শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৩

প্রধানমন্ত্রীকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের চিঠি// ১৯৭৩ সালের আইন সংশোধন না হলে বিচার নিরপেক্ষ হিবেনা

19/4/11
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যুদ্ধাপরাধ বিচারের লক্ষ্যে প্রণীত ১৯৭৩ সালের আইন এবং আইনের বিধিবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়েছে।  প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত  চিঠিতে এ দাবি জানিয়ে বলা হয়, অন্যথায়    নিরপেক্ষ বিচারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে মানদণ্ড রয়েছে তা বিদ্যমান আইনটি  পূরণ করবেনা। একই চিঠিতে তিনি ন্যায় বিচারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনেরও দাবি জানিয়েছেন।

সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের নির্বাহী পরিচালক ব্রাড এডামস লিখিত এ চিঠি গত ১৮ মে ২০১১  প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র  মন্ত্রী এবং ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও রেজিস্ট্রার বরাবার পাঠানো হয়। স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ বিচারের দাবি জানিয়ে চিঠিতে বলা হয় যুদ্ধপরাধ,  গণহত্যা এবং  মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করতে হবে আইনে। তাছাড়া ১৯৭৩ সালের আইনকে সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে প্রথম সংশোধনী এনে ৪৭ ধারায় যেসব সংযোজনী আনা হয়েছিল তাও বাতিল করতে হবে। বিচারকে স্বচ্ছ নিরপেক্ষ করতে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত যেসব অধিকার রয়েছে তা বহাল রেখে ১৯৭৩ সালের আইন এবং আইনের বিধিবিধান সংশোধনের দাবি জানানো হয়েছে চিঠিতে।  তিনি বলেন আদালতে এমন কোন বিচারক নিয়োগ দেয়া উচিত নয় যাদের বিচার নিয়ে  কোন  ধরনের সন্দেহ দেখা দিতে পারে।

যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার অনুষ্ঠানকে স্বচ্ছ  এবং নিরপেক্ষ করার জন্য ব্রাড এডামসের চিঠিতে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আইনের  ৬ (৮) ধারা সংশোধন। এ ধারায় বলা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের  গঠন,  এবং ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান, মেম্বার নিয়োগ এবং তাদের  বিষয়ে কোন আপত্তি তুলতে পারবেনা অভিযুক্ত পক্ষ।  ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট  অন সিভিল এন্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিআরপি)’র ১৪ (১) ধারা  অনুযায়ী ৬(৮) ধারা সংশোধন করতে হবে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৭ (ক) ধারা বাতিল করতে হবে। ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে  “এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের  (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়,  এই সংবিধানের  অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবেনা।”

চিঠিতে বলা হয়েছে ১৯৭৩ সালের সংবিধানে নতুনভাবে সংযোজিত ৪৭  ক (১) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে  সংবিধানে অন্যান্য যেসব মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে  নির্দিষ্ট কিছু  লোকের ক্ষেত্রে।  অথচ সংবিধানে বলা হয়েছে সকলেরই আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকার আছে এবং তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে।
অভিযুক্ত ব্যক্তি তার অধিকার রক্ষার জন্য হাই কোর্টে আবেদন করার অধিকারসহ সংবিধানের ৩১, ৩৩, ৩৫ এবং ৪৪ ধারায় যেসব  অধিকার দেশের সকল নাগরিকের ক্ষেত্রে প্রদান করা হয়েছে তা  সংবিধানের ৪৭ (১) ধারার মাধ্যমে কিছু কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্র থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে।

আইসিসিআরপির ১৪ ধারা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) ৫৫ ও ৬৭ ধারায় বর্ণিত অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

এডামস ব্রাড তার চিঠিতে উল্লেখ করেণ, মানবাধিকার এবং আর্ন্তাজাতিক  বিভিন্ন আইনে বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী দেশ। এসব আইন এবং চুক্তি ছাড়াও বাংলাদেশের সংবিধানে যে মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার ঘোষনা দেয়া হয়েছে তার সাথে সমন্বয়  করে ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইনের সংশোধন করা উচিত। ইতোমধ্যে ১৯৭৩ সালের আইন এবং আইনের বিধিবিধানের যেসব সংশোধন করা হয়েছে তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, আইনটির আরো সংশোধন না হলে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ বিচারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত যে মানদণ্ড রয়েছে তা ১৯৭৩ সালের আইন  পূরণ করতে পারবে  বলে আমাদের মনে হয়না এবং এ বিষয়ে আমরা  উদ্বিগ্ন।  তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের আইন প্রণীত হওয়ার পর বিশ্বে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক আদালত গঠন এবং  বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালের আইনে যে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের কথা বলা হয়েছে ঐসব আন্তর্জাতিক আদালতেও এসব অপরাধের বিচার হয়েছে।  যেমন যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার জন্য গঠিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমানাল কোর্ট, সিয়েরালিওনে স্পেশাল কোর্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমানাল কোর্ট। এসব আদালতে বিচারের যে আওতা, অপরাধের যে সংজ্ঞা   নির্ধারণ করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করা হয়েছে বাংলাদেশের তা আমলে নেয়া উচিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারের লক্ষ্যে।

 বাংলাদেশ আইসিসিআরপির একটি পক্ষ হওয়ায় নিরপেক্ষ বিচার অনুষ্ঠান এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে উল্লেখ করেণ তিনি।


ব্রাড এ্যাডামসের চিঠিতে  অপরাধের সংজ্ঞা, বিচারক, বিচার প্রকৃয়া, অভিযুক্তদের অধিকার রক্ষা, বাংলাদেশের সংবিধানে ঘোষিত মৌলিক মানাবধিকার এবং ৪৭ (ক) ধারা সংযোজন,  স্বাক্ষীদের  নিরাপত্তা, জামিন, বিচারের আওতা, আটক ব্যক্তিদের চিকিৎসা, তদন্ত, মৃত্যুদণ্ড প্রভৃতি  ১২ টি  বিষয়ে দফাভিত্তিক সুপারিশ পেশ করা হয় ।

ব্রাড বলেন আইসিসির ২৬ ধারায়  উল্লেখ  করা হয়েছে  “অপরাধ সংঘটনের সময় যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে ছিল তাদেরকে আদালত বিচারের আওতায় আনতে পারবেনা”। বাংলাদেশেও যুদ্ধাপরাধ  বিচারের লক্ষ্যে প্রণীত আইনে এ জাতীয় ধারা সংযোজন করতে হবে।

আইনে বলা হয়েছে বিচারে আসামী  দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর কেবল মাত্র আপীল বিভাগে আবেদন করতে পারবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার চলাকালেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আপিল চেম্বারে পেশ করতে পারে। মধ্যবর্তী জামিনের জন্য একটি  বিশেষ আপিল আদালত গঠন করা দরকার।

কনভেনশন এগেনেস্ট টরচার (ক্যাট) এর বাংলাদেশ একটি পক্ষ।  ক্যাট চুক্তিতে বলা হয়েছে জোর করে, নির্যাতন করে, বল প্রয়োগ করে আসামীর কাছ থেকে তথ্য আদায় করা যাবেনা। বাংলাদেশে তথ্য আদায়ের জন্য নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এ বিষয়টি সংশোধন করা দরকার।

চিঠিতে ব্রাড উল্লেখ করেণ,     ১৯৭৩ সালের আইনে  যুদ্ধাপরাধ, গনহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনে বর্ণিত অন্যান্য অপরাধের বিচার এবং আদালত গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আইনে এসব অপরাধের কোন সুষ্পষ্ট সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষন নেই। আইসিসি, আইসিসিপিআর ধারা অনুযায়ী অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করে আইন সংশোধনের দাবি জানানো হয়েছে।

তিনি বলেন এমন কোন বিচারক নিয়োগ দেয়া উচিত নয় যাদের বিচার নিয়ে কোন ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে। আইনের ৬(৮) ধারায় বলা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের গঠন, চেয়ারম্যান এবং মেম্বার নিয়োগ নিয়ে কেউ কোন আপত্তি তুলতে পারবেনা।  অথচ  রোম সংবিধি অনুযায়ী আসামী এবং আইনজীবী উভয় পক্ষ থেকে বিচারককে অযোগ্য ঘোষনার দাবি করার অধিকার রয়েছে। তাই ৬(৮) ধারা নিয়ে আমরা খুব  উদ্বিগ্ন  এবং এটি সংশোধন করা উচিত।

অভিযুক্তদের অধিকার রক্ষায় আইন এবং আইনের বিধিবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়ে বলা হয় আইসিসি অনুযায়ী  কাউকে দোষ শিকারে বাধ্য করা যাবেনা, নিরব থাকার অধিকার দিতে হবে। আসামী পক্ষকে মামলার জন্য প্রস্ততি গ্রহনে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বিষয়ে তাকে স্পষ্ট করে জানাতে হবে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আসামী সম্পূর্ণ নিদোষ এ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন