকুনী, গৃধিনী ছিড়ে ছিড়ে খায়নি, যাকে মানুষেরা তুলে এনে দাফন করেছে ।

তার দেহাবশেষ তুলে এনে ময়না তদন্ত করা  যাবে এবং হত্যাকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি পূর্নাঙ্গ খুনের মামলা দায়ের করা যাবে। খুনী আসামীর প্রধান নায়ক বিগ্রেডিয়ার আতিক রশীদ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ধরা পড়েছে। এখন যুদ্ধবন্দী হিসেবে আছে। সাধারন যুদ্ধবন্দীরা মুক্তি পেয়ে দেশে যেতে পারে কিন্তু যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাকে বিচার করে শাস্তি দেয়া যাবে।
সবাই মিলে নদী তীরে এক নির্জন জায়গায় আমরা হাজির হলাম। ইকবাল (ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল) আমাকে এক নির্জন জায়গায় বসিয়ে দিয়ে গেল। সে নিজেই আমানুল্লাহকে নিয়ে কবর খুড়ে তার বাবার দেহাবশেষ বের  করেছিল। এই দীর্ঘদিন পরেও তার বাবার পায়ে নাকি ছিল একজোড়া অবিকৃত নাইলনের মোজা। ডাক্তার সাহেব ছিলেন । তিনি ময়নাতদন্ত করলেন। বেশ কয়েকটি গুলি লেগেছিল। একটি পায়ে একটি বুকে একটি মাথায়। যেটি মাথায় সেটি সম্ভবত তার প্রাণ কেড়ে নিল। ... কফিন নৌকায় তুলে শহরে আনা হল। .....যখন কফিন আনা হয়েছে ঠিক তখন আফজাল সাহেবকেও (খান বাহাদুর সৈয়দ মো: আফজাল, পিরোজপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান) গ্রেফতার করে থানায় আনা হল। আমি তার কাছ থেকে একদিন কাজলের বাবার কথা জানতে চেয়েছিলাম। উত্তর না দিয়ে দেশ সম্পর্কে আমাকে জ্ঞান দান করেছিলেন। আমাকে দেখে তিনি শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
চিনতে পারলেন সেরকম ভাব করলেননা।
...যতদিন ছিলাম প্রতিদিন ভোরে  কবরস্থানে যেতাম। মাথার কাছে বসে কোরআন শরীফ পড়তাম (পৃ ৭৮-৮১)।

...অনেক কষ্ট করে খুনের কেসটা দাড় করানো  হয়েছিল। যারা দেখেছে তাদের সাক্ষী প্রমান। যারা কবর দিয়েছে তাদের সাক্ষী প্রমান। ময়না তদন্তের রিপোর্ট সবকিছু।  প্রধান আসামী ব্রিগেডিয়ার আতিক রশিদ। সাথে মেজর এজাজ। দীর্ঘ সময় নিয়ে তৈরি করে সেই কেস ফাইল করা হল (পৃ ৮৩)।

আমি ঢাকা ফিরে এলাম। ছেলেমেয়েদের বললাম যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। তাদের বাবাকে যারা হত্যা করেছে তাদের এদেশের মাটিতে বিচার করা হবে। এই স্বাধীন দেশের মানুষের সামনে  দাড়িয়ে জবাবদিহি করতে হবে সেই হত্যাকারী খুনীদের। বলতে হবে কেন বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে এই মানুষদের। ... আমি অপেক্ষা করে আছি। আমার ছেলে মেয়েরা অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হলনা। এদেশের ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানের নব্বই হাজার সৈন্য সসম্মানে তাদের দেশে ফিরে গেল। এদেশের সরকার একটি বার তার বিচারের কথা উচ্চারন পর্যন্ত করলনা। ত্রিশ লক্ষ প্রানের প্রতি অবমাননার এর থেকে বড় উদাহরন পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটিও নেই। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে আমি সেজন্য কখনো  ক্ষমা করিনি।
এরপর প্রত্যেক নতুন সরকার আসার পর দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আবেদন করে বলেছি, পাকিস্তান সরকারের কাছে আমার স্বামীর হত্যাকারীদের ফেরত চেয়ে এদেশে মাটিতে তাদের বিচার করা হোক। ত্রিশ লক্ষ প্রানের প্রতি যে অবমাননা দেখানো হয়েছে সেই অবমাননার অবসান করা হোক। কোন লাভ হয়নি। ...পাকিস্তান সরকারের কাছে সেই হত্যাকারিদের  ফেরত চাওয়া হোক (পৃ ৮৩-৮৪)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন