শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৩

স্টিফেন জে র‌্যাপের সুপারিশ

Mehedy Hasan
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্টিফেন  জে র‌্যাপকে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দান করেণ।  ২০০৯ সালের  সেপ্টেম্বর থেকে তিনি  এ  বিষয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। স্টিফেন এর আগে সিয়েরালিওনে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত বিশেষ আদালতে একজন মূখ্য আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন । ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এ আদালতে সিয়েরালিওনের গৃহযুদ্ধে ব্যাপক বর্বরতার অভিযোগে লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস টেইলরসহ আরো অনেকের  বিচার করা হয়।
বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রনে  ২০১১ সালের  ১০ জানুযারি  চার দিনের সফরে ঢাকা আসেন তিনি। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের  বিচার বিষয়ে  আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য বিচারক, আইনজীবী, তদন্তকারী,  আসামী পক্ষের আইনজীবী, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেণ। এরপর ওয়াশিংটন ফিরে গিয়ে তিনি  যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে তার অবস্থান তুলে ধরে ১০ পৃষ্ঠার একটি সুপারিশ পাঠান আইন ও পরমন্ত্রন্ত্রী বরাবার। গত ২১ মার্চ ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে  তার সুপারিশ বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃপক্ষের কাছে পৌছে দেয়া হয়। এখানে  স্টিফেনের  সুপারিশ  এবং মতামত তুলে ধরা হল।


অভিযুক্ত’র অধিকার রক্ষায় সংবিধানে ধারা সংযোজন করতে হবে

স্টিফেন জে র‌্যাপের চিঠিতে সুপারিশ  করে বলা হয়েছে,  কোন ব্যক্তি যত বড় অপরাধের অভিযোগেই অভিযুক্ত হোকনা কেন অভিযুক্ত ব্যক্তির অধকার  রক্ষা করতে হবে। তাকে তার  সকল আইনী সুরক্ষার ভোগ করার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

ইন্টারন্যাশনাল কনেভেনশন অব পলিটিক্যাল এন্ড সিভিল রাইটস (আইসিসিপিআর), ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যেসব আইনী সুরক্ষা এবং অধিকার  প্রদান করা হয়েছে সেগুলো যাতে অভিযুক্ত ব্যাক্তিরা পেতে পারেন তার নিশ্চয়তা বিধান করে সংবিধানে একটি ধারা সংযোজন করা উচিত। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে  তদন্ত চলছে এবং যাদের বিরুদ্ধে  চার্জশিট প্রদান করা হয়েছে তাদের সকলের ক্ষেত্রেই এ অধিকার প্রযোজ্য হবে।

এছাড়া র‌্যাপের চিঠিতে আরো একটি বিষয় মোটা দাগে উল্লেখ করে বলা হয়েছে বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের আইনে অপরাধের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা এবং ব্যাখা নেই। তাই আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে  অপরাধকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করার  নিশ্চয়তা বিধানের জন্যও সংবিধানে ধারা সংযুক্ত করা উচিত। ট্রইব্যুনালের জন্য আলাদা একটি আপীল বিভাগ গঠনেরও প্রস্তাব  করেছেন র‌্যাপ।

অভিযুক্ত ব্যক্তির কি কি অধিকার রয়েছে সেগুলো আইসিসিপিআর এ বর্ণিত আছে। বাংলাদেশ যার একটি পক্ষ। বাংলাদেশ এখান থেকে সহায়তা নিতে পারে ।

১৯৭৩ সালের আইনে বিভিন্ন অপরাধের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা এবং ব্যাখা নেই। কোন অপরাধে কাউকে অভিযুক্ত করার আগে  যাতে সে অপরাধকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয় সে বিধান রেখে সংবিধানে একটি ধারা  সংযোজন করা দরকার। সংবিধানে এ বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা দরকার যাতে ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা আইসিসির ‘এলিমেন্টস অব  ক্রাইমস’ থেকে গাইডলাইন গ্রহণ করেন অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করার ব্যাপারে।

মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা প্রভৃতি টার্মগুলো  আইসিসিতে সুনির্দিষ্ট করে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেসব অপরাধ সুনির্দিষ্ট করে ব্যাখার জন্য বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালের উচিত সাম্প্রতিক সময়ের সংজ্ঞা থেকে গাইডলাইন নেয়া। যেমন আইসিসিতে অপরাধের উপদানা ব্যাখ্যা করা আছে।

অতীত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইন নিয়ে প্রশ্ন:
স্টিফেন জে র‌্যাপের চিঠিতে   বলা হয়েছে, ১৯৭৩ সালে প্রণীত  আইনের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে যে আদালত গঠন করা হয়েছে তাতে বেশি কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।  তার মধ্যে একটি হল অতীতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এ আইনের গ্রহণযোগ্যতা।

কারণ নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি আইসিসিপিআর, (ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্ট অন সিভিল এন্ড পলিটিক্যাল রাইটস ) এর ১৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, “জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে প্রণীত কোন আইনে কোন ব্যক্তিকে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত করতে পারবেনা যদি ঐ ব্যক্তি আইন প্রণয়নের পূর্বে অপরাধ করে থাকে।” অর্থাৎ পরে আইন প্রণয়ন করে পূর্বের অপরাধের বিচার করতে পারবেনা।  বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের উচিত ১৯৭৩ সালের আইনের পর্যালোচনা করা যাতে বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক চুক্তি, আইন এবং সনদে স্বাক্ষর করেছে সেসব বিষয় ট্রাইব্যুনালে বজায় থাকে। ১৯৭৩ সালের আইনের যে রুলস অব প্রসিডিউর রয়েছে তা আইসিসিপিআর এর ১৫ ধারার সাথে সাযুজ্য কিনা তাও মিলিয়ে দেখা দরকার।


ট্রাইব্যুনালে পৃথক আপীল বিভাগ গঠন করা উচিত

 রাপের চিঠিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ক্ষেত্রে আলাদা কোন আপীল বিভাগ  রাখা হয়নি ।  বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং বিশেষ আদালতে  এ ব্যবস্থা রাখা হয়। ট্রাইব্যুনাল চূড়ান্ত রায় দেয়ার পর আসামী পক্ষ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে শুনানীর জন্য যেতে পারবে। সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ১৯৭৩ সালের আইনে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের জন্য একটি পৃথক এবং স্বতন্ত্র আপীল বিভাগ গঠন সম্ভব সুপ্রীম কোর্টের বিধানের সাথে সমন্বয় করে। পৃথক এ আপীল বিভাগের রুলস অব প্রসিডিউর সুপ্রীম কোর্টের রুলস অব প্রসিডিউর থেকে আলাদা হবে। 

আসামীর নির্দোষ দাবির  সুযোগ নেই১৯৭৩ সালের আইন ও ট্রাইব্যুনালে
স্টিফেন জে র‌্যাপের চিঠিতে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধ বিচারের লক্ষ্যে প্রণীত ১৯৭৩ সালের আইন  এবং এ আইনের অধীনে গঠিত ট্রাইব্যুনালের কোনটিতেই আসামীর নিজেকে নিদোর্ষ  দাবির  সুযোগ নেই। সারা বিশ্বের সকল আন্তর্জাতিক আইন, ট্রাইব্যুনাল এবং আইনের  প্রতিষ্ঠিত বিধান হল কাউকে বিচারে দোষী সাব্যস্ত করার আগ পর্যন্ত আসামী নিজেকে নির্দোষ দাবী করতে পারবে। তাকে অপরাধী বলা যাবেনা। কিন্তু ১৯৭৩ সালের আইন এবং ট্রাইবুনালে এ বিষয়টি নির্দিষ্ট করে উল্লেখ নেই।

তাছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য সকল আদালতে ফৌজদারী মামলার ক্ষেত্রে  সাক্ষ্য আইন এবং ফৌজদারী দণ্ডবিধি  প্রয়োগযোগ্য হলেও ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে  এ দুটি প্রয়োগের বিধান রাখা হয়নি।


আইসিসিপিআর এর ১৪ (২) ধারায় বলা  হয়েছে “বিচারে অপরাধী সাব্যস্ত  না হওয়া পর্যন্ত আইন অনুযায়ী যেকোন ফৌজদারী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেকে নির্দোষ দাবী করতে পারবে” । কিন্তু ১৯৭৩ সালের আইনে এবং বর্তমানের ট্রাইব্যুানালে কোথাও অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য রায়ের আগে নিজেকে নির্দোষ দাবি বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কোন কিছু উল্লেখ করা নেই।

যেহেতু বাংলাদেশ আইসিসিআরপি  রুলস গ্রহণ করেছে এবং বাংলাদেশের প্রচলিত ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আসামীর নির্দোষী দাবির ব্যবস্থা আছে তাই ট্রাইব্যুনালের  ক্ষেত্রে এ বিধান রাখার ব্যবস্থা করা উচিত। কম্পোডিয়ায় বিশেষ আদালতের জন্য যে মৌলিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় তাতেও এ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

আন্তর্জাতিক আদালতের উদাহরণ টেনে র‌্যাপ বলেন, ফৌজদারী  মামলার বিাচরের ক্ষেত্রে  আদালতের ওপর একটি দায়িত্ব থাকে ।  সেটি হল  আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে দূরতম কোন সন্দেহের অবকাশ থাকবেনা যে, সে অপরাধটি করেছে।

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত  ট্রাইব্যুনালের কার্যপ্রণালী বিধির ৫০ (১) এ বলা হয়েছে “অভিযোগ প্রমানের দায় আদালতের ওপর ন্যস্ত থাকবে” । কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য আদালতের কর্যিপ্রণালী



বিধিতে   এ বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ থাকে যে, আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হতে হবে। বাংলাদেশের আদালতের ওপর বিষয়টি নির্দিষ্ট করে আরোপ করা হয়নি। উপরন্তু ট্রাইব্যুনালের ৫০ (২) ধারায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমানের বিষয়টি কয়েকটি ক্ষেত্রে বরং অব্যাহতি দেয়া হয়েছে আদালতকে।    আসামীকে নির্দোষ প্রমানের দায়িত্ব সয়ং আসামীর ওপর অর্পন করা হয়েছে।  আন্তজাতিক যেসব আইন এবং  ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত গঠিত হয়েছে সেখানে এ বিষয়টি ভালভাবে সুরাহা করা হয়েছে এবং তাতে আসামীকে নির্দোষী প্রমানের দায়িত্ব আসামীর ওপর ন্যাস্ত করা হয়নি। বরং আসামী পক্ষের দাবি মোতাবেক আদালতে  আসামী পক্ষকে নোটিশ দেয়  আসামী পক্ষের বক্তব, সাক্ষ্য প্রমান উপস্থাপন, প্রস্ততি  গ্রহণ  এবং সাক্ষীদের তালিকা আদালতে হাজির করার জন্য। হেগভিত্তিক  ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) এর ৭৯ ধারায়  বিষয়টি বিস্তারিত উল্লেখ আছে।

আসামীকে নির্দোষ প্রমান এবং আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে তার দোষ যাতে আদালত প্রমান করতে বাধ্য হয় তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সংবিধানে একটি ধারা সংযোজনের সুপারিশ করা হয়েছে র‌্যাপের চিঠিতে। আইসিসির ৭৯ ধারা এবং কম্বোডিয়ার বিশেষ আদালত এর  ইন্টারন্যাল রূসা  ২১ (ঘ)  মোতাবেক এ ধারা সংবিধানে সংযোজন করা যায়।


র‌্যাপ  বলেন, ৪০ বছর আগে ১৯৭১ সালে বর্বরতার জন্য দায়ী অনেকে  মারা গেছে। তাদেরকে কখনো  প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয়নি। যুদ্ধাপরাধ আদালতের প্রধান কৌশলীকে অনেক ধকল মোকাবেলা করতে হবে। তাছাড়া ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার বেশ সীমাবদ্ধ। ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী পাকিস্তান বা অন্য দেশে বসবাসরতদের বিচারের ক্ষমতা নেই ট্রাইব্যুনালের। তারা সম্পূর্ণ ধরাছোয়ার বাইরে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতে ফৌজদারী  অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন এবং ফৌজদারী দণ্ডবিধি উভয়ই প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু ১৯৭৩ সালেল ২৩ ধারায় এর  একটিও রাখা হয়নি। ১৯৭৩ সালের ১৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধ প্রমানের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল টেকনিক্যাল রুলস অব এভিডেন্স মেনে চলতে বাধ্য নয়। বরং পত্রিকা, ম্যাগাজিনে  প্রকাশিত ছবি, প্রতিবেদন, ফিল্ম এবং টেপ রেকর্ডে ধারাণকৃত বিষয়াদি এবং অন্যান্য নন টেকনিকাল  প্রকৃয়া আদালত প্রমান হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে।

১৯৭৩ সালের আইনে অপরাধের সঠিক সংজ্ঞা নেই

স্টিফেন জে র‌্যাপের চিঠিতে বলা হয়েছে যুদ্ধাপরাধ  বিচারের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে যে আইন প্রণয়ন করা হয় তাতে অপরাধের সঠিক কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষন নেই এবং অপরাধকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। অপরাধের সঠিক কোন সংজ্ঞা নেই।  ১৯৭৩ সালের আইনে বর্ণিত অপরাধের ব্যাখ্যা বিশ্লেষনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সহায়তা  নিতে পারে বাংলাদেশ। কারণ আইসিসি’র আইনে বিভিন্ন   অপারাধকে সুনির্দিষ্টভাবে  সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং অপরাধের  সঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষন রয়েছে।

র‌্যাপের চিঠিতে ১৯৭৩ সালের আইনের রুলস অব প্রসিডিউর সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

১৯৭৩ সালের আইনটি প্রণয়নের সময় বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয় যাতে যুদ্ধাপরাধ বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আদালতের সামনে সংবিধান কোন  বাঁধা হয়ে দাড়াতে না পারে।  কিন্তু  তা সত্ত্বেও ৪০ বছর আগে প্রণীত আইনের মাধ্যমে ২০১১ সালে যে আদালত গঠন এবং বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে তাতে বেশ কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। ১৯৭৩ সালের আইনটি নুরেমবার্গ কোড অনুসারে তৈরি করা হয়। এর পর থেকে মানবিক আইনের আন্তর্জাতিক দর্শন পূর্ণরুপে বিকশিত হয়েছে। রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনাল, যুগোশ্লাভিয়া ট্রাইব্যুনাল, সিয়েরালিওনে বিশেষ আদালত গঠন  এবং আইসিসি প্রভৃতি গঠনের ফলে মানবিক আইনের দর্শন বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।


র‌্যাপ তার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ১৯৭৩ সালের আইনে বর্ণিত অপরাধসমূহ আন্তর্জাতিক আইনের  আলোকে  ব্যাখ্যা করতে পারলে এবং রুলস অব প্রসিডিউর সংশোধন করা হলে  বাংলাদেশের ট্রাব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হতে সক্ষম হবে বলে আশা করছি। কিন্তু তারপরও আপনারা যদি মনে করেণ এ পরিবর্তন যথেষ্ট নয় তাহলে আমি প্রস্তাব করব  যথাযথ আইনী সংশোধনী আনুন যাতে প্রত্যেকটি প্রস্তাবিত বিধি এবং প্রকৃয়া  আইসিটির কার্যপ্রণালীতে প্রয়োগ করা যায়।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তি, আইন এবং আদালতের সাথে বাংলাদেশের চুক্তির প্রসঙ্গ টেনে র‌্যাপ বলেছেন,  একটি স্বচ্ছ বিচার এবং অভিযুক্তদের অধিকার রক্ষায় ও অপরাধের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানের বিষয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে  প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং  তিনি আশা করছেন বাংলাদেশ তার নিজের দেয়া সেসব প্রতিশ্রুতি মেনে চলবে।  তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন,  যুদ্ধাপরাধের বিচার যাতে  স্বাধীন, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ হয় সেটিই তাদের   প্রত্যাশা। 

বিদেশী আইনজীবী আনার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে
স্টিফেন জে র‌্যাপ তার চিঠিতে বলেছেন,  যুদ্ধাপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে  বিদেশী আইনজীবীরা যাতে অংশ নিতে পারে সেজন্য সরকারের  উদ্যোগ নেয়া উচিত। যেহেতু বিদেশী আইনজীবী আনার ক্ষেত্রে  বার কাউন্সিলের অনুমোদন লাগে তাই সরকারের উচিত বারের কাছে এ বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করা।

র‌্যাপ বলেন,  যদিও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিদেশী আইনজীবী উপস্থিতির অনুমতি রয়েছে কিন্তু  প্রদত্ত এ অধিকার ফলপ্রসু করতে হলে সরকারের সদিচ্ছা  থাকতে হবে এবং  সরকারের নিজের পক্ষ থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু অনুমতি দিয়ে রাখলেই চলবেনা। কারণ বিদেশী আইনজীবীদের এদেশে  আসা এবং অবস্থানের বিষয়টি সরকারের ভিসানীতির ওপর নির্ভর করে।


র‌্যাপের চিঠিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধের বিষয়টি একটি খুবই বিশেষায়িত ক্ষেত্র   এবং এসব বিচারের ক্ষেত্রে বিশ্বের সকল দেশে একই মাপকাঠি, পদ্ধতি এবং মান বজায় রাখা উচিত। আর এজন্যই বিদেশী আইনজীবী উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৪২ ধারায় বিদেশী আইনজীবীদের উপস্থিতির অনুমতি দেয়া হয়েছে। যেকোন পক্ষ  বিদেশী আইনজীবী আনতে পারবে। তবে এ অধিকারকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে   সরকারের উচিত বার কাউন্সিলের কাছে   বিদেশী  আইনজীবী আনার ব্যাপারে প্রস্তাব করা যাতে বার কাউন্সিল  বিদেশী আইনজীবী আনার বিষয়টি অনুমোদন করে। আদালতের পক্ষ থেকে প্রধান কৌশুলী বিদেশী আইনজীবী আনার প্রস্তাব করতে পারে বার কাউন্সিলের কাছে। রুয়ান্ডায় গণহত্যার  দ্রত বিচারের ক্ষেত্রে তাদের অভ্যন্তরীণ আদালতে বিদেশী আইনজীবী ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেণ র‌্যাপ। 

র‌্যাপ তার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন কম্পোডিয়ায় বিশেষ আদালত গ্যালারীতে  এ পর্যন্ত ৭৩ হাজার দর্শক প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে। মূল বিচার এখনো শেষ হয়নি। কম্পোডিয়া এবং সিয়েরালিওনে যে বিচার চলছে তার প্রতি অধিকাংশ জনগণের সমর্থন রয়েছে এবং তারা মনে করে এ বিচার তাদের দেশে সামাজিক শান্তি স্থিতি এবং  ঐক্য গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশেরও উচিত বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সবাই যাতে সহজে জানতে পারে সে ব্যবস্থা রাখা ।
র‌্যাপ বলেন, বাংলাদেশ ৪০ বছর আগে ১৯৭১ সালে  সংঘটিত   অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধ বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালকে অনেক কঠিন পথ  পারি দিতে হবে। কিন্তু তারপরও

বাংলাদেশ এর একটি ইতিবাচক সমাপ্তি টানাতে পারে যদি  এদশের সব মানুষ মনে করে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ এবং ন্যায়ভিত্তিক  প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ বিচার সম্পন্ন হয়েছে।

র‌্যাপ তার চিঠিতে সর্বশেষ মন্তব্য করেণ এই বলে, “সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মান এবং  বিচার প্রক্রিয়া বজায় রেখে কিভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন এ ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে একটি মডেল হতে পারে সে বিষয়ে আমার এ চিঠি সংলাপের পথ প্রশস্ত করবে বলে আমি আশা  করি। ”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন