২৫/১২/২০১২
Mehedy Hasan
‘মোর স্বামীর পরানডা কি আছে? আমনেগো পায় ধরি, মোর স্বামীরে আইন্যা দেন। মোরে এটটু ঢাকা লইয়া যান। মুই যামু।’
দৈনিক নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে ফোন করা হয় অপহরনের শীকার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রী আরতী রানী বালীর কাছে। সুখরঞ্জন বালীর কোন খোঁজ পেলেন কি-না, আপনাদের এখন কি অবস্থা এসব প্রশ্ন করতেই কান্নার সুর ভেসে আসতে থাকে ফোনের অপর প্রন্ত থেকে। কান্না আস্তে আস্তে বিলাপে পরিণত হয়। বিলাপ করতে করতে আরতী রানী বারবার একটা কথাই বলতে লাগল ‘মোর স্বামীরে আইন্যা দেন, মোর স্বামীরে আইন্যা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। মোর স্বামীর পরানডা কি আর আছে? মোরে এটটু খবর দেন।’
আরতী রানী কাঁদতে কাঁদতে আরো বলেন, ‘ক্যান যে হে সাক্ষ্য দেতে গেল। আগেই বাড়ি আইয়া লোকজন কইছিল সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেলে তোরা বাঁচতে পারবিনা। শেষ পর্যন্ত কি হেইয়্যাই (তাই) আইল । ৩ তারিখ গেল ঢাকা। ৫ তারিখ ধইর্যা লইয়া গেল। আর কোন খবর পাইলামনা।’
আপনারা কোনভাবে খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন কি-না বা কেউ কোন খবর দিয়েছে কি-না জানতে চাইলে আরতী রানী বলেন, ‘মোরা মুর্খ মানুষ। কোথায় কার কাছে কি খোঁজ নিমু। কারে জিগামু। কে দেবে মোর স্বামীর খবর। মুই পইর্যা আছি বিছানায়। কাসতে কাসতে মোর জীবন যায়। মোর অসুখ।’
আপনাদের আয় রোজগার কি, সংসার কিভাবে চলছে জানতে চাইলে আবার কান্না জুড়ে দিয়ে বলেন, সংসার আর চলেনা। মাইয়ার জামাই ৫ কেজি চাউল দেছে। বুইনে দেয় মাঝে মাঝে, ভাইয়ে দেয়। মাঝে মাঝে অন্যরা দুয়েক কেজি চাউল লইয়া আয়। এইভাবে আর কয়দিন চলবে।’
সুখরঞ্জন বালী কি করত জানতে চাইলে তিনি বলেন, মিস্ত্রির কাজ করত। এই দিয়ে সংসার চলত। আবার কান্নার সুর তুলে ুিতনি বলতে লাগলেন ‘ঘর বানাইছে কিন্তু ঘরে রইতে পারলনা। মানুষটা কই চইল্যা গেল। আমনোগো পায়ে ধরি, মোর স্বামীরে আইন্যা দেন। আর কিছু চাইনা।’
ছেলে মেয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে আরতী রানী বলেন, এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছেলের বয়স ১৭/১৮ বছর।
গত ৫ নভেম্বর সুখরঞ্জন বালী মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ। ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা তাকে অপরহন করে । মাওলানা সাঈদীর পক্ষের কয়েকজন আইনজীবী এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। এ ঘটনা সাথে সাথে ট্রাইব্যুনালকে (১) অবহিত করে আসামী পক্ষ। ট্রাইব্যুনাল চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুকে এ বিষয়ে খোঁজ নেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। বেশ কিছুক্ষন পর তিনি ট্রাইব্যুনালে এসে জানান তিনি দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে এ নিয়ে আলাপ করেছেন। তারা জানিয়েছেন এ ধরনের কোন ঘটনার খবর তারা জানেননা। ট্রাইব্যুনালের গেটে এ জাতীয় কোন ঘটনাই ঘটেনি। এভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরনের দায়িত্ব অস্বীকার করে বিষয়টি এড়িয়ে গেল।
তারপর থেকে আজ অবধি নিখোঁজ সাক্ষী সুখরঞ্জন বালী।
সাক্ষী সুখরঞ্জন বালী ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য না দিয়ে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। বালীর বড় ভাই বিশাবালী ১৯৭১ সালে শহীদ হয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষের দাবি মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে। নিখোঁজ হবার আগে বালী একটি টিভিতে প্রদত্ত সাক্ষাৎকার দিয়ে বলে গেছেন পাকিস্তান আর্মি তার ভাইকে মেরেছে। তার ভাইকে ঘর থেকে ধরে নেয়া এবং হত্যার সময় সাঈদী সাহেব ছিলনা।
গত পাঁচ নভেম্বর মাওলানা সাঈদীপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, মনজুর আহমদ আনসারী, হাসাুল বান্না সোহাগের সাথে একই গাড়িতে করে ট্রাইব্যুনালে আসছিলেন সুখরঞ্জন বালী। সেদিন ট্রাইব্যুনালে বিশেষ নিরাপত্তার আয়োজন ছিল। বালীকে অপরহন করে নিয়ে যাওয়া বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবীরা জানান, তাদের বহনকারী গাড়িটি ট্রাইব্যুনালের গেটে পৌছলে গাড়ি থামিয়ে তাদের সামনেই বালীকে গাড়ি থেকে নামায় পুলিশের লোকজন। এরপর তাকে সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা দুই দিক থেকে দুই হাত ধরে টেনে দূরে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশের লোকজন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানানো হয়েছে অপহরনের পর দুবার তাকে পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল অসুস্থ অবস্থায়। কিন্তু সর্বশেষ সুখরঞ্জন বালী কোথায় কি অবস্থায় আছে তার খোঁজ খবর কেউ বলতে পারলনা। মানবাধিকার সংস্থারও কেউ এগিয়ে আসেনি বালী বা তার পরিবারের পাশে দাড়ানোর জন্য। ঢাকায় একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রধানকে ফোন করা হলে তিনি বিরক্তসহকারে বলেন আমরা এ নিয়ে কোন কথা বলতে চাইনা। এ নিয়ে আমরা কোন খোঁজ রাখিনা। কিছু জানিনা। আমাকে মাফ করবেন, কিছু মনে করবেননা, আমি এ নিয়ে কোন কথা বলতে পারবনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন