শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৩

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী মামলা : নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যা বিষয়ে ১৯৭২ সালের এফআইআর- এ যা রয়েছে


মেহেদী হাসান, ১৫/৮/২০১৩
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী যেসব অপরাধের অভিযোগে বিচার চলছে তার মধ্যে অন্যতম আলোচিত একটি অভিযোগ হল রউজান থানার  গহিরা গ্রামে কুন্ডেশ্বরী কমপ্লেক্স’র প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাকান্ড। এ হত্যাকান্ড বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের  ২ জন  সাক্ষী বলেছেন, তারা দেখেছেন  সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি নূতন চন্দ্র সিংহকে গুলি করে প্রথমে। এরপর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী  নিজেও তার  পিস্তল দিয়ে কয়েক রাউন্ড  গুলি করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। গুলি করার আগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নূতন চন্দ্র সিংহকে তার বাড়ির ভেতরে অবস্থিত মন্দির থেকে টেনে হিচড়ে বের করে নিয়ে আসে।

নূতন চন্দ্র সিংহ’র ছেলে সত্যরঞ্জন সিংহ ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে  তার পিতার হত্যা বিষয়ে একটি মামলা করেছিলেন  রাউজান থানা। রাউজান থানায় দায়েরকৃত এফআইআর-এ সত্যরঞ্জনসিংহ তার পিতা হত্যার যে বিবরন দিয়েছেন তার সাথে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীদের বর্নিত ঘটনার সাথে। সত্যরঞ্জন সিংহ ১৯৭২ সালের এফআইআর-এ যে বর্ননা দিয়েছেন তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন- পাকিস্তান আর্মির দুজন সদস্য তার পিতাকে মন্দির থেকে বের করে আনে। এরপর পাকিস্তান আর্মির এক সদস্য তাকে পরপর তিনটি গুলি করে। এতেই তার মৃত্যু হয়। সেখানে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে গুলি করার কোন অভিযোগ নেই। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং তার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে তার পিতা হত্যায় ষড়যন্ত্র এবং প্রররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে  ১৯৭২ সালের ওই মামলায়।

গত বুধবার  ট্রাইব্যুনালে এ মামলার যুক্তি উপস্থাপনের শেষ দিনে আসামী পক্ষ থেকে ১৯৭২ সালের  এফআইআর ডকুমেন্ট দাখিল করা হয়। এফআইআরটি নিম্নরূপ :

রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার মহোদয় সমীপেষু।
আমি শ্রী সত্য রঞ্জন সিংহ, পিতা-মৃত অধ্যক্ষ ণূতন চন্দ্র সিংহ সাং গহিরা, থানা-রাউজান, চট্টগ্রাম অদ্য আমার পিতার হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারী, প্ররোচনাকারী ও সমর্থনকারীর বিরুদ্ধে অত্র লিখিত অভিযোগ দায়ের করিতেছি ঘটনার বিবরণ যথাÑ
(১) আমার পিতা স্বর্গীয় ণূতন চন্দ্র সিংহ চট্টগ্রাম তথা সমগ্র বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নিজ ব্যয়ে কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির ও কুণ্ডেশ্বরী বালিকা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কয়েক লক্ষ টাকা দান করিয়া অশেষ খ্যাতি অর্জন করায় উগ্র হিন্দু বিদ্বেষী পার্শ্বোক্ত ১ (ফজলুল কাদের চৌধুরী) ও ২নং (সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী) ব্যক্তি তজ্জন্য বরাবর ঈর্ষা পরায়ণ ছিলেন। পার্শ্বোক্ত ৩-১০ ব্যক্তিগণ পার্শ্বোক্ত ১/২নং ব্যক্তির অন্ধ সমর্থক ও দুষ্কার্যের সহায়ক। আমার পিতার ন্যায্য ও সময়োচিত হস্তক্ষেপের দরুণ তাহাদের বহু দুষ্কার্য বহুবার বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় তাহারাও আমার পিতার প্রতি অতীব আক্রোশ ভাবাপন্ন ছিল। তাহাদের কেহ কেহ ইতিপূর্বে হত্যা ও ডাকাতির দায়ে শাস্তি ভোগ করিয়াছে।

(২) বিগত ১৩/০৪/১৯৭১ ইংরাজী তারিখ রোজ মঙ্গলবার বেলা অনুমান ৯.৩০ (সাড়ে নয়) ঘটিকার সময় পার্শ্বোক্ত ২-১০নং ব্যক্তি সমভিব্যবহারে হানাদার বাহিনী আমাদের ভিতর বাড়ী উপস্থিত হওয়ার সময় আমার বাবা আমাদের বাড়ীতে স্থাপিত শ্রী শ্রী কুণ্ডেশ্বরী দেবীর মন্দিরে স্বাভাবিক নিয়মে প্রার্থনারত ছিলেন। হানাদার বাহিনীর ২ জন লোক মন্দিরের অভ্যন্তরে ঢুকিয়া পড়িয়া প্রার্থনারত আমার বাবাকে মন্দির হইতে টানিয়া বাহিরে লইয়া আসে এবং তাঁহার নিকট নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার দাবি করে। তখন আমার বাবার নিকট থাকা মং ৮০,০০০/০০ নগদ টাকা এবং প্রায় ২০০ ভরি ওজনের স্বর্ণালংকার হানাদার বাহিনীর হাতে তুলিয়া দেন। উক্তমতে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার পাইয়া ও বাবার সহিত আলাপ আলোচনার পর হানাদার বাহিনী ফেরৎ যাওয়ার জন্য কিয়দ্দুর অগ্রহসর হইলে পার্শ্বোক্ত ২নং ব্যক্তি (সালাহউদ্দিন কাদের চৌধরী)  তাহার জামার পকেট হইতে একটি নোট বই বাহির করিয়া উহার একটি নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা খুলিয়া আমার বাবার নাম তাহার পিতার (১নং ব্যক্তি) দেওয়া হত্যাযোগ্য ব্যক্তির তালিকায় লিপিবদ্ধ থাকার বিষয় হানাদার বাহিনীল নিকট প্রকাশ করিলে এবং তাহার হাতের নোট বই এর পাতায় জনৈক হানাদার অফিসারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিলে উক্ত অফিসার বাবার বৃদ্ধাবস্থার বিষয় বিবেচনা করিয়া ও ইতিপূর্বে বাবার সহিত আলাপে মুগ্ধ হইয়া হত্যা করিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তখন পার্শ্বোক্ত ২-১০ ব্যক্তি বাহিরে অপেক্ষারত অপর এক অফিসারকে ডাকিয়া আনে এবং আমার বাবাকে হত্যা করা  না হইলে পাকিস্তানের সর্বনাশ সাধন করা হইবে এবং স্থানীয় মুসলমানগনের জীবন রক্ষা করা কঠিন হইবে এবং তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দসহ অনেক ইপি আর বাহিনীর আশ্রয়দাতা ইত্যাদি নানা বিষয়ের অবতারণা করিয়া পার্শ্বোক্ত ২-১০ নং ব্যক্তি শোষোক্ত অফিসারকে উত্তেজিত এবং বাবাকে হত্যার জন্য প্ররোচিত করিতে থাকিলে অফিসারটি পার্শ্বোক্ত ২-১০নং ব্যক্তির ষড়যন্ত্রমূলক কার্যের দ্বারা প্ররোচিত হইয়া তাহার অধিনস্থ জনৈক সিপাইকে বাবাকে হত্যা করার আদেশ দিলে পার্শ্বোক্ত ২-১০ নং ব্যক্তি একযোগে করতালি দিয়া অফিসারটিকে অভিনন্দন জানায়। এদিকে হত্যা করার জন্য হুকুমপ্রাপ্ত সৈনিকটি আমার বাবাকে মন্দিরের সামনে মাটিতে বসাইয়া প্রায় ১০.৫ ঘটিকার সময় রাইফেল দ্বারা পরপর তিনটি গুলি করায় শরীরে বিদ্ধ করিলে বাবা মাটিতে হেলিয়া পড়েন এবং গুলিবিদ্ধ স্থান হইতে অতিরিক্ত রক্তস্রাব হওয়ার দরুণ ২০ মিনিটের মধ্যেই দেহত্যাগ করেন। পার্শ্বোক্ত ব্যক্তিগণের পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনামূলক কার্যের ফলেই আমার বাবা অকালে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে বাধ্য হইয়া ছিলেন। বাবাকে উক্তমতে গুলিবিদ্ধ করার পর পার্শ্বোক্ত ২-১০নং ব্যক্তি পাকিস্তান জিন্দাবাদ মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ ফজলুল কাদের চৌধুরি জিন্দাবাদ এয়াহিয়া খান জিন্দাবাদ ইত্যাদি বৃথান দিতে দিতে আমাদের দেবী মন্দিরে প্রবেশ করে এবং পরে ৩নং ব্যক্তির দ্বারা আমাদের ভিতর বাড়ী হইতে আনীত কয়েক খানি বড়বড় কাঠের টুকরার আঘাতে পার্শ্বোক্ত ৩-১০নং ব্যক্তি দেবী মূর্তির বিভিন্ন অংশ ভাঙ্গিয়া ফেলে এবং সম্পূর্ণ রূপে বিকৃত করিয়া করিয়া ফেলে।
আমি ঘটনার সময় উপস্থিত না থাকিলেও প্রত্যক্ষদর্শী আমার জেষ্ঠতাত ভ্রাতাগণ ও কর্মচারীবৃন্দ ও অন্যান্য নিরপেক্ষ ব্যক্তির নিকট ঘটনার সম্পূর্ণ বিষয় জানিয়া ও ব্যক্তিগতভাবে অনুসন্ধান করিয়া ঘটনার সম্পর্কে সন্দেহাতীত হইয়া অত্র অভিযোগ পত্র দায়ের করিলাম।
অতএব প্রার্থনা এই যে, আপনি অনুগ্রহ পূর্বক ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত করতঃ অপরাধীগণের উপযুক্ত শাস্তি বিধানের নিমিত্তে আদেশ হয়। ইতি ২২/১/৭২ইংরাজী। নিবেদক-শ্রী সত্য রঞ্জন সিংহ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন