শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৩

রাফীক ভাই’র পাশে বসতাম ট্রাইব্যুনালে

 ১৩/৬/১২
মেহেদী হাসান
ট্রাইব্যুনালের কোর্ট রুমে   দুই সারি বেঞ্চ। ডান পাশে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আর বাম পাশে আসামী পক্ষের আইনজীবীরা বসেন। বাম পাশের সারিতে  আসামী পক্ষের আইনজীবীদের পেছনে আসামীর আত্মীয় স্বজনরা বসেন। তাছাড়া দুই পাশেই সাংবাদিকদের জন্য বেঞ্চ বরাদ্দ আছে।  আমি সাধারনত বাম পাশের সারিতে বসি যেখানে আসামীমের আত্মীয় স্বজনরা বসেন। কারন আমার একটু  ঠান্ডাজনিত সমস্যা আছে।  ট্রাইব্যুনালের এসিগুলো সব ডানমুখী। সে কারনে বাম পাশে  ঠান্ডা একটু কম লাগে।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর  মামলার প্রতি তারিখেই ওনার চার ছেলে   ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত থাকেন। (বিশেষ কারনে কেউ অনুপস্থিত থাকলে সেটা ভিন্ন)। বাম পাশে বসার কারনে প্রতিদিন তাদের সাথে দেখা হয় কথা হয় আমার।  প্রায়ই রাফীক ভাই’র পাশে বসতাম আমি। রাফীক ভাই দেখা হলে সবার আগে সালাম দিতেন। তারপর  ওনার পিতাকে নিয়ে নয়া দিগন্তের  নিউজের  প্রশংসা করতেন।  যেদিন কথা  বলার সুযোগ  হতনা সেদিন নিউজের জন্য মোবাইলে মেসেজ দিয় ধন্যবাদ জানাতেন এবং আমার জন্য দোয়া করতেন। সামনা সামনি যখন ধন্যবাদ জানাতেন তখন ওনার  চোখে মুখে  একটা   তৃপ্তির প্রকাশ আমি লক্ষ্য করতাম। এখন তিনি নেই। কিন্তু তার সেই চেহারা আমার  মনে ভেসে উঠছে বারবার।
গতকাল মঙ্গলবার তিনি আমার আগে কোর্টে  আসেন এবং তার পেছনে গিয়ে বসি আমি। তিনি আমার   দিকে ফিরে সালাম দিয়ে হাত মেলালেন। কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন আস্তে করে।
আজ  বুধবার আমি দশটা ৩৭ মিনিটে কোর্টরুমে প্রবেশ করে। ততক্ষনে কোর্ট  শুরু হয়ে গেছে। আমি আস্তে করে কোর্টরুমে ঢুকে বসে পড়লাম।  কথা বলার সুযোগ পাইনি।
দুপুর ১টায় কোর্ট বিরতি হলে সবার মত রাফীক ভাইও কোর্ট থেকে বের হয়ে যান লাঞ্চের  জন্য। । দেড়টার দিকে   ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় তলার সিড়ির গোড়ায় আবু বকর সিদ্দিক (মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী প্যানেলের সদস্য) আমাকে বললেন রাফীক ভাই আবার স্ট্রোক করেছেন। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
কোর্টের সামনে   মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের বহনকারী গাড়িটি  পার্ক করা থাকে। সেখানে তাদের জন্য লাঞ্চ থাকে। রাফীক ভাই একটার বিরতির পর গাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন লাঞ্চের জন্য। গাড়িতে ওঠার সময় তিনি বুকে পেইন ফিল করেন। সাথে সাথে ড্রাইভার মাওলানা সাঈদীর তৃতীয় ছেলে মাসুদ সাঈদীর কাছে ছুটে এসে খবর দেন। মাসুদ দৌড়ে গাড়ির কাছে গিয়ে দেখেন রাফীক ভাইর অবস্থা খুব খারাপ। প্রায় অচেতন। সাথে সাথে তিনি গাড়ি নিয়ে বারডেমে ছুটলেন। এরপরের খবর সবাই জানেন।

এই যখন ঘটনা তখনোও কোর্টে উপস্থিত কেউ তেমন কিছু জানেননা এ খবরের। মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজনরা রাফীক ভাইয়ের অসুস্থতার খবর জানেন শুধু। রাফীক ভাই যে অসুস্থ  হয়েছেন তা কোর্টে উপস্থিত সাঈদী সাহেবকে জানানো হয়নি। ইচ্ছা করেই কেউ জানায়নি। দুপুর তখন পৌনে দুইটা।  তখনো বিরতি চলছে।  আমি কোর্ট রুমে প্রবেশ করলাম। হুজুর (মাওলানা সাঈদী) কোর্টরুমে বেঞ্চে বসা। তার ছোট ছেলে নাসিম তার  সামনে বসে আছেন। হুজুর  আমাকে দেখে কাছে ডাকলেন। কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। অন্যান্য দিনের মতই হাসি খুসী তার চেহারা। আমার কাছে দোয়া চাইলেন। আম্মা  আমার আম্মা আব্বা, আমার পত্রিকার নিউজ এডিটর মাসুমুর রহমান খলিলী, নির্বাহী সম্পাদক সালাহউদ্দিন  বাবর ভাইকে সালাম দিলেন। আমিও  বিনয়ের সাথে তার কাছে দোয়া চাইলাম। তিনি শব্দ করে আমার জন্য দোয়া করলেন। আমিও শব্দ করে আমিন বললাম। রাফীক ভাইর বিষয়ে কিছু জানেন বলে মনে হলনা।
(বিররিতর সময় হুজুর কাঠগড়া থেকে নেমে বেঞ্চে বসেন। মাঝে মাঝে নিচের কাঠগড়ায় না গিয়ে সেখানেই নামাজ পড়েন এবং দুপুরের খাবার খান। )
দুইটার পর আবার কোর্ট শুরু হল। সাড়ে তিনটার দিকে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম (জেরায় এক্সপার্ট) বিচারপতি নিজামুল   হকের কাছে একটি চিরকুট পাঠালেন।
আমি  মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করলাম চিরকুটে কি লেখা ছিল।
তিনি বললেন, চিরকুট আমিই লিখেছিলাম। আমি লিখেছিলাম সাঈদী  সাহেবের বড় ছেলে গুরুতর অসুস্থ। বিষয়টি হুজুরকে জানানো হয়নি। তাই গোপানে আপনাকে জানাচ্ছি। আমরা আজ এবং আগামীকাল কোর্ট মুলতবি চাচ্ছি।

চিরকুট পড়ে নিজামুল হক বললেন প্রথম অংশ মানা গেল। কিন্তু দ্বিতীয় অংশ মানা গেলনা।
বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, আজকের মত মুলতবি করা যায় ।
মিজানুল ইসলাম বলেন, দয়া করে আগামীকাল মুলতবি করেন।
বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, না সেটি মানতে পারলাম না। আমরা যে কি অবস্থার মধ্যে আছি তা  আপনাকে বোঝাতে পারবনা। সেটি বলতে  চাইনা।
তারপর মিজানুল ইসলাম  আগামীকালের মুলতবির জন্য জোর অনুরোধ জানান। বিচারপতি নিজামুল হকও বারবার দুই পাশে মাথা নেড়ে তা বাতিল করতে থাকেন। তিনি বলেন, আমরা তো জনগনের চাপে আছি।  আগামী কাল কোর্টে কোন মামলা নেই। আমাদের কোন কাজ  নেই। সারা দুনিয়া জানবে কাল কোর্ট বসেনি। আপনি কাল আসতে না পারেন অন্য কাউকে আসতে  বলেন।

এরপর মিজানুল ইসলাম বলেন, আমি আপনার সমস্যা বুঝি। কিন্তু মানবিক কারনে শুধু একটা দিনের জন্য মুলতিব চাচ্ছি।  শুধু একটা দিনের জন্য। আমার শরীরও ভাল না। সকালে সিনিয়র (ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক মিজানুল ইসলামের শরীর খারাপের কারনে মুলতবি চেয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাইব্যুানাল দেননি। )  আবেদন করেছিল। সেটা নিয়ে আমার কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু আমি আপনাকে অনুরোধ করছি দয়া করে একদিন মুলতবি করেন। আমরা সবাই টিম হিসেবে কাজ করি। সবারই কাজ আছে।
এরপর বিচারপতি নিজামুল হক  কিছুক্ষন চুপ থেকে বলেন, তাজুল সাহেব আপনি আমার রুমে আসেন। রাষ্ট্রপক্ষেরও একজন আইনজীবীকে তিনি রুমে যেতে বলেন।
তারা  তার   খাস কামরায়  যাবার পরপরই  তিনটা ৪০ এর দিকে আমি  কোর্ট রুম থেকে বের হয়ে অফিসের দিকে রওয়ান দেই।  অফিসে ফেরার পথে একজন ফোন করে  প্রশ্ন করল  রাফীক  বীন সাঈদী  কি মারা গেছে?
আমি  সন্ধ্যার পর তাজুল ভাইকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম বিচারপতি নিজামুল হকের খাস কামরায় যাবার পর কি হল। তিনি  জানালেন,  আমরা সেখান  থাকা অবস্থায় মারা যাবার খবর পাইনি। তখন সিদ্ধান্ত হল আগামীকাল (বৃহষ্পতিবার ) সকালে কোর্ট বসবে। তারপর মুলতবি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এরপর বিচারপতি নিজামুল হকের চেম্বার থেকে বের হবার পরই  মৃত্যুর খবর আসল এবং আমরা কোর্টকে তা জানালাম।
হুজুর জেলে থাকা অবস্থায় কিছু দিন আগে তার মা মারা গেলেন। মৃত্যুল আগে বৃদ্ধা মাতা দেখতে পারলেননা ছেলের মুখ। ছেলেও দেখতে পেলেননা মায়ের মুখ। আর আজ  মারা গেলেন তার  অতি আদরের বড় সন্তান। তখন তিনি  আদালতের কাঠগড়ায়। তিনিও তখন সব থেকে কষ্টের, নির্মম,  ঘোষিত মুত্যৃর  খবরের অপেক্ষায় ।  জানতেও পারলেননা তার আদরের সন্তান  মৃত্যুপথযাত্রী। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
আমি দেখতাম কোর্ট শুরু হবার আগে এবং পরে রাফীক ভাই যতবারই হুজুরের  কাঠগড়ার সামনে যেতেন তখন তার মাথায়, কপালে  চুম্বন করতেন হুজুর। হুজুরকে সিড়ি থেকে নামা এবং ওঠার সময় তিনি সবসময় তার পাশে পাশে থাকতেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন