সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ডালিম হোটেল ঘটনার দিন ছাড়া আগে কখনো মীর কাসেম আলীকে দেখিনি-জেরায় সাক্ষী

দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান (এমসি) ও জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে গতকাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ তৃতীয় সাক্ষী নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর জবানবন্দী গ্রহণ করার পর তাকে জেরা শুরু করেন আসামীপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। আজ সাক্ষীর জেরা সম্পন্ন হয়েছে।
জেরায় সাক্ষী বলেছেন ডালিম হোটেলে ঘটনার দিন ছাড়া আগে কখনো মীর কাসেম আলীকে দেখিনি ।

সাক্ষ্যগ্রহণের সময় মীর কাসেম আলী ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় বসে সাক্ষ্য গ্রহণ দেখেন। তার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম এবং অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও সুলতান মাহমুদ সিমন।

জবানবন্দী (সংক্ষিপ্ত): জবানবন্দীতে সাক্ষী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৭ বছর। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় আমি চট্টগ্রাম শহরে আমি ও আমার সহযোদ্ধাদের সাথে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ করতে থাকি। তখন আমি শহরের আন্দরকিল্লার নাজির আহমেদ চৌধুরী রোডে আওয়ামী লীগ নেতা আজম নাসির উদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি। সেই বাড়ির নিকটে ছিল ডালিম হোটেল। যেটা ছিল আল-বদর বাহিনীর হেড কোয়াটার। আমার গোপন আস্থানার খবর কোনভাবে ফাঁস হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে এক গভীর রাতে আল-বদর বাহিনীর সদস্যরা এসে আমার আশ্রয়স্থল ঘেরাও করে ফেলে এবং আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে চোখ বেধে মারতে মারতে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। একটি অন্ধকার কক্ষে আমাকে ঢুকিয়ে মারধোর করতে থাকে এবং আমার কাছ থেকে জানতে চায় অস্ত্রসস্ত্র এবং আমার সহযোদ্ধারা কোথায়। আমার কাছ থেকে কথা বের করতে না পেরে আল-বদর সদস্যরা কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে আমার চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মীর কাসেম আলী অন্যান্য আল-বদর সদস্যদের নিয়ে আমার কক্ষে প্রবেশ করে। মীর কাসেম আলী আমাকে দেখিয়ে তার সঙ্গে আসা আল-বদর সদস্যদের বলে ওর কাছ থেকে কি এখনো কিছু আদায় করতে পারনি? ওকে আরো পেটাও’। এরপর আল-বদররা তাকে লাঠি, লোহার রড, ইলেকট্রিক তার এসব দিয়ে ইচ্ছেমতো পেটাতে থাকে। এক পর্যায়ে মীর কাশেম আলী নিজেই আমাকে জিজ্ঞাসা করে তোমার সহযোগীদের নাম কি? তাদের সেন্টার কোথায়, তাদের অস্ত্র কোথায়। আমি বলতে থাকি, আমি মুক্তযোদ্ধা নই। আমার কাছে কোন অস্ত্র নেই, আমি কিছু জানিনা। তখন তারা আমাকে পেটাতে পেটাতে রক্তাক্ত করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়।
৬ ডিসেম্বর আল-বদর সদস্যদের মুখে বলাবলি হচ্ছিল চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বম্বিং হয়েছে। সেখানে মীর কাসেম আলী আহত হয়েছে। এই কথাটি যখন প্রচারিত হয় তখন আল-বদররা আমাকে ও অন্যান্য বন্দীদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
’৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে আমরা অনুমান করতে পারি হোটেল নিস্তব্ধ। আল-বদরদের আনাগোনা চিল না। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর সকাল বেলা দরজা ভেঙ্গে গেলে দেখি বাইরে অনেক লোক। তারা বলছিলেন আল-বদররা পলিয়ে গেছে আপনারা বেরিয়ে আসুন। তখন আমরা যারা বন্দী ছিলাম তারা বাইরের লোকদের সহায়তায় বেরিয়ে আসি।
জবানবন্দি শেষে আসামীপরে আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সাক্ষীকে জেরা শুরু করে।

জেরা:
প্রশ্ন: আপনার জবানবন্দী মতে ৬ ডিসেম্বর মীর কাসেম আলী আহত হওয়ার পর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডালিম হোটেলে তাকে কখনো দেখেছেন?
উত্তর: আমি তাকে আমার কক্ষে কখনো দেখিনি।
প্রশ্ন: আপনি কি একই কক্ষে বন্দী ছিলেন, না বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কক্ষে আপনাকে রাখা হত?
উত্তর: ডালিম হোটেলের যে কক্ষে আমাকে প্রথম আটকে রাখা হয় সেখানেই সব সময় আমাকে থাকতে হত। তবে বিভিন্ন রুমে নিয়ে আমাকে নির্যাতন করা হত।
প্রশ্ন: আপনার বর্ণিত নির্যাতন ’৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কি ছিল?
উত্তর: হ্যাঁ, ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল।
এ পর্যন্ত জেরার পর গতকাল জেরা মুলতবি করা হয়।


৩/২/২০১৪
ডালিম হোটেল ঘটনার দিন ছাড়া আগে কখনো মীর কাসেম আলীকে দেখিনি-জেরায় সাক্ষী

জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান (এমসি) মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষী নাসিরুদ্দিন চৌধুরীকে আসামীপক্ষের জেরা শেষ হয়েছে। আজ  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ সাক্ষীকে জেরা করেন মীর কাসেম আলীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম।
জেরায় সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালে ডালিম হোটেলে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার আগে কখনো তিনি মীর কাসেম আলীকে দেখননি এবং ১৯৭১ সালের আগে মীর কাসেম আলীর সাথে তার কোন পরিচয়ও ছিলনা।

জেরা শেষে আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে।
 জেরার সময় মীর কাসেম আলীকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। তার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মিজানুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম এবং অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিক ও অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দিন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, সুলতান মাহমুদ সিমন ও নুরজাহান মুক্তা।

জেরা:
প্রশ্ন: আপনি কখন থেকে ডালিম হোটেল চেনেন?
উত্তর: স্বাধীনতার দুই বা তিন বছর পূর্ব থেকে মহামায়া নামে ওই হোটেলটি দেখেছি।
প্রশ্ন: ডালিম হোটেলের মালিক হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন।
উত্তর: সত্য। এই হোটেলটির নাম ’৭১ সালের পূর্বে ছিল মহামায়া হোটেল।
প্রশ্ন: ডালিম হোটেলের মালিক বা তার পরিবারের সদস্যদের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর: না।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালের আগে ওই ডালিম হোটেলের নিকটবর্তী ইসলামী ছাত্রসংঘের কোন অফিষ ছিল কি না?
উত্তর: জানা নেই।
প্রশ্ন: আপনি ভারতে যাওয়ার পূর্বে ডালিম হোটেলে কোন ক্যাম্প হয়নি।
উত্তর: সত্য।
প্রশ্ন: ভারতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ডালিম হোটেল ভবনটির মূল মালিকের দখলে ছিল কি?
উত্তর: বলতে পারব না।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর ডালিম হোটেলটির মালিক বা তার পরিবারের সদস্যদের সাথে কি আপনার দেখা হয়েছে?
উত্তর: দেখা হয়নি।
প্রশ্ন: বর্তমানে ডালিম হোটেলের মালিকানায় কে আছেন বলতে পারবেন?
উত্তর: বলতে পারব না।
প্রশ্ন: কখন থেকে ডালিম হোটেল টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়?
উত্তর: কখন থেকে বলতে পারব না।
প্রশ্ন: এ মামলার সাক্ষী জামালউদ্দিন যিনি একজন লেখক, তাকে চেনেন?
উত্তর: চিনি।
প্রশ্ন: ডালিম হোটেলের নির্যাতিত আবদুল জব্বার নামে কোন ব্যক্তির নাম শুনেছেন?
উত্তর: শুনিনি।
প্রশ্ন: আনোয়ারার জামাল চৌধুরীকে আপনি চেনেন?
উত্তর: চিনতাম। তিনি শান্তি কমিটি বা রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিলেন।
প্রশ্ন: মতিউর রহমান নামে কোন রাজাকারের নাম শুনেছেন?
উত্তর: শুনিনি।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে ডালিম হোটেলটি মতিউর রহমান রাজাকারের দখলে ছিল। 
উত্তর: আমার জানা নেই।
প্রশ্ন: ডালিম হোটেল ভবনের মালিক দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভবন দখল করে রাখা ও মহিলাদের শ্লীলতাহানি করার অভিযোগে ওই রাজাকার মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল।
উত্তর: সত্য নয়।
প্রশ্ন: আপনাকে আটক করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া বা সেখানে অত্যাচর করা বা সেখানে মীর কাসেম আলীর সাহেবকে দেখার কথা অসত্য। 
উত্তর: সত্য নয়।
প্রশ্ন: আপনি মীর কাসেম আলীকে কতদিন যাবৎ চিনতেন?
উত্তর: ডালিম হোটেল ছাড়া তার আগে অন্য কোথা মীর কাসেম আলী সাহেবকে আগে দেখিনি বা চিনতাম না।
প্রশ্ন: আপনি মীর কাসেম আলী সাহেবকে এই ট্রাইব্যুনালে দেখার আগে কখনোই দেখেননি।
উত্তর: সত্য নয়।
প্রশ্ন: আপনি কখন থেকে সাংবাদিকতা শুরু করেন?
উত্তর: ১৯৮০ সাল থেকে।
প্রশ্ন: বর্তমানে কোন পত্রিকায় কাজ করেন?
উত্তর: আমি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক।
প্রশ্ন: আপনার মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা সম্পার্কে কখনো কোন স্মৃতিচারণমূলক বা সম্পাদকীয় লিখেছেন?
উত্তর: না।
প্রশ্ন: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলা করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছেন?
উত্তর: না।
প্রশ্ন: মীর কাসেম আলীর সঙ্গে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আপনার কোন পরিচয় ছিল না।
উত্তর: সত্য।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালের পূর্বে বা পারে আপনি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন?
উত্তর: কোন ছাত্রসংগঠনের নেতা ছিলাম না, ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম।
প্রশ্ন: বিএলএফ মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে গঠিত হয়?
উত্তর: সত্য নয়।
প্রশ্ন: বিএলএফ এর প্রধান কে ছিলেন?
উত্তর: প্রধান কেউ ছিল না। সারা দেশে চারজন আঞ্চলিক প্রধান ছিলেন। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। 
প্রশ্ন: বিএলএফ এর ট্রেনিং কোথায় হয়েছিল?
উত্তর: আসাম রাজ্যের হাফনং-এ।
প্রশ্ন: বিএলএফ এর সঙ্গে গণবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী একই সঙ্গে ট্রেনিং নিয়েছিল?
উত্তর: সত্য নয়।
প্রশ্ন: আজম নাসিরউদ্দিন সাহেব কি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন?
উত্তর: না।
প্রশ্ন: আজম নাসিরউদ্দিন সাহেবের বাড়ি ও ডালিম হোটেল কি একই মহল্লায়?
উত্তর: একই মহল্লায় কি না জানিনা, তবে ওই বাড়ি থেকে ডালিম হোটেলের দূরত্ব ৬০০ থেকে ৭০০ গজ।
প্রশ্ন: হাজারি গলি হচ্ছে ডালিম হোটেলের পিছনে?
উত্তর: হ্যাঁ।
প্রশ্ন: হাজারি গলিটি একটি হিন্দু অধ্যুসিত এলাকা।
উত্তর: সত্য।
প্রশ্ন: এওয়াই খালেদ নামে কোন ব্যক্তিকে চেনেন?
উত্তর: না।
প্রশ্ন: নবী চৌধুরী ওরফে মাহমুদুন নবী চৌধুরীকে চেনেন?
উত্তর: নবী চৌধুরীকে আমি চিনতাম। তিনি শান্তিকমিটি চট্টগ্রামের প্রধান ছিলেন। আমার জানা মতে তিনি পিডিপি করতেন।
প্রশ্ন: জসিম, টুনটু সেন এবং রনজিত দাশকে আপনি চেনেন বা দেখে ছেন?
উত্তর: আমি তাদেরকে দেখিনি এবং আটক হওয়ার আগেও তাদের নাম শুনিনি।
প্রশ্ন: আপনি ওই তিনজনের নাম ট্রাইব্যুনালে প্রথম বলছেন?
উত্তর: ট্রাইব্যুনালে প্রথম বললাম কিনা সঠিক করে বলতে পারছি না, আগেও বলতে পারি।
প্রশ্ন: এই মামলার সাক্ষী সৈয়দ মো: এমরান ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আপনার সাথে ডালিম হোটেল থেকে মুক্তি পাননি। তিনি চট্টগ্রাম কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন? 
উত্তর: সত্য নয়।
প্রশ্ন: আপনি শোনা মতে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অসত্য সাক্ষ্য দিয়েছেন?
উত্তর: সত্য নয়।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন