মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ১৯৭৩ সালের আইনে অনেক দুর্বলতা রয়েছে যা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী । “আমরা স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ বিচারের যে মানদণ্ড রয়েছে তার সফল প্রয়োগ দেখতে চাই বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে।”
১৯৭৩ সালের আইন, আইনের বিধিবিধান এবং সংবিধান পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে এম্যানেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বচ্ছ এবং ন্যায় বিচারের যে মানদণ্ড রয়েছে তার অনেক কিছুই অনুপস্থিত ১৯৭৩ সালের আইনে। তাই এসব দুর্বলতা সংশোধন করা না হলে বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এ্যামনেস্টির পক্ষ থেকে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থার এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলের ডেপুটি ডাইরেক্টর মধু মালহোত্রা লিখিত এ চিঠিতে আইনটির বিভিন্ন দুর্বলতা উল্লেখ এবং সেগুলো সংশোধনের জন্য দীর্ঘ সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে যথাযথ অনুসন্ধানের মাধ্যমে সরকার দলীয় এবং সরকার সমর্থক দলের যারা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত তাদেরকেও গ্রেফতার করা না হলে এ ট্রাব্যুনালকে বিরোধী নেতা শিকারের একটি হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
১৯৭৩ সালের আইনের বিভিন্ন দুর্বলতা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা বিষয়ে যে সংজ্ঞা ১৯৭৩ সালের আইনে দেয়া হয়েছে তার সাথে আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞার মিল নেই। ১৯৭৩ সালের আইন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন এবং মানবাধিকার বিষয়ক চুক্তির পরিপন্থী। গত ২১ জুন পাঠানো চিঠির সুপারিশসমূহ নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।
চিঠির শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে “আমাদের এ সুপারিশসমুহ পাঠানোর উদ্দেশ্য হল যুদ্ধাপরাধ বিচারের আইনে যেসব দুর্বলতা আছে সেগুলো দূর করা যাতে বিচার নিরপেক্ষ হয়। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ বিচারের যে মানদন্ড রয়েছে তা মেনে যদি অভিযুক্তদের শাস্তি প্রদান করা না হয় তাহলে তা হবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরেকটি ঘটনা।
যুদ্ধাপরাধ বিচার কাজ একটি কঠিন বিষয় আমরা তা বুঝতে পারি কিন্তু আন্তর্জাতিক যে অভিজ্ঞতা এবং উদাহরণ রয়েছে সেখান থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিয়ে এবং আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে বাংলাদেশের আইন ও বিধিবিধান সংশোধন করে বিচারকে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ করতে পারে । আমরা স্বচ্ছ এবং
নিরপেক্ষ বিচারের যে মানদণ্ড রয়েছে তার সফল প্রয়োগ দেখতে চাই বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে। ”
চিঠিতে বলা হয়, আমরা এখানে কিছু সুপারিশ সন্নিবেশ করেছি যেগুলো বিচারকে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে অবিলম্বে প্রয়োগ করা অতিশয় জরুরি বলে আমরা মনে করি।
আমরা লক্ষ্য করেছি এখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের দায়ে যে সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সকলেই বিরোধী দলের নেতা। এদের মধ্যে পঁচ জন জামায়াতের এবং দু’জন বিএনপির । এতে মনে হচ্ছে যে, ট্রাইব্যুনাল শুধুমাত্র বিরোধী দলের সাথে সম্পৃক্ত সন্দেহভাজনদেরই বিচারের কাজ করছে। সরকারী দল বা সরকার সমর্থক কোন দলের নেতা হবার কারনে কেউ যেন নিজেদেরকে বিচারের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারে সেজন্য অবশ্যই আরো অধিকতর গুরুত্বের সাথে অনুসন্ধান কাজ চালানো উচিত। অন্যথায় এ ট্রাব্যুনালকে বিরোধী নেতা শিকারের একটি হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
বিচারে সন্দেহাতীতভাবে দোষী প্রমানের আগ পর্যন্ত একজন অভিযুক্ত নিজেকে নির্দোষী দাবি করার যে অধিকার তা প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধান, ১৯৭৩ সালের আইন বা আইনের বিধি কোনকিছুই পরিবর্তন করা হয়নি। এটি আমাদের কাছে অস্বস্তিকর। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক । অথচ বাংলাদেশ এটি মানতে বাধ্য। এসব আইনের সংশোধন দরকার। বিচারে দোষী প্রমানের আগে অভিযুক্ত’র নির্দোষীতার দাবি নিশ্চিত করতে হবে ট্রাইব্যুনালকে।
যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা বিষয়ে যে সংজ্ঞা ১৯৭৩ সালের আইনে দেয়া হয়েছে তার সাথে আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞার মিল নেই। ১৮৬০ সালের পেনাল কোড প্রয়োগ করা হবে কিনা সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে ঘোষনা করা হয়েছে আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে যাদের বিচারের জন্য হাজির করা হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে এ অধিকার হরন করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে যে নাগরিক অধিকার ঘোষনা করা হয়েছে তা সংবিধানে ৪৭ (ক) ধারা সংযোজনের মাধ্যমে হরণ করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালে যাদের বিচার করা হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে।
৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবেনা।”
এটি ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্ট অন সিভিল এন্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর) চুক্তির ৯ ধারার পরিপন্থী।
বিচারের জন্য অপেক্ষমান এবং আটকৃত ব্যক্তি জামিনা পাবেনা এটি আইসিসিপিআর এবং বিশ্বের প্রায় সকল আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান রীতির পরিপন্থি। ১৯৭৩ সালের আইনের ৩ (২) ধারাটি আইসিসিপিআর এর সাথে সাংঘর্ষিক। ট্রাইব্যুনাল নিজ ক্ষমতাবলে অন্তত একজনকে জামিন দিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে আইনের বিদ্যমান বাঁধা ট্রাইব্যুনালের এ ক্ষমতা প্রয়োগকে বাঁধা গ্রস্ত করতে পারে।
অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রোম সংবিধির ৫৫ ধারা এবং সকল আন্তর্জাতিক আদালতের স্বীকৃত যে বিধান রয়েছে তা মানা হয়নি ১৯৭৩ সালের আইনে।
আটক অবস্থায় যদি কেউ নির্যাতনের শিকার হয় তবে তা তদন্ত করে দেখার কোন বিধান রাখা হয়নি ১৯৭৩ সালের আইনে। তাছাড়া নির্যাতনের মাধ্যমে তথ্য আদায় না করা বিষয়েও কোন সুরক্ষা নেই
আইনে। একজন বন্দী অভিযোগ করেছেন যে, তাকে আটকের পরপরই নির্যাতন করা হয়েছে। এ অভিযোগ তদন্ত করে দেখার জন্য ট্রাইব্যুনালের কোন উদ্যোগ এখন পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়নি। অথচ কনভেনশন এগেনেস্ট টরচার চুক্তির ১২ এবং ১৩ ধারা মোতাবেক এটি করার দরকার ছিল।
অভিযুক্তদের আটকাদেশের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করা এবং আটকাদেশ অবৈধ হলে বন্দীকে মুক্ত করার আবেদনের নিশ্চয়তা রাখা হয়নি ১৯৭৩ সালের আইনে। এটি আইসিসিপিআর ৯ (৪) ধারার পরিপন্থী।
কাউকে মিথ্যা অভিযোগে বেআইনীভাবে আটক রাখলে তাকে ক্ষতিপুরণ দেয়ার বিধান রয়েছে আইসিসিপিআর এ কিন্তু ১৯৭৩ সালের আইনে এ জাতীয় কোন বিধান নেই।
১৮৭২ সালের এভিডেন্স এ্যাক্ট এবং ১৮৯৮ সালের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবেনা বলা হয়েছে। এসব আইন অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার রক্ষায় ভাল ভূমিকা পালন করে।
কোন প্রশ্নের জবাবে আসামীর নিরব অধিকার অধিকার সারা বিশ্বে স্বীকৃত। কিন্তু ১৯৭৩ সালের আইনের ১১ (২) ধারার মাধ্যমে এ অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে।
আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হবার আগ পর্যন্ত তাকে নির্দোষ দাবির নিশ্চয়তা সংবিধান, ১৯৭৩ সালের আইন বা বিধিমালা কোথাও রাখা হয়নি।
৫০ (১) বিধিতে বলা হয়েছে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানের বাধ্যবাধকতা নেই বিচারের ক্ষেত্রে।
ভুল বিচারের ক্ষেত্রেও কোন ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত সমস্ত আন্তর্জাতিক আদালতে এ ব্যবস্থা আছে। এটি আইসিসিপিআর এর ১৪ (৬) ধারার পরিপন্থী।
ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তর অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়নি সংবিধান এবং ১৯৭৩ সালের আইনে।
পুলিশ, আইনজীবী বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক অভিযুক্তকে তার অধিকার সম্পর্কে অবহিত করার কোন ব্যবস্থা নেই। তদন্ত, আপীল, বিচার প্রকৃয়ার অগ্রগতি সম্পর্কেও অভিযুক্তকে জানানোর যে বিধান রয়েছে তার কোন ব্যবস্থা নেই আইনে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন