শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৩

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) ও ১৯৭৩ সালের আইনের তুলনা

Mehedy Hasan
জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০০২ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) ।  জেনেভার হেগে অবস্থিত এ   আন্তর্জাতিক আদালত চারটি বিষয়ে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এগুলো হল গণহত্যা,  মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ  এবং আগ্রাসনমূল অপরাধ । বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালের নাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অর্থাৎ বাংলাদেশের এ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক কিছু অপরাধের যথা গনহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ। বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের অপরাধ আইনের সাথে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তিনটি বিষয়ে মিল রয়েছে যথা গণহত্যা,  মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ  । বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালে যেহেতু বিচার্য প্রধান তিনটি বিষয়ে মিল রয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতের সাথে তাই  আন্তর্জাতিক আদালতের তুলনায় বাংলাদেশের  আইনের তুলনা করা এবং দুর্বলতাগুলো খুব সহজেই চোখে পড়ছে সবার। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিধানাবলীকে ভিত্তি বা স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে  ধরে  বাংলাদেশের অপরাধ আইনের  সমালোচনা করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং  আইনবিশেষজ্ঞরা।

এ প্রতিবেদনে  আন্তর্জাতিক আদালতের সাথে বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনের কিছু তুলনা তুলে ধরা হয়েছে। তবে তার আগে আন্তর্জাতিক আদালাতের বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করা দরকার।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে  সংঘটিত  মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা যাতে পার পেয়ে না যায় সেজন্য একটি আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠার দাবী ওঠে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। এ পেক্ষাপটে ১৯৯৮ সালের ১৭ জুলাই ইতালীর রোমে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে  যা রোম সংবিধি বা রোম স্ট্যটিউট নামে পরিচিত। এ রোম সংবিধির অধীনেই প্রতিষ্ঠা করা হয় আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি)। আদালত প্রতিষ্ঠার সময় শর্ত দেয়া হয় বিশ্বের ৬০টি দেশ যখন এর পূর্ণাঙ্গ সদস্য হবে তখন থেকে এ আদলত কার্যকর হবে। ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে এর সদস্য সংখ্যা ৬০  উন্নীত হয় এবং  ঐ বছরই ১ জুলাই থেকে এ আদালতের বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগের কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশ এ রোম সংবিধিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ তবে পূর্ণ সদস্য হবার জন্য যে রেটিফিকেশন বা অনুস্বাক্ষর করা দরকার তা করেনি।

কেবলমাত্র এ আদালত কার্যকর হবার দিন থেকে যদি কোথাও  এ ধরণের অপরাধ ঘটে তবে এ আদালত তার বিচার করতে পারবে। আদালত প্রতিষ্ঠার  আগে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার বিচারের ক্ষমতা নেই এ আদালতের। এছাড়া অন্য কোন অপরাধের ক্ষেত্রে   যে রাষ্ট্রে ঐ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সে দেশ যদি তার বিচার করে সেক্ষেত্রে এ আদালত আগ বাড়িয়ে কোন হস্তক্ষেপ করবেনা। সংশ্লিষ্ট দেশ  যদি বিচার  না করে এবং সদস্য রাষ্ট্র  যদি বিচারের জন্য আবেদন করে তবেই কেবল শেষ আশ্রয় হিসেবে এ আদালত তার বিচারের উদ্যোগ নেবে।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়টি সামনে আসায় শুরুতে অনেকেই এ আদালতের সাহয্য নেয়া বা এ আদালতের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে কথা বলেন। তবে ২০০৯ সালের  ডিসেম্বর মাসে

আইসিসির প্রধান বিচারপতি স্যাং হুন সং বাংলাদেশ সফরের সময় বলেছেন, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা এবং সে সুযোগও নেই।  সরকারকে ডিঙ্গিয়ে ৩৮ বছর আগের বিষয় নিয়ে কাজ করা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা।  এরপর থেকে এ অধ্যায়ের অবসান ঘটে।

আইসিসির বিচারিক ক্ষমতা

আন্তর্জাতিক ফৌজদারি  আদালত (আইসিসি)  বিশ্বের বিভিন্ন  প্রান্তে সংঘটিত চারটি বড় ধরণের অপরাধের বিচার করতে পারবে। এগুলো হল
১.    গণহত্যা
২.    মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
৩.    যুদ্ধাপরাধ এবং
৪.    আগ্রাসনজনিত অপরাধ

গণহত্যা
কোন জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়কে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের বিরুদ্ধে নিচের যেকোন একটি অপরাধমূলক কাজ পরিচালনা করলে তা গণহত্যার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে যথা-

ক. কোন সম্প্রদায় বা শ্রেণীর  সদস্যদের হত্যা করা
খ. সম্প্রদায় বা শ্রেণীর  সদস্যদের শারিরীক এবং মানসিকভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতি
    করা
গ. আংশিক বা পুরোপুরিভাবে কোন শ্রেণীকে ধ্বংস করার জন্য তাদের ওপর কোনকিছু
    চাপিয়ে দেয় বা জীবন বিপন্ন করে তোলার ব্যবস্থা করা।
ঘ. জন্মহার নিয়ন্ত্রন করার জন্য কোন পদ্ধতি  চাপিয়ে দিয়ে তাদের  নির্মূলের কৌশল গ্রহণ করা
ঙ. শিশুদের জোরপূর্বক এক গ্রুপ থেকে অন্য গ্রুপে স্থানান্তর করা।

মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
বেসামরিক জনসাধারণের ওপর যখন পদ্ধতিগতভাবে বা  ব্যাপকভাবে নিচের যেকোন একটি অপরাধমূলক কর্মকান্ড  পরিচালনা করা হয় তখন তাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্ণিত করা হবে যথা-

ক. হত্যা
খ. খাদ্য ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে বঞ্চিত করে বিনাস/ধ্বংস/ উচ্ছেদ করা
গ. দাসত্ব করতে বাধ্য করা
ঘ. জোরপূর্বক জনসাধারণকে অন্যত্র স্থানান্তর বা দ্বীপান্তর করা
ঙ. অবরোধ করে  রাখা এবং  জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক  উপাদান থেকে বঞ্চিত করা
চ. নির্যাতন চালানো
ছ. ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা। কোন  জাতিকে দূষিত করা বা তাদের
   মধ্যে অন্য জাতির বিস্তার ঘটানোর  লক্ষ্যে  গণহারে নারীদের ধর্ষণ করে  জোরপূর্বক  গর্ভধারণ
    করানো।  বন্ধ্যাকরণ করা বা অন্য যেকোন ধরণের যৌন অপরাধ
জ. ধর্ম, বর্ণ, গোত্র,  জাতীয়তা, লিঙ্গ বা অন্য কোন কারণে  বৈষম্য, হয়রানি  এবং
   অবমূল্যায়ন করা
ঝ.    রাষ্ট্রীয় সমর্থনে গনগ্রেফতার , অপহরন করে জোরপূর্বক নিরুদ্দেশ  করা
ঞ.    বর্ণবাদের অপরাধ
ট.    অন্য যেকোন অমানবিক অপরাধ

যুদ্ধাপরাধ
ক. জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করে সংঘটিত   নিম্নের যেকোন অপরাধ যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গন্য হবে যথা-

১.    ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা
২.    ল্যাবরেটরিতে জীবন নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষাসহ নির্যাতন, অমনাবিক আচরণ করা যা কোন মেডিক্যাল সাসেন্স স্বীকৃত নয়
৩.    ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে কষ্ট দেয়া, আহত করা বা স্বাস্থ্যহানী ঘটানো।
৪.    বেআইনী এবং নির্মমভাবে সম্পত্তির ধ্বংস সাধন এবং অপব্যবহার
৫.    যুদ্ধবন্দীদের বা অন্য বন্দীদেরকে শত্রু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা
৬.    যুদ্ধবন্দী বা অন্য বন্দীদেরকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করা।
৭.    বেআইনীভঅবে দ্বীপান্তর, স্থানান্তর বা  আবদ্ধ করা
৮.    বন্দীদের জিম্মী হিসেবে ব্যবহার

খ. আন্তর্জাতিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে যেসব আইন এবং রীতিনীতি আছে তা ভঙ্গ করা যেমন:
১. বেসরমারিক নাগরিক অথবা অন্য ব্যক্তিবর্গ যারা যুদ্ধ বা সংঘাতে জড়িত নয় তাদের
    ওপর       ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমন পরিচালনা করা
২. বেসাসমরিক নাগরিকদের পন্য দ্রব্য বা এমন বস্তু যা যুদ্ধ সরঞ্জাম নয় তার ওপর
    ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমন পরিচালনা করা
৩. উদ্ধারকারী দল, স্থাপনা,  পন্যদ্রব্য, বেসামরিক বা মানবিক কাজে ব্যবহৃত যানবাহন বা
    টিম, শান্তিরক্ষা মিশনের ওপর  ইচ্ছাকৃত আক্রমন পরিচালনা।
৪. বেসরমাকি ব্যক্তিবর্গের জীবনহানি ঘটায়, সহায় সম্পত্তি ধ্বংস করে, স্বল্প এবং দীর্ঘ
    মেয়াদে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, প্রাকৃতিক  পরিবেশ বিপন্ন করে এমন কোন হামলা
    ইচ্ছাতৃতভাবে পরিচালনা করলে।
৫. বেসামরিক ভবন, শহর, গ্রাম এবং  আবাসিক এলাকায় বোমা হামলা  বা আক্রমন 
    পরিচালনা করলে।
৬. আত্মসমপর্ণকারী সৈন্য, বা নিরস্ত্র সৈন্যকে হত্যা বা আহত করা।
৭.  যুদ্ধ বিরতীর পতাকা, সেনা পোশাক, ব্যাজ এবং অন্যান্য সামরিক প্রতীকের প্রতরাণাপূর্ণ
     ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করা
৯.    দখলদার শক্তি কর্তৃক সেখানকার অধিবাসীদের নিজভূমি থেকে বিতদাড়ন করা
    ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ঐতিহাসিক স্থাপনা, দাতব্য সংস্থা, হাসপাতাল,
        আশ্রমে ইচ্ছাকৃতভাবে হামলা চালানো
১০.    বন্দীদের ওপর বেজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো
১১.    প্রতারণামূলকভাবে বন্দীদের হত্যা করা
১২.    বন্দীদেরকে তাদের নিজ দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা
১৩.    জীবানু অস্ত্র ব্যবহার বা কারো ওপর প্রয়োগ করা
১৪.    ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা, জাতিকে দূষিত বা এক জাতি থেকে অন্য জাতিতে রূপান্তরের জন্য নারীদের ধর্ষণ করে  জোরপূর্বক  গর্ভধারণ করানো, বন্ধ্যাকরণ করা বা অন্য যেকোন ধরণের যৌন অপরাধ ।
১৫.    নিরাপদ জোনে হামলা চালানো
১৬.    ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা, খাদ্য বহনে বাধা দেয়া
১৭.    ১৫ বছরের নিচের শিশুদের দিয়ে যুদ্ধ করানো

কমান্ডার এবং অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব

কমান্ডারের অধীনস্ত সৈনিকদের মাধ্যমে যদি কোন অপরাধমূলক কর্মকান্ড সংঘটিত হয়  তবে হুকুমদাতা হিসেবে তার দায়দায়িত্ব কমান্ডারের ওপর বর্তাবে। কমান্ডারের অধীনস্তদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ কমান্ডারের হুকুমে হয়েছে অথবা তার নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারনে হয়েছে বলে গণ্য করা হবে।

উর্ধ্বতনের নির্দেশ এবং আইনের অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা

সরকার বা উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে ( সামরিক বা বেসমারিক যা-ই হোক না কেন ) কেউ যদি  যুদ্ধাপরাধের মত কোন অপরাধ করে তবে সেক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি এর দায় থেকে অব্যাহতি পাবে যদি-

ক. সরকার বা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মানতে তিনি  আইনগতভাবে বাধ্য থাকেন
খ. তিনি যে আদেশ মানছেন তা যে বেআইনী তা যদি তিনি অবহিত না থাকেন
গ.  আদেশ যে বেআইনী বা অবৈধ তা যদি প্রকাশ করা না হয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন