সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৩

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ তম সাক্ষীর জবানবন্দী জেরা

 ১৯/৮/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে আজ ১৬ তম সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ।

জবানবন্দী :
আমার নাম মোঃ জানে আলম ওরফে জানু, আমার বয়স অনুমান ৫৯/৬০ বৎসর। আমার ঠিকানাঃ সাং বৃশালিখা, থানা বেড়া, জেলা পাবনা।
১৯৭১ সালে আমি দশম শ্রেনীর ছাত্র ছিলাম। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, সেই ভাষণের পরে আমরা বেড়া বিপিন বিহারী হাইস্কুল মাঠে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও ট্রেনিং গ্রহণ করি। ১৫/২০ দিন ট্রেনিং নেওয়ার পরে আমরা বেড়া থানার পুলিশের নিকট থেকে ১৪টি রাইফেল ও স্থানীয় লোকজনের লাইসেন্স করা বন্দুক কেড়ে নিয়ে উত্তরবঙ্গের বগুড়া রোডে তৎকালীন ডাববাগান বর্তমানে শহীদনগরে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। ১৯৭১ সালের ১৯শে এপ্রিল দুপুরের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংগে আমাদের ডাববাগানে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে আমরা পিছু হটে বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে পালিয়ে চলে যাই। কয়েকদিন পর আমরা আবার সংঘবদ্ধ হয়ে কুড়িগ্রামের রৌমারী বর্ডার দিয়ে ভারতে চলে যাই। সেখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে আমরা আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশে প্রবেশ করে টাংগাইলের শাহাজানির চরে অবস্থান নেই। আমরা তখন সংখ্যায় ৫০/৬০ জন ছিলাম। আমরা তখন বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে চলে যাই, আমি যে গ্রুপে ছিলাম সেই গ্রুপটি শাহাজদপুরে দুগলী গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করে। ২রা ডিসেম্বর রাত্রি আনুমানিক ১০.০০ টার দিকে সোহরাব আমাদের ক্যাম্পে আসে এবং আমাকে বলে চলো গ্রাম থেকে লোকজনের সংগে দেখা করে আসি। ঐদিন রাত্রি আনুমানিক ১০.০০টার পরে আমরা রওনা দিয়ে গ্রামের লোকজনের সংগে দেখা করি এবং রাত্রি আনুমানিক ১.০০/১.৩০টার দিকে আমি আমার নিজ বাড়িতে পৌঁছি এবং অবস্থান করি। পরদিন ৩রা ডিসেম্বর রাত্রিতে আমার আব্বা-আম্মা যখন গরুর খাবার দিতে গোয়াল ঘরে যায় তখন দেখতে পান রাজাকার, আলবদর এবং পাক বাহিনী রাস্তা দিয়ে চলাচল করছিল। তখন আমার বাবা এসে আমাকে বলে পাক বাহিনী গ্রাম ঘিরে ফেলেছে তুমি তাড়াতাড়ি উঠে পালাও। তখন আমি বাড়ির পিছন দিক দিয়ে পালায়ে হুড়াসাগর নদী পার হয়ে ওপারে আমাদের ক্যাম্পে চলে যাই। ভোর বেলা দেখতে পাই আমাদের গ্রামের অনেক লোকজন নদী পার হয়ে ওপারে আশ্রয় নিয়েছে। পরদিন বেলা বারোটা/সাড়ে বারোটার দিকে রাজাকার ও পাক বাহিনী চলে যাওয়ার পরে আমরা কয়েকজন গ্রামে ফিরে আসি। গ্রামে ফিরে এসে শুনি সোহরাবকে বেয়নেট দিয়ে খুচায়ে খুচায়ে পরে গুলি করে হত্যা করে এবং গ্রামের আর কিছু লোক যেমন ষষ্টি, ভাদু, মনু, প্রফূল্ল, পিন্টু সহ আরও অনেককে হত্যা করেছে এবং আমাদের গ্রামের প্রায় ৭০/৭২টি বাড়িঘর আগুন দিয়ে পোড়ায়ে দেয়। আমাদের দেখে গ্রামের লোকজন প্রাইমারী স্কুলের সামনে জড়ো হয় তখন গ্রামের ময়মরব্বীদের মুখে শুনলাম তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের নির্দেশে সাথিয়া থানার রাজাকার আলবদরের কমান্ডার রফিকুন্নবী ওরফে বাবলু নেতৃত্বে স্থানীয় রাজাকার, আলবদর ও পাক বাহিনীরা এই হত্যাকান্ড, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেছে। আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত নাই, পরে কাঠগড়ার নিকট গিয়ে দেখেন তিনি ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ার মধ্যে চেয়ারে বসে আছেন (সনাক্তকৃত)।

জেরা
জবানবন্দী শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন মাওলানা নিজামীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। জেরায় বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী যে উত্তর দেন তা নিম্নরূপ :

ডাববাগান সাথিয়া থানার করমজা ইউনিয়নে অবস্থিত। ডাববাগান আমাদের বাড়ি থেকে দক্ষিন দিকে ১০ কি.মি. দূরে। টাংগাইলের শাহাজানির চর কালিহাতি থানার অধীন। আমাদের বাড়ি থেকে শাহাজানির চরের দূরত্ব নদী পথে আনুমানিক ৩০ কি.মি. পূর্ব-উত্তর কোনে। ১৯৭১ সালে নদীপথে নগরবাড়ি থেকে আরিচা যেতে ঘন্টা দুয়েক এবং ফেরত আসতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা সময় লাগতো। আমাদের বাড়ি থেকে কালিহাতি যাওয়ার জন্য অন্য একটি পথ সিরাজগঞ্জ-ভুয়াপুর হয়ে যাওয়ার কোন পথ ছিল কিনা তাহা আমার জানা ছিল না। আমাদের বাড়ি থেকে নগরবাড়ি ঘাটে যেতে আধা ঘন্টা সময় লাগতো। হেটে যেতে নদীপথে বা স্থলপথে তিন/চার ঘন্টা সময় লাগতো। আরিচা থেকে আমাদের শাহাজানির চরের দূরত্ব কত তাহা আমার জানা নাই। আমি আরিচা ঘাটে কোনদিন যাই নাই বিধায় আরিচা ঘাট থেকে শাহাজানির চরে যেতে কত সময় লাগে তাহা বলতে পারব না। টাংগাইলের কালিহাতি ১৯৭১ সালে সব সময় মুক্ত এলাকা ছিল। ভারত থেকে আসার পর আমরা শাহাজানির চরে ৩/৪ দিন ছিলাম। ডাববাগানের যুদ্ধের পর যারা সংগঠিত হয়ে ভারতে গিয়েছিল তাদের অনেকেই শাহাজানির চরে ফিরে নাই। শাহজানির চরে আব্দুস সেলিম লতিফ সাহেব আমাদের সঙ্গে ছিল। আমরা যখন শাহজাদপুরে ফেরত আসি তখন আমাদের সঙ্গে আব্দুস সেলিম লতিফ সাহেব আমাদের সঙ্গে ছিলেন না। তিনি শাহজানির চরে থাকার পরে কোন এলাকায় ছিলেন তাহা আমার জানা নাই। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি আমার নাম সম্বলিত যে মুক্তিযোদ্ধা গেজেট প্রকাশিত হয়েছে তাহা দেখেছি। আমার নামের তালিকার ক্রমিক নং ১৩৮৩ এবং মুক্তিযোদ্ধা মোফাখখারুল ইসলাম এর ক্রমিক নং ১৩৮১, তিনি আমাদের গ্রামের লোক। আমার পিতার নামের আগে মৃত শব্দটি লেখা আছে। আমি সবগুলি পর্যালোচনা করি নাই, তবে পিতা মারা গেলে অবশ্যই নামের আগে মৃত লেখা থাকবে। আমার নামের আগে ১৩৮২ নম্বর ক্রমিকে আব্দুস সেলিম লতিফের নাম থাকতে পারে। আব্দুস সেলিম লতিফের পিতার নামের পূর্বে মৃত বা শহীদ শব্দটি লেখা আছে কিনা তাহা আমি জানি না। ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর ছাত্র ইউনিয়নের বা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি বা সেক্রেটারী কে ছিলেন তাহা আমার জানা নাই। ন্যাশনাল ষ্টুডেন্ট ফেডারেশন নামে কোন ছাত্র সংগঠন ছিল কিনা তাহা আমি বলতে পারি না। ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি কে ছিলেন তাহা আমার জানা নাই। ১৯৭১ সালে ডিসেম্বর মাসে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি কে ছিলেন তাহা আমার জানা নাই। যে লোক আমাকে মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি থাকার কথা বলেছিল তার নাম আমার মনে নাই, কারন ৪২ বৎসর আগের ঘটনা। রফিকুননবী বাবলু কে যখন মতিউর রহমান নিজামী সাহেব হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের নির্দেশ দিয়েছিল তখন সেখানে কে কে উপস্থিত ছিল তাহা আমি জানি না এবং আমি আজ পর্যন্ত তাহা জানার চেষ্টা করি নাই। ৬ই ডিসেম্বর পাবনা মুক্ত হলে আমি এলাকায় ফেরত আসার পর সোহরাব সাহেবকে হত্যার অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছিল কিনা তাহা আমার জানা নাই। আমি ১৪ই ডিসেম্বর এলাকায় ফেরত আসি। আমার আগে নাকি পরে আব্দুস সেলিম লতিফ সাহেব ফেরত আসেন তাহা আমি বলতে পারব না। বেড়া থানার নগরবাড়ি ফেরিঘাটে আর্মি ক্যাম্প ছিল। ফেরিঘাট ছাড়া বেড়া থানা এলাকায় অন্য কোন আর্মি ক্যাম্প ছিল কিনা তাহা আমার জানা নাই। ১৯৭০-৭১ সালে বেড়া থানার আব্দুর রাজ্জাক রাজা মিয়ার লাইসেন্স করা বন্দুক আমি এনেছিলাম। অন্য কোন বন্দুকের লাইসেন্স ধারীর নাম আমি বলতে পারব না। আব্দুর রাজ্জাক রাজা মিয়া মুসলিম লীগ করতেন পরে শুনেছি ঐ সময় মুসলিম লীগ শব্দটি আমরা জানতাম না। উক্ত রাজা মিয়া বেড়া পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন কিনা তাহা আমার জানা নাই। আমাদের ইউনিয়নের পিস কমিটির কোন মেম্বারকে আমি চিনতাম না। পাবনার পিস কমিটির কোন লোককে আমি কখনও দেখি নাই ও চিনতাম না। বিজয় অর্জনের পর পর ইউনিয়নের কোন রাজাকার, আলবদরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল কিনা তাহা আমি জানি না। বিজয় অর্জনের পরে বেড়া কলেজে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। ঐ ক্যাম্প ১০/১৫ দিন স্থায়ী ছিল। ঐ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিল এস,এম আমীর আলী। আমার আব্বা যখন আমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন তখন ছিল রাত্রি এবং অন্ধকার। আর্মি এবং রাজাকাররা এসেছে একথা শুনলে লোকজন পালিয়ে যেত। সোহরাব সাহেবের বাড়ি থেকে যেখানে তাকে হত্যা করা হয় সেখানের দূরত্ব আনুমানিক ১০০০/১২০০ ফিট হবে। যে চৌরাস্তায় সোহরাব সাহেবকে হত্যা করা হয়েছিল তার উত্তর পাশে জোলা এবং বাড়ি ছিল, দক্ষিণ পাশেও বাড়ি ঘর ছিল। সোহরাব সাহেবকে হত্যা করতে কে দেখেছে এ রকম কোন লোকের নাম আমার জানা নাই। আমি যে তারিখে সোহরাব সাহেবকে হত্যার কথা বলেছি তিনি সেই তারিখে শহীদ হন নাই, ইহা সত্য নহে। সোহরাব সাহেব দেশ স্বাধীনের অনেক পরে মারা গিয়েছেন, ইহা সত্য নহে। তিনি ৩রা ডিসেম্বরেই মারা গেছেন।

.............................“পরদিন ৩রা ডিসেম্বর রাত্রিতে আমার আব্বা-আম্মা যখন গরুর খাবার দিতে গোয়াল ঘরে যায় তখন দেখতে পান রাজাকার, আলবদর এবং পাক বাহিনী রাস্তা দিয়ে চলাচল করছিল। তখন আমার বাবা এসে আমাকে বলে পাক বাহিনী গ্রাম ঘিরে ফেলেছে তুমি তাড়াতাড়ি উঠে পালাও। তখন আমি বাড়ির পিছন দিক দিয়ে পালায়ে হুড়াসাগর নদী পার হয়ে ওপারে আমাদের ক্যাম্পে চলে যাই। ভোর বেলা দেখতে পাই আমাদের গ্রামের অনেক লোকজন নদী পার হয়ে ওপারে আশ্রয় নিয়েছে। পরদিন বেলা বারোটা/সাড়ে বারোটার দিকে রাজাকার ও পাক বাহিনী চলে যাওয়ার পরে আমরা কয়েকজন গ্রামে ফিরে আসি। গ্রামে ফিরে এসে শুনি সোহরাবকে বেয়নেট দিয়ে খুচায়ে খুচায়ে পরে গুলি করে হত্যা করে” বা “আমাদের দেখে গ্রামের লোকজন প্রাইমারী স্কুলের সামনে জড়ো হয় তখন গ্রামের ময়মরব্বীদের মুখে শুনলাম তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের নির্দেশে সাথিয়া থানার রাজাকার আলবদরের কমান্ডার রফিকুন্নবী ওরফে বাবলু নেতৃত্বে স্থানীয় রাজাকার, আলবদর ও পাক বাহিনীরা এই হত্যাকান্ড, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেছে।” একথাগুলি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে।

অদ্য ট্রাইব্যুনালের ডকে একজন ব্যক্তিই উপস্থিত আছেন তিনি মতিউর রহমান নিজামী সাহেব এবং তাকে আমি গত কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় আমাদের এলাকায় দেখেছি। ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর তারিখে আমি মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের নাম প্রথম শুনেছি। আমি একজন আওয়ামী লীগের কর্মী। আমি মতিউর রহমান নিজামী সাহেব এবং ইসলামী ছাত্রসংঘকে জড়িয়ে অসত্য সাক্ষ্য প্রদান করেছি, ইহা সত্য নহে। (জেরা সমাপ্ত)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন