বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৩

সেফ হাউজের দায়িত্বরত সকল ব্যক্তিবর্গ নথিপত্র তলব ট্রাইব্যুনালে

মেহেদী হাসান, ৩/৬/১২, রোববার
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষীদের ঢাকা এনে রাখা হয় যেখানে সেই সেফ হাউজ বা সাক্ষী হাউজের সমস্ত  নথিপত্র এবং দায়িত্বরত সকল ব্যক্তিবর্গকে ট্রাবইব্যুনালে  তলব করা হয়েছে।  আগামী ৭ জুন তাদের ট্র্াই্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে। ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইবু্যুনাল -১ আজ  এ আদেশ দেন।

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আইনজীবীদের পক্ষ থেকে সেফ হাউজে সাক্ষীদের  অবস্থান সম্পর্কিত   মোট পাঁচশত ৫০ পৃষ্ঠার তিনটি ডাইরি গতকাল ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়ায় ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দিলেন।

১৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দী তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহনের আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা হয়েছিল মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের পক্ষ থেকে। গতকাল এ বিষয়ে দ্বিতীয় দফা শুনানীর জন্য  ধার্য ছিল।

শুনানীর শুরুতে আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার  আব্দুর রাজ্জাক  সেফ হাউজের পাঁচশত পৃষ্ঠার  তিনটি ডাইরি ডকুমেন্ট আকারে দাখিল করেন ট্রাইব্যুনালে। ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে লিখিত জবাবে বলা হয়েছে এ জাতীয় কোন সেফ হাউজ তাদের নেই এবং এ ধরনের কোন ডাইরিও সেখানে মেনটেন করা হয়না। কিন্তু আমরা দেখাচ্ছি যে, সেফ হাউজ আছে এবং সেখানে ডাইরি মেনটেন করা হয়। কোন সাক্ষী কবে আসেন, কবে ফেরত যান, কয়বেলা খাবার খান, সেখানে কারা দায়িত্ব পালন করেন তার সব বিবরন এ ডাইরিতে আছে।  এমনকি কোন কোন সাক্ষীকে প্রসিকিউশনের রুমে পর্যন্ত আনা হয়েছিল।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, তিনটি ডাইরি রয়েছে আমাদের ডকুমেন্টে। একটি সাধারন ডাইরি, একটি হাজিরা ডাইরি এবং একটি খাবার সংক্রান্ত ডাইরি। ওনারা বলছেন খাবার বিষয়েও কোন  ডাইরি নেই। আমরা বলছি আছে। আপনাদের সামনে তা জমা দিয়েছি।  আব্দুল লতিফ নামে একজন সাক্ষী সম্পর্কে তারা বলছেন কোনদিন সে ঢাকায় আসেননি। কিন্তু আমরা দেখাচ্ছি, ডাইরিতে উল্লেখ আছে  সে ঢাকায় এসেছিল।
কোন সাক্ষী কবে আসেন, কবে যান, তাদের সবকিছুর বিবরন এখানে আছে। তারা বলছেন এ জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমরা বলছি আছে। এসব ডকুমেন্ট এখন ফেসবুক ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে।
এসব ডকুমেন্ট জমা দেয়ার পর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাড়াচাড়া করে দেখেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, ইউ হ্যাভ রিসিভড রিপলাই নাউ।
এরপর বিচারপতি নিজামুল হক সেফ হাউজের ঠিকানা পড়ে বোঝার চেষ্টা করেন এটির অবস্থান কোথায়। এপর তিনি প্রশ্ন করেন,  আমারা সাক্ষীদের নিরাপত্তার  জন্য এবং থাকার  যে সেফ হাউজের অনুমতি দিয়েছি এটা কি সেই সেফ হাউজ?
ব্যারিস্টার  আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ সেফ হাউজটি  গোলাপবাগে অবস্থিত।

গোলাপবাগ  কোথায় কোন থানায় অবস্থিত এ নিয়ে কথাবার্তা চলার এক পর্যায়ে বিচারপতি নিজামুল হক তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনকে বেশ ক্ষোভের সাথে বলেন, মি. আইও, গিভ আজ দি এডড্রেস অব সেফহাউজ। হু অয়ার ইন চার্জ? গিভ আজ এভরি পার্টিকুলার অব এভরিওয়ান হু অয়ার ইন রেসপনসিবল অব দি হাউজ।  (মি. তদন্ত কর্মকর্তা. সেফহাউজের ঠিকানা দেন আমাদের। সেখানকার  ইনচার্জ কে? কারা কারা সেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের সবার সম্পর্কে সবকিছু আমাদের জানান। )
এরপর বিচারপতি নিজামুল হক ক্ষোভের সাথে বলেন বিচার পরে করব । আগে এটা দেখে নেই।
এরপর বিচারপতি নিজামুল হক বেঞ্চ অফিসারকে ডেকে অর্ডার ডিকটেট করেন।
আদেশে তিনি বলেন, সেফহাউজের ইনচার্জসহ সেখানে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের সবাইকে আগামী ৭ জুন ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে হবে। সেফহাউজের সমস্ত নথিপত্রও দাখিল করতে হবে। আসামী পক্ষ থেকে সেফ হাউজের যে ডকুমেন্ট দাখিল করা হয়েছে সে বিষয়ে  জবাব দিতে হবে। তিনি তদন্ত কর্মকর্তার প্রতি নির্দেশ দিয়ে বলেন, আপনি তাদের হাজির হওয়া বিষয়ে জানাবেন এবং তাদের হাজির করার বিষয়ে  ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।  এ বিষয়ে আর কোন লিখিত নোটিশ প্রদান করা  হবেনা।
এসময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, সেফ হাউজ বলতে আমাদের কিছু নেই। তারা সেফ হাউজের নামে যে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন এই রিপোর্ট আমাদের না। এটি তাদের প্রডাকশন। হতে পারে এটি তাদের প্রডাকশন। তিনি সেফ হাউজের বদলে  উইটনেস হাউজ বা সাক্ষী হাউজ লেখার দাবি জানান।

আদেশ শেষে ব্যারিস্টার  আব্দুর রাজ্জাক  সাংবাদিকদের বলেন, তারা বলছেন সেফ হাউজ, ডাইরি এসব কিছু নেই। এটা মিথ্যা এবং প্রতারনার শামিল। আমরা আদালতে সেফ হাউজ বিষয়ে ডকুমেন্ট দাখিল করে দেখিয়েছি এসব ছিল।

গত ২০ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে  ৪৬ জন  সাক্ষীর একটি তালিকা দিয়ে আদালতে দরখাস্ত করে বলা হয় এদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা আদৌ সম্ভব নয়। তাই তারা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা তাদের অনুপস্থিতিতে  সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহন করার আবেদন করা হয়।
১৫ জন জন সাক্ষীর  জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন  করে ২৯ মার্চ আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের  পক্ষ থেকে  ২০ মার্চ  দাখিল করা আবেদনে সাক্ষী কেন আদৌ  করা সম্ভব নয় তার কারণও উল্লেখ করা হয় ।   পাঁচজন সাক্ষী  হাজির করতে না পারা বিষয়ে বলা হয়েছে তারা নিখোঁজ।  ১৪জন সম্পর্কে  উল্লেখ করা হয় তাদের  খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। নিখেঁাঁজ  পাঁচ জনের তিনজন সম্পর্কে উল্লেখ করা হয় তারা গোপনে  ভারতে পালিয়ে গেছে । একজন সম্পর্কে বলা  হয় তার স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে, ভ্রমনে মুত্যৃর ঝুকি রয়েছে।  নিখোঁজ  কয়েকজনস সাক্ষী সম্পর্কে বলা হয় মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সন্ত্রাসীদের ভয়ে  তারা বাড়িছাড়া।

২৯ মার্চ ট্রাইব্যুনাল  যে ১৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দী তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে আদেশ দেন সে আদেশ পুনবিবেচনার আবেদন করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী।   আবেদনে বলা হয় সাক্ষী হাজির করতে না পারা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যে কারণ উল্লেখ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানানো গল্প। এসব সাক্ষীরা মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজী না হওয়ায় তাদেরকে আদালতে হাজির করেনি প্রসিকিউশন।  সাক্ষীদের অনেকে তাদেরই হেফাজতে সেফ হাউজে ছিল ।

গত ২২ মে ১৫ জন সাক্ষী বিষয়ে পুনবিবেচনা আবেদনের ওপর প্রথম  শুনানী হয় ।  হাজির করা সম্ভব নয় বলে  বর্নিত ৪৬ জন সাক্ষীদের অনেকেই যে  রাষ্ট্রপক্ষের হেফজতে ছিল সে বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রমান আদালতে হাজির করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা। তিনজন সাক্ষীর ভিডিও দেখানো হয় ঐদিন আদালতে  । অন্য অনেকের বিষয়ে  আদালতে তথ্য প্রমান দাখিল করে  সাক্ষীদের নাম ধরে ধরে

বলা হয় তাদের মধ্যে কে কবে সেফ হাউজে আসেন, কবে বাড়িতে যান, কে কয়বেলা খাবার গ্রহণ করেন। কাকে  কবে সেফ হাউজ থেকে প্রসিকিউশনের রুমে পর্যন্ত আনা হয়েছিল তাও  উল্লেখ করা হয়।  ৩ জন সাক্ষী  সম্পর্কে  দিন তারিখ উল্লেখ করে বলা হয় তারা দুই দফায়  ৪৭ দিন পর্যন্ত সেফ হাউজে ছিল রাষ্ট্রপক্ষের  আইনজীবীদের হেফাজতে। অন্য অনেক সাক্ষী সম্পর্কে তথ্য প্রমান উপস্থাপন করে বলা হয় তারা কেউ কেউ   বাড়িতে আছেন, স্বাভাবিক কাজ কর্ম করছেন।

১৫ সাক্ষী বিষয়ে রিভিউ আবেদনের ওপর গত ২২ মে শুনানীর পর আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের কাছে জানতে চান তারা এ  অভিযোগের বিরুদ্ধে কোন লিখিত জবাব দেবেন কিনা। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলীর সম্মতিতে লিখিত জবাব দেয়ার জন্য সময় দেয়া হয় তাদের। তারা জবাব দাখিল করার পর গতকাল এ বিষয়ে শুনানীর জন্য ধার্য্য ছিল।

দুই সাক্ষীকে পুনরায় জেরার অনুমতি: মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে দুজন সাক্ষীকে পুনরায় জেরার অনুমতি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এরা হলেন মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার এবং অপর সাক্ষী মানিক পসারী। মাওলানা সাঈদীর পক্ষ থেকে মোট তিনজন সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার আবেদন জানানো হয়। অপরজন ছিলেন রুহুল আমিন নবীন। তবে তাকে পুনরায় ঢাকা  এনে হাজির করার অনুমতি দেয়া হয়নি।

কেন সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার আবেদন করা হয়েছিল এ বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা  এমন কিছু বিষয় আদালতে প্রদর্শন করেছেন  যা ঐসব সাক্ষীদের জবানবন্দীতে ছিলনা। সে বিষয়ে ন্যায় বিচারের সার্থে তাদের জেরা করা দরকার।   পুনরায় জেরার অনুমতি দেয়া হয়নি রুহুল আমিন নবীন সম্পর্কে  তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি বলেছিলেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স। আমরা ডকুমেন্ট সংগ্রহ করেছি যে, তিনি পরীক্ষায়  বহিষ্কার হয়েছিলেন এবং  অনার্স পাশ করেননি।

দুজন সাক্ষীকে ঢাকা এনে পুনরায় জেরা করা বিষয়ে তাদের জন্য  মোট পাঁচ হাজার টাকা খরচ বাবদ ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়ার জন্য আসামী পক্ষকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আগামী ১৫ জুনের মধ্যে দুজন সাক্ষীকে  হাজির করতে বলা হয়েছে।
বিচারপতি একেএম জহির আহমেদ আজ  এ বিষয়ে আদেশ দেন। এসময়  চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক ছাড়া অপর বিচারপতি আনোয়ারুল হক উপস্থিত ছিলেন।
ব্যারিস্টার  আব্দুর রাজ্জাক, তাজুল ইসলাম ছাড়াও  মাওলানা সাঈদীর পক্ষে  উপস্থিত ছিলেন মিজানুল ইসলাম, মনজুর  আহমেদ আনছারী, ব্যারিস্টার তানভীর  আল আমিন, ব্যারিস্টার এমারন সিদ্দিক, ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিক, শিশির মনির প্রমুখ আইনজীবী।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন