সোমবার ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২
আমার নাম এ্যাডভোটেক সুলতানা কামাল। আমার বয়স আনুমানিক ৬৩ বৎসর। আমি আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ১৮৩৮। আমি সর্বেেত্র ঢাকাতে পড়াশুনা করেছি। আমি সর্বপ্রথম ঢাকায় অবস্থিত নারী শিা মন্দির স্কুলে পড়াশুনা করি। আমি এস,এস,সি পাশ করেছি আজিমপুর গালর্স হাইস্কুল থেকে ১৯৬৫ সালে। হলিক্রস কলেজ থেকে এইচ,এস,সি, পাশ করেছি ১৯৬৭ সালে। ১৯৬৭ সালেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হই। আমি ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে অনার্স পাশ করি এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭১ সালের পরীা ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত এম,এ, পাশ করি। মুক্তিযুদ্ধের কারণে ঐ পরীা বিলম্বিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ ধানমন্ডি ল কলেজ থেকে ১৯৭৮ সারৈ আমি এল এল বি পাশ করি। ১৯৮৪ সালে আমি বার কাউন্সিল থেকে সনদ নেই। ১৯৭১ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ঘটনা যদি বলতে হয় তাহলে আমাকে পারিবারিক পরিস্থিতির কথা একটু উল্লেখ করতে হয় যে, এটা হয়তো সবারই জানা যে আমার মা সুফিয়া কামাল সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। তার ফলে ১৯৭০ সালে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল মতা হস্তান্তরের বিষয়ে সে সকল বিষয় আমরা খুব কাছে থেকে আগ্রহের সাথে ল্য করে যাচ্ছিলাম। আমার মা ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম পরিষদ বলে একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যারা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছিল মূল ধারার রাজনীতির আন্দোলনের সাথে। তার ফলে নির্বাচনের ফলাফল, সংসদ বসা না বসা ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের অত্যন্ত গভীর একটি আগ্রহ ছিল এবং মার্চ মাসে যখন থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে আমরা সাংগঠিনকভাবে অংশগ্রহন করছিলাম এবং সেই সময়ে যে সমস্ত সভা, সমিতি ও সমাবেশ হচ্ছিল তাতে অংশ গ্রহন করেছি সক্রিয়ভাবে। ৭ মার্চে তদানিন্তন রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায়ও উপস্থিত থেকে অংশগ্রহণ করেছি এবং “আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এই বাণীতে উজ্জিবীত হয়েছিলাম। এর পরই বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল যেখানে একদিকে ইয়াহিয়া খান গোলটেবিল বৈঠক ডেকে মতা হস্তান্তরের আলোচনার ভান চালিয়ে যাচ্ছিলেন, অন্যদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক কর্মী কিংবা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উজ্জিবীত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর নানা রকম হামলাও চালানো হচ্ছিল। এভাবেই চলছিল অনিশ্চিতের মধ্য দিয়ে এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত্রি ১২:০০টার দিকে আমার ভগ্নিপতি চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোনে আমাদের নিকট জানতে চান যে, ঢাকার অবস্থা কেমন এবং শুধু এটুকুই বলতে পারেন যে, অবস্থা ভাল নয়, একথা বলার পর পরই টেলিফোনের লাইন কেটে যায়। একই সঙ্গে আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমার মা বাবার বাড়ি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে সেই সময় ৪/৫টি বাড়ির ব্যবধানে ছিল এবং মেশিনগান এবং কামানের গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই এবং সেই সময় পিলখানা থেকেও আমরা পাল্টাপাল্টি গুলির শব্দ শুনতে পাই। একদিক থেকে রাইফেলের গুলি শব্দ এবং অন্য প্রাপ্ত থেকে কামানের গোলার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাই। আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যেও একটি ভীতির সঞ্চার হয়। আমার মা এবং বাবাকে যেহেতু স্থানীয়রা মুরুব্বী শ্রেণীর মনে করতেন সেহেতু তারা ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকেন কি হয়েছে। আমাদের পাশের দোতলা বাড়ির একজন জানালেরন যে, তাদের বাড়ির ছাদ থেকে কোনাকোনিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আগুনের হলকা দেখা যাচ্ছে এবং আমাদের বাড়ির সামনে একটি নির্মানাধীন বাড়ির ছাদে একটি কালো পাতাক উড়ছিল এবং সেই বাড়ির দারোয়ানকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। আমাদের বাড়ির সামনে পানির লেকের উপর একটি ব্রীজ আছে এবং ঐ ব্রীজের উপর দিয়ে মানুষের দৌড়াদৌড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছিল এবং ঐ ব্রীজের উপর একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। পরে জানতে যে, স্থানীয়ভাবে বিখ্যাত পানাউল্লা সাহেবের ছেলে সম্ভবত তার নাম খোকনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর আমরা এলোপাতাড়ি গুলির শব্দ শুনতে পাই যা রাতভর চলছিল। পিলখানার গোলাগুলির শব্দ স্পষ্ট মনে আছে ২৭ মার্চ ভোর পর্যন্ত চলছিল। ইতোমধ্যে প্রচার করা হয় যে, কারফিউ দেওয়া হয়েছে ঘর থেকে কেউ বের হবে না। ২৭ মার্চ কিছু সময়ের জন্য কারফিউশিথিল করা হয়। আমরা তখন রাস্তায় বের হয়ে জানার চেষ্টা করি যে, কি হলো। আমাদের বাড়িতে তখন কিছু লোকের সমাগম হতে শুরু করে, যাদের মধ্যে সাংবাদিক এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীরাও ছিলেন। তারা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সাংঘাতিক হত্যাকান্ড সংঘঠিত হয়েছে। প্রফেসর মনিরুজ্জামান, ডঃ জি,সি,দেব নিহত হয়েছেন, ডঃ জ্যেতির্ময় গুহ ঠাকুরতাকে গুলি করা হয়েছে, উনি আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন এবং অন্যান্য অনেক শিক পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ তাদেরকে হত্যা করার জন্য খোঁজা হচ্ছিল। জগন্নাথ হলে দফায় দফায় ছাত্রদেরকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ইকবাল হয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। মধুর ক্যান্টিনের মধুদার পরিবারের উপর আক্রমন করা হয়েছে, ঐ পরিবারের একাধিক সদস্য নিহত হয়েছেন। রোকেয়া হলের ধোপা বাসুদেব, তাকে ও তার পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছে। রোকেয়া হলেও সেনাবাহিনী প্রবেশ করেছিল। হাটখোলা অঞ্চল থেকে প্রয়াত সাংবাদিক সাহাদাৎ চৌধুরী জানান যে, ইত্তেফাক অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অফিসের সামনে এলোপাতাড়ি গোলাগুলিতে অনেক লোককে হত্যা করা হয়েছে। আমার একটি ছবি অনেক সময় দেখি যে, রিক্সার উপর রিক্সাওয়ালা এবং এক যাত্রী একত্রে নিহত হয়ে পড়ে আছে। সাংবাদিক শহিদুল্লাহ কায়ছার সংবাদ পাঠালেন যে, সংবাদ অফিসেও আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তার ভিতরে লেখক সাংবাদিক শহীদ সাদবের জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এরকম বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসতে থাকে যে, আগুন লাগানো হয়েছে, হত্যাকান্ড হয়েছে এবং মানুষ যত্রতত্র লাশ হয়ে পড়ে আছে। নারায়ণগঞ্জে আমাদের আত্মীয় সাত্তার জুটমিলসের ছিলেন তারাও জানালেন যে, সেখানেও হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে এবং একটি বাড়িতে ঘরের ভিতর ঢুকে মশারীর ভিতর শায়িত মা ও শিশুকে একই সংগে হত্যা করা হয়েছে এবং আস্তে আস্তে আমরা জানতে পারলাম যে, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, রাজশাহী সর্বত্রই একই ধরনের হত্যাকান্ড চলছে এবং পুলিশের তৎকালীন বড় কর্মকর্তা মামুণ মাহমুদ রাজশাহীতে ছিলেন তাকেও হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় কর্মরত বাঙ্গালী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণকে হত্যা করা হয়েছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় আমরা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে যে লেক আছে সেই লেকের পাড়ে এবং তার ঠিক কাছেই সেই সময়ে ধানমন্ডি গালর্স হাইস্কুল ছিল তার সামনে তখন কোন বাড়ি ছিল না, সেই গালর্স স্কুলের ছাদে মেশিনগান ফিট করা হচ্ছিল এবং লেকের পাড়েও মেশিনগান নিয়ে পাকিস্তান হানাদার সেনাবাহিনী অবস্থান নিচ্ছিল। অর্থাৎ ২৫ মার্চের সন্ধ্যা থেকেই তাদের এই আক্রমণের প্রস্তুতি চলছিল। ২৭ মার্চ সকাল বেলায় যখন আমরা রাস্তা পার হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তা দিয়ে হেটে যাই আমি নিজে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে পাকিমস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে মালামাল নিয়ে ট্রাকে তুলছিল। কারফিউ যখন আবার দেওয়া হয় তখন আমরা ঘরে ফিরে আসি এবং বিবিসি এবং অন্যান্য রেডিও থেকে আরও শুনতে পাই যে, তদনিন্তন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশে অপারেশন সার্চ লাইট নামে একটি হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে যা গণহত্যার সামিল এবং ল ল লোক নিজেদের বাড়ি ঘর ছেরে এখান থেকে সেখানে, এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এবং সিমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছিল। সেখানে ৮০ বৎসরের বৃদ্ধ বৃদ্ধা থেকে শুরু করে নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে মা পর্যন্ত দৌড়াচ্ছে। অর্থাৎ কিশোর, তরুণ, বৃদ্ধ, যুবক, সবল কিংবা অসমর্থ মানুষ চরম অনিরাপত্তাবোধ নিয়ে প্রাণ ভয়ে শুধুমাত্র প্রাণটুকু রা করার জন্য এদিক সেদিক ছুটে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছিল। আমাদের মতে এটা একটা চরম মানবতার অবমাননা এবং মানবাধিকারের নিকৃষ্টতম লংঘন। ইতোমধ্যে এই খবরটিও পাই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে ২৬ মার্চ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সেই খবরও পাচ্ছিলাম। আমাদের কিছু বন্ধু বান্ধব যারা বিভিন্ন আন্দোলনের সংগে যুক্ত ছিলেন তারা মুক্তিবাহিনী গঠন হওয়ার খবরও নিয়ে আসছিল এবং তারা সেই বাহিনীতে ক্রমশঃ যোগ দিচ্ছিলেন এবং আমাদের সংগে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন এবং সেভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগ হয়েছিল। আমার মাকে কেন্দ্র করেই আমাদের পরিবারে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল এবং আমরা দুই বোন সক্রিয়ভাবে উক্ত কার্যে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। এভাবেই তখন আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগে জড়িত নানাভাবে তথ্য আদান প্রদান, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগ সৃষ্টি করা এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অন্যদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা চলছিলই এবং হঠাৎ করে এপ্রিল মাস থেকে আমরা জানতে পারলাম যে তখনকার কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সংগে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। তখনকার পত্র পত্রিকায় সেই খবরগুলি অত্যন্ত ফলাও করে ছাপা হতো। কাজেই সেই ঘটনা শুলির সাথে কারা কারা যুক্ত ছিলেন তাদের নামও আমরা জানতে পারি এবং ঘুরে ফিরেই জামায়াতে ইসলামী, পি,ডি,পি, মুসলিম লীগ এই দলগুলির নাম উঠে আসতো এবং একটি নাম খুব বেশী করেই আমাদের চোখে পড়তো সেই নামটি হলো গোলাম আযম, যিনি টিক্কা খান এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে প্রায়ই মিলিত হতেন এবং কিভাবে পাকিস্তানের অখন্ডতা রা করা যায় সেই নিয়ে আলোচনা করতেন এবং বক্তৃতা ও বিবৃতি দিতেন। দুটো বিষয় খুব স্পষ্টভাবে উঠে আসতো যে, পাকিস্তান অর্থই হচ্ছে ইসলাম এবং পাকিস্তানের বিরোধীতা করা মানেই হচ্ছে ইসলামের বিরোধীতা করা। অর্থাৎ ইসলামকে বাঁচাতে হলে পাকিস্তানকে রা করতে হবে এবং তাদের ভাষায় মুক্তিযোদ্ধারাই দুস্কৃতিকারী তাদেরকে নির্মূল করতে হবে এবং এজন্য দেশবাসীকে উজ্জিবীত করতে হবে এবং সে দায়িত্ব তারা নিতে চান। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পেলাম যে, তারা প্রথমে শান্তি কমিটি নামে কিছু সাংগঠনিক তৎপরতা চালায় এবং জনসাধারণকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে চাপ সৃষ্টি করে যোগ দিতে বাধ্য করতে থাকে। এরপর আমরা দেখা পাই যে, তারা মে মাসে রাজাকার বাহিনী নামে একটি বাহিনী তৈরী করে। যতদূর মনে পড়ে রাজাকার বাহিনী জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে খুলনায় প্রথম সূচনা হয়েছিল। আমরা এও জানতে পারি যে, তারা কিছু গোপন কিলার ফোর্স তৈরী করার উদ্যোগ নিয়েছে এবং আলবদর, আলসামস নামে দুটি বাহিনী ঐ উদ্দেশ্যে গঠন করা হয় এবং তারা খুব গোপনে এ কাজগুলি করবে মর্মে জেনেছিলাম। আমরা জানতে পাই যে, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র এবং তরুণ কর্মীদেরকে নিয়ে এই বাহিনী তৈরী করা হয়েছিল। সর্বেেত্রই এসব কর্মকান্ডের সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে গোলাম আযমের নামই বার বার উল্লেখিত হয়েছে। প্রায়সই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উচ্চতম পর্যায় থেকে টিক্কা কান সহ গোলাম আযমের নাম ধরেই প্রসংশা করেছেন যে, পাকিস্তানের অখন্ডতা রার জন্যই তিনি এক কাজ করছেন। সেই সময়ে গোলাম আযম পাকিস্তান পর্যন্ত সফর করেন এবং সেখানে গিয়েও মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলেন এবং বার বার একথা বলেন যে, তিনিই পাকিস্তানের অখন্ডতা রা করার জন্য যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত। জুন মাসে আমার ছোট বোন সাইদা কামাল যার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ১৮৩৫ এবং আমি সীমান্ত পার হয়ে ভারতের আগরতলায় যেতে বাধ্য হই। জুন মাসে একটি ঘটনার পরিপ্রেেিত আমার সেই ছোট বোন এবং আমি সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের বাড়ির ঠিক সামনে স্কোয়ার্ড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান সাহেব থাকতেন। তিনি খবর পাচ্ছিলেন যে, বিমান বাহিনীতে যে বাঙ্গালী কর্মকর্তারা রয়েছেন তাদেরকে যখন ডাকা হয় তারপর তারা আর ফিরে আসেন না। এরকম একটা সময় যখন হামিদুল্লাহ খান সাহেবকে হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট করতে বলা হলো এবং নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, রায়ের বাজারের কাছে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় একটি অপারেশনে তাকে যেতে হবে। তখন তিনি আমার মায়ের নিকট এসে সাহায্য চান কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে তিনি বাঁচতে পারেন। তখন আমরা তাকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে সাহায্য করি। দুঃখজনকভাবে তার বাড়ির কাজের যে ছেলেটি ছিল তাকে পাক বাহিনী পরদিন ধরে নিয়ে যায়। আমরা হামিদুল্লাহ খান সাহেবের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করি। তখন একটা শংকা দেখা দিল যে কাজের ছেলেটি যদি জিজ্ঞাসাবাদের চাপে আমাদের পরিবারের সংগে হামিদুল্লাহ খান সাহেবদের যে যোগাযোগ হচ্ছিল সে খবর যদি বলে দেয় তাহলে আমাদের সংগে মুক্তিবাহিনীর যে যোগাযোগ আছে তাও প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। তখন আমাদেরকে পরামর্শ দেয়া হলো যেন আমরা দুই বোন অন্ততঃ সীমান্ত পার হয়ে যাই। তারপরে আমরা ১৬ জুন ঢাকা থেকে স্থল পথে রওনা হয়ে নদী পার হয়ে কুমিল্লার চান্দিনা থেকে রিক্সা করে আগরতলার সোনামুড়ায় পৌঁছাই। সোনামুড়া অঞ্চলে আমাদের পূর্ব পরিচিত একজন ডাক্তার যিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন তিনি সোনামুড়া ফরেস্ট বাংলাতে একটি ছোট চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছিলেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করার জন্য তিনি এবং তার স্ত্রী সেখানে ছিলেন এবং তারা দুজনই আমাদের বন্ধু ছিলেন। আমরা তাদের সংগে দেখা করি এবং আমরা দুই বোন তাদের সংগে কাজ করতে যোগ দেই। সেই চিকিৎসা কেন্দ্রটি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল। সেই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব। তার সংগে আমরা দেখা করলাম। তিনি আমাদের অনুমতি দিলেন সেখানে কাজকরার জন্য এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নিবন্ধিত হলাম। সেখানে থাকতে থাকতে একটা বড় হাসপাতালের পরিকল্পনা নেয়া হলো সেটা বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল নামে পরিচিতি হয়েছিল। আগরতলা থেকে ৬০ মাইল ভিতরে বিশ্রামগঞ্জ নামক স্থানে আমরা হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করি। সেখানে আমাদের সংগে এই কর্মকান্ডে জড়িত হন ডাঃ জাফরউল্লা চৌধুরী, ডাঃ মোবিন, ডাঃ কামরুজ্জামান প্রমুখ যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অত্যন্ত সম্মানিত এবং সুপরিচিত। পরে ডাঃ ক্যাপ্টেন সিতারা এসে আমাদের সংগে অক্টোবর মাসে যোগ দেন যিনি পরবর্তীতে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত হন। আমাদেরকে এ ব্যাপারে প্রথমে যিনি সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি ক্যাপ্টেন আখতার আহম্মেদ তিনিও পরবর্তী সময়ে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত হন। আমরা সেখানে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ থেকে আরও কয়েকজন মেয়ে যারা বাংলাদেশের ভিতরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে কাজ করছিল এবং যোগাযোগ রাখছিল তারাও সেখানে এস হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজে যোগ দেন। যাদের মধ্যে প্রফেসর জাকিয়া খাতুন, আসমা, রেশমা, মিনু, অনুপমা, পদ্মা, নিলিমা, ডাঃ ডালিয়া শামছুদ্দিন উল্লেখযোগ্য। আমরা সবাই একত্রে সেই হাসপাতালে কাজ করেছি। আমরা নানাভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের খবরাখবর পেতাম। বিভিন্ন বেতা, বিশেষ করে বিবিসি, আকাশ বাণী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং আমেরিকা প্রবাসী ভাইয়ের নিকট আমরা মায়ের দেয়া কোড ল্যংগুয়েজের চিঠি সমূহ যাহা ভাইয়ের মাধ্যমে আমাদের নিকট দেয়া হতো সেগুলির মাধ্যমে আমরা দেশের অভ্যন্তরের খবরাখবর পেতাম। তদুপরি মুক্তিযোদ্ধারা যখন গেরিলা যুদ্ধ করার জন্য দেশের অভ্যন্তরে যেত তারা ফিরে আসলে তাদের মাধ্যমেও খবরাখবর পেতাম। ২ নম্বর সেক্টরের যে সব মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করতো তাদের মাধ্যমে আমরা সেই সব অপারেশনের খবর এবং যারা দেশের অভ্যন্তরে এই স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতা করতো অর্থাৎ শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলসামস তাদের কার্যাবলীর খবরাখবরও আমরা পেতাম। শেরাটনের বোমা হামলার ঘটনা, রুমি, বদি, আলম, বাদল, চুন্নু, সামাদ, আলভী গং দের বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনের ঘটনা সবকিছুই আমরা নিয়মিত ঐ হাসপাতালে বসে পেতাম। আমরা খবর পেতাম যে, রাজাকার, আলবদর, আলসামস, শান্তি কমিটির লোকজন পাকিন্তান হানাদার বাহিনীদেরকে দেশের অভ্যন্তরের সমস্ত খবরাখবর প্রদান করতো বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপরে পরিবারবর্গের সব খবরাখবর, তাদের বাসস্থান, তাদের কার্যাবলী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নিকট প্রদান করতো। আমরা আরও খবর পাই যে, তারা বিভিন্ন বয়সের নারীদের ধরে নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে এবং বাংকারে প্রদান করতো। যার ফলে ক্রমাগত যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়ে তাদের অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন এবং অনেকেই নির্যাতনের কারণে সেই ক্যাম্প কিংবা বাংকারে নিহত হয়েছেন। রাজাকার, আলবদর, আলসামস বাহিনীর নেতা হিসাবে অনেকের নামের সংগে প্রায় সমসময়ই আমরা গোলাম আযমের নাম শুনতাম। তার সংগে আমরা আরও অনেক নাম শুনছি। যেমন, মতিউর রহমান নিজামী, আলি আহসান মোঃ মুজাহিদ, আব্বাস আলী খান গং দের নাম প্রায়শঃ শুনতাম তবে তাদের মধ্যে সর্বদাই জামায়াতের নেতা হিসেবে গোলাম আযমের নাম উচ্চারিত হতো। আলবদর, আলসামস, রাজাকার এই বাহিনী সমূহের নেতা হিসাবে গোলাম আযম স্বাধীনতার পক্ষের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এক প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমন এর বিরোধী পক্ষের প্রতীক ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। সেই সময়ে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এদের অবস্থা সম্পর্কে আমরা জেনেছি যে, প্রাণ রক্ষার্থে তাদেরকে দেশের ভিতরে একস্থান থেকে অন্যস্থানে পালাতে হয়েছে, ভারতে আশ্র নিতে হয়েছে এবং আমরা আরও অনেক ঘটনা শুনেছি যে, তাদেরকে সমস্ত সম্পত্তি ফেলে শুধুমাত্র নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। চার্চের মধ্যে ঢুকেও তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, মন্দির গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে তাদেরকে এই অত্যাচারিত ও ধর্মান্তিরিত হতে হয়েছে। (চলবে)
১১-০৬-২০১২ ইং পুনরায় জবানবন্দী শুরুঃ
শুধুমাত্র হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদেরকেই একই উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়েছে তা নয়, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং স্বাধীনতার পক্ষের প্রত্যেকটি মানুষের চেতনাকে আঘাত করে তাদের উপরে নির্যাতন করা হয়েছে, তবে বিশেষভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদেরকে চিহ্নিত করে ধর্মীয় কারণে তাদের উপরে হত্যা, লুন্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ করা হয়েছে। ২৫ শে মার্চের অপারেশন সার্চ সাইট পৃথিবীর অন্যতম একটি নিকৃষ্টতম গণহত্যা বলে চিহ্নিত এই কারণে যে, একটি গণতন্ত্রকামী জনগোষ্ঠীর ওপর যারা মূলত নিরস্ত্র ছিল তাদের ওপরে সশস্ত্র হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে। এখানে উল্লেখ করতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপরে হত্যাকান্ড, ইকবাল হল পুড়িয়ে দেওয়া, জগন্নাথ হলের ছাত্র হত্যা, রোকেয়া হলের অভ্যন্তরে হত্যাকান্ড, কালি মন্দির আক্রমণ, শাখারী বাজার, রায়েরবাজার, হাটখোলা ওয়ারী যে সমস্ত জায়গা হিন্দু অধ্যুষিত বলে পরিচিত কারফিউ দিয়ে অগ্নিসংযোগ কর আবার একই সাথে রাজারবাগে অগণিত পুলিশ বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, একই রকমভাবে পিলখানায় রাইফেলসের সদস্যদের উপর আক্রমণ করা একটি ঘৃণ্য গণহত্যার উদাহরণ স্থাপন করে। একইভাবে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ২৫ শে মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ধরনের গণহত্যা চলতে থাকে। বরিশালের একটি উদাহরণ দেই বাজারে সমবেত জনগোষ্ঠীর ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ করা হয়। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ যখন দৌড়ে নদীতে ঝাপ দিতে গেছে তখন লঞ্চ থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদেরকে বিপরীত দিক থেকে গুলি করেছে। এই ধরনের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এরকম ঘটনা দেশের সর্বত্রই হয়েছিল। এই ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করার কৌশল এবং সেই কৌশলকে সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা যারা দিয়েছে তারাও এই অপরাধের সমান ভাগিদার এবং আমরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে, বেতারের মাধ্যমে যা সেই সময়কার তথ্য সরবরাহের মূল মাধ্যম ছিল জানতে পারি এই সমর্থনের এবং সহযোগিতার মাষ্টার মাইন্ড ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা এবং শান্তি কমিটিরও অন্যতম শীর্ষ নেতা গোলাম আযম। আমরা এও জেনেছি যে, ১৯৭১ সালের ২৩ শে আগষ্ট এবং ৩১ আগষ্ট তারিখে গোলাম আযম পাকিস্তানের লাহোর এবং হায়দারাবাদে নিজে উপস্থিত থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এই সব কর্মকান্ডকে সমর্থন দিয়েছেন এবং মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন এবং মুক্তিবাহিনীকে নির্মূল করার আহবান জানিয়েছেন। লক্ষ্য করা যেতে পারে সেপ্টেম্বর মাসে যখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয় সেখানে জামায়াতে ইসলামীর সম্ভবত দুইজন সদস্যকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তাদের উদ্দেশ্য করে সংবর্ধনা দিতে গিয়ে গোলাম আযম বলেন ঠিক সে লক্ষ্যে শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছে একই লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদেরকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এখানে একটা প্রশ্ন পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে, শান্তি কমিটি কখনও সশস্ত্র কোন অভিযানে অংশ গ্রহণ করেছে কিনা? আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তারা কখনও কখনও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিয়েছে। রাজাকারদের কাছে অস্ত্র ছিল সেটা সকলেরই জানা আছে। আমরা আরও লক্ষ্য করি ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর যখন মুক্তিযুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে তখনও গোলাম আযম ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাত করে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন যে, মুক্তিবাহিনীকে পরাভূত করে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং তিনি দম্ভ করে একথাও বলেন যে, সে ব্যাপারে রাজাকাররাই যথেষ্ট।
লক্ষনীয় যে, একটি ব্যক্তি গণহত্যা পরিচালনাকারী সরকারের কতখানি কাছের লোক এবং আস্থাভাজন হলে ঐ সময়ে তাদের নেতার সাক্ষাত পান এবং তাদের পক্ষে কথা বলেন এবং আমরা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর একটি মরিয়া এবং নৃশংস আচরণ প্রত্যক্ষ করি ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এর বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের ভিতরে। যে উপায়ে এবং যে নির্যাতন ও অত্যাচার করে এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় নাৎসী আমলেরও অনেক হত্যাকান্ড তা দেখে লজ্জিত হবে। আমরা জানি রাকাজার, শান্তি কমিটি এবং আলবদর ও আলশামস এই সমস্ত বাহিনীর দার্শনিক এবং কৌশলগত পরিচালনায় নেতৃত্বে দিয়েছেন গোলাম আযম। ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর তারিখে আমরা ফিল্ড হাসপাতাল থেকে কলিকাতায় চলে যাই। তৎপর ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারী তারিখে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসি। ১৬ ডিসেম্বরে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর আমরা কলিকাতায় বসেই পাই। তখন যাতায়াতের ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আমরা ট্রেনে বেনাপোল পর্যন্ত এসে তারপর বিভিন্নভাবে ঢাকায় প্রবেশ করি, কখনও রিক্সায়, কখনও নৌকায়, কখনও বাসে। কারণ যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত ছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসি যেখানে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী, তাদের পরিবারের কেউ না ক্ েনিহত হয়েছেন, কোন কোন পরিবারের একাধিক সদস্য নিহত হয়েছেন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদেরকে হারিয়েছি, সহপাঠিদের হারিয়েছি, মুক্তিযুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছিল সেই বন্ধুদেরকে হারিয়েছি, এক একটি পরিবার তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি নিহত হওয়াতে দুরবস্থায় পতিত হয়েছে, নারীদের অবস্থা ততোধিক বিপন্ন কারণ তারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা সবাই জানি দুই লক্ষ নারী মুক্তিযুদ্ধকালীন সমেয় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, আরও দুই লক্ষ নারী নানাভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন এবং পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষ অভিভাবক হারা হয়ে অসহায় অবস্থায় নিপতিত হয়েছেন। তারা অনেকেই আমার মা সুফিয়া কামালের কাছে তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা বলতে আসেন এবং বাঁচার একটি উপায় খুঁজে দিতে এবং সাহায্য করার জন্য অনুরোধ জানায়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে আমার মা সুফিয়া কামাল তার অন্যান্য সহকর্মীদেরকে নিয়ে নারীদের পুনর্বাসনের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে শুরু করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ব্রাক নামে পরিচিত যে বেসরকারী সংস্থাটি আছে তার প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন আমার মা। ব্রাক এবং নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এ সমস্ত সংগঠনের মাধ্যমে তিনি তার সহকর্মীদের নিয়ে নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন এবং এর জনগণের পুনর্বাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। আমরা পরিবারের লোকেরাও ঐ কাজে যুক্ত হয়ে যাই। সেই কারণে নারী পুনর্বাসনের কাজে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাই। একই সংগে মানবাধিকার লংঘন এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এই ইস্যুগুলি নিয়ে কাজ করতে শুরু করি। এর ধারাবাহিকতায় মানবাধিকারের কাজের সাথে যুক্ত হই এবং আইন অধ্যয়ন করতে শুরু করি যা শেষ করি ১৯৭৮ সালে। নারী পুনর্বসান কেন্দ্রে মূলত যে কাজ করা হতো সেটা হলো যারা সাহায্য প্রার্থী হয়ে আসতেন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কারণ তাদের মধ্যে অধিকাংশই অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন। তাদের নিরাপদে থাকা এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক প্রয়োজন মেটানো, তারা যাতে করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সমাজে পুনর্বাসিত হতে পারেন সেজন্য তাদের জন্য নানান সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া এবং যারা পরিবারে ফিরে যেতে চেয়েছেন তারা যেন স্বসম্মানে পরিবারে ফিরে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা। আমি একটি বিশেষ দায়িত্বের কাণে ১৯ জন অত্যাচারিত নারীর সাক্ষাতকার নিয়েছিলামন যারা সবাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছিলেন এবং তাদের অনেককেই স্থানীয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোষরেরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে হস্তান্তরিত করেছিল। এরা মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্থ অবস্থায় ছিলেন এবং তাদের মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা দেখার জন্য বিশেষ করে এই সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়েছিল। নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে একজন বিদেশী ডাক্তার ছিলেন যার নাম ডাক্তার ডেবিস। তাছাড়াও দেশীয় নারী, পুরুষ স্বেচ্ছাসেবী ডাক্তাররাও ছিলেন। সার্বক্ষণিকভাবে আমার মা সুফিয়া কামাল, রাজনীতিবিদ বদরুন্নেছা আহমেদ, সমাজসেবী ছায়রা আহম্মেদ, মালেকা খান, আফিফা হক প্রমুখ এই পুনর্বাসন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। ঐ পুনর্বাসন কেন্দ্রটি ঢাকার ইস্কাটনে অবস্থিত ছিল। পুনর্বাসন কেন্দ্রে যে সমস্ত যুদ্ধ শিশু ছিল তাদের মায়েদেরকে একটা সুযোগ দেয়া হয়েছিল যে, তারা রাজি থাকলে ঐ শিশুদেরকে দত্তক দেয়া যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সংগে সম্পৃক্ততার কারণে এবং তার পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ যোগ থাকার কারণে একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে মানবাধিকার, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবতার মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং সেই অবস্থান থেকেই একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমি ট্রাইবুনালের কাছে এই প্রত্যাশা রাখি যে, পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম একটি গণহত্যার সংগে যারা জড়িত নীতিগতভাবে সমর্থন দিয়ে, সহযোগিতা দিয়ে এই গণহত্যাকে সমর্থন যুগিয়েছে এবং মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে ৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণ হানি ঘটিয়েছে, সাড়ে সাত কোটি জনগণের কিছু সংখ্যক ব্যক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল তারা ব্যতীত অন্য মানুষের মধ্যে এক কোটি লোককে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে, দেশের অভ্যন্তরে যারা ছিল তাদেরকে অনবরত ভীতিকর অবস্থায় নিজের বাড়ি, ঘর, গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয়ের জ্য ছোটাছুটি করতে বাধ্য করেছে, দুই লক্ষ নারীকে ধর্ষণের শিকার করেছে, আরও লক্ষ লক্ষ নারীকে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত করেছে এবং এই যুদ্ধের কারণে কোটি কোটি পরিবারকে বিপর্যস্থ করেছে, বিচারের মাধ্যমে এই মানবতাবিরোধী অপরাধীরা যথাযথ শাস্তি পাবে। আমি এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি। অধ্যাপক গোলাম আযম আজ ট্রাইবুনালে আসামীর কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন। এই আমার জবানবন্দী।
জেরা ঃ
আমি তদন্তকারী কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগমের নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি। তিনি অনেকবার আমার নিকট গিয়েছেন তবে যতদূর মনে পড়ে ২০১২ সালের, পরে বলেন ২০১১ সালের জুলাই মাসের ১১ তারিখে তার নিকট জবানবন্দী দেওয়া শেষ হয়েছে। তার নিকট একাধিকবার আমি জবানবন্দীর জন্য বসেছি। জবানবন্দী নেওয়ার জন্য তিনি আমার অফিসে এসছিলেন। আমি মনে করতে পারিনা যে, আমি কখনও তদন্ত সংস্থার অফিসে গিয়েছিলাম কিনা। যখন তদন্ত এবং প্রসিকিউশনের অফিস বই ট্রাইব্যুনালে ছিল তখন আমি ট্রাইব্যুনালের বিল্ডিংয়ে এসে রাজাকার অর্ডিন্যান্স তদন্ত সংস্থার কাছে দিয়েছিলাম।খুব সম্ভবত ২০১০ সালে দিয়েছিলাম, তবে তারিখ মনে নাই। তদন্ত সংস্থা বর্তমান অফিসটি কবে সেখানে স্থানন্তরিত হয়েছে তা আমার জানা নাই। আমি এই মামলায় কোন নালিশকালী ব্যক্তি নই। তদন্ত সংস্থার কমপ্লেইন রেজিস্টার ক্রমিক নং- ৫ তারিখ০১-০৮-২০১০ এর নালিশ কারীকে তা আমি জানি না। অধ্যাপক গোলাম বাংলাদেশের একজন পরিচিত ব্যক্তি। আসামী কাঠগড়ায় একজন ব্যক্তিই উপস্থিত আছেন।
রাজাকার বাহিনী গঠন তারিখ আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না তবে খুব সম্ভবত ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনায় জৈনিক ইউসুফের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছিল। আমাদের বাড়িতে ১৯৭১ সালে দৈনিক পূর্বদেশ, আজাদ পত্রিকা, মর্নিং নিউজ, দি পিপল পত্রিকা ইত্যাদি আসতো। দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠনের খবর পড়েছিলাম। উক্ত দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকাটি আমার সংরক্ষনে নাই, আমি উহা তদন্ত সংস্থায় জমা দিই নাই। আমার যতদূর মনে পড়ে ঐ খবরে ইউসুফ সাহেবের নাম ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ইউসুফ সাহেব খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠন করেছেন এই খবরটি প্রকাশিত হওয়ার কথা, তবে আমি অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় দেখেছি কিনা তা এ মুহুর্তে মনে করতে পারছি না। খুব সম্ভবত খবরটি সাপ্তাহিক বিচিত্রায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। আশির দশকে কোন এক সময়ে বিচিত্রায় এই খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ সময়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় নির্বাহী সম্পাদক ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির বর্তমান আহ্বায়ক জনাব শাহরিয়ার কবির। জনাব শাহরিয়ার কবীর সাহেব ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির আহ্বায়ক হওয়ার পূর্বে মস্তারি শফি ঐ কমিটির সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন তা আমি জানি। তবে আহ্বায়ক ছিলেন কিনা তা আমি জানি। রাজাকার বাহিনী গঠনের ব্যাপারে গেজেট বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আমি অবগত আছি যেটা আগষ্ট মাসে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে পাকিস্তান সামরিক সরকারের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অধিনস্থ করা হয় এটা আমি শুনেছি। রাজাকার বাহিনী সরকারের প্রতিষ্ঠিত একটি ডিরেক্টরেটরের মাধ্যমে পরিচালিত হতো এবং উহার প্রধান ছিলেন একজন ডিরেক্টর। রাজাকার বাহিনীর প্রথম ডিরেক্টর রহিম সাহেব পুলিশের ডিআইজি ছিলেন কিনা তা আমি জানিনা কেননা তখন আমি দেশে ছিলাম না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের আব্দুর রহিম নামে কোন সচিব ছিলেন কিনা তা আমার জানা নাই। রাজাকারদেরকে স্থানীয় এস.ডি.ও সাহেব নিয়োগ দিতেন কারন একটি গেজেটের মাধ্যমে যখন কোন সংগঠন কাজ করে তখন তাদের সরকারের নির্দেশনা বা কর্তৃত্ব মনে করতে হয়। রাজাকার বাহিনীর ট্রেনিং দিতেন সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্তৃক দেয়া হতো যখন তাদের কন্ট্রোলিং দায়িত্ব সরকারের উপর অর্পিত হয়।
প্রশ্ন ঃ আগষ্ট মাসের পূর্বে রাজাকারদের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে এরুপ কোন খবর সরকারী বিধিবদ্ধ বাহিনী হিসাবে আত্মপ্রকাশের পূর্বে ২রা আগষ্ট, ১৯৭১ এর পূর্বে রাজাকার বাহিনী কোন সশস্ত্র বাহিনী ছিলো কি?
উত্তর ঃ রাজাকারের মত বাহিনীর কার্যক্রমের জন্য তাদের নিকট অস্ত্র থাকা অপরিহার্য ছিল না কারন তারা বিভিন্নভাবে যেমন তথ্য সরবরাহ করা, বাড়ি চিনিয়ে দেওয়া, হুমকি দেওয়া, হয়রানী করা এসবের জন্য অস্ত্র প্রয়োজন হয় না।
আমি ১৯৭১ সালের জুন মাস পর্যন্ত আমি ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় ছিলাম। ঐ সময় ধানমন্ডি এলাকা লালবাগ থানার অধীনে ছিল। দেশ স্বাধীনের পর দেশে ফিরে ঢাকা জেলার রাজাকার এ্যাডজুটেন্ট কে ছিলেন সে খবর আমি নেই নাই। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ থেকে ৩রা জুন তারিখ পর্যন্ত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাস করতে যেতাম না। আমাদের বাড়িতে কখনও আর্মি, রাজাকার, আলবদর আসে নাই, তবে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আমার মায়ের উপর আলবদর কর্তৃক একটি হামলা করার পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল বলে আমি শুনেছি। আমার মা সুফিয়া কামাল দুইটি ডায়রী লিখতেন, একটি দৈনন্দিন অন্যটি কবিকা লেখা সংক্রান্ত। পরবর্তী আমার মায়ের দৈনন্দিন ডায়রীটি পরবর্তীকালে বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁর দৈনন্দিন ডায়রীতে ১৯৭১ সালের শেষের দিকে কোন এক জায়গায় তাকে আলবদর কর্তৃক হামলায় কথা উল্লেখ আছে। এই ষড়যন্ত্রকারীআলবদরদের নাম জানার কোন সুযোগ ছিলনা এবং তিনি আমাদের কে বলেও নাই। আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ই জুন পর্যন্ত আমাদের ঢাকায় থাকা অবস্থায় কোন আলবদরের সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই। কারন তারা গোপন কিনা ফোর্স ছিল বিধায় কারো কাছেই নিজেদের নাম প্রকাশ করেনি এমনটি যাদেরকে হত্যা করেছে তাদের সামনেও তারা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে এসেছে। (চলবে)
১১-০৯-২০১২ ইং ২:০০ মিঃ পুনরায় জেরা শুরু ঃ
১৯৭১ সালে কোন আলদরকে নাম এবং চেহেরা দিয়ে আমি সনাক্ত করতে পারি নাই। ১৯৭১ সালের ১৬ই জুন তারিখ পর্যন্ত আমি ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় ছিলাম, তখন রাজাকার বাহিনী গঠন হচ্ছে, সেই সময় পর্যন্ত কোন রাজাকার সদস্য আমি ধানমন্ডি এলাকায় দেখি নাই এবং কারও নামও আমি শুনি নাই। দেশ স্বাধীনের পরে দেশে ফিরে এসে আমি আমাদের ঐ ধানমন্ডিরবাড়িতেই ছিলাম এবং এখনও সেখানে আছি। আমার মা সুফিয়া কামালভারতে যান নাই। আমি দেশে ফেরত আসার পরে ধানমন্ডি এলাকার কোন রাজাকার, আলবদর, আলশামস সদষ্যকে দেখি নাই এবং কারও নামও শুনি নাই। দেশ স্বাধীনের অব্যবহিত পর পরই বাংলাদেশে যে সমস্ত পত্রিকা প্রকাশিত হতো সেই সমস্ত পত্রিকায় রাজাকার, আলবদর এবং আলশামস প্রধানদের নাম প্রকাশিত হয় নাই, তবে পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়েছে। আমি সর্বপ্রথম আলশামস বাহিনীর প্রধানের নাম কবে শুনেছি তার সঠিক তারিখ মনে নাই এবং তার নামও মনে নাই।আলশামস সদস্যের নাম আমি কোনদিন পত্রিকায় দেখি নাই, তবে আলবদর সদস্যের নাম দেখেছি। আমি সর্বপ্রথম আলবদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর নাম আশির দশকের প্রথম দিকে বিভিন্ন পত্রিকায় দেখেছি। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কোন পদে ছিলেন তা আমার মনে নাই, তবে শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা ১৯৭১ সালে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আমার নিকট পরিচিত ব্যক্তি ছিল না। আমি কখনও সরাসরি কোন ছাত্র রাজনীতি করি নাই। আমি ছয় দফা এবং এগার দফা আন্দোলনের বিভিন্ন মিটিং মিছিলে অংশগ্রহন করেছি। এগার দফা আন্দোলনের উদ্যেক্তা একটা বড় রাজনৈতিক জোটের মাধ্যমে হয়েছিল তার মধ্যে আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলগুলো ছিল। স্বাধীনতা পূর্বকালে পাকিস্তানে তিনটি রাজনৈতিক ধারা ছিল, একটি জাতীয়তাবাদী, একটি সমাজতান্ত্রিক এবং অন্যটি ধর্মভিত্তিক ১৯৭১ সালে ধর্মভিত্তিক দল সমূহ পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষে রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহন করেছিল তার মধ্যে জামায়াতে ইসলামী একটি দল। শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন খাজা খয়েরুদ্দিন। শান্তি কমিটি কার্য পরিচালনা করতোবিভিন্নঅঞ্চলেপাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালানোর মাধ্যমে। তারা ধর্মকে রাষ্ট্রের উপর অবস্থান দিয়েছিল এবং পাকিস্তানকে অখন্ড রাখার স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মভিরু মুসলমানরাই পাকিস্তানের অধিবাসী একথা প্রচার করতো, তদুপরি আরও প্রচার করতো যারা ভাল মুসলমান তারা বাংলাদেশ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন করতে পারে না। তারা ধর্মভিরু মানুষদেরকে মনোস্তাত্বিক চাপ প্রয়োগ করে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা বলতে যা বুঝায় তার পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করতো। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি এবং তারা শাখা সমূহ কত সদস্য বিশিষ্ট ছিল তা আমি জানি না। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি সর্বপ্রথম কত তারিখে মিটিং করেছি তা আমি বলতে পারব না। এপ্রিল মাসের কেন্দ্রীয় কমিটির কোন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা তা আমার এ মুহুর্তে মনে পড়ছে না। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য কোন দলের ছিল তা আমি এ মুহুর্তে বলতে পারব না, তবে তারা মুসলিম লীগ, পিডিবি, জামায়াতে ইসলামীর ছিল তা আমার মনে আছে।
খাজা খয়রুদ্দিন কর্তৃক পরিচালিত শান্তি কমিটি ব্যতিত অন্য কোন শান্তি কমিটি ছিল কিনা তা আমি জানি না, তবে মৌলভী ফরিদ আহমদ নামে একজনের শান্তি কমিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন মর্মে পত্র পত্রিকায় দেখেছি। মৌলভী ফরিদ আহমদ সাহেব সম্ভবত পি.ডি.বি করতেন। তিনি ধানমন্ডি এলাকায় বসবাস করতেন কিনা তা আমি জানি না। ধানমন্ডি এলাকায় কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির একটি অফিস ছিল কিনা তা আমি জানি না। আমার দেশে থাকা ধানমন্ডি এলাকায় শান্তি কমিটির কোন নেতার সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই বা সে এলাকায় থাকে এমন কোন নেতার নামও শুনি নাই। খাজা খয়রুদ্দিন সাহেবের শান্তি কমিটির অফিস কোথায় ছিল তা আমি জানি না। শান্তি কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহনের প্রক্রিয়া কি ছিল তা আমরা জানি না। তৎকালীন বিভিন্ন জেলা শান্তি কমিটির প্রধান এবং তার দলীয় পরিচয় আমি জানি না।
ইউনিয়ন পর্যায়ে কিছু কিছু ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শান্তি কমিটির প্রধান করা হয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কয়টি সশস্ত্র অপারেশনে শান্তি কমিটি অংশ গ্রহন করেছিল সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট সংখ্যা আমি এ মুহুর্তে বলতে পারছি না, তবে একাধিক অপারেশনে অংশ গ্রহন করেছিল। এ সংক্রান্ত কিছু কিছু তথ্য তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট আমি প্রদান করেছি।কিছু তথ্য আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। কিছু তথ্য আমাদের সংঙগঠন আইনও শালিশ কেন্দ্রের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত এবং কিছু তথ্য পত্র পত্রিকার কাটিং থেকে প্রাপ্ত। যে সমস্ত শান্তি কমিটির সদস্যরা এই সকল অপারেশনে অংশ গ্রহন করেছিল আমাদের প্রদত্ত তথ্যের মধ্যে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের নাম আছে কিনা তা আমার এ মুহুর্তে মনে পড়ছে না। শান্তি কমিটির সদস্যদের অস্ত্র সরবরাহের কোন নির্দেশ পাকিস্তান সরকার দিয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে কোন তথ্য আমার নিকট নাই। যেভাবে শান্তি কমিটি তাদের পরিচয় দিয়েছিল তাতে শান্তি কমিটি একটি বেসামরিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছিল। (চলবে)
১২-০৯-১২ পুনরায় জেরা শুরু ঃ-
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে শান্তি কমিটি যে সকল অপারেশনে থাকতো সেই সকল অপারেশনে ক্ষতিগ্রস্থ কোন ব্যাক্তি বা পরিবারের নাম আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট সরবরাহ করি নাই। পাকিস্তানী আর্মির যে অফিসারের নেতৃত্বে এই অপারেশনগুলি পরিচালিত হয়েছে তার নামও আমি তদন্তকরী কর্মকর্তার নিকট প্রদান করি নাই। কারণ তদন্তাকরী কর্মকর্তা তদন্ত করে উক্ত নাম সংগ্রহ করার কথা। কোন এলাকায় কত তারিখে কোন ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তৎমের্ম আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট কোন তথ্য সরবরাহ করি নাই। কারণ এই ধরনের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়,অন্যান্য ঘটনার ধারাবাহিকতায় এ সমস্ত ঘটনাগুলি ঘটেছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করে সেগুলি বের করবেন সেজন্য আমি স্থানও তারিখ উল্লেখ করি নাই। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা কবে, কোথায় হয়েছিল একথা বলা সম্ভব নয়, কারণ এধরণের গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা জনগনকে জানিয়ে করা হয়না, তবে আলবদর বাহিনীর কর্তৃক সংঘটিত গুপ্তহত্যার ব্যাপারে যেহেতু আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী এবং তিনিই জামায়াত ইসলামীর নেতা ছিলেন এাবং গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামীর আমির থাকায় তার অনুমোদন নিয়েই এই ধরনের হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল এবং তিনি এর দায় দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না। জামায়াত ইসলামীর কোন সভায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল সেটা বলা সম্ভব নয়। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব কবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের অনুমোদন দিয়েছিলেন তৎমর্মে কোন প্রমান্য তথ্য আমার জানামতে কোথাও নেই। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব বুদ্ধিজীবী হত্যাকন্ডের অনুমোদন দিয়েছিলেন তৎমর্মে কোন প্রমান্য তথ্য আমার নিকট নাই। তবে এ ধরণের সংগঠনের প্রধন হিসাবে তার সংগঠনের নেতা কর্মীদের কর্তৃক সংঘটিত কোন কাজ তার অনুমোদন ব্যতীত হওয়া সম্ভব নয়, তদুপরি এমন কিছু দেখা যায় না যে, যারা এসব কাজ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যাবস্থা তিনি গ্রহন করেছেন, অতএব নিয়ম অনুযায়ী সংগঠনের প্রধানের উপর এ ধরনের কার্যের দায় দায়িত্ব বর্তায়। রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং শান্তি কমিটি কাঠামোগত ভাবে জামায়াতে ইসলামীর অংগ সংগঠন বলে ধরে নেয়া যায় না, তবে এই সংগঠন সমূহ প্রতিষ্ঠান এবং কর্মপ্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকাই ছিল মূখ্য। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির প্রধান এবং সদস্য সচিব জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ছিলেন কিনা সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধরনা নাই, তবে তাদের কর্মপদ্ধতি এবং গঠন সম্পর্কে গোলাম আযমের মুখ থেকেই আমরা পত্র পত্রিকায় দেখেছি এবং তিনি শান্তি কমিটির মিছিলেও নেতৃত্ব দিয়ে অংশগ্রহন করেছেন। শান্তি কমিটি গঠনের আহবান জানিয়ে অধ্যাপক গোলাম আযম বিবৃতি দিয়েছিলেন এই মর্মে ১৯৭১ সালের ৫ এবং ৭ এপ্রিলে পূর্বদেশ, দৈনিক আযাদ পত্রিকায় কাটিং তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট প্রদান করা হয়েছে। অধ্যাপক গোলাম আযম শান্তি কমিটির যে মিছিলে নেতৃত্বে দিয়ে অংশগ্রহন করেছিলেন সেই মিছিলে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির আহব্বায়ক ও সদস্য সচিব ছিলেন কি না তা আমি বলতে পারি না, কারণ আমি তাদেরকে চিনি না, আমি যে মিছিলের কথা বলেছি সেই মিছিলের বিষয় আমি পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। সেই পত্রিকায় আমি ঐ মিছিলের খবর পড়েছি। আমি গোলাম আযমের নাম খোজাঁর জন্য খবর পড়তাম না, খবরের প্রসঙ্গে যখন তার নাম আসতো তখন সেটা লক্ষ্য করতাম। এ খবরে অধ্যাপক গোলাম আযমের নাম ছাড়া ও অন্য কারো নাম থাকতে পারে তবে আমার এ মূহূর্তে মনে পড়ছে না। শান্তি কমিটির কোন অধ:স্তন শাখাকে বাতিল করার কোন ক্ষমতা এককভাবে গোলাম আযম সাহেবের ছিল কি না সে সম্পর্কে আমার ধারনা নাই। শান্তি কমিটির কোন সদস্যদের দ্বারা বা অধ:স্তন কোন শান্তি কমিটি কর্তৃক কোন সংগঠিত অপরাধের বিচার চেয়ে বা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ চেয়ে বা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির বা অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের নিকট অভিযোগ আনা হয়েছিল এমন কোন প্রামান্য তথ্য আমার চোখে পড়ে নাই। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন সদস্যকে অপসারনের কোন ক্ষমতা অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের ছিল কি না তা আমার জানা নাই। রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর কোন সদস্যকে বরখাস্ত কারার বা শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের ছিল কি না তা আমার জানা নাই। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের বিষয়ে অনেক মামলা হয়েছিল তবে সংখ্যা ৫০ টি কি না তা আমি বলতে পারব না। শহিদুল্লাহ কায়ছার, মুনির চৌধুরী, ডা: আলিম নৌধুরী হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তিনটি পৃথক মামলা হয়েছিল। শহিদুল্লাহ কায়ছার সাহেব হত্যাকান্ড সম্পর্কিত যে মামলাটি হয়েছিল তাতে অভিযুক্তের নাম ছিল খালেক মজুমদার। তিনি জামায়াতে ইসলামীর নেতা ছিলেন এবং তাকে আলবদর হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। উল্লেখিত মামলায় নি¤œ আদালতে শাস্তি প্রদানের পরে উচ্চ আদালতে দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল এবং সেই আপিলে খালেক মাজুমদার সাহেব খালাস পেয়েছিলেন এবং ঐ রায়ে উল্লেখ আছে যে, রাষ্ট্রপক্ষ তাকে আলবদরের সদস্য প্রমানে ব্যর্থ হয়েছেন। উল্লেখিত তিনটি মামলাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যান্য মামলা সমূহে অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবকে উল্লেখিত হত্যার পরিকল্পনা কারী বা অন্য কোন ভাবে আসামী করা হয় নাই, কারণ সেগুলো একক ভাবে হত্যা মামলা হিসাবে দাঁড় করানো হয়েছিল এবং আজকে আমার যে স্বাক্ষ্য সেটা কোন একক হত্যা মামলায় প্রেক্ষিতে নয় সামগ্রিকভাবে ইহা ১৯৭১ সালের গনহত্যা সময়ে অধ্যাপক গোলাম আযম ভূমিকা নিয়ে।
১৯৭১ সালের সংঘটিত ঘটনার প্রেক্ষিতে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৭২ সালে দুটি মামলা পয়েছিল। উল্লেখিত মামলা দুইটি তার বিরুদ্ধে কমপ্লিসিটির (সম্পৃক্ততা) অভিযোগ ছিল। এ মামলা দুইটির ব্যপারে পরবর্র্তীতে আমি আর খবর রাখি নাই ফলে অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছিল কিনা তা আমি জানিনা। বুদ্ধিজীবী হত্যকান্ডের বিষয়ে ১৯৭১ সালে বিজয়ের পর পরই একটি সরকারি এবং একটি বেসরকারী তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল কিনা তা আমি বলতে পরলেও আমার মনে আছে ঐ সময়ে সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে এ ব্যপারে নানা উদ্যেগ নেয়া হয়েছিল তাহা কতদূর পৌছেছে সে সম্পর্কে আমি এ পর্যায়ে বলতে পারছিনা, তবে এই জনমতের চাপে ১৯৭৩ সালে বর্তমান আইনটি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন, ১৯৭৩ প্রনীত হয়।
জহির রায়হান সাহেব বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনেরজন্য অনেক কিছুই করেছিলেন এবং একটি নাগরিক কমিটিও করেছিলেন। এই নাগরিক কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্যের নাম আমি বলতে পারব না তবে শহীদ শহীদুল্লাহ কায়ছারের স্ত্রী পান্না কায়সার এ ব্যাপারে আমার মায়ের সংগে যোগাযোগ রাখতেন। বিজয় অর্জনের পরে দালাল আইনে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ গর্ভণর মালেক সাহেবের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তবে বিচার শেষ হয়েছিল কিনা তা আমি জানিনা। দালাল আইনে বিচার না করে জেনেভ কনভেনশন অনুযায়ী বিচার করার জন্য মালেক সাহেব কোন আবেদন জানিয়েছিলেন কিনা তা আমার জানা নাই। মালেক সাহেবের দালাল আইনে বিচারের বিরোধীতা করে কেউ কোন বিবৃতি দিয়েছিল কিনা তা আমি জানিনা। শহিদুল হক মামা নামে কোন ব্যক্তিকে আমি চিনি না। বাংলাদেশ টেলিভেশন থেকে প্রচারিত রনাঙ্গনের দিনগুলি নামে ধারাবাহিক যে অনুষ্ঠান তা সম্পর্কে আমি জেনেছি, তবে সময়ের অভাবে দেখার সুযোগ আমার হয় নাই। নাসির উদ্দিন ইউসুফ সাহেবের সংগে আমার পরিচয় আছে। তিনি ঐ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলেও মিরপুর ১৯৭২ সালের ৩১শে জানুয়ারী তারিখে মুক্ত হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে তারিখ আমার নির্দিষ্ট মনে নাই। তবে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পরও বাংলাদেশ কিছু কিছু পকেট হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের দখলে ছিল এবং আস্তে আস্তে সেগুলি দখল মুক্ত হয়। পাকিস্তানের একজন প্রাক্তনমন্ত্রীর বাড়ি থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পরিকল্পনার নথিপত্র পাওয়া গিয়েছিল, তবে কার তথ্য মতে উহা পাওয়া গিয়েছিল তাহা আমার এখন মনে নাই। অধ্যাপক মুনির চৌধুরী সাহেব ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সংহতির পক্ষে অনেকের সংগে বিবৃতির স্বাক্ষর করেছিলেন এটা আমার জানা আছে। ১৯৭১ সালে ২২ নভেম্বর পরে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হয়তো ছিলেন না। কারণ আমি জানি ১লা ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের সংগে দেখা করে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন এই মর্মে যে, মুক্তি বাহিনীকে নির্মূল করতে রাজাকাররাই যথেষ্ট। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের যে অঞ্চলে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ট ছিল সেখান থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমারাজাত্রিদিব রায় এম,এন,এ নির্বচিত হয়েছিলেন। ঐ সময় বৌদ্ধ ধর্মগুরু ছিলেন বিশুনান্দ মহাথেরু। উল্লেখিত দুই ব্যক্তি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষে কাজ করেছিলেন। (চলবে)
১৩-০৯-২০১২ ইং পূনরায় জেরা শুরু ঃ
ইহা সত্য যে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নূরুল আমিনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল এবং সেই মন্ত্রী সভায় রাজা ত্রিদিব রায় একজন মন্ত্রী ছিলেন। তবে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই কারন যে কোন মুক্তিসংগ্রামে আক্রমন কারী পক্ষ যাদের উপর আক্রমন করেছে তাদের মধ্যে কিছু লোককে দেখানোর জন্য বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়ে সামনে রাখে কারণ তারা মানুষকে ধোকা দেওয়ার চেষ্টা করে যাতে মানুষের কাছে এ ধরনের গণহত্যা বা এথনিককিনজিং এর কথা প্রকাশ না পায়। এটা আমার মনগড়া বক্তব্য নয়, স্বাধীনতার পরবর্তী বিভিন্ন বইয়ে একথা না থাকতে পারে, আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে তৎকালীন ঘটনাসমূহের বিশ্লেষন দিয়েই আমি একথা বলেছি। ইহা সত্য হতে পারে যে, তৎকালীন নূরুল আমিনের মন্ত্রী সভায় জামায়াতে ইসলামীর কোন সদস্য ছিল না। অংশুপ্রু চৌধুরীও বৌদ্ধদের নেতা ছিলেন এবং সেই নির্বাচনে এম.পি.এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ও ডাঃ মালেক মন্ত্রী সভায় একজন সদস্য ছিলেন। উনারা ঐ এলাকার জনগনের প্রতিনিধিত্ব করতেন। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মহিলা সংগ্রাম পরিষদের সভানেত্রী ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল, সম্পাদিকা ছিলেন মালেকা বেগম পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরে ঐ সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নাম নিয়ে এখনও তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৬১ সালে আমার জবানবন্দীতে প্রদত্ত মূল ধারার রাজনীতি বলতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে বুঝিয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমার মা বেগম সুফিয়া কামাল, বাবা এবং বড় ভাই আমাদের ধানমন্ডির বাড়িতেই ছিলেন। আমার মা অসংখ্য পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন, তবে ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৮২, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে কিনা তা আমি বলতে পারব না। এর ভিতরে অনেকগুলি সরকারী ও অনেকগুলি বেসরকারী পদক ছিল। ‘মাহে নও’ নামক একটি মাসিক পত্রিকায় আমার মা লেখালেখি করতেন যার সম্পাদক ছিলেন কবি আব্দুল কাদির।
আমার অপর বোন যিনি আমার সঙ্গে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি জীবিত আছেন। আমার যে ভাইয়ের মাধ্যমে আমরা ইনফরমেশন পেতাম তিনি এখনও জীবিত আছেন। আমার ভাইয়ের লিখিত বিভিন্ন খবরা খবর দেওয়া চিঠিগুলো আমরা সংরক্ষন করতে পারি নাই। ঐ চিঠিগুলোতে গোলাম আযম সম্পর্কে আমার বর্ণিত মতে কোন বক্তব্য না থাকায় আমি ইচ্ছাকৃতভাবে উহা গোপন করেছি, ইহা সত্য নহে। আমি আইন ও শালিশ কেন্দ্রের শীর্ষ নির্বাহী। আমি ওখান থেকে মাসিক সম্মানি পাই। ১৯৮৪ সালে আমি সিলেটে থাকতাম এবং ওখানে ফ্রিল্যান্স কনসালটেন্সি করতাম। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আমি সিলেটে ছিলাম। ঐ সময়ে আমি উল্লেখিত কাজ করতাম। আমার ওকালতিতে আমার সিনিয়র ছিলেন জে.এন.দেব। একটি সনদ পাওয়ার জন্য যতদিন কোর্টে যাওয়া প্রয়োজন আমি ততদিনই কোর্টে গিয়েছি, লাইসেন্স পাওয়ার জন্যে ৬ মাস কোর্টে যেতে হয়। আমি সিভিল প্রাকটিস করি। আমার এখনও সিলেট বারের সদস্য পদ আছে, তবে আমি কোর্টে যাইনি। আমি আমার বার কাউন্সিলে সনদ পাওয়ার জন্য যে এফিডেভিট জমা দিয়েছি সেখানে আমি কোন পেশায় নিয়োজিত নই মর্মে উল্লেখ করেছি। সেখানে আমি বলেছি যে, আমার সিনিয়রের সঙ্গে ফৌজদারী মামলা পরিচালনা করেছি। আমি জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র পড়ি নাই। ঐ সংগঠনের সদস্যপদ পাওয়া বা বাতিল হওয়ার কোন নিয়মাবলী আমি জানি না। আমার জবানবন্দীতে প্রদত্ত বক্তব্য “পত্র পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হতো” এখানে পত্রিকা বলতে আমি তৎকালীন পূর্বদেশ এবং দৈনিক আজাদ কে বুঝিয়েছি। ১৯৭১ সালের ৫ই এপ্রিল এবং ৭ই এপ্রিল তারিখে ঐ পত্রিকাগুলিতে খবর প্রচারিত হয়েছিল। ঐ পত্রিকাগুলোতে আমার বর্ণিত মতে গোলাম আযম সাহেবের ভূমিকা সম্পর্কে কোন বক্তব্য নাই, ইহা সত্য নহে। ঐ তারিখ সমূহের দৈনিক আজাদ পত্রিকায় এ ধরনের কোন খবরও নাই, ইহা সত্য নহে। ১৯৭১ সালের ৬ই এপ্রিল তারিখে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় যে বক্তব্য এসেছিল তাতে পি.ডি.পি’র নূরুল আমিন সাহেবের নেতৃত্বে খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের সাথে সাক্ষাত করে এবং দেশের স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য সাহায্য সহযোগিতার কথা বলা হয় এবং সেখানে গোলাম আযমের নেতৃত্বের কথা বলা হয় নাই, এর উত্তরে সাক্ষী বলেন যে, ইহা সত্য হতেও পারে, তবে ঐ সময়ে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় গোলাম আযমের নেতৃত্বে কথা বলা হয়েছে এবং শান্তি কমিটি গঠনের ব্যপারে তার মূখ্য ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখেছি যে, মিছিল, মিটিং হয়েছে বক্তৃতা দেয়া হয়েছে এমনকি গোলাম আযম সাহেবের দসতখত সম্বলিত এক টাকা মূল্যমানের টিকিটও বিক্রয় হয়েছে। শান্তি কমিটি গঠনের ব্যাপারে গোলাম আযম মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন একথাগুলি ১৯৭১ সালের ৫ ও ৭ই এপ্রিলের দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় আছে। নূরুল আমিনের নেতৃত্বে সামরিক আইন প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করার পরে ১১ই এপ্রিল, ১৯৭১ এর দৈনিক আজাম পত্রিকায় শান্তি কমিটি গঠিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়, তবে ১১ই এপ্রিল, ১৯৭১ এর পত্রিকায় কিনা তা আমি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না। শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন মুসলীম লীগ নেতা খাজা খয়রুদ্দিন। সেই শান্তি কমিটি ১৪০ সদস্য বিশিষ্ট ছিল কিনা তা আমার জানা নাই। এই কমিটির ডিকারেশন লেখা ছিল “নাগরিকদের প্রত্যহিক জীবনে স্বত্তর স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং জনমতে অহেতুক ও ভিত্তিহীন শংকা দূর করার উদ্দেশ্যে এই কমিটি গঠন করা হয়” ইহা সত্য তবে যে সময়ে জনগনকে হত্যা করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং লোকদেরকে নির্বিচারে হত্যা উচ্ছেদ করা হচ্ছে, সেই সময়ে এই ঘটনাগুলোকে অহেতুক ভিত্তিহীন শংকা বলে প্রকাশ করে তারা নিজেরাই নিজেদের দোষ সমূহকে ঢাকার অপচেষ্টা করে তাদের মানসিকতা এবং অপরাধের প্রতি তাদের সমর্থনকে তারাই প্রকাশ করেছে। এই ব্যাখ্যাটি আমার রাজনৈতিক অবস্থান এবং জামায়াতে ইসলামী গোলাম আযমের প্রতি আমার বিদ্বেষ প্রসূত, ইহা সত্য নহে। গোলাম আযমের বক্তব্য বা বিবৃতিতে মুক্তিযোদ্ধারাই দুষ্কৃতিকারী এই ধরনের বক্তব্য সম্বলিত বক্তৃতা বা লিফলেট বা পেপার কাটিং আমার নিকট আছে, তদন্তকারী কর্মকর্তাকেও আমি দিয়েছি তবে অদ্য ট্রাইব্যুনালে আনি নাই। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চাপ সৃষ্টি করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে কাউকে শান্তি কমিটিতে যোগদান করার ব্যাপারে বক্তব্য সম্বলিত কাগজপত্র আমার নিকট আছে, তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দিয়েছি তবে অদ্য ট্রাইব্যুনালে আনি নাই। যুদ্ধকালীন সময়ে অত্র বক্তব্য সম্বলিত দেশী বা বিদেশী কোন পত্রিকা আমার সংগ্রহে আপাততঃ নাই।
আমার জবানবন্দীতে প্রদত্ত বক্তব্য “গোপন কিলার ফোর্স তৈরি করার উদ্যেগ নিয়েছে....তারা গোপনে কাজগুলো করবে মর্মে জেনেছি” মর্মে যে বক্তব্য আমি দিয়েছি সে ব্যাপারে দেশী বা বিদেশী কোন পত্র পত্রিকায় যুদ্ধকালীন সময় খবর প্রকাশিত হয়েছিল কিনা তা আমি বলতে পারব না, তবে এই খবরগুলো যে সব মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে আসতেন এবং যারা আবার ভারতে ফিরে যেতেন তাদের মধ্যে অনেক গোয়েন্দাও ছিল তাদের নিকট থেকে আমরা জেনেছিলাম। এই খবরগুলি আমরা আগষ্টের শেষ দিকে, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে পেয়েছিলাম। এই খবরগুলি অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে শুনেছি, তাদের মধ্যে খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দার এরাই মূখ্য ছিলেন, তারা আমাদেরকে সব সময় দেশের অভ্যন্তরের কথা আমাদের আত্মীয় স্বজনের কথা বলতে গিয়ে একথাগুলি বলেছিলেন। আমরা যখন জুন মাসে ভারত যাই জনাব খালেদ মোশাররফ সাহেব তার আগে থেকেই সেক্টর ২ এর কমান্ডার ছিলেন। জামায়াত ইসলামী একটি রাজনৈতিক সংগঠন। এর জন্ম অবিভক্ত ভারতে হয়েছে। আমরা শুনেছি যে, পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির ছিলেন গোলাম আযম। তিনি কবে থেকে আমিরের দায়িত্ব নিয়েছেন তা আমি বলতে পারব না। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠিত শান্তি কমিটির রাজাকার, আলবদর, আলশামস সবগুলি এপ্রিল ১৯৭১ বা তার পরে হয়েছে। গঠনতন্ত্র মতে শান্তি কমিটি ছিল সামাজিক শক্তি এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামস ছিল সহায়ক (ধীঁরষরধৎু) বাহিনী। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এগুলি অস্তিত্যহীন হয়ে যায়। গোলাম আযম সাহেব ঐ সময়ে কোন কমিটি বা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন না, তবে তার অধীনস্থ মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আলবদর প্রধান ছিলেন এবং উল্লেখিত চারটি সংগঠন তৈরিতে গোলাম আযম সাহেবই মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন, হিটলার নাৎসি বাহিনীর প্রধান ছিলেন না, এমনকি সদস্যও ছিলেন না, এমনকি সদস্যও ছিলেন না কিন্তু তিনি ছিলেন ন্যাৎসী বাাহিনীর অত্যাচারের মূল নায়ক তেমনি যদিও গোলাম আযম সাহেব উল্লেখিত চারটি সংগঠনের প্রাতিষ্ঠানিক মূখ্য নেতা ছিলেন না কিন্তু এই সবগুলি সংগঠন তার নির্দেশে ও নেতৃত্বে পরিচালিত হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যা করেছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমি মনে করি গোলাম আযম সাহেব সেরকমই করেছেন। হিটলার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমায় ছিলে ইয়াহিয়া খান এবং তৎকালীন গভর্নর ছিলেন টিক্কা খান। হিটলারের অবস্থানে ১৯৭১ সালে গোলাম আযম সাহেব ক্ষমতাবান ছিলেন না। হিটলারের সঙ্গে গোলাম আযম সাহেবের তুলনা করা অস্বাভাবিক এবং উদ্দেশ্যমূলক, ইহা সত্য নহে। (চলবে)
১৩-০৯-১২ ইং- ২.০০ ঘটিকা, পূনরায় জেরা শুরু ঃ
স্বাধীনতার পরে স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে যত ইতিহাস লেখা হয়েছে, যত বই লেখা হয়েছে সব জায়গায় ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, গোলাম আযম সাহেবকে সঙ্গে নয়, আমি গোলাম আযম সাহেবের নাম উল্লেখ করে ইতিহাস বিকৃতি করছি, ইহা সত্য নহে, আমি গোলাম আযম সাহেবকে ঐ দুইজনের সঙ্গে যুক্ত করছি। ইহা সত্য নহে যে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর উচ্চতম পর্যায় থেকে গোলাম আযমের প্রশংসা করে কোন বিবৃতি দেয়া হয় নাই। এই প্রশংসা সম্বলিত বিবৃতি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে প্রদান করেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব অঞ্চলীয় কমান্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালেক লিখিত ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইটি আমি পড়েছি। উনি কোন পাকিস্তানপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সামরিক বাহিনীর তৎপরতায় প্রভাব থাকায় কথা স্বীকার করেন নাই, ইহা তাহার নিজস্ব মতামত। হামিদুল্লাহ খান সাহেবের বাসায় কাজের ছেলেটিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা আমি আমার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছি তাকে যুদ্ধকালীন অবস্থায় এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকলেও খোঁজ করা হয়েছে কিন্তু তার কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। সেই ছেলেটির নাম আমার এ মুহুর্তে মনে পড়ছে না। ১৯৭১ সালে দেশী, বিদেশী পত্রিকায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর নেতা হিসাবে গোলাম আযমের নাম আসে নাই ইহা সত্য, তবে তাদের কার্যকলাপের সঙ্গে তার নাম এসেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের পত্র-পত্রিকায় আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের অভিযান ও কার্যাবলীর খবরের সঙ্গে গোলাম আযম সাহেবের নাম এসেছে এই ধরনের ঐ সময়কার কোন পত্র পত্রিকা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট দিই নাই।
একটি সামরিক বাহিনীর সহায়ক বাহিনী যখন কোন অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে তখন তার কৌশলগত দিক এবং পরিকল্পনা হয় তারা নিজেরা তৈরি করে সামরিক বাহিনী অনুমোদন নেয় অথবা সামরিক বাহিনীর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালনা করে নিয়ম মত তাই হয় (প্রসিকিউশনেরে আপত্তি সহকারে), তবে নিয়ম মত ঐ তিন বাহিনী কাজ করছে তা তৎকালীন ঘটনা সমূহ দেখলে মনে হয় না। রাজাকার বাহিনী গেজেটের মাধ্যমে সরকারী তত্ত্বাবধানে আসার আগে তার প্রধান কে ছিলেন তার নাম আমার মনে নাই। নারী পূনর্বাসন কেন্দ্রে যারা এসেছিলেন তাদের অনেকের নাম আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছি। আমি যে ১৯ জন অত্যাচারিত নারীর সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম তাদের নাম আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট দিতে পারি নাই, কারন সেগুলি যেখানে ছিল সেখান থেকে ১৯৭৫ সালের পর নষ্ট করা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট তারিখ বা সাল বলতে পারব না। এই নষ্ট করার ব্যাপারে অভিযোগ করার দায়িত্ব নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষের। তারা তা করেছে কিনা তা আমার জানা নাই। আমার জবানবন্দীতে উল্লেখিত বরিশালের যে ঘটনা অর্থাৎ সমবেত জনগনের উপর হিলকপ্টার ও লঞ্চ থেকে গুলি বর্ষনের ঘটনা খুব সম্ভবত মে মাসের ১০ তারিখে সংঘটিত হয়েছিল এবং সেই ঘটনায় আমাদের বাড়ির কেয়ার টেকার আব্দুল মালেক সরদার, যাকে আমরা কাকা বলে ডাকতাম তিনি নিহত হন। ঐ ঘটনায় বহু প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে কেউ বর্তমানে জীবিত আছেন কিনা তা আমার জানা নাই। আক্রমনকারী হেলিকপ্টার ও লঞ্চ এর নিয়ন্ত্রকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিকট ছিল বলে আমরা জেনেছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর চলাচল রোধকল্পে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় ব্রীজ কালভার্ট ধ্বংস করেছে। অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খানের সঙ্গে বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে শুধুমাত্র জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাম শোনা যায় ইহা সত্য, ইহাতেও মনে হয় ঐ সময় বেসামরিক ব্যক্তিরাও জড়িত ছিল।
ইহা সত্য নহে যে, আমার মা ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম পরিষদ বলে একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যারা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছিল মূল ধারার রাজনীতির আন্দোলনের সাথে, বা মার্চ মাসে যখন থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে আমরা সাংগঠনিকভাবে অংশগ্রহন করেছিলাম এবং সেই সময়ে সে সমস্ত সভা, সমিতি ও সমাবেশ হচ্ছিল তাতে অংশ গ্রহন করেছি সক্রিয়ভাবে। ৭ই মার্চে তদানিন্তন রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায়ও উপস্থিত থেকে অংশগ্রহন করেছি এবং “আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এই বানীতে উজ্জিবীত হয়েছিলাম, বা অন্যদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক কর্মী কিংবা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উজ্জিবীত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর নানা রকম হামলাও চালানো হচ্ছিল, বা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাত্রি ১২-০০ টার দিকে আমার ভগ্নিপতি চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোনে আমাদের নিকট জানতে চান যে, ঢাকার অবস্থা কেমন এবং শুধু এটুকুই বলতে পারেন যে, অবস্থা ভাল নয়, একথা বলার পর পরই টেলিফোনের লাইন কেটে যায়, বা আমাদের পাশের দোতলা বাড়ির একজন জানালেন যে, তাদের বাড়ির ছাদ থেকে কোনাকোনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আগুনের হলকা দেখা যাচ্ছে এবং আমাদের বাড়ির সামনে একটি নির্মানাধীন বাড়ির ছাদে একটি কালো পতাকা উড়ছিল এবং সেই বাড়ির দারোয়ানকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। আমাদের বাড়ির সামনে পানির লেকের উপর একটি ব্রীজ আছে এবং ঐ ব্রীজের উপর দিয়ে মানুষের দৌড়াদৌড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছিল এবং ঐ ব্রীজের উপর একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, বা সাংবাদিক শহিদুল্লাহ কায়ছার সংবাদ পাঠালেন যে, বা আস্তে আস্তে আমরা জানতে পারলাম যে, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, রাজশাহী সর্বত্রই একই ধরনের হত্যাকান্ড চলছে এবং পুলিশের তৎকালীন বড় কর্মকর্তা মামুন মাহমুদ রাজশাহীতে ছিলেন তাকেও হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় কর্মরত বাঙ্গালী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণকে হত্যা করা হয়েছে, বা ২৭শে মার্চ সকাল বেলায় যখন আমরা রাস্তা পার হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তা দিয়ে হেটে যাই আমি নিজে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে মালামাল নিয়ে ট্রাকে তুলছিল, বা তারা কিছু গোপন কিলার ফোর্স তৈরি করার উদ্যেগ নিয়েছে এবং আলবদর, আলশামস নামে দুটি বাহিনী ঐ উদ্দেশ্যে গঠন করা হয় এবং তারা খুব গোপনে একাজগুলি করবে মর্মে জেনেছিলাম, বা নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, রায়ের বাজারের কাছে হিন্দু অধ্যূষিত এলাকায় একটি অপারেশনে তাকে যেতে হবে, বা সেই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন খালেদ মোশাররফ সাহেব। তার সঙ্গে আমরা দেখা করলাম, বা সেখানে আমাদের সঙ্গে এই কর্মকান্ডে জড়িত হন ডাঃ জাফরউল্লা চৌধুরী, ডাঃ মোবিন, ডাঃ কামারুজ্জামান প্রমুখ যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অত্যন্ত সম্মানিত ও সুপরিচিত। পরে ডাঃ ক্যাপ্টেন সিতারা এসে আমাদের সাথে অক্টোবর মাসে যোগ দেন যিনি পরবর্তীতে বীর প্রতীক উপাধীতে ভূষিত হন, বা আমরা যেখানে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ থেকে আরও কয়েকজন মেয়ে যারা বাংলাদেশে ভিতরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করছিল এবং যোগাযোগ রাখছিল তারাও সেখানে এসে হাসপাতালে সেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজে যোগ দেন। যাদের মধ্যে প্রফেসর জাকিয়া খাতুন, আসমা, রেশমা, মিনু, অনুপমা, পদ্মা, নিলিমা, ডাঃ ডালিয়া শামসুদ্দিন উল্লেখযোগ্য, বা আমেরিকা প্রবাসী ভাইয়ের নিকট আমার মায়ের দেয়া কোড ল্যাংগুয়েজের চিঠি সমূহ যাহা আমাদের নিকট দেয়া হতো সেগুলির মাধ্যমে আমরা দেশের অভ্যন্তরের খবরাখবর পেতাম, বা শেরাটনের বোমা হামলার ঘটনা, রুমি, বদি, আলম, বাদল, চুন্নু সামাদ, আলভী গংদের বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে ঘটনা সবকিছুই আমরা নিয়মিত ঐ হাসপাতালে বসে পেতাম, বা আলশামস, রাজাকার এই বাহিনী সমূহের নেতা হিসেবে গোলাম আযম স্বাধীনতার পক্ষের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এক প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমন এর বিরোধী পক্ষের প্রতীক ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম, বা চার্চের মধ্যেও ঢুকেও তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, মন্দির গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে তাদেরকে এই অত্যাচারিত ও ধর্মান্তরিত হতে হয়েছে, বা শুধুমাত্র হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান দেরকেই একই উদ্দেশ্যে আক্রমন করা হয়েছে তা নয়, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং স্বাধীনতার পক্ষের প্রত্যেকটি মানুষের চেতনাকে আঘাত করে তাদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে, তবে বিশেষভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের চিহ্নিত করে ধর্মীয় কারণে তাদের উপর হত্যা লুন্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণ সহ বিভিন্ন অপরাধ করা হয়েছে, বা কালি মন্দির আক্রমন, শাখারী বাজার, রায়ের বাজার, হাটখোলা ওয়ারী যে সমস্ত জায়গা হিন্দু অধ্যূষিত বলে পরিচিত কারপিউ দিয়ে অগ্নিসংযোগ করা আবার একই সাথে রাজারবাগে অগনিত পুলিশ বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, একই রকমভাবে পিলখানায় রাইফেলসের সদস্যদের উপর আক্রমন করা একটি ঘৃন্য গণহত্যার উদাহরন স্থাপন করে, বা বরিশালের একটি উদাহরন দেই বাজারে সমবেত জনগোষ্ঠির উপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ করা হয়। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ দৌড়ে নদীতে ঝাপ দিতে গেছে তখন লঞ্চ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদেরকে বিপরীত দিতে থেকে গুলি করেছে। এই ধরনের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এরকম ঘটনা দেশের সর্বত্রই হয়েছিল। এই ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার কৌশল এবং সেই কৌশলকে সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে তারাও এই অপরাধের সমান ভাগিদার, বা সহযোগিতার মাস্টার মাইন্ড, বা ১৯৭১ সালের ২৩শে আগষ্ট এবং ৩১শে আগষ্ট তারিখে গোলাম আযম পাকিস্তানের লাহোর এবং হায়দারাবাদে নিজে উপস্থিত থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এইসব কর্মকান্ডকে সমর্থন দিয়েছেন এবং মক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন এবং মুক্তিবাহিনীকে নির্মূল করার আহ্বান জানিয়েছেন। লক্ষ্য করা যেতে পারে সেপ্টেম্বর মাসে যখন তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নতুন মন্ত্রী সভা গঠন করা হয় সেখানে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদেরকে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এখানে একটা প্রশ্ন পরিস্কার করা প্রয়োজন যে, শান্তি কমিটি কখনও সশস্ত্র কোন অভিযানে অংশ গ্রহন করেছে কিনা। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তারা কখনও কখনও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে তারা সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিয়েছে। রাজাকারদের কাছে অস্ত্র ছিল সেটা সকলেরই জানা আছে। আমরা আরও লক্ষ্য করি ১৯৭১ সালের ১লা ডিসেম্বর যখন মুক্তিযুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে তখনও গোলাম আযম ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাত করে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন যে, মক্তিবাহিনীকে পরাভূত করে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং তিনি দম্ভভরে একথাও বলেন যে, সে ব্যাপারে রাজাকাররাই যথেষ্ট, বা যে উপায়ে এবং যে নির্যাতন ও অত্যাচার করে এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় নাৎসী আমলেরও অনেক হত্যাকান্ড তা দেখে লজ্জিত হবে। আমরা জানি রাজাকার, শান্তি কমিটি ও আলবদর ও আলশামস এই সমস্ত বাহিনীল দার্শনিক এবং কৌশলগত পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন গোলাম আযম। এই কথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই। আমার জবানবন্দীতে উল্লেখিত বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের অত্যাচারের ব্যপারে আমি যা বলেছি তা আমি তদন্তাকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে। রাজশাহীর উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা মামুন মাহমুদকে আমি চিনি, তিনি বাঙ্গালী ছিলেন, তিনি আমাদের অতিপরিচিত বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন। আমি আমার আত্মজীবনী মূলক একটি বই লিখেছি তার নাম “আত্ম কথা নিলীমার নীচে”। আমি রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা হয়েছিলাম। এই উপদেষ্টা নিয়োগ পাওয়ার আগে বেবী মওদুদ, আসাদুজ্জামান নূর, সাবের হোসেন চৌধুরী এবং মোনায়েম সরকার আমাকে টেলিফোন করে বলেছিলেন তোমার নাম নেত্রী শেখ হাসিনা উপদেষ্টা হিসাবে ১৪ দলের পক্ষ থেকে পাঠিয়েছে, যদি সিলেক্ট করে তবে তুমি না করোনা। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান এম,পি সাবের হোসেন চৌধুরী জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এটা আমাদের অফিসিয়াল যোগাযোগ। আমি আমার জবানবন্দীতে অধ্যাপক গোলাম আযমকে স্বাধীনতা বিরোধীতার প্রতীক, গণহত্যা সমর্থনের ও সহযোগিতায় মাস্টার মাইন্ড, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের দার্শনিক এবং কৌশলগত পরিকল্পনাকারী সহ তার বিরুদ্ধে জবানবন্দীতে এবং জেরার উত্তরে যে সমস্ত অভিযোগ এনেছি তাহা সম্পূর্ণ অসত্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত, ইহা সত্য নহে। আমি তার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছি ইহা সত্য নহে। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব পাকিস্তানের অখন্ডতা বিশ্বাসী হলেও তার ভূমিকা শুধুমাত্র রাজনৈতিক, ইহা সত্য নহে। (সমাপ্ত)
আমার নাম এ্যাডভোটেক সুলতানা কামাল। আমার বয়স আনুমানিক ৬৩ বৎসর। আমি আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ১৮৩৮। আমি সর্বেেত্র ঢাকাতে পড়াশুনা করেছি। আমি সর্বপ্রথম ঢাকায় অবস্থিত নারী শিা মন্দির স্কুলে পড়াশুনা করি। আমি এস,এস,সি পাশ করেছি আজিমপুর গালর্স হাইস্কুল থেকে ১৯৬৫ সালে। হলিক্রস কলেজ থেকে এইচ,এস,সি, পাশ করেছি ১৯৬৭ সালে। ১৯৬৭ সালেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হই। আমি ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে অনার্স পাশ করি এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭১ সালের পরীা ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত এম,এ, পাশ করি। মুক্তিযুদ্ধের কারণে ঐ পরীা বিলম্বিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ ধানমন্ডি ল কলেজ থেকে ১৯৭৮ সারৈ আমি এল এল বি পাশ করি। ১৯৮৪ সালে আমি বার কাউন্সিল থেকে সনদ নেই। ১৯৭১ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ঘটনা যদি বলতে হয় তাহলে আমাকে পারিবারিক পরিস্থিতির কথা একটু উল্লেখ করতে হয় যে, এটা হয়তো সবারই জানা যে আমার মা সুফিয়া কামাল সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। তার ফলে ১৯৭০ সালে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল মতা হস্তান্তরের বিষয়ে সে সকল বিষয় আমরা খুব কাছে থেকে আগ্রহের সাথে ল্য করে যাচ্ছিলাম। আমার মা ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম পরিষদ বলে একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যারা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছিল মূল ধারার রাজনীতির আন্দোলনের সাথে। তার ফলে নির্বাচনের ফলাফল, সংসদ বসা না বসা ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের অত্যন্ত গভীর একটি আগ্রহ ছিল এবং মার্চ মাসে যখন থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে আমরা সাংগঠিনকভাবে অংশগ্রহন করছিলাম এবং সেই সময়ে যে সমস্ত সভা, সমিতি ও সমাবেশ হচ্ছিল তাতে অংশ গ্রহন করেছি সক্রিয়ভাবে। ৭ মার্চে তদানিন্তন রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায়ও উপস্থিত থেকে অংশগ্রহণ করেছি এবং “আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এই বাণীতে উজ্জিবীত হয়েছিলাম। এর পরই বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল যেখানে একদিকে ইয়াহিয়া খান গোলটেবিল বৈঠক ডেকে মতা হস্তান্তরের আলোচনার ভান চালিয়ে যাচ্ছিলেন, অন্যদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক কর্মী কিংবা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উজ্জিবীত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর নানা রকম হামলাও চালানো হচ্ছিল। এভাবেই চলছিল অনিশ্চিতের মধ্য দিয়ে এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত্রি ১২:০০টার দিকে আমার ভগ্নিপতি চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোনে আমাদের নিকট জানতে চান যে, ঢাকার অবস্থা কেমন এবং শুধু এটুকুই বলতে পারেন যে, অবস্থা ভাল নয়, একথা বলার পর পরই টেলিফোনের লাইন কেটে যায়। একই সঙ্গে আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমার মা বাবার বাড়ি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে সেই সময় ৪/৫টি বাড়ির ব্যবধানে ছিল এবং মেশিনগান এবং কামানের গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই এবং সেই সময় পিলখানা থেকেও আমরা পাল্টাপাল্টি গুলির শব্দ শুনতে পাই। একদিক থেকে রাইফেলের গুলি শব্দ এবং অন্য প্রাপ্ত থেকে কামানের গোলার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাই। আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যেও একটি ভীতির সঞ্চার হয়। আমার মা এবং বাবাকে যেহেতু স্থানীয়রা মুরুব্বী শ্রেণীর মনে করতেন সেহেতু তারা ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকেন কি হয়েছে। আমাদের পাশের দোতলা বাড়ির একজন জানালেরন যে, তাদের বাড়ির ছাদ থেকে কোনাকোনিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আগুনের হলকা দেখা যাচ্ছে এবং আমাদের বাড়ির সামনে একটি নির্মানাধীন বাড়ির ছাদে একটি কালো পাতাক উড়ছিল এবং সেই বাড়ির দারোয়ানকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। আমাদের বাড়ির সামনে পানির লেকের উপর একটি ব্রীজ আছে এবং ঐ ব্রীজের উপর দিয়ে মানুষের দৌড়াদৌড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছিল এবং ঐ ব্রীজের উপর একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। পরে জানতে যে, স্থানীয়ভাবে বিখ্যাত পানাউল্লা সাহেবের ছেলে সম্ভবত তার নাম খোকনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর আমরা এলোপাতাড়ি গুলির শব্দ শুনতে পাই যা রাতভর চলছিল। পিলখানার গোলাগুলির শব্দ স্পষ্ট মনে আছে ২৭ মার্চ ভোর পর্যন্ত চলছিল। ইতোমধ্যে প্রচার করা হয় যে, কারফিউ দেওয়া হয়েছে ঘর থেকে কেউ বের হবে না। ২৭ মার্চ কিছু সময়ের জন্য কারফিউশিথিল করা হয়। আমরা তখন রাস্তায় বের হয়ে জানার চেষ্টা করি যে, কি হলো। আমাদের বাড়িতে তখন কিছু লোকের সমাগম হতে শুরু করে, যাদের মধ্যে সাংবাদিক এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীরাও ছিলেন। তারা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সাংঘাতিক হত্যাকান্ড সংঘঠিত হয়েছে। প্রফেসর মনিরুজ্জামান, ডঃ জি,সি,দেব নিহত হয়েছেন, ডঃ জ্যেতির্ময় গুহ ঠাকুরতাকে গুলি করা হয়েছে, উনি আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন এবং অন্যান্য অনেক শিক পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ তাদেরকে হত্যা করার জন্য খোঁজা হচ্ছিল। জগন্নাথ হলে দফায় দফায় ছাত্রদেরকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ইকবাল হয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। মধুর ক্যান্টিনের মধুদার পরিবারের উপর আক্রমন করা হয়েছে, ঐ পরিবারের একাধিক সদস্য নিহত হয়েছেন। রোকেয়া হলের ধোপা বাসুদেব, তাকে ও তার পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছে। রোকেয়া হলেও সেনাবাহিনী প্রবেশ করেছিল। হাটখোলা অঞ্চল থেকে প্রয়াত সাংবাদিক সাহাদাৎ চৌধুরী জানান যে, ইত্তেফাক অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অফিসের সামনে এলোপাতাড়ি গোলাগুলিতে অনেক লোককে হত্যা করা হয়েছে। আমার একটি ছবি অনেক সময় দেখি যে, রিক্সার উপর রিক্সাওয়ালা এবং এক যাত্রী একত্রে নিহত হয়ে পড়ে আছে। সাংবাদিক শহিদুল্লাহ কায়ছার সংবাদ পাঠালেন যে, সংবাদ অফিসেও আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তার ভিতরে লেখক সাংবাদিক শহীদ সাদবের জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এরকম বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসতে থাকে যে, আগুন লাগানো হয়েছে, হত্যাকান্ড হয়েছে এবং মানুষ যত্রতত্র লাশ হয়ে পড়ে আছে। নারায়ণগঞ্জে আমাদের আত্মীয় সাত্তার জুটমিলসের ছিলেন তারাও জানালেন যে, সেখানেও হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে এবং একটি বাড়িতে ঘরের ভিতর ঢুকে মশারীর ভিতর শায়িত মা ও শিশুকে একই সংগে হত্যা করা হয়েছে এবং আস্তে আস্তে আমরা জানতে পারলাম যে, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, রাজশাহী সর্বত্রই একই ধরনের হত্যাকান্ড চলছে এবং পুলিশের তৎকালীন বড় কর্মকর্তা মামুণ মাহমুদ রাজশাহীতে ছিলেন তাকেও হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় কর্মরত বাঙ্গালী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণকে হত্যা করা হয়েছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় আমরা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে যে লেক আছে সেই লেকের পাড়ে এবং তার ঠিক কাছেই সেই সময়ে ধানমন্ডি গালর্স হাইস্কুল ছিল তার সামনে তখন কোন বাড়ি ছিল না, সেই গালর্স স্কুলের ছাদে মেশিনগান ফিট করা হচ্ছিল এবং লেকের পাড়েও মেশিনগান নিয়ে পাকিস্তান হানাদার সেনাবাহিনী অবস্থান নিচ্ছিল। অর্থাৎ ২৫ মার্চের সন্ধ্যা থেকেই তাদের এই আক্রমণের প্রস্তুতি চলছিল। ২৭ মার্চ সকাল বেলায় যখন আমরা রাস্তা পার হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তা দিয়ে হেটে যাই আমি নিজে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে পাকিমস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে মালামাল নিয়ে ট্রাকে তুলছিল। কারফিউ যখন আবার দেওয়া হয় তখন আমরা ঘরে ফিরে আসি এবং বিবিসি এবং অন্যান্য রেডিও থেকে আরও শুনতে পাই যে, তদনিন্তন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশে অপারেশন সার্চ লাইট নামে একটি হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে যা গণহত্যার সামিল এবং ল ল লোক নিজেদের বাড়ি ঘর ছেরে এখান থেকে সেখানে, এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এবং সিমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছিল। সেখানে ৮০ বৎসরের বৃদ্ধ বৃদ্ধা থেকে শুরু করে নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে মা পর্যন্ত দৌড়াচ্ছে। অর্থাৎ কিশোর, তরুণ, বৃদ্ধ, যুবক, সবল কিংবা অসমর্থ মানুষ চরম অনিরাপত্তাবোধ নিয়ে প্রাণ ভয়ে শুধুমাত্র প্রাণটুকু রা করার জন্য এদিক সেদিক ছুটে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছিল। আমাদের মতে এটা একটা চরম মানবতার অবমাননা এবং মানবাধিকারের নিকৃষ্টতম লংঘন। ইতোমধ্যে এই খবরটিও পাই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে ২৬ মার্চ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সেই খবরও পাচ্ছিলাম। আমাদের কিছু বন্ধু বান্ধব যারা বিভিন্ন আন্দোলনের সংগে যুক্ত ছিলেন তারা মুক্তিবাহিনী গঠন হওয়ার খবরও নিয়ে আসছিল এবং তারা সেই বাহিনীতে ক্রমশঃ যোগ দিচ্ছিলেন এবং আমাদের সংগে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন এবং সেভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগ হয়েছিল। আমার মাকে কেন্দ্র করেই আমাদের পরিবারে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল এবং আমরা দুই বোন সক্রিয়ভাবে উক্ত কার্যে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। এভাবেই তখন আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগে জড়িত নানাভাবে তথ্য আদান প্রদান, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগ সৃষ্টি করা এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অন্যদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা চলছিলই এবং হঠাৎ করে এপ্রিল মাস থেকে আমরা জানতে পারলাম যে তখনকার কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সংগে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। তখনকার পত্র পত্রিকায় সেই খবরগুলি অত্যন্ত ফলাও করে ছাপা হতো। কাজেই সেই ঘটনা শুলির সাথে কারা কারা যুক্ত ছিলেন তাদের নামও আমরা জানতে পারি এবং ঘুরে ফিরেই জামায়াতে ইসলামী, পি,ডি,পি, মুসলিম লীগ এই দলগুলির নাম উঠে আসতো এবং একটি নাম খুব বেশী করেই আমাদের চোখে পড়তো সেই নামটি হলো গোলাম আযম, যিনি টিক্কা খান এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে প্রায়ই মিলিত হতেন এবং কিভাবে পাকিস্তানের অখন্ডতা রা করা যায় সেই নিয়ে আলোচনা করতেন এবং বক্তৃতা ও বিবৃতি দিতেন। দুটো বিষয় খুব স্পষ্টভাবে উঠে আসতো যে, পাকিস্তান অর্থই হচ্ছে ইসলাম এবং পাকিস্তানের বিরোধীতা করা মানেই হচ্ছে ইসলামের বিরোধীতা করা। অর্থাৎ ইসলামকে বাঁচাতে হলে পাকিস্তানকে রা করতে হবে এবং তাদের ভাষায় মুক্তিযোদ্ধারাই দুস্কৃতিকারী তাদেরকে নির্মূল করতে হবে এবং এজন্য দেশবাসীকে উজ্জিবীত করতে হবে এবং সে দায়িত্ব তারা নিতে চান। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পেলাম যে, তারা প্রথমে শান্তি কমিটি নামে কিছু সাংগঠনিক তৎপরতা চালায় এবং জনসাধারণকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে চাপ সৃষ্টি করে যোগ দিতে বাধ্য করতে থাকে। এরপর আমরা দেখা পাই যে, তারা মে মাসে রাজাকার বাহিনী নামে একটি বাহিনী তৈরী করে। যতদূর মনে পড়ে রাজাকার বাহিনী জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে খুলনায় প্রথম সূচনা হয়েছিল। আমরা এও জানতে পারি যে, তারা কিছু গোপন কিলার ফোর্স তৈরী করার উদ্যোগ নিয়েছে এবং আলবদর, আলসামস নামে দুটি বাহিনী ঐ উদ্দেশ্যে গঠন করা হয় এবং তারা খুব গোপনে এ কাজগুলি করবে মর্মে জেনেছিলাম। আমরা জানতে পাই যে, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র এবং তরুণ কর্মীদেরকে নিয়ে এই বাহিনী তৈরী করা হয়েছিল। সর্বেেত্রই এসব কর্মকান্ডের সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে গোলাম আযমের নামই বার বার উল্লেখিত হয়েছে। প্রায়সই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উচ্চতম পর্যায় থেকে টিক্কা কান সহ গোলাম আযমের নাম ধরেই প্রসংশা করেছেন যে, পাকিস্তানের অখন্ডতা রার জন্যই তিনি এক কাজ করছেন। সেই সময়ে গোলাম আযম পাকিস্তান পর্যন্ত সফর করেন এবং সেখানে গিয়েও মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলেন এবং বার বার একথা বলেন যে, তিনিই পাকিস্তানের অখন্ডতা রা করার জন্য যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত। জুন মাসে আমার ছোট বোন সাইদা কামাল যার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ১৮৩৫ এবং আমি সীমান্ত পার হয়ে ভারতের আগরতলায় যেতে বাধ্য হই। জুন মাসে একটি ঘটনার পরিপ্রেেিত আমার সেই ছোট বোন এবং আমি সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের বাড়ির ঠিক সামনে স্কোয়ার্ড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান সাহেব থাকতেন। তিনি খবর পাচ্ছিলেন যে, বিমান বাহিনীতে যে বাঙ্গালী কর্মকর্তারা রয়েছেন তাদেরকে যখন ডাকা হয় তারপর তারা আর ফিরে আসেন না। এরকম একটা সময় যখন হামিদুল্লাহ খান সাহেবকে হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট করতে বলা হলো এবং নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, রায়ের বাজারের কাছে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় একটি অপারেশনে তাকে যেতে হবে। তখন তিনি আমার মায়ের নিকট এসে সাহায্য চান কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে তিনি বাঁচতে পারেন। তখন আমরা তাকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে সাহায্য করি। দুঃখজনকভাবে তার বাড়ির কাজের যে ছেলেটি ছিল তাকে পাক বাহিনী পরদিন ধরে নিয়ে যায়। আমরা হামিদুল্লাহ খান সাহেবের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করি। তখন একটা শংকা দেখা দিল যে কাজের ছেলেটি যদি জিজ্ঞাসাবাদের চাপে আমাদের পরিবারের সংগে হামিদুল্লাহ খান সাহেবদের যে যোগাযোগ হচ্ছিল সে খবর যদি বলে দেয় তাহলে আমাদের সংগে মুক্তিবাহিনীর যে যোগাযোগ আছে তাও প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। তখন আমাদেরকে পরামর্শ দেয়া হলো যেন আমরা দুই বোন অন্ততঃ সীমান্ত পার হয়ে যাই। তারপরে আমরা ১৬ জুন ঢাকা থেকে স্থল পথে রওনা হয়ে নদী পার হয়ে কুমিল্লার চান্দিনা থেকে রিক্সা করে আগরতলার সোনামুড়ায় পৌঁছাই। সোনামুড়া অঞ্চলে আমাদের পূর্ব পরিচিত একজন ডাক্তার যিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন তিনি সোনামুড়া ফরেস্ট বাংলাতে একটি ছোট চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছিলেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করার জন্য তিনি এবং তার স্ত্রী সেখানে ছিলেন এবং তারা দুজনই আমাদের বন্ধু ছিলেন। আমরা তাদের সংগে দেখা করি এবং আমরা দুই বোন তাদের সংগে কাজ করতে যোগ দেই। সেই চিকিৎসা কেন্দ্রটি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল। সেই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব। তার সংগে আমরা দেখা করলাম। তিনি আমাদের অনুমতি দিলেন সেখানে কাজকরার জন্য এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নিবন্ধিত হলাম। সেখানে থাকতে থাকতে একটা বড় হাসপাতালের পরিকল্পনা নেয়া হলো সেটা বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল নামে পরিচিতি হয়েছিল। আগরতলা থেকে ৬০ মাইল ভিতরে বিশ্রামগঞ্জ নামক স্থানে আমরা হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করি। সেখানে আমাদের সংগে এই কর্মকান্ডে জড়িত হন ডাঃ জাফরউল্লা চৌধুরী, ডাঃ মোবিন, ডাঃ কামরুজ্জামান প্রমুখ যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অত্যন্ত সম্মানিত এবং সুপরিচিত। পরে ডাঃ ক্যাপ্টেন সিতারা এসে আমাদের সংগে অক্টোবর মাসে যোগ দেন যিনি পরবর্তীতে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত হন। আমাদেরকে এ ব্যাপারে প্রথমে যিনি সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি ক্যাপ্টেন আখতার আহম্মেদ তিনিও পরবর্তী সময়ে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত হন। আমরা সেখানে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ থেকে আরও কয়েকজন মেয়ে যারা বাংলাদেশের ভিতরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে কাজ করছিল এবং যোগাযোগ রাখছিল তারাও সেখানে এস হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজে যোগ দেন। যাদের মধ্যে প্রফেসর জাকিয়া খাতুন, আসমা, রেশমা, মিনু, অনুপমা, পদ্মা, নিলিমা, ডাঃ ডালিয়া শামছুদ্দিন উল্লেখযোগ্য। আমরা সবাই একত্রে সেই হাসপাতালে কাজ করেছি। আমরা নানাভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের খবরাখবর পেতাম। বিভিন্ন বেতা, বিশেষ করে বিবিসি, আকাশ বাণী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং আমেরিকা প্রবাসী ভাইয়ের নিকট আমরা মায়ের দেয়া কোড ল্যংগুয়েজের চিঠি সমূহ যাহা ভাইয়ের মাধ্যমে আমাদের নিকট দেয়া হতো সেগুলির মাধ্যমে আমরা দেশের অভ্যন্তরের খবরাখবর পেতাম। তদুপরি মুক্তিযোদ্ধারা যখন গেরিলা যুদ্ধ করার জন্য দেশের অভ্যন্তরে যেত তারা ফিরে আসলে তাদের মাধ্যমেও খবরাখবর পেতাম। ২ নম্বর সেক্টরের যে সব মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করতো তাদের মাধ্যমে আমরা সেই সব অপারেশনের খবর এবং যারা দেশের অভ্যন্তরে এই স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতা করতো অর্থাৎ শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলসামস তাদের কার্যাবলীর খবরাখবরও আমরা পেতাম। শেরাটনের বোমা হামলার ঘটনা, রুমি, বদি, আলম, বাদল, চুন্নু, সামাদ, আলভী গং দের বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনের ঘটনা সবকিছুই আমরা নিয়মিত ঐ হাসপাতালে বসে পেতাম। আমরা খবর পেতাম যে, রাজাকার, আলবদর, আলসামস, শান্তি কমিটির লোকজন পাকিন্তান হানাদার বাহিনীদেরকে দেশের অভ্যন্তরের সমস্ত খবরাখবর প্রদান করতো বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপরে পরিবারবর্গের সব খবরাখবর, তাদের বাসস্থান, তাদের কার্যাবলী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নিকট প্রদান করতো। আমরা আরও খবর পাই যে, তারা বিভিন্ন বয়সের নারীদের ধরে নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে এবং বাংকারে প্রদান করতো। যার ফলে ক্রমাগত যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়ে তাদের অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন এবং অনেকেই নির্যাতনের কারণে সেই ক্যাম্প কিংবা বাংকারে নিহত হয়েছেন। রাজাকার, আলবদর, আলসামস বাহিনীর নেতা হিসাবে অনেকের নামের সংগে প্রায় সমসময়ই আমরা গোলাম আযমের নাম শুনতাম। তার সংগে আমরা আরও অনেক নাম শুনছি। যেমন, মতিউর রহমান নিজামী, আলি আহসান মোঃ মুজাহিদ, আব্বাস আলী খান গং দের নাম প্রায়শঃ শুনতাম তবে তাদের মধ্যে সর্বদাই জামায়াতের নেতা হিসেবে গোলাম আযমের নাম উচ্চারিত হতো। আলবদর, আলসামস, রাজাকার এই বাহিনী সমূহের নেতা হিসাবে গোলাম আযম স্বাধীনতার পক্ষের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এক প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমন এর বিরোধী পক্ষের প্রতীক ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। সেই সময়ে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এদের অবস্থা সম্পর্কে আমরা জেনেছি যে, প্রাণ রক্ষার্থে তাদেরকে দেশের ভিতরে একস্থান থেকে অন্যস্থানে পালাতে হয়েছে, ভারতে আশ্র নিতে হয়েছে এবং আমরা আরও অনেক ঘটনা শুনেছি যে, তাদেরকে সমস্ত সম্পত্তি ফেলে শুধুমাত্র নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। চার্চের মধ্যে ঢুকেও তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, মন্দির গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে তাদেরকে এই অত্যাচারিত ও ধর্মান্তিরিত হতে হয়েছে। (চলবে)
১১-০৬-২০১২ ইং পুনরায় জবানবন্দী শুরুঃ
শুধুমাত্র হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদেরকেই একই উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়েছে তা নয়, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং স্বাধীনতার পক্ষের প্রত্যেকটি মানুষের চেতনাকে আঘাত করে তাদের উপরে নির্যাতন করা হয়েছে, তবে বিশেষভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদেরকে চিহ্নিত করে ধর্মীয় কারণে তাদের উপরে হত্যা, লুন্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ করা হয়েছে। ২৫ শে মার্চের অপারেশন সার্চ সাইট পৃথিবীর অন্যতম একটি নিকৃষ্টতম গণহত্যা বলে চিহ্নিত এই কারণে যে, একটি গণতন্ত্রকামী জনগোষ্ঠীর ওপর যারা মূলত নিরস্ত্র ছিল তাদের ওপরে সশস্ত্র হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে। এখানে উল্লেখ করতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপরে হত্যাকান্ড, ইকবাল হল পুড়িয়ে দেওয়া, জগন্নাথ হলের ছাত্র হত্যা, রোকেয়া হলের অভ্যন্তরে হত্যাকান্ড, কালি মন্দির আক্রমণ, শাখারী বাজার, রায়েরবাজার, হাটখোলা ওয়ারী যে সমস্ত জায়গা হিন্দু অধ্যুষিত বলে পরিচিত কারফিউ দিয়ে অগ্নিসংযোগ কর আবার একই সাথে রাজারবাগে অগণিত পুলিশ বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, একই রকমভাবে পিলখানায় রাইফেলসের সদস্যদের উপর আক্রমণ করা একটি ঘৃণ্য গণহত্যার উদাহরণ স্থাপন করে। একইভাবে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ২৫ শে মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ধরনের গণহত্যা চলতে থাকে। বরিশালের একটি উদাহরণ দেই বাজারে সমবেত জনগোষ্ঠীর ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ করা হয়। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ যখন দৌড়ে নদীতে ঝাপ দিতে গেছে তখন লঞ্চ থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদেরকে বিপরীত দিক থেকে গুলি করেছে। এই ধরনের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এরকম ঘটনা দেশের সর্বত্রই হয়েছিল। এই ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করার কৌশল এবং সেই কৌশলকে সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা যারা দিয়েছে তারাও এই অপরাধের সমান ভাগিদার এবং আমরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে, বেতারের মাধ্যমে যা সেই সময়কার তথ্য সরবরাহের মূল মাধ্যম ছিল জানতে পারি এই সমর্থনের এবং সহযোগিতার মাষ্টার মাইন্ড ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা এবং শান্তি কমিটিরও অন্যতম শীর্ষ নেতা গোলাম আযম। আমরা এও জেনেছি যে, ১৯৭১ সালের ২৩ শে আগষ্ট এবং ৩১ আগষ্ট তারিখে গোলাম আযম পাকিস্তানের লাহোর এবং হায়দারাবাদে নিজে উপস্থিত থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এই সব কর্মকান্ডকে সমর্থন দিয়েছেন এবং মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন এবং মুক্তিবাহিনীকে নির্মূল করার আহবান জানিয়েছেন। লক্ষ্য করা যেতে পারে সেপ্টেম্বর মাসে যখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয় সেখানে জামায়াতে ইসলামীর সম্ভবত দুইজন সদস্যকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তাদের উদ্দেশ্য করে সংবর্ধনা দিতে গিয়ে গোলাম আযম বলেন ঠিক সে লক্ষ্যে শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছে একই লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদেরকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এখানে একটা প্রশ্ন পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে, শান্তি কমিটি কখনও সশস্ত্র কোন অভিযানে অংশ গ্রহণ করেছে কিনা? আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তারা কখনও কখনও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিয়েছে। রাজাকারদের কাছে অস্ত্র ছিল সেটা সকলেরই জানা আছে। আমরা আরও লক্ষ্য করি ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর যখন মুক্তিযুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে তখনও গোলাম আযম ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাত করে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন যে, মুক্তিবাহিনীকে পরাভূত করে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং তিনি দম্ভ করে একথাও বলেন যে, সে ব্যাপারে রাজাকাররাই যথেষ্ট।
লক্ষনীয় যে, একটি ব্যক্তি গণহত্যা পরিচালনাকারী সরকারের কতখানি কাছের লোক এবং আস্থাভাজন হলে ঐ সময়ে তাদের নেতার সাক্ষাত পান এবং তাদের পক্ষে কথা বলেন এবং আমরা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর একটি মরিয়া এবং নৃশংস আচরণ প্রত্যক্ষ করি ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এর বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের ভিতরে। যে উপায়ে এবং যে নির্যাতন ও অত্যাচার করে এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় নাৎসী আমলেরও অনেক হত্যাকান্ড তা দেখে লজ্জিত হবে। আমরা জানি রাকাজার, শান্তি কমিটি এবং আলবদর ও আলশামস এই সমস্ত বাহিনীর দার্শনিক এবং কৌশলগত পরিচালনায় নেতৃত্বে দিয়েছেন গোলাম আযম। ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর তারিখে আমরা ফিল্ড হাসপাতাল থেকে কলিকাতায় চলে যাই। তৎপর ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারী তারিখে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসি। ১৬ ডিসেম্বরে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর আমরা কলিকাতায় বসেই পাই। তখন যাতায়াতের ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আমরা ট্রেনে বেনাপোল পর্যন্ত এসে তারপর বিভিন্নভাবে ঢাকায় প্রবেশ করি, কখনও রিক্সায়, কখনও নৌকায়, কখনও বাসে। কারণ যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত ছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসি যেখানে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী, তাদের পরিবারের কেউ না ক্ েনিহত হয়েছেন, কোন কোন পরিবারের একাধিক সদস্য নিহত হয়েছেন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদেরকে হারিয়েছি, সহপাঠিদের হারিয়েছি, মুক্তিযুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছিল সেই বন্ধুদেরকে হারিয়েছি, এক একটি পরিবার তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি নিহত হওয়াতে দুরবস্থায় পতিত হয়েছে, নারীদের অবস্থা ততোধিক বিপন্ন কারণ তারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা সবাই জানি দুই লক্ষ নারী মুক্তিযুদ্ধকালীন সমেয় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, আরও দুই লক্ষ নারী নানাভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন এবং পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষ অভিভাবক হারা হয়ে অসহায় অবস্থায় নিপতিত হয়েছেন। তারা অনেকেই আমার মা সুফিয়া কামালের কাছে তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা বলতে আসেন এবং বাঁচার একটি উপায় খুঁজে দিতে এবং সাহায্য করার জন্য অনুরোধ জানায়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে আমার মা সুফিয়া কামাল তার অন্যান্য সহকর্মীদেরকে নিয়ে নারীদের পুনর্বাসনের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে শুরু করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ব্রাক নামে পরিচিত যে বেসরকারী সংস্থাটি আছে তার প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন আমার মা। ব্রাক এবং নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এ সমস্ত সংগঠনের মাধ্যমে তিনি তার সহকর্মীদের নিয়ে নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন এবং এর জনগণের পুনর্বাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। আমরা পরিবারের লোকেরাও ঐ কাজে যুক্ত হয়ে যাই। সেই কারণে নারী পুনর্বাসনের কাজে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাই। একই সংগে মানবাধিকার লংঘন এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এই ইস্যুগুলি নিয়ে কাজ করতে শুরু করি। এর ধারাবাহিকতায় মানবাধিকারের কাজের সাথে যুক্ত হই এবং আইন অধ্যয়ন করতে শুরু করি যা শেষ করি ১৯৭৮ সালে। নারী পুনর্বসান কেন্দ্রে মূলত যে কাজ করা হতো সেটা হলো যারা সাহায্য প্রার্থী হয়ে আসতেন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কারণ তাদের মধ্যে অধিকাংশই অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন। তাদের নিরাপদে থাকা এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক প্রয়োজন মেটানো, তারা যাতে করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সমাজে পুনর্বাসিত হতে পারেন সেজন্য তাদের জন্য নানান সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া এবং যারা পরিবারে ফিরে যেতে চেয়েছেন তারা যেন স্বসম্মানে পরিবারে ফিরে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা। আমি একটি বিশেষ দায়িত্বের কাণে ১৯ জন অত্যাচারিত নারীর সাক্ষাতকার নিয়েছিলামন যারা সবাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছিলেন এবং তাদের অনেককেই স্থানীয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোষরেরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে হস্তান্তরিত করেছিল। এরা মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্থ অবস্থায় ছিলেন এবং তাদের মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা দেখার জন্য বিশেষ করে এই সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়েছিল। নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে একজন বিদেশী ডাক্তার ছিলেন যার নাম ডাক্তার ডেবিস। তাছাড়াও দেশীয় নারী, পুরুষ স্বেচ্ছাসেবী ডাক্তাররাও ছিলেন। সার্বক্ষণিকভাবে আমার মা সুফিয়া কামাল, রাজনীতিবিদ বদরুন্নেছা আহমেদ, সমাজসেবী ছায়রা আহম্মেদ, মালেকা খান, আফিফা হক প্রমুখ এই পুনর্বাসন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। ঐ পুনর্বাসন কেন্দ্রটি ঢাকার ইস্কাটনে অবস্থিত ছিল। পুনর্বাসন কেন্দ্রে যে সমস্ত যুদ্ধ শিশু ছিল তাদের মায়েদেরকে একটা সুযোগ দেয়া হয়েছিল যে, তারা রাজি থাকলে ঐ শিশুদেরকে দত্তক দেয়া যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সংগে সম্পৃক্ততার কারণে এবং তার পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ যোগ থাকার কারণে একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে মানবাধিকার, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবতার মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং সেই অবস্থান থেকেই একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমি ট্রাইবুনালের কাছে এই প্রত্যাশা রাখি যে, পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম একটি গণহত্যার সংগে যারা জড়িত নীতিগতভাবে সমর্থন দিয়ে, সহযোগিতা দিয়ে এই গণহত্যাকে সমর্থন যুগিয়েছে এবং মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে ৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণ হানি ঘটিয়েছে, সাড়ে সাত কোটি জনগণের কিছু সংখ্যক ব্যক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল তারা ব্যতীত অন্য মানুষের মধ্যে এক কোটি লোককে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে, দেশের অভ্যন্তরে যারা ছিল তাদেরকে অনবরত ভীতিকর অবস্থায় নিজের বাড়ি, ঘর, গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয়ের জ্য ছোটাছুটি করতে বাধ্য করেছে, দুই লক্ষ নারীকে ধর্ষণের শিকার করেছে, আরও লক্ষ লক্ষ নারীকে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত করেছে এবং এই যুদ্ধের কারণে কোটি কোটি পরিবারকে বিপর্যস্থ করেছে, বিচারের মাধ্যমে এই মানবতাবিরোধী অপরাধীরা যথাযথ শাস্তি পাবে। আমি এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি। অধ্যাপক গোলাম আযম আজ ট্রাইবুনালে আসামীর কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন। এই আমার জবানবন্দী।
জেরা ঃ
আমি তদন্তকারী কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগমের নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি। তিনি অনেকবার আমার নিকট গিয়েছেন তবে যতদূর মনে পড়ে ২০১২ সালের, পরে বলেন ২০১১ সালের জুলাই মাসের ১১ তারিখে তার নিকট জবানবন্দী দেওয়া শেষ হয়েছে। তার নিকট একাধিকবার আমি জবানবন্দীর জন্য বসেছি। জবানবন্দী নেওয়ার জন্য তিনি আমার অফিসে এসছিলেন। আমি মনে করতে পারিনা যে, আমি কখনও তদন্ত সংস্থার অফিসে গিয়েছিলাম কিনা। যখন তদন্ত এবং প্রসিকিউশনের অফিস বই ট্রাইব্যুনালে ছিল তখন আমি ট্রাইব্যুনালের বিল্ডিংয়ে এসে রাজাকার অর্ডিন্যান্স তদন্ত সংস্থার কাছে দিয়েছিলাম।খুব সম্ভবত ২০১০ সালে দিয়েছিলাম, তবে তারিখ মনে নাই। তদন্ত সংস্থা বর্তমান অফিসটি কবে সেখানে স্থানন্তরিত হয়েছে তা আমার জানা নাই। আমি এই মামলায় কোন নালিশকালী ব্যক্তি নই। তদন্ত সংস্থার কমপ্লেইন রেজিস্টার ক্রমিক নং- ৫ তারিখ০১-০৮-২০১০ এর নালিশ কারীকে তা আমি জানি না। অধ্যাপক গোলাম বাংলাদেশের একজন পরিচিত ব্যক্তি। আসামী কাঠগড়ায় একজন ব্যক্তিই উপস্থিত আছেন।
রাজাকার বাহিনী গঠন তারিখ আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না তবে খুব সম্ভবত ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনায় জৈনিক ইউসুফের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছিল। আমাদের বাড়িতে ১৯৭১ সালে দৈনিক পূর্বদেশ, আজাদ পত্রিকা, মর্নিং নিউজ, দি পিপল পত্রিকা ইত্যাদি আসতো। দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠনের খবর পড়েছিলাম। উক্ত দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকাটি আমার সংরক্ষনে নাই, আমি উহা তদন্ত সংস্থায় জমা দিই নাই। আমার যতদূর মনে পড়ে ঐ খবরে ইউসুফ সাহেবের নাম ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ইউসুফ সাহেব খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠন করেছেন এই খবরটি প্রকাশিত হওয়ার কথা, তবে আমি অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় দেখেছি কিনা তা এ মুহুর্তে মনে করতে পারছি না। খুব সম্ভবত খবরটি সাপ্তাহিক বিচিত্রায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। আশির দশকে কোন এক সময়ে বিচিত্রায় এই খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ সময়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় নির্বাহী সম্পাদক ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির বর্তমান আহ্বায়ক জনাব শাহরিয়ার কবির। জনাব শাহরিয়ার কবীর সাহেব ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির আহ্বায়ক হওয়ার পূর্বে মস্তারি শফি ঐ কমিটির সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন তা আমি জানি। তবে আহ্বায়ক ছিলেন কিনা তা আমি জানি। রাজাকার বাহিনী গঠনের ব্যাপারে গেজেট বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আমি অবগত আছি যেটা আগষ্ট মাসে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে পাকিস্তান সামরিক সরকারের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অধিনস্থ করা হয় এটা আমি শুনেছি। রাজাকার বাহিনী সরকারের প্রতিষ্ঠিত একটি ডিরেক্টরেটরের মাধ্যমে পরিচালিত হতো এবং উহার প্রধান ছিলেন একজন ডিরেক্টর। রাজাকার বাহিনীর প্রথম ডিরেক্টর রহিম সাহেব পুলিশের ডিআইজি ছিলেন কিনা তা আমি জানিনা কেননা তখন আমি দেশে ছিলাম না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের আব্দুর রহিম নামে কোন সচিব ছিলেন কিনা তা আমার জানা নাই। রাজাকারদেরকে স্থানীয় এস.ডি.ও সাহেব নিয়োগ দিতেন কারন একটি গেজেটের মাধ্যমে যখন কোন সংগঠন কাজ করে তখন তাদের সরকারের নির্দেশনা বা কর্তৃত্ব মনে করতে হয়। রাজাকার বাহিনীর ট্রেনিং দিতেন সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্তৃক দেয়া হতো যখন তাদের কন্ট্রোলিং দায়িত্ব সরকারের উপর অর্পিত হয়।
প্রশ্ন ঃ আগষ্ট মাসের পূর্বে রাজাকারদের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে এরুপ কোন খবর সরকারী বিধিবদ্ধ বাহিনী হিসাবে আত্মপ্রকাশের পূর্বে ২রা আগষ্ট, ১৯৭১ এর পূর্বে রাজাকার বাহিনী কোন সশস্ত্র বাহিনী ছিলো কি?
উত্তর ঃ রাজাকারের মত বাহিনীর কার্যক্রমের জন্য তাদের নিকট অস্ত্র থাকা অপরিহার্য ছিল না কারন তারা বিভিন্নভাবে যেমন তথ্য সরবরাহ করা, বাড়ি চিনিয়ে দেওয়া, হুমকি দেওয়া, হয়রানী করা এসবের জন্য অস্ত্র প্রয়োজন হয় না।
আমি ১৯৭১ সালের জুন মাস পর্যন্ত আমি ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় ছিলাম। ঐ সময় ধানমন্ডি এলাকা লালবাগ থানার অধীনে ছিল। দেশ স্বাধীনের পর দেশে ফিরে ঢাকা জেলার রাজাকার এ্যাডজুটেন্ট কে ছিলেন সে খবর আমি নেই নাই। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ থেকে ৩রা জুন তারিখ পর্যন্ত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাস করতে যেতাম না। আমাদের বাড়িতে কখনও আর্মি, রাজাকার, আলবদর আসে নাই, তবে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আমার মায়ের উপর আলবদর কর্তৃক একটি হামলা করার পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল বলে আমি শুনেছি। আমার মা সুফিয়া কামাল দুইটি ডায়রী লিখতেন, একটি দৈনন্দিন অন্যটি কবিকা লেখা সংক্রান্ত। পরবর্তী আমার মায়ের দৈনন্দিন ডায়রীটি পরবর্তীকালে বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁর দৈনন্দিন ডায়রীতে ১৯৭১ সালের শেষের দিকে কোন এক জায়গায় তাকে আলবদর কর্তৃক হামলায় কথা উল্লেখ আছে। এই ষড়যন্ত্রকারীআলবদরদের নাম জানার কোন সুযোগ ছিলনা এবং তিনি আমাদের কে বলেও নাই। আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ই জুন পর্যন্ত আমাদের ঢাকায় থাকা অবস্থায় কোন আলবদরের সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই। কারন তারা গোপন কিনা ফোর্স ছিল বিধায় কারো কাছেই নিজেদের নাম প্রকাশ করেনি এমনটি যাদেরকে হত্যা করেছে তাদের সামনেও তারা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে এসেছে। (চলবে)
১১-০৯-২০১২ ইং ২:০০ মিঃ পুনরায় জেরা শুরু ঃ
১৯৭১ সালে কোন আলদরকে নাম এবং চেহেরা দিয়ে আমি সনাক্ত করতে পারি নাই। ১৯৭১ সালের ১৬ই জুন তারিখ পর্যন্ত আমি ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় ছিলাম, তখন রাজাকার বাহিনী গঠন হচ্ছে, সেই সময় পর্যন্ত কোন রাজাকার সদস্য আমি ধানমন্ডি এলাকায় দেখি নাই এবং কারও নামও আমি শুনি নাই। দেশ স্বাধীনের পরে দেশে ফিরে এসে আমি আমাদের ঐ ধানমন্ডিরবাড়িতেই ছিলাম এবং এখনও সেখানে আছি। আমার মা সুফিয়া কামালভারতে যান নাই। আমি দেশে ফেরত আসার পরে ধানমন্ডি এলাকার কোন রাজাকার, আলবদর, আলশামস সদষ্যকে দেখি নাই এবং কারও নামও শুনি নাই। দেশ স্বাধীনের অব্যবহিত পর পরই বাংলাদেশে যে সমস্ত পত্রিকা প্রকাশিত হতো সেই সমস্ত পত্রিকায় রাজাকার, আলবদর এবং আলশামস প্রধানদের নাম প্রকাশিত হয় নাই, তবে পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়েছে। আমি সর্বপ্রথম আলশামস বাহিনীর প্রধানের নাম কবে শুনেছি তার সঠিক তারিখ মনে নাই এবং তার নামও মনে নাই।আলশামস সদস্যের নাম আমি কোনদিন পত্রিকায় দেখি নাই, তবে আলবদর সদস্যের নাম দেখেছি। আমি সর্বপ্রথম আলবদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর নাম আশির দশকের প্রথম দিকে বিভিন্ন পত্রিকায় দেখেছি। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কোন পদে ছিলেন তা আমার মনে নাই, তবে শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা ১৯৭১ সালে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আমার নিকট পরিচিত ব্যক্তি ছিল না। আমি কখনও সরাসরি কোন ছাত্র রাজনীতি করি নাই। আমি ছয় দফা এবং এগার দফা আন্দোলনের বিভিন্ন মিটিং মিছিলে অংশগ্রহন করেছি। এগার দফা আন্দোলনের উদ্যেক্তা একটা বড় রাজনৈতিক জোটের মাধ্যমে হয়েছিল তার মধ্যে আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলগুলো ছিল। স্বাধীনতা পূর্বকালে পাকিস্তানে তিনটি রাজনৈতিক ধারা ছিল, একটি জাতীয়তাবাদী, একটি সমাজতান্ত্রিক এবং অন্যটি ধর্মভিত্তিক ১৯৭১ সালে ধর্মভিত্তিক দল সমূহ পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষে রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহন করেছিল তার মধ্যে জামায়াতে ইসলামী একটি দল। শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন খাজা খয়েরুদ্দিন। শান্তি কমিটি কার্য পরিচালনা করতোবিভিন্নঅঞ্চলেপাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালানোর মাধ্যমে। তারা ধর্মকে রাষ্ট্রের উপর অবস্থান দিয়েছিল এবং পাকিস্তানকে অখন্ড রাখার স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মভিরু মুসলমানরাই পাকিস্তানের অধিবাসী একথা প্রচার করতো, তদুপরি আরও প্রচার করতো যারা ভাল মুসলমান তারা বাংলাদেশ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন করতে পারে না। তারা ধর্মভিরু মানুষদেরকে মনোস্তাত্বিক চাপ প্রয়োগ করে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা বলতে যা বুঝায় তার পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করতো। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি এবং তারা শাখা সমূহ কত সদস্য বিশিষ্ট ছিল তা আমি জানি না। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি সর্বপ্রথম কত তারিখে মিটিং করেছি তা আমি বলতে পারব না। এপ্রিল মাসের কেন্দ্রীয় কমিটির কোন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা তা আমার এ মুহুর্তে মনে পড়ছে না। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য কোন দলের ছিল তা আমি এ মুহুর্তে বলতে পারব না, তবে তারা মুসলিম লীগ, পিডিবি, জামায়াতে ইসলামীর ছিল তা আমার মনে আছে।
খাজা খয়রুদ্দিন কর্তৃক পরিচালিত শান্তি কমিটি ব্যতিত অন্য কোন শান্তি কমিটি ছিল কিনা তা আমি জানি না, তবে মৌলভী ফরিদ আহমদ নামে একজনের শান্তি কমিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন মর্মে পত্র পত্রিকায় দেখেছি। মৌলভী ফরিদ আহমদ সাহেব সম্ভবত পি.ডি.বি করতেন। তিনি ধানমন্ডি এলাকায় বসবাস করতেন কিনা তা আমি জানি না। ধানমন্ডি এলাকায় কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির একটি অফিস ছিল কিনা তা আমি জানি না। আমার দেশে থাকা ধানমন্ডি এলাকায় শান্তি কমিটির কোন নেতার সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই বা সে এলাকায় থাকে এমন কোন নেতার নামও শুনি নাই। খাজা খয়রুদ্দিন সাহেবের শান্তি কমিটির অফিস কোথায় ছিল তা আমি জানি না। শান্তি কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহনের প্রক্রিয়া কি ছিল তা আমরা জানি না। তৎকালীন বিভিন্ন জেলা শান্তি কমিটির প্রধান এবং তার দলীয় পরিচয় আমি জানি না।
ইউনিয়ন পর্যায়ে কিছু কিছু ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শান্তি কমিটির প্রধান করা হয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কয়টি সশস্ত্র অপারেশনে শান্তি কমিটি অংশ গ্রহন করেছিল সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট সংখ্যা আমি এ মুহুর্তে বলতে পারছি না, তবে একাধিক অপারেশনে অংশ গ্রহন করেছিল। এ সংক্রান্ত কিছু কিছু তথ্য তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট আমি প্রদান করেছি।কিছু তথ্য আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। কিছু তথ্য আমাদের সংঙগঠন আইনও শালিশ কেন্দ্রের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত এবং কিছু তথ্য পত্র পত্রিকার কাটিং থেকে প্রাপ্ত। যে সমস্ত শান্তি কমিটির সদস্যরা এই সকল অপারেশনে অংশ গ্রহন করেছিল আমাদের প্রদত্ত তথ্যের মধ্যে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের নাম আছে কিনা তা আমার এ মুহুর্তে মনে পড়ছে না। শান্তি কমিটির সদস্যদের অস্ত্র সরবরাহের কোন নির্দেশ পাকিস্তান সরকার দিয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে কোন তথ্য আমার নিকট নাই। যেভাবে শান্তি কমিটি তাদের পরিচয় দিয়েছিল তাতে শান্তি কমিটি একটি বেসামরিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছিল। (চলবে)
১২-০৯-১২ পুনরায় জেরা শুরু ঃ-
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে শান্তি কমিটি যে সকল অপারেশনে থাকতো সেই সকল অপারেশনে ক্ষতিগ্রস্থ কোন ব্যাক্তি বা পরিবারের নাম আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট সরবরাহ করি নাই। পাকিস্তানী আর্মির যে অফিসারের নেতৃত্বে এই অপারেশনগুলি পরিচালিত হয়েছে তার নামও আমি তদন্তকরী কর্মকর্তার নিকট প্রদান করি নাই। কারণ তদন্তাকরী কর্মকর্তা তদন্ত করে উক্ত নাম সংগ্রহ করার কথা। কোন এলাকায় কত তারিখে কোন ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তৎমের্ম আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট কোন তথ্য সরবরাহ করি নাই। কারণ এই ধরনের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়,অন্যান্য ঘটনার ধারাবাহিকতায় এ সমস্ত ঘটনাগুলি ঘটেছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করে সেগুলি বের করবেন সেজন্য আমি স্থানও তারিখ উল্লেখ করি নাই। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা কবে, কোথায় হয়েছিল একথা বলা সম্ভব নয়, কারণ এধরণের গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা জনগনকে জানিয়ে করা হয়না, তবে আলবদর বাহিনীর কর্তৃক সংঘটিত গুপ্তহত্যার ব্যাপারে যেহেতু আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী এবং তিনিই জামায়াত ইসলামীর নেতা ছিলেন এাবং গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামীর আমির থাকায় তার অনুমোদন নিয়েই এই ধরনের হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল এবং তিনি এর দায় দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না। জামায়াত ইসলামীর কোন সভায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল সেটা বলা সম্ভব নয়। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব কবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের অনুমোদন দিয়েছিলেন তৎমর্মে কোন প্রমান্য তথ্য আমার জানামতে কোথাও নেই। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব বুদ্ধিজীবী হত্যাকন্ডের অনুমোদন দিয়েছিলেন তৎমর্মে কোন প্রমান্য তথ্য আমার নিকট নাই। তবে এ ধরণের সংগঠনের প্রধন হিসাবে তার সংগঠনের নেতা কর্মীদের কর্তৃক সংঘটিত কোন কাজ তার অনুমোদন ব্যতীত হওয়া সম্ভব নয়, তদুপরি এমন কিছু দেখা যায় না যে, যারা এসব কাজ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যাবস্থা তিনি গ্রহন করেছেন, অতএব নিয়ম অনুযায়ী সংগঠনের প্রধানের উপর এ ধরনের কার্যের দায় দায়িত্ব বর্তায়। রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং শান্তি কমিটি কাঠামোগত ভাবে জামায়াতে ইসলামীর অংগ সংগঠন বলে ধরে নেয়া যায় না, তবে এই সংগঠন সমূহ প্রতিষ্ঠান এবং কর্মপ্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকাই ছিল মূখ্য। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির প্রধান এবং সদস্য সচিব জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ছিলেন কিনা সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধরনা নাই, তবে তাদের কর্মপদ্ধতি এবং গঠন সম্পর্কে গোলাম আযমের মুখ থেকেই আমরা পত্র পত্রিকায় দেখেছি এবং তিনি শান্তি কমিটির মিছিলেও নেতৃত্ব দিয়ে অংশগ্রহন করেছেন। শান্তি কমিটি গঠনের আহবান জানিয়ে অধ্যাপক গোলাম আযম বিবৃতি দিয়েছিলেন এই মর্মে ১৯৭১ সালের ৫ এবং ৭ এপ্রিলে পূর্বদেশ, দৈনিক আযাদ পত্রিকায় কাটিং তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট প্রদান করা হয়েছে। অধ্যাপক গোলাম আযম শান্তি কমিটির যে মিছিলে নেতৃত্বে দিয়ে অংশগ্রহন করেছিলেন সেই মিছিলে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির আহব্বায়ক ও সদস্য সচিব ছিলেন কি না তা আমি বলতে পারি না, কারণ আমি তাদেরকে চিনি না, আমি যে মিছিলের কথা বলেছি সেই মিছিলের বিষয় আমি পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। সেই পত্রিকায় আমি ঐ মিছিলের খবর পড়েছি। আমি গোলাম আযমের নাম খোজাঁর জন্য খবর পড়তাম না, খবরের প্রসঙ্গে যখন তার নাম আসতো তখন সেটা লক্ষ্য করতাম। এ খবরে অধ্যাপক গোলাম আযমের নাম ছাড়া ও অন্য কারো নাম থাকতে পারে তবে আমার এ মূহূর্তে মনে পড়ছে না। শান্তি কমিটির কোন অধ:স্তন শাখাকে বাতিল করার কোন ক্ষমতা এককভাবে গোলাম আযম সাহেবের ছিল কি না সে সম্পর্কে আমার ধারনা নাই। শান্তি কমিটির কোন সদস্যদের দ্বারা বা অধ:স্তন কোন শান্তি কমিটি কর্তৃক কোন সংগঠিত অপরাধের বিচার চেয়ে বা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ চেয়ে বা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির বা অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের নিকট অভিযোগ আনা হয়েছিল এমন কোন প্রামান্য তথ্য আমার চোখে পড়ে নাই। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন সদস্যকে অপসারনের কোন ক্ষমতা অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের ছিল কি না তা আমার জানা নাই। রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর কোন সদস্যকে বরখাস্ত কারার বা শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের ছিল কি না তা আমার জানা নাই। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের বিষয়ে অনেক মামলা হয়েছিল তবে সংখ্যা ৫০ টি কি না তা আমি বলতে পারব না। শহিদুল্লাহ কায়ছার, মুনির চৌধুরী, ডা: আলিম নৌধুরী হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তিনটি পৃথক মামলা হয়েছিল। শহিদুল্লাহ কায়ছার সাহেব হত্যাকান্ড সম্পর্কিত যে মামলাটি হয়েছিল তাতে অভিযুক্তের নাম ছিল খালেক মজুমদার। তিনি জামায়াতে ইসলামীর নেতা ছিলেন এবং তাকে আলবদর হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। উল্লেখিত মামলায় নি¤œ আদালতে শাস্তি প্রদানের পরে উচ্চ আদালতে দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল এবং সেই আপিলে খালেক মাজুমদার সাহেব খালাস পেয়েছিলেন এবং ঐ রায়ে উল্লেখ আছে যে, রাষ্ট্রপক্ষ তাকে আলবদরের সদস্য প্রমানে ব্যর্থ হয়েছেন। উল্লেখিত তিনটি মামলাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যান্য মামলা সমূহে অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবকে উল্লেখিত হত্যার পরিকল্পনা কারী বা অন্য কোন ভাবে আসামী করা হয় নাই, কারণ সেগুলো একক ভাবে হত্যা মামলা হিসাবে দাঁড় করানো হয়েছিল এবং আজকে আমার যে স্বাক্ষ্য সেটা কোন একক হত্যা মামলায় প্রেক্ষিতে নয় সামগ্রিকভাবে ইহা ১৯৭১ সালের গনহত্যা সময়ে অধ্যাপক গোলাম আযম ভূমিকা নিয়ে।
১৯৭১ সালের সংঘটিত ঘটনার প্রেক্ষিতে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৭২ সালে দুটি মামলা পয়েছিল। উল্লেখিত মামলা দুইটি তার বিরুদ্ধে কমপ্লিসিটির (সম্পৃক্ততা) অভিযোগ ছিল। এ মামলা দুইটির ব্যপারে পরবর্র্তীতে আমি আর খবর রাখি নাই ফলে অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছিল কিনা তা আমি জানিনা। বুদ্ধিজীবী হত্যকান্ডের বিষয়ে ১৯৭১ সালে বিজয়ের পর পরই একটি সরকারি এবং একটি বেসরকারী তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল কিনা তা আমি বলতে পরলেও আমার মনে আছে ঐ সময়ে সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে এ ব্যপারে নানা উদ্যেগ নেয়া হয়েছিল তাহা কতদূর পৌছেছে সে সম্পর্কে আমি এ পর্যায়ে বলতে পারছিনা, তবে এই জনমতের চাপে ১৯৭৩ সালে বর্তমান আইনটি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন, ১৯৭৩ প্রনীত হয়।
জহির রায়হান সাহেব বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনেরজন্য অনেক কিছুই করেছিলেন এবং একটি নাগরিক কমিটিও করেছিলেন। এই নাগরিক কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্যের নাম আমি বলতে পারব না তবে শহীদ শহীদুল্লাহ কায়ছারের স্ত্রী পান্না কায়সার এ ব্যাপারে আমার মায়ের সংগে যোগাযোগ রাখতেন। বিজয় অর্জনের পরে দালাল আইনে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ গর্ভণর মালেক সাহেবের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তবে বিচার শেষ হয়েছিল কিনা তা আমি জানিনা। দালাল আইনে বিচার না করে জেনেভ কনভেনশন অনুযায়ী বিচার করার জন্য মালেক সাহেব কোন আবেদন জানিয়েছিলেন কিনা তা আমার জানা নাই। মালেক সাহেবের দালাল আইনে বিচারের বিরোধীতা করে কেউ কোন বিবৃতি দিয়েছিল কিনা তা আমি জানিনা। শহিদুল হক মামা নামে কোন ব্যক্তিকে আমি চিনি না। বাংলাদেশ টেলিভেশন থেকে প্রচারিত রনাঙ্গনের দিনগুলি নামে ধারাবাহিক যে অনুষ্ঠান তা সম্পর্কে আমি জেনেছি, তবে সময়ের অভাবে দেখার সুযোগ আমার হয় নাই। নাসির উদ্দিন ইউসুফ সাহেবের সংগে আমার পরিচয় আছে। তিনি ঐ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলেও মিরপুর ১৯৭২ সালের ৩১শে জানুয়ারী তারিখে মুক্ত হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে তারিখ আমার নির্দিষ্ট মনে নাই। তবে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পরও বাংলাদেশ কিছু কিছু পকেট হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের দখলে ছিল এবং আস্তে আস্তে সেগুলি দখল মুক্ত হয়। পাকিস্তানের একজন প্রাক্তনমন্ত্রীর বাড়ি থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পরিকল্পনার নথিপত্র পাওয়া গিয়েছিল, তবে কার তথ্য মতে উহা পাওয়া গিয়েছিল তাহা আমার এখন মনে নাই। অধ্যাপক মুনির চৌধুরী সাহেব ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সংহতির পক্ষে অনেকের সংগে বিবৃতির স্বাক্ষর করেছিলেন এটা আমার জানা আছে। ১৯৭১ সালে ২২ নভেম্বর পরে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হয়তো ছিলেন না। কারণ আমি জানি ১লা ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের সংগে দেখা করে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন এই মর্মে যে, মুক্তি বাহিনীকে নির্মূল করতে রাজাকাররাই যথেষ্ট। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের যে অঞ্চলে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ট ছিল সেখান থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমারাজাত্রিদিব রায় এম,এন,এ নির্বচিত হয়েছিলেন। ঐ সময় বৌদ্ধ ধর্মগুরু ছিলেন বিশুনান্দ মহাথেরু। উল্লেখিত দুই ব্যক্তি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষে কাজ করেছিলেন। (চলবে)
১৩-০৯-২০১২ ইং পূনরায় জেরা শুরু ঃ
ইহা সত্য যে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নূরুল আমিনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল এবং সেই মন্ত্রী সভায় রাজা ত্রিদিব রায় একজন মন্ত্রী ছিলেন। তবে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই কারন যে কোন মুক্তিসংগ্রামে আক্রমন কারী পক্ষ যাদের উপর আক্রমন করেছে তাদের মধ্যে কিছু লোককে দেখানোর জন্য বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়ে সামনে রাখে কারণ তারা মানুষকে ধোকা দেওয়ার চেষ্টা করে যাতে মানুষের কাছে এ ধরনের গণহত্যা বা এথনিককিনজিং এর কথা প্রকাশ না পায়। এটা আমার মনগড়া বক্তব্য নয়, স্বাধীনতার পরবর্তী বিভিন্ন বইয়ে একথা না থাকতে পারে, আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে তৎকালীন ঘটনাসমূহের বিশ্লেষন দিয়েই আমি একথা বলেছি। ইহা সত্য হতে পারে যে, তৎকালীন নূরুল আমিনের মন্ত্রী সভায় জামায়াতে ইসলামীর কোন সদস্য ছিল না। অংশুপ্রু চৌধুরীও বৌদ্ধদের নেতা ছিলেন এবং সেই নির্বাচনে এম.পি.এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ও ডাঃ মালেক মন্ত্রী সভায় একজন সদস্য ছিলেন। উনারা ঐ এলাকার জনগনের প্রতিনিধিত্ব করতেন। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মহিলা সংগ্রাম পরিষদের সভানেত্রী ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল, সম্পাদিকা ছিলেন মালেকা বেগম পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরে ঐ সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নাম নিয়ে এখনও তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৬১ সালে আমার জবানবন্দীতে প্রদত্ত মূল ধারার রাজনীতি বলতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে বুঝিয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমার মা বেগম সুফিয়া কামাল, বাবা এবং বড় ভাই আমাদের ধানমন্ডির বাড়িতেই ছিলেন। আমার মা অসংখ্য পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন, তবে ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৮২, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে কিনা তা আমি বলতে পারব না। এর ভিতরে অনেকগুলি সরকারী ও অনেকগুলি বেসরকারী পদক ছিল। ‘মাহে নও’ নামক একটি মাসিক পত্রিকায় আমার মা লেখালেখি করতেন যার সম্পাদক ছিলেন কবি আব্দুল কাদির।
আমার অপর বোন যিনি আমার সঙ্গে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি জীবিত আছেন। আমার যে ভাইয়ের মাধ্যমে আমরা ইনফরমেশন পেতাম তিনি এখনও জীবিত আছেন। আমার ভাইয়ের লিখিত বিভিন্ন খবরা খবর দেওয়া চিঠিগুলো আমরা সংরক্ষন করতে পারি নাই। ঐ চিঠিগুলোতে গোলাম আযম সম্পর্কে আমার বর্ণিত মতে কোন বক্তব্য না থাকায় আমি ইচ্ছাকৃতভাবে উহা গোপন করেছি, ইহা সত্য নহে। আমি আইন ও শালিশ কেন্দ্রের শীর্ষ নির্বাহী। আমি ওখান থেকে মাসিক সম্মানি পাই। ১৯৮৪ সালে আমি সিলেটে থাকতাম এবং ওখানে ফ্রিল্যান্স কনসালটেন্সি করতাম। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আমি সিলেটে ছিলাম। ঐ সময়ে আমি উল্লেখিত কাজ করতাম। আমার ওকালতিতে আমার সিনিয়র ছিলেন জে.এন.দেব। একটি সনদ পাওয়ার জন্য যতদিন কোর্টে যাওয়া প্রয়োজন আমি ততদিনই কোর্টে গিয়েছি, লাইসেন্স পাওয়ার জন্যে ৬ মাস কোর্টে যেতে হয়। আমি সিভিল প্রাকটিস করি। আমার এখনও সিলেট বারের সদস্য পদ আছে, তবে আমি কোর্টে যাইনি। আমি আমার বার কাউন্সিলে সনদ পাওয়ার জন্য যে এফিডেভিট জমা দিয়েছি সেখানে আমি কোন পেশায় নিয়োজিত নই মর্মে উল্লেখ করেছি। সেখানে আমি বলেছি যে, আমার সিনিয়রের সঙ্গে ফৌজদারী মামলা পরিচালনা করেছি। আমি জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র পড়ি নাই। ঐ সংগঠনের সদস্যপদ পাওয়া বা বাতিল হওয়ার কোন নিয়মাবলী আমি জানি না। আমার জবানবন্দীতে প্রদত্ত বক্তব্য “পত্র পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হতো” এখানে পত্রিকা বলতে আমি তৎকালীন পূর্বদেশ এবং দৈনিক আজাদ কে বুঝিয়েছি। ১৯৭১ সালের ৫ই এপ্রিল এবং ৭ই এপ্রিল তারিখে ঐ পত্রিকাগুলিতে খবর প্রচারিত হয়েছিল। ঐ পত্রিকাগুলোতে আমার বর্ণিত মতে গোলাম আযম সাহেবের ভূমিকা সম্পর্কে কোন বক্তব্য নাই, ইহা সত্য নহে। ঐ তারিখ সমূহের দৈনিক আজাদ পত্রিকায় এ ধরনের কোন খবরও নাই, ইহা সত্য নহে। ১৯৭১ সালের ৬ই এপ্রিল তারিখে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় যে বক্তব্য এসেছিল তাতে পি.ডি.পি’র নূরুল আমিন সাহেবের নেতৃত্বে খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের সাথে সাক্ষাত করে এবং দেশের স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য সাহায্য সহযোগিতার কথা বলা হয় এবং সেখানে গোলাম আযমের নেতৃত্বের কথা বলা হয় নাই, এর উত্তরে সাক্ষী বলেন যে, ইহা সত্য হতেও পারে, তবে ঐ সময়ে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় গোলাম আযমের নেতৃত্বে কথা বলা হয়েছে এবং শান্তি কমিটি গঠনের ব্যপারে তার মূখ্য ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখেছি যে, মিছিল, মিটিং হয়েছে বক্তৃতা দেয়া হয়েছে এমনকি গোলাম আযম সাহেবের দসতখত সম্বলিত এক টাকা মূল্যমানের টিকিটও বিক্রয় হয়েছে। শান্তি কমিটি গঠনের ব্যাপারে গোলাম আযম মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন একথাগুলি ১৯৭১ সালের ৫ ও ৭ই এপ্রিলের দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় আছে। নূরুল আমিনের নেতৃত্বে সামরিক আইন প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করার পরে ১১ই এপ্রিল, ১৯৭১ এর দৈনিক আজাম পত্রিকায় শান্তি কমিটি গঠিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়, তবে ১১ই এপ্রিল, ১৯৭১ এর পত্রিকায় কিনা তা আমি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না। শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন মুসলীম লীগ নেতা খাজা খয়রুদ্দিন। সেই শান্তি কমিটি ১৪০ সদস্য বিশিষ্ট ছিল কিনা তা আমার জানা নাই। এই কমিটির ডিকারেশন লেখা ছিল “নাগরিকদের প্রত্যহিক জীবনে স্বত্তর স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং জনমতে অহেতুক ও ভিত্তিহীন শংকা দূর করার উদ্দেশ্যে এই কমিটি গঠন করা হয়” ইহা সত্য তবে যে সময়ে জনগনকে হত্যা করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং লোকদেরকে নির্বিচারে হত্যা উচ্ছেদ করা হচ্ছে, সেই সময়ে এই ঘটনাগুলোকে অহেতুক ভিত্তিহীন শংকা বলে প্রকাশ করে তারা নিজেরাই নিজেদের দোষ সমূহকে ঢাকার অপচেষ্টা করে তাদের মানসিকতা এবং অপরাধের প্রতি তাদের সমর্থনকে তারাই প্রকাশ করেছে। এই ব্যাখ্যাটি আমার রাজনৈতিক অবস্থান এবং জামায়াতে ইসলামী গোলাম আযমের প্রতি আমার বিদ্বেষ প্রসূত, ইহা সত্য নহে। গোলাম আযমের বক্তব্য বা বিবৃতিতে মুক্তিযোদ্ধারাই দুষ্কৃতিকারী এই ধরনের বক্তব্য সম্বলিত বক্তৃতা বা লিফলেট বা পেপার কাটিং আমার নিকট আছে, তদন্তকারী কর্মকর্তাকেও আমি দিয়েছি তবে অদ্য ট্রাইব্যুনালে আনি নাই। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চাপ সৃষ্টি করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে কাউকে শান্তি কমিটিতে যোগদান করার ব্যাপারে বক্তব্য সম্বলিত কাগজপত্র আমার নিকট আছে, তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দিয়েছি তবে অদ্য ট্রাইব্যুনালে আনি নাই। যুদ্ধকালীন সময়ে অত্র বক্তব্য সম্বলিত দেশী বা বিদেশী কোন পত্রিকা আমার সংগ্রহে আপাততঃ নাই।
আমার জবানবন্দীতে প্রদত্ত বক্তব্য “গোপন কিলার ফোর্স তৈরি করার উদ্যেগ নিয়েছে....তারা গোপনে কাজগুলো করবে মর্মে জেনেছি” মর্মে যে বক্তব্য আমি দিয়েছি সে ব্যাপারে দেশী বা বিদেশী কোন পত্র পত্রিকায় যুদ্ধকালীন সময় খবর প্রকাশিত হয়েছিল কিনা তা আমি বলতে পারব না, তবে এই খবরগুলো যে সব মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে আসতেন এবং যারা আবার ভারতে ফিরে যেতেন তাদের মধ্যে অনেক গোয়েন্দাও ছিল তাদের নিকট থেকে আমরা জেনেছিলাম। এই খবরগুলি আমরা আগষ্টের শেষ দিকে, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে পেয়েছিলাম। এই খবরগুলি অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে শুনেছি, তাদের মধ্যে খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দার এরাই মূখ্য ছিলেন, তারা আমাদেরকে সব সময় দেশের অভ্যন্তরের কথা আমাদের আত্মীয় স্বজনের কথা বলতে গিয়ে একথাগুলি বলেছিলেন। আমরা যখন জুন মাসে ভারত যাই জনাব খালেদ মোশাররফ সাহেব তার আগে থেকেই সেক্টর ২ এর কমান্ডার ছিলেন। জামায়াত ইসলামী একটি রাজনৈতিক সংগঠন। এর জন্ম অবিভক্ত ভারতে হয়েছে। আমরা শুনেছি যে, পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির ছিলেন গোলাম আযম। তিনি কবে থেকে আমিরের দায়িত্ব নিয়েছেন তা আমি বলতে পারব না। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠিত শান্তি কমিটির রাজাকার, আলবদর, আলশামস সবগুলি এপ্রিল ১৯৭১ বা তার পরে হয়েছে। গঠনতন্ত্র মতে শান্তি কমিটি ছিল সামাজিক শক্তি এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামস ছিল সহায়ক (ধীঁরষরধৎু) বাহিনী। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এগুলি অস্তিত্যহীন হয়ে যায়। গোলাম আযম সাহেব ঐ সময়ে কোন কমিটি বা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন না, তবে তার অধীনস্থ মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আলবদর প্রধান ছিলেন এবং উল্লেখিত চারটি সংগঠন তৈরিতে গোলাম আযম সাহেবই মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন, হিটলার নাৎসি বাহিনীর প্রধান ছিলেন না, এমনকি সদস্যও ছিলেন না, এমনকি সদস্যও ছিলেন না কিন্তু তিনি ছিলেন ন্যাৎসী বাাহিনীর অত্যাচারের মূল নায়ক তেমনি যদিও গোলাম আযম সাহেব উল্লেখিত চারটি সংগঠনের প্রাতিষ্ঠানিক মূখ্য নেতা ছিলেন না কিন্তু এই সবগুলি সংগঠন তার নির্দেশে ও নেতৃত্বে পরিচালিত হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যা করেছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমি মনে করি গোলাম আযম সাহেব সেরকমই করেছেন। হিটলার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমায় ছিলে ইয়াহিয়া খান এবং তৎকালীন গভর্নর ছিলেন টিক্কা খান। হিটলারের অবস্থানে ১৯৭১ সালে গোলাম আযম সাহেব ক্ষমতাবান ছিলেন না। হিটলারের সঙ্গে গোলাম আযম সাহেবের তুলনা করা অস্বাভাবিক এবং উদ্দেশ্যমূলক, ইহা সত্য নহে। (চলবে)
১৩-০৯-১২ ইং- ২.০০ ঘটিকা, পূনরায় জেরা শুরু ঃ
স্বাধীনতার পরে স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে যত ইতিহাস লেখা হয়েছে, যত বই লেখা হয়েছে সব জায়গায় ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, গোলাম আযম সাহেবকে সঙ্গে নয়, আমি গোলাম আযম সাহেবের নাম উল্লেখ করে ইতিহাস বিকৃতি করছি, ইহা সত্য নহে, আমি গোলাম আযম সাহেবকে ঐ দুইজনের সঙ্গে যুক্ত করছি। ইহা সত্য নহে যে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর উচ্চতম পর্যায় থেকে গোলাম আযমের প্রশংসা করে কোন বিবৃতি দেয়া হয় নাই। এই প্রশংসা সম্বলিত বিবৃতি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে প্রদান করেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব অঞ্চলীয় কমান্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালেক লিখিত ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইটি আমি পড়েছি। উনি কোন পাকিস্তানপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সামরিক বাহিনীর তৎপরতায় প্রভাব থাকায় কথা স্বীকার করেন নাই, ইহা তাহার নিজস্ব মতামত। হামিদুল্লাহ খান সাহেবের বাসায় কাজের ছেলেটিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা আমি আমার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছি তাকে যুদ্ধকালীন অবস্থায় এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকলেও খোঁজ করা হয়েছে কিন্তু তার কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। সেই ছেলেটির নাম আমার এ মুহুর্তে মনে পড়ছে না। ১৯৭১ সালে দেশী, বিদেশী পত্রিকায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর নেতা হিসাবে গোলাম আযমের নাম আসে নাই ইহা সত্য, তবে তাদের কার্যকলাপের সঙ্গে তার নাম এসেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের পত্র-পত্রিকায় আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের অভিযান ও কার্যাবলীর খবরের সঙ্গে গোলাম আযম সাহেবের নাম এসেছে এই ধরনের ঐ সময়কার কোন পত্র পত্রিকা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট দিই নাই।
একটি সামরিক বাহিনীর সহায়ক বাহিনী যখন কোন অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে তখন তার কৌশলগত দিক এবং পরিকল্পনা হয় তারা নিজেরা তৈরি করে সামরিক বাহিনী অনুমোদন নেয় অথবা সামরিক বাহিনীর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালনা করে নিয়ম মত তাই হয় (প্রসিকিউশনেরে আপত্তি সহকারে), তবে নিয়ম মত ঐ তিন বাহিনী কাজ করছে তা তৎকালীন ঘটনা সমূহ দেখলে মনে হয় না। রাজাকার বাহিনী গেজেটের মাধ্যমে সরকারী তত্ত্বাবধানে আসার আগে তার প্রধান কে ছিলেন তার নাম আমার মনে নাই। নারী পূনর্বাসন কেন্দ্রে যারা এসেছিলেন তাদের অনেকের নাম আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছি। আমি যে ১৯ জন অত্যাচারিত নারীর সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম তাদের নাম আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট দিতে পারি নাই, কারন সেগুলি যেখানে ছিল সেখান থেকে ১৯৭৫ সালের পর নষ্ট করা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট তারিখ বা সাল বলতে পারব না। এই নষ্ট করার ব্যাপারে অভিযোগ করার দায়িত্ব নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষের। তারা তা করেছে কিনা তা আমার জানা নাই। আমার জবানবন্দীতে উল্লেখিত বরিশালের যে ঘটনা অর্থাৎ সমবেত জনগনের উপর হিলকপ্টার ও লঞ্চ থেকে গুলি বর্ষনের ঘটনা খুব সম্ভবত মে মাসের ১০ তারিখে সংঘটিত হয়েছিল এবং সেই ঘটনায় আমাদের বাড়ির কেয়ার টেকার আব্দুল মালেক সরদার, যাকে আমরা কাকা বলে ডাকতাম তিনি নিহত হন। ঐ ঘটনায় বহু প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে কেউ বর্তমানে জীবিত আছেন কিনা তা আমার জানা নাই। আক্রমনকারী হেলিকপ্টার ও লঞ্চ এর নিয়ন্ত্রকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিকট ছিল বলে আমরা জেনেছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর চলাচল রোধকল্পে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় ব্রীজ কালভার্ট ধ্বংস করেছে। অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খানের সঙ্গে বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে শুধুমাত্র জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাম শোনা যায় ইহা সত্য, ইহাতেও মনে হয় ঐ সময় বেসামরিক ব্যক্তিরাও জড়িত ছিল।
ইহা সত্য নহে যে, আমার মা ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম পরিষদ বলে একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যারা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছিল মূল ধারার রাজনীতির আন্দোলনের সাথে, বা মার্চ মাসে যখন থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে আমরা সাংগঠনিকভাবে অংশগ্রহন করেছিলাম এবং সেই সময়ে সে সমস্ত সভা, সমিতি ও সমাবেশ হচ্ছিল তাতে অংশ গ্রহন করেছি সক্রিয়ভাবে। ৭ই মার্চে তদানিন্তন রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায়ও উপস্থিত থেকে অংশগ্রহন করেছি এবং “আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এই বানীতে উজ্জিবীত হয়েছিলাম, বা অন্যদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক কর্মী কিংবা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উজ্জিবীত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর নানা রকম হামলাও চালানো হচ্ছিল, বা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাত্রি ১২-০০ টার দিকে আমার ভগ্নিপতি চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোনে আমাদের নিকট জানতে চান যে, ঢাকার অবস্থা কেমন এবং শুধু এটুকুই বলতে পারেন যে, অবস্থা ভাল নয়, একথা বলার পর পরই টেলিফোনের লাইন কেটে যায়, বা আমাদের পাশের দোতলা বাড়ির একজন জানালেন যে, তাদের বাড়ির ছাদ থেকে কোনাকোনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আগুনের হলকা দেখা যাচ্ছে এবং আমাদের বাড়ির সামনে একটি নির্মানাধীন বাড়ির ছাদে একটি কালো পতাকা উড়ছিল এবং সেই বাড়ির দারোয়ানকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। আমাদের বাড়ির সামনে পানির লেকের উপর একটি ব্রীজ আছে এবং ঐ ব্রীজের উপর দিয়ে মানুষের দৌড়াদৌড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছিল এবং ঐ ব্রীজের উপর একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, বা সাংবাদিক শহিদুল্লাহ কায়ছার সংবাদ পাঠালেন যে, বা আস্তে আস্তে আমরা জানতে পারলাম যে, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, রাজশাহী সর্বত্রই একই ধরনের হত্যাকান্ড চলছে এবং পুলিশের তৎকালীন বড় কর্মকর্তা মামুন মাহমুদ রাজশাহীতে ছিলেন তাকেও হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় কর্মরত বাঙ্গালী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণকে হত্যা করা হয়েছে, বা ২৭শে মার্চ সকাল বেলায় যখন আমরা রাস্তা পার হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তা দিয়ে হেটে যাই আমি নিজে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে মালামাল নিয়ে ট্রাকে তুলছিল, বা তারা কিছু গোপন কিলার ফোর্স তৈরি করার উদ্যেগ নিয়েছে এবং আলবদর, আলশামস নামে দুটি বাহিনী ঐ উদ্দেশ্যে গঠন করা হয় এবং তারা খুব গোপনে একাজগুলি করবে মর্মে জেনেছিলাম, বা নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, রায়ের বাজারের কাছে হিন্দু অধ্যূষিত এলাকায় একটি অপারেশনে তাকে যেতে হবে, বা সেই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন খালেদ মোশাররফ সাহেব। তার সঙ্গে আমরা দেখা করলাম, বা সেখানে আমাদের সঙ্গে এই কর্মকান্ডে জড়িত হন ডাঃ জাফরউল্লা চৌধুরী, ডাঃ মোবিন, ডাঃ কামারুজ্জামান প্রমুখ যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অত্যন্ত সম্মানিত ও সুপরিচিত। পরে ডাঃ ক্যাপ্টেন সিতারা এসে আমাদের সাথে অক্টোবর মাসে যোগ দেন যিনি পরবর্তীতে বীর প্রতীক উপাধীতে ভূষিত হন, বা আমরা যেখানে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ থেকে আরও কয়েকজন মেয়ে যারা বাংলাদেশে ভিতরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করছিল এবং যোগাযোগ রাখছিল তারাও সেখানে এসে হাসপাতালে সেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজে যোগ দেন। যাদের মধ্যে প্রফেসর জাকিয়া খাতুন, আসমা, রেশমা, মিনু, অনুপমা, পদ্মা, নিলিমা, ডাঃ ডালিয়া শামসুদ্দিন উল্লেখযোগ্য, বা আমেরিকা প্রবাসী ভাইয়ের নিকট আমার মায়ের দেয়া কোড ল্যাংগুয়েজের চিঠি সমূহ যাহা আমাদের নিকট দেয়া হতো সেগুলির মাধ্যমে আমরা দেশের অভ্যন্তরের খবরাখবর পেতাম, বা শেরাটনের বোমা হামলার ঘটনা, রুমি, বদি, আলম, বাদল, চুন্নু সামাদ, আলভী গংদের বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে ঘটনা সবকিছুই আমরা নিয়মিত ঐ হাসপাতালে বসে পেতাম, বা আলশামস, রাজাকার এই বাহিনী সমূহের নেতা হিসেবে গোলাম আযম স্বাধীনতার পক্ষের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এক প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমন এর বিরোধী পক্ষের প্রতীক ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম, বা চার্চের মধ্যেও ঢুকেও তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, মন্দির গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে তাদেরকে এই অত্যাচারিত ও ধর্মান্তরিত হতে হয়েছে, বা শুধুমাত্র হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান দেরকেই একই উদ্দেশ্যে আক্রমন করা হয়েছে তা নয়, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং স্বাধীনতার পক্ষের প্রত্যেকটি মানুষের চেতনাকে আঘাত করে তাদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে, তবে বিশেষভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের চিহ্নিত করে ধর্মীয় কারণে তাদের উপর হত্যা লুন্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণ সহ বিভিন্ন অপরাধ করা হয়েছে, বা কালি মন্দির আক্রমন, শাখারী বাজার, রায়ের বাজার, হাটখোলা ওয়ারী যে সমস্ত জায়গা হিন্দু অধ্যূষিত বলে পরিচিত কারপিউ দিয়ে অগ্নিসংযোগ করা আবার একই সাথে রাজারবাগে অগনিত পুলিশ বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, একই রকমভাবে পিলখানায় রাইফেলসের সদস্যদের উপর আক্রমন করা একটি ঘৃন্য গণহত্যার উদাহরন স্থাপন করে, বা বরিশালের একটি উদাহরন দেই বাজারে সমবেত জনগোষ্ঠির উপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ করা হয়। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ দৌড়ে নদীতে ঝাপ দিতে গেছে তখন লঞ্চ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদেরকে বিপরীত দিতে থেকে গুলি করেছে। এই ধরনের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এরকম ঘটনা দেশের সর্বত্রই হয়েছিল। এই ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার কৌশল এবং সেই কৌশলকে সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে তারাও এই অপরাধের সমান ভাগিদার, বা সহযোগিতার মাস্টার মাইন্ড, বা ১৯৭১ সালের ২৩শে আগষ্ট এবং ৩১শে আগষ্ট তারিখে গোলাম আযম পাকিস্তানের লাহোর এবং হায়দারাবাদে নিজে উপস্থিত থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এইসব কর্মকান্ডকে সমর্থন দিয়েছেন এবং মক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন এবং মুক্তিবাহিনীকে নির্মূল করার আহ্বান জানিয়েছেন। লক্ষ্য করা যেতে পারে সেপ্টেম্বর মাসে যখন তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নতুন মন্ত্রী সভা গঠন করা হয় সেখানে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদেরকে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এখানে একটা প্রশ্ন পরিস্কার করা প্রয়োজন যে, শান্তি কমিটি কখনও সশস্ত্র কোন অভিযানে অংশ গ্রহন করেছে কিনা। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তারা কখনও কখনও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে তারা সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিয়েছে। রাজাকারদের কাছে অস্ত্র ছিল সেটা সকলেরই জানা আছে। আমরা আরও লক্ষ্য করি ১৯৭১ সালের ১লা ডিসেম্বর যখন মুক্তিযুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে তখনও গোলাম আযম ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাত করে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন যে, মক্তিবাহিনীকে পরাভূত করে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং তিনি দম্ভভরে একথাও বলেন যে, সে ব্যাপারে রাজাকাররাই যথেষ্ট, বা যে উপায়ে এবং যে নির্যাতন ও অত্যাচার করে এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় নাৎসী আমলেরও অনেক হত্যাকান্ড তা দেখে লজ্জিত হবে। আমরা জানি রাজাকার, শান্তি কমিটি ও আলবদর ও আলশামস এই সমস্ত বাহিনীল দার্শনিক এবং কৌশলগত পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন গোলাম আযম। এই কথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই। আমার জবানবন্দীতে উল্লেখিত বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের অত্যাচারের ব্যপারে আমি যা বলেছি তা আমি তদন্তাকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে। রাজশাহীর উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা মামুন মাহমুদকে আমি চিনি, তিনি বাঙ্গালী ছিলেন, তিনি আমাদের অতিপরিচিত বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন। আমি আমার আত্মজীবনী মূলক একটি বই লিখেছি তার নাম “আত্ম কথা নিলীমার নীচে”। আমি রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা হয়েছিলাম। এই উপদেষ্টা নিয়োগ পাওয়ার আগে বেবী মওদুদ, আসাদুজ্জামান নূর, সাবের হোসেন চৌধুরী এবং মোনায়েম সরকার আমাকে টেলিফোন করে বলেছিলেন তোমার নাম নেত্রী শেখ হাসিনা উপদেষ্টা হিসাবে ১৪ দলের পক্ষ থেকে পাঠিয়েছে, যদি সিলেক্ট করে তবে তুমি না করোনা। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান এম,পি সাবের হোসেন চৌধুরী জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এটা আমাদের অফিসিয়াল যোগাযোগ। আমি আমার জবানবন্দীতে অধ্যাপক গোলাম আযমকে স্বাধীনতা বিরোধীতার প্রতীক, গণহত্যা সমর্থনের ও সহযোগিতায় মাস্টার মাইন্ড, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের দার্শনিক এবং কৌশলগত পরিকল্পনাকারী সহ তার বিরুদ্ধে জবানবন্দীতে এবং জেরার উত্তরে যে সমস্ত অভিযোগ এনেছি তাহা সম্পূর্ণ অসত্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত, ইহা সত্য নহে। আমি তার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছি ইহা সত্য নহে। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব পাকিস্তানের অখন্ডতা বিশ্বাসী হলেও তার ভূমিকা শুধুমাত্র রাজনৈতিক, ইহা সত্য নহে। (সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন