শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

পিডব্লিউ ১৩

রোবার ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২
আমার নাম আনোয়রা বেগম, আমার বয়স অনুমান ৭০ বৎসর।
আমার গ্রাম রামকৃঞ্চপুর, থানা-হোমনা, জেলা-কুমিল্লা। আমি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়াছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের ১৬ বৎসর পূর্বে আমার সিরু মিয়া দারোগার সহিত বিবাহ হয়। বিয়ের পর কুষ্টিয়ার দর্শনাতে আমার স্বামীর কর্মস্থলে চলিয়া যাই। দুই বৎসর পরে আমার বাবার বাড়িতে আমার একমাত্র ছেলে সন্তান আনোয়ার কামাল জন্ম গ্রহণ করে। আনোয়ার কমালের যখন ৩/৪ মাস তখন তাকে সহ আমি গাজীপুরের কালিগঞ্জে স্বামীর কর্মস্থলে চলে যাই। এরপর আমরা মুন্সিগঞ্জ তৎপর মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানায় চলে যাই। এরপর আমরা ঢাকা কোর্টে চলে আসি, এরপর ঢাকা, রমনা থানায় আসি, তৎপর লালবাগ থানায়। সর্বশেষ মুহাম্মদপুর থানায় চলে যাই। সেখানে আমার স্বামী কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে আমরা যখন মোহাম্মাদপুর থানায় আসি তখন আমার পুত্র আনোয়ার কামালের বয়স ১৪ বৎসর ছিল এবং সে মতিঝিল সরকারি হাই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ তারিখে আমার স্বাক্ষী সিরু মিয়া মোহাম্মাদপুর থানায় দারোগা হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ঐ দিন দিবাগত রাতে যখন পাকিস্তান আর্মিরা মোহাম্মাদপুর থানা ঘেরাও করে ফেলে তখন আমার স্বামী পিছনের রাস্তা দিয়ে থানা থেকে বের হয়ে বাসায় আসেন। তখন আমাদের বাসা ছিল ৩৬ নম্বর চামেলীবাগ, শান্তিনগরে। তিনি বাসায় এসে আমাকে ও আমার ছেলেকে নিয়ে দোতলা থেকে নিচে নামার পর কয়েকজন লোক আমাদের ঐ বাড়ির সামনে এসে আমার স্বামীকে বলে যে, বেরিকেট দিতে হবে আপনি আমাদের সাথে চলেন। তখন আমার স্বামী আমাদের সেখানে রেখে তাদের সাথে চলে গেলেন। তখন রাত আনুমানিক সাড়ে এগারোটা বাজে। এরপর গোলাগুলির শব্দ শোনা যায় এবং মাইকিং হতে থাকে এই কথা বলে যে, আপনারা কেউ ঘর থেকে বের হবেন না। আমাদের ঘরের লাইট নিভিয়ে ফেলেন। চারদিকে গুলাগুলির শব্দ শুনা যায় এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনেও গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই এবং সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাত্রি আনুমানিক ১২টা সাড়ে বারোটার সময় আমার স্বামী বাসায় ফিরে আসেন। তখন আমরা ঘরের মেঝেতে শুয়েপড়ি। ঐ ২৫ মার্চ সারারাত্রি গোলাগুলির শব্দ শুনা যায়, ২৬ মার্চ সারাদিন এবং রাত্রি বেলায়ও গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। আমার স্বামী আমকে বলে যে, তাকে (সিরু মিয়া) সবাই চিনে তাকে হয়ত ধরে নিয়ে যাবে এবং আমার ছেলে কামালকেও মেরে ফেলবে আমরা তাঁকে বাঁচাতে পারবো না। ছেলে কামাল ২৫ মার্চ তারিখে বিকেলে আমাদের বাসার সামনে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিল। ঐ সময় আমাদের বাসা ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের খুবই নিকটে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছিল এবং ২৭ মার্চ তারিখ সকালে দুই ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়েছিল। তখন আমার স্বামী আমাকে বলেন যে, তুমি কামালকে নিয়ে খিলগাঁওয়ে তোমার বোনের বাসায় চলে যাও। তিনি আরো বলেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধু এবং গাজী গোলাম মোস্তফা সাহেবের খবর নিয়ে আসবেন। ২৭ মার্চ তারিখে সন্ধ্যার পরে খিলগাঁওয়ে আমার বোনের বাসায় এসে বলেন যে, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে গেছেন এবং গাজী গোলাম মোস্তফা পলাতক আছেন। মার্চ মাসের ২৮/২৯ তারিখে আমার স্বামী, ছেলে এবং ঐ বোনের পরিবারের সকল সদস্য সহ আমাদের নিজ গ্রামের বাড়ি রামকৃঞ্চপুরে চলে যাই। এর এক সপ্তাহ পরে আমার স্বামী ভারতে চলে যান। সেখানে ১৫/২০ দিন থাকার পর আমাদের গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। তিনি বলেন যে, তিনি ভারতে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যোগদান করে এসেছেন এবং তাকে আমাদের এখানকার ৫টি থানা এলাকার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের তদারকি করার জন্য। আমার স্বামী আমাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন এবং অনেককে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন এবং শরনার্থদের ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করতেন এবং তিনি এসব কাজের জন্য প্রায়ই ভারতে যেতেন এবং আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল। কামাল এই কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চাইতো। আমাদের বাড়িতে সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ তার পরিবার প্রায় একমাস অবস্থান করে তৎপর আমার স্বামী তাদেরকে ভারতে নিয়ে আসেন। তার ১৫ দিন পরে আমার স্বামী নদীর পাড়ে বসে ছিলেন এমন সময় একটা নৌকা করে জোহরা তাজউদ্দিন তার ছেলে মেয়েদের কে নিয়ে আসেন। তখন আমার স্বামী তাদেরকে অন্য একজন আত্মীয়ের আসায় নিয়ে রাখেন। ৩/৪ দিন থাকার পরে আমার স্বামী তাদেরকে ভারতে নিয়ে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর তারিখে আমার স্বামী আমার ছেলে কামাল, নজরুল, কাশেম, জাহাঙ্গীর, সেলিম ও সফিউদ্দিন ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। নজরুল দাউদকান্দি থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিল। যাওয়ার আগে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। ২৬ অক্টোবর তারিখে তারা ছতরা নামীয় একটি গ্রামে ছিল কারণ তখন বর্ডারে খুব কড়াকড়ি ছিল, তারা পার হতে পারে নাই। তালেব নামে একটি ছেলে ছিল যে জয়বাংলা পত্রিকা ভারত থেকে আনা নেওয়া করতো সে এসে বলে তন্তর নামে যে চেকপোষ্ট আছে সেখানে পাকিস্তানী আর্মি এবং রাজাকার নাই, সেই রাস্তা দিয়ে আপনারা যেতে পারেন। যাওয়ার সময় আমার স্বামী তালেবের হাতে আমার উদ্দেশ্যে লেখা চিঠি দিয়ে যান কোন চিন্তা না করার জন্য। আমি সেই চিঠি পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম যে, তারা ভারতে চলে গেছে। কিন্তু দুই দিন পরে আমার স্বামীর চাচাত ভাই ঝাড়–মিয়া এসে আমাকে বলেন যে, আমার স্বামী এবং ছেলে সহ যারা ভারতে যাচ্ছিলেন তারা রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েছে। পরে পাকিস্তান আর্মিরা এসে তাদেরকে ব্রাহ্মনবাড়িয়া অবস্থিত ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আমার ভাই ফজলু মিয়া ঐ ক্যাম্পে তাদেরকে দেখতে যান। আমার ছেলে কামাল সিগারেটের প্যাকেটের মধ্যে থাকা সাদা কাগজে লিখে একখানা চিঠি আমাকে দেয়। এই সেই চিঠির ফটোকপি যাহা ইতোপূর্বে প্রদর্শনী- ৪৯৭ হিসাবে চিহ্নিত আছে। তৎপর আমি ১৫ রোজার পরে আমার পিতার সঙ্গে ঢাকায় আসি। ঢাকায় এসে আমার বোনের বাসা খিলগাঁও উঠলাম। আমার উক্ত বোনের নাম মনোয়ারা এবং স্বামীর নাম মোঃ মহসীন আলী খান। আমার বোনের স্বামী তখন মতিঝিল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং পরে তিনি খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অবসরে যান। আমি আগেই জানতাম এবং মহসিনের নিকটও শুনেছি যে, গোলাম আযম সাহেবের দুই ছেলে মহসিন আলী খানের ছাত্র ছিল। আমি আমার ছেলে এবং স্বামীকে বাঁচানোর জন্য মহসীন আলী খানকে অনুরোধ করলে সে গোলাম আযম সাহেবের বাসায় গিয়ে তাদের ছাড়ানোর ব্যাপারে অনুরোধ করেন। তখন গোলাম আযম সাহেব বলেন আপনি দুই দিন পরে আসেন। তৎপর দুই দিন পরে মহসীন আলী খান গোলাম আযম সাহেবের বাসায় পুনরায় গেলে গোলাম আযম সাহেব গাড়িতে করে তাকে তার অফিসে নিয়ে যান।
তখন গোলাম আযম সাহেবের অফিস ছিল নাখালপাড়াস্থ পুরাতন সংসদ ভবনের পিছনে। গোলাম আযম সাহেব একটি চিঠি লিখে মহসিন আলী খাঁন এর হাতে দেন। মহসীন আলী খান চিঠিটি আমার হাতে দেন। উক্ত চিঠি নিয়ে আমার ভাই ফজলুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া যান এবং চিঠিটি তিনি পিস কমিটির সভাপতি পেয়ারা মিয়ার নিকট দেন। পেয়ারা মিয়া তখন আরেকটি চিঠি খুলে আমার ভাইকে দেখান এবং সেটা পড়তে বলেন। ঐ চিঠিতে নির্দেশ ছিল, এরা মুক্তিবাহিনী এদের খতম করে দেওয়া হোক। তিনি আমার ভাইকে আরও বলেন আপনি যে চিঠি নিয়ে এসেছেন সেই চিঠিতে অনেক লেখা থাকলেও এটা সাদা কাগজ এ লেখার গুরুত্ব নেই। তখন আমার ভাই কান্নাকাটি করে বাড়ি ফিরে আসেন এবং বাড়িতে এসেও কান্নাকাটি করেছেন। পেয়ারা মিয়া বাড়িতে এসে আমার ভাইকে আল্লাহর নাম নিতে বলেছেন। পেয়ারা মিয়া যে চিঠি আমার ভাইকে দেখিয়েছেন সেই চিঠির নির্দেশ ছিল গোলাম আযমের। এর দুইদিন পরে আমার ভাই কামালের আব্বা এবং কামালের সংগে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া দেখা করতে গেলে তার নিকট তার ব্যবহৃত কাপড় চোপড় ফেরত দেয়া হয়।
তখন শুনি তারা নিহত হয়েছেন। দেশ স্বাধীনের পর শফিউদ্দিন জেল থেকে বেরিয়ে এসে আমার সংগে দেখা করে এবং তার নিকট শুনেছি যে, আমার স্বামী ও সন্তানসহ ৩৮ জনকে ২১ শে নভেম্বর রোজার ঈদের দিন রাত্রে পৌরতলায় গুলি করে হত্যা করে মাটির নিচে পুতে ফেলা হয়েছে। তাদেরকে জেলখানা থেকে আর্মিরা নাকি রাজাকাররা নিয়ে গিয়েছিল তা সফিউদ্দিন আমাকে বলে নাই। যখন তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় তখন নাকি সবাই কান্নাকাটি করেছিল এবং কামাল নাকি বলছিল আমার মায়ের তো আর কেউ রইল না, কোনদিন যদি রাস্তায় কোন মহিলা পাগল দেখেন তখন মনে করবেন সেই আমার মা। ঐ সময় ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলে আহমদ ইমতিয়াজ বুলবুলও ছিল, সে দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। তার নিকট থেকে আমি একথাগুলি শুনেছি। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে এই মামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তার নিকট আমি ছবি এবং চিঠি দিয়েছি যা প্রদর্শনী- ৪৯৬ থেকে প্রদর্শনী -৪৯৬/৫ এবং ৪৯৭ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। আমি অত্র ট্রাইব্যুনালের নিকট আমার স্বামী, পুত্র সহ এই গণহত্যার বিচার চাই।

জেরা
১৫ রোজায় ঢাকায় এসে ৩/৪ দিন পরে আমি বাড়ি ফিরে যাই। সঠিক সময়টি আমার মনে নাই। (চলবে)

০১-১০-২০১২ ইং পুনরায় জেরা শুরুঃ
আমি আমার বাবার বাড়ি রামচন্দ্রপুরে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। রামচন্দ্রপুর মুরাদনগর থানার এবং রামকৃঞ্চপুর হোমনা থানায়, দুই স্থানের দূরত্ব ১ মাইলের মত। আমার পিতার পরিবার এবং আমার স্বামী সিরু মিয়ার পরিবারের মধ্যে পূর্ব থেকেই জানাশোনা ছিল। আমার বিবাহের কতদিন আগে আমার স্বামী চাকুরীতে যোগ দিয়েছিলেন তা আমি বলতে পারব না। আমার বিয়ের সময় আমার স্বামী খুব সম্ভব এস. আই পদে চাকুরী করতেন। আমার সঙ্গে বিবাহের পূর্বে তার কোন বিবাহ ছিল না। উনি ইন্টারমিডিয়েট পাশ ছিলেন। পুলিশের বিভিন্ন পদ পদবী সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণা নাই। আমার বিবাহের পরে উনি কোন প্রমোশন পেয়েছিলেন কিনা তা আমি বলতে পারব না। আমার সঙ্গে বিবাহের সময় তার বয়স অনুমান ২৫/২৬ বৎসর ছিল। আমার স্বামী দারোগা ছিলেন নাকি জমাদ্দার ছিলেন তা আমি জানি না। বিবাহের সময় আমার বয়স ছিল ১৪ বৎসর। আমার স্বামীর চার বোন ছিল। কোন ভাই ছিল না। ১৯৭১ সালে আমার শ্বশুর জীবিত ছিলেন না। ১৯৭১ সালে আমার শ্বশুর বাড়িতে আমি, আমার স্বামী, সন্তান ও শ্বাশুড়ি থাকতাম। আমার স্বামীর আত্মীয় স্বজনরা ঐ এলাকাতেই বসবাস করতেন। ১৯৭১ সালে আমার কোন আপন চাচা শ্বশুর বা মামা শ্বশুর জীবিত ছিলেন না। ঐ সময় আব্দুল মজিদ নামে এক সম্পর্কে চাচা শ্বশুরকে আমরা মুরব্বী হিসেবে মানতাম। আমার শ্বশুর বাড়ি হোমনা থানা থেকে তিন মাইল দূরে ছিল। ১৯৭১ সালে আমরা ৬ ভাই, তিন বোন ছিলাম। ৬ ভাইয়ের বর্তমানে ২ ভাই জীবিত আছে। আমার পিতা ব্যবসা করতেন। আমার জীবিত বড় ভাই পূর্বে ব্যবসা করতেন, এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। আমার স্বামী সিরু মিয়া সর্বশেষ কর্মস্থল মুহাম্মাদপুর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে ছিলেন তার নাম আমি এ মুহূর্তে বলতে পারব না। সেই সময় মুহাম্মদপুর থানায় কতজন দারোগা ছিলেন বা তাদের নাম কি ছিল তা আমি বলতে পারব না। মুহাম্মাদপুর থানায় কর্মরত থাকার পূর্বে আমার স্বামী কোর্টে কি হিসাবে কর্মরত ছিলেন তা আমি বলতে পারব না। আমরা চামেলীবাগের যে বাসায় থাকতাম তা সেই সময় খুব সম্ভব রমনা থানার অন্তর্গত ছিল। আমাদের পরিবারের সঙ্গে চামেলীবাগের স্থানীয় লোকদের সম্পর্ক ভাল ছিল। ঐ সময়ের চামেলীবাগের নেতৃস্থানীয় কোন আওয়ামী লীগ নেতার নাম আমি বলতে পারব না। আমার ছেলে আমাদের বাসায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সময় আমার ছেলের সঙ্গে আমার বাসার কাজের ছেলে ছিল। বাইরের কেউ ছিল না। ১৯৭১ সালে আমার ছেলে যে স্কুলে পড়াশুনা করতো সেই একই স্কুলে গোলাম আযম সাহেবের দুই ছেলে লেখাপড়া করতো একথা আমি আমার ভগ্নিপতি মহসীন আলী খানের নিকট থেকে শুনেছি। আমার ছেলে এ সম্পর্কে আমার নিকট কোন কথা বলে নাই। গোলাম আযম সাহেবের ছেলেরা কোন কাসে পড়তো বা তাদের নাম কি তা আমি জানি না। গোলাম আযম সাহেবের দুই ছেলের নাম আমার ভগ্নিপতি আমাকে বললেও তা আমার এখন মনে নাই। ২৫ মার্চের পরে আমার স্বামী সিরু মিয়া মুহাম্মাদপুর থানায় আর তার কার্য উপলক্ষ্যে যান নাই। আমরা যখন হোমনায় ফেরত যাই তখন আমাদের সঙ্গে আমার দুই বোন এবং তাদের স্বামী সন্তানরাও ছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমার বোনেরা এবং তাদের সন্তানরা ঢাকায় ফেরত আসে। আমার বোন মনোয়ারা আমার থেকে বয়সে ছোট। আমার বিবাহের কতদিন পরে আমার বোন মনোয়ারার বিবাহ হয় তা আমার খেয়াল নাই। ১৯৭১ সালে আমার বোন মনোয়ারার একটি ছেলে ছিল। মহসীন আলী খান বি. এ., বি. এড. ছিলেন। তিনি কোন সালে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেছিলেন তা আমার মনে নাই। আমার বোনের সঙ্গে বিবাহের পরে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। তিনি ২০০০ সালের পরে অবসরে গিয়েছেন, তবে সঠিক সন আমি বলতে পারছি না। তিনি শিক্ষকতা ব্যতীত অন্য কোন পেশা গ্রহণ করেন নাই। আমার দুই বোন আমার পিতার বাড়িতে ছিল। মুহসীন আলী খান সাহেব মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকায় তার কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন। আমরা গ্রামের বাড়িতে পৌঁছবার ৭/৮ দিন পরে মহসীন আলী খান ঢাকায় ফেরত আসেন। ১৬ ডিসেম্বরের আগে তিনি কয়েকবার কুমিল্লায় গিয়েছিলেন। তিনি কুমিল্লা গেলে তার শ্বশুর বাড়িতে থাকতেন। মহসীন আলী খান সাহেবের বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুকিমপুর গ্রামে। কুমিল্লা শহরে কবে শান্তি কমিটি গঠিত হয় তা আমি বলতে পারব না। কারা ঐ কমিটির দায়িত্বে ছিল তাও আমি বলতে পারব না। হোমনা থানার শান্তি কমিটির সভাপতি কে ছিলেন তার নাম এ মুহূর্তে আমার মনে নাই, কারণ তাকে মেরে ফেলেছে। আমার স্বামীর বাড়ি কোন ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত ছিল তা আমার জানা নাই। আমার স্বামীর ইউনিয়নে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান কে ছিলেন তা আমার জানা নাই। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমি একবার শুধু ঢাকায় এসেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে একবার ঢাকায় আসা ব্যতীত আমি সম্পূর্ণ যুদ্ধকালীন সময়ে আমার স্বামীর বাড়িতে ছিলাম। আমি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বা তৎপর কখনও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাই নাই। তালেবকে আমি যুদ্ধের আগে থেকেই চিনতাম, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তার সঙ্গে আরও ভালভাবে পরিচয় হয়। দেশ স্বাধীনের মাস খানেক পরে পুনরায় আমার বাবা আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় আমরা ঢাকার চামেলীবাগের যে বাড়িতে ছিলাম দেশ স্বাধীনের পরেও সেই বাড়িতে উঠেছিলাম। ঐ বাড়িটি আমার বাবা আমাকে দিয়েছিলেন। এখনও সে বাড়িতেই বসবাস করছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে মাঝে মধ্যে দেশের বাড়িতে বেড়াতে যাই, তবে স্থায়ীভাবে ঢাকার ঐ বাড়িতেই বসবাস করি। স্বাধীনতার পরে আমি কোন সালে দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই তা আমার মনে নাই। দ্বিতীয় বিবাহের পরে আমার এক মেয়ে হয়েছে। তালেবের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমার আর দেখা হয় নাই। জয়বাংলা পত্রিকার কোন কপি আমার নিকট এখন সংরক্ষিত নাই। আমার স্বামী সিরু মিয়া তালেবের মাধ্যমে যে চিঠিটি আমার কাছে দিয়েছিল তা এখন আমার কাছে নাই, তা হারিয়ে গেছে। যে চিঠির ফটোকপি (প্রদর্শনী- ৪৯৭) তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার নিকট থেকে এনেছেন তার মূল কপি আমার নিকট আছে। আমার ছেলের লেখা অন্য চিঠি এবং কাগজপত্র আমার সংরক্ষণে আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে থাকা অবস্থায় আমার স্বামী আমার নিকট কোন চিঠিপত্র দেয় নাই। আমি আমার ছেলে বা স্বামীকে কারাগারে কোন চিঠি পাঠাই নাই। আমাদের পক্ষে বা শ্বশুর বাড়ির পক্ষের কোন নিকট আত্মীয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ছিল না। আমার পিতা বা ভাইয়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে কোন ব্যবসা ছিল না। আমার স্বামী এবং সন্তান ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে থাকাকালীন সময়ে আমার ভাই ফজলুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে গেলে কোথায় অবস্থান করতেন তা আমার জানা নাই। আমার ভাই ফজলুর রহমান আমার থেকে তিন বৎসরের বড়। উনার এক মেয়ে, বয়স ৪০ বৎসর। আমার ঐ ভাইয়ের স্ত্রী এখনও জীবিত আছেন। তিনি এখনও আমার পিতার বাড়িতে বসবাস করেন। চিনু মিয়া নামীয় কোন ব্যক্তিকে আমি দেখি নাই। আমাকে আমার স্বামী ও সন্তানের আটক হওয়া সম্পর্কে যে খবর দেয় সেই ঝাড়–মিয়া বর্তমানে জীবিত নাই। যে সমস্ত রাজাকাররা আমার স্বামী এবং সন্তানকে আটক করেছিল তাদের পরিচয় কেহ আমার নিকট দেয় নাই। আমরা ঢাকা থেকে আমার শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পরে ঐ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঐ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পটি ছিল। আমার স্বামী আটক হওয়ার পরে ঐ ক্যাম্পের দায়িত্বে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ ছিল না, তবে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে আসা যাওয়া করতো। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই পরস্পর যোগাযোগ করতেন। আমার স্বামীকে ৫টি থানার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সেই থানাগুলির নাম আমার স্বামী আমাকে বলেন নাই। তবে তিনি হোমনা থানার দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যে সকল রাজাকারদের ধরে আনা হয়েছিল তাদের আমার স্বামীর বাড়িতে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল এবং মারধর করা হয়েছিল। তাদের কাউকে মেরে ফেলা হয় নাই। রাজাকাররা আমাদের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের কোন ব্যক্তিকে হত্যা করে নাই, তবে তারা থানায় যাতায়াত করার কারণে তাদেরকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বা তার আগে লঞ্চে যাতায়াত করতাম।

পেয়ারা মিয়ার বাড়ী কোথায় এবং পেশা কি ছিল এ সম্পর্কে আমার ধারণা নাই। পেয়ারা মিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে জীবিত ছিলেন কিনা সে সম্পর্কে আমি জানি না। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে উত্তেজিত জনতা পেয়ারা মিয়ার বাড়ি আক্রমণ করায় তার বাড়িতে ৯ জন সদস্য নিহত হয়েছেন কিনা সে সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নাই। পেয়ারা মিয়ার মেয়ের সংগে জেনারেল সফিউল্লার ছেলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিবাহ হয়েছে কিনা তা আমি জানি না। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমি পেয়ারা মিয়ার বিরুদ্ধে কোথাও কোন অভিযোগ দায়ের করি নাই আমার ভাই পেয়ারা মিয়ার নিকট গোলাম আযম সাহেবের চিঠি নিয়ে একাই গিয়েছিলেন আমি গোলাম আযম সাহেবের হাতের লেখা কোনদিন দেখি নাই। আমি তার স্বাক্ষরও দেখি নাই। গোলাম আযম সাহেবের হাতের লেখা বা স্বাক্ষর আমার ভাই ঐ চিঠি দেখার পূর্বে কখনও দেখে নাই। আমি ঢাকা থেকে গোলাম আযম সাহেবের যে চিঠিটি আমি নিজে নিয়ে আমার ভাইকে দিয়েছিলাম সেই চিঠিতে কি লেখা ছিল সেটা আমি দেখি নাই, কারণ সেটা খামবদ্ধ ছিল। আমার নিয়ে দেওয়া চিঠিটি আমার ভাই ফজলুর রহমান পেয়ারা মিয়ার ওখানে বসে পড়েছিল। সেই চিঠিতে কি লেখা ছিল তা আমার ভাই আমাকে বলেছিল। সেই চিঠিতে আমার স্বামী এবং সন্তানকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য বলা হয়েছিল। চিঠিটি ছোট দুই লাইনের চিঠি ছিল। চিঠিটি কাকে সম্বোধন করা হয়েছিল তা আমি বলতে পারব না। পেয়ারা মিয়ার নিকট থাকা আগের চিঠিটি কাকে সম্বোধন করা ছিল তা আমি বলতে পারিনা, তবে আমার ভাই দেখেছিল, কিন্তু সে আমাকে বলে নাই। আগের চিঠিটি পেয়ারা মিয়ার নিকট কিভাবে পৌছেছিল সে সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নাই। ঐ সময় ব্রাহ্মনবাড়িয়ার পিস কমিটির সভাপতি ছিলেন হাবিবুর রহমান, পেয়ারা মিয়া নয় এটা আমি জানি না। আমার স্বামী সহ ৩৮ জনের হত্যাকান্ডের বিষয়ে মামলা হয়েছিল মনে হয়, তবে আমরা করি নাই। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের নাম আমি ১৯৭১ সালের আগেও শুনেছি এবং পরেও শুনেছি। ১৯৭১ সালে আমাদের বাড়িতে রেডিও ছিল। আমাদের বাড়িতে পত্রিকা রাখা হতো। স্বাধীনতার পরেও আমাদের বাসায় পত্রিকা রাখা হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহায়তায় অথবা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহায়তাকারীরা এদেশে যে সব অপরাধ সংগঠন করেছিল সেই সমস্ত বিষয় তদন্তের জন্য সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল বলে আমি শুনেছি। উক্ত কমিশনের নিকট আমি আমার স্বামী ও সন্তানের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে কোন অভিযোগ দায়ের করি নাই। আমাদের বাড়ি থেকে হোমনা থানায় হেটে যাওয়া যেত এবং নৌকা বা লঞ্চেও যাওয়া যেত। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের হোমনা থানায় উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কাইউম শহীদ হয়েছিলেন পাক আর্মিদের সঙ্গে যুদ্ধে এবং পাক আর্মিরা যে লঞ্চে যাতায়াত করতো তাতে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেছিল। হাবিলদার গিয়াসকে আমি চিনি না। তবে একজন মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কোন সময়ে আমি আমার পিতার বাড়িতে থাকি নাই। আমার পিতার পরিবার ও শ্বশুরের পরিবার রাজনীতির সংগে সম্পর্কিত ছিল না।(চলবে)

০১-১০-১২ ইং পুনরায় জেরা শুরুঃ-
আমি সর্বশেষ আমার স্বামী সিরু মিয়ার রামকৃষ্ণপুর বাড়িতে কোন সালে যাই তা আমার স্মরণ নাই। সফিউদ্দিন (পি,ডব্লিউ-১১) আহমেদের সংগে আমার সর্ব প্রথম পরিচয় হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়। তার বাড়ি রামনগর। আমি তার বাড়িতে কোনদিন যাই নাই। বিজয়ের পরে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার ১৫/২০ দিন পরে আমার সংগে সফিউদ্দিন দেখা করে। তার সংগে পরবর্তীতেও আমার দেখা সাক্ষাত হয়েছে। সফিউদ্দিন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদানের পরেও আমার সাথে দেখা হয়েছে। স্বাধীনতার পরে সে আমার বাসায় ৮/১০ বৎসর ছিল। শহীদ নজরুল ইসলামের সংগে ২৫ শে অক্টোবর ১৯৭১ এর মাস খানেক আগে আমার সংগে প্রথম পরিচয় হয়। আহম্মেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সংগে আমার কোন পরিচয় নাই। তবে তার সংগে টেলিফোনে আমার কথা হয়েছে। আহম্মেদ ইমতিয়াজ বুলবুল যখন টেলিভিশনে আমার স্বামী ও ছেলের হত্যকান্ডের কথা বলে তখন তার সংগে আমি যোগাযোগ করে টেলিফোনে কথা বলি। সেটা আজ থেকে আট/দশ বৎসরের কম সময় আগে। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জারু মোল্লা নামীয় কোন ব্যক্তির নাম শুনি নাই। আমি দানা মোল্লা নয়, দানা মিয়ার নাম শুনেছি। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তার অন্যান্য পরিচয় সম্পর্কে আমার ধারণা নাই, তবে তার বাড়িতে নিয়ে কামাল এবং কামালের আব্বা সহ অন্যান্যদের নির্যাতন করেছে তাহা সফিউদ্দিনের নিকট থেকে আমি শুনেছি। এই দানা মিয়ার সংগে আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে যোগাযোগের চেষ্টা করি নাই। জাহাঙ্গীর সেলিমের সংগে আমার মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পরিচয় হয়। বিজয়ের পরে তার সংগে আমার দেখা হয় নাই। পেয়ারা মিয়ার নাম আমি আমার ভাইয়ের নিকট থেকে প্রথম শুনেছি। তিনি পিস কমিটির সভাপতি ছিলেন এটুকু ছাড়া তার অন্য কোন পরিচয় আমার জানা নেই।

আমার স্বামী ও সন্তানের হত্যাকান্ডের বিষয়টি স্বাধীনতার পর পত্র-পত্রিকায় বের হয়েছিল। সেই পত্রিকা আমি পড়েছিলাম। সেখানে গোলাম আযম সাহেবকে জড়িয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সেই পত্রিকার কপি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সরবরাহ করেছি। পত্রিকাটির নাম আমার এখন মনে নাই। সেই পত্রিকার ফটোকপি আমার নিকট আছে। গাজী গোলাম মোস্তফা সাহেবকে আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকেই চিনি। তাদের বাসায় আমাদের যাতায়াত ছিল। গাজী গোলাম মোস্তফা সাহেব ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আমার স্বামী এবং সন্তানের হত্যাকারীদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য আমি উনাকে অনুরোধ করি নাই। কারণ উনি সব জানতেন। আমার স্বামী এবং সন্তানের হত্যকান্ডের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সংগে দেখা করার চেষ্টা করি নাই। কারণ তিনিও এই ঘটনার বিষয় জানতেন। বিজয় অর্জনের পর ৭৫ সাল পর্যন্ত আমি স্বামী এবং সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে কোন পত্রিকায় বিবৃতি দেই নাই। পত্র-পত্রিকার পক্ষ থেকে আমার সাক্ষাত নেয়া হয়েছিল। পত্রিকার নাম মনে নাই। তবে সাংবাদিক মুছা সাদিক সাহেব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পরে এই সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন। সেখানে আমি এই চিঠির বর্ণনা দিয়েছিলাম। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংগে আমার ব্যক্তিগত কোন সাক্ষাত হয় নাই। আমার ছেলের স্কুলের সহপাঠীরা তার মৃত্যুর পর কয়েক বছর আমার বাসায় যাতায়াত করেছে। আমার ছেলে স্বাধীনতার যে পতাকাটি উত্তোলন করেছিল সেই পতাকাটি আমার নিকট নাই। কবি হাসান হাফিজুর রহমান সাহেবের নেতৃত্বে স্বাধীনতার ইতিহাস লেখার জন্য একটি কমিটি বা কমিশন গঠিত হয়েছিল কিনা তা আমার জানা নেই। রামকৃষ্ণপুর গ্রামে কুমিল্লার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার জন্য আমার খোঁজে লোকজন গিয়েছিল কিন্তু আমি বাড়ি ছিলাম না। কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচারের জন্য একটি গণ আদালত গঠিত হয়েছিল তা আমি শুনেছি। আমি গোলাম আযম সাহেবের বিরুদ্ধে গণ আদালতে অভিযোগ দায়ের করি নাই। ১৯৭১ সালে পাক আর্মি এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা সংঘঠিত বিভিন্ন অপরাধ তদন্ত করার জন্য একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল তা আমি শুনেছি। উক্ত কমিশনের নিকট আমি কোন অভিযোগ দিই নাই। ডা: এম, হাসান একই বিষয়ে গবেষণা কার্য পরিচালনা করেছেন কিনা তা আমি জানি না। ডা: এম, হাসান এর পক্ষ থেকে কোন ব্যক্তি আমার সংগে কোন সময় যোগাযোগ করে নাই। ঢা.বি. অধ্যাপক জনাব মুনতাসির মামুন (পি-ডাব্লিউ-১) একই বিষয়ে গবেষণা করেছেন তা আমি জানি। আমি তার সংগে স্বামী সন্তানের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে যোগাযোগের চেষ্টা করি নাই। তিনিও আমার সংগে কোন যোগাযোগ করেন নাই। আমার ভগ্নিপতি মহসিন আলী খান সাহেব খিলগাঁও সরকারী স্কুলে কোন সালে যোগদান করেন তা আমার মনে নাই। তবে তা স্বাধীনতার পরে। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মতিউর রহমান সাহেব সর্বপ্রথম এই মামলা সংক্রান্তে আমার সংগে যোগাযোগ করেন। তদন্তকালীন সময়ে আমার সংগে তদন্তকারী কর্মকর্তা মতিউর রহমান সাহেবের কয়েকবার দেখা হয়েছে। একই দিনে তার নিকট জবানবন্দী দিয়েছি এবং কাগজপত্র প্রদান করেছি। ১৯৭১ সালে আমি ঢাকায় যে এলাকায় থাকতাম সেই এলাকার জামায়াতের প্রধান কে ছিলেন তা আমি বলতে পারব না। আমার ছেলে আনোয়ার কামাল তৃতীয় শ্রেণী থেকেই সেন্ট্রাল সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মতিঝিলে পড়াশুনা করত, যাহা মতিঝিল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত।  আমার ছেলে কোনদিন অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের কোন ছেলের নাম আমার নিকট বলে নাই। মহসীন আলী খান সাহেব কোন সময়ই অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের ছেলেদের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন না, ইহা সত্য নহে। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব মহসীন আলী খান সাহবের নিকট কোন চিঠি দেন নাই এবং আমার ভ্রাতা ফজলুর রহমান ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় পেয়ারা মিয়ার নিকট ঐ চিঠি দেন নাই, ইহা সত্য নহে। পেয়ারা মিয়া সাহেবও আমার ভাই ফজলুর রহমানকে গোলাম আযম সাহেবের কোন চিঠি দেখান নাই, ইহা সত্য নহে। যেহেতু ফজলুর রহমান এবং পেয়ারা মিয়া কেউ জীবিত নাই এজন্য তাদের বরাত দিয়ে দীর্ঘদিন পর অসত্য তথ্য আদালতে উপস্থাপন করিয়াছি, ইহা সত্য নহে। পেয়ারা মিয়া ব্রাহ্মনবাড়িয়া শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন না, ইহা সত্য নহে। এ সম্পর্কে আমার নিকট কোন প্রামান্য তথ্য না থাকায় আমি সরকারি তদন্ত কমিশন গণ আদালতসহ অন্য কোথাও গোলাম আযমের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনি নাই, ইহা সত্য নহে। আমি যে দুটি চিঠির বর্ণনা দিয়েছি তা পরবর্তীকালে তদন্তকর্মকর্তা কর্তৃক শিখিয়ে দেয়া বক্তব্য, ইহা সত্য নহে।

ঐ দিন দিবাগত রাতে যখন পাকিস্তান আর্মিরা মোহাম্মাদপুর থানা ঘেরাও করে ফেলে তখন আমার স্বামী পিছনের রাস্তা দিয়ে থানা থেকে বের হয়ে বাসায় আসেন। বা (পুলিশ লাইনে) মাইকিং হতে থাকে এই কথা বলে যে, আপনারা কেউ ঘর থেকে বের হবেন না। আমাদের ঘরের লাইট নিভিয়ে ফেলেন। বা সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাত্রি আনুমানিক ১২টা সাড়ে বারোটার সময় আমার স্বামী বাসায় ফিরে আসেন। তখন আমরা ঘরের মেঝেতে শুয়েপড়ি। ঐ ২৫ মার্চ সারারাত্রি গোলাগুলির শব্দ শুনা যায়। বা আমার স্বামী আমকে বলে যে, তাকে (সিরু মিয়া) সবাই চিনে তাকে হয়ত ধরে নিয়ে যাবে এবং আমার ছেলে কামালকেও মেরে ফেলবে আমরা তাঁকে বাঁচাতে পারবো না। ছেলে কামাল ২৫ মার্চ তারিখে বিকেলে আমাদের বাসার সামনে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিল। ঐ সময় আমাদের বাসা ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের খুবই নিকটে। বা তাকে আমাদের এখানকার ৫টি থানা এলাকার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের তদারকি করার জন্য। বা নজরুল দাউদকান্দি থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিল। যাওয়ার আগে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। ২৬ অক্টোবর তারিখে তারা ছতরা নামীয় একটি গ্রামে ছিল কারণ তখন বর্ডারে খুব কড়াকড়ি ছিল, তারা পার হতে পারে নাই। বা এর দুইদিন পরে আমার ভাই কামালের আব্বা এবং কামালের সংগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দেখা করতে গেলে তার নিকট তার ব্যবহৃত কাপড় চোপড় ফেরত দেয়া হয়। বা দেশ স্বাধীনের পর শফিউদ্দিন জেল থেকে বেরিয়ে এসে আমার সংগে দেখা করে। একথা গুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে। গোলাম আযম সাহেবের দুই ছেলে আমার ভগ্নিপতি মুহসিন আলী খানের ছাত্র ছিল একথা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছি কিনা তা আমার স্মরণ নাই। ৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নাম শুনেছি, আমি সেখানে কোন বক্তৃতা দিই নাই। গোলাম আযম সাহেবকে জড়িয়ে আমি যে সমস্ত বক্তব্য দিলাম তা অসত্য এবং তদন্তকারী কর্মকর্তার শিখানো মতে, ইহা সত্য নহে। (সমাপ্ত)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন