শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৩

শহীদ পরিবারের কাজ হল ঘোরাঘুরি:

আয়েশা ফয়েজ তার বইয়ে লিখেছেন, “পেনশনের টাকা তোলার জন্য কাগজপত্র নিয়ে আবার গেলাম। কাজলের আব্বার পরিচিত একজন এআইজি তার অধস্তন অফিসারকে ডেকে আমার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। অফিসার বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, কোন চিন্তা করবেননা স্যার। সব ঠিক করে দেব।
তার সাথে অফিসে গিয়েছি। সে   রাগে ফেটে  পড়ল। মুখ খিচিয়ে বলল, আপনার বেশি ক্ষমতা  হয়েছে না? ভাবেন ওপরওয়াল বললেই সব হয়ে যাবে? মনে রাখবেন টাকা অত সহজে পাওয়া যায়না। টাকা যদি চান এখানে এসে খরচপাতি করবেন।
ভদ্র লোক গজগজ করতে করতে তার এক সহকর্মীকে বললেন, এই একটা নতুন দল বের হয়েছে। শহীদ পরিবার। যেখানেই যাই সেখানেই শহীদ পরিবার। জ্বালিয়ে খাচ্ছে এরা।

এইভাবে শহীদ পরিবার হিসেবে আমার এক নতুন জীবন শুরু হল। শহীদ পরিবারের  প্রথম কাজ হচ্ছে ঘোরাঘুরি করা। আমার ঘোরা ঘুরি শুরু হল। এক অফিস থেকে আরেক অফিস। এক অফিসার থেকে আরেক অফিসার। এভাবে আস্তে আস্তে ঘোরাঘুরিতে অভিজ্ঞ হয়ে গেলাম।

ঢাকায় থাকার জায়গার খুব সমস্যা। শহীদ পরিবারকে বাড়ি দেয়া হয়েছে শুনে তার জন্য ঘোরাঘুরি শুরু করেছি।  একদিন খোঁজ খবর নিয়ে বাড়ি সংক্রান্ত একজন মন্ত্রী, নাম মতিউর রহমান, তার সাথে দেখা করতে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার মত আরো অনেকে আছেন। দীর্ঘ সময় পর মন্ত্রী  মহোদয়ের সাথে দেখা হল। আমাদের দেখে একেবারে ক্ষেপে গেলেন মহোদয়। পেয়েছেন কি আপনারা? প্রত্যেক দিন সকালে এসে বসে থাকেন? সকালে ঘুম থেকে উঠেই আর কত বিধবার মুখ দেখব?
আমি লজ্জায় মরে গেলাম। খোদা তুমি আমাকে আর কত অপমান সহ্য করাবে?

অবশেষে এভাবে ঘেরাঘুরি করতে করতে  অশেষ লজ্জা অপমান হজম করে আয়েশা ফয়েজ শহীদ পরিবার হিসেবে একটি বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছিলেন। তার স্বামীর বন্ধু কাজী জাহেদুল ইসলাম বাড়িটি তাকে পাইয়ে  দেয়ার ব্যবস্থা করেন। জনৈকি অবাঙ্গালীর পরিত্যাক্ত বাসা। ১৯/৭ বাবর রোড।
এই বাড়ি থেকেই তিনদিনের  মাথায় তাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের  রক্ষীবাহিনী অস্ত্রের মুখে তাড়িয়ে দেয়। ডাক্তার মনোয়ার হোসেন নামে এক প্রতিবেশী তাদের আশ্রয় দেন ।  
মনীষী আহমদ ছফা গণকণ্ঠ পত্রিকায়  পরের দিন  শহীদ পরিবারের ওপর এ নির্যাতনের একটি খবর ছাপার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে  রক্ষী বাহিনী প্রধান নুরুজ্জামান ওপরের তলা দিলেন  আয়েশা ফয়েজকে  এবং নিচের তলা দিলেন  রক্ষী বাহিনীর মেজর সুবেদার  হাফিজকে।

বাসা লুট:
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এসডিপিও ফয়জুর রহমান তার স্ত্রী আয়েশা ফয়েজ এবং ছেলে মেয়েদের পিরোজপুরের সরকারি বাসা ছেড়ে নাজিরপুর থানার  নিভৃত  পল্লী বাবলা গ্রামে গোপন আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেন। সেখানে একদিন গোপনে  পরিবারের সাথে দেখা করতে আসেন ফয়জুর রহমান। এ অবস্থায় পিরোজপুর থানার ওসি তফাজ্জাল হোসেন তাকে অভয় দিয়ে পিরোজপুর আসার জন্য চিঠি লেখেন। । চিঠি মোতাবেক পিরোজপুর হাজির  হবার পর ১৯৭১ সালের ৫ মে ফয়জুর রহমানকে বলেশ্বর নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করা হয়।

স্বামী হত্যার খবর পাওয়ার সাথে সাথে আয়েশা ফয়েজ সমস্ত বাঁধা বিপত্তি উপেক্ষা করে   একা ছুটে যান পিরোজপুর। ওসি তফাজ্জালসহ স্বামীর অফিসের অধস্তন কর্মকর্তা, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান খান বাহাদুর সৈয়দ মো: আফজাল সবার সাথে দেখা করে স্বামীর  বিষয়ে সঠিক খবর জানতে চান। কিন্তু সবাই  তার কাছে   স্বামী ফয়জুর রহমান হত্যার কথা  গোপন রাখে।  স্বামীর ব্যাপারে কোন সন্ধান না
পেয়ে  আয়েশা ফয়েজ ফিরে আসেন পিরোজপুর তাদের সরকারি বাসায়।  সে বাসা লুট হওয়া বিষয়ে তিনি তার বইয়ে যা লিখেছেন তা এখানে তুলে ধরা হল। 

“আমি একা বাসায় বসে আছি। রাতে ঘরদোর গুছিয়ে বাসায় বসে থাকলাম। ....কিন্তু সে (স্বামী ফয়জুর রহমান) আর আসেনা। ভোর হতেই সবাই আমাকে চাপ দেয় চলে যাবার জন্য। .... আমি তখন বাসা ছেড়ে বাচ্চাদের কাছে যাব বলে ঠিক করলাম। আমি আবার ঘর পরিস্কার করে দিলাম। কাজলের (হুমায়ূন আহমেদ) বাবা যদি ফিরে আসে  তার জন্য পরিস্কার কাপড় আলনায় ঝুলিয়ে দিলাম। বিছানায় নতুন চাঁদর দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিলাম। রিক্সা নৌকাঘাটে পৌছানোর আগেই মিলিটারি সদলবলে এসে আমার বাসা লুট করে নিল। আমার এতদিনের সংসার, কাজলের আব্বার শত শত বই, তার লেখা অপ্রকাশিত বইয়ের পান্ডুলিপি, বাচ্চাদের ছেলেবেলার স্মৃতি সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। রাস্তার মানুষ ডেকে মিলিটারি আদেশ দিল সব কিছু  লুট করে নিয়ে যেতে। ”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন