শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৩

সাঈদীর বিচার শুরু : বিচারপতি নিজামুল হকের ট্রাইব্যুনালে থাকার ব্যাখ্যা বুধবার

20-11-11
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এ বিচার  শুরু হলো ট্রাইব্যুনালে।
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের দায়ের করা দুটি আবেদনের শুনানীর মাধ্যমে আজ সকালে আদালতের  কার্যক্রম  শুরু হয়। প্রথম আবেদনটি ছিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম কোন বিবেচনায় পুনরায় আদালতে বসেছেন তার ব্যাখ্যা দাবি সংক্রান্ত। দ্বিতীয়টি ছিল মামলার কাগজপত্র  এবং স্বাক্ষীদের প্রস্তুতির জন্য তিন মাস সময় চেয়ে বিচার শুরু করার বিষয়ে।
প্রথম আবেদন  শুনানী শেষে  ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক আগামী ২৩ নভেম্বর তার (বিচারপতি নিজামুল হক) আদালতে বসা বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদানের দিন ধার্য করেন।  দ্বিতীয় আবেদনের প্রেক্ষিতে আগামী ৭ ডিসেম্বর তিনি অভিযুক্ত পক্ষের স্বাক্ষীদের তালিকা আদালতে উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি আদালত আগামী ৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রণের দিন ধার্য করেছেন।
এরপর তিনি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নির্দেশ দেন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে  অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপনের।  চিফ প্রসিকিউটর বেলা ২ টায় সূচনা বক্তব্য শুরু করেন।
ট্রাইব্যুনালের চেয়রম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটরদের সূচনা বক্তব্য রাখার নির্দেশ দেয়ায় তার বিরুদ্ধে আপত্তি জানান মাওলানা সাঈদীর প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানে বিরুদ্ধে উত্থাপিত আবেদনের শুনানী নিষ্পত্তি না করে বিচার শুরু করা উচিত নয়। এটা বেমানান। তিনি বলেন, সূচনা বক্তব্য রাখা মানে বিচার শুরু হয়ে যাওয়া। আগামী বুধবার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আবেদনের নিষ্পত্তির যে তারিখ ধার্য করা হয়েছে তার পরে এ বিচার শুরু করার জন্য প্রার্থনা করেন।
সকালে  ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের পদে বহাল থাকার বিষয়ে দায়ের করা আবেদনের শুনানিতে অংশ নেন সুপ্রিম কোর্টের নিসিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার  মওদুদ আহমেদ, সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। এসময় ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটরদের সাথে  অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম  শুনানীতে অংশ নেন।
ব্যারিস্টার মওদুদ  আহমেদ  শুনানীতে বলেন, এ বিচার একটি রাজনৈতিক রূপ লাভ করেছে।  বিরোধীদল দমনের জন্য ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে যাদের বিচার কার্যক্রম চলছে তাদেরকে ১৯৯৩ সালে গঠিত  গণতদন্ত কমিশন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেছিল। সেটি ছিল একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ।  সেই উদ্যোগের সাথে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক জড়তি ছিলেন। এই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অতীতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের একটি রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে বিচারকাজ চালিয়ে যান তাহলে এর রাজনৈতিককরণ আরো স্পষ্ট হবে। সেজন্য আপনি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান  পদে থাকলে  পদটি আরো  বিতর্কিত হবে এবং আপনি নিজেও বিতর্কিত হবেন। নিরপক্ষে এবং স্বচ্ছ বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই থাকেব ক্রমাগত।
পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক যদি বলেন যে, তিনি গণতদন্ত কমিশনের সাথে জড়িত ছিলেননা তাহলে সেটি ভিন্ন বিষয়।
ব্যারিষ্টার মওদুদ বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক  লিখিত আকারে বলুক তিনি কি করনে এখনো ট্রাইব্যুনালে আছেন। তিনি যদি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যান তাহলে সেটা হবে অসদারচনের শামিল। সুপ্রীম কোর্টের মর্যাদা, সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতির মর্যাদার স্বার্থে তার এ পদ থেকে সরে দাড়ানো উচিত। তিনি  বলেন, যেহেতু সরকার তাকে নিয়োগ দিয়েছে তাই সরকার প্রধান বিচারপতিকে পরামর্শ দিতে পারে তাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য।
অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানীতে অংশ নিয়ে  বলেন, এ ধরনের আবেদনের কথা আমরা কখনো শুনিনি। কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি এভাবে ব্যাখ্যা চাইতে পারেননা। এটি আদালত অবমাননার শামিল। একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারপতিকে বলতে পারেননা যে আপনি কেন আদালতে বসছেন  তার ব্যাখ্যা দিতে হবে।  বিচার কার্যক্রমকে বাঁধাগ্রস্ত করা এবং বিলম্বিত করার জন্যই এ ধরনের আবেদন করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল  হকের বিরুদ্ধে  ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণতদন্ত কমিশনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে এ পদ থেকে সরে দাড়ানোর দাবি জানিয়ে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে  ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক গত ২৭ অক্টোবর একটি আবেদন  দায়ের করেন। গত ১৪ নভেম্বর এ বিষয়ে শুনানী শেষে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয় এবং  বিচারপতি নিজামুল হকের সরে দাড়ানোর বিষয়টি তার সুবিবেচনার ওপর ছেড়ে দেন ট্রাইব্যুনালের অপর  দুই বিচারপতি এ. টি. এম. ফজলে কবির এবং এ. কে. এম. জহির আহমদ। গত ১৬  নভেম্বর আবার আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে দুই দিন অনুপস্থিতির পর  আদালতে বসেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক। তখন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয় বিচারপতি নিজামুল হক কোন বিবেচনায় আবার আদালতে বসেছেন সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে। পাশপাশি এ  বিষয়ে ব্যাখ্যা না দেয়া পর্যন্ত  ঐদিনের নির্ধারিত শুনানী মুলতবীর আবেদন জানানো হয়। কিন্তু সে আবেদন প্রত্যাখ্যান হওয়ায় ঐদিন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা আদালত থেকে বেরিয়ে আসেন। বিচারপতি নিজামুল হক কোন বিবেচনায় আদালতে বসেছেন সে বিষয়ে আবেদনের শুনানীর গতকাল ২০ নভেম্বর ধার্য ছিল। 
এবিষয়ে শুনানীতে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ভারত পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, বিচারপতি নিজামুল হকের এ পদ থেকে সরে দাড়ানো উচিত। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান কিভাবে তার সুবিবেচনা প্রয়োগ করেছেন, কোন বিবেচনায় এখনো তিনি আদালতে বসা অব্যাহত রেখেছেন, তিনি যে পক্ষপাতদুষ্ট নন এবং কিভাবে তিনি এ  বিচারে নিরপেক্ষতা বজায় রাখবেন  সে বিষয়ে আমরা ব্যাখ্যা চান তিনি।
শুনানী  শেষে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, যেখানে চেয়ারম্যানের থাকা বা না থাকার বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি সেখানে  সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে মাওলানা সাঈদীর  বিচার শুরু করা ঠিক হবেনা। অ্যাটর্নি জেনারেলের আদালত অবমানার অভিযোগ সম্পর্কে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা অনেকগুলো অভিযোগ করেছি, তার পক্ষে অনেক উদাহরণ পেশ করেছি। তার একটিও তো তিনি খন্ডাতে পারেননি। আদালত অবমাননার একটি উদাহরণও তিনি দিতে পারেননি। তার বক্তব্য রাজনৈতিক। আদালত অবমাননার বিষয়টি দেখবেন আদালত।
শুনানীতে অংশ নিয়ে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, একজন বিচারপতি তার নিজের মামলার বিচার নিজেই করতে পারেন না। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি আমাদের কাছে গৌরবের। যেহেতু আপনি সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেছে পক্ষপাতিত্ব নিয়ে এবং তার পক্ষে প্রমাণও হাজির করা হয়েছে তাই সুপ্রিম কোর্টের মর্যদা রক্ষায় আপনার সরে দাঁড়ানো উচিত।
মাওলানা  সাঈদীর অপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম আবেদন পেশের যৌক্তিকতা উপস্থাপন করে বলেন, ১৪ তারিখের আদেশে তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়নি। বিষয়টি আপনার (বিচারপতি নিজামুল হক) সুবিবেচনার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। তাই তিনি ট্রাইব্যুনারের চেয়ারম্যানের কাছে ব্যাখ্যা দাবী করেন তার আদালতে বসার অব্যাহত রাখার বিষয়ে।
বিচারপতি নিজামুল হক, বিচারপতি এ.টি.এম ফজলে কবীর ও বিচারপতি এ.কে.এম. জহির আহমেদ সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল উভয় পক্ষের শুনানি গ্রহণ করেন।
দুপুরের বিরতির পর রাষ্ট্রপক্ষে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর প্রারম্ভিক বক্তব্যের (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হয় মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর। ৮৮ পৃষ্ঠার স্টেটমেন্টের মধ্যে গতকাল বিকেল ৪ টা পর্যন্ত ৬১ পৃষ্ঠা পাঠ করা হয়েছে। আজ সোমবার যথারীরীতি বাকী অংশ পাঠ করা হবে। এই স্টেটমেন্ট সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়বস্তু উল্লেখ করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষে ৮৮ পৃষ্ঠার ওপেনিং স্টেটমেন্টের ওপর চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান বক্তব্য রাখেন। তারা তাদের বক্তব্যে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুট, হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা, দেশত্যাগে বাধ্য করা, হিন্দু মহিলাদের পাক বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া, পাকিস্তান ক্যাম্প স্থাপনে সহায়তা করা, ধর্ষণে সহায়তা করা সহ মানবতা বিরোধী অপরাধের তথ্য তুলে ধরেন।  তারা বলেন, এবিচার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা ব্যক্তিগত অভিলাষের জন্য জন্য নয় গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। মাওলনা সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও তারা উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিল করা ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ১৪ জুলাই। গত ৩ অক্টোবর সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০ টি অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গত বছর গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাকে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আটক রয়েছেন।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আদালতে আরো উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, ব্যারিষ্টার ফকরুল ইসলাম, ব্যারিষ্টার মুন্সী আহন কবীর, অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, ব্যারিষ্টার তানভীর আহমেদ আল আমীন, ব্যারিষ্টার ইমরান এ সিদ্দিক, ব্যারিষ্টার এহসান এ সিদ্দিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।   
অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নী জেনারেল ছাড়াও চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান, সৈয়দ হায়দার আলী, রানা দাশগুপ্ত, জিয়াদ আল মালুম, মোহাম্মদ আলীসহ অপরাপর প্রসিকিউটরগণ উপস্থিত ছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন