বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

দেলোয়ার শিকদার এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আলাদা ব্যক্তি বলে স্বীকার করেছে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী- শুনানীতে আইনজীবী

মেহেদী হাসান, ১৩/২/২০১৪
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল শুনানীতে তার আইনজীবী  বলেছেন, দেলোয়ার শিকদার এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যে এক ব্যক্তি নয় বরং, আলাদা ব্যক্তি তা স্বীকার করেছে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মধুসূদন ঘরামী। এ সাক্ষী জেরায় স্বীকার করেছেন দেলোয়ার শিকদার নামে পিরোজপুরে একজন কুখ্যাত রাজাকার ছিল এবং স্বাধীনতার পর  মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় লোকজন মিলে পিরোজপুরে তাকে হত্যা করতে পারে।

প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে যুক্তি উপস্থাপনের মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান এ তথ্য তুলে ধরেন। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৪ নং অভিযোগ হোগলাবুনিয়া গ্রামে হিন্দু পাড়ায় আগুন দেয়া এবং শেফাল ঘরামীকে ধর্ষণ এর অভিযোগ বিষয়ে তিনি গতকাল যুক্তি পেশ করেন। যুক্তি উপস্থাপনে তাকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন।

অ্যাডভোকেট শাহজাহান  বলেন, মাওলানা সাঈদীর পিতার নাম ইউসুফ সাঈদী। আর দেলোয়ার শিকদারের পিতার নাম রসুল শিকদার। ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মধুসূদন ঘরামীকে দেলোয়ার শিকদারের পিতার নাম রসুল শিকদার উল্লেখ করে নির্দিষ্টভাবে প্রশ্ন করা হয়েছিল । এর জবাবে তিনি স্বীকার করেছেন স্বাধীনতার পর সে পিরোজপুরে নিহত হয়ে থাকতে পারে। 

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ হল পূর্বে তার নাম ছিল দেলোয়ার শিকদার। স্বাধীনতার পর তিনি তার নাম পরিবর্তন করে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ধারন করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষের বেশ কয়েকজন সাক্ষীও  একই অভিযোগ করেছেন। তারা বলেছেন বর্তমানে যে সাঈদীর বিচার হচ্ছে তিনিই ছিলেন ১৯৭১ সালে দেলোয়ার শিকদার।

অপর দিকে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালে তথ্য প্রমান  উপস্থাপন করে প্রমানের চেষ্টা করেছেন দেলোয়ার শিকদার নামে পিরোজপুরে একজন কুখ্যাত রাজাকার ছিল। তবে সে বর্তমানে আর বেঁচে নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার অপকর্মের কারনে যুদ্ধের পর সে জনরোষের মুখে পড়ে এবং মুক্তিযোদ্ধা ও জনতা মিলে তাকে মেরে ফেলে। নিহত সেই রাজাকার দেলোয়ার শিকদারের পিতার নাম রসুল শিকদার। আর  মাওলানা সাঈদীর পিতার নাম ইউসুফ সাঈদী এবং মাওলানা সাঈদীর ১৯৫৭ সালের দাখিল সনদেও তা লেখা রয়েছে। ১৯৫৭ সালের দাখিল সনদে মাওলানার নামও  দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী মর্মে লেখা রয়েছে। কাজেই মাওলানা সাঈদী জন্মের পর থেকেই এ নামে পরিচিত এবং তিনি কখনো দেলোয়ার শিকদার ছিলেননা।

ট্রাইব্যুনালে  রাষ্ট্রপক্ষের সবচেয়ে প্রবীণ ৮১ বছর বয়স্ক সাক্ষী মধুসূদন ঘরামীও জেরায় স্বীকার করেন দেলোয়ার শিকদার নামে পিরোজপুরে একজন রাজাকার ছিল।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৪ নং অভিযোগ শেফালী ঘরামীকে ধর্ষণ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন তার স্বামী মধুসূদন ঘরামী। গতকাল আপিল বেঞ্চে এ ১৪ নং অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপনের সময় মধুসূদন ঘরামীর প্রসঙ্গ আসে।

আজ যুক্তি উপস্থাপনের শুরুতে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান প্রথমে ট্রাইব্যুনালের রায় থেকে ১৪ নং অভিযোগ পড়ে শোনান। এতে বলা হয়েছে মাওলানা সাঈদীর নেতৃত্বে হোগলাবুনিয়া গ্রামে হিন্দু পাড়ায় আক্রমন এবং এসময় শেফালী ঘরামী নামে একজন মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়।

অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, মাওলানা সাঈদী শেফালী ঘরামীকে ধর্ষণ করেননি। তখন একজন বিচারপতি প্রশ্ন করেন, সে সেখানে ছিল কি-না। আরেকজন বিচারপতি বলেন, অভিযোগ হল আসামীর নেতৃত্বে তারা সেখানে গেছে। এসময় একজন বিচারপতি রায় থেকে একটি লাইন পড়ে শোনাতে বলেন অ্যাডভোকেট শাহজাহানকে যেখানে লেখা রয়েছে, তার টিমের সদস্যরা ঘরে আগুন দিয়েছে। অ্যাডভোকেট শাহজাহান লাইনটি পড়ে শোনান।

এরপর অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ট্রাইব্যুনালের রায়ে ১৪ নং অভিযোগে  মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের ১, ২, ৩ এবং     ২৩ নং সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। কিন্তু সাক্ষ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় রাষ্ট্রপক্ষের ১, ২ এবং তিন নং সাক্ষী হোগলাবুনিয়া গ্রামে  হিন্দু পাড়ায় আগুন দেয়া এবং শেফালী ঘরামীকে ধর্ষণ করা বিষয়ে  একটি কথাও বলেনি।

অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ২৩ নং সাক্ষী মধুসূদন ঘরামী শেফালী ঘরামীর স্বামী এবং তিনি এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এরপর তিনি মধুসূদন ঘরামীর জবানবন্দী এবং জেরা থেকে পড়ে শোনান আদালতে।

মুধুসূদন ঘরামী তার জবানবন্দীতে বলেছেন, তার বড়ভাই নিকুঞ্জ ১৯৭০ সালের আগেই মারা গেছে। যখন সেনাবাহিনী নামে  এবং লুটপাট শুরু করে তার আগে মধুসূদন বিয়ে করেছেন। ফালগুন মাসে তিনি শেফালী ঘরামীকে বিয়ে করেছেন বলে জানান তার জবানবন্দীতে।
(মধূসূদন ঘরামী অসুস্থ হওয়ায় ট্রাইব্যুনালে সিকবেডে শুয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। অন্যান্য সাক্ষীরা যেভাবে নিজ থেকে ঘটনা বর্ননা করেছেন তিনি সেভাবে বলেননি। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তাকে ঘটনা বিষয়ে প্রশ্নের মাধ্যমে জবানবন্দী গ্রহণ করেছিলেন তখন।)

মধূসূদনের বাড়িতে  রাজাকার বাহিনীর সাথে আর কারা এসেছিল এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তার কাছ থেকে নির্দিষ্ট করে জানতে চাইলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন ‘আমি বাড়িতে ছিলামনা তখন। কারা এসেছিল জানিনা।  আমার স্ত্রী পরে আমাকে বলেছে তোমাকে  যে মুসলমান বানিয়েছে সে এসেছিল। ’
আরেক প্রশ্নের জবাবে মধুসূদন ঘরামী বলেন, ‘আমার স্ত্রী আমাকে আরো বলেছে যে, তাকে ধর্ষন করা হয়েছে। অসহ্য  যন্ত্রনা। আমি আর বলতে পারছিনা। আমার চিন্তা করনা। তুমি পালাও। ’

মুধসূদন ঘরামী তার জবানবন্দীতে  আরো জানান ‘আমাদের  বাড়িতে লুটপাটের চার পাঁচ মাস পরে অগ্রহায়ন মাসে আমার  স্ত্রীর  একটি  কন্যা সন্তান হয়। তার নাম সন্ধ্যা। সন্তান হবার পর আমার   স্ত্রীকে লোকজন গঞ্জনা করত। তখন আমি আমার    শ্যালক কার্তিক শিকদারকে বললাম   কি করবা? সে বলল ভারতে নিয়ে যাই। তখন আমার   স্ত্রী    ভারতে চলে যায়। তারপর আর তার সাথে দেখা হয়নি। এর পর আমি  আর বিয়ে করেননি।

মধুসূদনের জবানবন্দী থেকে এ পর্যন্ত পড়ে শোনানোর পর জেরা থেকে পড়ে শোনান অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান।  জেরা থেকে পড়ে শোনানোর শুরুতে অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং দেলোয়ার শিকদার যে এক ব্যক্তি নয় এবং আলাদা তা এ সাক্ষী স্বীকার করেছেন। তাছাড়া তিনি সাক্ষ্য দেয়ার সময় মাওলানা সাঈদীকে ডকে চিহ্নিত করতে পারেননি। তিনি বলেন, সাঈদী এবং শিকদার নাম বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে। কিন্তু আজকে এ সাক্ষীর বরাতে এ বিষয়টি যতটুকু এসেছে তা তুলে ধরতে চাই।

ট্রাইব্যুনালে জেরায় মধুসূদনকে প্রশ্ন করা হয় ‘সেকেন্দার শিকদার, দানেস মোল্লা, সৈয়দ মো: আফজাল, দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল  শিকদার এরা রাজাকার বাহিনী গঠন করে’।
জবাবে মুধসূদন ঘরামী বলেন, ‘হ্যা’।
জেরায় তাকে আবার প্রশ্ন করা হয় ‘আপনার এলাকায় আরেকজন কুখ্যাত রাজাকার ছিল মোসলেম মাওলানা?
জবাবে মধুসূদন বলেন ‘হ্যা’। 
জেরায় আরেকটি প্রশ্ন ছিল ‘রাজ্জাক রাজাকার, দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল শিকদার। এদের অত্যাচারের কারনে স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা  এবং এলাকার লোকজন মিলে এদেরকে মেরে ফেলে।’
এর জবাবে সাক্ষী বলেন,  পিরোজপুরে হতে পারে।

এ পর্যায়ে অ্যাডভোকেট শহজাহান বলেন, মাওলানা সাঈদীর পিতার নাম ইউসুফ সাঈদী । আর ট্রাইব্যুনালে জেরার সময় মধুসূদনকে   সুষ্পষ্টভাবে দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল শিকদার উল্লেখ করে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালে অত্যাচারের কারনে দেলোয়ার শিকদারকে মুক্তিযোদ্ধা এবং এলাকার লোকজন মিলে মেরে ফেলেছে।  জবাবে মধুসূদন বলেছেন দেলোয়ার শিকদারকে পিরোজপুর মেরে ফেলা হতে পারে।

এরপর অ্যাডভোকেট শাহজাহান মধূসূদনকে ট্রাইব্যুনালে  জেরার নিম্নের অংশ পড়ে শোনান  আদালতে।
আইনজীবী : আপনার স্ত্রী তো কোন মেম্বার চেয়ারম্যান, রাজাকার বা পিস কিমিটির লোকদের চিনতেননা।
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : দেলোয়ার পরে নিজেকে শিকদার পরিচয় দিত। আগে শুনিনি এখন শুনছি সাঈদী-এ কথাগুলো আপনি ট্রাইব্যুনালে বলেছেন কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীতে বলেননি।
সাক্ষী : নাও বলতে পারি।
আইনজীবী : স্ত্রী বলে, তোমাকে যে মুসলমান বানায় সে এসেছিল, তুমি পালাও। একথাও আপনি বলেননি তদন্ত  কর্মকর্তার কাছে।
সাক্ষী : স্মরন নেই।
আইনজীবী : বাজারে মসজিদে বসে মুসলমান বানায় সেকথাও বলেননি  তদন্ত  কর্মকর্তার কাছে।
সাক্ষী : মনে নেই।
আইনজীবী : আপনার নাম আলী আশরাফ আর  কৃষ্ণ বাবুর নাম আলী আকবার রাখা হয় সেকথাও বলেননি।
সাক্ষী : স্মরন নেই।
আইনজীবী : কাশেম আলী হাওলাদার ওরফে কাশেম  মাস্টার আপনার একটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলে যায় এবং সাত মাস জেল খাটে।
সাক্ষী : হ্যা।
আইনজীবী : কাশেম মাস্টার আপনার স্ত্রীকে ধর্ষন করে সে অভিযোগ আপনি করেন  এবং সে কারনে সে জেলে যায়।
সাক্ষী : সত্য নয়।
আইনজীবী : আপনার স্ত্রী শেফালী ঘরামী ভারতে চলে গেছে  আপনার সাথে বিরোধের কারনে।
সাক্ষী : সত্য নয়।
আইনজীবী : ২০১০ সালের পর থেকে আপনি  এবং আপনার বৌদী বয়স্ক ভাতা পান।
সাক্ষী : হ্যা।
আইনজীবী : আপনারা দুজন একান্নে/একপাকে খান।
সাক্ষী : হ্যা।
আইনজীবী : সাক্ষী দেয়ার জন্য কতদিন আগে ঢাকায় আসলেন?
সাক্ষী : ১৮/২০ দিন আগে অনুমান।
আইনজীবী : আপনি সুস্থ  অবস্থায়  ঢাকায় আসেন। এই মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য চাপে পড়ে আপনি অসুস্থ  হয়ে পড়েন।
সাক্ষী : প্রায় সুস্থ  অবস্থায় ঢাকায় আসি। পরে অসুস্থ  হই।

আজ যুক্তি উপস্থাপনের শুরুতে অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, আমি জ্বরে আক্রান্ত।  শুনানীতে অংশ নিতে কষ্ট হচ্ছে।  শুনানী মুলতবি করলে ভাল হয়। প্রধান বিচারপতি বলেন, শুরু করেন। তারপর দেখব। এরপর বিরতি পর্যন্ত যুক্তি উপস্থাপনের পর অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, আগামী রোববার আবার বলতে চাই। আজ মুলতবি করা হোক। আদালত  আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ এ মামলার কার্যক্রম মুলতবি ঘোষনা করেন।

রাষ্ট্রপক্ষে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিতি ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মিঠু, তারিকুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ।







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন