বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

হাজী মো : মোবারক হোসেন এর বিরুদ্ধে নবম সাক্ষীর জবানবন্দী এবং জেরা সম্পন্ন

৪/৯/২০১৩
হাজী মো : মোবারক হোসেন এর বিরুদ্ধে আজ নবম সাক্ষীর জবানবন্দী এবং জেরা সম্পন্ন হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ।

জবানবন্দী :
আমার নাম ভানু বিবি, আমার বয়স আনুমানিক ৭০ বৎসর। আমার ঠিকানা-গ্রাম- টানমান্দাইল, থানা-আখাউড়া, জেলা-ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া।
আমি একজন গৃহিনী। সংগ্রামের বৎসরের ৫ই ভাদ্র তারিখ সকাল অনুমান ১০.০০/১১.০০ টার দিকে মোবারক আলী আমাদের বাড়ি এসে আমার শ্বশুর নূর বক্স হাজী, স্বামী এবং ভাসুর আবুল বাশারকে জানায় যে, আমাদের বাড়িতে শান্তি কমিটির মিটিং বসবে তোমরা সকলে উপস্থিত থাকবা, যদি না থাক তাহলে তোমাদের অসুবিধা হবে। বিকাল বেলায় আসরের সময় ১৩০/১৩৫ জন লোক মিটিং করে। মোবারক আলী, তার সাথের লোকজন এবং পাঞ্জাবীরা মিলে মিটিং শুরু করে, এক পর্যায়ে বাড়িতে থাকা গ্রামের লোকজনকে রশি দিয়ে বেঁধে নৌকায় উঠাইয়া গঙ্গা সাগর দিঘীর পাড় নিয়ে যায়। তারা আমার শ্বশুর, আমার ভাসুর, আমার স্বামী ও আমার দুই মামা শ্বশুরসহ বেঁধে গঙ্গা সাগর পাঞ্চাবীদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে তাদেরকে অনেক মার ধর করে এবং জিজ্ঞাস করে মক্কা শরীফ কে কে গিয়েছ হাত উঠাও। আমি আরো জানতে পারি যে, তাদের কিছু লোককে মসজিদে রাখে এবং কিছু লোককে গঙ্গা সাগর দিঘীর পশ্চিম পাড়ে নিয়ে তাদেরকে দিয়ে গর্ত করাইয়া গুলি করিয়া প্রায় ৩১ জনকে মেরে ফেলেছে। সেখানে আমার স্বামী ডাঃ আবু তাহের, আমার ভাসুর আবুল বাশার এবং মামা শ্বশুর গোলাম মাওলা ও গোলাম হাক্কানীকেও সেখানে মেরে ফেলে। আমার শ্বশুর যেহেতু মক্কা শরীফ গিয়েছিল সে কারণে তাকে ছেড়ে গিয়েছিল। তিনি বাড়িতে ফিরে এসে জানায় যে, মোবারক আলীর জন্যই এসকল লোকগুলো মারা গিয়েছে। এ ঘটনার দুই/তিন দিন পূর্বে তিন লাখ পীর ব্রীজ ভাঙ্গায় আমার স্বামী এবং আমার ভাসুর সাহায্য করেছিল, তারা দুইজনেই আওয়ামী লীগ করতো। আমি অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি।

জেরা ঃ
আমার স্বামী কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেছে এবং কসবা এসে ডাক্তারী করেছে। কসবাতে আমার স্বামীর চেম্বার ছিল। কসবায় আমার স্বামীর চেম্বার এবং আমাদের বাড়ীর দূরত্ব আনুমানিক দুই মাইল। আমার প্রথম ছেলের পিতার নাম ডাঃ আবু তাহের। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় আমার প্রথম ছেলে শাহ আলম এর বয়স ছিল ১২ বৎসর। আমার ছোট ছেলে রফিকুর ইসলাম দক্ষিন আফ্রিকাতে থাকে। রফিকুল ইসলামের পিতার নাম সুরুজ মিয়া। সংগ্রামের পরের বৎসর আমি সুরুজ মিয়াকে বিয়ে করি। ১৯৭১ সালে কুমিল্লার কোন মেডিকেল কলেজ ছিল তাহা জানিনা, তবে আমার স্বামী কুমিল্লাতে ডাক্তারি পড়তো। আমার পিতার বাড়ি কুমিল্লা জেলার চকবাজারে। আমার স্বামীর ডাক্তারির সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য দালিলিক প্রমানপত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় কসবার পুড়াইয়া ফেলেছে। ১৯৭১ সালে আমরা কসবা থানার যে পাড়ায় থাকতাম সে পাড়ার নাম সাহাপাড়া। এটি একটি হিন্দুপাড়া ছিল। ঐ হিন্দু পাড়া সংগ্রামের সময় পুড়াইয়া দেয় নাই, তবে আমার স্বামীর ডাক্তারির চেম্বারসহ বাজার পুড়াইয়া দিয়েছিল। সেই বাজারের নাম আমি জানিনা। কয়টি দোকান পুড়াইছে তাহা আমি বলতে পারবনা। আমার স্বামী, আমার ভাসুর ও আমার শ্বশুর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষনের জন্য যায় নাই, তবে কসবা সদর থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। আমার স্বামীর চেম্বারের পাশের দোকানটি কার ছিল তাহা আমি বলতে পারবনা। আমার স্বামী, শ্বশুড় এবং ভাসুর যে আওয়ামী লীগ করতো তাহা ১৯৭১ সালের পূর্বে কসবা এবং টানমান্দাইল এলাকার লোকেরা জানতো। আমার শ্বশুর বাড়ী টানমান্দাইল গ্রামে স্কুলের পূর্ব পাশে। সংগ্রামের সময় আমার শ্বশুড় বাড়ীর উত্তর দিকে কোন ঘর বাড়ি ছিলনা, তবে বর্তমানে আছে। পূর্ব দিকে ওহাব মাষ্টারের বাড়ি ছিল। পশ্চিম দিকে ঘর-বাড়ি ছিল অনেক দূরে। আমার শ্বশুর বাড়ির পশ্চিম দিকে কোন রাস্তা ছিল না নৌকাযোগে আসা যাওয়া করতো, তবে বর্তমানে চলাচলের রাস্তা আছে। এখন নৌকা অনেক দূর গিয়ে চলাচল করে। আমার শ্বশুড় বাড়ির পশ্চিম পাশে কোন নদী বা খাল ছিল না, তবে একটি ছড়া ছিল। আমার শ্বশুর বাড়ির পাশে একটি বাড়ি ছিল ওহাব মাষ্টারের বর্তমানে অনেক বাড়ি আছে। টানমান্দাইল থেকে তিনলাখপীর ব্রীজের দূরত্ব আনুমানিক একমাইল হবে। টানমান্দাইল থেকে তিনলাখপীর ব্রীজের মধ্যে অনেক গ্রাম আছে। ঐসব গ্রাম থেকে লোকজন আমাদের বাড়ির মিটিংয়ে এসেছিল। ঐসব গ্রামের লোকজনের নাম আমি বলতে পারবনা। যখন পাক আর্মিরা আসছিল তখন মিটিং চলছিল কিন্তু আমরা কোন চিৎকারের শব্দ শুনিনাই, ঐ মিটিংয়ে আমাদের বাড়িতে কোন মাইক লাগানো হয়নাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গঙ্গাসাগর এলাকায় গিয়েছিলাম। সংগ্রামের সময় আমাদের প্রতিবেশীসহ অনেক লোক মারা গিয়েছে। রাজাকার জমশেদকে আমি চিনি না। আমাদের বাড়িতে ঘটনার দিন ১৩০/১৩২ জন পাকিস্তানী আর্মি ও বাঙ্গালী এসেছিল। ঐ বাঙ্গালিরা আর্মির সাথেও এসেছিল এবং রাজাকারদের সাথেও এসেছিল। তারা আমাদের বাড়িতে এক/দেড় ঘন্টা ছিল। তারা আমাদের বাড়িতে বন্দুক নিয়ে এসেছিল, রশি নিয়ে আসে নাই। আমার শ্বশুড়কে মারধর করে নাই, তবে আমার ভাসুরের ছেলেকে মারধর করেছে। গঙ্গাসাগর আমার শ্বশুড়কে নিয়ে মসজিদে রেখেছিল আর আমার স্বামী ও ভাসুরসহ অন্যান্যদেরকে কাচারি ঘরে রেখেছিল। আমার শ্বশুরকে জিজ্ঞাস করিনি যে, কতজন মসজিদে ছিল আর কতজন কাচারি ঘরে ছিল। আমি কাচারি ঘর দেখেছিলাম। কাচারি ঘর ও মসজিদ পাশাপাশি। আমার শ্বশুর ফেরত আসার কথা শুনে গ্রামের লোকেরা আসে নাই, তবে মামা শ্বশুর গোলাম কাদের এসেছিল। গঙ্গাসাগর দিঘীর পাড়ে কাচারি ঘরে যাদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের মা বাবা আমার শ্বশুরের কাছে আসে নাই।
‘‘সংগ্রামের বৎসরের ৫ই ভাদ্র তারিখ সকাল অনুমান ১০.০০/১১.০০ টার দিকে মোবারক আলী আমাদের বাড়ি এসে আমার শ্বশুর নূর বক্স হাজী, স্বামী এবং ভাসুর আবুল বাশারকে জানায় যে, আমাদের বাড়িতে শান্তি কমিটির মিটিং বসবে তোমরা সকলে উপস্থিত থাকবা, যদি না থাক তাহলে তোমাদের অসুবিধা হবে” বা ‘‘ তারা আমার শ্বশুর, আমার ভাসুর, আমার স্বামী ও আমার দুই মামা শ্বশুরসহ বেঁধে গঙ্গা সাগর পাঞ্চাবীদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে তাদেরকে অনেক মার ধর করে এবং জিজ্ঞাস করে মক্কা শরীফ কে কে গিয়েছ হাত উঠাও” বা ‘‘আমার ভাসুর আবুল বাশার এবং মামা শ্বশুর গোলাম মাওলা ও গোলাম হাক্কানীকেও সেখানে মেরে ফেলে। আমার শ্বশুর যেহেতু মক্কা শরীফ গিয়েছিল সে কারণে তাকে ছেড়ে গিয়েছিল। তিনি বাড়িতে ফিরে এসে জানায় যে, মোবারক আলীর জন্যই এসকল লোকগুলো মারা গিয়েছে। এ ঘটনার দুই/তিন দিন পূর্বে তিন লাখ পীর ব্রীজ ভাঙ্গায় আমার স্বামী এবং আমার ভাসুর সাহায্য করেছিল, তারা দুইজনেই আওয়ামী লীগ করতো”- একথাগুলো আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলিনাই, ইহা সত্য নহে।
আমি ভন্ডপীর দারু মিয়ার পরামর্শে ও আব্দুল হামিদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে অর্থের লোভে এই মিথ্যা মোকদ্দমায় মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান কররি, ইহা সত্য নহে। মোবারক আলী কখনও আমাদের বাড়িতে যায় নাই, ইহা সত্য নহে। মোবারক আলী পাকিস্তানিদের সাথে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন