বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৩

তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দী

মেহেদী হাসান, ১৭/৪/২০১২
২৫ মার্চ ১৯৭১। পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে অপরাশেন সার্চ লাইটের  নামে বাঙ্গালী নিধন ও হত্যাযজ্ঞের সূচনা করে। রাত্রি অনুমান সাড়ে ১১টার সময় ঢাকাসহ সারা দেশে কামান, রাইফেল গ্রেনেড ইত্যাদি আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা আক্রমন চালায়। কামান ও মটারের মুহুর্মুহু আক্রমনে প্রকম্পিত হতে থাকে সমগ্র ভূবন, ( এসময় বিচারপতি একেএম জহির আহমেদ কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সমুগ্র ভূবন! তখন হেলাল উদ্দিন বলেন সমগ্র বাংলাদেশ এবং ভূবনের বদলে বাংলাদেশ রেকর্ডভুক্ত করা হয়।) । অন্তরাত্মা কাপানো সেইসব গোলার  আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হয় নিরীহ জনগনের বাড়িঘর, বাজার অফিস আদালত বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহ এমনকি নি®প্রাণ শহীদ মিনার। মেশিনগান ও স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের অবিরাম গুলি বর্ষনে বিদীর্ণ হতে থাকে নিরীহ পথচারী। প্রধান সড়কগুলোর আশপাশের গৃহবাসী, বস্তি, বাজার, ফুটপাথ, বিভিন্ন টার্মিনাল ও স্টেশনে আশ্রয়প্রার্থী জনগন, পুলিশ, ইপিআর, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও আবাসিক এলাকায় অবস্থানরত ছাত্র শিক্ষক কর্মচারী। অপরারেশন সার্চ লাইটের নামে পাক হানাদার বাহিনী সারা দেশে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে  ঢাকা শহরকে একটি লাশের নগরীতে পরিনত করে।
পাক সেনাবাহিনীর একটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল), জগন্নাথ হলের সব ছাত্রকে হত্যা করে। হত্যার আগে তাদের দিয়েই জগন্নাথ হলের সামনে একটি গর্ত করানো হয়। সেখানে তাদের মৃতদেহ মাটিচাপা দেয়া  হয়। এ নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের দৃশ্য বুয়েটের প্রফেসর নুরুল উল্লাহ ভিডিও করেছেন এবং তা ইন্টারনেটে ও মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভে  সংরক্ষিত আছে।
পাক হানাদার বাহিনী বিভিন্ন অঞ্চল হতে মহিলাদের ধরে এনে ক্যাম্পে আটকে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছে।

প্রথম গুলিবর্ষনের প্রাক মুহূর্তে পাক রেডিওর কাছাকাছি  একটি তরঙ্গ হতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষনা প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। অত্যন্ত ক্ষীনকন্ঠে  ঘোষনায় উচ্চারন  করেন (এসময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন ক্ষীন কণ্ঠে ঘোষনা নয় বরং ঘোষনাটি ক্ষীনভাবে শোনা যায় বলেন। পরে সেভাবেই লিপিবদ্ধ করা হয়। )

“এই হয়ত আপনাদের জন্য আমার শেষ বানী হতে পারে। (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী বানীর স্থলে বার্তা  বলতে বলেন)। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানে আছ এবং যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ মুহুর্ত  পর্যন্ত  দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়ায় পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। ”
স্বাধীনতা ঘোষনার পর  মুহূর্তে পাক  দখলদার বাহিনীর লে. কর্ণেল জেড এ :খান ও মেজর হেলালের নেতৃত্বে এক প্লাটুন কমান্ডো রকেট লেঞ্চারের আঘাতের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমন করে এবং গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাঙ্গালি জাতি মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে । একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আকাঙ্খা এই দেশের মানুষের বুকের মাঝে জাগিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তান কারাগারে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে যে মানুষটি এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি হলেন তাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি তার পরিবারের সবাইকে তাদের নিজের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে ৩০ মার্চ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে  ভারতে আশ্রয় নেন। তখন তার সাথে ছিলেন তরুন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম।  পরে তিনি সবার সাথে যোগাযোগ করে মুজিবনগরে  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। মুজিবনগর হতে ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সনদ ঘোষনা করা হয়। এই সনদ দিয়েই বাংলাদেশ নৈতিক এবং আইনগতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই নতুন রাষ্ট্রের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি  ও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হন।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে (মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায় )বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে শপথ গ্রহণ  করে (এসময় পর্দায় মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান দেখানো হয় ) । এরপর হতেই শুরু হয় গণযুদ্ধ।
পাক দখলদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের  প্রতিটি গ্রামে অত্যাচার  চালাতে থাকে। বাংলাদেশের বহু জনগণ এই হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় এবং প্রায় এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। এরপরও পুলিশ, ইপিআর, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদের সদস্যসহ বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম  হতে ছাত্র যুবকম শিক্ষক কৃষক  শ্রমিক সকল শ্রেণীর লোকজন দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে যোহ দেয় এবং পাক হানাদার বাহিনীর  বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। তখন পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য  শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল শামস নামে সহযোগী বাহিনী গঠন করে। তারা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অস্বীকার করে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্য দেশের মধ্যে হত্যা, গণহত্যা, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধসহ সকল প্রকার অপরাধ করতে থাকে।

পাক হানাদার বাহিনী সর্বত্র ইসলামের নামে ও পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার নামে স্থানীয় দোসরদের নিয়ে  গঠিত শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল শামস ইত্যাদি বাহিনীর সহযোগিতায় হিন্দু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকেত নিশ্চিহ্ন করার জন্য বাঙ্গালী জাতিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী,  দুষ্কৃতকারী, ইসলাম বিরোধী, ভারতীয় অনুচার ব্রাক্ষ্মন্যবাদের দালাল ইত্যাদি উল্লেখপূর্বক নিরপরাধ, নিরস্ত্র অসহায় মানুষকে  নির্বিচারে হত্যঅসহ ব্যাপক গণহত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষন, বাড়িঘর দোকান পাট, ব্যাংক ইত্যাদি জ্বালাও পোড়াও ও ধ্বংস করে। বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ   করে। যার ফলে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়। চার লাখ  মা বোন ইজ্জত হারায় এবং  প্রায় এক কোটি লোক গৃহহারা  সহায় সম্বলহীন অবস্থায় শরনার্থী হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব ঘটনা এটিএন বাংলা ‘মুুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ নামে একটি সিডি তৈরি করে যা আমি তদন্তের সময় সংগ্রহ করি। (এসময় বিচারপতি নিজামুল হক বলেন সিডি  তৈরি করে না প্রামান্য চিত্র তৈরি করে? তখন তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, প্রামান্য চিত্র।   কিন্তু আপনি কি বলেছেন? এরপর তা প্রামান্য চিত্র হিসেবে লেখা হয়।  এরপর এটিএন বাংলার দুই ঘন্টার প্রামান্য চিত্রটি আদালতে প্রদর্শন করা হয় বড় পর্দায়। )

চার এপ্রিল ১৯৭১ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীর গোলাম আযম সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী জমিয়তে ইলামায়ে ইসলামের সভাপতি মহসিন উদ্দিন আহমেদ অ্যডভোকেট সাদী গভর্নর টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন এবং এ লক্ষ্যে পিস কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। পিস কমিটি গঠনের পর ১৬ এপ্রিল ১৯৭১ সন্ধ্যায় নুরুল আমিনের নেতৃত্বে গোলাম আযমসহ অন্যান্য সদস্যরা গভর্নর হাউজে টিক্কা খানের সাথে মিলিত হন। গোলাম আযম উক্ত বৈঠকে বলেন,  জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ঐক্য ও অখন্ডতার  স্বার্থে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে আছে। গোলাম আযম পাকিস্তান আর্মির কর্মকান্ডকে সমর্থন করে জনগণকে সাহায্যের জন্য বক্তব্য প্রদান করে বলেন যে, ইসলামের পূণ্যভূমি  পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য আর্মির সাথে তারা আছেন।
১৯৭১ সালের মে মাসে মাওলানা একেএম ইউসুফের নেতৃত্বে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে খুলনায় আনসার ক্যাম্পে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। 
আগস্ট ১৯৭১ সালে সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ রাজাকার বাহিনীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করে। মাওলানা ইউসুফ এ বাহিনীর নামকরন করেন  রাজাকার বাহিনী। ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাদের রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া হয়। শান্তি কমিটির মাধ্যমে রাজাকারদের রিক্রুট করা হয় । এ বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য ছিলেন মাদ্রাসার মোহাদ্দিস এবং মোদাচ্ছির (তখন বিচারপতি নিজামুল হক বলেন মোহাদ্দিস আর মোদাচ্ছির মানে কি। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রপক্ষের  আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলীও এর উত্তর দিতে পারছিলেননা। সৈয়দ হায়দার আলী মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেন মোহাদ্দিস মানে কি হাদিস বিশেজ্ঞ না যে শিক্ষক হাদিস পড়ান ? তখন মিজানুল ইসলাম বলেন যিনি  হাদিসের ব্যাখ্যা করেন তিনি মোহাদ্দিস আর যিনি কোরানের ব্যাখ্যা করেন তিনি মোদাচ্ছির।)
এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের  ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে  সুবিস্তৃত হয়ে ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে ইতিহাসে ভয়াবহতম গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছে  গোলাম আযম তার নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী ও সমর্থকবৃন্দ। বস্তুত সামরিক জান্তার চেয়ে এই  তথাকথিত শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী গণহত্যায় আরো বেশি অবদান রাখে। সেনাবাহিনী যে জনপগে গেছে সেখানেই বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। কিন্তু শান্তি কমিটি ও রাজাকাররা খুন করেছেন সুনির্দিষ্ট তালিকা  প্রস্তুতির মাধ্যমে অত্যন্ত নৈপুন্যের সাথে। শান্তি কমিটি ও রাজাকাররা নিজের হাতে খুন ধর্ষণ, লুটতরাজ  ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সংঘটন করে।
পাক দখলদার বাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর লোকেরা ২৫ মার্চ ১৯৭১ হতে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩০ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা এবং  চার লাখ  মা বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে। প্রায় এক কোটি লোক ভারতে শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত পিরোজপুর মহকুমায় বর্তমানে পিরোজপুর জেলায় পাক হানাদার বাহিনীকে সহাযোগিতা করা, পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা, মুক্তিবাহিনীকে ধ্বংস করার নামে গণহত্যা পরিচালনা করা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ মানবতাবিরোধী অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধ সংঘটনের লক্ষ্যে খান বাহাদুর সৈয়দ মো: আফজালকে  পিরোজপুর মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান  করে অন্যান্যদের নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি কমিটি গঠনের পর  হতে তাদের অত্যাচার নির্যাতন আর হত্যাযজ্ঞের কারনে  শহরের মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে গ্রামে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকে।

এ পর্যন্ত বলার পর বিচারপতি নিজামুল হক  তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেন একটু শটকার্ট করে আগামীকাল আসেন। এভাবে বললে তো জীবনেও শেষ হবেনা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন