মেহেদী হাসান, ৫/২/২০১৪
বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় একটি আলোচিত অভিযোগ হল ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা। এ অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগে রাষ্ট্র পক্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হল মফিজউদ্দিন পসারী। মফিজ উদ্দিন পসারী ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা ঘটনায় মাওলানা সাঈদীকে সরাসরি জড়িত করে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী দিয়েছেন। মফিজ উদ্দিন পসারী একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা ঘটনার বিবরন দিয়েছেন । কিন্তু একই সাক্ষী পিরোজপুরে একটি মামলায় মেজিস্ট্রেট এর কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীতে বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টিকে কে মেরেছে তা তিনি দেখেননি এবং জানেনওনা।
ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিল আবেদনে আজ এ বিষয়ে আসামী পক্ষ যুক্তি পেশ করেন।
প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহন করেন।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে যুক্তি পেশ করেন অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান। মফিজ উদ্দিন পসারী পিরোজপুরে মেজিস্ট্রেট এর কাছে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে যে জবানবন্দী দেন তা তিনি আদালতে পড়ে শোনান। ২০১০ সালে মফিজউদ্দিন কর্তৃক প্রদত্ত সে জবানবন্দীতে ঘটনার বিবরনে লেখা রয়েছে- ‘আমি ১৯৭১ সালে মুুক্তিযুদ্ধের সময় মানিক পসারীর পিতা সইজুদ্দীন পসারীর বাড়িতে গরু মহিষ চড়ানোর কাজ করতাম। আমার সাথে ইব্রাহীমও কাজ করত। একদিন পাক বাহিনীর লোকজন, মিলিটারি, দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার সিকদার ও দেলোয়ার আসে। এসে সইজুদ্দিন ও রইজুদ্দিনকে খোঁজ করে। তাদেরকে না পেয়ে বাড়িঘরে আগুন দেয়। আমাকে ও ইব্রাহীমকে মিলিটারি, সেকেন্দার সিকদার ও দানেশ মোল্লা নিয়ে যায়। আমি রাতে পালায়ে আসি। ইব্রাহীমকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে শুনি ইব্রাহীম মারা গেছে। কিন্তু কে মেরেছে দেখিনি ও জানিনা।’
কিন্তু এই মফিজ উদ্দিন পসারী ২০১১ সালে ২৯ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার সময় ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা ঘটনার বিবরন দিয়ে বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি পিরোজপুর বাদুরা গ্রামে তার মামা সইজুদ্দীন পসারীর বাড়িতে কাজ করতাম। আমার সাথে ঐ বাড়িতে কাজ করত ইব্রাহমী কুট্টি নামে আরেক লোক। ১৯৭১ সালের ৮ মে সকালে গরু মহিষ নিয়ে চরে যাই। সাথে ইব্রাহিম কুট্টিও ছিল। কিন্তু আনুমানিক ১০/১১টার দিকে চরে বসে বসে মামার বাড়িতে বাড়িতে আগুন এবং ধোয়া দেখতে পাই। তারপর মামার বাড়ির দিকে ফিরে আসি। ১২/১৪ জন পাক আর্মি, ২০/২২ জন রাজাকার মামার বাড়ি যাচ্ছে দেখতে পাই। তার মধ্যে দিলু শিকদার ছিল। আমরা পালাতে চাইলে পাক আর্মি ধরে ফেলে। দিলু শিকদার ইব্রাহীমের চুল ধরে বলে “শুয়ারের বাচ্চা যাচ্ছো কোথায়”। রাজাকার মবিন, রাজ্জাক আরো কয়েকজন আমাদের দুজনকে এক দড়িতে বাঁধে। এরপর রাজাকাররা ঘরে ঢুকে লুটপাট করে এবং কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেকেন্দা শিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, মবিন, রাজ্জাক দিলু শিকদারসহ আরো অনেক রাজাকার তেল ছিটিয়ে ঘরে আগুন দিতে বলে। তারপর আমাদের দুজনকে পারেরহট বাজারে নিয়ে যায়। বাজারের মধ্যে ব্রিজের মাঝখানে নিয়ে ইব্রাহিমকে জিজ্ঞেস করে সইজুদ্দীন পসারী, মানিক পসারী কোথায় থাকে। তুই তো সইজুদ্দীনের বডি গার্ড । তুই জানিস তারা কোথায়। না বললে তোকে গুলি করব। এরপর পুল থেকে নামিয়ে দিলু শিকদার (তাদের ভাষায় দিলু শিকদার মানে মাওলানা সাঈদী) সেকেন্দার শিকাদর উর্দুতে কি যেন বলল। আমি উর্দু বুঝিনা এবং কি বলেছিল তা শুনতে পাইনি। এরপর ইব্রাহিমকে দড়ি থেকে খুলে ছেড়ে দিল এবং আমাকে নিয়ে সামনের দিকে গেল।
তারপর গুলির শব্দ শুনতে পাই। ইব্রাহিম মা বলে চিৎকার করে। পেছনে তাকিয়ে দেখি ইব্রাহিমকে গুলি করছে। সেনাবানিহনী লাথি মেরে লাশ নদীতে ফেলে দিল। তারপর আমাকে নিয়ে পারেরহাট রাজাকার ক্যাম্পে গেল। সইজুদ্দীন পসারী এবং মানিক পসারীর নাম জানার জন্য অনেক অত্যাচার করল দানেশ আলী মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, দেলু শিকদার মবিন রাজাকার। এর এক পর্যায়ে রাতে বাথরুমে যাবার কথা বলে বাইরে বের হই এবং পালিয়ে আসি।
পিরোজপুরে যে মামলায় মফিজউদ্দিন পসারী জবানবন্দী দিয়েছেন সেই মামলটি করেছিলেন মানিক পসারী ২০০৯ সালে। মানিক পসারীও মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন। মানিক পসারী মাফিজ উদ্দিন পসারীর মামাত ভাই এবং মফিজ উদ্দিন মানিক পসারীদের বাড়িতে থেকে কাজ করত। ঘটনার দিন ইব্রাহীম কুট্টির সাথে মফিজকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মফিজ উদ্দিন, মানিক পসারীসহ রাষ্ট্রপক্ষের অন্যান্য সাক্ষীরা বলেছেন। অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, মানিক পসারী ট্রাইব্যুনালে তার সাক্ষ্যে মফিজ উদ্দিনের ওপর নির্যাতন বিষয়ে বলেছেন কিন্তু তিনি তাদের বাড়ির ঘটনা এবং ইব্রাহীম হত্যা বিষয়ে পিরোজপুরে যে মামলা করেছেন সেখানে মফিজ বিষয়ে বিষয়ে তিনি একটি কথাও উল্লেখ করেননি এবং মফিজকে সাক্ষীও করেননি।
আট নং অভিযোগ বিষয়ে আগের দিন উপস্থাপিত যুক্তির ধারাবাহিকতায় আজ সকালে সাত নং সাক্ষী মফিজ উদ্দিন পসারীর সাক্ষ্য খন্ডন করে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান। মফিজ উদ্দিন পসারী কর্তৃক পিরোজপুরে এবং ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ত জবানবন্দী তুলনা করে অ্যাডভোকেট শাহজাহান যুক্তি পেশ করেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মফিজ উদ্দিন যে জবানবন্দী দিয়েছেন তার একটি কথাও তিনি ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীতে বলেননি।
সকালে মহিষ চড়াতে যাবার কথা, সকাল ১০/১১টার দিকে গরু আতালে নিয়ে আসার কথা, দেলু শিকদার কর্তৃক থাবা দিয়ে ইব্রাহীম কুট্টির চুল ধরে গালি দেয়ার কথা, তাকে ও ইব্রাহীম কুট্টিকে এক দড়িতে বেঁধে রাখা, মা বলে চিৎকার শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি ইব্রাহীমকে গুলি দিছে এরপর লাথি মেরে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া, ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে দানেশ মোল্লা ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়ার ফলে তার ঠোট কেটে যাওয়া এবং দাত ভেঙ্গে যাওয়া, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয়ার কথা বলার পর রাজ্জাক রাজাকার তাকে নিয়ে বাইরে যাওয়া এবং তখন নদী পার হয়ে পালিয়ে যাওয়া, এরপর ফজরের সময় মানিক পসারীর সাথে দেখা হওয়ার পর তাকে সব ঘটনা খুলে বলার কথা তিনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীতে বলেননি।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ইব্রাহীম কুট্টিকে পাড়েরহাটে হত্যার ঘটনা দেখার কথা তিনি পিরোজপুরেও বলেননি এবং এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকেও বলেননি।
এসময় একজন বিচারপতি বলেন, বরং পিরোজপুরে মেজিস্ট্রেট এর কাছে তিনি পজিটিভ জবানবন্দী দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইব্রাহীম কুট্টিকে কে মেরেছে তা তিনি জানেননা। দ্যাট ইজ ভেরি ইমপরটেন্ট।
অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, চার্জে ঘটনার সময় উল্লেখ আছে ৩টা। কিন্তু মফিজ উদ্দিন বলেছেন ১০/১১টার দিকে তিনি মানিক পসারীর বাড়িতে ধোয়া উড়তে দেখেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের ছয় নং সাক্ষী মানিক পসারী বলেছেন, ঘটনার দিন রাত দেড়টার দিকে মফিজ পালিয়ে তার কাছে আসে। তিনি তখন মফিজের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন। অপর দিকে মফিজ বলেছেন, রাতে পালিয়ে এসে মানিক পসারীর বাড়িতে কাউকে তিনি পাননি। জঙ্গলে বাকি রাত পার করেন। ফজরের সময় মানিক পসারী জঙ্গলে তার কাছে আসে দেখা করার জন্য।
এরপর আট নং অভিযোগ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আট নং সাক্ষী মোস্তফা হাওলাদারের সাক্ষ্য খন্ডন করে যুক্তি পেশ করেন অ্যাডভোকেট শাহজাহান। তিনি বলেন, অন্য সাক্ষীরা বলেছেন ইব্রাহীম ও মফিজকে প্রথমে পাড়েরহাট বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ইব্রাহীমকে হত্যার পর মফিজকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু আট নং সাক্ষী বলেছেন প্রথমে দুজনকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় পরে কুট্টিকে পাড়েরহাট ব্রিজের কাছে আনা হয়।
জেরায় মোস্তফা হাওলাদারকে সাজেশন দিয়ে বলা হয় একই দড়িতে দুজনকে বাঁধা, লাথি মেরে ইব্রাহীমের লাশ নদীতে ফেলে দেয়ার কথা আপনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বলেননি। মোস্তফা হাওলদার জবাব দেন তিনি বলেছেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে জেরায় প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান একথা মোস্তফা হাওলাদার তাকে বলেননি।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষের নয় নং সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে যুক্তি পেশ করা হয়। আট নং অভিযোগ বিষয়ে নয় নং সাক্ষী বলেছেন পাড়েরহাট ও আশপাশের এলাকায় যেসব লুটপাট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে তা সবাই হয়েছে মাওলানা সাঈদীর নেতৃত্বে। ট্রাইব্যুনাল রায়ে নয় নং সাক্ষীর একথাটা আমলে নিয়েছে কিন্তু এই কথাটা আবার সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বলেননি।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষের ১০ নং সাক্ষী বাসুদেব মি¯ির সাক্ষ্য বিষয়ে যুক্তি পেশ করা হয়। অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, সাক্ষী বলেছেন, সাক্ষীর তার জবানবন্দীতে জানিয়েছেন তার পিতা তখন মানিক পসারীর বাড়িতে কাঠ মিস্ত্রির কাজ করত। সেও তার পিতার সাথে যোগালীর কাজ করত। ঘটনার দিন খুব সকালে সে তার পিতার সাথে মানিক পসারীর বাড়িতে আসে। সাক্ষী জানায় সকাল আটটা/নয়টার দিকে আর্মি আসার ঘটনায় বাড়ির সব লোকজন পালিয়ে যায়।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, সকাল আটটা/নয়টার দিকে বাড়ির সব লোকজন পালিয়ে গেল। ঘটনা ঘটল বিকাল তিনটায়। সাক্ষী দাবি করেছেন তিনি বাড়ি লুটপাট, আগুন দেয়া, ইব্রাহীম ও মাফিজকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া এবং হত্যার ঘটনা দেখেছেন। এ ঘটনা দেখতে হলে তাকে তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রশ্ন হল বাড়ির সব লোক যখন পালিয়ে গেল তখন একজন কাঠ মিস্ত্রি কেন সেখানে এত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন? এটা মানুষের স্বাভাবিক স্বভাবের বিরুদ্ধ আচরন এবং এটা অসম্ভব ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তদুপরি তিনি একজন হিন্দু। তখনকার পরিস্থিতিতে পাকিস্তান আর্মি আসায় সবাই পালিয়ে গেল আর তিনি একজন হিন্দু যুবক হয়েও সেখানে অবস্থান করার দাবি সে সময়কার বাস্তবতার সাথে খাপ খায়না।
তাছাড়া বাসুদেব পিরোজপুর মামলায় একজন সাক্ষী এবং সেখানে তিনি তার জবানবন্দীতে বলেছেন ইব্রাহীমকে কে গুলি দিয়েছে তা তিনি দেখেননি। তিনি একথা শুনেছেন। সুতরাং এ সাক্ষী কোন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নয়।
রাষ্ট্রপক্ষের ১১ নং সাক্ষী আবদুল জলিল শেখ সাক্ষ্য দেয়ার এক বছর আগে থেকে একটি খামার একটি বাড়ি প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন। তার প্রথম স্ত্রীর নাম সখিনা। তৃতীয় স্ত্রীর নাম ফিরোজা। দ্বিতীয় স্ত্রী গোলেনুর তার বিরুদ্ধে যৌতুক মামলা করলে পরে সমঝোতা হয়। কিন্তু পরে গোলেনুর আবার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে। এ কারনে সে তখন সাত মাস হাজত খাটে। পরে আপস রফায় মামলা নিষ্পত্তি হয় বলে ট্রাইব্যুনালে জানিয়েছে সে। সাক্ষী বিষয়ে এ তথ্য উপস্থাপনের সময় একজন বিচারপতি বলেন মামলা ফেস করা এবং হাজত বাস মানেই দোষী সাব্যস্ত হওয়া নয়। কারো বিরুদ্ধে মামলা থাকতেই পারে। কাজেই এসব বিষয় না বলাই ভাল।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ১১ নং সাক্ষী আবদুল জলিল শেখ বলেছেন তিনি মানিক পসারীর বাড়িতে আগুন দেয়ার দিন মানিক পসারীর ভাই আলমগীর শেখসহ অন্যান্যদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন। কিন্তু মানিক পসারী জানিয়েছেন আলমগীর পসারী তার থেকে ৩০ বছরের ছোট। ১৯৭১ সালে মানিক পসারীর বয়স ছিল ২৭ বছর। সে হিসেবে আলমগীর পসারীর তখন জন্মই হয়নি। কাজেই তাকে দেখার কথা মিথ্যা।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে আট নং অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নং সাক্ষীর ওপরও নির্ভর করেছেন। কিন্তু ১২ নং সাক্ষী এমপি আবদুল আউয়াল আট নং অভিযোগ বিষয়ে কিছুই বলেননি। আট নং অভিযোগ প্রমানের ক্ষেত্রে কেন তার ওপরও নির্ভর করল তা আমরা বুঝতে পারছিনা।
এরপর আট নং অভিযোগ প্রমানের ক্ষেত্রে আসামী পক্ষের যেসব সাক্ষীর ওপর ট্রাইব্যুনাল নির্ভর করেছেন তাদের বিষয়ে যুক্তি উপস্থান করা হয়। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে যে তিনজন সাক্ষী ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের সকলেই বলেছেন, ইব্রাহীমকে নলবুনিয়ায় তার শশুরবাড়ি থাকা অবস্থায় অক্টোবার মাসে রাজাকাররা হত্যা করে। তাকে জুন মাসে পাড়েরহাট হত্যা করা হয়নি।
আসামী পক্ষের ২ নং সাক্ষীর জবানবন্দী তিনি এসময় পড়ে শোনান আদালতে। ২ নং সাক্ষী আব্দুর রাজ্জাক তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন আমাদের নলবুনিয়ায় একটা ঘটনাই ঘটেছে। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি হঠাৎ একদিন শেষ রাত্রে একটা আওয়াজ হয়। আমি অনুমান করলাম এটা গুলির আওয়াজ। তারপর দেখি যে, ফজরের টাইম হয়ে গেছে। আমি আযান দিয়া নামাজ পড়ি। নামাজ পড়ার পর উত্তরদিকে রাস্তার পাশে যাই কোথায় কি হয়েছে জানার জন্য। তখন গিয়ে দেখি উত্তর দিক থেকে সামনের খাল দিয়ে নৌকায় করে ইব্রাহিম কুট্টির লাশ নিয়ে পাড়ের হাটের দিকে আসতেছে। নৌকায় কালাম চৌকিদার, আইয়ুব আলী চৌকিদার এবং হাকিম মুন্সিকে দেখি। এরপর দেখি আরও কয়েকজন লোক খালের পাড় দিয়ে উত্তর দিক থেকে আসতেছে। যে সব লোক আসতেছে তাদের মধ্যে দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, মোসলেম মাওলানা, রুহুল আমিন, মোমিন রাজাকার ছিল। আরও দেখি উক্ত লোকেরা আজু হাওলাদারের বৌ এবং তার ছেলে সাহেব আলীকে বেঁধে নিয়ে আসতেছে এবং পাড়েরহাটের দিকে নিয়া যাচ্ছে। তারপর দিন শুনি আজু হাওলাদারের বৌ বাড়িতে আসে এবং সাহেব আলীকে পিরোজপুরে নিয়ে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেছেন, এ সাক্ষী ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছেন। ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ প্রমানের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল তার ওপর নির্ভর করেছে কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সম্পর্ণ বিপরীত চিত্র বর্ননা করেছেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ চুপ থেকেছে। এসময় একজন বিচারপতি বলেন ইব্রাহীমকে যে হত্যা করা হয়েছে সেটা নেয়া হয়েছে এ সাক্ষীর মাধ্যমে। তখন অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ইব্রাহীমকে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু হত্যার সময় এবং ঘটনাস্থল বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছেন এ সাক্ষী। এ সাক্ষীর বক্তব্য থেকে এটা পরিস্কার যে ইব্রাহীমকে নলবুনিয়ায় হত্যা করেছে রাজাকার বাহিনী। পাড়েরহাটে তাকে হত্যা করা হয়নি। অক্টোবর মাসে তাকে নলবুনিয়ায় হত্যা করা হয়। জুন মাসে নয়।
এরপর ইব্রাহীম হত্যা বিষয়ে আসামী পক্ষের ৭ এবং ১১ নং সাক্ষীর জবানবন্দীও পড়ে শোনানো হয় ।
সাত নং সাক্ষী জামাল হোসেন ফকির বলেছেন আমার বাড়ি পিরোজপুর জেলার নলবুনিয়া গ্রামে অবস্থিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমি আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাত্রের প্রথম ভাগে বিলে বড়শি পেতে আসি। রাত্রের শেষ ভাগে আমি নৌকা নিয়ে বড়শি তুলে বাড়ির কাছাকাছি আসলে বিশাল একটা শব্দ শুনতে পাই। শব্দ শুনে আমি খেয়াল করি আমার পাশ লাগানো আজহার আলী হাওলাদারের বাড়িতে কান্নাকাটির শব্দ শোনা যায়। আমি ঘরে চলে আসি। আমার আব্বা বলেন, আজহার মামার বাড়ি বড় একটা শব্দ শোনা গেছে এবং কান্নাকাটিরও শব্দ শোনা যাচ্ছে । চলো গিয়ে দেখে আসি। আজহার আলীর বাড়ির উঠানের মাঝ বরাবর পূর্ব দিকের গাছের আড়ালে গিয়ে দেখি ইব্রাহিম কুট্টির লাশ আইয়ুব আলী চৌকিদার, কালাম চৌকিদার, হাকিম মুন্সি, মান্নান ও আশরাফ আলী খালের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তার পিছে দানেশ মোল্লা, সেকান্দার শিকদার, মোসলেম মওলানা, রুহুল আমিন, মোমিনরা মিলে সাহবে আলীকে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে তার মাকেসহ পাড়েরহাটে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সামনে এগিয়ে দেখি ইব্রাহিম কুট্টির লাশ নৌকায় তুলে পাড়েরহাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সাহেব আলীদের ঘরে চলে আসি। ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতেছে এবং তার হাত দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছে। তার বোন রানী বেগম মমতাজের হাত বেঁধে দিচ্ছে দেখি। তখন আমি ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগমকে জিজ্ঞাসা করলাম, ফুফু তোমার কি হয়েছে? তখন মমতাজ বেগম উত্তর দেয় যে গুলিতে ইব্রাহিম কুট্টি মারা গেছে সেই গুলি তার হাতেও লেগেছে, লাঠি দিয়ে তার আব্বার গায়েও আঘাত করেছে। ঐখানে তখন পাড়া প্রতিবেশী অনেক লোকজন জমায়েত হয়। আমরা বাড়িতে চলে যাই। বিকালে শুনতে পাই যে, সাহেব আলী ও তার আম্মাকে পিরোজপুরে নিয়ে গেছে। ইব্রাহিম কুট্টির লাশ পাড়েরহাট বাদুরা পোলের সাথে নৌকায় বেঁধে রেখেছে। তারপরদিন বেলা এগারোটার দিকে শুনতে পাই যে, সাহেব আলীর আম্মা বাড়িতে ফিরেছে। তারপর আমরা তাদের বাড়িতে যাই। জিজ্ঞাসা করি বুয়া (সাহেব আলীর আম্মা) আপনি এসেছেন, সাহেব আলী চাচা কৈ। তারপর সে বলে যে, পিরোজপুর নিয়া সাহেব আলীকে মিলিটারীরা গুলি করে মারছে। এর কিছুদিন পরে দেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীনের পাঁচ/ছয় মাস পর মমতাজ বেগম ভাই এবং স্বামী হত্যার মামলা করে।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে ১১ নং সাক্ষী গোলাম মোস্তাফা ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে বলেছেন : আমার নাম মোঃ গোলাম মোস্তফা, বয়স- ৬২ বছর । গ্রাম নলবুনিয়া, থানা জিয়ানগর, জেলা- পিরোজপুর। বর্তমানে আমি অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ অক্টোবর আমার গ্রাম নলবুনিয়ায় আজাহার আলী হাওলাদারের বাড়িতে একটি ঘটনা ঘটে। ওইদিন ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্তে এক প্রচন্ড শব্দ শুনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠার পরেই মসজিদে আযান হলে মসজিদে নামায পড়তে যাই। নামাজের পরে মুসল্লিদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হতে থাকে যে, আযানের পূর্বে কোথায় এই প্রচন্ড শব্দটি হলো। এই আলাপ আলোচনা করতে করতে আমরা মসজিদের সামান্য দূরে খালের পাড়ের রাস্তায় আসি। একটু পরেই দেখতে পাই যে, উত্তর দিক থেকে দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দার শিকদার, রুহুল আমীন, মোমিন আজহার আলী হাওলাদারের ছেলে সাবেহ আলী এবং তার মাকে নিয়ে পাড়েরহাটের দিকে যাচ্ছে। তার ৫/৭ মিনিট পরে নৌকায় করে আইউব আলী চকিদার, কালাম চকিদার, হামিক মুন্সি, আব্দুল মান্নান, আশরাফ আল মিলে আজহার আল হাওলাদারের জামাই ইব্রাহীম কুট্টির লাশ নিয়ে যাচ্ছে।
এরপর আমরা কায়েকজন আজহার হাওলাদারের বাড়ি যাই। সেখানে গিয়ে বাড়িভর্তি মানুষ এবং ঘরে কান্নার রোল শুনতে পাই। লোকজন বলাবলি করতেছে আজহার হাওলাদারের জামাইকে (ইব্রাহীম কুট্টি) মেরে ফেলেছে। আজহাল আলীর স্ত্রী এবং ছেলেকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে। আজাহরকেও মেরেছে। লোকজন বলল ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যার সময় তার স্ত্রী মমতাজের হাতেও গুলি লাগে। মমতাজকেও জিজ্ঞাসা করায় সেও তাই জানাল।
এরপর আমরা সেখান থেকে চলে আসি, বিকালের দিকে শুনি সাহেব আলীকে এবং তার মাকে রাজাকাররা পিরোজপুরে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। পরের দিন শুনি সাহেব আলীর মা সেতারা বেগম ফিরে এসেছে এবং সাহেব আলীকে পাকিস্তানী বাহিনী পিরোজপুরে গুলি করে মেরেছে। এরপর শুনেছি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মমতাজ বেগম তার স্বামী ও ভাই হত্যার জন্য এস.ডি.ও বরাবরে একটি মামলা দায়ের করেছে।
এ পর্যন্ত যুক্তি উপস্থাপনের পর শুনানী আগামীকাল বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যটর্নি জেনারেল এমকে আনোয়ার এবং আসামী পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় একটি আলোচিত অভিযোগ হল ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা। এ অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগে রাষ্ট্র পক্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হল মফিজউদ্দিন পসারী। মফিজ উদ্দিন পসারী ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা ঘটনায় মাওলানা সাঈদীকে সরাসরি জড়িত করে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী দিয়েছেন। মফিজ উদ্দিন পসারী একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা ঘটনার বিবরন দিয়েছেন । কিন্তু একই সাক্ষী পিরোজপুরে একটি মামলায় মেজিস্ট্রেট এর কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীতে বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টিকে কে মেরেছে তা তিনি দেখেননি এবং জানেনওনা।
ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিল আবেদনে আজ এ বিষয়ে আসামী পক্ষ যুক্তি পেশ করেন।
প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহন করেন।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে যুক্তি পেশ করেন অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান। মফিজ উদ্দিন পসারী পিরোজপুরে মেজিস্ট্রেট এর কাছে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে যে জবানবন্দী দেন তা তিনি আদালতে পড়ে শোনান। ২০১০ সালে মফিজউদ্দিন কর্তৃক প্রদত্ত সে জবানবন্দীতে ঘটনার বিবরনে লেখা রয়েছে- ‘আমি ১৯৭১ সালে মুুক্তিযুদ্ধের সময় মানিক পসারীর পিতা সইজুদ্দীন পসারীর বাড়িতে গরু মহিষ চড়ানোর কাজ করতাম। আমার সাথে ইব্রাহীমও কাজ করত। একদিন পাক বাহিনীর লোকজন, মিলিটারি, দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার সিকদার ও দেলোয়ার আসে। এসে সইজুদ্দিন ও রইজুদ্দিনকে খোঁজ করে। তাদেরকে না পেয়ে বাড়িঘরে আগুন দেয়। আমাকে ও ইব্রাহীমকে মিলিটারি, সেকেন্দার সিকদার ও দানেশ মোল্লা নিয়ে যায়। আমি রাতে পালায়ে আসি। ইব্রাহীমকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে শুনি ইব্রাহীম মারা গেছে। কিন্তু কে মেরেছে দেখিনি ও জানিনা।’
কিন্তু এই মফিজ উদ্দিন পসারী ২০১১ সালে ২৯ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার সময় ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা ঘটনার বিবরন দিয়ে বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি পিরোজপুর বাদুরা গ্রামে তার মামা সইজুদ্দীন পসারীর বাড়িতে কাজ করতাম। আমার সাথে ঐ বাড়িতে কাজ করত ইব্রাহমী কুট্টি নামে আরেক লোক। ১৯৭১ সালের ৮ মে সকালে গরু মহিষ নিয়ে চরে যাই। সাথে ইব্রাহিম কুট্টিও ছিল। কিন্তু আনুমানিক ১০/১১টার দিকে চরে বসে বসে মামার বাড়িতে বাড়িতে আগুন এবং ধোয়া দেখতে পাই। তারপর মামার বাড়ির দিকে ফিরে আসি। ১২/১৪ জন পাক আর্মি, ২০/২২ জন রাজাকার মামার বাড়ি যাচ্ছে দেখতে পাই। তার মধ্যে দিলু শিকদার ছিল। আমরা পালাতে চাইলে পাক আর্মি ধরে ফেলে। দিলু শিকদার ইব্রাহীমের চুল ধরে বলে “শুয়ারের বাচ্চা যাচ্ছো কোথায়”। রাজাকার মবিন, রাজ্জাক আরো কয়েকজন আমাদের দুজনকে এক দড়িতে বাঁধে। এরপর রাজাকাররা ঘরে ঢুকে লুটপাট করে এবং কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেকেন্দা শিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, মবিন, রাজ্জাক দিলু শিকদারসহ আরো অনেক রাজাকার তেল ছিটিয়ে ঘরে আগুন দিতে বলে। তারপর আমাদের দুজনকে পারেরহট বাজারে নিয়ে যায়। বাজারের মধ্যে ব্রিজের মাঝখানে নিয়ে ইব্রাহিমকে জিজ্ঞেস করে সইজুদ্দীন পসারী, মানিক পসারী কোথায় থাকে। তুই তো সইজুদ্দীনের বডি গার্ড । তুই জানিস তারা কোথায়। না বললে তোকে গুলি করব। এরপর পুল থেকে নামিয়ে দিলু শিকদার (তাদের ভাষায় দিলু শিকদার মানে মাওলানা সাঈদী) সেকেন্দার শিকাদর উর্দুতে কি যেন বলল। আমি উর্দু বুঝিনা এবং কি বলেছিল তা শুনতে পাইনি। এরপর ইব্রাহিমকে দড়ি থেকে খুলে ছেড়ে দিল এবং আমাকে নিয়ে সামনের দিকে গেল।
তারপর গুলির শব্দ শুনতে পাই। ইব্রাহিম মা বলে চিৎকার করে। পেছনে তাকিয়ে দেখি ইব্রাহিমকে গুলি করছে। সেনাবানিহনী লাথি মেরে লাশ নদীতে ফেলে দিল। তারপর আমাকে নিয়ে পারেরহাট রাজাকার ক্যাম্পে গেল। সইজুদ্দীন পসারী এবং মানিক পসারীর নাম জানার জন্য অনেক অত্যাচার করল দানেশ আলী মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, দেলু শিকদার মবিন রাজাকার। এর এক পর্যায়ে রাতে বাথরুমে যাবার কথা বলে বাইরে বের হই এবং পালিয়ে আসি।
পিরোজপুরে যে মামলায় মফিজউদ্দিন পসারী জবানবন্দী দিয়েছেন সেই মামলটি করেছিলেন মানিক পসারী ২০০৯ সালে। মানিক পসারীও মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন। মানিক পসারী মাফিজ উদ্দিন পসারীর মামাত ভাই এবং মফিজ উদ্দিন মানিক পসারীদের বাড়িতে থেকে কাজ করত। ঘটনার দিন ইব্রাহীম কুট্টির সাথে মফিজকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মফিজ উদ্দিন, মানিক পসারীসহ রাষ্ট্রপক্ষের অন্যান্য সাক্ষীরা বলেছেন। অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, মানিক পসারী ট্রাইব্যুনালে তার সাক্ষ্যে মফিজ উদ্দিনের ওপর নির্যাতন বিষয়ে বলেছেন কিন্তু তিনি তাদের বাড়ির ঘটনা এবং ইব্রাহীম হত্যা বিষয়ে পিরোজপুরে যে মামলা করেছেন সেখানে মফিজ বিষয়ে বিষয়ে তিনি একটি কথাও উল্লেখ করেননি এবং মফিজকে সাক্ষীও করেননি।
আট নং অভিযোগ বিষয়ে আগের দিন উপস্থাপিত যুক্তির ধারাবাহিকতায় আজ সকালে সাত নং সাক্ষী মফিজ উদ্দিন পসারীর সাক্ষ্য খন্ডন করে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান। মফিজ উদ্দিন পসারী কর্তৃক পিরোজপুরে এবং ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ত জবানবন্দী তুলনা করে অ্যাডভোকেট শাহজাহান যুক্তি পেশ করেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মফিজ উদ্দিন যে জবানবন্দী দিয়েছেন তার একটি কথাও তিনি ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীতে বলেননি।
সকালে মহিষ চড়াতে যাবার কথা, সকাল ১০/১১টার দিকে গরু আতালে নিয়ে আসার কথা, দেলু শিকদার কর্তৃক থাবা দিয়ে ইব্রাহীম কুট্টির চুল ধরে গালি দেয়ার কথা, তাকে ও ইব্রাহীম কুট্টিকে এক দড়িতে বেঁধে রাখা, মা বলে চিৎকার শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি ইব্রাহীমকে গুলি দিছে এরপর লাথি মেরে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া, ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে দানেশ মোল্লা ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়ার ফলে তার ঠোট কেটে যাওয়া এবং দাত ভেঙ্গে যাওয়া, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয়ার কথা বলার পর রাজ্জাক রাজাকার তাকে নিয়ে বাইরে যাওয়া এবং তখন নদী পার হয়ে পালিয়ে যাওয়া, এরপর ফজরের সময় মানিক পসারীর সাথে দেখা হওয়ার পর তাকে সব ঘটনা খুলে বলার কথা তিনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীতে বলেননি।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ইব্রাহীম কুট্টিকে পাড়েরহাটে হত্যার ঘটনা দেখার কথা তিনি পিরোজপুরেও বলেননি এবং এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকেও বলেননি।
এসময় একজন বিচারপতি বলেন, বরং পিরোজপুরে মেজিস্ট্রেট এর কাছে তিনি পজিটিভ জবানবন্দী দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইব্রাহীম কুট্টিকে কে মেরেছে তা তিনি জানেননা। দ্যাট ইজ ভেরি ইমপরটেন্ট।
অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, চার্জে ঘটনার সময় উল্লেখ আছে ৩টা। কিন্তু মফিজ উদ্দিন বলেছেন ১০/১১টার দিকে তিনি মানিক পসারীর বাড়িতে ধোয়া উড়তে দেখেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের ছয় নং সাক্ষী মানিক পসারী বলেছেন, ঘটনার দিন রাত দেড়টার দিকে মফিজ পালিয়ে তার কাছে আসে। তিনি তখন মফিজের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন। অপর দিকে মফিজ বলেছেন, রাতে পালিয়ে এসে মানিক পসারীর বাড়িতে কাউকে তিনি পাননি। জঙ্গলে বাকি রাত পার করেন। ফজরের সময় মানিক পসারী জঙ্গলে তার কাছে আসে দেখা করার জন্য।
এরপর আট নং অভিযোগ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আট নং সাক্ষী মোস্তফা হাওলাদারের সাক্ষ্য খন্ডন করে যুক্তি পেশ করেন অ্যাডভোকেট শাহজাহান। তিনি বলেন, অন্য সাক্ষীরা বলেছেন ইব্রাহীম ও মফিজকে প্রথমে পাড়েরহাট বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ইব্রাহীমকে হত্যার পর মফিজকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু আট নং সাক্ষী বলেছেন প্রথমে দুজনকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় পরে কুট্টিকে পাড়েরহাট ব্রিজের কাছে আনা হয়।
জেরায় মোস্তফা হাওলাদারকে সাজেশন দিয়ে বলা হয় একই দড়িতে দুজনকে বাঁধা, লাথি মেরে ইব্রাহীমের লাশ নদীতে ফেলে দেয়ার কথা আপনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বলেননি। মোস্তফা হাওলদার জবাব দেন তিনি বলেছেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে জেরায় প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান একথা মোস্তফা হাওলাদার তাকে বলেননি।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষের নয় নং সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে যুক্তি পেশ করা হয়। আট নং অভিযোগ বিষয়ে নয় নং সাক্ষী বলেছেন পাড়েরহাট ও আশপাশের এলাকায় যেসব লুটপাট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে তা সবাই হয়েছে মাওলানা সাঈদীর নেতৃত্বে। ট্রাইব্যুনাল রায়ে নয় নং সাক্ষীর একথাটা আমলে নিয়েছে কিন্তু এই কথাটা আবার সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বলেননি।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষের ১০ নং সাক্ষী বাসুদেব মি¯ির সাক্ষ্য বিষয়ে যুক্তি পেশ করা হয়। অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, সাক্ষী বলেছেন, সাক্ষীর তার জবানবন্দীতে জানিয়েছেন তার পিতা তখন মানিক পসারীর বাড়িতে কাঠ মিস্ত্রির কাজ করত। সেও তার পিতার সাথে যোগালীর কাজ করত। ঘটনার দিন খুব সকালে সে তার পিতার সাথে মানিক পসারীর বাড়িতে আসে। সাক্ষী জানায় সকাল আটটা/নয়টার দিকে আর্মি আসার ঘটনায় বাড়ির সব লোকজন পালিয়ে যায়।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, সকাল আটটা/নয়টার দিকে বাড়ির সব লোকজন পালিয়ে গেল। ঘটনা ঘটল বিকাল তিনটায়। সাক্ষী দাবি করেছেন তিনি বাড়ি লুটপাট, আগুন দেয়া, ইব্রাহীম ও মাফিজকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া এবং হত্যার ঘটনা দেখেছেন। এ ঘটনা দেখতে হলে তাকে তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রশ্ন হল বাড়ির সব লোক যখন পালিয়ে গেল তখন একজন কাঠ মিস্ত্রি কেন সেখানে এত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন? এটা মানুষের স্বাভাবিক স্বভাবের বিরুদ্ধ আচরন এবং এটা অসম্ভব ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তদুপরি তিনি একজন হিন্দু। তখনকার পরিস্থিতিতে পাকিস্তান আর্মি আসায় সবাই পালিয়ে গেল আর তিনি একজন হিন্দু যুবক হয়েও সেখানে অবস্থান করার দাবি সে সময়কার বাস্তবতার সাথে খাপ খায়না।
তাছাড়া বাসুদেব পিরোজপুর মামলায় একজন সাক্ষী এবং সেখানে তিনি তার জবানবন্দীতে বলেছেন ইব্রাহীমকে কে গুলি দিয়েছে তা তিনি দেখেননি। তিনি একথা শুনেছেন। সুতরাং এ সাক্ষী কোন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নয়।
রাষ্ট্রপক্ষের ১১ নং সাক্ষী আবদুল জলিল শেখ সাক্ষ্য দেয়ার এক বছর আগে থেকে একটি খামার একটি বাড়ি প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন। তার প্রথম স্ত্রীর নাম সখিনা। তৃতীয় স্ত্রীর নাম ফিরোজা। দ্বিতীয় স্ত্রী গোলেনুর তার বিরুদ্ধে যৌতুক মামলা করলে পরে সমঝোতা হয়। কিন্তু পরে গোলেনুর আবার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে। এ কারনে সে তখন সাত মাস হাজত খাটে। পরে আপস রফায় মামলা নিষ্পত্তি হয় বলে ট্রাইব্যুনালে জানিয়েছে সে। সাক্ষী বিষয়ে এ তথ্য উপস্থাপনের সময় একজন বিচারপতি বলেন মামলা ফেস করা এবং হাজত বাস মানেই দোষী সাব্যস্ত হওয়া নয়। কারো বিরুদ্ধে মামলা থাকতেই পারে। কাজেই এসব বিষয় না বলাই ভাল।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ১১ নং সাক্ষী আবদুল জলিল শেখ বলেছেন তিনি মানিক পসারীর বাড়িতে আগুন দেয়ার দিন মানিক পসারীর ভাই আলমগীর শেখসহ অন্যান্যদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন। কিন্তু মানিক পসারী জানিয়েছেন আলমগীর পসারী তার থেকে ৩০ বছরের ছোট। ১৯৭১ সালে মানিক পসারীর বয়স ছিল ২৭ বছর। সে হিসেবে আলমগীর পসারীর তখন জন্মই হয়নি। কাজেই তাকে দেখার কথা মিথ্যা।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে আট নং অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নং সাক্ষীর ওপরও নির্ভর করেছেন। কিন্তু ১২ নং সাক্ষী এমপি আবদুল আউয়াল আট নং অভিযোগ বিষয়ে কিছুই বলেননি। আট নং অভিযোগ প্রমানের ক্ষেত্রে কেন তার ওপরও নির্ভর করল তা আমরা বুঝতে পারছিনা।
এরপর আট নং অভিযোগ প্রমানের ক্ষেত্রে আসামী পক্ষের যেসব সাক্ষীর ওপর ট্রাইব্যুনাল নির্ভর করেছেন তাদের বিষয়ে যুক্তি উপস্থান করা হয়। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে যে তিনজন সাক্ষী ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের সকলেই বলেছেন, ইব্রাহীমকে নলবুনিয়ায় তার শশুরবাড়ি থাকা অবস্থায় অক্টোবার মাসে রাজাকাররা হত্যা করে। তাকে জুন মাসে পাড়েরহাট হত্যা করা হয়নি।
আসামী পক্ষের ২ নং সাক্ষীর জবানবন্দী তিনি এসময় পড়ে শোনান আদালতে। ২ নং সাক্ষী আব্দুর রাজ্জাক তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন আমাদের নলবুনিয়ায় একটা ঘটনাই ঘটেছে। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি হঠাৎ একদিন শেষ রাত্রে একটা আওয়াজ হয়। আমি অনুমান করলাম এটা গুলির আওয়াজ। তারপর দেখি যে, ফজরের টাইম হয়ে গেছে। আমি আযান দিয়া নামাজ পড়ি। নামাজ পড়ার পর উত্তরদিকে রাস্তার পাশে যাই কোথায় কি হয়েছে জানার জন্য। তখন গিয়ে দেখি উত্তর দিক থেকে সামনের খাল দিয়ে নৌকায় করে ইব্রাহিম কুট্টির লাশ নিয়ে পাড়ের হাটের দিকে আসতেছে। নৌকায় কালাম চৌকিদার, আইয়ুব আলী চৌকিদার এবং হাকিম মুন্সিকে দেখি। এরপর দেখি আরও কয়েকজন লোক খালের পাড় দিয়ে উত্তর দিক থেকে আসতেছে। যে সব লোক আসতেছে তাদের মধ্যে দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, মোসলেম মাওলানা, রুহুল আমিন, মোমিন রাজাকার ছিল। আরও দেখি উক্ত লোকেরা আজু হাওলাদারের বৌ এবং তার ছেলে সাহেব আলীকে বেঁধে নিয়ে আসতেছে এবং পাড়েরহাটের দিকে নিয়া যাচ্ছে। তারপর দিন শুনি আজু হাওলাদারের বৌ বাড়িতে আসে এবং সাহেব আলীকে পিরোজপুরে নিয়ে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেছেন, এ সাক্ষী ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছেন। ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ প্রমানের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল তার ওপর নির্ভর করেছে কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সম্পর্ণ বিপরীত চিত্র বর্ননা করেছেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ চুপ থেকেছে। এসময় একজন বিচারপতি বলেন ইব্রাহীমকে যে হত্যা করা হয়েছে সেটা নেয়া হয়েছে এ সাক্ষীর মাধ্যমে। তখন অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ইব্রাহীমকে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু হত্যার সময় এবং ঘটনাস্থল বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছেন এ সাক্ষী। এ সাক্ষীর বক্তব্য থেকে এটা পরিস্কার যে ইব্রাহীমকে নলবুনিয়ায় হত্যা করেছে রাজাকার বাহিনী। পাড়েরহাটে তাকে হত্যা করা হয়নি। অক্টোবর মাসে তাকে নলবুনিয়ায় হত্যা করা হয়। জুন মাসে নয়।
এরপর ইব্রাহীম হত্যা বিষয়ে আসামী পক্ষের ৭ এবং ১১ নং সাক্ষীর জবানবন্দীও পড়ে শোনানো হয় ।
সাত নং সাক্ষী জামাল হোসেন ফকির বলেছেন আমার বাড়ি পিরোজপুর জেলার নলবুনিয়া গ্রামে অবস্থিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমি আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাত্রের প্রথম ভাগে বিলে বড়শি পেতে আসি। রাত্রের শেষ ভাগে আমি নৌকা নিয়ে বড়শি তুলে বাড়ির কাছাকাছি আসলে বিশাল একটা শব্দ শুনতে পাই। শব্দ শুনে আমি খেয়াল করি আমার পাশ লাগানো আজহার আলী হাওলাদারের বাড়িতে কান্নাকাটির শব্দ শোনা যায়। আমি ঘরে চলে আসি। আমার আব্বা বলেন, আজহার মামার বাড়ি বড় একটা শব্দ শোনা গেছে এবং কান্নাকাটিরও শব্দ শোনা যাচ্ছে । চলো গিয়ে দেখে আসি। আজহার আলীর বাড়ির উঠানের মাঝ বরাবর পূর্ব দিকের গাছের আড়ালে গিয়ে দেখি ইব্রাহিম কুট্টির লাশ আইয়ুব আলী চৌকিদার, কালাম চৌকিদার, হাকিম মুন্সি, মান্নান ও আশরাফ আলী খালের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তার পিছে দানেশ মোল্লা, সেকান্দার শিকদার, মোসলেম মওলানা, রুহুল আমিন, মোমিনরা মিলে সাহবে আলীকে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে তার মাকেসহ পাড়েরহাটে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সামনে এগিয়ে দেখি ইব্রাহিম কুট্টির লাশ নৌকায় তুলে পাড়েরহাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সাহেব আলীদের ঘরে চলে আসি। ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতেছে এবং তার হাত দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছে। তার বোন রানী বেগম মমতাজের হাত বেঁধে দিচ্ছে দেখি। তখন আমি ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগমকে জিজ্ঞাসা করলাম, ফুফু তোমার কি হয়েছে? তখন মমতাজ বেগম উত্তর দেয় যে গুলিতে ইব্রাহিম কুট্টি মারা গেছে সেই গুলি তার হাতেও লেগেছে, লাঠি দিয়ে তার আব্বার গায়েও আঘাত করেছে। ঐখানে তখন পাড়া প্রতিবেশী অনেক লোকজন জমায়েত হয়। আমরা বাড়িতে চলে যাই। বিকালে শুনতে পাই যে, সাহেব আলী ও তার আম্মাকে পিরোজপুরে নিয়ে গেছে। ইব্রাহিম কুট্টির লাশ পাড়েরহাট বাদুরা পোলের সাথে নৌকায় বেঁধে রেখেছে। তারপরদিন বেলা এগারোটার দিকে শুনতে পাই যে, সাহেব আলীর আম্মা বাড়িতে ফিরেছে। তারপর আমরা তাদের বাড়িতে যাই। জিজ্ঞাসা করি বুয়া (সাহেব আলীর আম্মা) আপনি এসেছেন, সাহেব আলী চাচা কৈ। তারপর সে বলে যে, পিরোজপুর নিয়া সাহেব আলীকে মিলিটারীরা গুলি করে মারছে। এর কিছুদিন পরে দেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীনের পাঁচ/ছয় মাস পর মমতাজ বেগম ভাই এবং স্বামী হত্যার মামলা করে।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে ১১ নং সাক্ষী গোলাম মোস্তাফা ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে বলেছেন : আমার নাম মোঃ গোলাম মোস্তফা, বয়স- ৬২ বছর । গ্রাম নলবুনিয়া, থানা জিয়ানগর, জেলা- পিরোজপুর। বর্তমানে আমি অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ অক্টোবর আমার গ্রাম নলবুনিয়ায় আজাহার আলী হাওলাদারের বাড়িতে একটি ঘটনা ঘটে। ওইদিন ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্তে এক প্রচন্ড শব্দ শুনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠার পরেই মসজিদে আযান হলে মসজিদে নামায পড়তে যাই। নামাজের পরে মুসল্লিদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হতে থাকে যে, আযানের পূর্বে কোথায় এই প্রচন্ড শব্দটি হলো। এই আলাপ আলোচনা করতে করতে আমরা মসজিদের সামান্য দূরে খালের পাড়ের রাস্তায় আসি। একটু পরেই দেখতে পাই যে, উত্তর দিক থেকে দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দার শিকদার, রুহুল আমীন, মোমিন আজহার আলী হাওলাদারের ছেলে সাবেহ আলী এবং তার মাকে নিয়ে পাড়েরহাটের দিকে যাচ্ছে। তার ৫/৭ মিনিট পরে নৌকায় করে আইউব আলী চকিদার, কালাম চকিদার, হামিক মুন্সি, আব্দুল মান্নান, আশরাফ আল মিলে আজহার আল হাওলাদারের জামাই ইব্রাহীম কুট্টির লাশ নিয়ে যাচ্ছে।
এরপর আমরা কায়েকজন আজহার হাওলাদারের বাড়ি যাই। সেখানে গিয়ে বাড়িভর্তি মানুষ এবং ঘরে কান্নার রোল শুনতে পাই। লোকজন বলাবলি করতেছে আজহার হাওলাদারের জামাইকে (ইব্রাহীম কুট্টি) মেরে ফেলেছে। আজহাল আলীর স্ত্রী এবং ছেলেকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে। আজাহরকেও মেরেছে। লোকজন বলল ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যার সময় তার স্ত্রী মমতাজের হাতেও গুলি লাগে। মমতাজকেও জিজ্ঞাসা করায় সেও তাই জানাল।
এরপর আমরা সেখান থেকে চলে আসি, বিকালের দিকে শুনি সাহেব আলীকে এবং তার মাকে রাজাকাররা পিরোজপুরে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। পরের দিন শুনি সাহেব আলীর মা সেতারা বেগম ফিরে এসেছে এবং সাহেব আলীকে পাকিস্তানী বাহিনী পিরোজপুরে গুলি করে মেরেছে। এরপর শুনেছি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মমতাজ বেগম তার স্বামী ও ভাই হত্যার জন্য এস.ডি.ও বরাবরে একটি মামলা দায়ের করেছে।
এ পর্যন্ত যুক্তি উপস্থাপনের পর শুনানী আগামীকাল বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যটর্নি জেনারেল এমকে আনোয়ার এবং আসামী পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন