ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি (ঘাদানিক) গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশিনের সেক্রেটারিয়েট এর সদস্য ছিলেন। এ তদন্ত কমিশন বর্তমানে কারাবন্দী জামায়াতের অনেক নেতৃবৃন্দসহ মোট ১৬ জনকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে দুই দফা তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে ১৯৯৪ এবং ১৯৯৫ সালে।
গণতদন্ত কমিশনের সেক্রেটারিয়েট এর কাজ ছিল উক্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত কাজে কমিশনকে সর্বাত্মক সহায়তা করা।
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম গণতদন্ত কমিশনের সাথে সম্পৃক্ত থাকা ছাড়াও ১৯৯২ সালে গনআদালতের রায় বাস্তাবায়নের দাবিতে তখন সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন। অতীতে একাধিক রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততারও প্রমান পাওয়া গেছে বিচারপতি নিজামুল হকের বিরুদ্ধে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এস এম হল শাখার জাসদ ছাত্রলীগের জিএস ছিলেন।
জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন। কবি সুফিয়া কামালকে করা হয় এর চেযারম্যান। কমিশন ১৬ জনের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে যুদ্ধপারাধের অভিযোগ তদন্ত করে।
যে তদন্ত কমিশন বর্তমানে আটক নেতৃবৃন্দকে আগেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে সেই কমিশনের সাথে সম্পৃক্ত হাইকোর্টের তৎকালীন এ্যাডভোকেট (বর্তমানে বিচারপতি) নিজামুল হক নাসিমকে করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমও তখন গণতদন্ত কমিশিনের সেক্রেটারিয়েট সদস্য ছিলেন। ট্রাইব্যুনালের অপর প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু গণআদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে জাহানারা ইমামের সাথে ঢাকা, রাজশাহীসহ সারা দেশে অসংখ্য সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম শুধু যে গণতদন্ত কমিশনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তাই নয় বরং জাহানরা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালত ১৯৯২ সালে জামায়াতের তৎকালীন আমীর প্রফেসর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যে ফাঁসির রায় দিয়েছিল সেই রায় বাস্তবায়নেরও দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। গণআদালতের রায়ের প্রতি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানিয়ে ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল শুক্রবার সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির কক্ষে আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের একটি সভা হয়। এ সভায় অংশগ্রহণ করেণ বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক। এ বিষয়ে ১৯৯২ সালে ১১ এপ্রিল দৈনিক সংবাদে পরিবেশিত প্রতিবেদনে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের নাম রয়েছে।
তাছাড়া গণআদালতের কারনে জাহানারা ইমামসহ যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে তখন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছিল সেই মামলায় আসামী পক্ষের আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের সাথে তখন বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমও আইনী সহায়তা প্রদান করেণ।
যুদ্ধাপরাধ তদন্তে কবি সুফিয়া কামালকে চেয়ারম্যান করে যে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয় সেই কমিশনকে তাদের কাজে সহায়তা করার জন্য গঠন করা হয় তদন্ত কমিশন সেক্রেটারিয়েট। আইনজীবী, সাংবাদিক এবং লেখকদের সমন্বয়ে মোট ৪০ জন সদস্য বিশিষ্ট ছিলেন সেক্রেটারিয়েটে ।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম যে ঘাদানিক ও গণতদন্ত কমিশনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তার প্রমান গণতদন্ত কমিশনের প্রথম ও দ্বিতীয় রিপোর্ট, শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত এবং লিখিত দুটি বই যথাক্রমে ‘একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’, ‘গণ আদালতের পটভূমি’ এবং বিবিসি সাংবাদিক সাবির মুস্তাফা অনুদিত গণতদন্ত কমিশনের ইংরেজি ভার্সনসহ (রিপোর্ট অন দি ফাইন্ডিংস অব দি পিপলস ইনকোয়ারি কমিশন..) সর্বত্র নিজামুল হক নাসিমের নাম উল্লেখ রয়েছে সেক্রেটারিয়েট সদস্য হিসেবে।
বর্তমানে কারাবন্দী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মোজাহিদ, মুহম্মদ কামারুজ্জামান, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আব্দুল কাদের মোল্লাসহ মোট আটজনের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের তদন্তে জাতীয় গণ তদন্ত কমিশন গঠন করা হয় ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় কমিটি এ কমিশন গঠন করেণ। শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত এ বিষয়ক বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণ আদালত গোলাম আজমের যে প্রতীকী ফাঁসির রায় দিয়েছে তারাই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য নেতৃবৃন্দের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত এবং তাদের বিচারের দাবিতে জনমত তৈরির লক্ষ্যে গঠিত হয় গণতদন্ত কমিশন।
১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ প্রথম দফায় কমিশন আটজনকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরা হলেন আব্বাস আলী খান, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আব্দুল আলীম (বর্তমানে জামিনে মুক্ত) মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আব্দুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং আব্দুল কাদের মোল্লা।
১৯৯৫ সালের ২৬ মার্চ কমিশন তাদের দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। এখানে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করা হয় তারা হলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আল আহসান মোহাম্মদ মোজাহিদ, মাওলানা এ কে এম ইউসুফ, মাওলানা আব্দুস সোবহান, এ এস এম সোলায়মান, মোহাম্মদ আয়েন উদ্দিন, এবিএম খালেক মজুমদার এবং ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন।
দৈনিক সংবাদের খবর: জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালত ১৯৯২ সালে প্রফেসর গোলাম আযমের প্রতীকী ফাঁসির যে রায় প্রদান করে সে রায়ের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ সুপ্রীম কোর্টে একটি সমাবেশ করে তখন। সে সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম। ১৯৯২ সালে ১১ এপ্রিল দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত “আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের দাবি: গণআদালতের রায় সম্পর্কে আইনানুগ ব্যবস্থা
নিতে হবে” শীর্ষক খবরে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের নাম রয়েছে সভায় উপস্থিত অন্যান্যদের সাথে।
সংবাদে পরিবেশিত খবরে লেখা হয় “গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ আইনজীবী সমিতি সমূহের সমন্বয় পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভা সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতির কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেণ সমন্বয় পরিষদের আহবায়ক শামসুল হক চৌধুরী। সভার প্রস্তাবে গণআদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়।.......... সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এম আমীর উল ইসলাম, শফিক আহমেদ, আব্দুল বাসেত মজুমদার, আলহাজ্ব গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, আফসার উদ্দিন আহমেদ, গোলাম মাঈনুদ্দীন, আ ফ ম মেসবাহউদ্দীন, শামসুদ্দীন মিঞা, কে এম সাইফুদ্দীন আহমেদ, এম কে রহমান, নিজামুল হক নাসিম, ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আব্দুল মান্নান, আব্দুল গণি তালুকদার, ফরিদ আহমদ, মমতাজ উদ্দিন ফকির। খবর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির।”
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা: বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে অধ্যয়নকালে এস এম হলের একজন ছাত্র ছিলেন। তিনি এস এম হল শাখার জাসদ ছাত্র লীগের জিএস নির্বাচিত হন। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হন। এর আগে পটুয়াখালি সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে অধ্যয়নকালে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ছাত্রলীগের (আওয়ামী লীগ) একজন সাধারন মানে কর্মী/সমর্থক ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন তার কলেজ জীবনের পরিচিতরা।
ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের গণআদালতের সাথে সম্পৃক্ততা বিষয়ে আইনজীবীদের প্রতিকৃয়া
অভিযোগকারী কখনো বিচারের আসনে বসতে পারেননা
যুদ্ধাপরাধ বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত গণতদন্ত কমিশনের সাথে সম্পুক্ততার বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা বলেছেন, নৈতিকভাবে চেয়ারম্যান ঐ পদে বসার অধিকার হারিয়েছেন। কারণ আইনের সাধারণ কথা হল অভিযোগকারী কখনো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার করতে পারেননা। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বর্তমানে যাদের বিচার চলছে গণতদন্ত কমিশন আগেই তাদেরকে একই অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। আর ট্রাইব্যুনালের বর্তমান চেয়ারম্যান ঐ তদন্ত কমিশন সেক্রেটারিয়েট মেম্বার ছিলেন। সেই একই লোকের ওপর এখন তাদের বিচারের দায়িত্ব অর্পিত হলে কখনো ন্যায় বিচার হতে পারেনা।
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এর সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এখন যাদের বিচার চলছে তাদেরকে আগেই যারা অভিযুক্ত করেছে তাদের এ বিচার কাজের সাথে জড়িত না থাকা বিচারিক দায়িত্ব। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত ১৯৯৩ সালের জাতীয় গণতদন্ত কমিশিনের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে খবর বেরিয়েছে। তিনি যদি এভাবে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণতদন্ত কমিশনের সাথে জড়িত থেকে থাকেন তাহলে তার আর এ পদে থাকা উচিত কি উচিত কিনা সে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব এখন তার। আমরা মনে করি তার সম্পর্কে যে খবর পত্রিকায় বের হয়েছে তারপর আর তার এ পদে থাকা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। কারো বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ প্রমানিত হলে তার এ জাতীয় পদে থাকার নৈতিক অধিকার থাকেনা।
ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞ বলেন, আইনের একেবারে সাধারণ কথা হল যিনি বিচার চাইবেন বা বিচারপ্রার্থী বা অভিযোগকারী তিনি বিচার করতে পারেননা। অভিযোগকারী অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচারের জন্য বিচারের আসনে বসতে পারেননা। তাহলে ন্যায় বিচার পাওয়া যায়না। এটা সম্ভব নয়। এটা সারা বিশ্বের সর্বজনস্বীকৃত বিষয় । কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যাদের বিচার করা হচ্ছে তাদেরকে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আগেই অভিযুক্ত করেছেন। তিনি তাদের বিরুদ্ধে একজন বিচার প্রার্থী ছিলেন। তিনি অভিযোগকারী, তিনিই বিচারক। এটা কেমন করে হতে পারে। যিনি আগে থেকেই একজনকে অভিযুক্ত করে বিচার চেয়ে আসছেন সেই একই লোক এখন তাদের বিচারের জন্য চেয়ারে বসেছেন। এটা তো বিচারের নামে প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়।
গণতদন্ত কমিশনের সেক্রেটারিয়েট এর কাজ ছিল উক্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত কাজে কমিশনকে সর্বাত্মক সহায়তা করা।
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম গণতদন্ত কমিশনের সাথে সম্পৃক্ত থাকা ছাড়াও ১৯৯২ সালে গনআদালতের রায় বাস্তাবায়নের দাবিতে তখন সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন। অতীতে একাধিক রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততারও প্রমান পাওয়া গেছে বিচারপতি নিজামুল হকের বিরুদ্ধে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এস এম হল শাখার জাসদ ছাত্রলীগের জিএস ছিলেন।
জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন। কবি সুফিয়া কামালকে করা হয় এর চেযারম্যান। কমিশন ১৬ জনের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে যুদ্ধপারাধের অভিযোগ তদন্ত করে।
যে তদন্ত কমিশন বর্তমানে আটক নেতৃবৃন্দকে আগেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে সেই কমিশনের সাথে সম্পৃক্ত হাইকোর্টের তৎকালীন এ্যাডভোকেট (বর্তমানে বিচারপতি) নিজামুল হক নাসিমকে করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমও তখন গণতদন্ত কমিশিনের সেক্রেটারিয়েট সদস্য ছিলেন। ট্রাইব্যুনালের অপর প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু গণআদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে জাহানারা ইমামের সাথে ঢাকা, রাজশাহীসহ সারা দেশে অসংখ্য সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম শুধু যে গণতদন্ত কমিশনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তাই নয় বরং জাহানরা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালত ১৯৯২ সালে জামায়াতের তৎকালীন আমীর প্রফেসর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যে ফাঁসির রায় দিয়েছিল সেই রায় বাস্তবায়নেরও দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। গণআদালতের রায়ের প্রতি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানিয়ে ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল শুক্রবার সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির কক্ষে আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের একটি সভা হয়। এ সভায় অংশগ্রহণ করেণ বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক। এ বিষয়ে ১৯৯২ সালে ১১ এপ্রিল দৈনিক সংবাদে পরিবেশিত প্রতিবেদনে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের নাম রয়েছে।
তাছাড়া গণআদালতের কারনে জাহানারা ইমামসহ যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে তখন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছিল সেই মামলায় আসামী পক্ষের আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের সাথে তখন বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমও আইনী সহায়তা প্রদান করেণ।
যুদ্ধাপরাধ তদন্তে কবি সুফিয়া কামালকে চেয়ারম্যান করে যে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয় সেই কমিশনকে তাদের কাজে সহায়তা করার জন্য গঠন করা হয় তদন্ত কমিশন সেক্রেটারিয়েট। আইনজীবী, সাংবাদিক এবং লেখকদের সমন্বয়ে মোট ৪০ জন সদস্য বিশিষ্ট ছিলেন সেক্রেটারিয়েটে ।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম যে ঘাদানিক ও গণতদন্ত কমিশনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তার প্রমান গণতদন্ত কমিশনের প্রথম ও দ্বিতীয় রিপোর্ট, শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত এবং লিখিত দুটি বই যথাক্রমে ‘একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’, ‘গণ আদালতের পটভূমি’ এবং বিবিসি সাংবাদিক সাবির মুস্তাফা অনুদিত গণতদন্ত কমিশনের ইংরেজি ভার্সনসহ (রিপোর্ট অন দি ফাইন্ডিংস অব দি পিপলস ইনকোয়ারি কমিশন..) সর্বত্র নিজামুল হক নাসিমের নাম উল্লেখ রয়েছে সেক্রেটারিয়েট সদস্য হিসেবে।
বর্তমানে কারাবন্দী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মোজাহিদ, মুহম্মদ কামারুজ্জামান, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আব্দুল কাদের মোল্লাসহ মোট আটজনের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের তদন্তে জাতীয় গণ তদন্ত কমিশন গঠন করা হয় ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় কমিটি এ কমিশন গঠন করেণ। শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত এ বিষয়ক বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণ আদালত গোলাম আজমের যে প্রতীকী ফাঁসির রায় দিয়েছে তারাই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য নেতৃবৃন্দের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত এবং তাদের বিচারের দাবিতে জনমত তৈরির লক্ষ্যে গঠিত হয় গণতদন্ত কমিশন।
১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ প্রথম দফায় কমিশন আটজনকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরা হলেন আব্বাস আলী খান, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আব্দুল আলীম (বর্তমানে জামিনে মুক্ত) মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আব্দুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং আব্দুল কাদের মোল্লা।
১৯৯৫ সালের ২৬ মার্চ কমিশন তাদের দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। এখানে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করা হয় তারা হলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আল আহসান মোহাম্মদ মোজাহিদ, মাওলানা এ কে এম ইউসুফ, মাওলানা আব্দুস সোবহান, এ এস এম সোলায়মান, মোহাম্মদ আয়েন উদ্দিন, এবিএম খালেক মজুমদার এবং ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন।
দৈনিক সংবাদের খবর: জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালত ১৯৯২ সালে প্রফেসর গোলাম আযমের প্রতীকী ফাঁসির যে রায় প্রদান করে সে রায়ের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ সুপ্রীম কোর্টে একটি সমাবেশ করে তখন। সে সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম। ১৯৯২ সালে ১১ এপ্রিল দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত “আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের দাবি: গণআদালতের রায় সম্পর্কে আইনানুগ ব্যবস্থা
নিতে হবে” শীর্ষক খবরে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের নাম রয়েছে সভায় উপস্থিত অন্যান্যদের সাথে।
সংবাদে পরিবেশিত খবরে লেখা হয় “গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ আইনজীবী সমিতি সমূহের সমন্বয় পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভা সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতির কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেণ সমন্বয় পরিষদের আহবায়ক শামসুল হক চৌধুরী। সভার প্রস্তাবে গণআদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়।.......... সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এম আমীর উল ইসলাম, শফিক আহমেদ, আব্দুল বাসেত মজুমদার, আলহাজ্ব গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, আফসার উদ্দিন আহমেদ, গোলাম মাঈনুদ্দীন, আ ফ ম মেসবাহউদ্দীন, শামসুদ্দীন মিঞা, কে এম সাইফুদ্দীন আহমেদ, এম কে রহমান, নিজামুল হক নাসিম, ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আব্দুল মান্নান, আব্দুল গণি তালুকদার, ফরিদ আহমদ, মমতাজ উদ্দিন ফকির। খবর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির।”
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা: বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে অধ্যয়নকালে এস এম হলের একজন ছাত্র ছিলেন। তিনি এস এম হল শাখার জাসদ ছাত্র লীগের জিএস নির্বাচিত হন। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হন। এর আগে পটুয়াখালি সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে অধ্যয়নকালে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ছাত্রলীগের (আওয়ামী লীগ) একজন সাধারন মানে কর্মী/সমর্থক ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন তার কলেজ জীবনের পরিচিতরা।
ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের গণআদালতের সাথে সম্পৃক্ততা বিষয়ে আইনজীবীদের প্রতিকৃয়া
অভিযোগকারী কখনো বিচারের আসনে বসতে পারেননা
যুদ্ধাপরাধ বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত গণতদন্ত কমিশনের সাথে সম্পুক্ততার বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা বলেছেন, নৈতিকভাবে চেয়ারম্যান ঐ পদে বসার অধিকার হারিয়েছেন। কারণ আইনের সাধারণ কথা হল অভিযোগকারী কখনো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার করতে পারেননা। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বর্তমানে যাদের বিচার চলছে গণতদন্ত কমিশন আগেই তাদেরকে একই অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। আর ট্রাইব্যুনালের বর্তমান চেয়ারম্যান ঐ তদন্ত কমিশন সেক্রেটারিয়েট মেম্বার ছিলেন। সেই একই লোকের ওপর এখন তাদের বিচারের দায়িত্ব অর্পিত হলে কখনো ন্যায় বিচার হতে পারেনা।
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এর সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এখন যাদের বিচার চলছে তাদেরকে আগেই যারা অভিযুক্ত করেছে তাদের এ বিচার কাজের সাথে জড়িত না থাকা বিচারিক দায়িত্ব। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত ১৯৯৩ সালের জাতীয় গণতদন্ত কমিশিনের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে খবর বেরিয়েছে। তিনি যদি এভাবে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণতদন্ত কমিশনের সাথে জড়িত থেকে থাকেন তাহলে তার আর এ পদে থাকা উচিত কি উচিত কিনা সে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব এখন তার। আমরা মনে করি তার সম্পর্কে যে খবর পত্রিকায় বের হয়েছে তারপর আর তার এ পদে থাকা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। কারো বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ প্রমানিত হলে তার এ জাতীয় পদে থাকার নৈতিক অধিকার থাকেনা।
ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞ বলেন, আইনের একেবারে সাধারণ কথা হল যিনি বিচার চাইবেন বা বিচারপ্রার্থী বা অভিযোগকারী তিনি বিচার করতে পারেননা। অভিযোগকারী অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচারের জন্য বিচারের আসনে বসতে পারেননা। তাহলে ন্যায় বিচার পাওয়া যায়না। এটা সম্ভব নয়। এটা সারা বিশ্বের সর্বজনস্বীকৃত বিষয় । কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যাদের বিচার করা হচ্ছে তাদেরকে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আগেই অভিযুক্ত করেছেন। তিনি তাদের বিরুদ্ধে একজন বিচার প্রার্থী ছিলেন। তিনি অভিযোগকারী, তিনিই বিচারক। এটা কেমন করে হতে পারে। যিনি আগে থেকেই একজনকে অভিযুক্ত করে বিচার চেয়ে আসছেন সেই একই লোক এখন তাদের বিচারের জন্য চেয়ারে বসেছেন। এটা তো বিচারের নামে প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন