মেহেদী হাসান,১০/২/২০১৪
বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মুফাসসিরে কোরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ এবং তার স্ত্রী মমতাজ বেগম কর্তৃক ১৯৭২ সালে দায়ের করা মামলা বিষয়ে যুক্তি পেশ করেছে আসামী পক্ষ। আজ এ বিষয়ে যুক্তি উপস্থান করে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম পিরোজপুরে ১৯৭২ সালে যে মামলা করেন তাতে তিনি মোট ১৩ জনকে আসামী করেন। কিন্তু সেই আসামীর তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। শুধু তাই নয়, মমতাজ বেগমের সে মামলার বিবরনে বলা হয়েছে ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবার নলবুনিয়া তার শশুর বাড়ি থাকা অবস্থায়। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের দাবি মাওলানা সাঈদীর পরামর্শে ৮ মে তাকে পাড়েরহাট বাজারে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। তিনি যদি এর সাথে জড়িত থাকতেন তাহলে অন্তত মমতাজ বেগমের মামলায় তাকে তখন আসামী করা হত।
প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহণ করেন।
শুনানীর সময় অ্যাডভোকেট শাহজাহান মমতাজ বেগমের মামলার সার্টিফায়েড কপি আদালতে পেশ করেন।
অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার বিচার চেয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ পিরোজপুর এসডিও বরাবর এ মামলা করেন। পরে ১৬ জুলাই এ মামলাটি থানায় এজাহার হিসেবে পাঠানো হয়।
মামলার এজাহারে মমতাজ বেগম উল্লেখ করেছেন তার স্বামী ইব্রাহীম কুট্টি তার বাপের বাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় শান্তি কমিটির লোকজন এবং পাকিস্তান আর্মি গুলি করে হত্যা করেছে। ঘটনার সময়কাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর ।
আর রাষ্ট্রপক্ষ চাজশিটে করেছে তাকে পাড়েরহাট বাজারে ১৯৭১ সালের হত্যা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরাও তাদের সাক্ষ্যে বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টিকে পাড়েরহাট বাজার ৮ মে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে যে মামলা করেছেন তাতে ঘটনাস্থল এবং ঘটনার সময়কাল সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন দেখা যায়।
তিনি বলেন, মমতাজ বেগমের মামলায় আরো উল্লেখ আছে যে, ওই ঘটনার সময় তাদের বাড়ি থেকে তার ভাই সাহেব আলীকে এবং তার মা সিতারা বেগমকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পিরোজপুর। পরে তার মাকে ছেড়ে দেয়া হলেও তার ভাই সাহেব আলীকে আর ছাড়া হয়নি। তাকে পাকিস্তান পিরোজপুরে আর্মি গুলি করে হত্যা করে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, মমতাজ বেগম সে মামলায় মোট ১৩ জনকে আসামী করেছেন। এরা হল দানেশ মোল্লা, আতাহার আলী, আশ্রাব আলী, আব্দুল মান্নান, আইউব আলী, কালাম চৌকিদার, রুহুল আমিন, আব্দুল হাকিম মুন্সি, মমিন উদ্দিন, সেকোন্দার আলী শিকদার, শামসুর রহমান এসআই, মোসলেম মাওলানা। এছাড়া পাকিস্তান আর্মিকেও আসামী করা হয় মমতাজ বেগমের মামলায়। কিন্তু মমতাজ বেগমের মামলায় আসামীদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই।
তিনি বলেন, পাড়েরহাটে ৮ মে’র ঘটনায় বারবার ঘুরে ফিরে দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার সিকদার, মোসমেল মাওলানা এদের নাম এসেছে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যে। মমতাজ বেগমের মামলায়ও তাদেরকেই আসামী করা হয়েছে।
এরপর অ্যাডভোকেট শাহজাহান মমতাজ বগেমের মামলার বিবরন পড়ে শোনান আদালতে। ১৯৭২ সালে দায়ের করা সে মামলার বিবরন নিম্নরূপ:
“ঘটনার বিবরন এই যে, বিবাদীগন পরষ্পর যোগাযোগে রাইফেল পিস্তল ছোরা লাঠি ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া আমার পিতার ঘর বেড়দিয়া আমার স্বামীর উপর গুলি করিয়া হত্যা করিয়া আমার শরীরে জখম করিয়া আমার মাতা ও ভ্রাতাকে ধরিয়া পিরোজপুর আনিয়া আমার মাতাকে ছাড়িয়া দিয়া আমার ভ্রাতা সিরাজুলকে গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। আক্রোশের কারণ এই যে, আমি ও আমার স্বামী আমার স্বামীর বারিতে বাদুরা গ্রামে বাসবাস করিতেছিলাম। গত মে মাসে পাক সৈন্য এদেশে আসিয়া যখন অকারনে গুলি করিয়া মানুষ হত্যা করিতে থাকে তখন কতিপয় হিন্দু আমাদের সরনাপন্ন হওয়ায় আমরা তাহাদের আশ্রয় দেওয়ায় পাক সৈন্য ও তাহাদের দালালরা আমার স্বামীকে হত্যা করিতে খোঁজ করিতে থাকায় আমরা ভয়ে ভীত হইয়া আমরা পিত্রালয়ে বসবাস করিতেছিলাম। তথায় বিবাদীগন ক্রোধ করিয়া উক্তরুপ অত্যাচার করিয়াছে।
প্রকাশ থাকে যে, বর্তমানে আমি গর্ভবতী থাকায় আমার পিতা পারোরহাট আওমীলীগ অফিসে জানাইয়া কোন প্রতিকার পাইনাই। তাই এই দরখাস্ত করিতে বিলম্ব হইল।
সে মতে প্রার্থনা, আদালত দয়া করিয়া উক্ত ধারামতে উক্ত বিবাদীগনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট দিয়া ধৃত করাইয়া সুবিচার করিতে আজ্ঞা হয়। ইতি মমতাজ বেগম”
মামলার বিবরন পড়া শেষে অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দাবি ১৯৭১ সালে আট মে ইব্রাহীমকে পাড়েরহাট বাজারে হত্যা করা হয়েছে। আর ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে মমতাজ বেগম তার আবেদনে উল্লেখ করেছেন তিনি তখন গর্ভবতী। ১৯৭১ সালের ৮ মে পাড়েরহাট ইব্রাহীম নিহত হলে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে তার গর্ভবতী থাকার কথা নয়। এথেকেও প্রমানিত যে ইব্রাহীম কুট্টি ১৯৭১ সালে আট মে পাড়েরহাট নিহত হয়নি। তাকে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর তার শশুর বাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায়ই হত্যা করা হয়েছে। এর সাথে মাওলান সাঈদী কোন অবস্থাতেই জড়িত নন। থাকলে অন্তত মমতাজ বেগমের মামলায় তার নাম থাকত আসামী হিসেবে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আমাদের এ ডকুমেন্টকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং একে অসত্য আখ্যায়িত করেছে। তাদের উচিত ছিল পিরোজপুর থেকে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে ডাকার ব্যবস্থা করে তাদের দাবি প্রমান করা। কিন্তু তারা তা করেনি। বরং আমরা থানা থেকে এ মামলার নথিপত্র তলবের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল সে আবেদন খারিজ করে দিয়েছে।
ইব্রাহীম কুট্টি বিষয়ে গতকাল যুক্তি পেশের শুরুতে অ্যাডভোকেট শাহজাহান রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের পরষ্পরবিরোধী কয়েকটি তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ সাক্ষী মানিক পসারী বলেছেন তাকে পাড়েরহাট পুলের গোড়ায় গুলি করে হত্যা করা হয়।
সপ্তম সাক্ষী মফিজ উদ্দিন বলেছেন, পুল থেকে ২০/৩০ হাত দূরে নিয়ে তাকে গুলি দিয়েছে। অষ্টম সাক্ষী বলেছেন ব্রিজের উপর নিয়ে তাকে গুলি করা হয়েছে। চতুর্থ সাক্ষী সুলতান বলেছেন, তাকে থানার ঘাটে গুলি করা হয়েছে। এভাবে হত্যার ঘটনাস্থল সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরাই ভিন্ন ভিন্ন কথা বলেছেন। শুধু তাই নয় রাষ্ট্রপক্ষের একটি ডকুমেন্টেও আবার হত্যার ঘটনাস্থল সম্পর্কে আরেক রকম তথ্য রয়েছে। এ ডকুমেন্ট জমা দিয়েছিলেন এক নং সাক্ষী এবং মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার। মাহবুুবুল আলম জিয়া নগর থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে পিরোজপুর বলেশ্বর নদীর বেদিতে নিয়ে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের একটি তালিকা তৈরি করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্যাডে তৈরি করা নিহতদের এ তালিকায় অন্যান্যদের মধ্যে ইব্রাহীম কুট্টির নাম রয়েছে একেবারে শেষে। এখানে উল্লেখ আছে ইব্রাহীম কুট্টিকে নলবুনিয়া তার শুশুর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে বলেশ্বর নদীর বেদিতে হত্যা করা হয়।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষই এ ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে এবং তারা এ ডকুমেন্ট এর ওপর নির্ভর করেছে। তাদের ডকুমেন্টেই উল্লেখ আছে ইব্রাহীম কুট্টিকে নলবুনিয়ায় তার শশুর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যে দাবি করেছে মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীরা। মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীরা বলেছেন তাকে ১ অক্টোবার নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে।
অ্যাডভোটেক শাহজাহান বলেন এটা পরিষ্কার যে, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী এবং ডকুমেন্টে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থান উল্লেখ আছে। আর রাষ্ট্রপক্ষ যখন ঘটনা স্থল থেকে সরে যায় তখন আসলে তারা মামলা থেকেই সরে গেছে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, মাওলানা সাঈদীর পক্ষে ১৭ তম সাক্ষী ভাগিরথীর ছেলে গণেশ চন্দ্র সাহা অষ্টম অভিযোগ ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ বিষয়ে একটি কথাও বলেননি। কিন্তু তারপরও এ অভিযোগ প্রমানের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল রায়ে অন্যান্য সাক্ষীর সাথে গনেশ চন্দ্রের ওপর নির্ভর করেছে ।
মানিক পসারীর বাড়িতে আগুন দেয়ার অভিযোগ বিষয়ে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, একুশের চোখ অনুষ্ঠানে এক সাক্ষাৎকারে মানিক পসারি বলেছেন তাদের বাড়িঘর পোড়ানোর কোন চিহ্ন এতদিন পর আর নেই। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে তাদের বাড়ির পোড়া টিন কাঠ আলামত হিসেবে হাজির করা হয়েছে। একুশের চোখ সাক্ষাৎকারে তার বক্তব্য অনুসারে এসব আলামত মিথ্যা।
অষ্টম অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন শেষে গতকাল দশম অভিযোগ বিশাবালী হত্যার অভিযোগ খন্ডন করে যুক্তি পেশ শুরু হয়েছে। শুনানী আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান এবং আসামী পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে গিয়াস উদ্দন মিঠু, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, তারিকুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দিক উপস্থিত ছিলেন।
বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মুফাসসিরে কোরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ এবং তার স্ত্রী মমতাজ বেগম কর্তৃক ১৯৭২ সালে দায়ের করা মামলা বিষয়ে যুক্তি পেশ করেছে আসামী পক্ষ। আজ এ বিষয়ে যুক্তি উপস্থান করে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম পিরোজপুরে ১৯৭২ সালে যে মামলা করেন তাতে তিনি মোট ১৩ জনকে আসামী করেন। কিন্তু সেই আসামীর তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। শুধু তাই নয়, মমতাজ বেগমের সে মামলার বিবরনে বলা হয়েছে ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবার নলবুনিয়া তার শশুর বাড়ি থাকা অবস্থায়। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের দাবি মাওলানা সাঈদীর পরামর্শে ৮ মে তাকে পাড়েরহাট বাজারে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। তিনি যদি এর সাথে জড়িত থাকতেন তাহলে অন্তত মমতাজ বেগমের মামলায় তাকে তখন আসামী করা হত।
প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহণ করেন।
শুনানীর সময় অ্যাডভোকেট শাহজাহান মমতাজ বেগমের মামলার সার্টিফায়েড কপি আদালতে পেশ করেন।
অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার বিচার চেয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ পিরোজপুর এসডিও বরাবর এ মামলা করেন। পরে ১৬ জুলাই এ মামলাটি থানায় এজাহার হিসেবে পাঠানো হয়।
মামলার এজাহারে মমতাজ বেগম উল্লেখ করেছেন তার স্বামী ইব্রাহীম কুট্টি তার বাপের বাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় শান্তি কমিটির লোকজন এবং পাকিস্তান আর্মি গুলি করে হত্যা করেছে। ঘটনার সময়কাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর ।
আর রাষ্ট্রপক্ষ চাজশিটে করেছে তাকে পাড়েরহাট বাজারে ১৯৭১ সালের হত্যা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরাও তাদের সাক্ষ্যে বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টিকে পাড়েরহাট বাজার ৮ মে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে যে মামলা করেছেন তাতে ঘটনাস্থল এবং ঘটনার সময়কাল সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন দেখা যায়।
তিনি বলেন, মমতাজ বেগমের মামলায় আরো উল্লেখ আছে যে, ওই ঘটনার সময় তাদের বাড়ি থেকে তার ভাই সাহেব আলীকে এবং তার মা সিতারা বেগমকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পিরোজপুর। পরে তার মাকে ছেড়ে দেয়া হলেও তার ভাই সাহেব আলীকে আর ছাড়া হয়নি। তাকে পাকিস্তান পিরোজপুরে আর্মি গুলি করে হত্যা করে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, মমতাজ বেগম সে মামলায় মোট ১৩ জনকে আসামী করেছেন। এরা হল দানেশ মোল্লা, আতাহার আলী, আশ্রাব আলী, আব্দুল মান্নান, আইউব আলী, কালাম চৌকিদার, রুহুল আমিন, আব্দুল হাকিম মুন্সি, মমিন উদ্দিন, সেকোন্দার আলী শিকদার, শামসুর রহমান এসআই, মোসলেম মাওলানা। এছাড়া পাকিস্তান আর্মিকেও আসামী করা হয় মমতাজ বেগমের মামলায়। কিন্তু মমতাজ বেগমের মামলায় আসামীদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই।
তিনি বলেন, পাড়েরহাটে ৮ মে’র ঘটনায় বারবার ঘুরে ফিরে দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার সিকদার, মোসমেল মাওলানা এদের নাম এসেছে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যে। মমতাজ বেগমের মামলায়ও তাদেরকেই আসামী করা হয়েছে।
এরপর অ্যাডভোকেট শাহজাহান মমতাজ বগেমের মামলার বিবরন পড়ে শোনান আদালতে। ১৯৭২ সালে দায়ের করা সে মামলার বিবরন নিম্নরূপ:
“ঘটনার বিবরন এই যে, বিবাদীগন পরষ্পর যোগাযোগে রাইফেল পিস্তল ছোরা লাঠি ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া আমার পিতার ঘর বেড়দিয়া আমার স্বামীর উপর গুলি করিয়া হত্যা করিয়া আমার শরীরে জখম করিয়া আমার মাতা ও ভ্রাতাকে ধরিয়া পিরোজপুর আনিয়া আমার মাতাকে ছাড়িয়া দিয়া আমার ভ্রাতা সিরাজুলকে গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। আক্রোশের কারণ এই যে, আমি ও আমার স্বামী আমার স্বামীর বারিতে বাদুরা গ্রামে বাসবাস করিতেছিলাম। গত মে মাসে পাক সৈন্য এদেশে আসিয়া যখন অকারনে গুলি করিয়া মানুষ হত্যা করিতে থাকে তখন কতিপয় হিন্দু আমাদের সরনাপন্ন হওয়ায় আমরা তাহাদের আশ্রয় দেওয়ায় পাক সৈন্য ও তাহাদের দালালরা আমার স্বামীকে হত্যা করিতে খোঁজ করিতে থাকায় আমরা ভয়ে ভীত হইয়া আমরা পিত্রালয়ে বসবাস করিতেছিলাম। তথায় বিবাদীগন ক্রোধ করিয়া উক্তরুপ অত্যাচার করিয়াছে।
প্রকাশ থাকে যে, বর্তমানে আমি গর্ভবতী থাকায় আমার পিতা পারোরহাট আওমীলীগ অফিসে জানাইয়া কোন প্রতিকার পাইনাই। তাই এই দরখাস্ত করিতে বিলম্ব হইল।
সে মতে প্রার্থনা, আদালত দয়া করিয়া উক্ত ধারামতে উক্ত বিবাদীগনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট দিয়া ধৃত করাইয়া সুবিচার করিতে আজ্ঞা হয়। ইতি মমতাজ বেগম”
মামলার বিবরন পড়া শেষে অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দাবি ১৯৭১ সালে আট মে ইব্রাহীমকে পাড়েরহাট বাজারে হত্যা করা হয়েছে। আর ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে মমতাজ বেগম তার আবেদনে উল্লেখ করেছেন তিনি তখন গর্ভবতী। ১৯৭১ সালের ৮ মে পাড়েরহাট ইব্রাহীম নিহত হলে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে তার গর্ভবতী থাকার কথা নয়। এথেকেও প্রমানিত যে ইব্রাহীম কুট্টি ১৯৭১ সালে আট মে পাড়েরহাট নিহত হয়নি। তাকে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর তার শশুর বাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায়ই হত্যা করা হয়েছে। এর সাথে মাওলান সাঈদী কোন অবস্থাতেই জড়িত নন। থাকলে অন্তত মমতাজ বেগমের মামলায় তার নাম থাকত আসামী হিসেবে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আমাদের এ ডকুমেন্টকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং একে অসত্য আখ্যায়িত করেছে। তাদের উচিত ছিল পিরোজপুর থেকে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে ডাকার ব্যবস্থা করে তাদের দাবি প্রমান করা। কিন্তু তারা তা করেনি। বরং আমরা থানা থেকে এ মামলার নথিপত্র তলবের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল সে আবেদন খারিজ করে দিয়েছে।
ইব্রাহীম কুট্টি বিষয়ে গতকাল যুক্তি পেশের শুরুতে অ্যাডভোকেট শাহজাহান রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের পরষ্পরবিরোধী কয়েকটি তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ সাক্ষী মানিক পসারী বলেছেন তাকে পাড়েরহাট পুলের গোড়ায় গুলি করে হত্যা করা হয়।
সপ্তম সাক্ষী মফিজ উদ্দিন বলেছেন, পুল থেকে ২০/৩০ হাত দূরে নিয়ে তাকে গুলি দিয়েছে। অষ্টম সাক্ষী বলেছেন ব্রিজের উপর নিয়ে তাকে গুলি করা হয়েছে। চতুর্থ সাক্ষী সুলতান বলেছেন, তাকে থানার ঘাটে গুলি করা হয়েছে। এভাবে হত্যার ঘটনাস্থল সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরাই ভিন্ন ভিন্ন কথা বলেছেন। শুধু তাই নয় রাষ্ট্রপক্ষের একটি ডকুমেন্টেও আবার হত্যার ঘটনাস্থল সম্পর্কে আরেক রকম তথ্য রয়েছে। এ ডকুমেন্ট জমা দিয়েছিলেন এক নং সাক্ষী এবং মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার। মাহবুুবুল আলম জিয়া নগর থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে পিরোজপুর বলেশ্বর নদীর বেদিতে নিয়ে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের একটি তালিকা তৈরি করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্যাডে তৈরি করা নিহতদের এ তালিকায় অন্যান্যদের মধ্যে ইব্রাহীম কুট্টির নাম রয়েছে একেবারে শেষে। এখানে উল্লেখ আছে ইব্রাহীম কুট্টিকে নলবুনিয়া তার শুশুর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে বলেশ্বর নদীর বেদিতে হত্যা করা হয়।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষই এ ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে এবং তারা এ ডকুমেন্ট এর ওপর নির্ভর করেছে। তাদের ডকুমেন্টেই উল্লেখ আছে ইব্রাহীম কুট্টিকে নলবুনিয়ায় তার শশুর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যে দাবি করেছে মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীরা। মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীরা বলেছেন তাকে ১ অক্টোবার নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে।
অ্যাডভোটেক শাহজাহান বলেন এটা পরিষ্কার যে, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী এবং ডকুমেন্টে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থান উল্লেখ আছে। আর রাষ্ট্রপক্ষ যখন ঘটনা স্থল থেকে সরে যায় তখন আসলে তারা মামলা থেকেই সরে গেছে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, মাওলানা সাঈদীর পক্ষে ১৭ তম সাক্ষী ভাগিরথীর ছেলে গণেশ চন্দ্র সাহা অষ্টম অভিযোগ ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ বিষয়ে একটি কথাও বলেননি। কিন্তু তারপরও এ অভিযোগ প্রমানের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল রায়ে অন্যান্য সাক্ষীর সাথে গনেশ চন্দ্রের ওপর নির্ভর করেছে ।
মানিক পসারীর বাড়িতে আগুন দেয়ার অভিযোগ বিষয়ে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, একুশের চোখ অনুষ্ঠানে এক সাক্ষাৎকারে মানিক পসারি বলেছেন তাদের বাড়িঘর পোড়ানোর কোন চিহ্ন এতদিন পর আর নেই। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে তাদের বাড়ির পোড়া টিন কাঠ আলামত হিসেবে হাজির করা হয়েছে। একুশের চোখ সাক্ষাৎকারে তার বক্তব্য অনুসারে এসব আলামত মিথ্যা।
অষ্টম অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন শেষে গতকাল দশম অভিযোগ বিশাবালী হত্যার অভিযোগ খন্ডন করে যুক্তি পেশ শুরু হয়েছে। শুনানী আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান এবং আসামী পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে গিয়াস উদ্দন মিঠু, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, তারিকুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দিক উপস্থিত ছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন