শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৩

পিরোজপুর শান্তি কমিটির তালিকায় সভাপতির নাম নেই!



২১/১১/২০১২ বুধবার

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় আজ ভাগিরথী হত্যার অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন আসামী পক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগের একটি অভিযোগ হল- ভাগিরথী নামে একটি মেয়ে পাকিস্তান সেনা ক্যাম্পে কাজ করত। মাওলানা সাঈদী পাকিস্তানী সেনাদের খবর দেয় যে, ভাগীরথী  মুক্তিযোদ্ধাদের চর হিসেবে পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পের খবর  মুক্তিযোদ্ধাদের পৌছে দেয়। এরপর পাকিস্তান সেনারা তাকে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়।

মিজানুল ইসলাম বলেন, ভাগিরথী হত্যায় আল্লামা সাঈদীর সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যেসব ডকুমেন্ট দাখিল করেছে তার মধ্যে রয়েছে ১৯৭২ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকার একটি রিপোর্ট,  তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক রেকর্ডকৃত ভাগিরথীর ছেলে গণেশ চন্দ্র সাহার  জবানবন্দী। এছাড়া  তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দী   এবং জেরা, রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নং সাক্ষী স্থানীয় এমপি একেএমএ আউয়ালের সাক্ষ্যে বিষয়টি এসেছে রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্ট হিসেবে।

আসামী পক্ষ থেকে এ বিষয়ে যে ডকুমেন্ট   রয়েছে  তা হল ভাগিরথীর ছেলে গণেশ কর্তৃক  আল্লামা সাঈদীর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য প্রদান এবং আসামী পক্ষের  ১০ নং সাক্ষীর জবানবন্দী।

রাষ্টপক্ষ কর্তৃক জমা দেয়া ‘বর্বরতার রেকর্ড’ শীর্ষক ১৯৭২ সালের দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রতিবেদনটি পড়ে শোনান মিজানুল ইসলাম। প্রতিবেদেনর সারমর্ম  বিষয়ে মিজানুল ইসলাম বলেন, ভাগিরথীকে পাকিস্তান সেনা ক্যাম্পে  নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছিল। এরপর ভাগিরথী চিন্তা করল তার সবকিছুই যখন চলে গেল তখন সে প্রতিশোধ নেয়ার  পরিকল্পনা করল। পাকিস্তান সেনাদের বিশ্বাস ভাজন হবার সে কৌশল নিল ।  তাদের  খবরাদি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌছে দিত সে। একদিন তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৈন্যরা ভাগিরথীর গ্রামে আসে। সেখানে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল মুক্তিযোদ্ধারা। ৪৫ জন খান সেনা তাদের গ্রামে এসেছিল । তার মধ্য থেকে ৪/৫ জন প্রান নিয়ে ফিরে যেতে পেরেছিল। এরপর পাকিস্তানী সেনারা এর জন্য ভাগিরথীকে দায়ী করে এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মিজানুল ইসলাম বলেন,  তদন্ত কর্মকর্তা দৈনিক আজাদের প্রতিবেদন বিষয়ে  স্বীকার করেছেন  ওই প্রতিবেদনে ভাগিরথী হত্যা বিষয়ে সাঈদী সাহেবের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই।
মিজানুল ইসলাম বলেন,  ভাগিরথী হত্যা বিষয়ে দৈনিক আজাদের প্রতিবেদন যদি সত্য ধরা হয় তাহলে দেখা যায়  ভাগিরথী হত্যার সময় রাজাকারদের  সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে কিছু নেই। রাজাকারা তাকে  ধরিয়ে দিয়েছিল এ কথা উল্লেখ আছে শুধু ।
মিজানুল ইসলাম বলেন,  রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী এক ঘন্টা ধরে ভাগিরথীকে পিরোজপুর শহরে গাড়ির পেছনে টেনে হত্যা করা হল। কমপক্ষে ৫ থেকে ১০ মাইল তাকে টেনে হিচড়ে শরীর ক্ষত বিক্ষত করা হল। শত শত মানুষ এ ঘটনা দেখার কথা।   কিন্তু তারা এর পক্ষে একজন প্রত্যক্ষদর্শীও হাজির করতে পারলনা?  পিরোজপুরের সব লোক কি মাওলানা সাঈদীর পক্ষাবলম্বনকারী? একজন লোকও কি নেই যিনি এ বিষয়ে সত্য কথা বলতে পারেন? যদি ধরে নেয় হয়  ভাগিরথীর ছেলে গণেশের জবানবন্দী রেকর্ডের পর তারা মনে করেছেন আর কোন সাক্ষী দরকার নেই কিন্তু গণেশকে যখন  তারা সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে আনতে পারলনা তখনো তো তারা অন্য কোন সাক্ষী আনতে  পারতো। কিন্তু তারপরও তো আনলনা।

মিজানুল ইসলাম বলেন, গণেশসহ  ৪৬ জন সাক্ষীকে  হাজির করা সম্ভব নয়  উল্লেখ করে রাষ্ট্রপক্ষ দরখাস্ত করেছিল তাদের অনুপস্থিতিতে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দী  হিসেবে গ্রহণ করা হোক। ট্রাইব্যুনাল গণেশচন্দ্রসহ ১৫ জনের জবানবন্দী গ্রহণ করেছেন ১৯.২ ধারায়।  কিন্তু  গণেশ আসামী পক্ষে  ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দেয়ার পর  ১৯.২ ধারা অনুযায়ী  তার জবানবন্দী আর ট্রাইব্যুনালের কাছে গ্রহণযোগ্য হবার কোন উপায় নেই। । কারণ গণেশ যে আল্লামা সাঈদীর  পক্ষ অবলম্বনকারী সন্ত্রাসীদের ভয়ে আত্মগোপনে ছিল তার পক্ষে কোন  প্রমান তারা হাজির করতে পারেনি। বরং তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন ডাকাতের ভয়ে গণেশ পালিয়ে ছিল। সেই ডাকাত একজন শাস্তি প্রাপ্ত লোক বলেও তিনি জানিয়েছেন। কাজেই  গণেশ যে আল্লামা সাঈদীর পক্ষাবলম্বনকৃত  সন্ত্রাসীদের ভয়ে পালিয়ে ছিলনা তাতো নিশ্চিত। রাষ্ট্র কি একজন সাক্ষীকে ডাকাতের কাছ থেকে নিরাপত্তা দিয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে পারেনা? গণেশের কি এমন সম্পত্তি আছে যে তার ডাকাতের  ভয় থাকবে? তাছাড়া গণেশকে রাষ্ট্রপক্ষ জেরার সময় এ মর্মে একটি সাজেশনও তারা দেননি যে, সে আল্লামা সাঈদীর সন্ত্রাসীদের ভয়ে পালিয়েছিল কি-না।

মিজানুল ইসলাম বলেন,  গণেশ  আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ বলেছিল সে আর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী নয়। কিন্তু অপর দিকে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে তার প্রদত্ত জবানবন্দী আবার তারা গ্রহণ করতে চায়। এটা শুধু বৈপরীত্য এবং ডাবল স্ট্রাডার্ড নয়। আরো কিছু বলা যায়। আমি তা বললামনা।

মিজানুল ইসলাম বলেন, তদন্ত কর্মকর্তার কাছে   গনেশের যে জবানবন্দী রেকর্ড করা আছে তাতে বলা হয়েছিল মটর সাইকেলের পেছনে তার মাকে বেঁধে শহরে টেনে হিচড়ে ঘোরানো হয়েছিল।
অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালে তিনি তার জবানবন্দীতে বলেছেন তার মাকে  জীপের পেছনে বাঁধা হয়েছিল। গণেশ তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তাতে লেখা আছে যে মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান সর্দার ভাগিরথীর কাছ থেকে পাকিস্তানী সেনাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতেন তিনি বর্তমানে পিরোজপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান । কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় বললেন উপজেলা চেয়ারম্যান   মতিউর রহমান সর্দার এবং   ভাগিরথীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহকারী মতিউর রহমান সর্দার আলাদা ব্যক্তি । মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান জীবিত আছে কি-না তাও তিনি জানেননা।
এসময় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, সাক্ষী যা বলেছে তদন্ত কর্মকর্তা তা লিখেছে। এখানে তার দোষ কোথায়? সাক্ষীর ওই লাইনটা  হয়ত সঠিক নয়।
মিজানুল ইসলাম বলেন, তিনি সাক্ষীর একটি জবানবন্দী জমা দিলেন এবং  জেরার সময় ধরে নেয়া যায় সে জবানবন্দী তার সামনে ছিল। সেখানে  গণেশ বলল উপজেলা চেয়ারম্যান  মতিউর রহমান এবং   মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান একই ব্যক্তি । আর তদন্ত কর্মকর্তা বললেন একই ব্যক্তি নন।  এটা একজন তদন্ত কর্মকর্তা কি করে বলতে পারেণ তার সামনে সাক্ষীর ডকুমেন্ট থাকার পরও?

মিজানুল ইসলাম বলেন, তাছাড়া দৈনিক আজাদের রিপোর্টে লেখা আছে ভাগিরথীর তখন একটি সন্তান ছিল। অন্যদিকে গণেশ তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তাতে লেখা আছে তারা দুই ভাই ছিল তখন। তার বড় ভাইর নাম ছিল কার্তিক। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ভাগিরথী হত্যা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষই বিপরীতধর্মী তথ্য দিয়েছে।
বিচারপতি নিজামুল হক প্রশ্ন করেন, গনেশের যে জবানবন্দী তদন্ত কর্মকর্তা রেকর্ড করেছেন এবং ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ জমা দিয়েছেন তাতে লেখা আছে তার মায়ের হত্যা বিষয়ে সে লোকমুখে শুনেছে। শোনা কথা কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা তার কিছুই সে জানেনা। স্বাধীনতার পর সে লোকমুখে শুনেছে পাড়েরহাটের রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেলুর প্রত্যক্ষ হাত ছিল তার ময়ের হত্যা বিষয়ে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?

মিজানুল ইসলাম বলেন, গণেশ চন্দ্র  আল্লামা সাঈদীর পক্ষে এই ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন তার মায়ের হত্যার সাথে সাঈদী সাহেব জড়িত নন। ট্রাইব্যুনালে তিনি যা বলেছেন তা তদন্ত কর্মকর্তার রেকডকৃত বক্তব্যের বিপরীত।

শান্তি কমিটির তালিকায় সভাপতির নাম নেই!
তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত রাজাকার এবং শান্তি কমিটির একটি ওয়েবসাইট ট্রাইব্যুনালের পর্দায় দেখান  মিজানুল ইসলাম। পিরোজপুর  শান্তি কমিটির যে তালিকা  দেখানো হয় তাতে দেখা যায় পিরোজপুর শান্তি কমিটির সভাপতি খান বাহাদুর সৈয়দ মো: আফজালের নাম নেই। রাজাকার তালিকায়ও তার নাম নেই। রাজাকার তালিকায় আল্লামা সাঈদীর নাম আছে।

মিজানুল ইসলাম  বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন একটি জেলার রাজাকার এবং শান্তি কমিটির তালিকা তৈরি করা হল আর তাতে সে জেলার  শান্তি কমিটির সভাপতির নাম  রাখা হলনা।  কাজেই  এই তালিকার কি কোন গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বাস যোগ্যতা থাকতে পারে?  যে লেখক এই তালিকা তৈরি করেছে  সেই লেখকের গ্রহণযোগ্যতা, সততা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, তালিকায় আফজাল সাহেবের নাম না থাকলে কি তিনি শান্তি কমিটির লোক ছিলনা এটা বোঝায়?  তালিকায় নাম নেই কিন্তু তার বাইরে কি আর কোন রাজাকার বা শান্তি কমিটির লোক নেই? বা তালিকায় যাদের নাম আছে তারা সবাই  রাজাকার বা শান্তি কমিটির তাও কি ধরে নেয়া যায়?
মিজানুল ইসলাম বলেন আমি আপনার সাথে  সম্পূর্ণ একমত।  তালিকায় নাম না থাকলে যে আফজাল সাহেবর শান্তি কমিটির লোক নন  মর্মে আখ্যায়িত হবেন তা নয়।  আমি বোঝাতে চেয়েছি তালিকায় আসল ব্যক্তি সভাপতির নাম যদি না থাকে তাহলে সেই তালিকার  গ্রহণযোগ্যতা  বিশ্বাসযোগ্যতা প্রথমেই  চলে যায়।
বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, লেখক যাদের নাম পেয়েছে তাদের নাম দিয়েছে। ওনার নাম হয়ত তিনি পাননি।
মিজানুল ইসলাম বলেন, এটা হতে পারেনা। একজন লোক একটি  এলাকার শান্তি কমিটির তালিকা করবেন আর তিনি  সেই এলাকার সভাপতির নাম পাবেনা কিন্তু অন্যদের নাম পাবে তা  বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনা।

রাজাকার এবং শান্তি কমিটির তালিকার  যে ওয়েবসাইট দেখানো হল এ বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে মিজানুল ইসলাম  পরবর্তীতে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় বলেছিলেন ডা. এম এ হাসানের ওয়েবসাইট থেকে তিনি এ তথ্য পেয়েছেন। এটি  ডা. এম  এ হাসানের  ওয়েবসাইট। ওয়েবসাইটটির নাম ওয়ারক্রিমিনালসবিডিডটওআরজি। এখানে এ তালিকা আছে। তাছাড়া ওয়ারক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির আহবায়ক ডা. এম এ হাসানের যে ডকুমেন্ট জমা দেয়া হয়েছেঠ তাতেও  তালিকা আছে। উভয় তালিকা একই।  এ ডকুমেন্ট  তদন্ত কর্মকর্তা তাদের পক্ষের ডকুমেন্ট হিসেবে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেছেন।

যুক্তি উপস্থাপনে মিজানুল ইসলামকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট মনজুর  আহমদ আনসারী,  ব্যারিস্টার  তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, অ্যাডভোকেট শিশির মো: মনির প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু,  প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী প্রমুখ।
ট্রাইব্যুনাল (১) চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আনোয়ারুল হক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন