বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৩

অনুপস্থিত ১৫ সাক্ষীর জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ

মেহেদী হাসান, ২৯/৩/২০১২, বৃহষ্পতিবার
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৫ জন সাক্ষী  তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ  করেছেন ট্রাইব্যুনাল। আজ ট্রাইব্যুনালে আদেশ দেয়া হয়েছে।

সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে জবানবন্দীকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করাকে নজীরবিহীন আখ্যায়িত করছেন  মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। তিনি বলেন,  পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরণের নজির নেই যে পুলিশের কাছে দেয়া সাক্ষ্যকে জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

গত ২০ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে একটি আবেদন পেশ করা হয়। আবেদনে বলা হয়  মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে  ৪৬ জন  সাক্ষীকে  হাজির করা আদৌ সম্ভব নয়। তাই  ৪৬ জন সাক্ষী  তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে  জবানবন্দী  দিয়েছেন তা  তাদের অনুপস্থিতিতে আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহন করা হোক।

আবেদনে ৪৬ জন সাক্ষীর  মধ্যে ১৯ জনকে ঘটনার সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ১৯ জন সাক্ষীর মধ্য থেকে ১৫ জনের জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হবে মর্মে গতকাল ট্রাইব্যুনাল আদেশ দিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের দরখাস্তে ১৯ জন ঘটনার সাক্ষী হাজির করতে না পারা বিষয়ে বিভিন্ন কারণ  উল্লেখ করা হয়েছিল।  এদের মধ্যে পাঁচজনকে হাজির করতে না পারা বিষয়ে বলা হয়েছে তারা নিখোঁজ।  ১৪জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। মাওলানা সাঈদীর পক্ষের অস্ত্রধারীদের হুমকির কারনে  তারা আত্মগোপন করেছে।  নিখেঁাঁজ  পাঁচ জনের তিনজন গোপনে ভারতে পালিয়ে গেছে। এছাড়া একজনের স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে এবং বয়স ও অসুস্থতাজনিত কারনে ভ্রমনে মৃত্যুর ঝুকি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আদালত যে ১৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন এরা হলেন, ঊষারানী মালাকার,

সুখরঞ্জন বালী, আশিষ কুমার মন্ডল, সুমীত রানী মন্ডল, সমর মিস্ত্রী, সুরেষ চন্দ্র মন্ডল, গণেশ চন্দ্র সাহা, শহিদুল ইসলাম খান সেলিম, আইউব আলী হাওলাদার, সিতারা বেগম, রানী বেগম, মো: মোস্তফা, আব্দুল লতিফ হাওলাদার, অনিল চন্দ্র মন্ডল এবং  অজিত কুমার শীল। 
১৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দী  তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহন বিষয়ক আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, তাদের  হাজির না করা বিষয়ে প্রসিকিউশন যে কারণ  দেখিয়েছে তা সন্তোষজনক ।   এছাড়া অন্য সাক্ষীদের জবানবন্দী   সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহনের আবেদন বাতিল করা হল।

ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেন,  তদন্ত কর্মকর্তার দুটি রিপোর্ট হাজির করে প্রসিকিউটর সঠিকভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, একজন সাক্ষী গুরুতর অসুস্থ এবং তার পক্ষে ঢাকায় ভ্রমন করা দুরুহ ব্যাপার।

সাঈদীর পক্ষাবলম্বনকারী অস্ত্রধারী গ্রুপ কর্তৃক অন্যান্য  সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখানো এবং বাড়ি থেকে পলায়নে বাধ্য করা বিষয়ে  বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা যে রিপোর্ট দিয়েছেন তাও সন্তোষজনক  হিসেবে আখ্যায়িত করেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, “এর প্রেক্ষিতে  আমরা ১৫ জন সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা এভিডেন্স হিসেবে গ্রহনের আদেশ দিচ্ছি।”

ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষনে বলেন, আমরা বুঝতে পেরেছি  অভিযুক্তের পক্ষে লোকজন সাক্ষীদের সাথে কথা বলছেন। তারা শুধু কথাই বলছেননা বরং তারা যাতে সাক্ষী দিতে না আসেন সে বিষয়ে ভয়ভীতিও প্রদর্শন করছেন। দৈনিক নয়া দিগন্ত  পত্রিকার সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারকে সতর্ক করার সময় ট্রাইব্যুনাল এ পর্যবেক্ষনমূলক মন্তব্য করেন।
ট্রাইব্যুনাল আদেশে আরো বলেন, যে ১৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হল তা জেরা ছাড়া গ্রহণ করা হয়েছে সেটি ট্রাইব্যুনাল মনে রাখবে এবং জেরা ছাড়া এ জবানবন্দী কতটুকু মূল্য বহন করে তাও মাথায় রাখা হবে।

৪৬ অনুপস্থিত সাক্ষীর  জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার আবেদনের ওপর গত ২৭ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী  সৈয়দ হায়দার আলী  বক্তব্য উপস্থাপন  করেন।  বক্তব্যে সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখানো, খুন জখমের হুমকি দেয়ার অভিযোগ করা হয়। এসব কারনে  সাক্ষী   খুঁজে না পাওয়া, আত্মগোপনে চলে  যাওয়ার কথা জানান তিনি। এছাড়া  একজন সাক্ষীর অসুস্থতার তথ্য তুলে ধরেন। 

এ আবেদনের বিরোধীতা করে আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ২৮ মার্চ যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি অভিযোগ করেন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় প্রসিকিউশন সাক্ষী আনতে পারেনি। অনুপস্থিত এসব সাক্ষীর যে জবানবন্দী জমা দেয়া হয়েছে তা তদন্ত কর্মকর্তার মনগড়া বক্তব্য। সাক্ষী হাজির না করা বিষয়ে  রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী যে কারণ দেখিয়েছেন তা বানোয়াট এবং বাস্তবতা বিবর্জিত। এর পক্ষে তারা কোন  প্রমান হাজির করতে পারেননি এবং আইনেরও বিরোধী এ আবেদন।
          ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আদালতে  কয়েকজন সাক্ষীর বিষয়ে তথ্য উপস্থাপন করে বলেন, তারা এলাকায় আছেন, স্বাভাবিক কাজকর্ম করছেন। তাছাড়া শাহরিয়ার কবির, জাফর ইকবাল, জুয়েল আইচ, মেজর জিয়াউদ্দিন এর মত নেতৃস্থানীয় সাক্ষীগন কেন আসবেননা সে বিষয়ে কারণ দেখাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। 

আসামী পক্ষের আইনজীবীর প্রতিক্রিয়া:
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালের আদেশ শেষে সাংবাদিককদের বলেন,  পুলিশের বক্তব্য গ্রহণ করে ১৫ জনের জবানবন্দী ট্রাইব্যুনাল সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করেছে। প্রসিকিউশনের আবেদনটি ছিল একটি  জংলী আবেদন। আমরা  আগেই বলেছি এ

ধরনের আবেদন গ্রহণ করা হলে  ন্যায় বিচারের কবর রচিত হবে।  ট্রাইব্যুনাল আমাদের বক্তব্য গ্রহণ না করে প্রসিকিউশনের বক্তব্য গ্রহণ করে ১৫ সাক্ষীর পুলিশের তৈরি করা জবানবন্দী গ্রহণ করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরণের নজির নেই যে, পুলিশের কাছে দেয়া সাক্ষ্যকে জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পুলিশের আচার আচরণ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়না। এ বিষয়ে তিনি শাহরিয়ার কবিরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা তাকে সাক্ষি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।  অথচ দৈনিক জনতা পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে শাহরিয়ার কবির বলেছেন, তিনি  পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি দেননি।  তদন্ত কর্মকর্তা মিথ্যা বলেছেন। শাহরিয়ার কবির বলেছেন, তিনি মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে কোন সাক্ষী নন। 
মিজানুল ইসলাম বলেন, তিনি আরো বলেন, তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করা হলে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ছাড়া অন্য কিছু পাওয়ার সুযোগ নেই।

ট্রাইবুনালের এই আদেশের বিরুদ্ধে আমাদের উচ্চ আদালতে যাওয়ার এই মুহুর্তে সুযোগ নেই। তবে এই আদেশের বিরুদ্ধে আমরা রিভিউ (পুনঃবিবেচনা) আবেদন করব। তিনি বলেন, মিথ্যা বানোয়াট এবং যা হয়নি তা দিয়ে সাক্ষীদের নামে জবানবন্দী  তৈরি করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা যে মনগড়া  বক্তব্য সাজিয়ে জবানবন্দী তৈরি করেছেন তার প্রমান আমরা আগেও পেয়েছি। পূর্বের অনেক সাক্ষী বলেছেন তারা এ তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দেননি।  তিনি আরো বলেন, ট্রাইব্যুনালের এই আদেশ বহাল থাকলে ন্যায় বিচার পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।


          নয়া দিগন্তকে সতর্ক করল ট্রাইব্যুনাল:
          গত ২৭ মার্চ দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত “মা বলেছেন, মরার আগে হুজুরের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলতে পারবনা। সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় হাজির করা গেলনা সাক্ষীদের” রিপোর্ট বিষয়ে আজ ট্রাইব্যুনাল বলেছেন এটি অতিশয় অবমাননাকর। আমরা এ রিপোর্টের কারনে নয়া দিগন্ত কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের প্রতি নোটিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তবে  ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের আবেদনের প্রেক্ষিতে আমরা পক্ষকে নোটিশ পাঠানো থেকে বিরত থাকলাম।

          ট্রাইব্যুনাল বলেন, বিচারাধীন বিষয়ে একজন সাংবাদিক কিভাবে সাক্ষীর সাথে কথা বলে রিপোর্ট করেন  তা ভেবে আমরা বিস্মিত। নয়া দিগন্তের সাংবাদিক সাক্ষীর কাছে গিয়ে কথা বলেছেন এবং সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে কথা  বলেছেন তা ছেপে দিয়েছেন। ডিটেইলস রিপোর্ট করেছেন। দৈনিক নয়া দিগন্তের সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারকে সতর্ক করে দিয়ে বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, আমি তার নাম বলতে চাইনা।  তিনি বলেন, এ ধরনের  রিপোর্ট  ট্রাইব্যুনালের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় ।      বিচরাধীন বিষয়ে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে আরো  সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন